৮. আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকার
আওরঙ্গজেবের পর
স্রষ্টা ছাড়া আর কারো নেই ভবিষ্যতের জ্ঞান;
যদি কেউ বলে সে তা জানে, তবে তাকে বিশ্বাস করো না!
–বাবা মুসাফির (মৃত্যু ১৭১৪) নকশবন্দিয়া সুফি দরবেশ, আওরঙ্গজেবের ছেলেদের মধ্যকার উত্তরাধিকার লড়াই নিয়ে মন্তব্য
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে । আওরঙ্গজেব-পরবর্তী সময়ে মোগলদের পতন যত দ্রুত বা সামগ্রিক হয়েছিল বলে যে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে, সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি মোটেই তেমন ছিল না। তবে এমনকি অতি সূক্ষ্ম তারতম্যকে অনুমোদন করা হলেও বলতে হবে, আওরঙ্গজেবের পর মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমাগত পতন বেশ অবাক করা ।
সম্রাটের তিন জীবিত ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে উত্তারাধিকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার দ্বিতীয় ছেলে মোয়াজ্জেম যুদ্ধে অপর দু’জনকে- আযম ও কাম বখশ- হত্যা করেন। তিনি বাহাদুর শাহ নাম ধারণ করে মোগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। উত্তরাধিকার লড়াই ছিল প্রত্যাশিত এবং তা সাধারণত মোগল শক্তিকে নতুন করে উজ্জীবিত করত। কিন্তু এবার এই পরবর্তী ধাপে তা না হয়ে বরং মোগল সাম্রাজ্যে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে থাকা সমস্যাগুলো বিপর্যয় সৃষ্টি করে ।
আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে মোগল রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রতি চলমান অনেক হুমকি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন বাহাদুর শাহ। উত্তরে জাট ও শিখেরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, দক্ষিণে মারাঠারা ফুঁসছিল, অকার্যকর করের ফলে কোষাগার ফাঁকা হয়ে পড়ছিল, রাজপুতেরা বিদ্রোহ করছিল। বাহাদুর শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর এসব সমস্যার আরো অবনতি ঘটে। কারণ মোগল কর্তৃত্বের প্রতি নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানাতে অনেকেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাহাদুর শাহ তার বাবার মতো ছিলেন না। তিনি মোগল সার্বভৌমত্বের বিরোধিতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মারওয়ারের রাঠোর রাজপুত পরিবার (তারা ৩০ বছর আগে আওরঙ্গজেবের সময় ব্যর্থ বিদ্রোহ করেছিল) আবারো চেষ্টা করে মোগল নিয়ন্ত্রণ ছুঁড়ে ফেলে দিতে। রাঠোরের শাসক অজিত সিং যোধপুর থেকে মোগল বাহিনীতে বিতাড়িত করেন, এমনকি নগরীতে রাজকীয় দখলদারিত্বের সময় নির্মাণ করা মসজিদগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করেন। বাহাদুর শাহ যোধপুর পুনর্দখল করেন। কিন্তু অজিত সিং অল্প সময়ের মধ্যেই মারওয়ারের জন্য বর্ধিত স্বাধীনতা লাভ করেন। এর অন্যতম কারণ ছিল বাহাদুর শাহ তখন পাঞ্জাবে শিখ-নেতৃত্বাধীন একটি বিদ্রোহের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিলেন। এটিও ছিল আওরঙ্গজেবের আমল থেকে রয়ে যাওয়া আরেকটি অস্থিরতা।
বাহাদুর শাহ মারা যান ১৭১২ সালে, তার বাবার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর। এরপর মোগল সাম্রাজ্য দ্রুত গতিতে ভেঙে পড়ে। ১৭১২ থেকে ১৭১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে অল্প ব্যবধানে উত্তরসূরি হিসেবে শাসন করেছিলেন চারজন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর ১৩ বছরের মধ্যে পাঁচজন বাদশাহ মোগল সিংহাসনে বসেছিলেন, অথচ আগের ১৫০ বছরে রাজত্ব করেছিলেন মাত্র চারজন। বস্তুত, এ ধরনের অস্থিতিশীলতার কারণে মোগল রাজপরিবার অভিজাতদের ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়ে ধারাবাহিক কর আদায়সহ রাষ্ট্র পরিচালনার স্বাভাবিক কার্যক্রম পর্যন্ত চালাতে পারছিল না। রাজকীয় প্রশাসনে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়, অনেক এলাকা মোগল রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে পড়ে ।
—
ইরানি যুদ্ধবাজ নেতা নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি লুণ্ঠন করেন, মোগল গর্ব হিসেবে টিকে থাকা সবকিছু পদদলিত করেন। নাদির শাহ মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পণবন্দী করে রাখেন, আর তার সৈন্যরা দিল্লিবাসীর ওপর গণহত্যা চালায়, এর বিপুল সম্পদরাশির কোষাগার লুণ্ঠন করে। দুই মাস পর নাদির শাহ ইরান ফিরে যাওয়ার সময় সাথে করে ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর হীরাসহ মোগল সার্বভৌমত্বের মহামূল্যবান প্রতাঁকের অনেক কিছু নিয়ে যান। হামলার অল্প সময় পর চিত্রিত নাদির শাহের একটি ছবিতে তাকে ভারী অলংকার, আক্ষরিকভাবেই লুণ্ঠিত মোগল সম্পদে সজ্জিত অবস্থায় দেখা যায় । নাদির শাহের হামলার পর মোগল সাম্রাজ্য সত্যিকার অর্থে আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। ওই সময়ের এক মুসলিম বুদ্ধিজীবী বিষয়টিকে বলেছেন এভাবে : ‘দিল্লির সালতানাত হয়ে পড়েছেন শিশুর খেলনা ।’
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ নাগাদ মোগল সাম্রাজ্য নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তারপর ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা একটি আদালত কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘোষণা করে। তবে ওই পর্যায় পর্যন্ত ‘সাম্রাজ্য’ ছিল কেবল নামে। ১৭৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমির মালিকানা, সেনাবাহিনী ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাসহ সত্যিকারের সার্বভৌমত্বের প্রায় সব বিষয় করায়ত্ত করে ইতোমধ্যেই ক্ষয়ে পড়া মোগল সাম্রাজ্য আরো নিঃশেষ করে ফেলেছিল। সর্বশেষ বাদশাহর আগের জন্য তথা দ্বিতীয় আকবর শাহ (শাসনকাল ১৮০৬-৩৭) জীবন্ত জাদুঘর প্রদর্শন সামগ্রীতে পরিণত হয়েছিলেন, ব্যয়ভার মেটানোর জন্য দরবারে বিদেশী পর্যটকদের দর্শনদানের বিনিময়ে ফি গ্রহণ করতেন ।
—
কোন কারণে মোগল শক্তির পতন হলো বা ঠিক কখন মোগল সাম্রাজ্য মেরামতের অযোগ্য হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, আওরঙ্গজেব আংশিকভাবে হলেও দায়ী। এটি একটি অদ্ভূত যুক্তি। কারণ আওরঙ্গজেবই মোগল সাম্রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেবের সাফল্য হয়তো তার বিনাশও ছিল। তিনি সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যকে খুব বেশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে ফেলেছিলেন। ফলে সম্প্রসারণশীল রাজকীয় সম্পদ শিথিল হয়ে আসছিল, পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার মুখে পড়ে গিয়েছিল ।
আরো সংশয়পূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন যে আওরঙ্গজেবের কঠোর নীতিপরায়ণতাই ছিল মরণ আঘাত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ওপর বিশ শতকের সবচেয়ে বেশি গবেষণামূলক কাজ করেছেন যে যদুনাথ সরকার, তিনি তার নিজস্ব নাটকীয় কায়দায় এভাবে বলেছেন, ‘[আওরঙ্গজেবের আমলে] মোগল আল হেলাল পূর্ণিমার চাঁদের পূর্ণতা পায় এবং তারপর দৃশ্যমানভাবেই ক্রমশ ক্ষীণজ্যোতি হতে শুরু করে।’ যদুনাথ সরকার তার পাঁচ খণ্ডের হিস্টরি অব আওরঙ্গজেবসহ এই সম্রাটকে নিয়ে লেখা অনেক গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার শেষ বৃহৎ গ্রন্থটি শুরু করেছেন এই বলে যে ‘আওরঙ্গজেবের জীবন হলো একটি দীর্ঘ ট্রাজেডি, অদৃশ্যমান অপ্রতিরোধ্য ভাগ্যের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির ব্যর্থ সংগ্রামের কাহিনী, যুগের শক্তিতে কিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মানবীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে তার উপাখ্যান।’ যদুনাথ সরকারের কাছে আওরঙ্গজেব ছিলেন ট্রাজিক ব্যক্তিত্ব। অধিকন্তু, অন্যান্য উপনিবেশিক-আমলের চিন্তাবিদের মতো যদুনাথ সরকারও আওরঙ্গজেবকে মনে করতেন ধর্মান্ধ (এবং সে কারণেই ‘মোগল আল হেলাল’)। তিনি মনে করেছিলেন, ইসলামের একটি বিশেষ ধারার প্রতি তার নিবেদিতপ্রাণ থাকার কারণে সাম্রাজ্যে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমান সময়ের খুব কম ইতিহাসবিদই যদুনাথ সরকারের মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ধর্মভিত্তিক ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছেন। কিন্তু তবুও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি লোকরঞ্জক বিষয়ই হয়ে রয়েছে। এর আংশিক কারণ, এটি আখ্যানগত সমস্যা, ঐতিহাসিক নয়। নীতিবাদী গল্পকথনে কোনো শক্তিশালী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পতনের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করার মধ্যে মানবীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের আবেদন রয়েছে। মুসলিম দুরাত্মারা বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে চটকদার জিনিস, এটিই ধার্মিক আওরঙ্গজেবকে আকর্ষণীয় বলির পাঠায় পরিণত করেছে। এর বিপরীতে, আধুনিক ইতিহাসবিদেরা একগুচ্ছ সামাজিক, রাজস্ব, প্রশাসনিক কারণ উল্লেখ করেছেন, যা মোগল শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। এ ধরনের পরিব্যাপ্ত, পদ্ধতিভিত্তিক ব্যাখ্যা ইতিহাসের জন্য উপাদেয় হলেও বাজারের গল্পকথকদের জন্য মুখরোচক নয় ।
খোলামেলাভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-পরবর্তী মোগল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। আমরা তার শাসনকালের সাথে সম্পর্কিত অনেক বিষয়ের ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছি। মোগল রাষ্ট্র ফাঁপায় পরিণত করতে তার ভূমিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় জানা দরকার। তবে আওরঙ্গজেব দূর দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে তিনি একটি তিক্ত উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন। তিনি শেষ বয়সে লেখা তার চিঠিপত্রে প্রায়ই মোগল সাম্রাজ্যের সামনে অন্ধকার দিন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যদিও সাম্রাজ্যের পতনমুখ গতি বদলে দিতে নিজেকে ক্ষমতাহীন দেখতে পেয়েছিলেন।
—
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনার জন্য আওরঙ্গজেবকে সম্ভাব্য দায়ী করার বিষয়টি সরিয়ে রেখে আমরা কিভাবে এই জটিল, অনেক সময় সাংঘর্ষিক চরিত্রের সম্রাটের দীর্ঘ, অসম শাসনকালকে মূল্যায়ন করতে পারি? আধুনিক মানদণ্ডের আলোকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা নিয়ে আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করার মধ্যে অন্তঃদৃষ্টির অবকাশ থাকে সামান্যই । কিন্তু তার সময়ের অন্যান্য শাসকের সাথে, বিশেষ করে পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের সাথে তিনি কিভাবে তুলনীয় তা আরো ফলপ্রসূভাবে জানতে চাইতে পারি ।
আওরঙ্গজেব তার পূর্ববর্তী যেকোনো মোগল সম্রাটের চেয়ে, অন্তত অনেক মোগল প্রথার প্রতিষ্ঠাতা আকবরের পর থেকে, অনেক বেশি মোগল রীতিনীতি ভেঙেছেন। কিন্তু কিছু শিল্পকলার ওপর থেকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস করা, দাক্ষিণাত্যে সরে যাওয়া, জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনের মতো অনেক পরিবর্তন সাধন সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব মোগল প্রশাসনিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির দিক থেকে বিপুলভাবে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে গেছেন। তিনি আকবরের মতো আন্তঃসংস্কৃতির পথিকৃত ছিলেন না (হয়তো ভারত সম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক হিসেবে তিনি এর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করতেন না)। কিন্তু আওরঙ্গজেব ফতোয়া-ই-আলমগিরির মতো বিশাল মাত্রার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কয়েকটি ফারসি রামায়ণ তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। শাহ জাহানের সমমানের মহান নির্মাতা ছিলেন না আওরঙ্গজেব, কিন্তু তবুও যদি লাহোরের বাদশাহি মসজিদ বিবেচনা করা হয়, তবে তিনি খুব পিছিয়েও থাকবেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ লোক যেমনটা মনে করে, তার চেয়েও মোগল পূর্বসূরীদের সাথে অনেক বেশি সমরূপ ছিলেন তিনি।
আওরঙ্গজেব তারপরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি তার গতানুগতিক উদ্বেগ ও তার সামরিক নৈপূণ্যের দিক থেকে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পূর্ববর্তী মোগল শাসকেরাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের কথা বলা যেতে পারে । যে কেউ যাতে সম্রাটের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, সেজন্য জাহাঙ্গীর আগ্রা দুর্গ থেকে নদীর কিনারা পর্যন্ত ৬০টি ঘণ্টা-সংবলিত একটি বিশাল ‘ন্যায়বিচারের শিকল’ ঝোলানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে ন্যায়বিচার ছিল অনেক কম প্রদর্শনীর বিষয়। তিনি অসৎ প্রশাসকদের দমন করা ও নিরাপদে ধর্মীয় উৎসবের নিশ্চয়তা দানকেই বুঝতেন ন্যায়বিচার। অবশ্য সম্রাটের ইচ্ছা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের প্রশাসন দুর্নীতির মতো জঘন্য কাজ করত। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেব তার সারা জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও মধ্য যুগের অন্য অনেক রাজার মতো তিনিও বারবার চির অতৃপ্ত রাজনৈতিক শক্তির জন্য তার ঘোষিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।
আওরঙ্গজেব ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দারুণ দক্ষ সামরিক কৌশলবিদ । তিনিই সম্ভবত ছিলেন মোগল ধারায় সবচেয়ে সুদক্ষ জেনারেল। তিনি দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার লড়াইয়ের মাধ্যমে ময়ূর সিংহাসন জয় করেছিলেন। কয়েক প্ৰজন্ম ধরে মোগলদের কাম্য দাক্ষিণাত্য তিনি জয় করেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রবীণ আওরঙ্গজেব যেকোনোভাবেই হোক না কেন, দক্ষিণ ভারতে তার পথ হারিয়েছিলেন, লক্ষ্যহীনভাবে দুর্গগুলো দখল করছিলেন, বৃদ্ধ বাদশাহ ও দুর্বল যুবরাজদের কাছ থেকে সুযোগ গ্রহণে ইচ্ছুক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে নির্বিষ হয়ে ওঠেছিলেন।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল যদি ২০ বছর সংক্ষিপ্ত হতো, জাহাঙ্গীর (তিনি শাসন করেছিলেন ২২ বছর) বা শাহ জাহানের (তিনি শাসন করেছিলেন ৩০ বছর) কাছাকাছি সময় পর্যন্ত শাসন করতেন, তবে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা হয়তো তাকে ভিন্নভাবে বিচার করতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের শেষ দশকগুলোতে ছেলেদের শৃঙ্খলিত করা, ক্রমবর্ধমান হারে স্ফীত হয়ে ওঠা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল থাকা, বাজে পরামর্শপুষ্ট যুদ্ধে নিয়োজিত হওয়া ছিল তার জট পাকানো উত্তরাধিকারের বিশাল অংশ। ফলে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া হয়েছে বিপুল উচ্চাভিলাষ ও মোগল ভারতের বাস্তবতার মধ্যে অপূরণীয় ব্যবধানে জর্জরিত একজন জটিল মানুষ ও রাজার মিশ্রণ মূল্যায়ন ।
আওরঙ্গজেবকে শৃঙ্খলমুক্ত করা
সময়, পরিস্থিতি, ইতিহাস আমাকে যা বানিয়েছে, আমি অবশ্যই তাই, তবে তারপর আমি তার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা সবাইই তাই ।
–জেমস ব্যান্ডউইন, আমেরিকান লেখক, ১৯৫৫
আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক স্মৃতির সাথে ঐতিহাসিক সম্রাটের রয়েছে স্রেফ ঝাপসা সাদৃশ্য। এই অমিল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণ হলো উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক ধারণার প্রশমন করা এবং অপরটি হলো ঐতিহাসিক গবেষণাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা ।
আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক খ্যাতির ফলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই মোগল অতীত নিয়ে রাজনৈতিক ইন্ধনযুক্ত ভাষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, আওরঙ্গজেবের দুই ভাষ্যই (ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেব ও ধার্মিক আওরঙ্গজেব) প্রকাশ্য ধারায় পরিণত হয়েছে। ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের চিত্রটি বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসকারী। এতে হিন্দু ও হিন্দুবাদকে ধ্বংস করতে আগ্রহী উগ্র আওরঙ্গজেবের চিত্র আঁকা হয়। মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ বাড়াতে ও ভারতীয় মুসলিমদেরকে বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করতে ভারতের রাজনীতিবিদ ও অন্যরা এই ধারণা প্রচার করে। আওরঙ্গজেবকে বিশুদ্ধ মুসলিম (উর্দু কবি মোহাম্মদ ইকবাল, মৃত্যু ১৯৩৮, তাকে ‘ভারতের মূর্তি গৃহে ইব্রাহিম’ হিসেবে অবহিত করেছিলেন) হিসেবে চিত্রিত করাও সমস্যাসঙ্কুল। এভাবে উপস্থাপনের ফলে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে মুসলিমরা প্রধানত তাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়, আর ইসলাম হলো মৌলিকভাবে হিন্দু ধর্মের চেয়ে আলাদা। ভারতবর্ষের জন্য এই ধারণার অর্থ হলো এই যে মুসলিমেরা পুরোপুরি ভারতীয় হতে পারে না, আর পাকিস্তানে তারা ধারণা দেয় যে সব মূল্যবান নাগরিককে অবশ্যই ইসলামের সংকীর্ণ ধরনের সংজ্ঞায় থাকতে হবে।
—
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ধারণা কেন বাতিল করার জরুরি, তার দ্বিতীয় কারণ হলো, যাতে আমরা তাকে ইতিহাসের পরিভাষায় বুঝতে পারি। আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সময়ের মানুষ, আমাদের সময়ের নয়। আমি যুক্তি দিয়েছি যে আওরঙ্গজেব ন্যায়বিচার নিয়ে তার আদর্শের আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক আচরণের (আদব ও আখলাক) প্ৰতি দায়বদ্ধ ছিলেন, রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করেছেন। আওরঙ্গজেবের বিশ্ববীক্ষা তার নিজের ধর্মভক্তি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মোগল সংস্কৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত (আধুনিক সময় এ ধারণাটিতে আচ্ছন্ন) তার স্বার্থের অনুকূলে ছিল না, বরং তিনি তার ধারণার আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মোগল ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা এবং উপমহাদেশজুড়ে তার মুষ্ঠি সম্প্রসারণ করার দিকে নজর দিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরও আওরঙ্গজেব সহজে সংক্ষিপ্ত করাকে প্রতিহত করেন। তিনি ছিলেন প্রবল বৈপরীত্যপূর্ণ ও ধাঁধাময় এক ব্যক্তিত্ব। আওরঙ্গজেব নিয়ম অনুসরণে পুরোপুরি আচ্ছন্ন ছিলেন। এমনকি রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিয়েও সর্বক্ষণ অস্থির থাকতেন। কিন্তু বাবাকে বন্দী করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায় দেখতে পাননি, অবশ্য এই কারণে এশিয়ার একটি বড় অংশে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। তিনি দারা শুকোহসহ তার পরিবার সদস্যদের হত্যা করতে কিংবা শত্রুদের টুকরা টুকরা করে কাটতেও (এই যেমন শম্ভুজির ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই) দ্বিধা করেননি। আবার তিনি নিজ হাতে টুপি সেলাই করতেন, ধার্মিক জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা লালন করতেন। খারাপ প্রশাসক, পচা আম, অপদার্থ ছেলেদের প্রতি ক্রুদ্ধ হতেন তিনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীতের সমঝদার, এমনকি গায়িকা হিরাবাইয়ের প্রেমেও পড়েছিলেন। কিন্তু মধ্যবয়সের শুরুতে তিনি নিজেকে সঙ্গীত শিল্পের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ বয়সে আরেক সঙ্গীতশিল্পী উদয়পুরির সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, অথচ নিজের কবরের জন্য অচিহ্নিত একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাত্রায় সম্প্রসারিত করলেও নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে করতেন ।
আওরঙ্গজেব ছিলেন রহস্যময় সম্রাট। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ইতিহাসবিদ কাফি খান তাকে পারস্য ঐতিহ্যের কিংবদন্তিপ্রতীম শাসক জামশিদের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘জামশিদের সমমানের একজন শাসকের ৫০ বছরের শাসনকালের প্রধান ঘটনাগুলোর সারাংশ টানার চেষ্টা সাগর থেকে এক কলস পানি নেওয়ার মতো।’ এই উৎসুক্য সৃষ্টিকারী সম্রাট এবং যে সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেছেন, সে সম্পর্কে অনেক কথা বলা এখনো বাকি রয়ে গেছে। কল্পকথার আওরঙ্গজেবের আবরণটি পরিষ্কার করার পরই আমরা কেবল মধ্য যুগের ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী ধাঁধার মুখোমুখি হতে পারি ।