নীতিপরায়ণ মানব ও নেতা

৫. নীতিপরায়ণ মানব ও নেতা

ধর্মভক্তি ও ক্ষমতা

সম্রাট [আওরঙ্গজেব] একটি দোয়া লিখে সেটিকে [বন্যার] পানিতে নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথেই পানি কমতে শুরু করল। খোদাভক্ত সম্রাটের দোয়া খোদা কবুল করলেন, দুনিয়া আবারো শান্ত হলো ।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব বাহিনীর এক হিন্দু সৈনিক, লিখেছেন ফারসিতে

অন্য সব মোগল শাসকের মতোই আওরঙ্গজেব মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, জীবনজুড়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্মের অনুশীলন করেছেন। অনেক আগে মারা যাওয়া সম্রাটদের মনের ভাবনা সম্পর্কে জানা অসম্ভব। তবে তাদের কর্মের ওপর ভিত্তি করে মনে হতে পারে যে আওরঙ্গজেব তার পূর্বসূরিদের চেয়ে বেশি ধার্মিক ছিলেন। তিনি তার পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আর মদ্যপান ও আফিম থেকে বিরত ছিলেন। এই দুটি নেশায় মোগল পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্য মারা গেছেন। ১৬৬০ এর দশকে আওরঙ্গজেব কোরআনে হাফেজ হন। শেষ বয়সে তিনি নামাজের টুপি সেলাই করতেন, নিজ হাতে পবিত্র কোরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। এসব কাজ তিনি করতেন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ।

তবে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনোভাবেই বিশুদ্ধবাদী ছিল না । বরং তিনি সারা জীবন প্রখ্যাত হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন, যেমনটি করেছিলেন তার পূর্বসূরি মোগল সম্রাটেরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৮০-এর দশকে আওরঙ্গজেব বৈরাগী হিন্দু শিব মঙ্গলদাস মহারাজের সাথে ধর্মীয় আলোচনা করেন, ওই সন্ন্যাসীকে বিপুল উপহার প্রদান করেন। সম্রাটের সাথে ইসলামি সুফি সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এটিও ছিল দীর্ঘ দিন ধরে অনুসরণ করা মোগল ঐতিহ্য। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রের একটি চিশতি দরগায় তার কবর হওয়ার মধ্যে। একটি ছবিতে দুই ছেলেকে নিয়ে রাজস্থানের আজমিরে মইনুদ্দিন চিশতির (মৃত্যু ১২৩৬) দরগায় যেতে দেখা যায় আওরঙ্গজেবকে। ছবিটি সম্ভবত ১৬৮০ সালের দিকের (চিত্র ৫)। ইসলাম সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসের মধ্যে অনেক তাবিজ-কবজের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার যুদ্ধের সময় তিনি দোয়া-দরুদ লিখে সেগুলো রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া ঝান্ডা ও পতাকায় গেঁথে দিয়েছিলেন।

আওরঙ্গজেব প্রায়ই তার নিজের ও অন্যদের কল্যাণের জন্য প্রকাশ্যে তার ধর্মভক্তি প্রকাশ করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুদ্ধ পতাকায় দোয়া দরুদ লিখে সেলাই করার কথা বলা যায়। তিনি কাজটি করতেন তার ও তার সৈন্যদের দৃষ্টিতে জয় নিশ্চিত করার জন্য। সম্রাট একবার দোয়া লিখে বন্যার পানিতে নিক্ষেপ করেছিলেন। ভীমসেন স্যাক্সেনার ভাষায় এতে পানি হ্রাস পেয়েছিল। আরেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, যুদ্ধের মধ্যেই তিনি তার ধর্মনুরাগ প্রকাশ করার লক্ষ্যে নামাজ পড়ার জন্য ঘোড়া থেকে নেমে গিয়েছিলেন। তিনি কাজটি করেছিলেন তার সৈন্যদের এই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে যে আল্লাহ তাদের পক্ষে আছেন। আওরঙ্গজেব হতে চাইতেন ভালো মুসলিম এবং তা অন্যদের দেখাতেও চাইতেন ।

মুসলিম শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় আদর্শ দাবি করত যে তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন, তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেবেন। তিনি তার নাতি আজিমুশ্বানের কাছে লেখা এক পত্রে লিখেছেন : ‘তুমি ইহকাল ও পরকালের সুখের উৎস হিসেবে প্রজাদের সুরক্ষা প্রদানকে বিবেচনা করতে পারো।’ তবে ইসলামের সাথে তার প্রকাশ্য সম্পর্ক নিয়ে সম্রাট বারবার সমস্যায় পড়তেন । দুটির মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে আওরঙ্গজেব সাধারণত রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বেদীতে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা বলি দিতেন, যদিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত তার বুকে ভারী বোঝা হয়ে থাকত ।

পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ও তাকে অর্ধ দশকেরও বেশি সময় আটকে রেখে ইসলামি বিধান লঙ্ঘন করেছিলেন আওরঙ্গজেব। আমি আগেই বলেছি, মক্কার শরিফ এই রায় স্পষ্টভাবে দেন। তিনি আওরঙ্গজেবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন যে শাহ জাহান জীবিত থাকা পর্যন্ত হিন্দুস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেবেন না। মক্কার শরিফের মন পরিবর্তনের চেষ্টায় কখনো বিরাম দেননি আওরঙ্গজেব। এতে মনে হয়, মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের অনুমোদনের অভাব মোগল সম্রাটকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ১৬৬৬ সালে শাহ জাহান ইন্তিকাল করলে সমস্যাটির আপনা-আপনি সমাধান হয়। তবে এর মধ্যবর্তী সাড়ে সাত বছরের ইসলামি নীতিমালার লঙ্ঘনের জন্য আওরঙ্গজেবকে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।

এর কয়েক দশক পর এক ইউরোপিয়ান পর্যটক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে আওরঙ্গজেবের মদ্যপানসহ ‘কঠোর সংযম’ ছিল তার পিতার প্রতি করা তার আগেকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। এই সূক্ষ্ম যোগসূত্র নির্ভুল হোক বা না হোক, খুব সম্ভবত অবৈধ মুসলিম রাজা হিসেবে আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করার কারণেই তিনি আরো নিবেদিতপ্রাণ মুসলিমে পরিণত হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ঐকান্তিকতার সাথে পবিত্র কোরআন মুখস্ত করা, পবিত্র কোরআনের অনুলিপি তৈরী করাসহ তার আরো সুস্পষ্ট ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা ঘটে তার সিংহাসনে আরোহণের পর। এখানে, আওরঙ্গজেবের ধার্মিকতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি যেভাবে তার রাজকীয় অভিজ্ঞতা তার ধার্মিক জীবনে পরিবর্তনকে উদ্দীপ্ত করেছিল।

তার শাসন পরিক্রমার ধারায় ইসলামি ধর্মীয় আদর্শ ও মোগল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মধ্যে আরো নানা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৮৬ সালের বিজাপুর অভিযানকালে বিজাপুরের ধর্মবিদদের একটি দল আওরঙ্গজেবের কাছে গিয়ে এই যুক্তিতে অবরোধ তুলে নিতে বলেন যে একই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অন্যায়। আওরঙ্গজেব অনড় থাকেন, তিনি বিজাপুরের পতন না হওয়া পর্যন্ত তার নৃশংস কৌশল কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। সম্রাট তারপর বিজাপুরি প্রাসাদের কিছু দেয়ালচিত্র মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এটা বোঝাতে যে মোগল ধর্মীয় রাষ্ট্রের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ছবিগুলো পৌত্তলিকতাবিষয়ক!

তিনি যখন মনে করতেন, কোনো কাজ সাম্রাজ্যের স্বার্থ পূরণ করবে তখন আওরঙ্গজেব এমনকি আগে অনুমোদিত ইসলামি নীতিমালার সাথেও আপস করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৭০০ সালে মারাঠা শক্ত ঘাঁটি সাতারা দুর্গ অবরোধের সময় মোগল সৈন্যরা ৯ হিন্দু ও চার মুসলিমকে আটক করে। আওরঙ্গজেবের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রণীত আইনি গ্রন্থ ফতোয়া-ই-আলমগিরি অনুযায়ী এক মোগল বিচারক চার মুসলিমকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ইসলাম গ্রহণ করার শর্তে হিন্দুদেরকে মুক্তির রায় দেন। এই সাজা ছিল বেশ নমনীয়। এতে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় আওরঙ্গজেব ওই বিচারককে ‘অন্যভাবে রায় দিতে বলেন, যাতে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া না হয়।’ সূর্যোদয়ের আগেই বিদ্রোহী সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ইসলামের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ তথা আলেম সমাজ আওরঙ্গজেবের প্রয়োজন অনুযায়ী ধর্মীয় বিবেকজনিত দ্বিধা ত্যাগ করার আগ্রহের ব্যাপার নিয়ে অন্ধ হয়ে থাকেনি পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো আওরঙ্গজেবও তার পুরো রাজত্বকালে আলেমদের, বিশেষ করে কাজি হিসেবে তাদের ভূমিকার সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়েছেন। সিংহাসন দখল করেই তিনি প্রধান কাজি হিসেবে আবদুল ওয়াহাবের নাম ঘোষণা করেন। এর কারণ হলো, তার পূর্ববর্তী প্রধান কাজি পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আওরঙ্গজেবের পাপ এড়িয়ে যাননি। কয়েক দশক পর আবদুল ওয়াহাবের ছেলে (তিনিও ছিলেন কাজি) শায়খুল ইসলামের সাথে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই কাজি ইসলামি দেশ বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল ও অনেক মুসলিমকে হত্যার বিষয়টি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শায়খুল ইসলাম অল্প সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে হজে চলে যান। রাজকীয় নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য নিয়ে চলতে অস্বীকৃতিকারী ব্যক্তিকে অপসারণ করার জন্য এটি ছিল মোগলদের দীর্ঘ দিন ধরে অনুসরণ করা ব্যবস্থা।

আকবরের আমল থেকেই মোগল শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বিধানে অন্যতম উপাদান ছিল আলেম সমাজ। আকবর এই সম্প্রদায়ের অধিকতর কঠোর সদস্যদের বিদ্রূপ করতেন, কয়েকজন সোচ্চার ব্যক্তিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। আকবরের অনুকরণে আওরঙ্গজেবও তার সিংহাসন আরোহণের বিরোধিতাকারী শাহ জাহানের প্রধান কাজির মতো আলেম সমাজের সমস্যা সৃষ্টিকারী সদস্যদের অসন্তুষ্ট করার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবে সম্ভব হলে আলেমদের প্রশান্ত রাখার জন্য আওরঙ্গজেব তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করতেন, বিশেষ করে তাদের জন্য আয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন ।

আওরঙ্গজেব ফতোয়া-ই-আলমগিরি লেখার জন্য অনেক জ্ঞানী মুসলিমকে অর্থ প্রদান করেছিলেন। ১৬৬৭ থেকে ১৬৭৯ সালের সময়কালে এটি রচনা করা হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে আলেমরা জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র সংশোধনের দায়িত্বেও ছিলেন, জিজিয়ার কর তারাই আদায় করতেন । ১৬৭৯ সালের শুরুতে আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে সামরিক সেবা না দেওয়ার বিপরীতে জিজিয়া কর আরোপ করেন। রাজপুত ও মারাঠা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, ব্রাহ্মণ ধর্মীয় নেতাদের এই কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে সাধারণ জৈন, শিখ ও অন্যান্য অমুসলিমের জন্য তা প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। জিজিয়া কর মোগল সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ বছর বাতিল ছিল। আওরঙ্গজেবের এটি পুনঃজীবিত করার একটি কারণ ছিল এর সংগ্রহের দায়িত্বে আলেমদের নিয়োজিত করার জন্য। তাত্ত্বিকভাবে জিজিয়ার ফলে আলেমদের মধ্যে বিশেষ করে যারা যথার্থ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে মোগল সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করে সম্রাটদের ধর্মীয় আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহে ভুগতেন তাদের মধ্যে আওরঙ্গজেবের খ্যাতি বাড়াতেও সহায়ক হয়েছিল।

আওরঙ্গজেবের অনেক অভিজাত (এদের মধ্যে ছিলেন অনেক প্রখ্যাত মুসলিম ও রাজপরিবারের সদস্য, যেমন আওরঙ্গজেবের বড় বোন জাহানারা ) দুর্বল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হিসেবে জিজিয়া নিয়ে তীব্র বিদ্রূপ করেছিলেন। এই কর অনেক হিন্দুকেও কষ্ট দেয়। আওরঙ্গজেবকে লেখা এক কঠোর সমালোচনামূলক পত্রে (এটি হয় শিবাজি কিংবা ১৬৫২-১৬৮২ সাল পর্যন্ত মেবার শাসনকারী রাজপুত শাসক রানা রাজ সিং লিখেছিলেন) জিজিয়াকে ফালতু হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এই যুক্তিতে যে এটি আকবরের আমল থেকে মোগল নীতির ভিত্তি হিসেবে বিরাজমান সুলেহ কুল (সবার জন্য শান্তি) ধারণার পরিপন্থী।

বাস্তবে, জিজিয়া পুনঃবহাল শক্তিশালী আলেমদের ওপর আওরঙ্গজেবের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়নি। সমসাময়িক অনেক ঘটনায় জিজিয়া সংগ্রহে অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। সংগৃহীত অর্থের একটি বড় অংশই লোভী সংগ্রহকারীদের পকেট থেকে বের হয়নি। এ ধরনের চুরি বন্ধ করতে অক্ষম ছিলেন আওরঙ্গজেব।

নৈতিক তদারকি

রাজা হলেন গরিবের রাখাল, এমনকি যদি তিনি তার মহিমা দিয়ে তাদের ভীতও করেন।
রাখালের জন্য ভেড়া থাকে না। ভেড়ার সেবা করার জন্যই রাখালের অস্তিত্ব থাকে ।
–সাদি, গুলিস্তাঁ

আওরঙ্গজেবের তার আদর্শের সাথে আপস করতে ইচ্ছুক থাকলেও বাদশাহ তার প্রজাদের প্রতি পিতৃমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করতেন । তিনি মনে করতেন যে তার সাম্রাজ্যে বসবাসকারী সবার কেবল দৈহিকই নয়, তাদের নৈতিক কল্যাণের দায়িত্বও তার। সে অনুযায়ী তিনি তার সাম্রাজ্যে বসবাসকারীদের নৈতিক জীবনযাপন করতে তাদেরকে উৎসাহিত, এবং এমনকি জবরদস্তিও করতেন ।

আওরঙ্গজেব নিজেকে নীতিপরায়ণ নেতা হিসেবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতাবিষয়ক ইসলামি আদর্শ সামনে আনতেন। তার পিতৃসুলভ প্রবণতা গড়ে ওঠেছিল সাদির গুলিস্তাঁর (গোলাপ উদ্যান) মতো ফারসি নীতিবাদী গ্রন্থাবলীতে পাওয়া রাজাদের দুঃখদায়ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এসব সতর্ক রাজা শাসন করতেন ভালোই, তবে ধারণা করা হতো, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সবচেয়ে পাপাচারপূর্ণ স্বৈরাচার। উল্লেখ্য, আওরঙ্গজেব হিন্দু ও মুসলিম সবারই কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি ধর্ম নির্বিশেষে সব প্রজার জন্য একই ধরনের আচরণবিধি প্রণয়ন করেছিলেন। কিছু ঘটনায় দেখা যায়, তিনি একটি ধর্মীয় গ্রুপের নির্দিষ্ট ইস্যুগুলোর সমাধান করছেন, যদিও তিনি কার্যত সবার জন্য প্রযোজ্য নীতিই তাতে প্রয়োগ করছেন।

মোগল ভারতে বসবাসকারীদের মধ্যে নীতিপরায়ণতা প্রচারের জন্য আওরঙ্গজেব যেসব সবচেয়ে সাধারণ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রয়োগ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল নানা নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ! আওরঙ্গজেব তার রাজত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যালকোহল, আফিম, পতিতাবৃত্তি, জুয়া, উস্কানি সৃষ্টিকারী ধর্মীয় লেখালেখি, ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীনভাবে উদযাপনসহ বিভিন্ন পাপাচার সীমিত বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। মুহতাসিবদের (সেন্সর) দায়িত্ব ছিল নৈতিক বিধিমালা প্রয়োগ করা, প্রতিটি নগরীতে আলেমদের অনেকে এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ ধরনের বিধিনিষেধের যৌক্তিকতা ও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন : জনসাধারণ ও ব্যক্তির জীবনবিধান। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট মৌলিক উদ্বেগগুলোও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দীপনা সৃষ্টি করত। এগুলোই তাত্ত্বিকভাবে নীতিপরায়ণ ও নিরাপদ রাজ্য হিসেবে মোগল ভারতকে তৈরীতে হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আওরঙ্গজেব দৃঢ়ভাবে এই মনোভাব পোষণ করতেন যে নৈতিকতা হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও শাসিতদের কল্যাণ সুরক্ষিত রাখার শাসকের বৃহত্তর কর্তব্যের আওতাভুক্ত বিষয়।

আওরঙ্গজেব তার পুরো সাম্রাজ্যে অ্যালকোহল পান হ্রাস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার আমলে যেসব উল্লেখযোগ্য নীতি ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি। অ্যালকোহলকে ব্যাপকভাবে অনৈস্লামিক হিসেবে নিন্দা করা হতো, মোগল সম্রাটেরা অ্যালকোহল পানে নিরুৎসাহিত করার জন্য ধর্মীয় নীতির আলোকে সোচ্চার ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে জৈন সন্ন্যাসী শান্তিচন্দ্রের কথা বলা যায়। তিনি ১৫৯০ সালের দিকে আকবরের ‘অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করা’ নিয়ে আলোচনা করে বলেছিলেন যে ‘এটি সার্বজনীনভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।’ জাহাঙ্গীরও অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছিলেন (যদিও তিনি ছিলেন পুরো মাত্রায় মদ্যপ)। এই নিষেধাজ্ঞা বারবার আরোপ করায় মনে হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা ছিল অকার্যকর।

বিফল হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করে মদ ও তাড়ি বিক্রি সীমিত করার চেষ্টা করেন। ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের সাক্ষ্য অনুযায়ী মদ ছিল ‘জেন্টিল ও মোহামেতান [হিন্দু ও মুসলিম] উভয় আইনেই নিষিদ্ধ,’ এবং দিল্লিতে তা সহজলভ্য ছিল না। তবে সাধারণভাবে, আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে অ্যালকোহল গলধঃকরণ ছিল ব্যাপক অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে আওরঙ্গজেবের দরবারে ইংরেজ রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম নরিস সাক্ষ্য দিয়েছেন, আসাদ খান (১৬৭৬ থেকে ১৭০৭ সময়কালে প্রধান উজিড়) ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার কাছে ‘কড়া মদের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই এবং হাতের কাছে পেলে তারা প্রতিদিন তা পান করেন। সে অনুযায়ী, আসাদ খানের কাছে কিছু মদ ও পছন্দের পানপাত্র (যা দিয়ে কড়া পানি’ গলধঃকরণ করা যাবে) পাঠিয়ে তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন ।

আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগতভাবে অ্যালকোহল পান করতে অস্বীকৃতি জানালেও তিনি জানতেন, তার কর্মকর্তাদের মধ্যে খুব কম লোকই তার উদাহরণ অনুসরণ করেন। গালগল্প ও অতিরঞ্জনের প্রকট দুর্বলতাসম্পন্ন নিকোলি মানুচি লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব একবার উত্তেজিতভাবে অভিমত প্রকাশ করেন যে হিন্দুস্তানে মাত্র দুজন মদ পান করেন না। এদের একজন হলেন তিনি ও অন্যজন হলেন প্রধান কাজি আবদুল ওয়াহাব। তবে মানুচি গোপনীয়তা ফাঁস করে তার পাঠকদের জানিয়েছেন : ‘কিন্তু আবদুল ওয়াহাবের ব্যাপারে [আওরঙ্গজেব] ভুল ছিলেন। কারণ আমি তাকে প্রতিদিন এক বোতল করে স্পিরিট (ভিনো) পাঠাতাম। তিনি তা পান করতেন গোপনে, যাতে সম্রাট তা বুঝতে না পারেন। ‘

আওরঙ্গজেবের জারি করা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল আফিম উৎপাদন ও ব্যবহারের হ্রাস করা । এগুলোও একই ধরনের ব্যর্থ পরিণতি বরণ করে।

আওরঙ্গজেব অনেক ধর্মীয় ছুটির সার্বজনীন উদযাপন সীমিত করেন। এসব বিধিনিষেধ সব ধর্মের লোকজনকেই প্রভাবিত করেছিল। কারণ আওঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যের সব প্রধান ধর্মের উৎসব নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন এবং আজকের দিনের অনেক ভারতীয়ের মতো তখনও ভারতীয়রা একের পবিত্র দিনগুলো অন্যরাও পালন করত।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের অষ্টম বছরে ফারসি নববর্ষ নওরোজ, মুসলিমদের ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা ‘বড় ধরনের জাঁকজমকভাবে পালনের’ ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। একই সময় তিনি হিন্দুদের হলি ও দিওয়ালি এবং মুসলিমদের মোহররম উদযাপনের সাথে সম্পৃক্ত হইচই হ্রাস করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গজেবের এসব হুকুম জারি করার আংশিক কারণ ছিল এই যে তার কাছে হইচয়ের বাড়াবাড়ি বিতৃষ্ণাকর মনে হয়েছিল । জননিরাপত্তার বিষয়গুলোও সম্ভবত তার এই উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে কাজ করেছিল।

মধ্য যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় উৎসবগুলো প্রায়ই পরিণত হতো বিপজ্জনক বিষয়ে। উদাহরণ হিসেবে ভীমসেন স্যাক্সেনার কথা বলা যায়। তিনি মহারাষ্ট্রের ত্রিমবাকে প্রতি ১২ বছর পরপর হওয়া একটি বিশাল উৎসবের কথা বলেছেন (তিনি সম্ভবত কুম্ভ মেলার কথা উল্লেখ করেছেন)। সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র দলগুলো এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জড়ো হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করত। এতে অনেকে হতাহত হতো। ভারতবর্ষ সফরকারী ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট বলেছেন, ১৬৬৬-৬৭ সময়কালে গোলকোন্ডায় মোহররম উদযাপন (তাতে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ে অংশ নিত) এতই উন্মাদনাপূর্ণ হয়ে পড়েছিল যে সহিংসতা হওয়াটাই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ১৬৬৯ সালে বুরহানপুরে মোহররম উৎসবের সময় ৫০ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয় । মোগল ভারতবর্ষে চুরি ও অন্যান্য অপরাধও ব্যাপকভাবে হতো ধর্মীয় উৎসবের সময়। যেমন গুজরাতের হলি উৎসবকারীদের বিশাল আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ চুরি করার প্রবণতা ছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এই প্রথা দমন করার জন্য তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইসময় তিনি হলি ও দিওয়ালি উভয় উৎসবে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে নির্দেশও দিয়েছিলেন ।

আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উৎসবগুলোতে প্রচুর মদ্য পান করে উন্মাদ হওয়া ও অবৈধ আচরণ করা হ্রাস করেছিলেন, তবে এ ধরনের উৎসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বস্তুত, শাসনকালের প্রথম দিকে ইতোপূর্বে হিন্দু উৎসবগুলোর ওপর আরোপ করা কর হ্রাস করে এসব উৎসবকে উৎসাহিত করেছিলেন। বিপুলসংখ্যক উদাহরণে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের পুরো শাসনকালে লোকজন সার্বজনীন অবকাশ যাপনের সময়গুলোতে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকের শেষ দিকেও অনেক ইউরোপিয়ান পর্যটক ও হিন্দু লেখক হলি উদযাপনের কথা লিখেছেন। এমনকি আওরঙ্গজেবের নিজের সন্তানেরা পর্যন্ত অমুসলিম ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিত। আওরঙ্গজেব তার জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে তার ছেলে মোয়াজ্জেমকে নওরোজ উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব এই প্রাচীন প্রথাকে কিংবদন্তীপ্রতীম হিন্দু শাসক বিক্রমাদিত্যের অভিষেক উদযাপন স্মারকও মনে করতেন ।

নৈতিক আচরণ উন্নয়নের এজেন্ডার অংশ হিসেবে আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন তার প্রজাদের, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক ঝোঁক গড়ে তুলতে । সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করাবিষয়ক তার কথিত এজেন্ডা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়ে থাকেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু বাস্তবে আওরঙ্গজেবের সরকার কখনো হিন্দুদের বা অন্য কোনো ধর্মের লোকদের মধ্যে ব্যাপক ধর্মান্তরের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করার তাগিদ অনুভব করেছিল।

ইসলামে ধর্মান্তরের ফলে অনেকে মোগল ক্রমপরম্পরার উচ্চতর ধাপে উঠতে পারত, জিজিয়া কর আদায়কারীসহ মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত অনেক চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতো। অবশ্য, ধর্মান্তরের ফলে লোকজনকে আওরঙ্গজেবের অনুসন্ধানের আওতায়ও নিয়ে আসত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯৯ সালে এক চিঠিতে দুই ব্যক্তির নিন্দা করেন এ কারণে যে তারা ‘তাদের ইসলামে ধর্মান্তর নিয়ে দম্ভ করছে এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে কথা বলছে। আওরঙ্গজেব তাদেরকে ‘অধার্মিক লোক’ (বেদিন) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আন্তরিকতা না থাকায় উভয়কেই কারারুদ্ধ করার আদেশ দেন তিনি |

সার্বিকভাবে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে খুব কম হিন্দুই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। রাজদরবারে আসা নিয়মিত বুলেটিনগুলোতে অতি সামান্য সংখ্যক ধর্মান্তরের খবর আসত, অনেক সময় সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নামও থাকত, এদেরও বেশির ভাগ ছিল নিম্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় কর্মী।

আওরঙ্গজেব অবশ্য মুসলিম প্রজাদের ব্যাপারে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন। তিনি তাদের ধর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছেন বেশি, বিশেষ করে আহমদ সরহিন্দির (মৃত্যু ১৬২৪) নির্বাচিত কিছু লেখার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন। সরসিন্দি ছিলেন সুফি নকশবন্দি তরিকার সদস্য। তিনি তার তীব্র বিতর্কমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত ছিলেন। তার ওই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সরহিন্দি জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে ইন্তিকাল করলেও তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে শাহ জাহানের শাসনকালে। তার গ্রন্থ কোনো কোনো মাদরাসা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, অনেকে ক্রমবর্ধমান হারে তাকে মুজাহিদ (সংস্কারক), এমনকি নবি হিসেবেও বিবেচনা করতে থাকে। সমসাময়িক ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো যেভাবে গ্রন্থরাজি সেন্সর করত, সে তুলনায় আনুষ্ঠানিক হাতিয়ারের অভাব ছিল মোগল সাম্রাজ্যে। কিন্তু আওরঙ্গজেব ১৬৮০-এর দশকে সরহিন্দিকে আলাদা করে রাখেন, তার কিছু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রচনা নিষিদ্ধ করেন।

অনেক সময় আওরঙ্গজেব নির্দিষ্ট কিছু মুসলিম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। এসব গ্রুপের মতবাদ ইসলাম সম্পর্কে তার ভাষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪০-এর দশকে আওরঙ্গজেব তখনো ছিলেন গুজরাত পরিচালনার দায়িত্বে থাকা যুবরাজ, আহমদাবাদের মোগল সৈন্যরা মাহদাবি সম্প্রদায়ের (সহস্রাব্দবাদী এই সম্প্রদায় পনের শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়) কয়েক ডজন সদস্যকে হত্যা করে। মাহদাবিদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল। সম্ভবত এ কারণেও তাদের প্রতি এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর ৪০ বছর পর, তখন তারা তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে, মাহদাবিদের একটি প্রতিনিধিদল রাজদরবারে আওরঙ্গজেব ও প্রধান কাজিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তারা নিরীহ, মূলধারার মুসলিম!

আওরঙ্গজেব বিচ্যুত বিবেচিত অরাজনৈতিক মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর ওপরও চড়াও হয়েছিলেন। যুবরাজ থাকার সময় তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের শাখা ইসমাইলি বোহরাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন। তিনি তাদের এক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তার পুরো রাজত্বকালে ইসমাইলি বোহরাদের হয়রানি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি তার শাসনকালের অষ্টম বছরে বোহরা মসজিদগুলোতে সুন্নিদের মতোই দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি কয়েক দশক পরও রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যরা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাঝে মাঝেই গ্রেফতার করত।

পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো আওরঙ্গজেবও জনকল্যাণের নামে কোন কোন জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার হিসেবে কোনগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে সে ব্যাপারে সতর্ক সীমারেখা টেনেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সঙ্গীতও ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, আওরঙ্গজেব তার পুরো সাম্রাজ্যে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ভুল ধারণাটির অপনোদন করেছেন ক্যাথেরিন স্কোফিল্ডের মতো বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকরঞ্জক ধারণার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। আওরঙ্গজেব তার নিজের দরবারে সামান্য কিছু ধরনের সঙ্গীত সীমিত করেছিলেন।

সম্ভবত আরো মজার ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব কখনো তার আমলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যঙ্গমূলক কবিতা নিষিদ্ধ করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেষ বয়সে সরকারি কর্মকর্তা কামগর খানের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে জনৈক কবি আদি রসাত্মক একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। অপমানিত কামগর খান এতে বাদশাহের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আওরঙ্গজেব জবাবে বলেন, ‘এই কবি আমাকে নিয়েও [ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করতে ছাড়েনি। আর এর বিপরীতে আমি তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে [এজন্য হলেও] আর সে এ কাজ না করে, কিন্তু এর পরও সে [ব্যঙ্গ] রচনা কমায়নি।’ আওরঙ্গজেব তখন আবেদনটি খারিজ করে কামগর খানকে উপদেশ দেন, ‘আমাদের উচিত হবে আমাদের সংবেদনশীলতা অবদমিত করে সম্প্রীতিতে বসবাস করা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *