যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ৯

০৯.

সকালবেলা—বেলা তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে দ্বিতীয় কাপ চায়ের আস্বাদ গ্রহণ করছিল, পাশে বসে সুব্রত। জংলী এসে বললে, মল্লিক সাহেব এসেছেন।

কে? সুদর্শন? যা নিয়ে আয়।

একটু পরে জংলীর পিছনে পিছনে এসে ঘরে প্রবেশ করল সুদর্শন।

আরে এস, এস ভায়া—তারপর বল কি খবর, অনেক দিন পরে এলে।

সুদর্শন বসতে বসতে বললে, আপনি তো দাদা আজকাল বড় একটা কারও সঙ্গে দেখাই করেন না শুনতে পাই।

কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।

সুদর্শন বললে, তাই অযথা বিরক্ত করতে আসি না।

বুঝতে পারছি, তা সাবিত্রীর খবর কি?

সে যথারীতি সংসার আর ছেলে নিয়ে আছে—সামনের বছরে ছেলেকে ভর্তি করতে হবে, কোথায় কেমন করে ভর্তি করবে সেটাই এখন তার সর্বক্ষণের চিন্তা।

হ্যাঁ—আজকাল ছেলেমেয়েদের পড়ানো যা একটা প্রবলেম হয়েছে। তা তোমার হঠাৎ আগমনের হেতুটা কি বল?

দিনপাঁচেক আগে একটা নিউজ বের হয়েছে কাগজে, দেখেছেন কিনা জানি না। পার্ক স্ট্রীটের একটা ম্যানসননীলাকাশ নাম, তার চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–

মনে পড়ছে না, তা কি সুইসাইড বুঝি—

তাহলে তো গণ্ডগোল মিটেই যেত।

সুদর্শন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলে গেল কিরীটীকে। সব শোনার পর কিরীটী বললে, তাহলে তোমার ধারণা—ব্যাপারটার মধ্যে কোন ফাউল প্লে আছে।

হ্যাঁ—আমার মনে হচ্ছে, ওটা আদৌ সুইসাইড নয়—

হোমিসাইড!

হ্যাঁ—আমার মনে হয়, রজতবাবুকে ঐ কালো কর্ডের ফাঁস গলায় দিয়ে হত্যা করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

হুঁ। তা তোমাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কি বলছে? মৃত্যুর কারণ কি বলছে রিপোর্টে?

গোলমালটা তো দাদা সেখানেই।

কি রকম!

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলছে—ফ্রাকচার অফ দি বেস-স্কালই নাকি মৃত্যুর কারণ—কজ অব ডেথ।

আর ঐ গলার ফাঁসটা?

বলছে তাদের মতে, ঐ সরু কৰ্ডটা গলায় চেপে বসলেও সেটা নাকি মৃত্যুর কারণ নয়–কারণ–

কি?

কোন অ্যাসফেসিয়ার চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি মৃতদেহে।

কিরীটী বললে, তা কেসটা যে একটা মার্ডার—গলার ঐ কালো কর্ডের ফসটি ছাড়া আর কোন যুক্তি তোমার আছে কি?

উপর থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেহের ইনজুরি আরও বেশী থাকত অর্থাৎ যে রকম পাওয়া যেত তাও পাওয়া যায়নি। আর চারপাশে রক্তও বেশী থাকত।

হুঁ। আর কিছু—

তারপর ধরুন দাদা, মৃত্যু ঘটেছে, রিপোর্ট বলছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময়ে। এবং তাই যদি হয় তো ঐ সময় ঐ অত বড় ফ্ল্যাটবাড়িটার মধ্যে কেউ কি এমন জেগে ছিল না যারা একটা মানুষের দেহ অত উঁচু থেকে নীচে পড়লে যে শব্দটা হওয়া স্বাভাবিক সেই রকম একটা শব্দ শুনতে পেত না! অথচ আমি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, সেরকম কোন শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। ব্যাপারটা কি বেশ একটু সন্দেহজনক নয়?

তা তো ঠিকই।

ধরেই নিলাম না হয়, আবার সুদর্শন বলতে লাগল, ব্যাপারটা একটা সুইসাইড—কিন্তু লোকটা হঠাৎ দুতিন দিনের ছুটি নিয়ে এসে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইসাইড করতে গেল কেন? সরিবাবু ও তার বোন বকুল দেবীর স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, বিবাহের দিন ঠিক করবার জন্যই সে আম্বালা থেকে এসেছিল—সেক্ষেত্রে বকুল দেবীর সঙ্গে দেখা হবার আগেই এমন কি ঘটে গেল যাতে করে তাকে ঐভাবে আত্মহত্যা করতে হল শেষ পর্যন্ত!

সুদর্শন থামে না। বলে চলে, অনন্য বক্সী ও তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর কথাটা তো ভুললে চলবে না—রজতবাবুর সঙ্গে একসময় বিপাশার ঘনিষ্ঠতা ছিল—এক পাড়ায় পাশাপাশিই বলতে গেলে বাড়িতে ওরা থাকত। আচমকা অনন্য বক্সী ওদের মাঝখানে এসে পড়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল—অনন্য বক্সীর সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিপাশার বিয়ে হয়ে গেল।

তুমি বলতে চাও, সেখানেও কোন গোলমাল থাকতে পারে—

পারে না কি! আপনিই বলুন!

খবর নিয়েছিলে এবারে কলকাতায় আসার পর বিপাশা ও রজতবাবুর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা? কিরীটী বললে।

না—এখনও খবর নিইনি।

কেন নিলে না?

আমি এখনও অনুসন্ধান চালাবার মত কোন একটা নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাইনি। আর সেই কারণেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি–

কিরীটী একটু চুপ করে থেকে বললে, সুদর্শন, তোমার মুখ থেকে কেসটা সম্পর্কে যতটুকু শুনলাম তাতে আমার মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা ফাউল প্লে থাকা হয়ত বিচিত্র নয়। তুমি আপাতত এক কাজ কর।

বলুন দাদা–সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল সুদর্শন।

তোমরা জানতে পেরেছ শনিবার সকালে রজতবাবু কলকাতায় এসেছিলেন এবং এসে উঠেছিলেন তাঁর বন্ধু সরিৎবাবুর নীলাকাশের চারতলায় ১৪নং খালি ফ্ল্যাটে এবং আরও জানা গেছে একমাত্র সরিৎবাবুর ভৃত্য পঞ্চানন—ঐ পঞ্চাননের কাছ থেকে এবং তার সঙ্গেই কেবল রজতবাবুর দেখা হয়েছিল—খোঁজ করে দেখ—আর কারও সঙ্গে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ঐ দিন সকাল থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঐ ১৩১৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ : হয়েছিল কিনা, অবশ্যই তার পরিচিতদের মধ্যে কারও। আচ্ছা পঞ্চানন তো সন্ধ্যার কিছু আগে ছুটি নিয়ে যায় রাত্রের মত—তাই না?

হ্যাঁ-রজতবাবু তাকে রাত্রের মত ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন।

এমনও তো হতে পারে সুদর্শন, সে ছুটি হয়তো রজতবাবু ইচ্ছা করেই দিয়েছিলেন পঞ্চাননকে–মানে কোন বিশেষ কারণে পঞ্চাননের ঐ সময়টা ফ্ল্যাটে উপস্থিতি চান নি বলেই সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত। আরও একটা খবর তোমায় জানতে হবে, নীলাকাশে আসার পর রজতবাবু বের হয়েছিলেন কিনা আর বের হলে কতক্ষণের জন্য বের হয়েছিলেন—পঞ্চাননকে কি বলে গেছেন কোথায় যাচ্ছেন বা কিছু। এবং ঐ সময়ের মধ্যে অর্থাৎ যতক্ষণ ফ্ল্যাটে ছিলেন এবং পঞ্চাননও ছিল—কেউ রজতবাবুর সঙ্গে ফ্ল্যাটে দেখা করতে এসেছিল কিনা। কথাটা তো তুমি পঞ্চাননকে প্রশ্ন করেও জানতে পার।

তা পারি।

হ্যাঁ মনে রেখো পঞ্চানন is a very important clue এই রহস্যের ব্যাপারে। তাকে sidetrack করে যেয়ো না। কারণ একমাত্র ঐ পঞ্চাননই তোমাকে বলতে পারবে—ঐদিন সকাল থেকে ঐ ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ পঞ্চানন ফ্ল্যাটে ছিল—ঐ সময়ে রজতবাবুর detail movements ও activities সম্পর্কে। ওটা জানা তোমার একান্তভাবেই দরকার। সেই সঙ্গে আরও একটা কাজ তোমাকে করতে হবে–

কি দাদা–বলুন?

অনন্য বক্সী ও তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর সঙ্গে দেখা করে তারা ওর এবার কলকাতায় আসা সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা সেটাও তোমার জানা দরকার।

অতঃপর তখনকার মত সুদর্শন বিদায় নিল।

সুব্রত এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবারে বললে, আচ্ছা কিরীটী, এমনও তো হতে পারে—সরিৎবাবু যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা সব নয়—

কি রকম?

মানে সরিৎবাবু যা বলেছেন তার বন্ধু সম্পর্কে সেটা সব নয়-বন্ধু যখন, তখন আবার অনেক কিছুই হয়ত রজবাবু সম্পর্কে জানেন তিনি—জানাটাও স্বাভাবিক এবং ব্যাপারটা তারই ওখানে ঘটেছে বলে হয়ত অনেক কিছু বলেন নি–চেপে গেছেন অনেক কথা।

কথাটা তোর হয়ত মিথ্যা নয় সুব্রত—কথাটা আমার মনে হয় নি—তুই সুদর্শনকে বললি কেন! আমার মাথার মধ্যেকার গ্রে সেলগুলো সত্যিই বোধ হয় বয়সের দরুন অ্যাট্রফি করে গেছে। নচেৎ–

না—কিরীটী রায় এখনও কিরীটী রায়–casually ব্যাপারটা আলোচনা করছিলি বলেই হয়ত এতক্ষণ কথাটা তোর মনে হয়নি–

কৃষ্ণা এসে ঐসময় ঘরে ঢুকল। বললে, সুদর্শনবাবু এসেছেন?

হ্যাঁ, এসেছিল। এইমাত্র চলে গেল।

তা হঠাৎ এতদিন পরে!

সুব্রতই বললে, বেচারা একটা জটিল মামলায় জড়িয়ে পড়েছে।

খুনোখুনির কোন ব্যাপার নিশ্চয়ই!

সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, অবিশ্যি সুদর্শনের ধারণা তাই।

কি রকম?

এক ভদ্রলোক চারতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন—তার তদন্ত করতে গিয়ে সুদর্শনের ধারণা হয়েছে—ওটা তা নয়—একটা মার্ডার। হত্যা!

শকুনের দৃষ্টি সব সময় ভাগাড়ের দিকে, কৃষ্ণা বললে।

তুমি কি মনে কর কৃষ্ণা, কিরীটী মৃদু হেসে বললে, পুলিশ কেবল খুন-ডাকাতি খুঁজেই বেড়ায়!

তা ছাড়া কি? যত সব নৃশংস ব্যাপার!

না কৃষ্ণা, ওরা সদাসতর্ক চোখ মেলে আছে বলেই সমাজের আর দশজন নিশ্চিন্ত হয়ে আছে, ওরা যে সোসাইটির কত বড় উপকার করে

বুঝেছি আর ওদের গুণকীর্তন গাইতে হবে না! সুদর্শন তোমাকে সক্রিয় করে গেছে। তা ঘটনাটা সত্যি কি বল তো সুব্রত?

সুব্রত তখন সংক্ষেপে ঐদিনকার সকালবেলার আলোচনার সারাংশটা বিবৃত করে গেল। সব শুনে কৃষ্ণা বললে, সুদর্শন বোধ হয় ঠিকই অনুমান করেছে।

তোমারও ধারণা তাহলে—

হ্যাঁ খুন—পরিষ্কার মার্ডার। দুটি পুরুষ-দুটি নারী। গণ্ডগোেল ঐ চার মূর্তিকে নিয়েই।

কি রকম? সুব্রত শুধালে।

রজতশুভ্র, অনন্য বক্সী–বিপাশা আর বকুল। কি গো, তুমি যে একেবারে চুপচাপ? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কৃষ্ণা।

ভাবছি—

কি, শুনি?

পুরুষ না নারী?

নারী কখনই নয়–

তা হলে তো তোমার মতে ঐ অনন্য বক্সীই রজতশুভ্রর গলায় ফাঁস দিয়ে চারতলার ব্যালকনি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।

আমি কি তাই বলছি! আমি বলেছি কেবল গোলমালটা ঐখানেই—

কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে–অর্থাৎ যদি অনন্য বক্সীই হয়—তার রয়েছে স্ট্রং অ্যালিবাই— বালিগঞ্জ সারকুলার রোড আর পার্ক স্ট্রীটে যেমন যথেষ্ট ব্যবধান—তেমনি সে ব্যবধান অতিক্রম করে গেলেও সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে অত রাত্রে আকস্মিক প্রবেশ নিশ্চয়ই রজতশুভ্র (যদি অবিশ্যি তাই হয়ে থাকে) নিশ্চয়ই ভাল চোখে দেখেননি—হৃষ্টমনেও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি।

কেন শুনি? কৃষ্ণার প্রশ্ন।

বুঝলে না—পরস্পর তো পরস্পরের প্রেমের রাইভ্যাল ছিলেন!

কৃষ্ণা বললে, তাই হয়তো একটা ড়ুয়েল লড়ে গেছেন দুজনে সেই রাত্রে ঐ ফ্ল্যাটে—

সুব্রত বললে, ফলে একজনের মৃত্যু।

কৃষ্ণা ঝাঝিয়ে ওঠে, কেন–হতে পারে না?

পারবে না কেন, পারে পারে কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছ রজতশুভ্র ছিলেন একজন আর্মি অফিসার। আগ্নেয়াস্ত্র নিশ্চয়ই কিছু একটা তাঁর কাছে ছিল—সেক্ষেত্রে কিরীটী বললে, দেখ তুমি যাই বল—

কৃষ্ণা বললে, অনন্য বক্সীর উপরে আমার সন্দেহ হচ্ছে—

অর্থাৎ তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে, কিরীটী বললে, অনন্য বক্সীর মনের মধ্যে তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর প্রণয়ীর সম্পর্কে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সে দ্বন্দ্বটা ধূমায়িত হতে হতে পর্বতের আকার ধারণ করেছিল—অ্যারাবিয়ান নাইটের সেই গল্প, কলসীর থেকে ধোঁয়া বেরুতে বেরতে এক দৈত্যের আকার ধারণ করেছিল–

কৃষ্ণা হেসে ফেলে।

হাসছ কি–কিছুই বিচিত্র নয়। মানুষের মন না মতি। তোমার ইঙ্গিতটা সত্যিই রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু আপাতত এক পেয়ালা কফি হলে মন্দ হত না।

সকাল থেকে ক’কাপ হয়েছে জান?

এত ভোলা মন নয় আমার—এবারে হলে হবে পঞ্চম।