যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ২

০২.

ওল্ড বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পাশেই বক্সীর বাড়ি। চারতলা বাড়ি। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন অনন্য বক্সীর বাবার বাবা অরিন্দম বক্সী বার-এট-ল। অরিন্দম বক্সী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামজাদা ব্যারিস্টার। প্রচুর ইনকাম ছিল তাঁর। এক মেয়ে এক ছেলে—অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী আর শ্রীমতী।

অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সীও বিলাত গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে, কিন্তু ব্যারিস্টার হয়েই ফিরে এসেছিলেন কয়েকটা বছর সেখানে স্ফুর্তি করে। অবিশ্যি ব্যারিস্টারি পাস করবার প্রয়োজনও ছিল না তার কারণ বাপের ঐ বাড়ি ছাড়াও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ছিল এবং সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট। অনন্যর মা প্রতিমা নামেও প্রতিমা ছিলেন, দেখতেও যেন প্রতিমার মত—যে কলেজে পড়তেন প্রতিমা, সেখানকার কলেজ-বিউটি ছিলেন তিনি।

অনিন্দ্য বক্সীর হবি ছিল গলফ আর পিংপংকলকাতা শহরের একটা নামজাদা ক্লাবের মেম্বার ছিলেন তিনি। অবিশ্যি সবই পরে ডাঃ দাশগুপ্ত একটু একটু করে প্রশ্ন করে করে অনন্য বক্সীর মুখ থেকেই শুনেছিলেন। আরও একটা ব্যাপার, অনিন্দ্য বক্সীর নেশা ছিল মদ্যপান। স্কচের একজন যাকে বলে কনোসিয়োর ছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যেই একটা বার তৈরি করেছিলেন। ক্লাবে তিনি কিন্তু মদ্যপান করতেন না—মদ্যপান করতেন গৃহে ফিরে। এবং একা নয়—সে সময় তার সঙ্গিনী হতেন তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা অবিশ্যি দু-এক পেগের বেশী কোনদিনই পান করতেন না, কিন্তু মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চালিয়ে যেতেন অনিন্দ্য বক্সী।

ড্রাইভার রতন সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।

পিছনের সীটে পাশাপাশি বসেছিল অনন্য আর বিপাশা। বিপাশার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে অন্ধকারে অনন্য বিপাশার সরু সরু নরম নরম আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করছিল নিঃশব্দে আপন মনে।

বিপাশা!

বল।

আমার এই ব্যাধি কি কোন দিনই সারবে না?

কেন সারবে না—ডাঃ দাশগুপ্ত অত বড় ডাক্তার—দেখো তুমি, ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।

আচ্ছা উনি তো ঘুমের একটা ওষুধ দেবেন বলছিলেন—লিখে দিলেন না?

আমাকে বলে দিয়েছেন।

দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

ওষুধটা তাহলে দোকান থেকে নিয়ে নাও না।

দরকার হবে না আজই, আমাকে দুটো ক্যাপসুল দিয়ে দিয়েছেন–বলেছেন আজ আর কাল খাবার পর পরশু সকালে ফোনে জানাতে।

কিছুই হবে না—দেখো ঠিক রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যাবে।

না, দেখো ভাঙবে না।

তুমি জান না বিপাশা—আমি জানি ঘুম ঠিক ভেঙে যাবে, আর সেই কুয়াশাটা চারপাশ থেকে অক্টোপাসের মত অষ্টবাহু মেলে আমাকে তার কুক্ষিগত করবে। তারপর সেই চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর—যাও, যাও—এগিয়ে যাও–

না, কিছু আর হবে না দেখো, বিপাশা জোরগলায় যেন বলে কথাটা।

বিপাশা!

কি! একটা কথা এতদিন তোমায় কখনও বলিনি, আজ বলছি—

কি কথা?

আমি–আমিও বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাবারই মত—

ছিঃ, কি আবোল-তাবোল চিন্তা কর বল তো!

আবোল-তাবোল নয়, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে আমি সেই দিকেই এগিয়ে চলেছি—টু দ্যাট এন্ড–

ফের ঐসব আজেবাজে কথা যদি তুমি বল, আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।

রাগ করো না বিপাশা—আমার ওপরে তুমি রাগ করো না, তুমি রাগ করলে আমি কোথায় যাব!

কেন তুমি ঐসব তাহলে বল?

আর বলব না।

ওদের গাড়িটা একসময় এসে গেট দিয়ে ঢুকে পোর্টিকোর সামনে দাঁড়াল। দারোয়ান রামভরোসে এগিয়ে এল।

সাব—

কি হয়েছে?

একজন সাহেব সন্ধ্যের দিকে এসেছিলেন—

কে–কি নাম–কিছু বলেছে?

না। কেবল আপনার আর মাঈজীর খোঁজ করছিলেন—

বসতে বললি না কেন? অনন্য বলল।

বলেছিলাম কিন্তু বসলেন না, বললেন, আবার আসবেন।

অনন্য শুধায়, কিরকম দেখতে সাহেবকে?

খুব লম্বা-চওড়া চেহারা, চোখে চশমা, মুখে পাইপ—

ঠিক আছে, তুম গেট বন্ধ কর দো।

রামভরোসে চলে গেল সেলাম জানিয়ে।

ওদের আসার সাড়া পেয়ে পুরাতন ভৃত্য পরেশ এসে দরজা খুলে ইতিমধ্যে দাঁড়িয়েছিল।

দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল।