যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ১২

১২.

দাদা–সুদর্শন ডাকল।

কি, বল।

বকুল দেবীই তাহলে হত্যাকারিণী রজতবাবুর?

না।

কিন্তু–

বকুল দেবীর অবিশ্যি ধারণা শ্বাসরোধেই রজতশুভ্রর মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তা নয়। জ্ঞান হারিয়েছিলেন মাত্র রজতশুভ্র-বকুল দেবী উত্তেজনার মাথায় রজতবাবুর গলার কারটা দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চাইলেও রজতবাবুর মৃত্যু তাতে ঘটেনি।

তাহলে কে সে—কে হত্যাকারী?

বকুল দেবী রজতবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন হতভম্ব হয়ে হয়ত বসে ছিলেন, আর তখুনি জোরে বেলটা বোধ হয় বেজে ওঠে ভয় পেয়ে বকুল দেবী পাশের ঘরে সম্ভবত আত্মগোপন করলেন, পাছে ধরা পড়ে যান। দরজাটা খোলাই ছিল—সেই খোলা দরজাপথে এবারে হত্যাকারী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। লোকটা কে এবং কি করছে—অতঃপর আমার অনুমান, দরজার আড়ালে থেকে বকুল দেবী সবই দেখেছেন সেরাত্রে।

তবে—তবে তিনি তার নামটা প্রকাশ করছেন না কেন? আর হত্যাকারীই বা ঘরে কেউ আছে কিনা পরীক্ষা না করে না দেখে বাকি কাজটা করল কেন?

হয়ত-হয়ত দুজনার মধ্যে দেখা হয়েছিল—

দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ—আমার অনুমান তাই, এবং যেহেতু উভয়ে উভয়ের হয়তো পরিচিত বলেই কেউ মুখ খোলেনি।

আপনি তাহলে বুঝতে পেরেছেন দাদা, রজতবাবুর হত্যাকারী কে?

অনুমান করতে পেরেছি বৈকি। কিন্তু একটা জায়গায় বিশ্রী একটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে সুদর্শন–জটটা না খোলা পর্যন্ত হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারছি না। কাল তো রবিবার–

হ্যাঁ।

কাল সকাল দশটা নাগাদ এস আমার ওখানে একবার, ডাঃ দাশগুপ্তর ওখানে যাব—তারপর

তারপর কি?

অনন্য বক্সীর গৃহে।

সুদর্শন কিরীটীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডাঃ মনসিজ দাশগুপ্তের সঙ্গে কিরীটীর কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না—কিরীটী সুদর্শনকে বলেছিল পরের দিন সকালে তাকে নিয়েই ডাঃ দাশগুপ্তের ওখানে যাবে, কিন্তু কিরীটী সকালবেলাই ডাঃ দাশগুপ্তকে ফোন করে তার গৃহে চলে গেল সুদর্শন আসবার আগেই।

কিরীটীর নামই শুনেছিলেন ডাঃ দাশগুপ্ত, চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না। বললেন, কি সৌভাগ্য আমার–কোন দিন ভাবিনি আপনার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ আসবে—বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য?

আপনার এক রোগী সম্পর্কে কিছু জানবার জন্য আমি এসেছি ডাঃ দাশগুপ্ত—

রোগী?

হ্যাঁ, আপনি অনন্য বক্সীর চিকিৎসা করছেন শুনেছি—

ঠিকই শুনেছেন–কার কাছে শুনলেন?

তার স্ত্রীর কাছে। আপনাদের মনোবিজ্ঞানের সব দুরূহ রোগের সঙ্গে আমারও কোন পরিচয় নেই—আপনি যদি অনন্য বক্সীর ব্যাপারটা আমাকে একটু বলেন।

ইট ইজ এ কমপ্লিকেটেড কেস!

কি রকম।

বলতে পারেন সাধারণ কথায়—তার মধ্যে সর্বক্ষণ একটা ড়ুয়েল পার্সোনালিটির টানাপোড়ে চলেছে। আর সেটার মূলে, আমার ধারণা, তার মার একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু–

আপনি জানেন কিসে তার মার মৃত্যু ঘটেছিল?

না, কেবল ওঁরা বলেছেন একটা দুর্ঘটনায়—

তার মাকে তার বাবা গলা টিপে হত্যা করেছিলেন।

সত্যি?

হ্যাঁ। তারপর দোতলা থেকে নীচে ফেলে দেন মৃতদেহটা।

হরিবিল। তা আপনি জানলেন কি করে?

বিপাশা দেবীই বলেছেন।

তিনি তাহলে ব্যাপারটা জানতেন?

না, মাত্র গতকালই তাঁর স্বামীর মুখ থেকে সব শোনেন। অনন্যবাবু বললেন, ব্যাপারটা তাঁর। চোখের সামনেই ঘটেছিল।

তা হঠাৎ তাকে হত্যা করলেন কেন ভদ্রলোক?

স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ হওয়ায়, অথচ ভদ্রমহিলা ইনোসেন্ট ছিলেন।

হুঁ। এখন বুঝতে পারছি—সেটাই ক্রমশ অনন্যবাবুর মধ্যে একটা জটিল কমপ্লেকসের সৃষ্টি করেছিল-যার ফলে তার মধ্যে একটা সুইসাইডাল টেনডেনসি ডেভলাপ করেছে। কিন্তু সৌভাগ্য, তাঁর স্ত্রী সত্যিই তাকে ভালবাসেন তিনিই এযাবৎকাল তাকে রক্ষা করে আসছেন—তবে শেষ পর্যন্ত পারবেন কিনা জানি না।

আপনি নীলাকাশের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে পড়েছেন ডাঃ দাশগুপ্ত?

পড়েছি।

তাকে হত্যা করা হয়েছে—

সুইসাইড নয় তাহলে ব্যাপারটা?

না। আচ্ছা আমি তাহলে উঠি—

এক কাপ চা খাবেন না?

পরে একদিন আসব—আজ নয়—আজ আমার একটু বিশেষ তাড়া আছে।

কিরীটী গৃহে প্রত্যাবর্তন করে দেখে সুদর্শন তার অপেক্ষায় বসে আছে।

কতক্ষণ ভায়া!

তা প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে। সুদর্শন বললে।

চল—অনন্য বক্সীর ওখানে যাওয়া যাক।

অনন্য বক্সীর গৃহে পৌঁছে কিরীটী জানতে পারল, অনন্য বক্সী কোথায় বের হয়েছেন।

বিপাশা ছিল।

কিরীটী পরেশকে বললে, মাকে বল কিরীটীবাবু এসেছেন–

পরেশ খবর দিতে গেল।

একটু পরে এসে বললে, উপরে চলুন বসবেন—

দুজনে উপরের হলঘরে গিয়ে বসল।

একটু পরে বিপাশা এল।

কিরীটী বললে, বসুন বিপাশা দেবী—

বিপাশার সমস্ত চোখেমুখে যেন একটা ক্লান্ত বিষণ্ণতা। চোখ দুটো বসে গেছে।

বিপাশা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল বিষণ্ণ ক্লান্ত দৃষ্টি তুলে।

আপনি আমাদের গতকাল সবটুকু সত্য প্রকাশ করে বলেন নি—

বলিনি! কি বলিনি? বিপাশার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত।

আপনি সে রাত্রে ঠিক কখন নীলাকাশ থেকে ফিরেছিলেন?

রাত দশটা নাগাদ।

না।

আমি–

না, তার আরও পরে আপনি ফিরেছিলেন সেরাত্রে—আর সেখানে আপনার সঙ্গে বকুল দেবীর দেখা হয়েছিল।

না, না,–বকুলকে আমি দেখিনি।

শুনুন—অবিশ্যি আমার অনুমান—আপনি বেরুবার মুখেই বকুলদেবী গিয়ে বোধ হয় ঘরে ঢোকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনি পাশের ঘরে গিয়ে আত্মগোপন করেন–

আমি—

বলতে দিন আমায়-বকুল দেবী হয়ত আপনাকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন—আর সেটাই তার ক্রোধে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে রজতবাবুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাই না?

হ্যাঁ।

তারপর রজতবাবুর গলার কারটা দিয়ে বকুল দেবী রজতবাবুর গলায় ফাঁস দেন।

হ্যাঁ।

রজতবাবু শ্বাসরোধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। ঠিক সেই সময় আর একজন ঘরে এসে ঢোকে—তাকেও আপনি দেখেছেন—কেবলুন বলুন—তাকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন—

জানি না—আমি জানি না—চিনতে পারিনি। চিৎকার করে ওঠে বিপাশা।

পেরেছিলেন চিনতে বলুন—আমি বলছি, আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন।

না-না-না-না–দুহাতে মুখ ঢাকল বিপাশা।

আপনার স্বামী অনন্যবাবু, তাই নয় কি! বলুন বিপাশা দেবী বলুন!

বিপাশা চুপ।

বকুল দেবী তখন ঘরের মধ্যেই—দুজনাই আপনারা ঘরের মধ্যে ছিলেন তখন—এবারে বলুন, রজতবাবুর অচৈতন্য দেহটাকে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেন আপনার স্বামীই কী?

না।

তবে?

সে রজতকে মৃত দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-অনন্য নির্দোষ।

আপনারা—তাহলে কি আপনারাই দুজনে মিলে—

হ্যাঁ, আমরাই তখন দুজনে পরামর্শ করে রজতের মৃতদেহটা ধরাধরি করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিই—

অথচ আপনি জানেন না, জানতেও পারেন নি রজতবাবু তখনও বেঁচেই ছিলেন।

বেঁচে ছিল রজত? নানা, তা হতেই পারে না।

হ্যাঁ, বেঁচে ছিলেন।

আমি—আমিই তাহলে রজতকে হত্যা করেছি, কারণ আমারই পরামর্শে বকুল সম্মত হয়ে আমাকে সাহায্য করেছিল-রজতকে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিতে–

আমার মতে কিন্তু তা নয়—

বিপাশা স্তব্ধ অনড় হয়ে বসেছিলেন।

তাঁর দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আপনি চেয়েছিলেন রজতবাবুর হাত থেকে মুক্তি বিপাশা দেবী, আর বকুল দেবী চেয়েছিলেন তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতি রজতবাবু যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তার সঙ্গে প্রেমের একটা অভিনয় করে চলেছিলেন এতদিন ধরে, তার বদলা নিতে ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে। আপনারা হয়ত রজতের দেহটা নীচে ফেলে দেবার পরামর্শও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেননি—দুজনে আপনারা রজতকে ঐ অবস্থায় ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন—

বিপাশা যেমন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, তেমনিই বসে রইল।

হঠাৎ কিরীটী বললে, চল সুদর্শন!

সুদর্শন একটা কথাও বলল না, কিরীটীর নির্দেশমত উঠে দাঁড়াল। দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

আর বিপাশা যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল।

জীপে উঠে সুদর্শন প্রশ্ন করল, কে তাহলে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি দিয়ে নীচে ফেলে দিল দাদা?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও বুঝতে পারনি!

না।

বোঝা উচিত ছিল—আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখ, দেখবে হত্যাকারী কে–

সত্যি বলছি, এখনও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকছে দাদা। তবে কি অনন্যবাবুই পরে আবার ফিরে এসে—

না।

তবে? কে ফেলল নীচে রজতবাবুর দেহটা?

মনে কর না, ব্যাপারটা নিছক একটা সুইসাইড ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি সুইসাইড করে বিপাশাকেও মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন এবং হয়ত সেই সঙ্গে অনন্যবাবুর কমপ্লেকস যেটা তার বাপমার ব্যাপারকে কেন্দ্র করে উঠেছিল, সেটারও অবসান করে দিয়ে গিয়েছেন—

কি রকম?

এবারে হয়ত অনন্যবাবু বুঝতে পারবেন, বিপাশা তাকে সত্যিই ভালবাসেন। রজতবাবু তাঁর জীবনের পাতা থেকে একেবারে মুছে গিয়েছে চিরকালের মত। এবং বকুল দেবীও একটা শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বেঁচে গেছেন।

কিন্তু তাহলে কি রিপোর্ট দেবেন?

এটা একটা সুইসাইড—আমি তাই বলব।

তাহলে বিপাশা ও বকুল দেবী

না, ওঁরাই ধরাধরি করে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন–

তাহলে ঐ কথা আপনি বললেন কেন?

সুদর্শন, কেন যে ও-কথা বলে এলাম, আজ তুমি না বুঝলেও একদিন হয়ত বুঝতে পারবে বুঝতে পারবে ঐ কথা বলা ছাড়া কিরীটী রায়ের সামনে আর দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না।

প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারছি, সব কিছুর উপরে একজন আছেন–তিনি যেমন পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তার এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও–ভুলে যাও সব ব্যাপারটা—

 দাদা, এতদিন জানতাম কিরীটী রায়ের কাছে অন্যায়ের পাপের কোন ক্ষমা নেই কিন্তু আজ বুঝলাম, এত বড় ক্ষমা বোধ হয় একমাত্র কিরীটী রায়ের পক্ষেই সম্ভব।

ওরে না না—আমিও মানুষ—দোষ-গুণ-ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই তোমাদের কিরীটী রায়।

গাড়ি তখন কিরীটী বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছে।

কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে গেল।

আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ মৃদু আলোর ঝরনা দিয়ে যেন পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল।