যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ১১

১১.

লালবাজারে ফিরে এসে সুদর্শন দেখে সরিৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

সরিৎবাবু–কি ব্যাপার—

দেখুন মিঃ মল্লিক, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি—অবশ্যই আমার বলা উচিত ছিল—

কি কথা?

সরিৎ পকেট থেকে কাগজ-মোড়া একটা ছোট রুমাল, দুটো টুকরো পোড়া সিগারেটের শেষাংশ ও লাল প্লাস্টিকের চুড়ির ভাঙা টুকরো বের করে সুদর্শনের সামনে টেবিলের ওপরে রাখল।

এ তো দেখছি দুটুকরো ভাঙা প্ল্যাস্টিকের চুড়ির অংশ, একটা লেডিজ রুমাল, আর দুটো পোড়া সিগারেটের অংশ! এসব কোথায় পেলেন সরিৎবাবু?

পরশু সকালে আমার বসবার ঘরে—পঞ্চানন ঝট দিতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছে।

আপনার বসবার ঘরে?

হ্যাঁ।

সুদর্শন প্রথমেই রুমালটা তুলে নিল, রুমালে তখনও রয়েছে মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধ এবং আরও একটা গন্ধ-গন্ধটাকে ঠিক কিসের গন্ধ সুদর্শন বুঝে উঠতে পারে না। প্ল্যাস্টিকের চুড়ির ভাঙা টুকরো দুটো পরীক্ষা করল—শেষে সিগারেটের শেষাংশ দুটো—দামী বিলাতী সিগারেট–ক্যারাভান এ মার্কাটা তখনও পড়া যায়।

এগুলো মনে হল, সরিৎ বললে, আমার ঘরে পাওয়া গিয়েছে আপনাকে জানানো দরকার বলেই নিয়ে এলাম।

জিনিসগুলো আবার কাগজে মুড়ে সুদর্শন ড্রয়ার খুলে তার মধ্যে রেখে দিয়ে বললে, ধন্যবাদ সরিৎবাবু।

সরিৎ বললে, আমি কিন্তু সিগারেট খাই না, মিঃ মল্লিক!

আপনার বন্ধু রজতবাবু স্মোক করতেন না?

না।

কখনও সখ করেও না।

না, আগে তো কখনও দেখিনি—তবে ইতিমধ্যে যদি সে সিগারেট ধরে থাকে বলতে পারি।

কতদিন তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

তা ধরুন প্রায় বৎসরখানেক—

তিনি কতদিন আম্বালায় ছিলেন?

মাস চারেক আগে সে আম্বালায় পোস্টে হয়ে এসেছিল—

ঠিক আছে—আপনি এখন আসুন।

সরিৎ বিদায় নিল।

সুদর্শনও বসল না। কিরীটীর সঙ্গে একবার দেখা করা প্রয়োজন–উঠে পড়ল সুদর্শন। কিরীটীর ওখানে গিয়ে দেখল কিরীটী কোথায় বের হয়েছে–কৃষ্ণা বললে, সুব্রতকে নিয়ে বের হয়েছে ঘণ্টা দুই আগে—ফেরার সময় হয়েছে, তুমি বোস না।

ঠিক আছে বৌদি-আমি বসছি।

কিরীটী আর সুব্রত ফিরে এল আরও আধঘণ্টা পরে, ঘরে ঢুকে সুদর্শনকে দেখে বললে, সুদর্শন কতক্ষণ?

তা প্রায় আধ ঘণ্টা–

কিরীটী বসতে বসতে বললে, তোমার কেসটায় শেষ পর্যন্ত আমাকেও জড়িয়ে পড়তে হল ভায়া–

তাই নাকি।

হ্যাঁ-এরিয়া কমান্ড অফিস থেকে ব্রিগেডিয়ার শর্মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই গিয়েছিলাম, শর্মার সঙ্গে আমার অনেক কালের পরিচয়—ভারি চমৎকার লোক।

তা হঠাৎ সেখানে—তার আবার আপনাকে কি প্রয়োজন পড়ল!

ক্যাঃ চৌধুরীর ব্যাপারটা নিয়েই—

ক্যাঃ চৌধুরী।

হ্যাঁ—তোমাদের রজতশুভ্র। হেড কোয়ার্টার থেকে জরুরী নির্দেশ এসেছে, রজতশুভ্রর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখবার জন্য।

তাই বুঝি ব্রিগেডিয়ার শর্মা–

হ্যাঁ, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ফোনে অবিশ্যি ব্যাপারটা বলেননি—কেবল। বলেছিলেন, বেচারী ভীষণ বিপদে পড়েছেন—আমি যদি তাকে একটু সাহায্য করি।

এ তো ভালই হল দাদা। কিন্তু তারাও কি ব্যাপারটা একটা হোমিসাইড বলে ধরেছে!

পুলিশের বড়কর্তা আই. জি. মিঃ গুপ্ত নাকি তাই বলেছেন শর্মাকে। শর্মা মিঃ গুপ্তকে অনুরোধ করেছেন আমাকে যথাসম্ভব মদৎ দেবার জন্য। মিঃ গুপ্তও সেখানে ছিলেন।

তাহলে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে বলুন দাদা!

তা কতকটা চিন্তিতই বলে যেন মনে হল এখানকার কমান্ড হেডকোয়ার্টারকে। তারপর তোমার কথা বল।

আমার কথা—

কতদূর এগুলে বল না, যেখানে ছিলে এখনও সেখানেই আছ?

সুদর্শন একে একে ঐদিনের ঘটনা সব বলে গেল এবং সবশেষে কাগজের মোড়কটা পকেট থেকে বের করে কিরীটীর হাতে দিয়ে বলল, এগুলো দেখুন দাদা। কিরীটী চুড়ির টুকরো, সিগারেটের টুকরো পরীক্ষা করে রুমালটা নাকের সামনে তুলে ধরে শুঁকতে শুঁকতেই একসময় সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল।

সুদর্শন!

বলুন দাদা—

রুমালে মাখা সেন্টের গন্ধ ছাপিয়ে যে একটা পরিচিত গন্ধ নাকে আসছে!

কিসের গন্ধ দাদা?

মনে হচ্ছে ক্লোরোফর্মের গন্ধ।

ক্লোরোফর্মের গন্ধ?

হ্যাঁ–ইয়েস—আবার একবার ভাল করে রুমালটার ঘ্রাণ নিয়ে কিরীটী বললে, হ্যাঁ  ভায়া— it is chloroform! এই রুমালে যে ক্লোরোফর্ম মাখানো হয়েছিল, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে এই ফেইন্ট গন্ধ থেকে। রুমালটা নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটের ঘরের মেঝেতে পাওয়া গিয়েছে যখন—কিরীটী আর কিছু বলল না। তবে সুদর্শনের মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।

সুদর্শন—

বলুন দাদা–

আমি এখন একেবারে নিশ্চিন্ত একটা ব্যাপারে। ক্যাঃ চৌধুরীকে সেরাত্রে হত্যাই করা হয়েছিল।

গলায় ফাঁস দিয়ে?

হয়ত ক্লোরোফর্ম আর ফাঁস দুটো একসঙ্গেই কাজ করেছে।

আপনি তাহলে বলতে চান দাদা, আগে ক্যাঃ চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে, তারপর ডেড বডিটা চারতলার ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা আত্মহত্যা দাঁড় করবার জন্য!

হয়ত তাই—তবু কিন্তু সব কিছুর মধ্যে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে।

খটকা!

হ্যাঁ—ফাঁসটা খুলে নিল না কেন হত্যাকারী—আর ফাঁসই লাগিয়ে যদি হত্যা করা হয়ে থাকত-ক্লোরোফর্মের প্রয়োজন হল কেন? কেবলমাত্র ফাঁস লাগিয়ে বা কেবলমাত্র ক্লোরোফর্ম নিয়েই যখন ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যেত, তখন দুটোরই প্রয়োজন হল কেন?

হয়ত ফাঁস লাগাবার পরে struggle করছিল ক্যাঃ চৌধুরী, তখন ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছে!

তুমি যা বলছ তা হয়ত অসম্ভব কিছু নয় ভায়া–কিন্তু তাহলে—

কি দাদা?

He or She!

মানে?

মানে হত্যাকারী কোন পুরুষ না স্ত্রীলোক। সেই প্রশ্নটাই সর্বপ্রথম মনে জাগবে। নাহে, ব্যাপারটা গোলমেলে। Complicated!

কিরীটী একটু থেমে কতকটা যেন আপনমনেই বলতে লাগল, সত্যি মানুষের মন কি বিচিত্র। আর কি বিচিত্ৰই না মানুষের ভালবাসার টানাপোড়েন। কি জান ভায়া—এখন আমি প্রায়ই ভাবি—ভালবাসার সত্যিকারের সংজ্ঞাটা কি। প্রেম কাকে বলে। শুধু কি পরস্পরের প্রতি নারীপুরুষের পরস্পরের একটা দেহগত যৌনাত্মক আকর্ষণ, না ঐ স্থূল যৌন আকর্ষণের বাইরেও কিছু আছে!

সুব্রত এতক্ষণ ওদের কথা নিঃশব্দে শুনছিল, এবারে বললে, যৌনানুভূতিকে বাদ দিয়ে ভালবাসা বা প্রেম বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিরীটী।

না রে সুব্রত, আমি তোর কথাটা পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে পারলাম না।

কেন?

এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দুটি পুরুষ ও দুটি নারী আছে—অনন্য আর রজতশুভ্র-বিপাশা আর বকুল। বিপাশা যাই বিবৃতি দিন না কেন, তার হয়ত কোন এক সময় সত্যিই কিছু দুর্বলতা ছিল তার প্রতিবেশী রজতশুভ্রর উপরে এবং যেটা সে ভুলবার চেষ্টা করেছে তার জীবনে অনন্যর আবির্ভাবের পর এবং ভুললেও হয়ত একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি রজতশুভ্রকেনচেৎ সে ঐ রাত্রে নীলাকাশের ফ্ল্যাটে রজতের সঙ্গে দেখা করতে যেত না।

সে তো সে গিয়েছিল, সুব্রত বললে, নিছক প্রাণের দায়ে।

অত্যন্ত দুর্বল explanation!

মানে?

সেও অনায়াসেই তার স্বামীকে সব কথা জানাতে পারত এবং সেখানে না গেলেও পারত।

তবে সময় পেল কোথায়?

কেন, বাড়িতে ফোন তো ছিল।

তার স্বামী হয়ত অন্যরকম ভাবত–বিশ্বাস করত না তাকে হয়ত পুরোপুরি।

হ্যাঁ, সেও তাই ভেবেছিল—আর ভেবেছিল এই কারণে—

কি?

তার মনের মধ্যে তখনও রজতশুভ্রর প্রতি একটা অবচেতন স্বীকৃতি ছিল। কিম্বা—

কি বল?

স্বামীর দিক থেকে তার এমন কোন ভয়ের কারণ হয়ত ছিল, যেজন্য সে স্বামীকে শেষ পর্যন্ত জানাতে সাহস পায়নি। না রে—একটা গোলমাল কোথাও জট পাকিয়ে আছে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে!

গোলমাল?

হ্যাঁ—যেটা একমাত্র ওদের সঙ্গে কথা না বলে কোন মীমাংসায় পৌছানো সম্ভব নয়। সুদর্শন?

দাদা—

ওদের স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে না?

কেন পারবে না।

তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর—আর—

আর কি দাদাসুদর্শন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

বকুলের আপাতত তো পাটনায় ফেরা হতে পারে না। অনুরোধে না হলে তোমার পুলিশী অধিকার জারি করতে হবে।

আপনি বলতে চান দাদা, জোর করে বলে দেব সরিৎবাবুকে কথাটা—

প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। কারণ—

বলুন দাদা।

না, এখন থাকit is too early! তার আগে একবার নীলাকাশের ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখতে চাই।

কখন যাবেন বলুন?

আজ সন্ধ্যায়ই–

ঠিক আছে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।

সেই রাত্রির পর থেকেই—যে রাত্রে অনন্য ঘুমের মধ্যে বিপাশার গলা টিপে ধরেছিল—স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যেন একটা কোথায় সুক্ষ্ম চিড় ধরেছিল। মনে হচ্ছিল, দুজনই যেন দুজনার কাছ থেকে নিজেদের অজ্ঞাতেই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে—একটা যেন পরস্পরের সম্পর্কের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান রচিত হচ্ছে। অথচ দুজনাই প্রাণপণে সব কিছু ভুলে পরস্পর পরস্পরের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু পারছে না কিছুতেই পারছে না যেন। দুজনই দুজনার সঙ্গে কথা বলছে—কিন্তু ঠিক যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী নয়। একটা প্রাচীর যেন ওদের দুজনার মধ্যখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

 সেদিন অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে দুজনে এসে ব্যালকনিতে বসেছিল। বিপাশা চা করে এগিয়ে দিয়েছে কাপটা অনন্যর দিকে, কিন্তু অনন্য কেমন যেন অন্যমনস্ক। নিষ্ক্রিয়ভাবে দূরে সন্ধ্যার আলোকিত রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে আছে।

বিপাশা বললে, চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

হ্যাঁ–হ্যাঁ, চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল অনন্য। দুটো চুমুক দিয়ে আবার সামনের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।

কি, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে তো চা! বিপাশা বললে।

না—ঠিক আছে। জবাব দিল অনন্য।

একটা কথা বলব?

কি বল না।

তোমাকে তো আমি বলেছি কেন রজতের সঙ্গে সেরাত্রে দেখা করতে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে তুমি যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না—

না, না—তা কেন?

অনন্য–সত্যি যা তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও চাপা দেওয়া যায় না।

আমার একটা কথা তোমাকেও বলা বোধ হয় উচিত ছিল। তাই এই কটা দিন ধরে ভাবছি—

কি কথা?

আমার মায়ের ব্যাপারটা—

কোন কথা না বলে বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।

মাকে আমার বাবা—

ছাড় ওসব কথা।

না—তোমার জানা দরকার—আর আমারও এতদিন কথাটা না এড়িয়ে গিয়ে তোমাকে বলা উচিত ছিল—মাকে আমার বাবা–

থাক না অনন্য—যা অতীত তা ভুলে থাকাই ভাল।

না শোন—বাবা মাকে হত্যা করে এই ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন—

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ—কারণ আমি ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছিলাম।

কি বলছ তুমি?

আমার বয়স তখন কতই বা হবে—দশ কি এগারো–পাশের ঘরেই আমি ছিলাম ঘুমিয়ে, হঠাৎ মার গলার স্বরে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মার গলা কানে এল। শুনলাম মা বলছেন, তুমি বিশ্বাস কর, অবিনাশ আমার আপন খুড়তুতো ভাই-কোনদিন কোন পাপ আমাদের মনের– মধ্যে জাগেনি, বাবা চিৎকার করে উঠলেন, মিথ্যা কথা, ও ছেলে আমার নয়—তাই তাকে একটু আগে আমি গলা টিপে শেষ করে দিয়েছি

সে কি–ওগো এ তুমি কি করেছ–ছি ছি-আমার–

বাবা আবার চিৎকার করে উঠলেন, পাপের শেষ আমি রাখব না—

তারপর?

আমি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম—দেখলাম বাবা দুহাতে মার গলা টিপে ধরলেন। মা ছটফট করতে করতে একসময় এলিয়ে পড়লেন—আর বাবা তখন মার অচেতন দেহটা দুহাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরে এসে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিলেন।

বিপাশা যেন একেবারে পাথর।

অনন্য একটু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, পরের দিন পুলিশ এল—বাবার সঙ্গে সে-সুমকার পুলিশ কমিশনারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রায়ই তিনি আমাদের এখানে আসতেন, মার সঙ্গে বসে বসে গল্প করতেন–

তিনি–

তিনিই হচ্ছেন অবিনাশ মামা–মার আপন খুড়তুতো ভাই–যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত অবিনাশ মামাই ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে চাপা দিয়ে দেন বোধ হয়, অবিশ্যি সবটাই আমার ধারণা—আমি পুরোপুরি সব জানি না। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাবা ক্রমশ যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন। বেশীর ভাগই চুপচাপ—একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন—আপনমনে বিড় বিড় করতেন আর ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করতেন।

ভাবতে পার সে-সময়কার মনের অবস্থা আমার বিপাশা, রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারতাম না, ঘুমোলেই দেখতাম এসে সামনে দাঁড়িয়েছে—মাথাটা ফেটে তার চৌচির হয়ে ঘিলু বের হয়ে পড়েছে—অনন্য দুহাতে মুখ ঢাকল।

বিপাশা নিঃশব্দ স্থির প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে।

অনন্য আবার বলতে লাগল, ক্রমশ বাবা যেন কেমন অ্যাবনরম্যাল হয়ে যেতে লাগলেন— ঐ সময় আমার পিসিমা এলেন আমাদের বাড়িতে পিসিমা আসাতে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাবার ঐ একমাত্র বোন, বিধবা বিবাহের তিন বৎসর পর পিসেমশাই একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন পিসিমা-বাবা তাকে নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাবা আর ভাল হলেন না। আমি যেবারে ম্যাট্রিক দিই—বাবা একেবারে ঘোর উন্মাদ হয়ে গেলেন—তখন ডাক্তারদের পরামর্শেই তাঁকে রাঁচীতে রেখে আসা হল। বুঝতেই পারছ তখন আমি বেশ বড় হয়েছি—সব বুঝতে পারি। এই বিরাট বাড়িতে তখন আমি, পিসিমা আর কিছুদিন হল বাবাকে দেখাশুনা করবার জন্য পরেশকে রাখা হয়েছিল, সেই পরেশ। পরেশ কিন্তু বাবাকে রাঁচীতে পাঠাতে চায় নি। সে বলেছিল বাবার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। সেই সর্বক্ষণ তার দেখাশুনা করবে। কিন্তু বাবা তখন রীতিমত ভায়োলেন্ট।

সেখানকার চিকিৎসায়, অনন্য বলতে লাগল, বাবার অবস্থা ক্রমশ একটু একটু ভাল হয়ে উঠতে লাগল—অনেকটা শান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপর আর কোন প্রোগ্রেসই হয়নি! চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। আলো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না—অন্ধকার ঘরে থাকেন। ডাক্তাররা বললেন সুস্থ আর হবেন না আগের মত, আর স্বাভাবিক হবেন না। ব্রেনের কিছু সেলস্ অ্যাট্রফি করে গিয়েছে, বাবা সেই অবস্থাতেই এখনও আছেন—বি.এ. পড়ি যখন মধ্যে মধ্যে তাঁকে দেখতে যেতাম।

তোমাকে চিনতে পারেন?

না।

আচ্ছা, ঐ যে মণির কথা বললে—সে—

আমার ছোট একটি ভাই হয়েছিল, আমার থেকে আট বছরের ছোট-বাবা তাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন। এই সব কথা কতদিন তোমাকে বলব ভেবেছি, কিন্তু পারিনি বলতে। কে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে—আমার কণ্ঠ রোধ করেছে। বাবার কথা কোনদিনই আমি ভুলতে পারিনি। আমার মনের একটা অংশ যেন বাবা অধিকার করে রেখেছেন। তারপর দেখা দিল আমার মনের মধ্যে এক ভয়–

ভয়! কিসের ভয়?

বাবা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ান। একমাথা কাঁচা-পাকা রুক্ষ এলোমেলো চুল—একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি—আর বড় বড় দুটো রক্তচক্ষু। রাত্রে শয্যায় গিয়ে শুলেই যেন বাবার আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করত। আর মনে হত কে যেন অন্ধকারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতাম। দিনের বেলাটা কোন ভয় আতঙ্ক থাকত না-রাত্রি হলেই হত শুরু সেই ভয়ের বিভীষিকা। এমনি করেই চলছিল—তোমার সঙ্গে আলাপ হল ঐ সময়–কেন যেন তোমার কাছে গেলে আমার সবর্ভয় চলে যেত।

বিপাশা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও অনন্যর মুখের দিকে। আশঙ্কা অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাস যেন তার দুচোখের দৃষ্টিতে।

অনন্য আবার একটু থেমে বলতে লাগল, তুমি এলে এ-বাড়িতে—ভাবলাম আর বুঝি আমাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। দুঃস্বপ্নের পীড়ায় আমাকে বুঝি আর পীড়িত হতে হবে না। কটা দিন ভালই কাটল, কিন্তু ক্রমশ আবার যেন আগের সেই দ্বিধা, সংশয় ও ভয় আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল একটু একটু করে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। ঘুমোবার চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। মনে হত কে যেন দুহাতে ঠেলে আমাকে শয্যা থেকে তুলে দিচ্ছে। ঘরের বাইরে সিঁড়ির দিকে ঠেলছে—এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম উপরে—কে যেন ঠেলত আমাকে সামনের দিকে–

দাদাবাবু!

কে?

আজ্ঞে আমি পরেশ। পরেশ এসে সামনে দাঁড়াল।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকাল অনন্য পরেশের দিকে–বিরক্ত কণ্ঠে বললে, কি হয়েছে?

দুজন বাবু এসেছেন—

কে বাবু?

একজন মনে হল সেই পুলিশ অফিসার—অন্যজনকে চিনতে পারলাম না।

ব্যালকনির আলোটা তখনও জ্বালানো হয়নি—অন্ধকার। নীচের বাগানে অন্ধকারে ঝোপে ঝোপে একঝাক জোনাকি আলোর বিন্দু ছড়িয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।

আপনমনেই অনন্য বললে, আবার পুলিশ কেন! যা এইখানেই ডেকে আন—

পরেশ চলে গেল।

একটু পরেই সুদর্শনের সঙ্গে কিরীটী এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল। বিপাশা ইতিমধ্যে ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল।

নমস্কার। সুদর্শন বললে, অনন্যবাবু, আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম।

বসুন—অনন্য বললে।

সুদর্শন বললে, এঁকে আপনি চিনবেন হয়তনাম হয়ত শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়।

কিরীটী নামটা শুনেই বিপাশা যেন কেমন ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাল।

সুদর্শন আবার বললে, পুলিশের বড়কর্তা মিঃ গুপ্তর নির্দেশেই উনি এখানে এসেছেন—

কেন? অনন্য শুধাল।

ক্যাঃ চৌধুরী যিনি কয়দিন আগে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–

বুঝেছি, তা আমার কাছে কেন মিঃ মল্লিক! তাছাড়া আপনি তো একবার এসেছিলেন—আমার যা বলবার সবই তো সেদিন বলেছি—

জবাব দিল কিরীটী, জানি অনন্যবাবু, সুদর্শন ও সুধাকান্তর মুখ থেকে সবই আমি শুনেছি—

তবে—তবে আবার এসেছেন কেন?

আমাদের আরও কিছু জানা দরকার, কিরীটী বললে।

কিন্তু আমি তো আর কিছু জানি না।

আপনার স্ত্রী বিপাশা দেবী—শুনেছি আমরা, যেদিন ক্যাঃ চৌধুরী মারা যান সকাল দশটা সোয়া-দশটা নাগাদ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

হ্যাঁ।

কি কথাবার্তা হয়েছিল সে-সময় বিপাশা দেবীর তার সঙ্গে? কথাটা বলে কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল বিপাশার মুখের দিকে।

অনন্য যেন কি বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপাশাই বললে, আমাকে রজত জোর করে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল—

আঃ, বিপাশা থাম—অনন্য বাধা দেবার চেষ্টা করে।

অনন্য, ওঁদের জানা দরকার ব্যাপারটা—হ্যাঁ, শুনুন কিরীটীবাবু, অনন্যোপায় হয়েই তখন তাকে আমি নিরস্ত করি সন্ধ্যায় তার ওখানে যাব বলে—

গিয়েছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন। হারাত সোয়া আটটা নাগাদ

দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে আপনার?

হ্যাঁ—বলে, কি কথাবার্তা হয়েছিল উভয়ের মধ্যে বিপাশা একে একে বলে গেল এবং এও বললে, ঘর থেকে বেরুবার মুখে কাকে আড়ি পাততে লক্ষ্য করেছিল।

তাকে চিনতে পারেন নি?

না।

অনন্যবাবু?

কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল অনন্য।

আপনি তো পরেশের মুখ থেকেই জানতে পারেন ক্যাঃ চৌধুরীর আসার কথা!

হ্যাঁ।

তারপর আপনি কি করলেন?

আমি ব্যাপারটায় কোন গা দিই নি—

দেন নি?

না।

কেন?

কারণ ব্যাপারটায় কোন গুরুত্ব দেওয়া দরকার মনে করি নি।

আপনি সেরাত্রে কখন বাড়ি ফেরেন?

রাত সোয়া বারোটা নাগাদ বোধ হয়। একটা পার্টি ছিল, পার্টি সেরে ফিরি।

আপনি ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন নি?

না।

কিন্তু আমাদের সংবাদ অন্যরকম—

মানে? আপনি গিয়েছিলেন নীলাকাশে—

না—না-অনন্য বলে ওঠে।

বিপাশার কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় ঐ সময়।

দেখুন অনন্যবাবু, অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। আপনি গিয়েছিলেন আমরা জানি। কি, যান নি?

আমি–

বলুন কখন গিয়েছিলেন—নীলাকাশের দারোয়ান আপনাকে যেতে দেখেছে সাড়ে আটটা নাগাদ–

হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম—

অনন্য–অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে যেন বিপাশা।

হ্যাঁ বিপাশা—তুমি তখন ঘরের মধ্যে রজতবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলে—

কেন—কেন গিয়েছিলে? বিপাশা বললে, তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারনি অনন্য!

তোমাকে আমি বিশ্বাস করি বিপাশা–তুমি বিশ্বাস কর—

তবে–তবে কেন গিয়েছিলে সেখানে একটা চাকরের কথা শুনে?

অনন্য বললে, রজতের সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া করব বলেই গিয়েছিলাম, অন্য কোন কারণে নয়, তুমি বিশ্বাস কর—

দেখা হয়েছিল আপনাদের? কিরীটীর প্রশ্ন।

না।

কিরীটী বললে, দেখা হয়নি—দেখা না করেই চলে এসেছিলেন ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে?

তার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি। তাই আর দেখা করিনি শেষ পর্যন্ত।

তবে আবার দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন কেন, যদি আর দেখা করার কোন প্রয়োজনই বোধ করেন কি?

কে বললে আবার আমি গিয়েছিলাম? অনন্যর গলার স্বরে কেমন যেন একটা দ্বিধাসংকোচ।

ঐ দারোয়ানই বলেছে যে, আবার–হ্যাঁ, আবার অনেক রাত্রে সেখানে আপনি গিয়েছিলেন মিঃ বক্সী।

অনন্য একেবারে চুপ।

কি, জবাব দিন আমার প্রশ্নের। কখন গিয়েছিলেন আবার দ্বিতীয়বার সে রাত্রে নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে?

রাত সাড়ে এগারোটায়—কিন্তু–

কি?

ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে নেই রজত, বাথরুমের দরজা খোলা—ব্যালকনির দরজাটাও খোলা—তা হলেও প্রথমটায় বাথরুমে ঢুকে দেখি, তারপর ব্যালকনিতে ঢুকে দেখি—

কি, কি দেখলেন?

রজত পড়ে আছে ব্যালকনিতে, সে—সে তখন মৃত। আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াইনি, ছুটে নিচে পালিয়ে আসি। বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবুরজতকে আমি হত্যা করিনি। হয়ত হয়ত বেঁচে থাকলে তাকে আমি হত্যাই করতাম, কিন্তু—

তারপর বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। হঠাৎ যেন একটা পাষাণভার স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে ওঠে।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল পুনরায় কিরীটীই। সে বললে, অনন্যবাবু, আপনার মার কিভাবে মৃত্যু ঘটেছিল নিশ্চয়ই আপনি জানেন?

অনন্য যেন একেবারে পাথর। কেবল বিপাশার মুখের দিকে সে চেয়ে আছে। অসহায় বিষণ্ণ দৃষ্টি।

বিপাশা এ সময় বললে, একটা দুর্ঘটনায় আমার শাশুড়ি–

প্রশ্নটা আপনাকে করিনি, কিরীটী বললে, করেছি আপনার স্বামী অনন্যবাবুকে। জবাবটাও তার কাছ থেকে চাই। বলুন অনন্যবাবু, আমি যে প্রশ্ন করেছি তার জবাবটা দিন।

একটু আগে বিপাশাকে যে কথাগুলো বলেছিল অনন্য, কিরীটীকেও সেই কথাগুলোই বলে গেল ধীরে ধীরে।

সব শুনে কিরীটী বললে, এখন আপনার বাবা কেমন আছেন?

একেবারে শান্ত, তবে কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। কাউকে চিনতেও পারেন না। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকেন সর্বক্ষণ সেলের মধ্যে। আর হাতে একটা সুতো নিয়ে কেবল পাকান।

কবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল?

আমাদের বিয়ের মাসখানেক আগে বিয়ে করছি কথাটা বলতে গিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু বাবা আমার দিকে তাকালেনও না—একটা কথাও বললেন না।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুমালটা আর প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরোটা পকেটে থেকে বের করে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো বিপাশা দেবী, এ দুটো চিনতে পারেন?

না।

এগুলো কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন? নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটের মেঝেতে! ভাল করে পরীক্ষা করে দেখুন আবার বিপাশা দেবী, এটা একটা লেডিজ রুমাল-এর এক কোণে ইংরাজী অক্ষরে লাল সুতো দিয়ে লেখা একটা ইংরাজী অক্ষর বি।

বিপাশা—অনন্য স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তোমার রুমাল না ওটা?

না—শান্ত দৃঢ় গলায় জবাব দিল বিপাশা।

কিরীটী বললে, এই প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরো–

আমি কখনও হাতে চুড়িই পরি না—দেখছেন না আমার হাতে সোনার বালা ছাড়া কোন চুড়ি নেই! আর কিছু আপনার জিজ্ঞাস্য আছে মিঃ রায়?

একটা প্রশ্ন আর করব—রজতবাবু আপনাকে চিঠি লিখতেন—আর আপনিও জবাব দিতেন

মধ্যে মধ্যে

সে লিখত কিন্তু আমি তার একটা চিঠিরও কোন জবাব দিইনি—হাতে এলেই ছিঁড়ে ফেলে দিতাম।

ধন্যবাদ—আর আপনাকে বিরক্ত করব না—চলি-নমস্কার—চল সুদর্শন—

দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ওখান থেকে সোজা সুদর্শন আর কিরীটী এল নীলাকাশে। রাত তখনও বেশী হয়নি, নয়টা হবে।

ডোর-বেল বাজাতেই ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।

সুদর্শনের পরনে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম—পঞ্চানন একটু যেন হকচকিয়ে যায় ওদের দেখে।

সুদর্শন বললে, সরিৎবাবু আছেন?

আজ্ঞে না, তিনি তো এখনও ফেরেন নি। পঞ্চানন বললে।

তার বোন?

হ্যাঁ, দিদিমণি আছেন।

তাকেই তাহলে খবর দাও। বলবে লালবাজার থেকে মিঃ মল্লিক এসেছেন—

খবর দিতে হল না-বকুল ওদের গলা শুনেই বের হয়ে এসেছিল ঘর থেকে। বকুলের পরনে সাধারণ একটা মিলের শাড়ি-চুল রুক্ষ। চোখ দুটো যেন কিছুটা ফোলা-ফোলা।

বকুল দেবী, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। সুদর্শনই বললে।

আসুন—

কিরীটী আর সুদর্শন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

বসুন।

সরিৎবাবু এখনও ফেরেন নি?

না-দাদা তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় খুব অসুস্থ তাকে দেখতে গেছে। ফিরতে রাত হবে বলে গেছে।

সুদর্শন নিজে সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বসুন বকুল দেবী।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বকুলকে লক্ষ্য করছিল। রোগা পাতলা চেহারা, বর্ণশ্যাম কিন্তু চোখেমুখে একটা চমৎকার আলগা শ্ৰী আছে। বিশেষ করে চোখ দুটি সত্যিই সুন্দর। বকুল কিন্তু বলা সত্ত্বেও বসে না–দাঁড়িয়েই থাকে।

বসুন বকুল দেবী।

দাদাও নেই—আপনারা কাল আসবেন, বকুল বললে।

কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত সুদর্শন বললে, কাল প্রয়োজন হলে আবার আসতেই হবে, তবে এসেছি যখন আপনার সঙ্গে কথাটা সেরে যাই—

আমার সঙ্গে—

হ্যাঁ-বসুন না।

বকুল সামনের সোফাটায় বসল। পঞ্চানন দাঁড়িয়ে তখনও। সুদর্শন তাকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে যেতে বললে। পঞ্চানন চলে গেল।

বকুল দেবী–কথা শুরু করল কিরীটী, আপনি আমাকে হয়ত চেনেন না—আমার নাম—

পূর্বে দেখা কখনও না হলেও আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, বকুল বললে।

চিনতে পেরেছেন?

হ্যাঁ—আপনি কিরীটী রায়বকুলের গলাটা যেন কিরীটীর মনে হল একটু কেঁপে গেল।

বকুল দেবী-রজতবাবুর সঙ্গে তো আপনার বিবাহ স্থির হয়ে গিয়েছিল, তাই না? কিরীটী বললে।

হ্যাঁ, এই মাসেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।

আপনি কলকাতায় কবে আসেন?

রবিবার সকালে।

কোন্ ট্রেনে?

কেন বলুন তো!

না, তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোন ট্রেনে?

পাঞ্জাব এক্সপ্রেসে—

কটার সময় এসে হাওড়ায় পৌঁছান।

ভোর সাতটায়।

তারপর সোজা এখানে চলে আসেন বোধ হয়?

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনি তো এখানে এসে পৌছান বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ। আপনার হাওড়া থেকে। এখানে ট্যাক্সিতে আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগল?

হ্যাঁ—মানে অন্য জায়গায় পথে একটু কাজ সেরে আসতে দেরি হয়ে গেছে—

আপনি কিন্তু ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না বকুল দেবী, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।

মানে–কি বলতে চান আপনি-আমি মিথ্যা বলছি!

মিথ্যা না বললেও সত্য কথাটা আপনি বলছেন না।

আমি মিথ্যা বলিনি—সত্যিই বলছি–

বকুল দেবী—আমার দুটো চোখ যদি মিথ্যা না দেখে থাকে তো–আপনি এসেছেন রবিবার নয়–শনিবার সন্ধ্যায় এবং ট্রেনে নয়—প্লেনে!

কি বলছেন কিরীটীবাবু?

আমি সে সময় এয়ারপোর্টে ছিলুম—যে প্লেনে আপনি এসেছেন শনিবার, সেই প্লেনেই। পাটনা থেকে আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল, তাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে।

বকুল যেন একেবারে বোবা। পাথর।

কিরীটী বলতে লাগল শান্ত গলায়, হয়ত আপনিও লক্ষ্য করেছেন, একটা মোটামত ভারী গোঁফওয়ালা দামী স্যুট পরা হাতে একটা অ্যাটাচি কেস এক ভদ্রলোককে, যিনি ঠিক আপনার সঙ্গে সঙ্গে এসে প্লেন থেকে নেমে লাগেজের জন্য, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন কি মনে পড়ছে—আমার সেই বন্ধুটি দিল্লীর পুলিশের একজন বড়কর্তা এবং তিনিও আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবেন, কারণ তিনিও একবার একজনকে দেখলে বড় একটা ভোলেন না।

বকুল পূর্ববৎ নীরব।

হ্যাঁ–আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। কিরীটী আবার বললে।

হ্যাঁ—আমি শনিবার সন্ধ্যায় প্লেনেই এসেছি–মিনমিন গলায় বকুল বললে।

তারপর বোধ হয় সোজা এখানে আসেন, রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে–অবশ্য সবটাই আমার অনুমান।

না।

কি, না?

আমি পরের দিন দশটায় এখানে আসি।

কেন, আপনি তো জানতেন রজতবাবু এখানে আছেন! আপনার আগেই এসে পৌঁছে যাচ্ছেন। তবে সেদিনই এলেন না কেন? তার জন্যই তো কলকাতায়—তাই নয় কি–

বকুল আবার চুপ। মুখে কোন কথা নেই।

বকুল দেবী, আপনার ডান হাতের কবজিতে ছোট্ট একটুকরো অ্যাড়হিসিভ প্ল্যাস্টার লাগানো আছে দেখছি—কি হয়েছে, কেটে গেছে বুঝি কবজির কাছে?

হ্যাঁ—মানে—

তা কেমন করে কাটল? কিসে কাটল? হাতে তো দেখছি—এক হাতে একগাছা লাল রংয়ের—বোধ হয় প্ল্যাস্টিকের চুড়ি, অন্য হাতের চুড়িটা কোথায় গেল?

অন্যটা ভেঙে গেছে আজ সকালে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে—

কিরীটী পকেট থেকে লাল প্লাস্টিকের ভাঙা চুড়ির অংশটা কাগজের মোড়ক খুলে বের করে বললেন, দেখুন তো বকুল দেবী, এটা আপনার সেই ভাঙা চুড়িরই অংশ কিনা!

বকুলের দুচোখের দৃষ্টি ভাঙা প্লাস্টিকের চুড়ির অংশটার প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। বকুল যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে।

এটা কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন বকুল দেবী, এই ঘরেরই মেজেতে—আর কবে এটা পাওয়া গিয়েছে জানেন, সোমবার সকালে ঘর ঝাঁট দেবার সময় মেজেতে। বকুল দেবী, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন—আপনি আপনার চুড়িটার ভাঙা সম্পর্কে যা বললেন এইমাত্র, সেটা সত্য নয়! এবারে বলুন, কখন কেমন করে চুড়িটা আপনার ভেঙেছিল?

বকুল পূর্ববৎ স্তব্ধ।

এই ভাঙা চুড়ির টুকরা কি প্রমাণ করছে জানেন?

কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঋজু ও কঠিন। সে বলতে লাগল, আপনি পরের দিন সকাল দশটা সাড়ে দশটায় নয়, অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো—আপনি শনিবার রাত্রেই কোন এক সময় এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন–

না, না,—একটা চাপা আর্তনাদ যেন বের হয়ে এল অকস্মাৎ বকুলের কণ্ঠ চিরে।

হ্যাঁ, এসেছিলেন—আপনি এসেছিলেন সেই শনিবার রাত্রেই সত্যকে অস্বীকার করে কোন লাভ হবে না। সত্যকে চাপা দেবার চেষ্টা করলেও তা প্রকাশ পাবেই।

হ্যাঁ–হ্যাঁ—অস্ফুট চিৎকার করে বকুল বলে ওঠে, হ্যাঁ  এসেছিলাম বকুলের সর্বশরীর তখন থর থর করে কাঁপছে।

রজতবাবুকে আপনি ভালবাসতেন—

বাসতাম। বাসতাম কিন্তু আমি জানতাম না—জানতে পারিনি মানুষটা এত নীচ—একটা জানোয়ারজানেন সে আমাকে একলা ফ্ল্যাটের মধ্যে পেয়ে হঠাৎ সে আমার উপরে বলাৎকার করবার চেষ্টা করে, আমি প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করি—শেষটায় আমার এক প্রচণ্ড ধাক্কায় সে গিয়ে ছিটকে পড়ে সোফার ধারে লাগে মাথায়, জ্ঞান হারায়, আমি—আমি তখন তার গলায় যে কারে বাঁধা মাদুলীটা ছিল সেটা তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে তার শ্বাসরোধ করি—

হত্যা করলেন শ্বাসরোধ করে তাকে?

হ্যাঁ–হত্যা করে আমি বের হয়ে যাই—মৃতদেহটা মেঝের ওপর পড়ে থাকে।

কিন্তু আপনি জানেন না বকুল দেবী–রজতবাবুর তখনও মৃত্যু হয় নি—হি ওয়াজ সিম্পলি অ্যানকনসাস—নট ডেড!

না–না, সে মরে গিয়েছিল। আমি জানি সে মরে গিয়েছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।

না, তার মৃত্যু ঘটে ওপর থেকে নীচে কমপাউন্ডে ফেলে দেবার জন্য এই চারতলা থেকে–

বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আমি তাকে ফেলে দিইনি নীচে–

আমি তা বিশ্বাস করি, কিরীটী শান্ত গলায় বললে, সেটা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর ছিল না। অত বড় একটা লাশকে তুলে নিয়ে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া আপনার ক্ষমতায় কুলাত না—

সুদর্শন ঐ সময় বললে, তবে কে-কে ফেলে দিল নীচে রজতবাবুর অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচের কমপাউন্ডে?

বকুল দেবী ননস্যাম ওয়ান এলস্। অন্য অন্য কেউ।

পঞ্চানন কি? সুদর্শনের প্রশ্ন।

না। সে তো সেসময় ছিলই না—আমি তার মুভমেন্টস্ খোঁজ করে জেনেছি সে নয়। তবে কে বকুল দেবী জানেন সেটা উনিই বলুন কে সে? কিরীটী বললে।

আমি–জানি না।

জানেন। জানেন আপনি বকুল দেবী, বলুন কে—কে সে?

আমি চলে গিয়েছিলাম জানি না–

জানেন আপনি—আপনি সব দেখেছেন সেরাত্রে পরের ব্যাপারটা, কারণ আপনি তারও পরে এখান থেকে গিয়েছিলেন—

জানি না আমি জানি না। বকুল সহসা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বকুল কাঁদছে সোফার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে।

চল সুদর্শন—কিরীটী বললে।

দাদা–

হ্যাঁ চল–লিভ হার অ্যালোন, লেট হার ক্রাই!

কিরীটী আর সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং নীলাকাশে পুলিশের প্রহরা রেখে এসে জীপে উঠে বসল।

জীপ ছেড়ে দিল। দুজনাই চুপ।