যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ১

০১.

ঘরটা অন্ধকার।

এখনও রাত্রি—বোধ করি আটটা হবে। দিনের বেলাতেও ডাঃ মনসিজ দাশগুপ্তের এই ঘরে আলো প্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই। সমস্ত জানালা দরজায় ভারী পর্দা ঝোলানো। পর্দার ওপাশে বাইরের কাঁচের শার্সিও বন্ধ। আলো তো নয়ই—শব্দও বড় একটা এ-ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে না। তা ছাড়া ঘরটা দোতলায়—নীচের রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। ঘরের এক কোণে দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট্ট লাল ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিল—আলোর চারপাশে অন্ধকার দেওয়ালে একটা ঝাপসা লাল আলোর ছায়াপথ যেন সৃষ্টি করেছে।

একটা হাইব্যাক চেয়ারের উপরে সেই অন্ধকার ঘরে বসেছিল গা এলিয়ে অনন্য। বয়স খুব বেশী নয়—চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ হবে। মাঝারি সাইজ লম্বায়—বেশ বলিষ্ঠ গঠন, পরনে দামী একটা টেরিটের প্যান্ট ও গায়ে একটা টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট। ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশমতই অনন্য ঐ চেয়ারটার উপর বসে দূরের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনন্যর দুচোখের পাতা যেন ভারী হয়ে বুজে আসতে চাইছিল। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। চোখ মেলে থাকতে পারছিল না অনন্য। অল্প দূরে একটা টুলের উপর বসে ডাঃ দাশগুপ্ত। কলকাতা শহরের নামকরা একজন মনোবিজ্ঞানী। নামের শেষে অনেকগুলো বিলাতী ডিগ্রীর লেজুড় আছে। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মত, উঁচু লম্বা দেহের গঠন। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দৃঢ়বদ্ধ নাসা ও ওষ্ঠ। ধারালো চিবুক, বৃষ-স্কন্ধ। চওড়া বক্ষপট।

ডাঃ দাশগুপ্ত অনন্যকে প্রশ্ন করছিলেন, কেবল একটা কুয়াশা

হ্যাঁ—অনন্য জবাব দেয়, একটা কুয়াশা যেন আমার চারপাশে হঠাৎ এক সময় জমাট বেঁধে উঠতে থাকে—অনন্যর গলার স্বর যেন খুব ক্লান্ত। বলতে বলতে থেমে গেল।

বলুন তারপর—তারপর কি মনে হয় আপনার মিঃ বক্সী?

সেই কুয়াশাটা ক্রমশ জমাট ভারী হতে থাকে যেন সীসের মত। তারপরেই মনে হয় যেন। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পাই–

কণ্ঠস্বর!

হ্যাঁ। সেই কণ্ঠস্বর যেন আমাকে কেবলই বলতে থাকে, যাও যাও—এগিয়ে যাও—কেমন যেন কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে অনন্য—আবার গলার স্বর বুজে আসে তার। ঝিমিয়ে আসে।

বলুন মিঃ বক্সী, থামলেন কেন-বলুন? থামবেন না।

আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি, দুকান বন্ধ করে থাকতে চাই—শুনবো না কিছুতেই শুনবো না আমি—কিন্তু পারি না—আমি উঠে পড়ি—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে যেন সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়—

কোথায়?

উপরে ছাতের সিঁড়ির দিকে—

আপনি সিঁড়িতে ওঠেন?

হ্যাঁ, সেই সিঁড়ি চলে গেছে চারতলার ছাতে সোজা। আমিও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি পা ফেলে ফেলে। আর আমার সামনের সেই জমাট কুয়াশাটাও ঠিক হাত দুই তিন ব্যবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে আমার আগে আগে একটা কঠিন সংকেতের মত।

তারপর—বলুন–

একসময় চারতলার ছাতে গিয়ে উঠি—সেই কুয়াশা আর সেই কণ্ঠস্বর কখন যে আমাকে ছাতের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে যায়—জানতেও পারি না। হঠাৎ একসময় নজরে পড়ে

কি?

কুয়াশাটা যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে—আর তার মধ্যে দুলছে আর দুলছে—

কি, কি দুলছে?

একটা পাকানো দড়ির ফাঁস—সেই ফাঁসটা–ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসে আমার শ্বাসরোধ করেনা, না-হঠাৎ চিৎকার করে উঠল যেন অনন্য অন্ধকারের মধ্যেই, না–ঐ—ঐ যে সেই ফাঁসটা—

কোথায় কোথায় ফাঁস? চিৎকার করে ওঠেন ডাঃ দাশগুপ্ত।

ঐ—ঐ যে—দেখতে পাচ্ছেন না!

দপ্ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল—লাল আলোটা নিভে গেছে—উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। কিছুই আর অস্পষ্ট নেই। সব স্পষ্ট তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আলোয়।

ডাঃ দাশগুপ্ত দেখলেন অনন্য বক্সীর সারাটা দেহ তখনও কাঁপছে আর তার দুচোখের দৃষ্টিতে একটা আতঙ্ক—সারাটা কপাল জুড়ে ঐ শীতের রাত্রেও বিন্দু বিন্দু ঘাম।

মিঃ বক্সী–বক্সী, শুনছেন?

কে?

আমি ডাঃ দাশগুপ্ত–

অনন্য বক্সীর মুখের চেহারাটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসে। সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায় অনন্য বক্সী ডাঃ দাশগুপ্তের দিকে।

শুনুন মিঃ বক্সী, সবটাই আপনার মনের একটা ভ্রম। আমি বলছি, হ্যাঁ, ভ্রম—

ভ্রম?

হ্যাঁ—আমরা যাকে বলি হ্যালিউসিনেশন। সবটাই একটা, কল্পনা—বলতে পারেন একটা ড্রিম। ওর মধ্যে কোন সত্য নেই।

কল্পনা! হ্যাঁ  কল্পনা। ড্রিম আপনার মনের সবটাই ড্রিম? হ্যাঁ, আপনার অবচেতন মনের একটা দুঃস্বপ্নই আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

তবে সেই কুয়াশা, সেই কণ্ঠস্বর, চলমান কুয়াশা, সিঁড়ি ছাত ছাতের রেলিং—শুধু তাই নয় ডাঃ দাশগুপ্ত, ঐ সময় সেই কণ্ঠস্বর কেবলই যেন আমায় আমায় বলতে থাকে, ঝুলে পড়ো ঝুলে পড়ো-হ্যাঙ দাইসেলফ! হ্যাঙ হ্যাঙ

ওটাও আপনার একটা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়—মনের বিকার। শুনুন, মনকে আপনার শক্ত করতে হবে। কিছু না—সব মিথ্যে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগাবার কথা ভাবেন—আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন!

না, না, তা কেন ভাবব, কেন আমি আত্মহত্যা করব?

হয়ত—

কি?

আপনার মনের মধ্যে একটা দুঃখ আছে–কিছু না পাওয়ার ব্যথা আছে—

না, না—বিশ্বাস করুন ডাঃ দাশগুপ্ত, সেরকম কিছুই নেই–আমার স্ত্রী—সে আমায় ভালবাসে–

ঠিক আছে, একটা ওষুধ দিচ্ছি—রাত্রে শোবার আগে একটা করে ক্যাপসুল খেয়ে শোবেন।

ঘুমের ওষুধ?

হ্যাঁ।

ওতে কিছু হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত—

কে বলল হবে না? ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন।

হবে না আমি জানি। রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আমার ভেঙে যায়—ওষুধ খেলেও এবং না খেলেও। ঘুমের ওষুধে কোন কাজ হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত।

বেশ তো আপনি দেখুন না কটা দিন খেয়ে, আমি যে ওষুধ আপনাকে দিচ্ছি—

খেতে বলছেন খাব। কিন্তু আমি জানি কোন লাভ হবে না খেয়ে। অনন্যর কণ্ঠস্বরে কেমন। যেন একটা ক্লান্তি ও হতাশা।

চলুন বাইরের ঘরে যাওয়া যাক। ডাঃ দাশগুপ্ত চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, আসুন—

ঐ ঘর থেকে দুজনে বের হয়ে এল।

একটা চেয়ারের উপরে চুপচাপ বসেছিল বিপাশা। অনন্যর স্ত্রী। চমৎকার সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী তরুণী, পাতলা ছিপছিপে গড়ন। পরনে একটা সাদা শাড়ি চওড়া জড়িপাড়-হাতে দু-গাছা করে সরু সোনার চুড়ি—গায়ে একটা স্কার্ফ জড়ানো।

বসুন মিঃ বক্সী—

ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশে অনন্য তার স্ত্রীর পাশের খালি চেয়ারটার ওপর উপবেশন করল।

অনন্য বলল, এক গ্লাস জল পেতে পারি?

নিশ্চয়ই–বলে ডাঃ দাশগুপ্ত কলিংবেলটা টিপলেন। একজন বেয়ারা এসে ঘরে প্রবেশ করল। সুখলাল, এক গ্লাস পানি লাও–

সুখলাল ঘরের বাইরে চলে গেল।

বিপাশা ঐ সময় বলল, সব কিছু বলেছ তো ডাঃ দাশগুপ্তকে?

জবাব দিলেন ডাঃ দাশগুপ্তই বিপাশার প্রশ্নের, বললেন, হ্যাঁ।

ওর এমন কেন হয় ডাঃ দাশগুপ্ত? বিপাশা প্রশ্ন করে।

আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে মিসেস বক্সী।

বিপাশা ডাঃ দাশগুপ্তের মুখের দিকে তাকান, আমাকে!

হ্যাঁ।

বলুন–

আচ্ছা এ ধরনের মনের বিকারটা আপনি কতদিন লক্ষ্য করছেন আপনার স্বামীর মধ্যে মিসেস বক্সী?

মাস আষ্টেক ধরে। মানে বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওর ঐরকম হচ্ছে।

তার আগে ছিল না কিছু?

উনি তো বলেন ছিল না, বিপাশা বলল।

কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?

আট মাসের কিছু বেশী—

বিয়ের পর থেকেই তাহলে বলছেন?

কতকটা তাই–বিয়ের কুড়ি বাইশ দিন পর থেকেই–বিপাশা বলল।

সুখলাল ঐ সময় ট্রের ওপর জলভর্তি একটা কাঁচের গ্লাস হাতে ঘরে এসে ঢুকল।

অনন্য গ্লাসটা ট্রের ওপর থেকে তুলে নিয়ে চোঁ-চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে নিল।

সুখলাল শূন্য গ্লাসটা নিয়ে ঘর থেকে বের করে গেল।

ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, অনন্যর দিকে আবার তাকালেন, অনন্যর মুখের উপরে যেন একটা ক্লান্তির হতাশার দুশ্চিন্তার ছায়া।

অনন্য কেমন যেন ঝিমানো গলায় বলল, প্রতিটি রাত যে আমার কাছে কি ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন বহন করে আনে—আপনাকে বোঝাতে পারব না ডাঃ দাশগুপ্ত। রাত্রি যেন আমার কাছে এক ভীতি!

বিয়ের আগে তাহলে আপনার ঐ দুঃস্বপ্নটা ছিল না মিঃ বক্সী!

কী বললেন? না, এমন স্পষ্ট ছিল না—

এখন যেরকম আপনার মনে হয়, বিয়ের আগে কখনও আপনার সেরকম মনে হয়নি?

একেবারে মনে হয়নি তা নয়, কদাচিৎ কখনও-সখনও হয়েছে—

আচ্ছা একটা কথা মিঃ বক্সী, কখনও কোন বিশেষ মুহূর্ত বা বিশেষ ঘটনা আপনার কি মনে পড়ে যার সঙ্গে মনের ঐ ব্যাপারটার কোন যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হয়?

না, সেরকম কিছু মনে পড়ে না।

আপনি বলছিলেন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আপনার ভেঙে যায়—

হ্যাঁ।

ঠিক আছে, ঐ সময় যাতে ঘুম না ভাঙে সেই ব্যবস্থা আমি করব—

আমি জানি ডাঃ দাশগুপ্ত, তা হবে না। যত চেষ্টাই আপনি করুন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুম আমার ভেঙে যাবেই আমি জানি

সেরকম না হলেই তো হল!

পারবেন না—পারবেন না। অনেক ঘুমের ওষুধ দিয়ে আগেও অনেক ডাক্তার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেন নি। ডাঃ দাশগুপ্ত, একটা কথা কি জানেন?

কি?

আমি আর আমার জন্য ভাবি না—আর এও আমি জানি—

কি জানেন?

ঐ—ঐ ফাঁসটাই একদিন আমার গলায় চেপে বসবে, আমার শ্বাসরোধ করবে। যা হবার হোক, আমি আর ভাবতে পারি না—আপনি শুধু আমার স্ত্রী বিপাশাকে ওর মানসিক দুশ্চিন্তাটা যাতে যায় ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করে দিন–

বিপাশা ঐ সময় বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কেন, আমার কি হয়েছে? আমি তো সুস্থ স্বাভাবিক আছি।

না, তুমি নেই। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার চিন্তায় ও সারারাত জেগে থাকে। আট মাস আগে ওর যা চেহারা ছিল, আজ তার আর কিছুই নেই। আট মাস আগে যারা

ওকে দেখেছে আজ তারা ওকে দেখলে বোধ হয় চিনতেও পারবে না।

না, না ডাঃ দাশগুপ্ত, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। বিপাশা, কেন তুমি অমন করছ, ওঁকে জানতে দাও তোমার কথাটা—ওঁর জানা দরকার

আমার কিছু হয়নি ডাঃ দাশগুপ্ত, আপনি ওকে সুস্থ করে দিন। বিয়ের আগে ও যেমন ছিল তেমনি করে দিন। ওর কষ্ট সত্যিই আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বিপাশার গলার স্বর যেন কান্নায় বুজে আসতে চায়।

ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন—সত্যিই সুন্দর দেখতে ভদ্রমহিলা— কিন্তু তার সে সৌন্দর্য যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে।

মিঃ বক্সী!

বলুন।

আপনি তো চাকরি করেন?

 জবাব দিল বিপাশা, বলল, হ্যাঁ, উনি একটা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার।

ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন, তাহলে তো বেশ রেসপনসিবিল পোস্টেই আছেন উনি!

হ্যাঁ–বিপাশা বলল।

মিঃ বক্সী, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—একটু পাশের ঘরে যাবেন, ওঁকে আলাদা ভাবে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো করুন। আমি যাচ্ছি।

অনন্য উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।

মিসেস বক্সী?

বলুন।

আমি কিছু প্রশ্ন আপনাকে করব, আপনি কিন্তু কিছু না লুকিয়ে আমার সব প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন—দেবেন তো?

দেব।

আপনাদের বিবাহিত জীবন কেমন?

আমরা খুব সুখী দম্পতি। উনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন।

সেটা তো বুঝতেই পেরেছি। আচ্ছা বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ পরিচয় ছিল কি?

হ্যাঁ, ওকে আমি চার বছর ধরে জানি—

তার মানে আপনারা পরস্পর পরস্পরকে চার বছর ধরে জানেন?

হ্যাঁ।

খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আপনাদের মধ্যে, তাই না?

তা ছিল বৈকি—

একটা অত্যন্ত ডেলিকেট প্রশ্ন করব—

বেশ তো করুন।

বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে মানে বুঝতেই পারছেন কি আমি জানতে চাই–

বুঝেছি–হ্যাঁ, আমরা তো জানতামই পরস্পর পরস্পরকে বিবাহ করব, তাই–কিন্তু তা হলেও আপনি যেটা মীন করছেন, দেহের দিক থেকে সেরকমের ঘনিষ্ঠতা কখনও আমাদের মধ্যে বিয়ের আগে হয়নি—

হয়নি?

না। ওর ধ্যান-ধারণাটা ঠিক আর দশজন পুরুষের মত নয়, ও বলত—

কি?

দেহের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যে জানাজানি একজন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যেও বলত, বিয়ের আগে সেটা কাম্য নয়, আনন্দেরও নয়—

কেন?

ওর ধারণা ছিল—তাহলে তো পরস্পর পরস্পরকে জানার আর কিছুই বাকি রইল না। দেহের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাবার মত বিয়ের আগে নির্বুদ্ধিতা নাকি আর কিছু নেই।

ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার কথাগুলো শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এবং এবারে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিসেস বক্সী, ঐ মিঃ বক্সী ছাড়া আপনার আর কোন পুরুষ-বন্ধু মানে আর কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না বিয়ের আগে?

হ্যাঁ, ছিল—

কে সে?

রজতশুভ্র–ভবানীপুরে আমাদের পাড়াতেই থাকত—তার সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি আমি একসময়।

অনন্যবাবু সেটা জানতেন?

জানতেন বৈকি।

রজতশুভ্রকে নিয়ে কোনদিন কোন কথা আপনার স্বামী বলেন নি?

না।

বুঝতে পারছি আপনার প্রতি অনন্যবাবুর বিশ্বাস খুব গভীর ছিল। আচ্ছা, আপনার স্বামীর আপনি ছাড়া অন্য কোন বান্ধবী ছিলেন?

বলতে পারব না।

মানে–জানেন না?

ছিল না বলেই আমার মনে হয়, আর থাকলে সেটা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারতাম।

ওঁর আর কোন ভাই বোন আছেন?

না, বাপ-মায়ের ও একই ছেলে—

ওর মা-বাবা বেঁচে আছেন?

মা নেই আর ওর বাবা-মানে আমার শ্বশুরমশাই—বিপাশা হঠাৎ যেন থেমে গেল।

বলুন?

আমার শ্বশুরের মাথার গোলমাল আছে শুনেছি—

পাগল?

হ্যাঁ, রাঁচীতে মেন্টাল অ্যাসাইলামে আছেন—

কতদিন হবে?

শুনেছি আমার শাশুড়ির মৃত্যুর পরই ওঁর মাথার গোলমাল দেখা দেয়—একটা কথা আপনাকে বোধ হয় বলা আমার উচিত ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার শাশুড়ির মৃত্যুর ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, যতদূর আমি শুনেছি–

কি হয়েছিল তাঁর–মানে কিসে মৃত্যু হয় আপনি নিশ্চয়ই জানেন!

বিশদভাবে ঠিক জানি না ব্যাপারটা–

জানেন না?

না। এইটুকু শুধু জানি—মানে ওর মুখেই একদিন শুনেছিলাম—বলতে বলতে বিপাশা যেন ইতস্তত করে থেমে যায়।

বলুন—থামবেন না!

আমার শাশুড়ির নাকি কি একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল।

দুর্ঘটনা!

হ্যাঁ। অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন নাকি আমার শাশুড়ি, ওর যখন বছর দশ এগারো বয়েস তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান।

কি হয়েছিল ঠিক জানেন কিছু?

না।

আপনার স্বামীকে কথাটা কখনও জিজ্ঞাসা করেন নি?

না।

কেন?

কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুটা ওর মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আঘাত, হেনেছিল। তাই পারতপক্ষে ওর মার সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্নই আমি করিনি।

ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, আর কোন প্রশ্ন করলেন না।

বিপাশা প্রশ্ন করল, ডাঃ দাশগুপ্ত!

বলুন।

আমার স্বামী আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন তো?

মনে তো হয়—

মনে তো হয় বলছেন কেন?

কথাটা কি জানেন মিসেস বক্সী, ওঁর, মানে আপনার স্বামীর মনের মধ্যে কোন কিছুর প্রতিক্রিয়া খানিকটা কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আছে—যে কুয়াশাটা উনি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, সেটার ঠিক ঠিক বিশ্লেষণে না পৌছানো পর্যন্ত—অবিশ্যি আমি চেষ্টা করব, যাতে উনি আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন তবে আপনার স্বামীর কোঅপারেশন চাই সর্বাগ্রে এবং শুধু ওঁর নয়, আপনারও–

আমাকে কি করতে হবে বলুন?

কেসটা আমাকে একটু ভাবতে দিন মিসেস বক্সী, দিন পনেরো পরে আবার আসবেন আপনার স্বামীকে নিয়ে কিছুদিন পর পর আমি ওঁকে নিয়ে সিটিং দেবো!

আসব।

অতঃপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ডাঃ দাশগুপ্তর নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিপাশা ওঁর ঘর থেকে বের হয়ে এল।