মানসী তুমি – পরিচ্ছেদ ৮

০৮.

কিরীটী সদ্য শেষ করা কফির কাপটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখেছে, শ্রীমান জংলী এসে ঘরে ঢুকল।–বাবু, একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

কোথা থেকে আসছে, কি না কিছু বলেছে?

না, সে সব কথা তো কিছু বলেনি, কেবল বললে নাম–সুকুমার মিত্র।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, যা এই ঘরে পাঠিয়ে দে।

জংলী বেরিয়ে গেল। সুকুমার এসে ঘরে প্রবেশ করল।

আসুন। বসুন সুকুমারবাবু। কিরীটী বললে।

আপনি পরেশবাবুকে বলেছিলেন—

হ্যাঁ, মানসীর ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে চাই সুকুমারবাবু, তাই আপনাকে আসতে বলেছিলাম। আপনি তো তাকে অনেক দিন থেকেই, মানে তার বিয়ের আগে থাকতেই চিনতেন—আপনাদের দুজনার মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল—আচ্ছা আপনার কি মনে হয় মানসী দেবী সমুদ্রে ড়ুবে মারা গেছেন?

না, আমি বিশ্বাস করি না। শান্ত গলায় সুকুমার বললে।

কিন্তু কেন মানসী ভাল সাঁতার জানত বলে কি?

না, ঠিক তা নয়, তবে আমি ঠিক আপনাকে বোঝাতে পারব না ব্যাপারটা কিরীটীবাবু—

হুঁ। আচ্ছা সুকুমারবাবু আপনি তো মানসীকে ভালোবাসতেন, তাই না? মানসীও কি—

আগে মনে হয়েছে সেও বুঝি আমাকে ভালোবাসে–কিন্তু পরে মনে হয়েছে, না। কারণ তাই যদি হত, তাহলে সে শরদিন্দুদাকে বিবাহ করত না।

বিবাহটা সম্পূর্ণ তার বাপের কথা ভেবেই হয়তো—মানে তিনি শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়েছিলেন বিবাহে।

না, আমার মনে হয় সম্পত্তি আর ঐশ্বর্যের প্রতি তার মনের মধ্যে একটা লোভ ছিল আর সে কারণেই সে মত দিয়েছিল ঐ বিবাহে।

আপনি তাহলে মানসীর মৃত্যুসংবাদে খুশিই হয়েছিলেন বলুন!

না না–তা নয়–

আমার কিন্তু ধারণা সুকুমারবাবু আপনি খুশি হয়েছিলেন, আর তাই মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার মনের মধ্যে কোন সন্দেহ থাকলেও সেটা আপনি যাচাই করে নিতে চাননি।

কিরীটীর মনে হয়, সুকুমার যেন কেমন বিব্রত বোধ করছে।

যাকগে সে কথা, শরদিন্দুবাবু কি জানতে পেরেছিলেন, আপনাদের উভয়ের মধ্যে একদা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল?

মনে হয় জানতে পেরেছিল।

তাই যদি হয় তো, কিরীটী বললে, শরদিন্দুবাবু সব কথা জানার পর কি ভাবে ব্যাপারটা গ্রহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে জানেন কিছু কিংবা মানসীর মুখ থেকে কখনও কিছু শুনেছেন?

না, বরং মনে হয়েছে ব্যাপারটায় মানসী কোন গুরুত্বই দিত না। তা হলেও মধ্যে মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করত দাদা, সেটা বুঝতে পারতাম।

কিছু মনে করবেন না সুকুমারবাবু, একটা কথা—আপনি ওঁদের বিবাহের পর শরদিন্দুবাবুর বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন না কেন?

চলে যেতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু মানসীই আমাকে যেতে দেয়নি। তাছাড়া শরদিন্দুদাও বোধ হয় যেতে দিতেন না।

কিরীটী বললে, কিন্তু পরের বিপর্যয়টা বোধ হয় তাতে এড়ানো যেত।

আপনি কি বলতে চান, তাহলে ঐ দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী?

সবটুকু দায়িত্বই আপনার ঘাড়ে আমি চাপাচ্ছি না সুকুমারবাবু, তবে আপনিও কিছুটা দায়ী বই কি!

কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না-মানসীর মৃত্যু হয়েছে।

তার মানে আপনার ধারণা মানসী এখনও বেঁচে আছেন? তাই যদি হয় তাহলে অন্য দিকটাও নিশ্চয়ই ভেবেছেন মানে মানসী তাহলে কোথায়?

হয়তো কোথাও না কোথাও সে আছে।

কিন্তু কেন? কেন তিনি অজ্ঞাতবাসে থাকবেন? কি কারণ থাকতে পারে?

তা জানি না। আমার যা মধ্যে মধ্যে মনে হয়, তাই আপনাকে আমি বলেছি কিরীটীবাবু-সুকুমার বললে।

তার মানে কি এমন হতে পারে যে তিনি বিশেষ একটি সুযোগের অপেক্ষায় আছেন এলেই তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন।

কি জানি, ঠিক বলতে পারব নাসুকুমার যেন কেমন অসহায় ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।– আচ্ছা সুকুমারবাবু, আমি একবার আপনার দাদার সঙ্গে কথা বলতে চাই—আপনি ব্যবস্থা করতে পারেন?

কেন পারব না কিন্তু দাদা তো কলকাতায় নেই।

 কলকাতায় নেই? কোথায় গিয়েছেন?

পুরী।

পুরী! কবে?

গত পরশু রাত্রে—এক্সপ্রেসে।

তা হঠাৎ তিনি পুরী গেলেন কেন?

ঠিক বলতে পারব না।

ঠিক আছে, তিনি ফিরে আসুন—তারপর তাকে মিট করা যাবে। আচ্ছা শরদিন্দুবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রীরও শুনেছি দীঘার সমুদ্রে ড়ুবে মৃত্যু হয়েছে আকস্মিক ভাবে তাঁর মৃত্যুটা কি আপনার একটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে মনে হয়, নাকি কোন পূর্ব-পরিকল্পিত ব্যাপার?

তার মানে কি বলতে চান আপনি?

মানে বলতে চাই, মানসীর যে কারণে মৃত্যুর প্রয়োজন হয়েছিল, ঠিক তেমনি কোন কারণেই তারও মৃতুটা ঘটেছে কিনা!

মনে হচ্ছে, আপনি বলতে চাইছেন—দুটো ঘটনার কোনটাই দুর্ঘটনা নয়—দুটোই পূর্বপরিকল্পিত

হ্যাঁ সুকুমারবাবু, আমার তাই মনে হয়, দুটো ব্যাপারের মধ্যেই attempt of murder ছিল!

কিন্তু কেন—কেন তাদের হত্যা করা হবে—আর কি উদ্দেশ্যেই বা হত্যা করা হবে?

উদ্দেশ্য বা মোটিভটা জানতে পারা গেলেই তো সব জানা গেল। একটা কথা ভেবে দেখুন। সুকুমারবাবু, দুজনারই মৃত্যু হয়েছে সমুদ্রে ড়ুবে এবং দুটো ঘটনারই একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী তাদের স্বামী শরদিন্দুবাবু, ঘটনাস্থলে আর কেউ থাকলেও তার অস্তিত্ব এখনও অন্ধকারে। যাই হোক, আপাতত আপনাকে আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই। তবে আপনার সক্রিয় সহযোগিতা কিন্তু আমি সর্বদাই আশা করব—

আমি তাহলে এখন উঠি?

আসুন–শরদিন্দুবাবু ফিরে এলে যেন জানতে পারি।

জানাব–সুকুমার বিদায় নিল।

শরদিন্দু পুরীতে ছুটে এসেছিল তার সন্দেহের নিরসন করতেই। সেরাত্রে ফোনে মানসী কথা বলবার পর থেকেই শরদিন্দু যেন কিছুই আর ভাবতে পারছিল না। মানসী তাহলে বেঁচে আছে। সমুদ্রের জলে ড়ুবে শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয় নি! কিন্তু বেঁচেই যদি আছে—তা এতদিন সে চুপ করে ছিল কেন?

মানসী অভিযোগ জানাল, তাকে নাকি বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। তার লেমন স্কোয়াশের গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কখন কে তার লেমন স্কোয়াশে বিষ মেশালো? সে তো বিষ মেশায়নি। হ্যাঁ, সে অস্বীকার করবে না, মানসীর প্রতি একটা ঘৃণা ও তিক্ততা তার মনের মধ্যে জমে উঠেছিল, এমন কি মনে মনে মানসীর মৃত্যুকামনাও সে করেছে কত সময় ভেবেছেও মনে মনে, মানসীকে সে হত্যা করবে। কিন্তু পারেনি, মানসীর মুখের দিকে তাকালেই। তার সমস্ত ইচ্ছা কোথায় তলিয়ে গিয়েছে।

কটা দিন হোটেলে থেকে শরদিন্দু তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করল মানসীর—কিন্তু কোন সংবাদই সংগ্রহ করতে পারল না।