মানসী তুমি – পরিচ্ছেদ ৬

০৬.

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল সুকুমারের। অন্ধকার ঘর, আজকাল কেন যেন সুকুমারের কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। কয়েক রাত্রি পর পর সুকুমার ক্যমপোজ খেয়েছে কিন্তু তবু ঘুম আসেনি চোখে।

রাত্রে কখনও সুকুমার ঘরের দরজায় অর্গল দিয়ে শোয় না। অনেককালের অভ্যাস তার। ঘরের জানালা দরজা সব খোলাই থাকে, আর দরজাটা ভেজানো থাকে মাত্র। আজ বোধ হয় অনেকদিন পরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একটা মৃদু শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ মেলে, তাকাতেই সে দেখতে পেল, আবছায়া অবগুণ্ঠনবতী এক নারীমূর্তি তার শয্যার অল্প দূরে দাঁড়িয়ে।

কে—কে! সুকুমার ততক্ষণে উঠে বসেছে।

আমি চিনতে পারছ না সুকুমার, আমি মানসী!

মানসী!

কি, ভয় পেলে নাকি? মানসী মৃদু হাসল। হাসিটা যেন ঘরের বাতাসে মৃদু একটা কম্পন জাগায়।

সুকুমারের কণ্ঠে কোন শব্দ নেই। সে বোবা, সে পাথর।

ভাবছ বোধ করি মানসীর ভূত, আমি ভূত নই সুকুমার!

তুমি—তুমি বেঁচে আছ মানসী?

তাই তো মনে হচ্ছে—উহুঁ, উঠ না—আমার কাছে আসবার বা আমাকে স্পর্শ করবার চেষ্টা কোরো না।

মানসী–তুমি-সমুদ্রের জলে ড়ুবে তোমার মৃত্যু হয়নি?

না। ভুলে গেলে কেন আমি সাঁতার জানতাম। অনেক দূরে ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছিলাম। বটে—কিছু নোনা জল পেটে ঢুকেছিল, তাইতেই বেঁচে গেলাম শেষ পর্যন্ত খানিকটা বমি করে।

বমির সঙ্গেই বোধ হয় বিষটা বের হয়ে গিয়েছিল, নইলে হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল কেন—হাত পা সব শিথিল হয়ে এসেছিল কেন?

বিষ! কি বলছ তুমি মানসী?

একটা কথার সত্য জবাব দেবে সুকুমার? সেদিন দুপুরে আমার লেমন স্কোয়াশের সরবতের মধ্যে কে বিষ দিয়েছিল? তোমার তো সেটা না জানার কথা নয়—তবে এও জেনো, আমি ঠিক জানতে পারব—কে সেদিন লেমন স্কোয়াশের সঙ্গে আমায় বিষ দিয়েছিল! আচ্ছা চলি আবার আসব। আর দোহাই আমাকে অনুসরণ কোরো না!

মানসী, শোন, শোন—যেও না—মানসী—সুকুমার চেঁচিয়ে ওঠে নিজের অজ্ঞাতেই বুঝি।

মানসী তখন অদৃশ্য হয়েছে ঘর থেকে। শয্যা থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত যেতে যেতে মানসীকে আর দেখতে পেল না সুকুমার। সামনের বারান্দাটা অন্ধকার, শূন্য খাঁ খাঁ করছে। এদিকে ছাদে উঠবার সিঁড়ি সিঁড়িটা ওপরের দিকে ছাদে গিয়ে মিশেছে, নীচের দিকে একতলার ছাদ শেষ হয়েছে—প্রকাণ্ড ছাদ, তারপর নিচের তলা—সর্বত্র ঘুরে দেখল সুকুমার। মানসী কোথাও নেই।

সুকুমারের একবার মনে হয়, তবে কি সবটাই একটা স্বপ্ন? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে সে উঠে এসেছে? হয়তো তাই, নচেৎ মানসী কোথা থেকে আসবে! আজ প্রায় দুই বছর হল মানসী মারা গেছে পুরীতে সমুদ্র স্নান করতে গিয়ে!

সুকুমার আবার নিজের ঘরে ফিরে এল। কিন্তু বাকি রাতটা সে আর ঘুমাতে পারল না।

সুকুমার মানসীর সেই ডাইরির কথা ভোলেনি। মানসীর মৃত্যুর পর সে ওদের ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল, কিন্তু কোথাও কোন ডাইরি পায়নি। তার মনে হয়েছে, ডাইরিটা হয়তো মানসী পুরীতে সঙ্গে সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিল আর মানসীর মৃত্যুর পর হয়তো শরদিন্দু সেই ডাইরিটা নষ্ট করে ফেলেছে–

ডাইরিতে কি লিখেছিল মানসী, সেটা সুকুমার অনায়াসেই অনুমান করে নিতে পারে। সুকুমারকে কেন্দ্র করে শরদিন্দুর মনের মধ্যে যে একটা সন্দেহ ঘনীভূয় উঠেছিল, বিবাহের পর থেকেই, সেটাই বোধ হয় লেখা ছিল।

তবে এটা ঠিকই, মানসীর জলে ড়ুবে মৃত্যুর ব্যাপারটা সহজভাবে সে মেনে নিতে পারেনি। আর মেনে নিতে পারেনি বলেই মানসীর মৃত্যুর দিন কুড়ি পর সুকুমার পুরীতে গিয়েছিল। যে হোটেলে ওরা ৭/৮ দিন ছিল সেই হোটেলে ও নানাভাবে অনুসন্ধান করেছে চার-পাঁচদিন ধরে, এবং মোটামুটি যে সংবাদ সে সংগ্রহ করতে পেরেছে, সেটা হচ্ছে দুপুরে সাগরে স্নান করতে নেমে সাঁতার দিয়ে অনেকটা দূরে চলে যায় মানসী শরদিন্দু ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও সে ফেরেনি—শেষটায় সমুদ্রের জলে অদৃশ্য হয়ে যায় মানসী।

পুলিসের লোক ও নুলিয়ারা অনেক অনুসন্ধান করেছে মানসীর, কিন্তু মানসীর চিহ্নমাত্রও খোঁজ পাওয়া যায়নি তার মৃতদেহেরও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সবাই ধরে নিয়েছিল মৃতদেহটা ভাসতে ভাসতে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে।

পরেশ নন্দীর সঙ্গেও একদিন মানসীর মৃত্যু সম্পর্কে কথা হয়েছিল সুকুমারের।

পরেশ নন্দী স্পষ্টই বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি না সুকুমার—মানসীর জলে ড়ুবে মৃত্যু হয়েছে। ওটা একটা মিথ্যা রটনা মাত্র!

কেন বিশ্বাস করেন না পরেশবাবু? সুকুমার বলেছে।

একটা কথা ভুলো না সুকুমার, মেয়ে আমার সাঁতারে চ্যামপিয়ন ছিল।

চ্যামপিয়ান সাঁতারুরাও তো জলে ড়ুবেছে এমন নজির আছে।

আছে কি নেই তর্ক তুলতে চাই না, তবে আমি যেমন করে থোক, মানসীর রহস্যটা খুঁজে বের করব। আমার জ্যোতিষী বন্ধু বঙ্কিমনারায়ণ চক্রবর্তীও তার কোষ্ঠী দেখে বলেছেন—ঐ বয়েসে মানসীর মৃত্যুযোগ ছিল না। সে মরতে পারে না, আর কোন দুর্ঘটনায়ও তার মৃত্যুযোগ ছিল না কোষ্ঠীতে।

পরের দিন সুকুমার যখন ফ্যাক্টরিতে তার অফিসঘরে বসে কাজ করছে, পরেশ নন্দী এলেন। সুকুমার, কাল বিকেলের দিকে একবার আমাদের বাড়ি আসতে পার?

কেন পারব না কিন্তু কেন বলুন তো?

এক ভদ্রলোক তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান?

ভদ্রলোক! কে?

কিরীটী রায়ের নাম শুনেছ?

শুনেছি। তা তিনি হঠাৎ আমাকে কি প্রশ্ন করতে চান?

কথাটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি সুকুমার, পরেশ নন্দী বললেন, মানু যে জলে ড়ুবে মারা গিয়েছে, সে কথাটা যে আমার মন মেনে নিতে পারেনি সে কথা তো তোমাকে আমি আগেই বলেছি। কিন্তু ভেবে ভেবেও আমি কোন কূল-কিনারা পাইনি এতদিন। ভেবেছি কেবল, একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু কি করব? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একদিন আমার কিরীটী রায়ের কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ, ঐ একটিমাত্র মানুষ যিনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে গেলাম তার কাছে, অনুনয় করলাম সাহায্য করবার জন্য।

তিনি তাহলে মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটা–

হ্যাঁ, মৃত্যুর মধ্যে রহস্য যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা জানাবার চেষ্টা করবেন বলে আমায় কথা দিয়েছেন। আজ সকালে তিনি আমায় তার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তারও বিশ্বাস মানুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। মানুকে হত্যা করা হয়েছে।

কি বলছেন আপনি? কে তাকে হত্যা করবে? আর কেনই বা করবে?

কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে আমি জানি না তবে কে হত্যা করেছে তা বোধ হয় অনুমান করতে পেরেছি সুকুমার—তোমার ঐ ভাই

না না, এ অসম্ভব। এ হতেই পারে না! ভুলে যাচ্ছেন আপনি পরেশবাবু, মানসীকে সে বিয়ে করেছিল-মানসী তার স্ত্রী মানসীকে দাদা ভালোবাসত।

আমি প্রমাণ দেব সে মানুকে ভালোবাসত না। আর সে কথাটা তোমারও অজানা ছিল না।

আমি-আমি কিছু জানি না। সুকুমার বললে।

কর কিছু জানবার দরকার নেই। তুমি শুধু কিরীটী রায় বা জিজ্ঞাসা করবেন তার জবাব দিও।

এতদিন পর মানসীর ব্যাপারটা আবার খুঁচিয়ে তুললে হয়তা কারোরই ভাল হবে না। ভুলে যাবেন নাআপনিও নিষ্কৃতি পাবেন না!

আমি?

হ্যাঁ। মানসী অন্য একজনকে ভালোবাসত জেনেশুনেও আপনি আপনার স্বার্থের হাড়িকাঠে নিজের সন্তানকে বলি দিয়েছেন বাপ হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকাননি। যে মতটা তার সেদিন আপনি আদায় করেছিলেন, সেটা তার সত্যিকারের মত নয়—নিজের বাপের কথা ভেবেই সন্তানের আত্মবলি মাত্র। তাছাড়া আরও একটা কথা ভুলে যাবেন না, শরদিন্দুর অনেক টাকা আছে টাকার খেলায় শেষ পর্যন্ত হয়তো আপনি হেরে যাবেন। আমার অনুরোধ এসব আপনি করতে যাবেন না। পাস্ট ইজ পাস্ট। অতীতকে আজ আর বর্তমানে টেনে এনে কারও কোন লাভ হবে না।

আমার মেয়ের হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবই সুকুমার।

আমি—আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?

মানসীর তুমি দীর্ঘদিনের বন্ধু। শুধু বন্ধুই নও, মানু বিয়ের পর যে বাড়িতে গিয়েছিল, সে বাড়িতে তুমিও ছিলে, সর্বক্ষণ তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছ, তুমি হয়তো এমন অনেক কথাই জান, যা আমি জানি না বা আর কেউ জানে না, কিরীটীবাবু হয়তো এমন অনেক কিছু জানতে চাইবেন, যা আমি জানি না, তুমি জান।

আপনি বাড়ি যান পরেশবাবু। শরদিন্দুদা আজ কারখানায় এখনও আসেনি, তবে যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে।

ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তবে তার সঙ্গেও হয়তো রায়মশাই দেখা করতে চাইবেন। আচ্ছা

চলি—পরেশ নন্দী অতঃপর বিদায় নিলেন।

পরেশ নন্দী চলে গিয়েছেন অনেকক্ষণ, সুকুমার তার চেয়ারটার ওপরে চুপচাপ বসে ছিল। গতরাত্রির ব্যাপারটাই আবার সুকুমারের মনে উদয় হয়। কাল রাত্রে যা ঘটে গিয়েছে, সেটা কি। আগাগোড়াই একটা স্বপ্ন না নিষ্ঠুর সত্য?

সত্যি সত্যি যদি মানসী গতরাত্রে ওদের বাড়িতে এসে থাকে, তবে সে এসেছিল প্রথমে খিড়কির দরজাপথে বাড়ির পশ্চাতে বাগানে, তারপর মেথরদের যাতায়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছিল। সেখান থেকে তিনতলা এবং সেই পথ দিয়েই আবার ফিরে গিয়েছে।

বাড়িটা অনেকদিনকার পুরানো। পশ্চাৎদিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা বাগানের মত আছে। এক সময় ঐ জায়গায় নানা ফল ফুলের গাছ ছিল, পরবর্তীকালের যত্নের অভাবে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে—এখন ঘন আগাছায় ভরা। ঐ বাগানের সীমানা প্রাচীরের পাশে একটা ফ্যাক্টরি। তারপরে খানিকটা খোলা মাঠ। আরও ওদিকে বজবজ যাবার রেললাইন। রাত্রির দিতে। মোটামুটি ঐ জায়গাটা নির্জনই থাকে।

চৈত্রের শেষ। কদিন থেকেই প্রচণ্ড গরম পড়েছে এ শহরে, অফিসের এয়ারকন্ডিশান করা কামরায় বসে সেটা বোঝবার উপায় নেই। দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকাল সুকুমার, ছটা বেজে গিয়েছে।

গ্রীষ্মের দীর্ঘ মন্থর বেলাও পড়ে এসেছে। সুকুমার ভারী পরদা ঝোলানো কাঁচের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল—আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে, হয়তো কালবৈশাখী উঠবে ঝড়।

ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং ক্রিং। সুকুমার ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল।

–সুকুমার। আমি শরদিন্দু।

কি ব্যাপার দাদা তুমি আজ অফিসে এলে না?

কতকগুলো জরুরি কাজ ছিল। আর শোন, আমি আজ রাত্রের পুরী এক্সপ্রেসে পুরী যাচ্ছি।

পুরী যাচ্ছ? হঠাৎ?

না মানে একটু ঘুরে আসব এই আর কি, ভাল লাগছে না।

সুকুমার বলল, তা ফিরছ কবে?

দেখি, কিছু ঠিক নেই। জগৎবাবুকে বলে দিয়েছি, আমার কাজগুলো, মানে কাগজপত্রগুলো তোর কাছেই নিয়ে যেতে—তাকে যা পরামর্শ দেবার দিস।

কথাগুলো বলেই শরদিন্দু বোধ হয় ফোনটা নামিয়ে রাখল। তার দিক থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না।