মানসী তুমি – পরিচ্ছেদ ১১

১১.

সুব্রত পুরীতে এসে পৌঁছাল পরের দিন। কিরীটী স্টেশনে গিয়েছিল।

দুজনার দেখা হলে সুব্রত বললে, কি ব্যাপার বল তো, এত জরুরী তলব?

কিরীটী রিকশায় করে আসতে আসতেই পথে তার যা বলবার ছিল বললে।

সুব্রত সব শুনে বললে, তাহলে দুটো ব্যাপারে তুই স্থিরনিশ্চিত! প্রথমত, মানসী দেবী বেঁচে আছেন আজও এবং দ্বিতীয়ত, তাকে সেদিন হত্যা করারই চেষ্টা করা হয়েছিল।

কিরীটী বললে, ঠিক তাই—

কিন্তু কে সে শরদিন্দু, না সুকুমার?

দুজনকেই আমি সন্দেহ করি কিরীটী বললে, সুকুমারকে সন্দেহ করি সে হতাশ-প্রেমিক। বলে—অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত মানসীকে পেল না বলে, আর শরদিন্দু—তার মনে সব কথা শুনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল বিবাহের পরও মানসী সুকুমারকে ভুলতে পারেনি এবং সে দ্বিচারিণী।

দুপক্ষকে ঘিরেই যুক্তি তোর অকাট্য, তবে আমার মনে হয়, শরদিন্দুবাবুই সেদিন স্ত্রীকে কৌশলে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। কারণ সে সময় শরদিন্দুই পুরীতে ছিল, সুকুমার ছিল না।

সেটাও প্রমাণসাপেক্ষ। কিরীটী বললে।

যাক, বর্তমান নাটকে আমার রোলটা হচ্ছে তাহলে ফিল্ম ডাইরেকটারের!

হ্যাঁ।

কিন্তু আরও ভাল হত, বোধ হয় আমার রোলটা করবার জন্য বিরূপাক্ষ সেনের বন্ধু ফিল্ম ডাইরেকটার শিশির গুপ্তকে নিয়ে এলে।

কিরীটী হেসে ওঠে।

পরবর্তী শুটিংয়ের দিনের আশায় আশায় বসে থাকতে থাকতে কিরীটী আর সুব্রত দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল।

যেদিন ওই শুটিং হওয়ার কথা ঠিক, তার আগের দিন সকালে উদয়বাবু এসে বললেন, লক্ষ্মীদেবীর নাকি কোন খবরই নেই। ডিরেক্টার নীলমণি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠেছে তার কোন সংবাদ না পেয়ে। ভুবনেশ্বরে বার বার টেলিফোন করেও নীলমণি তার কোন সন্ধান পায়নি। ফলে এখন নির্দিষ্ট দিনে শেষ পর্যন্ত শুটিং হবে কিনা সে সম্পর্কে ইউনিটের সকলেই বেশ সন্দিহান। পুরীতে যে শুটিং হওয়ার কথা তার সবটাই প্রায় লক্ষ্মীদেবীকে নিয়ে!

কিরীটী শুধাল, ভুবনেশ্বরের যে ফোন নাম্বার লক্ষ্মী দেবীর, সেটা নিশ্চয়ই তার বাড়ির ফোন নাম্বার?

উদয় বললেন, ঠিক জানি না। কিন্তু কেন বলুন তো?

নীলমণিবাবু কি সে বাড়িটা জানেন? মানে যেখানে লক্ষ্মী দেবী থাকেন?

জানে বই কি।

ঠিকানাটা জেনে আসতে পারেন উদয়বাবু?

কেন পারব না—আমি আজই বিকেলে আপনাকে এসে জানাব।

উদয়বাবু চলে গেলেন।

কিরীটী তার পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে ঘরের খোলা জানালাপথে রৌদ্রঝলকিত সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। সুব্রত এগিয়ে আসে। বললে, কি ভাবছ কিরীটী?

ভাবছি এইভাবে অপেক্ষা না করে আগেই আমাদের লক্ষ্মী দেবীর সন্ধানে তার ভুবনেশ্বরের বাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কথাটা শেষ করা হল না—কিরীটী হঠাৎ বললে, মনে হচ্ছে যেন সুকুমারবাবু কবে এলেন পুরীতে? কথাটা বলে কিরীটী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে হোটেলের বাইরে চলে এল। সুব্রতও তাকে অনুসরণ করে।

বেলা তখন প্রায় সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা হবে। সমুদ্রের ধারে স্নানার্থীদের ভিড়। নানাবয়সী মেয়েপুরুষ—কেউ স্নান করছে কেউ সী-বীচের ওপরে বসে বা দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ নিচ্ছে।

কিরীটী বালুর উপর দিয়ে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে জলের দিকে।

কিন্তু যার সন্ধানে কিরীটী হোটেলে থেকে বের হয়ে এসেছিল সেই সুকুমারবাবুকে দেখতে পেল না। আশেপাশে কোথাও মানুষটার চিহ্নমাত্রও নেই। অনেক দূর থেকে দেখেও কিরীটীর মানুষটাকে চিনতে কষ্ট হয়নি!

সমুদ্রের জলে অনেকে স্নান করছিল, কিরীটী সেই দিকে তাকিয়ে রইল—প্রায় মিনিট কুড়িপঁচিশ, কিন্তু সুকুমার মিত্রকে দেখতে পেল না। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে, আশ্চর্য! গেল কোথায়?

পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুব্রত। সে বললে, তোমার ভুল হয়নি তো কিরীটী?

না সুব্রত, ভদ্রলোককে আমার চিনতে ভুল হয়নি।

বেলা সোয়া দশটা সাড়ে দশটা হলেও রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর। দূরে সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো চিকমিক করছে। কিরীটী এক সময় ফিরে দাঁড়াল। কিরীটীকে যেন একটু চিন্তান্বিত মনে হয়।

কি ভাবছ কিরীটী? সুব্রত শুধাল।

সুকুমারবাবু যে পুরীতে এসেছেন সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত সুব্রত। তাই ভাবছি, সকলের অজ্ঞাতে হঠাৎ তারও এখানে আসার কারণ কি?

অজ্ঞাতেই বা ভাবছ কেন, হয়তো শরদিন্দুবাবু কথাটা জানেন।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না সুব্রত, শরদিন্দুর অজ্ঞাতেই সুকুমারবাবু পুরীতে এসেছেন। অন্যথায় সুকুমারবাবু তাঁর দাদা যে হোটেলে উঠেছেন সেই হোটেলেই এসে উঠতেন। এখন কি মনে হচ্ছে, জান সুব্রত?

কি?

প্রথমত এখানে আসার উদ্দেশ্য উভয়েরই এক—একই কারণে উভয়ে এখানে এসেছেন।

কি কারণ?

কারণ আর কিছুই নয়, ঐ লক্ষ্মী দেবী। লক্ষ্মী দেবীর কথা দুজনেই জানতে পেরেছেন—আর তাই দুজনেই পুরীতে ছুটে এসেছেন।

কথা বলতে বলতে দুজনে হোটেলে ফিরে এল। তারপর সোজা দোতলায় উঠে কিরীটী ঘরে দুজনে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকে কিরীটী কলিং বেলটা টিপে হোটেলের একটা ছোকরা চাকরকে ডাকল।

ডাকুচি বাবু?

তোর কি নাম রে?

মোর নাম জলধর আছি বাবু।

 জলধর একটু চা খাওয়াতে পারিস?

এত্তে সময় তো চা পাইবে না বাবু, অর্ডার নেই। ঠিক আছি বাবু, মু দেখি কি করতে পারি। জলধর চলে গেল।

আচ্ছা সুব্রত, জলধরকে তোমার কেমন মনে হয়? ওর ওপরে রিলাই করা যেতে পারে? কিরীটী বলল।

কি ব্যাপারে?

এই আশেপাশে একটু খোঁজখবর নেওয়ার জন্য!

কিসের খোঁজখবর?

সুকুমারবাবু—ভদ্রলোক আশেপাশের কোন হোটেলেই উঠেছেন নিশ্চয়ই!

কিন্তু–

জলধর চেষ্টা করলে বোধ হয় খবরটা সংগ্রহ করে আনতে পারবে। আরও আমার একটা কথা কি মনে হচ্ছে জান সুব্রত লক্ষ্মী দেবীও হয়তো জানতে পেরেছেন ওদের দুই ভাইয়ের এখানে উপস্থিতির কথাটা। সত্যিই যদি লক্ষ্মী দেবী ও মানসী দেবী একই ব্যক্তি হয়, তাহলে যে কোন কারণেই হোক তিনি এই মুহূর্তে ওঁদের সামনে আসতে চান না। তাই তিনি হঠাৎ বেপাত্তা হয়েছেন!

কিন্তু লক্ষ্মী দেবীর কথা ওঁরা জানবেন কি করে?

সেটা অতি সহজ ব্যাপার, কোন পত্রিকায় হয়তো ওঁরা নতুন চিত্রতারকা লক্ষ্মী দেবীর ছবি। দেখেছেন। আর সেই ছবির সঙ্গে সংবাদ পড়েই

কিন্তু তাই যদি হয় তো লক্ষ্মীদেবী কি জানতেন না তার ছবি কাগজে বেরুলে এমন কিছু ঘটতে পারে—তখন তার বেঁচে থাকার ব্যাপারটা ওঁরা দুজনেই জেনে যাবেন।

তুমি একটা দিকই কেবল বিবেচনা করছ সুব্রত, কিরীটী বললে, এমনও তো হতে পারে সুব্রত, ওইভাবে তিনি ইচ্ছা করেই আত্মপ্রকাশ করেছেন। এবং এবারই শুরু হবে আসল নাটক!

ঠিক ঐ সময় সুষমা দেবীর স্বামী নিবারণ ভট্টাচার্য এসে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ভিতরে আসতে পারি?

আসুন—আসুন মিঃ ভট্টাচার্য।

মিঃ ভট্টাচার্য এসে ঘরে ঢুকলেন।—একটা সংবাদ আছে, মিঃ রায়!

কি বলুন তো?

আপনি লক্ষ্মী দেবীর ঠিকানা খুঁজছিলেন না? ভট্টাচার্য বললেন।

কে বললে আপনাকে?

একটু আগে উদয়বাবু এসেছিলেন—

এসেছিলেন? কিন্তু কই, আমাদের সঙ্গে তো দেখা করলেন না?

লক্ষ্মী দেবী ডাইরেকটার নীলমণি রাউতকে একটা নাকি চিঠি দিয়েছেন—তাতে জানিয়েছেন তিনি আর অভিনয় করতে পারবেন না তাঁর ছবিতে, আর তিনি ভুবনেশ্বর থেকে চলে যাচ্ছেন।

কবে এসেছে সে চিঠি?

আজই সকালে তোক মারফৎ–কথাটা উদয়বাবু আমাকে বলে চলে গেলেন।

উদয়বাবু কখন এসেছিলেন?

মিনিট দশেক আগে। তারপরই একটু থেমে ভট্টাচার্য বললেন, আপনার স্টকে আর আছে। নাকি স্যার? কতদিন বাদে যে সেদিন স্কচ খেলাম!

না, আর তো নেই! কিরীটী বললে।

নেই? ভট্টাচার্যের কণ্ঠস্বরে রীতিমত যেন একটা হতাশা ফুটে ওঠে। একটু থেমে নিম্নকণ্ঠে অতঃপর বললেন, এই নিন তার ঠিকানা–।

আচ্ছা চলি—ভট্টাচার্য ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটীকে একটু যেন চিন্তিত মনে হল সুব্রতর, সে বললে, কি ভাবছ?

ভাবছি উদয়বাবু আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? ঠিক আছে, চল!

কোথায়?

ভুবনেশ্বর।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ, শুভস্য শীঘ্রম, নাও—চটপটে জামাটা বদলে নাও–