মানসী তুমি – পরিচ্ছেদ ১৪

১৪.

দরজা খুলে সামনে এক ঘোমটা মাথায় ভদ্রমহিলাকে দেখে মানসী একটু যেন থমমত খেয়ে যায়। কিরীটী বলেছিল, সুকুমার বা শরদিন্দু আসতে পারে কিন্তু তারা তো নয়, এ যে এক ভদ্রমহিলা!

কে আপনি, কি চান?

আগন্তুক মহিলা বললেন, আপনি কি মানসী দেবী?

আমি—

আমি জানি আপনিই মানসী দেবী, চলুন আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

কে আপনি কোথা থেকে আসছেন?

দেরি করবেন না, আমি পুলিশের কাছ থেকে আসছি—

পুলিশ!

হ্যাঁ  ঘরে চলুন—আপনার খুব বিপদ মানসী দেবী!

কি ভেবে মানসী আর আপত্তি জানাল না। বললে, আসুন।

দুজনে এগোয়, মানসী দরজাটা বন্ধ করতেও ভুলে যায়। এবং মানসী লক্ষ্য করে না, সে পিছন ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ছায়ামূর্তি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।

দুজনে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। আগন্তুক ঘরের মধ্যে ঢুকেই হঠাৎ ক্ষিপ্র হাতে একটা সিল্কের রুমাল বের করে মানসীর গলায় পেঁচিয়ে দিল। মানসী প্রতিবাদ জানাবার বা চিৎকার করবারও সময় পায় না। রুমালের শক্ত ফাঁস তার গলায় চেপে বসতে শুরু করে।

ঠিক সেই মুহূর্তে আগন্তুক মহিলার মাথায় একটা কাপড় জড়ানো রুল দিয়ে তীব্র আঘাত হানে সুব্রত—অর্থাৎ ছায়ামূর্তি। আক্রমণকারী মাথা ঘুরে পড়ে যায়, তার হাতের ফাঁস শিথিল হয়ে যায়—মানসী তখনও হাঁপাচ্ছে।

পরমুহূর্তেই কিরীটী ও থানা অফিসার এসে ঘরে ঢুকল। ভূপতিত নারীমূর্তির দিকে তাকিয়ে থানা অফিসার বললে, এ কি! এ যে ভদ্রমহিলা?

উনি ভদ্রমহিলা নন বলেই মনে হচ্ছে, কিরীটী বললে।

ভদ্রমহিলা নন! বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন থানা অফিসার।

তাই তো আমার মনে হয়—সুব্রত, মুখ থেকে ঘোমটাটা সরাও তো!

সুব্রত নীচু হয়ে ভূপতিত স্ত্রীমূর্তির মুখ থেকে ঘোমটাটা সরাতেই অস্ফুট মানসী বলে ওঠে পরম বিস্ময়ে, কে! সুকুমার?

হ্যাঁ মানসী দেবী, সুকুমারবাবুই! গলা শুনে চিনতে পারেননি?

না। আশ্চর্য! মানসী বললেন।

আপনি গোড়া থেকেই উত্তেজিত ছিলেন মানসী দেবী, নচেৎ মেয়েলী গলায় কথা বললেও সুকুমারের কণ্ঠস্বরটা হয়তো আপনার মনে সন্দেহ জাগাত। সুকুমার নারীর বেশে এসেছিল। আপনার কাছে, যাতে সহজেই ওকে আপনি বাড়িতে ঢুকতে দেন।

না কিরীটীবাবু, তাহলেও চট করে ওকে আমি সন্দেহ করতাম না। ও অদ্ভুত মেয়েলী গলা নকল করতে পারত। কতদিন মেয়েলী গলায় আমায় সঙ্গে কথা বলে ও মজা করেছে।

ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে সুকুমারের জ্ঞান ফিরে আসছিল।

সেদিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, ওর জ্ঞান ফিরে আসছে মিঃ দাশ!!

সত্যি কিরীটীবাবু, আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ও আজ আমাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করবার চেষ্টা করবে!

দুবছর আগে ঐ সুকুমারই আপনার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল—

কি বলছেন, আমি যে—

না আপনার স্বামী শরদিন্দুবাবু নন। সেদিন হোটেলে স্নান করতে যাবার আগে যাকে আপনি ঘর থেকে বের হতে দেখেছিলেন তিনি শরদিন্দুবাবু নন, ঐ সুকুমার—সবার অলক্ষ্যে উনি গ্লাসে বিষ মিশিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।

সুকুমার ঐ সময় চোখ মেলে তাকাল।

কিরীটী বললে, উঠুন সুকুমারবাবু, বাড়ির বাইরে আপনার জন্য পুলিশ ভ্যান অপেক্ষা করছে।

সুকুমার ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার বোঝা উচিত ছিল সুকুমারবাবু, কিরীটী বলতে লাগল যে, আপনার প্রেমে সাড়া দেবার জন্যে অত রাত্রে ফোন করেননি মানসী দেবী। মানসী দেবীকে দিয়ে ভুবনেশ্বর থেকে আপনাকে পুরীর হোটেলে ফোন করানো হয়েছিল। তাই যদি করতেন, তাহলে কলকাতা থেকে আপনাকে যখন ফোন করেন তখুনি তিনি তার বর্তমান ঠিকানাটা আপনাকে দিতেন। সুতরাং আপনার বোঝা উচিত ছিল যে তার ফোনের পশ্চাতে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে। আমি কিন্তু ভাবিনি, এত সহজে আপনি আমার ফাঁদে পা ফেলবেন!

সুকুমারের দুচোখের বোবা-দৃষ্টি তখন যেন অগ্নিদৃষ্টিতে পরিবর্তিত হয়েছে, মনে হচ্ছিল, সে বুঝি তার চোখের দৃষ্টিতে কিরীটীকে ভস্ম করে দেবে।

মিঃ দাশ, কিরীটী এবার স্থানীয় থানা অফিসারকে সম্বোধন করে বললে, সুকুমারকে মুক্ত রাখাটা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত হবে না—লোহার বালা এনেছেন?

মিঃ দাশের ইঙ্গিতে একজন কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে সুকুমারের হাতে লৌহবলয় পরিয়ে দিল।

ঘণ্টাখানেক বাদে ভুবনেশ্বরের হোটেলের ঘরে জগন্নাথবাবু মানসী ও সুব্রতর সামনে কিরীটী তার কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করছিল–

সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে আদৌ কোন জটিলতা ছিল না। এবং সে কথাটা আমি প্রথমেই। বুঝতে পারি, পুরী হোটেলে লক্ষ্মী দেবীই যে মানসী দেবী কথাটা বুঝতে পেরে। বুঝতে আমার বিলম্ব হয় না যে দুবছর আগে সমুদ্রের জলে ড়ুবে মানসী দেবীর মৃত্যু হয়নি তিনি আজও বেঁচে আছেন। এবং বর্তমানে এই ভুবনেশ্বরেই থাকেন। তারপর মানসী দেবীর মুখে যখন তার সব কাহিনী শুনলাম, বুঝলাম সেদিন তাঁকে হত্যা করবারই চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তখনও সংশয় ছিল কিছুটা হত্যাকারীকে নিয়ে, এটা অবিশ্যি বুঝেছিলাম, তার স্বামী শরদিন্দু বা শরদিন্দুবাবুর ভাই মানসীর পূর্ব প্রণয়িনী সুকুমারবাবু দুজনের একজন দোষী।

কিন্তু কে? কে ওঁদের মধ্যে প্রকৃত দোষী সেটা বুঝতে সামান্য দেরি হয়েছিল আমার। কারণ ঐ হত্যা-প্রচেষ্টার মূলে ছিল কোন এক পুরুষের দীর্ঘদিনের লালিত এক ঘৃণা, যে ঘৃণা থেকে জন্ম নিয়েছিল আক্রোশ এবং সেটা দুজনার পক্ষেই সম্ভবপর ছিল। মানসীকে শেষ পর্যন্ত পেল না সুকুমার, তার প্রণয় অপমানিত হল—সেই অপমানই আক্রোশে পরিণত হতে পারে সুকুমারের পক্ষে; তেমনি শরদিন্দুবাবুর স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ, এবং সে সন্দেহ থেকে ঘৃণার জন্ম হয়েছিল, সেই ঘৃণাও আক্রোশে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই ঐ দুজনার মধ্যেই একজন দোষী। কিন্তু কে—কে দোষী?

আমি শেষ সীমানার জন্য শরদিন্দুবাবু ও সুকুমারবাবু দুজনকেই জানালাম মানসীর বর্তমান ঠিকানাটা এবং জানালাম মানসী আজও বেঁচে আছে। জানিয়েছিলাম এই কারণে যে সত্যিকারের যে দোষী সে এত বড় সুযোগটা হেলায় হারাবে না—সে ছুটে আসবেই। সুকুমার সংবাদটা পেয়ে দেরি করলেন না, ছুটে এলেন ভুবনেশ্বরে, আমার গণনা যে ভুল নয় সেটা প্রমাণ করবার জন্য। শরদিন্দুবাবুর কোন তাড়াহুড়া ছিল না বলেই ঐ রাতেই তিনি এখানে ছুটে আসেননি। হয়তো কাল সকালে আসবেন।

কিরীটীবাবু, জগন্নাথ বললেন, সুকুমারবাবুকে কি আপনি গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলেন?

মিথ্যা বলব না, করেছিলাম, পুরীতে তিনি আমাকে দেখতে পেয়েও গা-ঢাকা দেওয়ায় তার প্রতি আমার প্রথম সন্দেহ জাগে। আমার কাছে গোপনতার তো কোন প্রয়োজন ছিল না যদি অবিশ্যি সত্যি তিনি নির্দোষ হতেন। তার গিলটি কনসাস-ই তাঁকে গোপনতার আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। তবে এটাও ঠিক, মানসী দেবী এসে যদি গতরাত্রে আমার সঙ্গে দেখা না করতেন, আমি এত তাড়াতাড়ি শেষ মীমাংসায় হয়তো পৌছাতে পারতাম না।

ইতিমধ্যে রাত শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভোরের আলো জানালাপথে হোটেলের ঘরে এসে প্রবেশ করে। কিরীটী বলল, শরদিন্দুবাবুকে কি হোটেলে একটা ফোন করে দেব মানসী দেবী?

না। মানসী বলল।

শরদিন্দুবাবু তো নির্দোষ, মা! জগন্নাথ বললেন।

দোষী কি নির্দোষ আমি জানি না মেসোমশাই, মানসী বলল, এইটুকু জানি, সেখানে আর আমার পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়।

কিন্তু মা–

জানি মেসোমশাই আপনি কি বলবেন, কিন্তু আমার ধারণা সুকুমার যা করেছিল, শরদিন্দুর পক্ষেও সেটা অসম্ভব ছিল না, তার চোখেও যে আমি হত্যার সংকল্প দেখেছিলাম।

সুব্রত বলল, আর একবার ভেবে দেখলে পারতেন মানসী দেবী!

ভেবেছি, ভেবেই বলছি।

কিন্তু মানসী, তুমি জগন্নাথবাবুর কথাটা শেষ হল না, তার আগেই মানসী হঠাৎ উঠে নিঃশব্দে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

পরের দিনের এক্সপ্রেসে কিরীটী আর সুব্রত কলকাতায় যাবার জন্য উঠে বসল। মানসী জগন্নাথবাবুর গৃহে যায়নি, পুলিশ তার কোন সন্ধান করতে পারেনি তখন পর্যন্ত। ট্রেন ছাড়বার পর সুব্রত বলল, মানসী কোথায় গেল বল তো? কিরীটী মৃদু গলায় বলল, মানসীই জানে সে কথা।