মাতৃভক্তি

মাতৃভক্তি

স্কট্‌লণ্ডের অন্তঃপাতী ডণ্ডী নগরে এক দরিদ্রা নারী বাস করিতেন। তাঁহার একমাত্র শিশু সন্তান ছিল। বৃদ্ধা, অনেক কষ্টে ও অনেক পরিশ্রমে, কিছু কিছু উপার্জ্জন করিয়া, নিজের ও পুত্রের ভরণ পোষণ নির্ব্বাহ করিতেন।

 লেখা পড়া না শিখিলে মূর্খ হইবে, ও উত্তর কালে অনেক দুঃখ পাইবে, এই ভাবিয়া তিনি, লেখা পড়া শিখাইবার নিমিত্ত, পুত্রকে এক বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিলেন। পুত্রও, বিলক্ষণ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া উত্তমরূপে শিক্ষা করিতে লাগিল।

 ক্রমে ক্রমে, তাহার বয়ঃক্রম দ্বাদশ বৎসর হইল। এই সময়ে, তাহার জননী পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হইলেন। তাঁহার অবয়ব সকল অবশ ও অকর্ম্মণ্য হইয়া গেল। তিনি শয্যাগত হইলেন। ইতঃপূর্ব্বে তিনি যাহা উপার্জন করিতেন, তদ্দ্বারা কোন রূপে গ্রাসাচ্ছাদন ও পুত্রের বিদ্যাশিক্ষার ব্যয় নির্ব্বাহ হইত, কিছুমাত্র উদ্বৃত্ত হইত না, সুতরাং, তিনি কিছুই সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারেন নাই। এক্ষণে, তাঁহার পরিশ্রম করিবার ক্ষমতা না থাকায়, সকল বিষয়েই অত্যন্ত কষ্ট উপস্থিত হইল।

 জননীর এই অবস্থা ও কষ্ট দেখিয়া, পুত্র মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, ইনি অনেক কষ্টে আমায় লালন পালন করিয়াছেন, ইহার স্নেহে ও যত্নেই, আমি এত বড় হইয়াছি, ও এত দিন পর্য্যন্ত জীবিত রহিয়াছি, এখন ইহার এই দশা উপস্থিত, আমার প্রতিপালন ও বিদ্যাশিক্ষার নিমিত্ত, ইনি এত দিন যত্ন ও পরিশ্রম করিয়াছেন, এ সময়ে ইহার জন্য, আমার তদপেক্ষা অধিক যত্ন ও পরিশ্রম করা উচিত, আমি থাকিতে ইনি যদি অনাহারে প্রাণত্যাগ করেন, তাহা হইলে আমার বাঁচিয়া থাকা বিফল। আমার বার বৎসর বয়স হইয়াছে, এ বয়সে পরিশ্রম করিলে, অবশ্যই কিছু কিছু উপার্জ্জন করিতে পারিব।

 এই সমস্ত আলোচনা করিয়া, সেই সুবোধ বালক এক সন্নিহিত কারখানায় উপস্থিত হইল, এবং তথাকার অধ্যক্ষের নিকট আবেদন করিয়া, তাঁহার অনুমতিক্রমে, কর্ম্ম করিতে আরম্ভ করিল। তাহার যেমন বয়স, সে তদপেক্ষা অনেক অধিক পরিশ্রম করিতে লাগিল, এইরূপে সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া, সে যাহা উপার্জ্জন করিত, সমুদয় জননীর নিকট আনিয়া দিত। সেই উপার্জ্জন দ্বারা তাহাদের উভয়ের অনায়াসে গ্রাসাচ্ছাদন সম্পন্ন হইতে লাগিল।

 কর্ম্মস্থানে যাইবার পূর্ব্বে, ঐ বালক, গৃহসংস্কার প্রভৃতি আবশ্যক কর্ম্ম সকল করিয়া, জননীর ও নিজের আহার প্রস্তুত করিত, এবং অগ্রে তাঁহাকে আহার করাইয়া, স্বয়ং আহার করিত। সে প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে গৃহে আসিত, ইতিমধ্যে জননীর যাহা কিছু আবশ্যক হইতে পারে, সে সমুদয় প্রস্তুত করিয়া, তাঁহার পার্শ্বে রাখিয়া যাইত।

 বৃদ্ধা লেখা পড়া জানিতেন না; সুতরাং সমস্ত দিন, একাকিনী শয্যায় পতিত থাকিয়া, কষ্টে কালক্ষেপ করিতেন। পীড়িত অবস্থায় কোনও কর্ম্ম করিতে পারেন না, এবং কেহ নিকটেও থাকে না, যদি পড়িতে শিখেন, তাহা হইলে অনায়াসে দিন কাটাইতে পাবেন। এই বিবেচনা করিয়া সেই বালক, অনেক যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া, অল্প দিনের মধ্যে, তাঁহাকে এত শিক্ষা করাইল যে, তিনি, কাহার অনুপস্থিতিকালে, সহজ সহজ পুস্তক পাঠ করিয়া অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছন্দে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

 এই বালক সুবোধ ও মাতৃভক্ত না হইলে, বৃদ্ধার দুঃখের অবধি থাকিত না। ফলতঃ, অল্পবয়স্ক বালকের এরূপ আচরণ সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। প্রতিবেশীরা, তাহার চরিত্র দর্শনে প্রীত ও চমৎকৃত হইয়া, মুক্তকণ্ঠে তাহাকে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *