আতিথেয়তা

আতিথেয়তা

 মঙ্গো পার্ক নামে এক ব্যক্তি, দেশপর্য্যটন দ্বারা, লোকসমাজে বিলক্ষণ বিখ্যাত হইয়াছিলেন। তিনি, পর্য্যটন করিতে করিতে, আফ্রিকার অন্তঃপাতী বাম্বারা রাজ্যের রাজধানী সিগো নগরে উপস্থিত হইলেন, এবং তত্রত্য রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত, অভিলাষ করিলেন। মধ্যে এক নদী ব্যবধান আছে, তাহা উত্তীর্ণ হইয়া রাজবাটী যাইতে হইবে। সে দিবস, পারঘাটায় এত জনতা হইয়াছিল যে, অন্যূন দুই ঘণ্টা কাল, তাঁহাকে সেখানে অপেক্ষা করিতে হইল।

 এই অবকাশে, রাজপুরুষেরা রাজার নিকট সংবাদ দিল, এক হীনবেশ শ্বেতকায় মনুষ্য তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছে। শ্রবণমাত্র, নৃপতি আপন এক অমাত্যকে তাঁহার নিকটে পাঠাইলেন। সে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কহিল, আমি রাজকীয় আদেশক্রমে আপনাকে জানাইতেছি, তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে, নদী পার হইবেন না। পরে, সে কিঞ্চিৎ দূরবর্ত্তী এক গ্রাম দেখাইয়া দিল, এবং কহিল, অদ্য আপনি ঐ গ্রামে গিয়া রাত্রি যাপন করুন।

 পার্ক শুনিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন, কিন্তু আর কোনও উপায় নাই দেখিয়া, সেই গ্রামে চলিলেন। পথিমধ্যে রজনী ও ঝড় বৃষ্টি উপস্থিত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে, গ্রামে প্রবিষ্ট হইয়া তিনি স্থান অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিদেশীয় লোক বলিয়া কেহই সাহস করিয়া তাঁহাকে আশ্রয় দিল না। সুতরাং, তিনি অত্যন্ত বিপদে পড়িলেন। বিশেষতঃ, সেখানে বন্য জন্তুর অত্যন্ত উপদ্রব, অনাবৃত স্থানে থাকিলে, প্রাণনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। অতএব, কি উপায়ে নিরাপদে রাত্রি যাপন করিতে পারি, তিনি এই চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 অবশেষে, তিনি, অন্য কোনও উপায় দেখিতে না পাইয়া, এক বৃক্ষের স্কন্ধদেশে অশ্ব বন্ধন করিলেন। পরে, বৃক্ষের উপরিভাগে বসিয়া রজনী যাপন করিব তাহা হইলে, বন্য জন্তুতে আক্রমণ করিতে পারিবে না, এই স্থির করিয়া, ঐ বৃক্ষে আরোহণ করিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে এক বৃদ্ধা কাফরি সেই স্থানে উপস্থিত হইল। সে, তাঁহার আকার প্রকার দেখিয়া, স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, ইনি বিদেশীয় লোক, আশ্রয় না পাইয়া, ব্যাকুল ও চিন্তান্বিত হইয়াছেন। তখন, সে তাঁহাকে তাহার অনুগামী হইতে সঙ্কেত করিল। তদনুসারে, তিনি তাহার সমভিব্যাহারে চলিলেন।

 বৃদ্ধা, আপন আবাসে উপস্থিত হইয়া, কুটীরের এক অংশে তাঁহাকে থাকিতে দিল। তাহার কন্যারা গৃহকর্ম্মে ব্যাপৃতা ছিল, সে তাহাদিগকে অগ্রে অতিথিসেবার আয়োজন করিতে কহিল। তাহারা, অবিলম্বে এক বৃহৎ মৎস্য সংগ্রহ করিয়া, তাঁহার নিমিত্ত আহার প্রস্তুত করিল, এবং পর্য্যাপ্ত আহার করাইয়া, মাদুর পাতিয়া, তাঁহাকে শয়ন করাইল। এইরূপে অতিথিপরিচর্য্যা সমাপ্ত হইলে, তাহারা পুনরায় গৃহকর্ম্মে নিযুক্ত হইল, এবং অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত কর্ম্ম করিতে লাগিল।

কাফরিকন্যারা, বোধ হয়, শ্রমলাঘবের নিমিত্ত, কর্ম্ম করিবার সময় গান করিতে লাগিল। পার্ক কাফরিভাষা কিছু কিছু বুঝিতে পারিতেন। গান শুনিয়া, কাফরিজাতির উপর তাঁহার বিলক্ষণ ভক্তি জন্মিল। দেখিলেন, তিনিই তাহাদের গানের বিষয়। গানের মর্ম্ম এই, “ঝড় বহিতেছিল, বৃষ্টি পড়িতেছিল, দীন হীন শ্বেতকায় মনুষ্য ক্লান্ত হইয়া আমাদের বৃক্ষের তলে বসিয়া ভাবিতেছিলেন, তাঁহার জননী নাই যে দুগ্ধ দেন, স্ত্রী নাই যে আহার প্রস্তুত করিয়া দেন, এস, আমরা শ্বেতকায় মনুষ্যকে আশ্রয় দি, তাঁহার কেহ নাই, তিনি নিরাশ্রয়।”

 কাফরিস্ত্রীদিগের দয়া ও সৌজন্য দর্শনে, পার্ক মোহিত ও চমৎকৃত হইলেন। সে রাত্রি তাহারা আশ্রয় না দিলে, তাঁহার দুর্গতির সীমা থাকিত না, হয় ত, প্রাণনাশ পর্য্যন্ত ঘটিত। রাত্রি প্রভাত হইলে, তিনি গাত্রোত্থান করিলেন, গৃহস্বামিনীর নিকটে গিয়া, আন্তরিক ভক্তিসহকারে, তাহাকে শত শত ধন্যবাদ দিলেন, এবং তাহার ও তাহার কন্যাদিগের নিকটে বিদায় লইয়া, রাজধানী অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *