ভ্রাতৃবিরোধ

ভ্রাতৃবিরোধ

 এক গৃহস্থ ব্যক্তির কিছু ভূমি সম্পত্তি ছিল। তিনি, সাতিশয় যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে কৃষিকর্ম্ম করিয়া, স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ পূর্ব্বক, বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন হয়েন। তাঁহার দুই পুত্র ছিল। পাছে উত্তর কালে, বিষয় বিভাগ উপলক্ষ্যে ভ্রাতৃবিরোধ উপস্থিত হয়, এই আশঙ্কায় তিনি, অন্তিম কাল উপস্থিত হইলে, বিনিয়োগপত্র দ্বারা উভয়কে যথাযোগ্য বিষয় বিভাগ করিয়া দিয়া যান। তাঁহার এক উদ্যান ছিল, অনবধানতা বশতঃ তিনি বিনিয়োগপত্রে ঐ উদ্যানের কোনও উল্লেখ করিয়া যান নাই।

 তাহারা দুই সহোদরে, ঐ বিনিয়োগপত্র অনুসারে, প্রত্যেকে পৈতৃক বিষয়ের যে অংশ পাইয়াছিল, সুশীল সুবোধ ও পরিশ্রমশালী হইলে, তাহা দ্বারা সুখে, স্বচ্ছন্দে ও সম্মান সহকারে, সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু তাহাদের সেরূপ প্রকৃতি ছিল না। বিনিয়োগপত্রে পরিত্যক্ত অবিভক্ত উদ্যান লইয়া, পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইল। সেই উদ্যানের রমণীয়তা ও লাভকরতা উভয় গুণই বিলক্ষণ ছিল, এজন্য উভয়েরই একাকী সম্পূর্ণ উদ্যান অধিকার করিবার সম্পূর্ণ লোভ জন্মিল। সেই লোভ সংবরণে অসমর্থ হওয়াতে উভয়েরই অন্তঃকরণে, ঐ উপলক্ষে, পরস্পরের প্রতি বিষম বিদ্বেষ জন্মিয়া উঠিল। বিষয়লোভ মনুষ্যের অতি বিষম শত্রু। ভ্রাতৃস্নেহ ও হিতাহিতবোধ তাহাদের হৃদয় হইতে এক কালে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

 উভয়কে বিবাদে উদ্যত দেখিয়া, প্রতিবেশিগণ, মধ্যস্থ হইয়া, তাহাদের বিরোধ ভঞ্জনের যথোচিত চেষ্টা ও যত্ন করিলেন, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। উভয়েই বিদ্বেষবুদ্ধির এরূপ অধীন হইয়াছিল যে, উভয়েই কহিল, সর্ব্বস্বান্ত হয় তাহাও স্বীকার, তথাপি উদ্যানের অংশ দিব না। তাহাদের ঈদৃশ ভাব দর্শনে, সাতিশয় বিরক্ত হইয়া, মধ্যস্থগণ নিরস্ত হইলেন। উভয়ের পরমাত্মীয় ও যথার্থ হিতৈষী অতি মাননীয় এক ভদ্র ব্যক্তি, উভয়কে ডাকাইয়া, অশেষ প্রকারে বুঝাইতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, তোমরা কেন অকারণে বিরোধ করিতেছ বল, যেমন উভয়ে, অন্যান্য বিষয়ে, সমাংশভাগী হইয়াছ, বিবাদাস্পদীভূত উদ্যানেও সেইরূপ সমাংশভাগী হও। আমার কথা শুন, অন্যান্য বিষয়ের ন্যায়, উদ্যানও উভয়ে সমাংশ করিয়া লও। রাজদ্বারে আবেদন করিলেও, বিচারকর্ত্তারা সমাংশ ব্যবস্থাই করিবেন, এক জনকে এক বারে বঞ্চনা করিয়া, অপর জনকে কখনই সমস্ত উদ্যান দিবার আদেশ করিবেন না, লাভের মধ্যে, উভয় পক্ষের অনর্থক অর্থব্যয় হইবে, এই মাত্র, আর হয় ত এই বিবাদ উপলক্ষে, উভয়েরই সর্ব্বস্বান্ত হইবে। অতএব, ক্ষান্ত হও, আমি মধ্যবর্ত্তী থাকিয়া সামঞ্জস্য করিয়া, উদ্যানের বিভাগ করিয়া দিতেছি।

 এই হিতোপদেশ শ্রবণ করিয়া জ্যেষ্ঠ কহিল, আপনি আমাদের পরম আত্মীয় ও অতি মাননীয় ব্যক্তি, আপনার উপদেশবাক্য শ্রবণ ও আদেশবাক্য প্রতিপালন করা আমাদের সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কিন্তু অংশ করিয়া লইতে গেলে, এমন সুন্দর উদ্যান একবারে হতশ্রী হইয়া যায়, অতএব, আপনি আমার ভ্রাতাকে বুঝাইয়া বলুন, সে, ন্যায্য মূল্য লইয়া, আমাকে সমুদয় উদ্যান ছাড়িয়া দিউক। কনিষ্ঠও শুনিয়া, ঈষৎ হাস্য করিয়া, অবিকল ঐরূপ প্রস্তাব করিল। আত্মীয় ব্যক্তি বিস্তর বুঝাইলেন ও অনেক প্রকার কৌশল করিলেন, কিন্তু কাহাকেও উদ্যানের অংশ গ্রহণে অথবা মূল্য গ্রহণ পূর্ব্বক অংশ পরিত্যাগে সম্মত করিতে পারিলেন না। তখন তিনি, যৎপরোনাস্তি বিরাগ ও অসন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক, চলিয়া গেলেন।

 অনন্তর, উভয়েই, কর্ত্তব্য নিরূপণ নিমিত্ত, এক এক উকীলের নিকটে গমন করিল, এবং, তথায় অভিলাষানুরূপ উপদেশ ও পরামর্শ পাইয়া, নিরতিশয় উৎসাহ সহকারে, বিবাদে প্রবৃত্ত হইল। এক স্থানে জ্যেষ্ঠের জয়, অপর স্থানে কনিষ্ঠের জয়, এইরূপে কতিপয় বৎসর ব্যাপিয়া, মোকদ্দমা চলিল। অবশেষে, সর্ব্বশেষ বিচারালয়ে সমাংশের ব্যবস্থা অবধারিত হইল। তখন উভয়কেই অগত্যা সেই ব্যবস্থা শিরোধার্য্য করিয়া লইতে হইল।

 মোকদ্দমার ন্যায্য ব্যয় তাদৃশ অধিক নহে, কিন্তু আনুষঙ্গিক ব্যয় এত অধিক যে, দীর্ঘ কাল তাহাতে লিপ্ত থাকিলে, প্রায় সর্ব্বস্বান্ত হইয়া যায়। তাহাদের হস্তে যে টাকা ছিল, কিছু দিনের মধ্যে, তাহা নিঃশেষ হইয়া গেল, সুতরাং, টাকা সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত, উভয়কেই ভূমি সম্পত্তির কিয়ৎ অংশ বিক্রয় করিতে ও কিয়ৎ অংশ বন্ধক রাখিতে হইল। যে উদ্যানের নিমিত্ত এত আগ্রহ ও এত আক্রোশ, তাহাও, দীর্ঘ কাল উপেক্ষিত হইয়া, শ্রীভ্রষ্ট ও অকিঞ্চিৎকর হইয়া গেল। যখন মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হইল, সে সময়ে উভয়ের এত ঋণ হইয়াছিল যে সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিলেও, পরিশোধ হইয়া উঠিবে না। তাহারা, অহঙ্কারে মত্ত হইয়া, এবং প্রতিবেশিগণ ও আত্মীয়বর্গের উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, বিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, এক্ষণে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া, অবশেষে, তাহাদিগকে দুর্দ্দশায় কাল যাপন করিতে হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *