অপত্যস্নেহ

অপত্যস্নেহ

ইংলণ্ডের রাজধানী লণ্ডন নগরে হোয়াইট্‌চেপল নামে এক স্থান আছে। তথায় পরস্পর-সংলগ্ন শ্রেণীবদ্ধ কতকগুলি গৃহ ছিল। যাহাদের নিজের বসতিবাটী নাই, এরূপ লোকেরা ভাড়া দিয়া ঐ সকল গৃহে অবস্থিতি করিত। একদা দৈব ঘটনায় তথায় অতি ভয়ানক অগ্নিদাহ উপস্থিত হইল। যেখানে অগ্নি লাগে, তথায় প্রবল বেগে বায়ু বহিতে থাকে, সুতরাং অগ্নি উত্তরোত্তর অধিকতর প্রদীপ্ত হইয়া উঠে। এখানেও অগ্নি, প্রবল বাযুর সহায়তায়, অল্পক্ষণের মধ্যে, বিলক্ষণ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, অনেকেই গৃহ হইতে বহির্গত হইতে পারিল না। সমবেত প্রতিবেশীরা, অনেক কষ্টে কতকগুলি লোককে বহিষ্কৃত করিল, অবশিষ্ট সমুদয় লোক তন্মধ্যে রহিয়া গেল।

 একটী দরিদ্রা স্ত্রীর কতকগুলি শিশুসন্তান ছিল। সে, প্রতিবেশীদিগের সহায়তায়, আপন সন্তানগুলি লইয়া, বহির্গত হইয়াছিল। জগদীশ্বরের কৃপায়, এ যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম, এই ভাবিয়া, সে, তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়া, সাহায্যকারী প্রতিবেশীদিগের যথেষ্ট স্তুতি করিল, পরে একে একে সন্তানগুলির নাম গ্রহণপূর্ব্বক, আহ্বান করিতে গিয়া, জানিতে পারিল, সর্ব্বকনিষ্ঠ শিশু সন্তানটি আনীত হয় নাই, সে গৃহমধ্যে রহিয়া গিয়াছে। তাহাকে না দেখিতে পাইয়া, সেই দরিদ্রা উন্মত্তার ন্যায় হইল এবং সন্তানের স্নেহ ও মায়ার বশীভূত হইয়া, স্বীয় প্রাণবিনাশের শঙ্কা না করিয়া, অকুতোভয়ে, দ্রুত বেগে, অগ্নিরাশির মধ্যে প্রবেশ করিল।

 কিয়ৎক্ষণ পরে, সে, এক শিশু সন্তান ক্রোড়ে করিয়া পূর্ব্বস্থানে আগমন করিল। সন্তানের প্রাণ রক্ষা করিয়াছি, এই ভাবিয়া আহ্লাদে উন্মত্তপ্রায় হইল, এবং কিরূপে জ্বলন্ত অধিরোহণী দ্বারা আরোহণ করিল কিরূপে গৃহে প্রবেশপূর্ব্বক দোলা হইতে সন্তান লইয়া পুনরায় গৃহ হইতে নির্গত হইল, এই সমস্ত সন্নিহিত ব্যক্তিবর্গের নিকট বর্ণন করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, আহ্লাদভরে, শিশু সন্তানের মুখ চুম্বন করিতে গিয়া, দেখিতে পাইল, সে তাহার সন্তান নহে। তাহার পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে অপর এক স্ত্রীলোক থাকিত, সে, আপন সন্তান পরিত্যাগ করিয়া, পলাইয়া আসিয়াছিল, এ তাহার সন্তান।

 যৎকালে সে, শিশু সন্তানকে আনিবার নিমিত্ত গমন করে, তখন অগ্নিশিখায় সমস্ত স্থান এরূপ আচ্ছন্ন হইয়াছিল যে, কিছুমাত্র দেখিতে পাওয়া যায় নাই, সুতরাং স্বীয় গৃহ ভ্রমে অপর গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, এক্ষণে আপন ভ্রম বুঝিতে পারিয়া, শোকে নিতান্ত বিহ্বল হইয়া বিলাপ করিতে লাগিল। অপত্যস্নেহের এমনই মহিমা, সেই স্ত্রীলোক, কোনও মতে স্থির হইতে না পারিয়া, শোকসংবরণ করিয়া, পুনরায় সেই শিশু সন্তানের আনয়ন নিমিত্ত, জ্বলন্ত গৃহের অভিমুখে ধাবমান হইল। সে, গৃহের সম্মুখবর্ত্তিনী হইবামাত্র, উহা দগ্ধ হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। তখন সে, একবারে হতাশ হইয়া, হায় কি হইল বলিয়া বিচেতন ও ভূতলে পতিত হইল, এবং অল্প সময় মধ্যেই প্রাণত্যাগ করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *