গুরুভক্তি
রুশিয়ার রাজমহিষী দ্বিতীয় কেথেরিনের অপত্যস্নেহ অত্যন্ত প্রবল ছিল। কাহারও শিশু সন্তান দেখিলে, তিনি অনির্ব্বচনীয় প্রীতি অনুভব করিতেন। পরিচারকদিগের শিশু সন্তান সকল সর্ব্বদা তাঁহার নিকটে থাকিত। অনাথ বালক বালিকাদিগকে, স্নেহ ও যত্নপূর্ব্বক, লালন ও নিজ ব্যয়ে প্রতিপালন করিতেন। কৰ্মচারীদিগের উপর এই আদেশ ছিল, অনাথ বালক বালিকা দেখিলে, তাঁহার নিকটে আনিয়া দিবে।
এক দিন, পুলিসের লোকেরা, পথিমধ্যে একটি অতি অল্পবয়স্ক বালককে পতিত দেখিয়া, তাহাকে রাজমহিষীর নিকটে আনিয়া দিল। তিনি, সবিশেষ স্নেহ ও যত্ন সহকারে, তাহার লালন পালন করিতে লাগিলেন।
এই বালক রাজমহিষীর সবিশেষ স্নেহপাত্র হইল। সে পঞ্চমবর্ষীয় হইলে, তিনি তাহাকে বিদ্যালয়ে নিযুক্ত করিয়া দিলেন, এবং যাহাতে সে উত্তমরূপ বিদ্যা লাভ করিতে পারে, সে বিষয়ে অত্যন্ত যত্ন করিতে লাগিলেন। সেই বালক বিলক্ষণ বুদ্ধিমান, সুযোগ পাইয়া, আন্তরিক যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে, শিক্ষা করিতে লাগিল। বিশেষতঃ, সে স্বভাবতঃ অতিশয় সুশীল ও সুবোধ। যে সমস্ত গুণ থাকিলে, বালক লোকের প্রিয় ও স্নেহভাজন হয়, সেই সকল গুণে অলঙ্কৃত ছিল। ইহা দেখিয়া, রাজমহিষী অত্যন্ত আহ্লাদিত হইতে লাগিলেন। তাহার উপর তদীয় স্নেহ দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ফলতঃ তিনি তাহাকে আপন গর্ভজাত সন্তানের ন্যায় জ্ঞান করিতেন, এবং সেই বালকও তাঁহাকে আপন জননীর ন্যায় জ্ঞান করিত।
এক দিন, সে বিদ্যালয় হইতে প্রত্যাগমন করিলে, রাজমহিষী তাহাকে, নিকটে আসিবার নিমিত্ত, আহ্বান করিলেন। তিনি, অন্য অন্য দিন, তাহাকে যেরূপ হৃষ্ট ও প্রফুল্লবদন দেখেন, সে দিন সেরূপ দেখিলেন না। তাহাকে নিতান্ত ম্লান ও বিষণ্ণ দেখিতে পাইয়া, তিনি ক্রোড়ে বসাইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বালক রোদন করিতে লাগিল। তিনি তাহার নেত্র মার্জ্জন ও মুখ চুম্বন করিয়া, আশ্বাসবাক্যে কহিলেন, বৎস। তুমি কি জন্য রোদন করিতেছ, বল।
তখন সে কহিল, জননি, আমি আজ বিদ্যালয়ে যতক্ষণ ছিলাম, কেবল রোদন করিয়াছি। সেখানে গিয়া শুনিলাম, আমাদের শিক্ষক মরিয়াছেন, এবং দেখিলাম, তাঁহার স্ত্রী ও সন্তানেরা রোদন করিতেছেন। সকলে বলিতেছেন, তাঁহারা অত্যন্ত দুঃখী, খাওয়া পরা চলে, এমন সঙ্গতি নাই, এবং সাহায্য করে, এমন আত্মীয়ও নাই। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া, আমার অত্যন্ত দুঃখ হইয়াছে। মা। তোমায় তাঁহাদের কোনও উপায় করিয়া দিতে হইবে।
সেই বালকের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, রাজমহিষীর অন্তঃকরণে করুণার উদয় হইল। তিনি অবিলম্বে, এক পরিচারককে আহ্বান করিয়া, এ বিষযের অনুসন্ধান করিতে পাঠাইয়া দিলেন, এবং সেই বালকের মুখ চুম্বন করিয়া কহিলেন, বৎস! অল্প বয়সে তোমার এরূপ বুদ্ধি ও বিবেচনা হইয়াছে, ইহাতে আমি কি পর্য্যন্ত প্রীত হইলাম, বলিতে পারি না। যাহাতে তোমার শিক্ষকের পরিবার ক্লেশ না পায়, তাহা আমি অবশ্য করিব, তুমি সেজন্য দুঃখিত হইও না।
কিয়ৎক্ষণ পরে, প্রেরিত পরিচারক প্রত্যাগমন করিল, এবং শিক্ষকের মৃত্যু ও তদীয় পরিবারের অনুপায় বিষয়ে বালক যাহা কহিয়াছিল, সে সমুদয় সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া, রাজমহিষীর নিকট জানাইল। তখন তিনি, বালকের হস্তে দিয়া, শিক্ষকের পত্নীর নিকট, আপাততঃ তিন শত রূবল[১] পাঠাইলেন, এবং যাহাতে সেই নিরুপায় পরিবারের স্বচ্ছন্দে ভরণ পোষণ চলে, এবং শিশু সন্তানদিগের উত্তমরূপ বিদ্যাশিক্ষা হয় তাহার অবিচলিত ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
—
১. রুশিয়াদেশে প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রা, মূল্য ১॥৵০।