নিঃস্বার্থ পরোপকার

নিঃস্বার্থ পরোপকার

 পারিস নগরে, হেনল্ট নামে এক বিধবা নারী থাকিতেন। তিনি, নস্য বিক্রয় ব্যবসায় দ্বারা, বহু কাল পর্য্যন্ত, স্বচ্ছন্দে ও সম্মান পূর্ব্বক কাটাইলেন, কিন্তু বায়াত্তর বৎসর বয়সে, অতিশয় নিঃস্ব ও নিতান্ত নিরুপায় হইয়া পড়িলেন। যে গৃহে তাঁহার বিপণি ছিল, তাহার ভাটক দানে অসমর্থ হওয়াতে, তাঁহাকে ঐ গৃহ পরিত্যাগ করিতে হইল। এক্ষণে তাঁহার আর দাঁড়াইবার স্থান রহিল না। তাঁহার দুই পুত্র বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন ছিলেন, এই দুঃসময়ে তাঁহারা তাঁহার কিছুমাত্র আনুকূল্য করিলেন না।

 মারগরেট ডিমলিন নামে তাঁহার এক পরিচারিকা ছিল। সে তেইশ বৎসর তাঁহার নিকটে কর্ম্ম করে। এক্ষণে স্বামিনীর দুরবস্থা দেখিয়া, তাহার অত্যন্ত দয়া উপস্থিত হইল। সে দয়া করিয়া আনুকূল্য না করিলে, নিঃসন্দেহ অনাহারে তাঁহার প্রাণবিয়োগ ঘটিত।

 ডিমলিন, প্রথমতঃ, এক প্রতিবেশীর নিকটে উপস্থিত হইল, এবং অনেক বিনয় ও কাতরোক্তি করিয়া এই প্রার্থনা করিল, আপনি অনুগ্রহ করিয়া, আপন বিপণির এক পার্শ্বে, আমার স্বামিনীকে স্থান দিন। তিনি সম্মত হইলে, হেনল্টকে সেই স্থানেই বাস করাইল। তথায়, তিনি পূর্ব্ববৎ নস্য বিক্রয় করিতে লাগিলেন। তদ্দ্বারা যাহা লাভ হইতে লাগিল, তাহাতে তাঁহার সমুদয় ব্যয় নির্ব্বাহ হওয়া কঠিন দেখিয়া, ডিমলিন তাঁহার আনুকূল্যের নিমিত্ত, সূচীকর্ম্ম প্রভৃতি দ্বারা, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ উপার্জ্জন করিতে লাগিল।

 প্রতিবেশীরা ডিমলিনকে ধর্ম্মিষ্ঠা, দয়াশীলা ও সচ্চরিত্রা বলিয়া জানিত। সুতরাং অনেকেই তাহাকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইত। কিন্তু, এমন দুঃসময়ে, আমি ইহাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারি না, আমি গেলে, ইহার কষ্টের সীমা থাকিবে না, ইনি যত দিন জীবিত থাকিবেন, আমি অন্যত্র কুত্রাপি যাইতে পারিব না। এই বলিয়া, সে কাহারও প্রস্তাবে সম্মত হইত না।

 এইরূপে, নিরুপায় হেনল্ট যতদিন জীবিত রহিলেন, ডিমলিন, সাধ্যানুসারে তাঁহার পরিচর্য্যা ও প্রাণরক্ষা করিল। কিন্তু, সে তাঁহার কত দূর পর্য্যন্ত উপকার করিতেছে, তিনি তাহা বুঝিতে পারিতেন না। ডিমলিনের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন দূরে থাকুক, তিনি, অকারণে কুপিত হইয়া, সর্ব্বদা তাহাকে প্রহার করিতেন, ডিমলিন তাহাতেও রুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইত না। বিশেষতঃ, সে তাঁহার নিকটে যে তেইশ বৎসর কর্ম্ম করিয়াছিল, তাহার পনর বৎসরের বেতন পায় নাই। ইহাকেই নিঃস্বার্থ পরোপকার বলে। ফলতঃ ডিমলিনের আচরণ দয়া, ভদ্রতা ও প্রভুভক্তির অদ্ভুত দৃষ্টান্ত।

 পারিস নগরে ফ্রেঞ্চ একাডেমি নামে এক প্রসিদ্ধ সমাজ আছে। সৎকর্ম্মে লোকের উৎসাহ বর্দ্ধনের নিমিত্ত, সমাজের অধ্যক্ষেরা প্রতিবৎসর এক এক পারিতোষিক প্রদানের ব্যবস্থা করিয়াছেন। তাঁহাদের বিবেচনায় যে ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় সৎকর্ম্ম করে, সে ঐ পুরস্কার পায়। ডিমলিনের আচরণ শ্রবণে, তাঁহারা এত প্রীত হইলেন যে, সে ঐ বৎসরের পুরস্কারের সর্বাপেক্ষা অধিক যোগ্য, ইহা স্থির করিয়া, তাহাকেই ঐ পারিতোষিক প্রদান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *