ভাগীরথীর তীরে
অনন্তরাজ নৌকা ছেড়ে দিলেন।
রাজপুত্রের নৌকা। শাল পিয়াল আর গামার কাঠের পাটি দিয়ে তৈরি। কাঠের পাটিতে তাল আর লোহার গজাল। সামনের দিক ছুঁচোলো। পিছনের দিক গোলাকৃতি। এমন আকারের জন্যই নৌকার আঘাতে সামনের দিকের জল স্থানচ্যুত হয়ে যেন নৌকার দুদিকে সমানে বয়ে যায়। নৌকার গায়ে অপূর্ব কাঠের কারুকার্য। সারি সারি কাঠের কলসিতে আমের পল্লব। বসন্তের হাওয়ায় সে আমপাতাগুলি দুলে দুলে উঠছে।
নৌকার মাঝে দুইখানি ঘর। চন্দন কাঠের দেওয়াল। চালে কাঠের কলসিতে গৌরীবেলী। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে মধুমাসের বাতাসে।
ঘরটির দুপাশে নাইয়াদের বসার সুবন্দোবস্ত। কুড়িটি দাঁড় বওয়ার ব্যবস্থা।
পিছনের দিকে নাটশালা। গাইয়েদের বাস। রঙ্গ তামাশায় ভরপুর। নাটশালার দেওয়ালে বিভিন্নরকমের নকশা। কোনোটি নর্তকীর। কোনোটি আবার লীলার। ঢোল। এসরাজ। কোনোটি বীণা।
রতনপুর গ্রামের সবাই জানে বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে— কাষ্ঠকার, শিলাকার, লৌহকার, তাম্রকার আর সুবর্ণকার মিলে এ নৌকা তৈরি করেছেন।
নৌকার নাম— দিগন্ত।
এক মাসের পথ। কাঞ্চননগরের রাজকন্যের স্বয়ংবরে চলেছেন অনন্তরাজ।.
রাজঘাটের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোটো আর-একটি ঘাট আছে আধক্রোশ উজানে। বটের ঝুরির ছায়ায় শান্ত আড়ম্বরহীন ঘাট। ঘাটের কাছে ছোটো নৌকা বাঁধা। আকারে দিগন্তের এক-চতুর্থাংশ। আড়ম্বর বৈভবে তারও কম। ডিঙার গায়ে ফলন্ত ধানের শিষ খোদাই করা। রুপার কারুকার্য। চাঁদ উঠলে চকচক করে উঠবে গা। এতে যাচ্ছে ‘দিগন্ত’-র মাঝিমাল্লা, নর্তক, গায়ক, সৈন্যদলের খাদ্যসামগ্রী। একশত পাউটি চাল। সুগন্ধি মশলা। মোরগ হাঁস। শুকনো মিষ্টান্ন।
… আর রসুইকর।
এর নাম ‘ভাণ্ডার’।
রতনপুরের ঘাটে সহস্র এয়োবতী সমবেত হয়েছিলেন সীমন্তে জ্বলজ্বলে সিঁদুর নিয়ে। সমবেত কণ্ঠে বলেছিলেন, “এই দ্যাখো সিন্দুর/শত বাধা হও দূর।” জলের কুমির, অপদেবতা, জলপরি, উনপঞ্চাশ বায়ু সতী নারীর সিঁদুরের ভয়ে নৌকার কাছে আসে না। দীপমালার আলো প্রতিফলিত হয়েছিল গঙ্গার জলে।
.
‘দিগন্তে’ সোনার ঘট আর ‘ভাণ্ডারে’ রুপার ঘট স্থাপন করেছেন রাজপুরোহিত। স্বস্তিকবাচন আর গজাননের আবাহন করে দুই নৌকায় এঁকে দিয়েছেন তেলসিঁদুরে হাতির শুঁড়।
যাত্রা শুরু হল।
ক্রোশখানেকের অগ্র পশ্চাতে দুটি নৌকা ভেসে চলল দক্ষিণে। স্রোতের অনুকূলে দুটি রাজহাঁসের মতো ভেসে চলল।
নৌকায় নৌকায় জ্বলে ওঠে আলো। ‘দিগন্ত’-র প্রাচীরে প্রদীপের সারি। প্রত্যেকটি প্রদীপ আবার স্ফটিকের আবরণে ঢাকা, যার উপরিভাগে বায়ু চলাচলের জন্য ছিদ্রও রয়েছে।.
অনন্তরাজের বয়স অল্প। আঠারো-উনিশ বছরের যুবাপুরুষ। অস্থিরমতি। কপালে চন্দনলেপ। হাতে স্বর্ণবলয়। গলায় সুবর্ণমালিকা।
থেকে থেকে খোলা পাটাতনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন আর তরণীধরকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কতদিনের পথ এলাম গো, সুনন্দ?’
অভিজ্ঞ মাঝি পরম বিনয়ে বারবারই উত্তর দেয়, ‘প্রভু, এই তো আর কয়দিন মাত্র।’
গঙ্গার ডানপাড়ে তখন শিমুল পলাশে আগুন লেগেছে। বামপাড়ে শূন্য কুলগাছের বনের নিচে শেয়ালের আনাগোনা। প্রহরে প্রহরে তারা ডেকে ওঠে যামপ্রহরীর মতো।.
নবদ্বীপের ঘাটে নৌকা দুটি বাঁধা হয়েছে। কুড়িদিনের পথে কোনও বড়ো বিঘ্ন ঘটেনি। শুধু কালবৈশাখীর অগ্রদূত চৈতালি ঘূর্ণিতে ‘ভাণ্ডার’-এর পালের মাস্তুল ভেঙে পড়েছিল।
নবদ্বীপের পূর্বাকাশ ছেড়ে সূর্য তখন অনেকখানি উঠে এসেছে। চৈত্রের আঁচ সূর্যরশ্মি বেয়ে গঙ্গার জলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সারি সারি পসরা নিয়ে ভরে উঠছে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাণ্ডার। তিলমন্ডা, চন্দন বা ফুলের মালা তাতে যেমন রয়েছে, রয়েছে চাল, ডাল, মশলার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী।
পৃথক ফাঁকা জায়গায় কিছু পসরা বেশ বড়ো জায়গায় ছড়িয়ে বসেছে। তাতে সুর্মা, আতর, রেশমি কাপড়, পাথরের মালা।
অনন্তরাজ সাধারণ মানুষের বেশে নগর ঘুরতে বেরিয়েছেন। নারকেলের পুলি অনন্তরাজের বড়ো প্রিয়। আর তক্র (দই)। একটি খাদ্যভাণ্ডারে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আকৃতির মোদক। সুগন্ধে বাতাস ম ম করছে।
অনন্তরাজের আর তর সইল না।
দক্ষিণে মহিশূড়া থেকে শ্রীনাথপুর পর্যন্ত মানুষে মানুষে নবদ্বীপ পরিপূর্ণ। বসন্তোৎসব আগতপ্রায়। ফাগে রঙে রাজপথ বহু রঙে রঞ্জিত। অন্য নৌকার পশ্চিমি মাল্লারা দল বেঁধে ঢোল নিয়ে গান ধরেছে— ‘সাঁবরিয়া কঁহা চলে গ্যাইয়া/আগে নন্দী চলে, পিছে চলে সঁইয়া—’।
ভিক্ষাপোজীবী অন্ধ আতুর খঞ্জ গঙ্গাতীরে কাপড় পেতে যাত্রীদের কাছে বিচিত্র সুরে ভিক্ষা চাইছে। পুররক্ষী দলের লোভাতুর চোখ যুবতী নারী আর অসহায় ধনীর পেটিকার প্রতি।
অনন্তরাজ ভাগীরথীর তীর বরাবর হাঁটতে লাগলেন উত্তরে। ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে অপেক্ষাকৃত শান্ত একটি স্থানে পৌঁছোলেন। ভাগীরথী প্রবাহের পাশে একটি নিমগাছের ছায়ায় বসলেন। পাশে গৃহস্থ বাড়ি। বাঁশের বেড়ায় অপরাজিতা লতা। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় নিমগাছের সুশীতল ছায়া আরও মনোরম হয়ে উঠল।
হঠাৎ কানে এল— “নীয়তে বিবধিতার্থঃ অনেন ইতি ন্যায়ঃ”
কী সুন্দর উচ্চারণ! কী ভরাট গলা!
বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন অনন্ত। তাঁরই বয়সি একটি ছেলে মাটির উপরে আসন পেতে বসে একটি বৃহৎ গ্রন্থ পাঠ করছে।
সে কী রূপ! তাঁর নৌকা, রাজকোশের সমস্ত স্বর্ণভাণ্ডার গলিয়ে একত্রিত করলেও অমন দীপ্তি দেখা যাবে না।
পায়ে পায়ে অনন্ত এগিয়ে গেলেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মুগ্ধ কানে শুনতে লাগলেন।
পাঠ শেষ করে প্রণামান্তে ব্রাহ্মণ যুবক গ্রন্থটি বন্ধ করলেন। সামনেই অনন্তরাজকে দেখলেন। প্রথমে চমকিত হলেও, কিছু পরে সকৌতুকে দেখতে লাগলেন।
বললেন, ‘রাজামশাই, বসতে আজ্ঞা হোক।’
অনন্তরাজ কিছু বিস্মিত হলেন। তিনি তো রাজবেশ নৌকায় রেখে এসেছেন। তবে কী করে..? তাঁর দ্বিধা দেখে পরমসুন্দর বললেন, ‘কপালে চন্দনাঙ্কিত সূর্য রাজপুরুষেরই থাকে। আসুন। বসুন।’
– আপনি কে পণ্ডিত?
– আমি? পণ্ডিত ব্যুৎপত্তি। গুরুমশাই নিপাতনে সিদ্ধ বলেন। হা হা.. আপনার পরিচয় তো জানা হল না।
অনন্তরাজ বললেন,
– আমি স্বয়ংবরে যাচ্ছি কাঞ্চননগর।
– আপনাকে যদি তাঁর পছন্দ না হয়? কী করবেন?
– কী আর করব? ফিরে আসব।
– সে কী, রাজকন্যার প্রতি আপনার এমন নৈর্ব্যক্তিক মনোভাব কেন?
– তা নয়, তবে আমি প্রেমে বলের সমর্থক নই।
– বল নয়, মস্তক বলেও তো একটি ব্যাপার আছে, নাকি? নাকি সে শুধুমাত্র কেশপ্রসাধনের জন্য?
অনন্তরাজ সমবয়স্ক ব্রাহ্মণের হাত দুটি ধরে মিনতি করে বললেন,
– পণ্ডিত, তবে দিকনির্দেশ করো।
– করব, তবে পরিবর্তে কী পাব আমি?
– বান্ধব, রাজকন্যা বাদে যা চাইবে তাই…
– হা হা, সে সময়ে চেয়ে নেব। শোনো তবে—.
ভাগীরথীর শীতল চৈতালি বাতাসে নিম্ববৃক্ষের পাতাগুলি ঝমঝম করতে লাগল। রৌদ্র গাঢ় হল। দুই নওলকিশোরের বিশ্রম্ভালাপে যেন তাদের প্রতিধ্বনি।.
দুপুর গড়িয়ে যেতে বসল। ভিতরবাড়ি থেকে ডাক এল,
– নেয়ে আয় ছোটো খোকা।
ব্রাহ্মণ চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
– ওই শোনো মিতা, মা ডাকেন। চলো ডুব দিয়ে এসো, দুটিতে খেয়ে নিই। মায়ের আমার রান্না মোচার ঘণ্ট তো খাওনি….
কাঞ্চননগর নদীবন্দর। বিপণন, বিনোদন আর বিনিয়োগের স্থান। নগরীর চতুর্দিকে সুউচ্চ প্রাচীর।
সুউচ্চ অট্ট থেকে প্রহরী বাজপাখির মতো নজর রাখে নগরীর সীমান্তে। নদীবন্দরের বিপরীত দিকে অর্ধচন্দ্রাকারে সুগভীর পরিখা দুর্গনগরীকে ঘিরে আছে পূর্ব আর উত্তরে।
সারি সারি বিশাল নৌকার দল রাজহাঁসের মতো ভেসে আছে বন্দরে। রকমারি তাদের আকার। বাহারি তাদের কারুকৃতি।
‘ভাণ্ডার’ শুধুমাত্র বন্দরে নোঙর করেছে। ‘দিগন্ত’-র চিহ্নমাত্র নেই।.
শ্বেতপাথরে তৈরি সিঁড়ি নেমে গেছে রাজ-অন্তঃপুর থেকে নদীর দিকে। এই অংশে পরিখা অনুপস্থিত। প্রাচীর পার হয়ে দুই দণ্ড হাঁটলে প্রশস্ত ঘাট।
অশ্বত্থের ছায়ায় এক জটাজূটধারী সাধু বসেছেন। সামনে অশ্বত্থ ডাল, খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছেন। লাল পোশাক। থেকে থেকে… ‘কালী কৈবল্যদায়িনী’ বলে হুংকার দিয়ে উঠছেন।
প্রাসাদের দরজা দিয়ে ঝুমঝুম শব্দ ভেসে এল। একঝাঁক প্রজাপতির মতো পুরাঙ্গনারা বেরিয়ে এলেন। পিছনে যমদূতের মতো দুই প্রহরী। ঘাটের কাছে পৌঁছোনোর আগে তারা প্রাসাদের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। রাজকন্যা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো স্বরে বলে উঠল,
– ওমা, যুবক ঋষিঠাকুর! চল দেখে আসি।
বাতাসে হিল্লোল তুলে গান্ধার পদচারণায় কৃষ্ণা এলেন ঋষির সামনে। স্মিতহাস্যে ঋষি বললেন,
– কল্যাণীয়া, মঙ্গল হোক তোমার…
ঋষির মধুর কথায় রাজকন্যার কৌতুক মুহূর্তে উবে গেল। সে করজোরে হাঁটু মুড়ে বসে বলল,
– ঠাকুর, আমার দ্বিধাভঞ্জন করো।
– বলো, কী দ্বিধা?
– আগামিকাল আমার স্বয়ংবর। আমি বর বাছি কী দেখে বলো দেখি? রূপ দেখে না বল দেখে?
– ও দুটি ছাড়া রাজপুরুষের আছেই বা কী? গুণটি দ্যাখো যার/ মাল্য গলে তার।
– গুণ! সে বুঝব কী করে গো?
– সবাইকে একটি প্রশ্ন করবে। উত্তর যিনি দিতে পারবেন তাকেই বরমালা দিয়ো।
– কী প্রশ্ন ঠাকুর?.
ঋষি অন্য পুরাঙ্গনাদের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের ভাষা বুঝে রাজকন্যা তাদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তারা পিছিয়ে গেল অনতিদূরে। সেখানে নদীর হাওয়ায় কারও কথা শোনা গেল না। প্রহরীরা একবার ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে, আবার ছবির মতো স্থির হয়ে রইল।
আশীর্বাদী ফুল নিয়ে রাজকন্যা ভিজে গায়ে ঘরের শিবমূর্তির সামনে হাঁটু পেতে বসল। করজোড়ে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘সিদ্ধিনাথ, গুণীজনকে সিদ্ধি দিয়ো।’
দুধসাদা, ঘিয়ে রঙের রেশম আর তসরের ঢাকনা দেওয়া আসনে সভাগৃহ পরিপূর্ণ। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, চাঁপা, কেয়া ছড়িয়ে আছে।
ফুলের জলসা। পাপড়িমর্দিত সুগন্ধ।
ভৃত্যের দল ঘণ্টায় ঘণ্টায় আতরদানে করে আতর, গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ষড়ভুজ সভাগৃহের বাহুগুলির প্রতিটির মিলনস্থলে হাতির দাঁতের কাজ করা ধূপদানে দেওয়া আছে ফুলের শুকনো দলমণ্ডল। তাতে ধূপ, কেশর, গোলাপের শুকনো পাপড়ি, শ্বেতচন্দনের কুচি, দারুচিনির কাঁচা ছাল, রতি রতি কস্তুরি দেওয়া রয়েছে। তাও প্রহরে প্রহরে বদলে দেওয়া হচ্ছে পালা করে।
বৃত্তাকারে বসে আছেন দূর দূর দেশের রাজপুরুষের দল। সবাই উদগ্রীব।
নক্ষত্রলোকে চন্দ্রিমার মতো কৃষ্ণা সভাগৃহে উপস্থিত হলেন। চতুর্দিক তাঁর রূপের ছটায় ঝলমল করে উঠল।
.
রাজা পঞ্চশীল উঠে দাঁড়ালেন। জলদমন্দ্র স্বরে বললেন,
– উপস্থিত রাজন্যবর্গকে সম্মান ও অভিবাদন জ্ঞাপন করি। আপনারা রাজকুমারী কৃষ্ণার স্বয়ংবরে অনেক দূরদেশ থেকে এসেছেন। কাঞ্চননগর ধন্য হয়েছে আপনাদের পাদস্পর্শে। সবার শুভ হোক।
একটি ঘোষণা আছে। সবাই মন দিয়ে শুনবেন। রাজকুমারীর মনোগত বাসনা, তিনি শ্রেষ্ঠ গুণীকে স্বামী হিসেবে বেছে নেবেন।.
অভ্যাগতদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। সবাই নড়েচড়ে বসলেন। অনন্তরাজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন কৃষ্ণার দিকে। কিংশুক আর হেমলতায় ভুজঙ্গিনী কবরীবন্ধন মনোহরা হয়েছে আরও। রক্তমাণিক্য আর সুবর্ণখচিত শিরোভূষণে সিঁথিপাটি জ্বলজ্বল করছে। পরনে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সোনার জরি অলংকৃত পরিধেয়। হাতে রক্তকমলের কোরক।
অনন্তরাজের শ্বাসবায়ু বন্ধ হয়ে এল। বুক দুরুদুরু।
জলতরঙ্গ বেজে ওঠার ঠিক শুরুতে যেমন সুরমূর্ছনা শোনা যায়, তেমন স্বরে রাজকুমারী বললেন,
– উপস্থিত রাজন্যবর্গকে আমার প্রণাম। আমি একটিমাত্র প্রশ্ন সবাইকে করব। যিনি উত্তর দিতে পারবেন, তিনিই আমার এবং কাঞ্চননগরের স্বামী হবেন। একাধিক সঠিক উত্তরের ক্ষেত্রে পুনর্নির্বাচন হবে। উত্তরের সঙ্গে ব্যাখ্যাও আবশ্যিক।
সবার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল। সভায় অপার নৈঃশব্দ্য।
প্রশ্ন এল বাগদেবীর সংগীতের মতো,
“শিরোপরি পৃথ্বী ধরি
পৃষ্ঠে প্রিয় কৈটভারি,
ভূষণ ডমরুধর,
পর্বতেরে দণ্ড করি
সর্পে করি সহচরী
বৈরী সহচর।”
অনন্তরাজ লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘এর উত্তর আমি জানি। ইনি অনন্তরাজ… থুড়ি, অনন্তনাগ।’
কৃষ্ণা চমকিত হলেন। এত শীঘ্র উত্তর তিনি আশা করেননি। তাঁর হাত থেকে পদ্মের কুঁড়িগুলি পড়ে গেল। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘ব্যাখ্যা করুন আর্য।’
অনন্ত বললেন, ‘এ আর এমন কী? মাথায় করে পৃথিবীকে কে ধরেন? তিনিই অনন্তনাগ। পিঠে কৈটভহন্তারক বিষ্ণু। তিনিই শিবের… ডমরুধরের ভূষণ। মন্দার পর্বতকে তিনি দণ্ড করে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। সর্প বা নাগদেবী বিষ্ণুর বোন বা সহচরী। আর সর্পকুলের বৈরী অর্থাৎ খগরাজ গরুড় তাঁর বান্ধব।’
কৃষ্ণার সখীগণ উলুধ্বনি করে উঠল। লজ্জাবনতা রাজকুমারী অনন্তরাজের হাতে তুলে দিলেন স্বর্ণদর্পণ।
রাজ অমাত্যগণের সাধু সাধু রবে সভাগৃহ ভরে গেল। মাঙ্গলিক শঙ্খ বেজে উঠল। পুরনারীরা প্রাসাদের অলিন্দ থেকে স্বর্ণমুদ্রা ছড়িয়ে দিলেন উপস্থিত জনসাধারণের মধ্যে।.
তখন বরবকশাহি বংশের শেষ। রাজা গণেশ আর তস্য পুত্র যদু হাবসি মাৎস্যন্যায়ের মধ্যে বাংলায় স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ। যদু ধর্মান্তরিত হয়ে যদু বরবক শাহ্ নামে পরিচিত হয়েছেন। সুবুদ্ধি রায়ের সামান্য কর্মচারী থেকে বাংলা তখতে উঠে এসেছেন হোসেন শাহ্। গৌড় মালদহ থেকে সমগ্র বাংলাদেশের ওপর তাঁর শাসনব্যবস্থার ভিত্তি তখনও তিনি সুপ্রোথিত করে উঠতে পারেননি।
এই অস্থিতিশীল শাসনব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ত্রিবেণী, অগ্রদ্বীপ, ধার্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, আম্বুয়া, কুলিয়া, কালনা, বর্ধমানের বিত্তশালীরা ‘রাজা’ খেতাব নিয়ে ক্ষমতার দম্ভে উন্মাদপ্রায় হয়ে উঠেছেন।.
রাজা ক্ষেত্রপাল সর্বপ্রথম কোমরের তলোয়ারের ঝনাৎকারের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ পূর্বনির্ধারিত। স্বয়ংবরের মিথ্যা অভিনয়। কাঞ্চনপুর শঠ।’
তাঁর দেখাদেখি অন্য রাজারাও উঠে দাঁড়ালেন। শ্রীহট্টের যুবরাজ লাল চোখ করে বললেন, ‘রাজকন্যের পিরিতি যখন আগেই রসলোকে উত্তীর্ণ হয়েছে, আমাদের ডেকে পাঠানো কেন? রাজকার্য ফেলে, শতসহস্র মুদ্রা ব্যয় করে আমরা কি কোকিলের গান শুনতে এসেছি?’
কাঞ্চনপুররাজ প্রমাদ গণলেন। যদিও বা কাঞ্চনপুর বৈভবশালী রাজ্য, শক্তিমতী, তবুও এতজন ভূপতির রোষের সম্মুখীন হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি মধুর স্বরে বললেন, ‘রাজন্যবর্গ, আপনারা অতিথিশালায় কিছুকাল বিশ্রাম করুন। এ বিষয়ে গুরুতর আলোচনার জন্য আমি আজকের দিনটি সময় ভিক্ষা করি। আশা করি এ আবেদনে আপনারা অমত করবেন না।’
ক্ষেত্রপাল সরীসৃপের মতো শীতল অথচ বিষাক্ত চোখে কিছুক্ষণ রাজার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে শুধু আজকের দিন। মনে রাখবেন ক্ষেত্রপুর নির্বীর্য নয়।’
আগতপ্রায় সন্ধ্যার সূর্য ভাগীরথীর বুকে সিঁদুর গুলে দিচ্ছে। মধুমাসের কোকিল বৃক্ষশাখায় কুহুগান গেয়ে উঠছে থেকে থেকে। দক্ষিণ বাতায়ন দিয়ে আসা মৃদু হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে কৃষ্ণার অঞ্চলপ্রান্ত। ঘরে শুধুমাত্র তিনটি প্রাণী।
অনন্তরাজ অধীর হয়ে শ্বশুরমশায়কে বললেন, ‘আপনাকে আমি বারবার একই কথা বলছি মহারাজ। আমার কথামতো কাজ করুন। কোনও বিপদ হবে না।’
প্রবীণ রাজার কপালে চিন্তার বলিরেখা। ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘তা হয় না অনন্তরাজ। পরের ছেলেকে বিপদে ফেলে নরকে যাব যে। আর সঙ্গে মেয়েও যে রয়েছে আমার।
– আরে, সে তো আমারও বউ নাকি! এই মধুমাসে আর যাই হোক, আত্মহত্যা তো করব না নিশ্চিত। উঃ..!
কৃষ্ণার একটি বড়োসড়ো চিমটিতে অনন্তরাজ চুপ করে গেলেন।
মৃদু হেসে বৃদ্ধ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা নাহয় রাজা ব্যাটাচ্ছেলেদের বললাম, তুমি আমার মেয়ে নিয়ে পালিয়েছ। তারপর তুমি কী করবে শুনি?’
পরমানন্দে অনন্তরাজ নেচে উঠলেন। বললেন, ‘সে আপনি ভাববেন না। ভাগীরথীর উত্তর-পূর্ব বাঁকে আমার ‘দিগন্ত’ বাঁধা আছে। আপনি আমাকে দ্রুতগামী অশ্ব দিন শুধু। কোনোমতে নবদ্বীপে বান্ধবের কাছে গিয়ে পড়তে পারলে আমাকে শূলপাণি ছুঁতে পারবেন না।’
– কে বান্ধব তোমার? বঙ্গাধিপ? হা হা…
– মিতা আমার কাব্যঅমরার বাসব, ব্যাকরণবিশ্বের কার্তিকেয়। অমন মানুষ বিশ্বে না ছিল, না হবে। আমিই মাথামোটা। মিতার কথা অনুযায়ী যদি রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর দু-দণ্ড পরে দিতাম, খ্যাঁকশেয়ালের দল ফেউ ফেউ করে উঠতে পারত না।
কৃষ্ণা অবাক বললেন, ‘এ কথার অর্থ বুঝলাম না আর্যপুত্র!’
অনন্তরাজের চোখে দুষ্টু হাসি।
– মিতা সব বুঝিয়ে বলবেন। এখন চলো দেখি। এখন এই পোশাকটি পরো। নবদ্বীপ থেকে এনেছি।
কৃষ্ণা দেখলেন আপাদমস্তক ঢেকে যায় এমন একটি কালো পোশাক অনন্তরাজের হাতে। তিনি আঁতকে উঠলেন,
– এ যে যবন পোশাক! আমি পরব কেন?
– আরে দূর্, যবন? বিপদে যবন আপন। সব ঢেকে না গেলে সবাই চিনে ফেলবে যে।
‘দিগন্ত’ উজানে চলেছে। হাওয়াও অনুকূল নয়। গতি ধীর। শঙ্খচিলের দল ভাগীরথীর উপর চক্রাকারে উড়ছে শিকারের আশায়। প্রভাত সবিতা উদীয়মানা।
কক্ষের একটিতে অনন্তরাজ। অন্যটিতে কৃষ্ণা। প্রমোদকক্ষ থেকে মৃদু আলাপের শব্দ ভেসে আসছে।
পবন বহিল প্রিয়তমা সাজি,
সিন্দুরি দেহ নদীজল মোর,
প্রিয়তম মোর তীর দিয়া বাঁধো
নবনীতা প্রেমডোর…
পূর্ণ হৃদয়ে কৃষ্ণা কক্ষের বাতায়নপথে রূপসি ভাগীরথীর প্রবহমানতা দেখছেন। আনন্দঘন প্রভাত।
এমন সময় শুনলেন রক্ষীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। অনন্তরাজকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘প্রভু, পাঁচটি বিশাল জলপোত পিছু নিয়েছে।’
অনন্তরাজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, ভোরের আবছা আলোয় কৃষ্ণবর্ণ দৈত্যের মতো পাঁচটি জলযান দক্ষিণ দিগন্তে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন কৃষ্ণা। কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘সবাই বরুণের আবাহনী গাও। ঘটে আমপাতা আর বেল স্থাপন করো। প্রজাপতি খোদাই করা শঙ্খ বাজাও। মকরের মুখে দাও কেতকীগাছের কাঠ।’
হে জলদেবতা, এই নাও তোমার দূর্বা, এই নাও তোমার ফুল, এই নাও তোমার বস্ত্র, আর এই নাও তণ্ডুল। তোমার অভয়ে জল-কেউটিয়া শত ফণা তুলে নৃত্য করুক। জলকুমারী জলটুঙ্গিতে ঘুমোক আর জলকন্যা নৃত্য করুক। বায়ু হোক উত্তরমুখী, আকাশে ভাসুক জলধনু। শত্রুর গতিরোধ হোক।
অনন্তরাজ জানেন, তাঁর জলযানের মতো, শত্রুপক্ষের জলযানের গতিও ধীর। হাওয়া আর নদীস্রোত উভয়ই তাদের প্রতিকূল। কিন্তু নবদ্বীপ না পৌঁছোতে পারলে সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী। আর এ অসম সংগ্রামে পরাজয় নিশ্চিত। তাঁর জলযান বিলাসের উপযোগী। শত্রুপক্ষের পোতের সিংহ আর ঈগলচিহ্ন নির্দেশ করে সেগুলি যুদ্ধযান। সামনে ও পিছনে শীর্ণকায়। সামনের দিক ছুঁচোলো ও উত্থিত। তাই গতিবেগও বেশি।
তিনি দাঁড়িদের নির্দেশ দিলেন প্রাণপণে দাঁড় চালাতে। কুড়ি জোড়া হাতের শিরা উপশিরা ফুলে উঠল। নৌকার পাটাতন ভেসে গেল ঘামে।.
মধ্যাহ্নের আদিত্য অগ্নিবর্ষী। কালনার তটভূমি ধীরে ধীরে পার হয়ে যাচ্ছে দিগন্ত। দাঁড়িদের বিন্দুমাত্র বিরাম নেই। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী জলযানগুলির মধ্যে ক্ষেত্রপালের শঙ্খচিহ্নিত নিশান স্পষ্ট। ভীমাকৃতি কাঁঠাল আর পিয়াল কাঠে তৈরি জলযান। দু-কূলে প্রায় আশি গজ জল ভাঙতে ভাঙতে সে এগিয়ে আসছে।
অনন্তরাজ কথকঠাকুরের মুখে শুনেছেন, শঙ্খচূড় দৈত্য পুরাকালে দেবতাদের পরাজিত করে বেদ হরণ করে লুকিয়েছিল সমুদ্রগর্ভে। মীনরূপী বিষ্ণু তাঁকে হত্যা করে বেদ উদ্ধার করেন। শঙ্খচূড়ের নামে সকল জলজন্তু বিপদ দূরে থাকে। শঙ্খচূড়ের হাড় থেকেই শঙ্খের সৃষ্টি। শঙ্খধ্বনি একাধারে মঙ্গলধ্বনি ও রণবাদ্য। সেই শঙ্খচিহ্ন ক্ষেত্রপালের নিশানে।
অনন্তরাজের মনে বিষাদের ঘনঘটা। এই গতিতে চলতে থাকলে পঞ্চম প্রহরের আগেই ‘দিগন্ত’-র নাগাল পেয়ে যাবেন ক্ষেত্রপাল। দাঁতে দাঁত চেপে অসম যুদ্ধের জন্য তৈরি হলেন তিনি। পঞ্চাশ সৈন্যকে অস্ত্রসমাহারে প্রস্তুত থাকতে বললেন। মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাদের সামনে ব্যক্ত করলেন না।
পরাজয় নিশ্চিত। কৃষ্ণাকেও হারাবেন। যদি না…!
.
পঞ্চম প্রহরের কিছু আগে প্রধান মাঝি দারুক চিৎকার করে উঠল, ‘সামনে থেকে অনেকগুলো নৌকা আসছে!’
উত্তরের দিকে চাইলেন কৃষ্ণা। অনন্তরাজ। সকল সৈন্যদল।
বিশালাকৃতি জলযানগুলি রাক্ষসের মতো স্রোতের অনুকূলে ভেসে আসছে। কম্পমান রৌদ্রে দেখা যাচ্ছে সারি সারি কালো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা সৈন্যদল। কমপক্ষে কুড়িটি জলযান। পতাকায় আঁকা অর্ধচন্দ্র আর তারকাচিহ্ন।
কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে, অনন্তরাজ দু-হাত তুলে নাচতে লাগলেন। কৃষ্ণা ভাবলেন, বিপদের মুখে পড়ে অনন্তরাজের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘উভয় সংকটের মধ্যে পড়ে তোমার কি মাথাটাই গেছে? দেখছ না, এখন উত্তরেও রণতরী?’
অনন্তরাজ স্থান কাল ভুলে কৃষ্ণাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। পরম আহ্লাদে বললেন, ‘কে শত্রু? কোথায় শত্রু? উত্তরের ওই নৌবহর চাঁদ মামার। আমার বান্ধব পাঠিয়েছেন বউ, আমার প্রাণপ্রিয় মিতা। জয় মা শচী… জয় মোচার ঘণ্ট।’
কে চাঁদ কাজি? কে বান্ধব? কৃষ্ণা জানলেন না। জানলেন না নবদ্বীপের আসন্ন প্রদোষে ভাগীরথীর তীরে তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।
দক্ষিণের জলযানগুলির গতি ধীরে ধীরে মন্দীভূত হয়ে আসছে। সমুদ্রনগরের পূর্বদিকের বাঁকে তারা সম্পূর্ণ থেমে গেল।
“করিনু পিপ্পলীখণ্ড কফ নিবারিতে
উলটিয়া আরও কফ বাড়িল দেহেতে”
অনন্তরাজ বললেন, ‘ও কী কথা বান্ধব? কফ হলে বৈদ্যরাজের কাছে যাও।’
দীর্ঘদেহী দিব্যপুরুষ হা হা করে হেসে উঠলেন, ‘সত্যি তোমায় বলিহারি যাই বান্ধব! সাধু সেজে যে ব্যাসকূট কুমারীকে শিখিয়ে দিলে, তার উত্তর নিজেই লাফ দিয়ে উঠে সর্বপ্রথম দিয়ে দিলে? এইজন্যই বলেছিলুম, মস্তক বস্তুটি কি মিতানির বাকির খাতায় বাঁধা রেখেছ? হা হা…’
অনন্তরাজ বুঝলেন। লজ্জাবনত হলেন।
কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘বান্ধব, কী দেব তোমায়? স্বয়ং সালতানত তোমার গুণমুগ্ধ। আম্বুয়া মুলুকের কাজি স্বয়ং তোমার সহায়। ক্ষুদ্র আমি নরপতি তোমায় কী দেব?’.
ভাগীরথীর জলে তখন প্রাগৈতিহাসিক নক্ষত্রপুঞ্জ দুইটি ধারার মিলনস্থলে প্রতিফলিত হচ্ছে। পরপার অন্ধকার। মসিলিপ্ত। নবদ্বীপের পোড়ামা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে মিশে যাচ্ছে জাহান্নগরের বিষহরিপীঠের মঙ্গলশঙ্খধ্বনি।
ধীর মধুর স্বরে বিশ্বম্ভর বললেন, ‘এ দিন স্থায়ী নয় বান্ধব। সম্মুখে মহাসংগ্রাম। রুকনুদ্দিন বরবক শাহ্ আবিসিনিয়া থেকে যে হাবসি দাস নামক বিষবৃক্ষগুলি স্থাপন করেছেন, তাতে অবিলম্বে বিষফল পেকে উঠবে। গৌড়ের শাহি মঞ্জিলকেও হয়তো তারা রেয়াত করবে না। লড়াইয়ে নামতে হবে। শ্রীবাস অঙ্গন থেকে সেই বিপ্লবের শুভারম্ভ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। পাশে থেকো বান্ধব।’
অনন্তরাজ বিহ্বল হলেন। তারপরই চপল কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার মিতানির সঙ্গে আজ প্রথম নিভৃত আলাপ। তারে কী বলব? কী অলংকার তাকে দেব?’
সম্মিলিত জ্যোতিঃপুঞ্জরাশি থেকে উদ্বেলিত হাসি ঝরে পড়ল। মধুক্ষরা কণ্ঠে দিব্যপুরুষ বললেন, ‘নীলপদ্ম দিও মন্দবুদ্ধি। নারী অলংকার চায় স্বামীর কাছে, আর প্রিয়তমের কাছে চায় ফুল। তাঁকে ফুল দিয়ে বোলো,.
কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা। সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী স্বসিতায়তলোচনা।
শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিতমূর্ধজা। তাম্রতুঙ্গনখী সুভ্রূশ্চারুপীনপয়োধরা।।
মানুষং বিগ্রহং কৃত্বা সাক্ষাদমরবর্ণিনী। নীলোৎপলসমগন্ধ যস্যাঃ ক্রোশাৎ প্রবায়তি।
যা বিভর্তি পরং রূপং যস্যা নাস্ত্যুপমা ভুবি। দেবদানবযক্ষাণামীপ্সিতাং দেবরূপিণীম।।
(বেদব্যাসকৃত মূল মহাভারতে দ্রৌপদীর বর্ণনা, দ্রৌপদীরও অপর নাম কৃষ্ণা।)