ক্রান্তি উপক্রম
পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম লগ্ন। বৈদেশিক বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্তের ফলে তখন গঙ্গাতীরে জনবসতি ঘন হয়ে উঠেছে। মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তনের বেশ কিছু আগে থেকে ধর্মচিন্তায় গঙ্গার মাহাত্ম্য জাঁকিয়ে বসেছে। পাল-সেন রাজাদের সময়কাল থেকেই গঙ্গা ও তার বিভিন্ন শাখা ও উপনদী দেশের শাসনকার্য আর বাণিজ্যের ব্যাপারে রাজপথে পরিণত হয়েছে।
ভাগীরথী তীরের বাণিজ্যকেন্দ্র (সপ্তগ্রাম) এবং শাসনকেন্দ্র (আম্বুয়া), দুই-ই নবদ্বীপের খুব কাছে অবস্থিত ছিল। অনতিদূরে ‘ধাঁইগ্রাম’ (ধার্যগ্রামে) ছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের উপরাজধানী। ‘উপকারিকা’ নামে পরিচিত সেই উপরাজধানীকে বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত কাছারিবাড়ি বলা হত।
লক্ষ্মণ সেন বিদ্বৎপ্রিয় শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনকালে এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গঙ্গাতীরে শাস্ত্রজ্ঞ এবং ব্রাহ্মণের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে পঞ্চদশ শতকের একদম প্রথমদিকে ত্রিপুরা-সিলেট অঞ্চলে আরাকানি অভিযানের ফলে শিষ্ট ও নম্র ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্যাদি শিক্ষিত সম্প্রদায় বেশি করে গঙ্গাতীরে চলে আসতে থাকেন। এই কারণে পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে নবদ্বীপ অঞ্চল, অর্থাৎ কুলিয়া-কালনা-নবদ্বীপ-শান্তিপুর বিদ্বজ্জনাকীর্ণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ হয়েছিল।
কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা সদাপরিবর্তনশীল। কখনও শান্তির রাজহংসপক্ষের মতো সে পেলব, স্থিরমতি এবং শ্বেতশুভ্র। আবার কখনও বায়সপালকের মতো কৃষ্ণবর্ণ, বৈশাখী মেঘের মতো অশান্ত, অনিশ্চিত।
.
গৌড় থেকে শ্রীহট্ট বেশি দূরবর্তী নয়। শাহি দরবারের মাৎস্যন্যায়ী প্রভাব খুব শীঘ্রই পাহাড়ে বাধা পেয়ে উপজাতি অধ্যুষিত পর্বতশিলায় বাধা পেয়ে শ্রীহট্টের শান্ত সমাহিত সৌন্দর্যকে মলিন করে তুলেছিল। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের পুনর্বাসিত শান্তিপ্রিয় শাস্ত্রব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ এবং সেন রাজবংশের পাদোপজীবী পূর্বোল্লিখিত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং কর্ণাট থেকে আগত বৈদ্যসম্প্রদায় অনতিবিলম্বে ধর্মাচরণ এবং শাস্ত্র আলোচনায় বাধাপ্রাপ্ত হতে লাগলেন।
মিনহাজ-উদ্-দিন সিরাজ তখন দিল্লির সুলতান পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেছেন তবাকত-ই-নাসিরি নামক কেতাব। তাতে প্রচারিত হচ্ছে ইখতিয়ার-উদ-দিন মহম্মদ বিন্ বখতিয়ার খলজির আঠারোজন অশ্বারোহী দ্বারা নদিয়া জয়ের কাহিনি। ইসলামের অর্ধচন্দ্র আঁকা পতাকা এই অঞ্চলে প্রোথিত হয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক এবং অভিন্ন ঈশ্বরের বাণী প্রচার করছিল এবং পূর্ণ উদ্যমে দমন করার চেষ্টা করছিল পৌত্তলিকতার। কিন্তু গৌড়ের গৌরবই ছিল নাব্য অঞ্চল থেকে প্রধান। অনিবার্যভাবে এবং কিঞ্চিৎ সৌভাগ্যক্রমে ইসলামি ধারালো তলোয়ার পুণ্ড্র ও বরেন্দ্রভূমির দিকে আলোর সন্ধানে পতঙ্গের মতো উড়ে যায়। সে কারণেই সমস্ত বরেন্দ্রভূমি এবং রাঢ়ভুক্তি থেকে বুদ্ধিব্যবসায়ীগণ নবদ্বীপ ও শান্তিপুরকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
শকাব্দ ১৪০৭। খ্রিস্টীয় ১৪৮৬ অব্দ। জালাল-উদ্-দিন ফতে শাহ্ গৌড়ের তখতে আসীন হয়েছেন ১৪০২ শকাব্দে।
শনিবার। তেইশে ফাল্গুন। শ্রীমায়াপুরের পূর্বপ্রান্তে আমবাগানের মাথায় সূর্য উঠছে। হিমালয় থেকে আসা বাতাস শীতের শেষে ঘরে ফেরার তোড়জোড় করছে। মন্দার গাছে নতুন ফুলপাতা। নিবিড় পাতার ঘরে অদৃশ্য কোকিলের মধুর গান ঋতুরাজের বন্দনা গাইছে। জলঙ্গীর তীর বরাবর যবগাছের খেত। সদ্য আগত দখিনা বাতাসে তারা দুলে উঠছে মৃদু মৃদু।
.
শ্রীহট্ট থেকে আসা এক ব্রাহ্মণ পরিবার। কর্তা জগন্নাথ মিশ্র, পুরন্দর এবং তাঁর পত্নী শচী দেবী। জগন্নাথ বৈদিক শ্রেণির ব্রাহ্মণ। জয়ানন্দ বিরচিত চৈতন্যমঙ্গলের মতে শ্রীহট্টের মধ্যে জয়পুর গ্রামে জগন্নাথের পিতৃগৃহ এবং শ্বশুরালয় ছিল। দৈববিপাক এবং রাষ্ট্রবিপ্লব (রাজা কপিলেন্দ্রের সময়) দুই মিলে শ্রীহট্ট উচ্ছন্ন গেলে শচী দেবীর বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী সপরিবার-পরিজনে নবদ্বীপ চলে আসেন।
প্রসঙ্গান্তরে জয়ানন্দ লিখেছিলেন,— “চৈতন্য গোসাঞির পূর্বপুরুষ আছিলা যাজপুরে/শ্রীহট্টদেশেরে পলাঞা গেল রাজা ভ্রমরের ডরে।”
নীলাম্বর চক্রবর্তীর এতদাঞ্চলে প্রভাব ছিল। নবদ্বীপের কাজী (স্থানীয় মুসলমান শাসক) তাঁকে আত্মীয় পরিজনের মতো মান্য করত। নীলাম্বর ভালো জ্যোতিষী ছিলেন।
***
উক্ত দিনটিতে ফিরে আসি।
চক্রবর্তী গিন্নি অলিন্দ থেকে দেখলেন, ঈশান দ্রুত পদক্ষেপে চক্রবর্তীদের বাড়ির দিকে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণীর মনে আসন্নপ্রসবা মেয়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটি ভেসে উঠল।
তেরো মাস হতে চলল!
দশম গর্ভের সন্তান প্রসবে এত দেরি? ঈশান বারদরজা পার হয়ে এসে ডাকল, দিদিমা।
বর্ষীয়সী গৃহিণী কলেবরে বিশাল। তাও যথাসম্ভব দ্রুত নেমে এলেন অলিন্দ থেকে। ঈশান এগিয়ে এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। আবার ডাকল, দিদিমা।
গৃহিণী এবার অধৈর্য হয়ে উঠলেন।
– দিদিমা দিদিমা বাদ দে বাপু, কী হয়েছে তাই বল।
ঈশান কিছু ইতস্তত করল। আমতা আমতা করে বলল,
– আজ্ঞে মা-ঠারেন… ইয়ে… তাই বাবাঠাকুর তোমারে যেতে বলে দিল।
– ও মা কী হবে গো, চক্রবর্তী গিন্নি ভয়ে কেঁদে ফেললেন, ও গো শুনছ, বলে চতুষ্পাঠীর দিকে অগ্রসর হলেন।
.
ঈশান তাঁকে অনুসরণ করল। এই বাড়ির সবাই তার পরিচিত।
গিন্নি, চতুষ্পাঠীর দরজায় এসে ডাকলেন,
– ওগো শুনছ, ঈশান এসেছে।
চক্রবর্তী একটি পূর্বকৃত খসড়া দেখে ভূর্জপত্রে কারও জন্মলগ্নিকা পত্রিকা তৈরি করছিলেন। তিনি মুখ না তুলেই লিখলেন—
“পূর্ণেন্দু রাহুনা গ্রস্তে সন্ধ্যায়াং সিংহলগ্নকে।
নক্ষত্রে পূর্বফাল্গুন্যাং রাশৌ চ পশুরাজকে।।”
গৃহিণী আবার বললেন, ঈশান এসেছে।
নীলাম্বর মুখ তুলে বললেন, আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি গতকালই চাঁদকে পালকি পাঠাতে বলেছি। দিবারাত্রির সন্ধিক্ষণ ছাড়া, বুঝলে গিন্নি, সে পশুরাজ ভূমিষ্ঠ হবে না। তোমার নাতি লগনচাঁদা ছেলে, সিংহরাশি সিংহলগ্ন…
.
চক্রবর্তীর কথায় ছেদ পড়ল উচ্চৈঃস্বর ‘হু হুম্ না, হু হুম্ না’ শব্দে। চারজন পালকিবাহক এবং সঙ্গে দুজন অশ্বারোহী পাইক এসে একটি পত্রসহ অভিবাদন করে পাশে দাঁড়াল। সঙ্গে একটি পেটিকা।
চক্রবর্তী দেখলেন পত্রের মুখটি লাক্ষারস দিয়ে বন্ধ করা। উপরে ‘রাজপণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত নীলাম্বর চক্রবর্তী কাব্যব্যাকরণ ন্যায়পঞ্চানন সামুদ্রিকরত্ন পাক জনাবেষু’ পাঠ লেখা। পত্রটি খুলে তিনি দেখলেন, চাঁদ লিখছেন—
.
“পাক জনাবেষু চাচাসাহেব,
আপনার হুকুম অনুসারে তাঞ্জাম সহ দুইজন ঘোড়সওয়ার পাইক আপনার খেদমতে পাঠাইলাম। শচী আপনার বেটি। সেই কারণে সে আমার বহিন লাগিতেছে। চাচিসাহেবার হাতে পেটিকাটি দিবেন। ইহাতে গণেশের নামাঙ্কিত পঞ্চাশটি আশরফি আছে। শচীর খালাস হওয়া মাত্র কাজি মামুর এই সামান্য উপহারটুকু নবজাতককে দিবেন।
আমার সালাম জানিবেন।
ইতি,
চাঁদ কাজি।”
.
বলা বাহুল্য চাঁদ নবদ্বীপের শাসক। চক্রবর্তীর গ্রামবাসী। সর্বশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিতাগ্রণ্য চক্রবর্তী মহাশয়কে চাঁদ অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। ছোটোবেলায় কিছুদিন তিনি সুহৃদ চক্রবর্তীর কাছে আরবি ও ফারসি শিখেছিলেন। চক্রবর্তী মশাইকে তিনি ‘চাচাসাহেব’ নামে সম্বোধন করতেন।
পাইকদের দেখে গৃহিণী ঘরের দরজার আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। চক্রবর্তী বাহকগণকে বললেন,
– কই ও, পালকি আঙিনায় লাগাও।
ঈশানকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কি রে, কেমন আছে শচী?
ঈশান আবার আগের মতোই প্রণাম করে বলল,
– রাত থেকে আজ্ঞে কষ্ট পাচ্ছেন। বাবাঠাকুর বললে, এমন কষ্ট নাকি তিনি আগে কখনও পায়নি। তা আমি আচার্যি মাসি, গুপ্ত মাসিকে খপর দিয়ে তবে এখানে আসছি।
– চন্দ্রশেখরকে খবর পাঠাসনি?
– আজ্ঞে তাঁরা তো কাল থেকে সেখানেই।
আশ্চর্য চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন,
– আজ্ঞে, তাঁরা আগমেশ্বরী পাড়ায় পূজা দিতে গেছিলেন।
ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করে তারপর বলল,
– আমি দাদাঠাকুরকে নিয়ে টোল থেকে আসছি। আমি দেখতে পাইনি। দাঠাকুর মাসিমাকে দেখেই আঁচল ধরে টানতে টানতে সোজা বাড়ি। আমি শেষে ছিনাথপুর থেকে মাছ—, জানেন দাদামশায়, দু-সেরি রুই বলে কিনা এক পাই— তা আমিও..
.
‘তুই থাম’— চক্রবর্তী বাধা দিলেন। ‘বাচাল কোথাকার। আমি জিজ্ঞাসা করছি মেয়েদের মধ্যে আর কে কে আছেন?’
– কেন গুপ্তমাসি তো সেই ভোর রাত থেকেই আছেন। তেনারা এসে পড়লেন বলে। আর জানেন দাদামশায়, বললে পেত্যয় যাবেন না, কোথা থেকে খপর পেয়ে অদৈত্য ঠাকুর—
– বোকা কোথাকার। চক্রবর্তী হাসলেন।
সস্নেহে বললেন, ‘অদৈত্য নয়, অদ্বৈত। কী করেছে অদ্বৈত?’
– তিনি একবার নিমতলায় যাচ্ছেন, একবার ছনছাতলায়। কেবলই পাক মারছে আর মাঝে মাঝে হাঁক মারছে, ‘হরিবোল হরিবোল’। আমি তেনাকে বললাম— ঠাকুরমশায়—
– থাক, হয়েছে।
চক্রবর্তী ঈশানের উৎসাহ দমন করলেন, “তোকে আর সাতকাণ্ড রামায়ণ গাইতে হবে না। এখন চারটি খেয়ে দিদিমার পালকির সঙ্গে যাবি।”
নিরুৎসাহিত হয়ে ঈশান অন্দরে চলে গেল। চক্রবর্তী নিজে তাঁর পুথিপত্রে মনোনিবেশ করলেন।
.
“সুললিতগমনা চমকিতচপলা নিশীথীনিনিশাকর কর
অমানিশাগতয় জাগরিতকপোত নবউদভাসদিবাকর”
খাগের কলমে ভূর্জপত্রে বড়ো বড়ো করে লিখলেন চক্রবর্তী। তাঁর মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। এই যে রাত্রির প্রহর আর দিন শুরুর প্রহরের সন্ধিক্ষণ, তার মধ্যে কি পরম কাঙ্ক্ষিত কিছুর সন্ধান করছেন জ্যোতিষার্ণব নীলাম্বর চক্রবর্তী?
.
সেনবংশের শেষ হয় তুর্কদের হাতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তথা বল্লাল সেনীয় গোঁড়া কুলীন প্রথার চাপে বৌদ্ধধর্মের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ শ্রমণেরা ভ্রষ্ট, দেহবাদী, তান্ত্রিক ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়েন।
এর সমস্ত দায়ভার অবশ্য সেনবংশের ওপর বর্তায় না। সুপ্ত বীজপত্র যেমন নবীন সূর্যালোক ও পারিপার্শ্বিক বাতাসের সংস্পর্শে অর্ধজাগরূক হয়, তেমনই তার বাকি অর্ধের প্রাণশক্তি আসে সুপ্রাচীনা পৃথিবীর গভীরের সঞ্চিত জলরাশি থেকে।
বৌদ্ধধর্মের দেহবাদিতার বীজ তাদের প্রাচীনকালেই প্রোথিত।
হিন্দু তারা দেবীই বৌদ্ধবিশ্বাসের উগ্রতারা বা একজটা দেবী। বৌদ্ধ ‘সাধনমালায়’ পাওয়া যায় পর্ণ (পাতা) পরিহিতা পর্ণশবরী দেবীকে। ‘বাসবদত্তা’-র বেতালা দেবী আর বৌদ্ধ তন্ত্রের বজ্রবেতালী দেবীকে এক এবং অভিন্ন মনে হয়।
তার অর্থ কি তবে বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রে প্রাপ্ত সে দেবীগণ বৌদ্ধ দেবী? বৌদ্ধ তন্ত্রগুলোকে বৌদ্ধ বলার যুক্তিযুক্ততাই বা কী? দুই ভিন্ন ধর্মের সাধনার মিল বা গুহ্য যোগবিধির মিল দেখে এবং প্রচলিত হিন্দু তন্ত্রগুলি থেকে নতুন আবিষ্কৃত বৌদ্ধ তন্ত্রগুলির রচনাকাল প্রাচীনতর মনে করে বৌদ্ধ তন্ত্র থেকেই হিন্দুতন্ত্র গড়ে উঠেছে, এমন মত পোষণ করেন।
কিন্তু মূলে বৌদ্ধ বা হিন্দু বলে কোনও পৃথক তন্ত্রের অস্তিত্বই নেই। শুধুমাত্র সাধনার ক্ষেত্রে বিবিধ মন্ত্রপ্রয়োগের সঙ্গে যে ধ্যান পরিকল্পনা দেখা যায় তার সঙ্গে পরোক্ষভাবে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের ধ্যানধারণার কিছু কিছু যোগ লক্ষ করা যায়।
বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রসার মহাচিনে প্রচুর ঘটেছিল। অর্থাৎ বিহার-বঙ্গ-আসামের কিছু অঞ্চল এবং নেপাল-তিব্বত-ভুটান প্রভৃতি অঞ্চলে প্রসিদ্ধা কিছু দেবী বৌদ্ধ তন্ত্রে স্থান পেয়েছেন।
.
পর্ণশবরী দেবী এবং ষটচক্রের অধিষ্ঠাত্রী ডাকিনী, হাকিনী, লাকিনী, রাকিণী, শাকিনী দেবীগণের সকলে না হলেও অধিকাংশই মহাচিনাঞ্চল গৃহীতা বলে মনে হয়।
প্রাচীন বৈষ্ণব ও শৈব শাস্ত্রে যে শক্তিতত্ত্ব দেখতে পাওয়া যায়, তাতে প্রপঞ্চাত্মক যে বহিঃদৃষ্টি, তা পরমেশ্বরের স্বরূপের সঙ্গে অভিন্না সমবায়িনী শক্তি হতে হয় না; সৃষ্টি হয় বিক্ষেপ শক্তি বা পরিগ্রহ শক্তি থেকে।
এইখানেই এই তত্ত্বটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে রূপান্তর গ্রহণ করেছে অন্য রূপে।
আদিবুদ্ধ এবং আদিদেবী সৃষ্টির কারণ নন, সৃষ্টি হয় সশক্তিক ধ্যানীবুদ্ধ বা পঞ্চতথাগত থেকে। আদিবুদ্ধের সিসৃক্ষাত্মক পাঁচ প্রকারের ধ্যান আছে। তার প্রত্যেকটি ধ্যান থেকে প্রসৃত হন এক-একজন ধ্যানীবুদ্ধ। তাঁরা হলেন বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি এবং অক্ষোভ্য। এই পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধই হলেন যথাক্রমে রূপ-বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার-বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের দেবতা, এবং সৃষ্টি এই পঞ্চস্কন্ধাত্মক। এই পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের পঞ্চশক্তি হলেন যথাক্রমে তারা বা বজ্রধাত্বীশ্বরী, মামকী, পাণ্ডরা, আর্যতারা এবং লোচনা। সশক্তিক পঞ্চতথাগত মানবদেহের মাথা, মুখ, হৃদয়, নাভি ও পাদদেশ এই পঞ্চস্থানে অধিষ্ঠান লাভ করেন।
.
বৌদ্ধ তন্ত্রে আদিবুদ্ধকে অনুসরণ করে সর্বেশ্বরী মহাদেবী আদিদেবীকে পাওয়া যায়। অবশ্য একটু অন্যভাবেও পাওয়া যায়।
বৌদ্ধতন্ত্র মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই একটি বিশেষ পরিণতি। হীনযানীরা যেখানে পথের উপরেও স্থান দিয়েছেন শূন্যকে, মহাযানীরা সেখানে পথকেই ইষ্ট করে আনলেন বিশ্বমুক্তির প্রশ্ন তথা উপায়। সুতরাং মুক্তিদাত্রী শূন্যতার সঙ্গে তাঁরা যোগ করলেন কুশলকর্মের প্রেরণাদায়ক মহাকরুণা। শূন্যতা হল নেতিবাচক প্রজ্ঞা এবং করুণা হল ইতিবাচক উপায়, অর্থাৎ কুশল-কর্মপ্রেরণা। তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ এই প্রজ্ঞা-করুণার মিলনে বোধিচিত্তের সংজ্ঞা নির্ণয় করলেন,
‘শূন্যতা-করুণাভিন্নং বোধিচিত্তং তদুচ্যতে”
অর্থাৎ, শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতাই হল বোধিচিত্ত।
ক্রমে তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ ধর্মমত ও সাধনার ক্ষেত্রে এই বোধিচিত্ত এবং শূন্যতা-করুণা বহুদূর টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। বোধিচিত্ততত্ত্বই হল তন্ত্রের যুগল বা ‘যামল’ তত্ত্ব; মূল সামরস্য, প্রধান ‘মিথুনতত্ত্ব’।
“শূন্যতা প্রজ্ঞারূপিণী ভগবতী-উপায় নিখিল ক্রিয়াত্মক ভগবান্।”
অর্থাৎ, এই ভগবান্-ভগবতী সামঞ্জস্য রূপ মিথুনতত্ত্বই হল অদ্বয় বোধিচিত্ত তত্ত্ব।
তন্ত্রসাধনায় এই ভগবান্-ভগবতী পূর্বালোচিত আদিবুদ্ধ ও আদিদেবীর সঙ্গে মিশে গেলেন।
ফলে বৌদ্ধতন্ত্রেও এক সর্বেশ্বর ভগবান্ এবং এক সর্বেশ্বরী ভগবতীর কথা দেখা যায়। এই সর্বেশ্বর দেবতা সাধারণত শ্রীহেবজ্র, শ্রীহেরুক, শ্রীবজ্রধর, শ্রীবজ্রেশ্বর, শ্রীবজ্রসত্ত্ব, মহাসত্ত্ব, শ্রীমন্ মহাসুখ, শ্রীচণ্ডরোষণ প্রভৃতি রূপে দেখা দিয়েছেন। সর্বেশ্বরী দেবী তাঁরই সঙ্গে দেখা গেছেন তাঁরই অঙ্কবিহারিণীরূপে অথবা মিথুনাবস্থায়। তিনি কোথাও বজ্রধাত্রীশ্বরী, বজ্রবারাহী, কোথাও ভগবতীপ্রজ্ঞা বা প্রজ্ঞাপারমিতা বা দেবী নৈরাত্ম।
বৌদ্ধতন্ত্রগুলিতে এবার যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য, সেটি হল হিন্দুতন্ত্রের মতোই পরম-সামরস্য-জনিত কৈবল্যানন্দ লাভের জন্য নরনারীর মিলিত সাধনা। সাধিকাকে এক্ষেত্রে সাধকের মতোই শক্তিস্বরূপা হতে হবে। স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সাধনাই হল প্রচলিত ভৈরব-ভৈরবী সাধনার গূঢ়ার্থ।
চর্যাপদের মধ্যে এমন এক দেবীর উল্লেখ নানাভাবে পাওয়া যায়। কোথাও তিনি দেবী, কোথাও আবার ডোম্বী, চণ্ডালী, মাতঙ্গী, শবরী। বজ্রধরস্বরূপ সাধকের সঙ্গে তাঁর নাচগানের কথাও দেখা যায়,
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী |
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।” (১৭ সংখ্যক পদ) |
কোথাও আবার জাঁকজমকের সঙ্গে ডোম্বীকে বিবাহ করতে যাওয়ার এবং দিন-রাত্রি তাঁর সঙ্গে সুরতক্রীড়ার দৃশ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়,
“ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম |
জউতুকে কিঅ আণূতু ধাম।। |
অহণিসি সুরঅ পসঙ্গে যাঅ |
জোইণিজালে রএণি পোহাঅ।। |
ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো |
খণহ ণ ছাড়অ সহজ উন্মত্তো।।” (৪৯ সংখ্যক পদ) |
কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সর্বনিম্নচক্র বা পদ্মমূলাধারে সর্পাকারে কুণ্ডলিত হয়ে নিদ্রিতা। এই সুপ্তা শক্তিকে সাধিকার মাধ্যমে জাগরূক করে তার মাধ্যমে দেবীর শক্তিকে জাগিয়ে তোলাই সাধকের সাধনা। এই শক্তির অধ্যাত্ম রসের গভীরে প্রবেশ না করেই সহজে দেখা যায়, যোগতন্ত্রাদিতে এই শক্তির উত্থান ও গতি একটি বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো। এই প্রবাহের প্রতিক্ষণে সাধকের দিব্যানন্দের অনুভূতি।
অর্থাৎ, পঞ্চদশ শতকের শেষ লগ্নে এই কুলকুণ্ডলিনীর নিম্নতম ও স্থূলতম চক্রজাত শক্তির অভ্যুত্থানের সঙ্গে যে আনন্দানুভূতির জন্ম, মস্তকস্থিত উষ্ণীষকমলে পৌঁছেই তৎকালীন বৌদ্ধ-হিন্দু তান্ত্রিকগণের পরম কাম্য মহাসুখ।
***
নীলাম্বর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন।
রাজ্যভ্রষ্ট শাক্য রাজকুমারের নির্লিপ্ত নিষ্কাম মুখখানি মানসপটে ভেসে উঠল।
সমগ্র নবদ্বীপ রাত্রিজাগরণের কালিমা নিয়ে এখনও অর্ধসুপ্ত। শুঁড়িখানা থেকে শোনা গেছে জড়ানো গলায় চটুল গান,
“জোইণি তঁই বিণু খণহিঁ ণ জীঁবমি। |
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।।” |
যোগিনী, তোমাকে বিনা ক্ষণমাত্র বাঁচব না, তোমার মুখচুম্বন করে কমলরস পান করব।
কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে উত্তর এসেছে,
– শুঁড়ির মুখে যোগবাক্য! দূর হ..
.
– কামচন্ডালী, ছিনাল মাগি… তোর এত সাহস..!
নীলাম্বর চক্রবর্তী একমনে পাঠ অধ্যয়নে নিমগ্ন ছিলেন। পুস্তক পুথি যত্নসহকারে গুছিয়ে রেখে মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন, এমন সময়… একটি বছর আঠারোর বিবাহিতা মেয়ে, ‘আমাকে বাঁচান’ বলে তাঁর পায়ের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
কপালে সিঁদুরের বড়ো টিপ। সিঁথিসংলগ্ন চুল এবং গালে সিঁদুরে মাখামাখি। সারা দেহ থেকে শৌণ্ডিকালয়ের গন্ধ ভেসে আসছে। নাকে কাপড় দিলেন চক্রবর্তী। তিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একদল মাতাল তাঁর উঠোন আর রাস্তার সংযোগস্থলে ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
কারণ সামনেই অশ্বারোহী পাইক তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
দ্রুত পদক্ষেপে চক্রবর্তী বাইরে এলেন। দলপতির কাঁধে লুটিয়ে পড়া লম্বা লম্বা চুল টেনে ধরে, পঞ্চান্ন বছরের দুর্বল হাত দিয়ে পায়ের খড়ম খুলে পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললেন, পাষণ্ড!
মাতাল বৃদ্ধের দুঃসাহসে অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল,
– শ্লা… আমার গায়ে হাত! যোগী সিদ্ধেশ্বরের গায়ে হাত! জানো শ্লা…!
ততক্ষণে অশ্বারোহীদের একজন এগিয়ে এসেছে। শঙ্কর মাছের লেজ দিয়ে তৈরি চাবুক ‘ছপাৎ ‘করে পড়ল মাতালের পিঠে। জল থেকে তোলা বানমাছের মতো কিলবিল করে উঠে উন্মত্ত ব্যক্তি বলল, “জনাব, আমি যোগী সিদ্ধাই… ওই মাগি আমার যোগসঙ্গিনী। আজই সাধিকার নিম্নচক্র জাগানোর কথা… এর মধ্যে ও মাগি সাধনা বন্ধ করে পালিয়ে এসেছে… ওই তো… ওই তো… ওর স্বামীও আছে সঙ্গে… অ্যাই হারামজাদা যুগির ব্যাটা, বল না!”
ততক্ষণে আর-একটা আঘাত নেমে এসেছে যোগীপুরুষের পিঠে। সে আর দাঁড়াল না। চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল ভাগীরথীর উদ্দেশে। অশ্রাব্য খেউড় বেরিয়ে আসতে লাগল মুখের থুতু আর গেঁজলার সঙ্গে— ‘শালা জাতখেয়োর বাচ্চা চক্কোত্তি… তোর টিকিতে যদি শুয়োরের চর্বি বাঁধতে না পারি, আমিও সিদ্ধাই নই।’
অশ্বারোহীদ্বয় ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের তাড়া করে গেল। পানোন্মত্ত দস্যুর দল ভাগীরথীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করল।
চক্রবর্তী ফিরে এসে দেখলেন মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে। ঈশানের সঙ্গে গিন্নিকে পালকি করে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মেয়েটির স্বামীকে কান ধরে অন্ধকারের ভিতর থেকে টেনে নিয়ে এলেন,
– নিজের বউকে বাঁচাতে পারো না? ঘোমটা দিয়ে ঘরে বসে থাকো। এর নাম সাধনা? এই তবে ঈশ্বরভজনা? ছিঃ! কেঁচো কোথাকার।
চক্রবর্তী ভাবছিলেন, এ কী অরাজকতা! শকাব্দ ১৪০৭ এখন। জালাল-উদ্-দিন ফতেহ্ শাহ্ পাঁচ বছর আগে গৌড়ের সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর পিতামহ রুকন্-উদ্-দিন বরবক শাহ্ আবিসিনিয়া থেকে হাবসি দাস নামে যে বিষবৃক্ষগুলো এনে গৌড়ের মাটিতে রোপণ করেছিলেন, তারা এখন এই দেশের সরস মাটিতে আমূল প্রোথিত হয়ে পাতা শাখা মেলে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। গৌড়ের শাহি মঞ্জিলকেও তারা রেয়াত করে না। ইলিয়াস শাহি বংশের তরুণ নবাব তাঁর বিনিদ্র রাত্রিযাপনের ক্লান্তিজনিত অলীক তন্দ্রামিশ্রিত স্বপ্নে রক্তপিপাসু খঞ্জরের খোয়াবে চমকে চমকে উঠছেন আর হারেমের নারী নামে পিশাচিনীর মাংসপিণ্ডে বেহেস্তের নূর আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। এই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার পথ তাঁর নেই। মালিক আন্দিলের সতর্ক চোখ এবং খোজাপ্রধান সুলতান শাহজাদার বিশাল তলোয়ার তাঁকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করছে।
রাজশক্তি পাঠানের হাতে।
ধর্ম! সমাজ! চক্রবর্তী মৃদু ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন।
বহু বহু যুগের অব্যবহার, অপব্যবহারে সে পড়ে আছে গলিত, ছিন্ন। ভ্রান্ত ধর্মবোধ, আচার, বিচার, অনাচার, পাপাচারের মরচে তাকে করে তুলেছে শুকনো খড়ের দড়ির মতোই দুর্বল। অরাজক দেশ। বহুরাজক সমাজ। বৌদ্ধতন্ত্রনামক শবাচারী দেবদেবীগণের সঙ্গে শাক্ত ও শৈব বাশুলী, যম মিলেমিশে পরমানন্দে পাপাচারী নৃত্যে বিভোর হয়ে মদ মাংস নারীসঙ্গে ধ্বংসের পথে চলেছে।
মাতৃকাসাধন, পঞ্চ ম-কার চর্চা নবদ্বীপ তথা অধিকাংশ গৌড়ের প্রধান উপজীব্য ও কাঙ্ক্ষিত বিষয়।
মানুষের চর্চা কেউ করে না। এ থেকে কি নিস্তার নেই?
ইতিমধ্যে চক্রবর্তীর মনে পড়ল, নাতি বিশ্বরূপের আচার্য অদ্বৈতাচার্য কোন এক স্বর্গীয় প্রেরণায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবাহন করছেন। সেই অবতারই এই মাৎস্যন্যায় থেকে বিশ্বকে রক্ষা করবেন।
অদ্বৈতের এ দিবাস্বপ্নে বড়ো নীলাম্বরের হাসি পেল। বৃদ্ধ আচার্যের মস্তিষ্কশিথিলতা বই তো নয়। যুগপুরুষের আগমন কি এতই সহজলভ্য?
মহাকালই কালের প্রয়োজনে যুগন্ধর পুরুষের জন্ম দেন। তাঁরা যুগের প্রয়োজন সিদ্ধ করে আবার অপ্রকট হন। অতিলৌকিক বিভিন্ন ক্রিয়া তাঁদের কালক্রমে ভগবানের রূপে মানুষের অধিমানসে পরিচিত করায়। কালের প্রয়োজনেই এমন করে শ্রীকৃষ্ণ, শাক্যসিংহ এবং আরবের মরুপ্রান্তরে মহম্মদ আবির্ভূত হয়েছেন। কোনও ব্যক্তিবিশেষের ডাকে মহাপুরুষের আবির্ভাব কল্পনা, সে মস্তিষ্কবিকৃতির রাজলক্ষণই বটে।
চক্রবর্তী যখন নবদ্বীপের পথে জামাইবাড়ি রওনা দিলেন তখন বেলা চৌদ্দ দণ্ড পার হয়ে গেছে।
চন্দ্রগ্রহণের লগ্নে ভাগীরথীর ঘাটে স্নান করার জন্য কাতারে কাতারে লোক জমা হচ্ছে। দক্ষিণে মহিশূড়া থেকে উত্তরে শ্রীনাথপুর পর্যন্ত তটভাগ মানুষের মাথায় পূর্ণ। কোলাহল যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো শব্দ নিয়ে ভাগীরথীর তরঙ্গকে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ.. বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছ।
চক্রবর্তী আর দেরি করলেন না। উত্তর-পূর্ব দিকে রওনা দিলেন।
.
জামাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখলেন বিশাল নিমগাছের নিচে অস্থায়ী আঁতুড়গৃহ তৈরি হয়েছে। দুই জামাই চন্দ্রশেখর ও জগন্নাথ, শ্রীবাস, অদ্বৈতাচার্য এবং জগন্নাথের প্রতিবেশী বৈদ্য গুপ্তমশাই চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তবে জগন্নাথের মুখে যেন বাসন্তী কালবৈশাখীর অনাগত মেঘ এবং অদ্বৈতের অস্থিরতায় সেই কালবৈশাখীরই সূচনাপর্বের অস্থিরতা।
.
আঁতুড়ঘর থেকে শ্রীবাসপত্নী মালিনী একটি শ্বেতপাথরের পাত্রে গঙ্গাজল নিয়ে জগন্নাথের কাছে এসে বললেন, ‘বুড়ো আঙুলটা একবার ডুবিয়ে দিন তো মিত্রমশাই।’
– কিছু হবে তাতে?
জগন্নাথের গলায় হতাশা।
মালিনী মুখরা বলে পরিচিত। ঘোমটার আড়াল থেকে বললেন, ‘আর বললাম না, এখানে বটঠাকুর (অদ্বৈত আচার্য) রয়েছেন বলে। যাক্ গে, মাসিমা বললেন, এখন দিন তো তাড়াতাড়ি। তবে এ আপনাকে বলে রাখছি, এ সৃষ্টিছাড়া এখন যেমন শচীকে কষ্ট দিচ্ছে, সারাজীবন সে মাকে জ্বালিয়ে খাবে।’
গুপ্ত বললেন, ‘আগে তিনি আসুন। ভগবান রামচন্দ্রের কৃপায় বউমা আগে বিপন্মুক্ত হয়ে উঠুন। তবে এ কথা ঠিক, দীর্ঘ পনেরো বছরের কবিরাজি জীবনে এইভাবে তেরো মাস গর্ভবাস দেখিনি।’
অদ্বৈত পাশেই চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিলেন। চোখ না খুলেই তিনি বললেন, ‘সে আসছে গুপ্ত.. সে আসছে। বউমা মহতের জন্ম দেবেন, আর একটু কষ্ট সহ্য করবেন না, তা কি হয়? দীর্ঘ গর্ভবাসের কারণ এখানেই।’
এতক্ষণ চক্রবর্তীকে কেউ লক্ষ করেননি। তিনি গলাখাঁকারি দিয়ে ডাকলেন, জগন্নাথ..
.
উপস্থিত সকলেই তাঁকে প্রণাম করল। স্বস্তি উচ্চারণ করে তিনি বৈদ্য গুপ্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন কী অবস্থা?’
গুপ্ত কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘এখনও সম্পূর্ণ প্রসবের ব্যথা ওঠেনি তালুইমশাই। রক্তাল্পতায় বউমা একেবারে শুকিয়ে গেছেন। এজন্যই আরও দেরি হবে মনে হচ্ছে।’
– কোনও ওষুধ প্রয়োগ করেছ নাকি?
– আজ্ঞে না। আপাতত তার প্রয়োজন দেখছি না। তা ছাড়া মায়ের আমার গর্ভের আকার দেখে মনে হচ্ছে শিশু বিশাল।
চক্রবর্তী হা হা করে হেসে উঠলেন। অদ্বৈত, জগন্নাথ, গুপ্ত সচকিত হলেন।
সূর্যদেব ধীরে ধীরে জাহান্নগরের বিষহরি পীঠের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। ভাগীরথীর পশ্চিমাংশে অনাগত সন্ধ্যার দ্বিধাগ্রস্ত ছায়াসন্নিবেশ। পূর্বপ্রান্তে জলঙ্গীর নীল জলে ডিমের কুসুমের মতো কমলা লাল আলো পড়ে এক অনির্বচনীয় শোভার সৃষ্টি করছে। আকাশের পর্দা সরিয়ে ভীরু নক্ষত্রের দল একটি দুটি করে ফুটে উঠছে।
উচ্চকণ্ঠে ভাগীরথীর দিকে হাত দেখিয়ে নীলাম্বর বললেন, ‘অদ্বৈত, দেখতে পাচ্ছ জলাধার?’
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি মৃদু হাস্যে বললেন, ‘হ্যাঁ জ্যোতিষার্ণব।’
– গাছের সারি?
– হ্যাঁ.
.
– আর… আর পূর্ণচন্দ্র?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতিসূচক মৃদু হাসি হাসলেন অদ্বৈত আচার্য।
– তবে কী বুঝলে? সিংহ আসছে?
– আপনি মহাজ্ঞানী। আপনি ত্রিকালদর্শী। আপনিই বলুন।
***
“ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অর্ধচন্দ্র আকৃতির দেশ। হিমালয়ের উত্তুঙ্গ শিখর তার একদিকে যেমন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, তেমনই আর-এক প্রান্তে সমভূমি মিশেছে সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত্রে।
রুপানদেহী প্রদেশের একপ্রান্তে এক বিরাট সরোবর। কথিত, এ সরোবর মানুষের তৈরি নয়। দেবদহ নামের হ্রদটি নাকি মনুষ্যসৃষ্ট নয়। অনাদিকাল থেকে পার্শ্ববর্তী তিলৌরকোট, রুপানদেহী, কোলিয়ান ইত্যাদি রাজ্যে জল সরবরাহ করে এই জলাশয়। সরল পাইন ঝাউ গাছের মাঝে মাঝে বয়ে চলে হাওয়া।
পার্শ্ববর্তী জনপদটির নামও দেবদহ। শাক্যরাজবংশের শ্বশুরালয়। প্রজাপতি গৌতমী ও মায়াদেবীর পিত্রালয়।
ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে কোশল ছিল অন্যতম। কোশল অঞ্চল তখন তিনটি বড়ো জনপদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অযোধ্যা, সাকেত এবং শ্রাবস্তী। ছোটোখাটো কিছু জনপদও ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। যেমন শ্বেতাভ্য, উকাত্থ, দণ্ডকাপ্পা, নালকপন, পঙ্কধ ইত্যাদি। অনেক পরে রামায়ণ অনুসারে, ইক্ষ্বাকু এবং তদপরবর্তী অযোধ্যা ছিল কোশলের রাজধানী। মহাজনপদ যুগ বা ঈশাজন্মের পাঁচ-ছয়শত বছর আগে কোশলের রাজধানী ছিল শ্রাবস্তী। মৌর্য-পরবর্তী যুগের রাজাদের শাসন কিন্তু সেই অযোধ্যা থেকেই চলত।
ঈশা-পূর্বের সাতশত থেকে তিনশত বছর আগের কৃষ্ণমৃত্তিকা সংস্কৃতির অন্তর্গত কোশল কালের ক্রমানুসারে আরও নয়শত বছর আগের লৌহ-পূর্ব যুগের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমি তখন দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম ধান উৎপাদক অঞ্চল। বৈদিক বা পশ্চিমের কুরু-পাঞ্চালের তাম্র-ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি থেকে কোশল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে লৌহসংস্কৃতি এবং নগরসভ্যতার দিকে।
ধর্মবোধ এবং ঈশ্বরচিন্তার দিক দিয়েও কোশল ছিল কুরু পাঞ্চাল বা ব্রাহ্মণ্য বৈদিক সংস্কৃতির চেয়ে পৃথক। লৌকিক বা প্রাকৃতিক দেবদেবীর পূজার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক নিবেদন প্রচলিত ছিল। যক্ষ, যক্ষিণী, হ্রদ, মাটি, গাছ, নদীপূজার প্রচলন ছিল বহুলপ্রচলিত। মাটির সরসতা, উর্বরতা সম্বন্ধীয় দৈবী চিন্তাপ্রসূত ভক্তিমার্গের পথিক কোশলরাজ্য শক্তিবৃদ্ধির চেয়ে শিল্প, সংস্কৃতি, ভাস্কর্যের ওপর বেশি জোর দিতেন।
কোশল সাম্রাজ্যের মূল জীবনদর্শন ছিল ত্যাগ, পূজা, বলিদান, মৃত্তিকাপ্রেমের মাধ্যমে নিজ জাতি তথা রাজ্যবাসীর বিপদ ও পরিবেশের দূষণের প্রতিরোধ করা।
কোশলরাজ্যের এক কোণে ছোট্য জনপদ। শাক্যজাতির বাসভূমি। কোশলের ইক্ষ্বাকু বংশের অন্তর্গত এক ছোট্ট অঞ্চলের ক্ষুদ্র নরপতি। রাজা শুদ্ধোদন।
“বিবস্বান বংশজাত ইক্ষ্বাকু নৃপতি |
আদিত্য আশীর্বাদে ক্ষত্রিয় শ্রীপতি, |
কপিলাবস্তু মহাপুর মনোহর অতি |
মহামায়া, গৌতমী; সতী আর মতি…” |
নীলাম্বর থামলেন। মধুমাসের ভাগীরথীতে তখনও রয়ে গেছে শীতঋতুর মৃদু ছোঁয়া। ধুতির প্রান্তটি গায়ে জড়িয়ে নিলেন। সর্বাঙ্গ হর্ষ ও মৃদু ঠান্ডা বাতাসে পর্যায়ক্রমে কণ্টকাকীর্ণ।
অদ্বৈত চুপ। তিনি সব জানেন। তিনি সর্বজ্ঞানের আধার। বৈদ্য গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, মহাবুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন? তিনি তবে এক ক্ষুদ্র জনপদের রাজা ছিলেন?
নীলাম্বর সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকালেন ভিষগাচার্যের দিকে। তারপর বললেন, ‘ইক্ষ্বাকু বংশের রাজাদের মধ্যে মান্ধাতা, সগরের নামও পাবে গুপ্ত। রাজা ইক্ষ্বাকুর জ্যেষ্ঠপুত্র ওক্কমুখ। তস্য পুত্র শিবসঞ্জয়। তস্য পুত্র সিহশ্বর। কথিত যে, রাজা সিহশ্বরের বিরাশি হাজার সন্তান ছিল এবং তাঁরাই শাক্য।’
অদ্বৈত মুখ খুললেন এবার।
– শাক্যদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জয়সেন নামে পরিচিত হন। তাঁর পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিহাহনু। রাজা শুদ্ধোদনের পিতা।
শিহাহনু পুত্র শুদ্ধোদন শাক্যবংশীয়দের একজন সামন্ত ছিলেন কোশল সাম্রাজ্যের মধ্যেই। প্রাচীন আর্যাবর্তের উত্তর সীমায় কপিলাবস্তু রাজধানী থেকে শাসন করতেন।
কোলিয়ান গোষ্ঠীর শাসনাঞ্চল ছিল দেবদহ। প্রাচীন নেপালের এই অঞ্চলে দেবদহ নামে সত্যিই একটি সরোবর ছিল। কথিত আছে এই হ্রদ মানব, দানব বা প্রকৃতিনির্মিত নয়।
দেবদহ অতি আশ্চর্য স্থান। প্রাচীন নেপালের রুপানদেহী অঞ্চলে, কোলীয় রাজ্যের রাজধানী ছিল এই স্থান। লুম্বিনী ও বুটওয়াল থেকে চার যোজন উত্তরে হিমালয়ে কোলে দেবদহ। আর-একদিকে রয়েছে নওলপরশি অঞ্চল।
‘দেব’ অর্থাৎ দেবতারা এই সরোবর তৈরি করেন। ‘দহ’ শব্দের অর্থ সবারই জানা। ‘হ্রদ’-এর অপভ্রংশ হল ‘দহ’। দেব, দেবী, ঋষিগণের অবগাহনের স্থান। মনুষ্যনির্মিত নয় এ জলাধার। পালিভাষায় বলা হয়,
“স্বয়ংজত ভ স দহ/তস্ম পি দেবদহ”
অর্থাৎ, যে হ্রদ স্বয়ং জন্মেছে, তার নামই দেবদহ।
এই দেবদহের জলেই সমগ্র কোলীয় রাজবংশের তৃষ্ণা, অবগাহন সম্পন্ন হত।
অদ্বৈতের কণ্ঠ স্মৃতিমেদুর হয়ে এল। দু-চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল আবেগের অনবদমিত অশ্রুবিন্দুতে। গভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি এমনই মধুমাস। পাহাড়ি ফুলেরা সেজে উঠছে নতুন মকরন্দের গয়নায়। পাখি উড়ে এসে বসছে সদ্য গলে যাওয়া বরফ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসা জলধারার পাশে।’
ষোড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে রাশি রাশি ধনভাণ্ডার। উপঢৌকন।
তিনশো জোড়া হাতির দাঁত। বাছাই করা হীরকখণ্ডের সম্ভার। অফুরন্ত স্বর্ণ আকরিক। পঞ্চাশটি গোরুর গাড়ি পূর্ণ চন্দনকাঠের গুঁড়িতে। দারুচিনি, ধূমগন্ধা পানীয়ের ফল, কলা, নারকেল চলেছে ঘোড়ায় টানা দ্রুত শকটে। দক্ষিণদেশ থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে। পদযাত্রী ভৃত্য। সোনার নকশাকরা শিবিকায় বণিকশ্রেষ্ঠ। শিবিকার গায়ে সোনার পাতে গড়া গন্ধর্বমূর্তি। রজতনির্মিত জোড়া হাতি। ফুলেল লতা। লোহার কীলক পালকির নির্মাণ মজবুত করেছে আরও। বর্শাধারী পঞ্চাশজন রক্ষী। পঞ্চাশ তিরন্দাজ। পশ্চিমে ও দক্ষিণে বিস্তৃত সহ্যাদ্রি। মাঝে তাকে প্রস্থ বরাবর ছুঁয়ে গেছে বিন্ধ্য, সাতপুরা ও নীলগিরি।
পশ্চিমের গিরিমালায় বাধা পেয়ে উত্তর-পূর্বের মৌসুমী বাতাস শিখরে শিখরে ঘনিয়ে উঠছে মেঘপ্রাসাদের মতো। পশ্চিমঘাটের পূর্বদিক প্রতিবাত ঢাল। মেঘের ছায়ায় মেদুর শিলামালার কন্দর।
অস্মক বিদর্ভ উজ্জয়িনী হয়ে পূর্বে রাস্তা বাঁক নিয়ে বুন্দেলখন্ডি মালভূমি আর গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে পথ। দীর্ঘ পাঁচমাসের পথ। ওয়াঘুর নদীর জলতলের উচ্চতা দেখে পদব্রজীদের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ফুলে ভরা বাদামগাছে শিরশিরে ভিজে ভিজে হাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে বর্ষার মেঘ ইন্দ্রলোকের সাজঘরে কাজলের শেষ রূপটানটি দিয়ে নিচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই ওয়াঘুর, কাবেরী, গোদাবরী, ভীমা, কৃষ্ণায় পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাথুরে গা বেয়ে নৃত্যচপলা জলরাশি নেমে আসবে উপলনূপুর বাজিয়ে। বিষধর শঙ্খচূড়ের প্রসূতির কাল বর্ষা। প্রসবের খিদেয় শঙ্খিনী বেপরোয়া হয়ে উঠবে। পর্বতবাসী নিষাদ উপজাতির তীক্ষ্ণাগ্র তির হাওয়ায় শিস্ তুলবে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে।
কপিলাবস্তু পর্যন্ত একশত পঁচিশ যোজন পথ ভয়াল ও অগম্য হয়ে উঠবে।
তাও তাঁদের পৌঁছোতে হবে। শাক্যরাজা শুদ্ধোদন ও দেবদহী রাজকন্যা মহামায়ার পরিণয় অনুষ্ঠানে যোগদান করতেই হবে। এ বিবাহ শুধু বিবাহ নয়, এক মহাযুগ, মহান আবির্ভাবের পূর্বানুষ্ঠান।
.
সুদুর উত্তর পুষ্কলবতী, গান্ধার বা মগধ, সৌরাষ্ট্র, বৈশালী থেকে আসছে শঙ্খনির্মিত কারুকার্যখচিত অলংকারাদি, চুনি পান্না পোখরাজ বৈদূর্যমণির সম্ভার। ভারে ভারে দণ্ডাকৃতি কার্ষাপণ। ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপিতে রাজ্যসমূহের উপহার ও উপঢৌকনসমূহের বিবরণ ও নবদম্পতিকে লেখা আশীর্বচন।
“ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলন কোমল মলয় সমীরে
মধুকর নিকর করম্বিত কোকিল কূজিত কুঞ্জকুটীরে।।
বিরহতি হরিরিহ সরস বসন্তে।
নৃত্যতি যুববিজনেন সমং সখী বিরহিজনস্য দুরন্তে।।”
.
জয়দেবের বর্ণনার বসন্ত ঋতুর আগমনে ফাল্গুনী চতুর্দশীতে বিবাহ সম্পন্ন হল শুদ্ধোদন-মায়াদেবীর। আলোকে স্বর্ণে আনন্দগীতে কোলীয় তথা কপিলাবস্তু ভেসে যেতে লাগল। দূরদূরান্তের অধিবাসীরা দেবদহের জল দিয়ে পুণ্য করলেন রাজপরিবার অঙ্গন। ধান, যব, জোয়ার অঞ্জলি করে ঢেলে দেওয়া হল রাজবধূর অঞ্চলে। উলুধ্বনি, শঙ্খ, ঘণ্টায় দেবদহের পুণ্যতীর হয়ে উঠল আরও স্বর্গীয়।
দেবদেবীগণ অন্তরাল থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন ও তা ঝরে পড়ল হিমালয়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাকণার রূপে।
পরিপূর্ণ চিত্তে উদ্ভাসিত ফাল্গুনী চন্দ্রমা পশ্চিমে অগ্রসর হল অচেনা পুরের তারকাখচিত মেঘমণ্ডলের বাসরে।
.
বিশ্বরূপের পাঠাভ্যাসের শব্দে সকলের সংবিৎ ফিরল। মুরারীর সঙ্গে সে দুলে দুলে পড়ছে,
“কেশব ধৃত বামন শরীর জয় জগদীশ হরে
গোলোকের স্বামী নাচে মধুকৈটভারে,
দশরূপ ধরি প্রভু যুগ হইতে কাল
অসিরূপে বিনাশকারী; পালনরূপে ঢাল।”
চক্রবর্তী শুনলেন মালিনী ডাকছেন,
– শচী… শচী.
ক্ষীণ কণ্ঠের যন্ত্রণার উত্তর,
– উউঁ.
স্নেহার্দ্র গলায় মালিনী বললেন,
– এটি একটু খেয়ে নে ভাই, চোখ খোল। এই দেখ মাসিমা এসেছেন।
শচীর পাণ্ডুর গাল বেয়ে কোটরগত চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল, স্তিমিত স্বরে বলে উঠলেন,
– এসেছ মা, মা গো… আমি যে আর বাঁচিনে মা।
চক্রবর্তী গিন্নির গলা শোনা গেল,
– কাঁদিসনে মা, আর-একটু কষ্ট কর। জামাইয়ের পা-ধোয়া জলটুকু খেয়ে নে।
– এনেছ? দাও।
মালিনী বললেন,
– তুই শুয়ে থাক শচী, আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।
শচী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললেন,
– মালিনী, আমাকে আর কত ঋণী করে রাখবি ভাই?
– এখন থাম তো তুই।
মালিনী স্বভাবসিদ্ধ গলায় ঝংকার দিয়ে বললেন, ঋণ করে পার পাবি না তুই শচী। সুদে আসলে সব শোধ করে নোব, মিলিয়ে নিস।
শচী হাসলেন। আনন্দের অশ্রু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামল। মালিনী সস্নেহে আঁচল দিয়ে তা মুছিয়ে দিলেন। গুপ্ত গৃহিণী বললেন,
– তুমি এখন চুপ করো বিশ্বরূপের মা।
সূর্য অস্ত গেলেন পশ্চিম দিগন্তে। বিশাল চাঁদ অন্ধকারের ঘোমটা তুলে পূর্বে ভাগীরথীর আরশিতে প্রতিবিম্ব দেখতে এল।
শচীর কাতরধ্বনি শুনে চক্রবর্তী বাইরে এলেন।
.
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নীলাম্বরের পাশে এসে দাঁড়ালেন অদ্বৈত। কাঁধে হাত রাখলেন। এই স্নেহের স্পর্শে আরও যেন ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ। ঘোরতর কান্নায় ভেঙে পড়ে অদ্বৈতকে জড়িয়ে ধরলেন মাতৃহারা শিশুর মতো।
ভাগীরথীর তীরে জনাসমাগমের তীব্র কোলাহল ছাপিয়ে পরপাড়ের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্য থেকে ভেসে উঠল ঘোর শিবারব। তীরসংলগ্ন শ্মশানের আগুন থেকে মৃদু মৃদু ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। কোনও শ্মশানবাসী কাপালিকের শবসাধনার মন্ত্রোচ্চারণ সুস্পষ্ট।
এই ঘন অন্ধকারে অদ্বৈত আচার্যের কণ্ঠস্বর কোনও যুগঘোষকের কণ্ঠস্বরের মতো গাঢ় হয়ে উঠল।
– জ্যোতিষার্ণব, মনে করুন, সেই বৈশাখী পূর্ণিমার রাত। লুম্বিনীর বনে চাঁদের আলোয় সরল গাছের পাতায় পাতায় মহাজাগতিক আলেখ্য। মায়াদেবী চলেছেন দেবদহের পুণ্যসলিলে স্নান করতে।
শাক্য রাজবংশের রীতি তখন অন্তঃসত্ত্বা রমণী, বীজবপনকারী কৃষক, নবনির্মাণোৎসুক মৃৎশিল্পী এবং অভিষেকোদ্যত রাজাকে দেবদহের জলে স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে নিতে হবে কর্মোদ্যোগ।
দেবদহের কোলীয় রাজপ্রাসাদ মায়াদেবীর পিতৃগৃহও বটে। সেখানেই নবজাতক বিশ্বে আসবেন। সে কী সুন্দর রাত্রি চক্রবর্তী মশাই। গাছে গাছে ফুল ফল। বনের সব পশু হিংসা ভুলে একে অপরের পাশাপাশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে এক অনিমিখ অপেক্ষা যেন কোনও বিরাট আগমনের। রাতের কিরাত ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বাঁশিতে তুলেছে এক অনির্বচনীয় সুর।
হঠাৎ! মায়াদেবী যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। সঙ্গিনীরা তাঁকে পরম যত্নে ধরাধরি করে একটি শালগাছের নিচে বসালেন।
বৈশাখী দখিন মলয়ে সেই শালগাছের ফুলের মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল কপিলাবত্থ উপত্যকায়। দেবদহ থেকে ভেসে এল দুটি জলের স্রোত। একটি উষ্ণ ও অপরটি সুশীতল।
সেই দুই স্রোত এখনও বয়ে যায় মন্মথ উপত্যকায়। তার জলে গা ডুবিয়ে বসে সর্বত্যাগী শ্রমণের আত্মারা ষড়যন্ত্র করেন কীভাবে উপত্যকাকে ফুল, ফল, ফসল, গন্ধ, রসে ভরিয়ে দেওয়া যায়, যাতে সব দুঃখ, কষ্ট, জরাচিন্তা, বার্ধক্যের দৌর্বল্য, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মানুষ মহতী ভবিষ্যতের চিন্তায় বিলীন হতে পারে।
.
অদ্বৈতের গদগদ কণ্ঠস্বর বাধা পড়ল মালিনীর আর্তচিৎকারে। আর সঙ্গে সঙ্গে এক শিশুকণ্ঠের সুমধুর কান্নার শব্দ… শচীর বিস্রস্ত কাপড় ঠিক করে দিয়ে নবজাতককে কোলে নিলেন। সন্তানহীনার তৃষিত ঠোঁট স্পর্শ করল সদ্যোজাতের কপাল।
বৈদ্য গুপ্ত দৌড়ে অন্দরমহলে ঢুকলেন।
স্বল্পভাষী জগন্নাথ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন। হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ওঠানামায় তাঁর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। আশায়, আবেগে, ভয়ে, তিনি শ্রীবাসের হাত ধরলেন। শ্রীবাস তাঁর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কোনও চিন্তা কোরো না দাদা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ঘরের ভেতরে গুপ্ত দেখলেন, কী দেখলেন? তাঁর দু-চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল যেন। এ কে? এ কি শিশু, না একতাল সোনা? শচীর পাশে যেন মহীশূরের সকল সোনা একত্রিত রূপ নিয়েছে। ঘন চাঁচর চুল জন্মাবস্থাতেই। ধনুকের মতো দুই ভ্রূর নিচে পদ্মের পাপড়ির মতো দুই বিশাল চোখ আকর্ণবিস্তৃত। উন্নত নাক মৃদু শ্বাসপ্রশ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
তিনি কাঁপা কাঁপা স্বরে মালিনীকে বললেন, ঠিক আছে। ওর পা দুটো ধরে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিন।
মুখ ফিরিয়ে বাইরে দাঁড়ানো জগন্নাথকে বললেন, ‘ও হে জগন্নাথ, তোমার ছেলে হয়নি গো, বউমা একতাল সোনা জন্ম দিয়েছেন। এ কী রূপ! নাঃ, আমি বাইরে যাই, নজর লেগে যাবে।’
আবেগে বৃদ্ধের গলা বুজে এল। বাষ্পীভূত চোখে দেখলেন নবদ্বীপের ঘরে ঘরে স্বর্ণাভ মঙ্গলদীপ জ্বলে উঠছে। তিরতির করে কাঁপছে তারা মৃদু বাতাসে। নিশ্চুপ প্রায়ান্ধকার নদীতীর। এ যেন বহু যুগের ওপারের নৈঃশব্দ্য, এক প্রবল বিস্ফোরণের প্রহর গুনছে। এক মহা শুভারম্ভের বার্তা বহন করে আনছে ভাগীরথী হিমালয়ের সানুদেশ থেকে।
.
ইতিমধ্যে প্রচণ্ড জোরে কেঁদে উঠল নবজাতক। এ যেন সমগ্র বিশ্ববাসীর কান্না একা নিজের গলায় ধারণ করে বরাভয় দান করছে।
হঠাৎ সমগ্র নবদ্বীপে ‘হরি বোল’ শব্দের প্রচণ্ড নিনাদ উঠল। চক্রবর্তী দেখলেন, পূর্ণচন্দ্র রাহুগ্রস্ত হতে চলেছে।
শান্তস্বভাব অদ্বৈত এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিলেন। হঠাৎ সিংহের মতো লাফিয়ে উঠোনে এসে পড়লেন এবং পাগলের মতো নাচতে নাচতে বললেন,
“সর্বসল্লক্ষণে পূর্ণ সপ্তকে বাসরে তথা।
মিশ্র-পত্নী-শচী গর্ভাদুদিতো ভগবান হরিঃ।”
চক্রবর্তী হাসলেন, বললেন,
– তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক অদ্বৈত। দুহাজার বছর আগে বিশ্বে এমনই এক আবির্ভাব ঘটেছিল।
“শাখাম্আলম্ববমান্যহ দেবী কদাচিতথ লুম্বিনীম্।
দেব্যহ কুক্ষিম বিভিদ্যাসু বোধিসত্ত্ব বিনির্যায়ু।।”
ঈশান হাঁ করে শুনছিল। সে বলল,
– দাদু, ভাই ওইটুকুন, তাতেই সিঙ্গের মতো চেঁচাচ্ছে গো। হ্যাঁ গো, এ কী ভাষা কইলে তুমি? মানে কী?
নীলাম্বরের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল,
– ঈশান, ওরে পাগলা ভাই আমার, এও এক মা-জ্বালানি পরভুলানি ছেলের জন্মকথা। রানি মহামায়া শুদ্ধোদনের প্রাসাদ থেকে যাচ্ছেন বাপের বাড়ি। শুদ্ধোদনের প্রাসাদ অতি সুন্দর। তার তুলনা চলে শুধুমাত্র কৈলাসের সঙ্গেই। সে প্রাসাদের সুন্দরী মেয়েদের মুখ দেখে পদ্ম লজ্জা পায়, চাঁদ হিংসেয় কালিমাখা মুখ করে বসে থাকে। রাজার রাজা হয়ে স্বয়ং শূলপাণির মতো রাজ্যশাসন করেন শাক্যরাজা।
পথের মাঝেই মহারানির যন্ত্রণা শুরু হল, এই তোর শচীমায়ের মতোই। ফুলে ভরা শালগাছের ডাল ধরে মাটিতে বসে পড়লেন মায়াদেবী। তখনই হঠাৎ মায়ের পেট থেকে বাগমতী নদীর ধারার মতো উচ্ছল বোধিসত্ত্ব জন্ম নিলেন।
পুষ্যা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম। সারা বিশ্বের দুঃখহর শ্রীবুদ্ধ অমিতাভ অমিতায়ুধের জন্ম। প্রেমের অমোঘ অস্ত্রে সমস্ত লোভ, লালসা, দুঃখ, ভয় তিনি জয় করেছেন।
আজ বাংলার এই চরম দুর্দিনে, এ চরম অব্যবস্থার অবসান করবে আমার এই দশম দৌহিত্র বিশ্বম্ভর। তোমার কথাই ঠিক অদ্বৈত। শ্রীবাস ক্ষেত্র প্রস্তুত করো।
– তবে চাঁদে গেরন লাগল কেন দাদু?
ঈশানের দ্বিধাগ্রস্ত প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্রশেখর বললেন,
সিংহরাশি সিংহলগ্ন উচ্চ গ্রহগণ।
ষড়্ বর্গ অষ্ট বর্গ সর্ব সুলক্ষণ।।
অকলঙ্ক গৌরচন্দ্র দিলা দরশন।
সকলঙ্ক চন্দ্রে আর কোন প্রয়োজন।।
এত জানি রাহু কৈল চন্দ্রের গ্রহণ।।
বারবার শঙ্খধ্বনি হল জগন্নাথের কুটিরে। মিতবাক শ্রীবাসের মনে দ্বিধার মেঘ। সংশয়।
একদিকে শাক্যবংশের বৈভব এবং পরবর্তী মৌর্যরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা, বুদ্ধের পথ সুগম ছিল সর্বদিশে। তাঁর সংগ্রাম ছিল নিজের সঙ্গে, ষড়রিপুর সঙ্গে। বোধিলাভ সম্ভবপর হয়েছে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি!
বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের গলিত মৃতদেহের ওপর কাপালিক হয়ে বসেছে মরুদেশীয় যবনরাজা। আপামরের অন্তর্লোকে লালসা, কাম, মদ আর বিকৃত ধর্মবোধের পাপাচার। নেড়া-নেড়ি-গৌড়িয়া মিলেমিশে শ্মশানের কুকুরের মতো ঘৃণ্য চিৎকারে ভরিয়ে তুলছে দেবী উপদেবী শাখাদেবীর থান।
এর মধ্যে, এ ঘন পাপপঙ্কিল পরিস্থিতিতে কীভাবে লেখা হবে নতুন পথের দিশা? কীভাবে রচিত হবে ভক্তিসাগরে নিমজ্জিত ক্রান্তিসম্ভব?