অন্ধকার দরজার মা
১
আর্থাআআআর… আর্থাআআআআর… আর্থাআআআর..
ডাকটা খুব স্পষ্ট নয়। তবুও শোনা যায়। পশ্চিমে আটলান্টিকের পাড় খুব একটা খাড়া নয়। পাথুরে ঢাল ভেজা ভেজা কালো পাথর বেয়ে নেমে গেছে মহীসোপানের উপকণ্ঠে। পায়ে চলা পথটা সন্ধ্যার অন্ধকারে আবছা দেখা যায়। সেটা উঠে গেছে উত্তরে পাহাড়টার মাথায়। মহাসমুদ্রের প্রচণ্ড গর্জন শোনা যায়। পাথরের আছড়ে পড়া ঢেউ থেকে উঠে আসছে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা বাষ্প। পুবদিকের ঢাল বেয়ে পথের একদম পাশ পর্যন্ত উঠে এসেছে অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতাব্দী প্রাচীন ওকগাছের সারি। মাঝে মাঝে পাথুরে জমিতে যেটুকু মাটি পাওয়া যায় তাতে লাইকেন, পপলার, উইলোর ঝোপ।
গা ছমছম করে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ।
সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ার একঝলক যেন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা। ওকগাছগুলো কত বছরের পুরোনো, আর্থার জানে না। বাবা বলে ২০০ বছরের, ঠাকুরদা বলে ৫০০ বছরের। বিশপ ভিক্টর অবশ্য বলেন পাঁচশো কোটি বছর আগে পৃথিবী ঠান্ডা হওয়ার পর প্রথম যে জীবন সৃষ্টি হয়, তা হল এই ওকগাছগুলো। দিনের আলোয় এই কথাগুলো দিব্যি হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আবছায়া ভিজে ভিজে সন্ধ্যায় পশ্চিমে প্রচণ্ড সামুদ্রিক গর্জন আর পুবের অসীম নৈঃশব্দ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আর্থারের বুকটা ছ্যাঁকছ্যাঁক করে উঠল।
একটা কান্না শোনা যাচ্ছে না?
ওকগাছের গুঁড়িগুলোর গায়ে শ্যাওলা জমে পিছল। ওগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে। তবুও দুটো গাছের গুঁড়িতে ভর দিয়ে আর্থার কান্নার উৎসটা বোঝার জন্য ব্র্যাকলুন বনভূমির ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল।
…আর্থাআআআর… আর্থাআআআআর..
.
ওই তো আবার মেয়েলি গলার ডাক! সঙ্গে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছু বলছেও গলাটা। গলাটা শুকিয়ে এল আর্থারের।
সন্ধ্যার পর এখানে আসাটা একদমই ঠিক হয়নি।
তবে সোনার লোভ, সোনার লোভ! সোনা, তাল তাল সোনা… উফ, বলছিল বটে ডাবলিনের লোকগুলো, সাত লক্ষ টন সোনা রয়েছে মাউন্ট অক্স আর ব্র্যাকলুন বনের মাঝামাঝি কোথাও। জ্বলজ্বলে আগুনের মতো সোনার নদী বয়ে যাচ্ছে মাটির সামান্য নিচেই। এই তো, গাঁইতিও সে নিয়ে এসেছে সঙ্গে। দু-তিন-পঞ্চাশ কোপ মেরে কেজি কুড়ি তুলে নিতে পারলে তাকে আর পায় কে? ডাবলিন কি জুরিখে একর তিরিশেক জমি, খামার, পোস্টকার্ডের মতো বাংলো… আর, এলিন… ওঃ। এবার তো আর সে আর্থারকে মানা করতে পারবে না। সোনা হাতে এলেই ও মায়ো কাউন্টি এগজিকিউটিভ। ভয়টা ঝেড়ে ফেলে আর্থার এগিয়ে চলল। কিছুটা উপরে উঠে ফাঁকা পথ শেষ। সামনে ব্র্যাকলুন বন ঢাল ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনের স্যাঁতসেঁতে পথ বেয়েই এবার পৌঁছোতে হবে পাথুরে দুর্গে।
আকাশছোঁয়া কালো গাছগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। পথ নামমাত্র। ইতস্তত করল আর্থার। আজকের সন্ধ্যাটা ভালো নয়। মেঘলা আবহাওয়া আয়ারল্যান্ডে আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু আজকের মেঘটা ঠিক যেন মেঘ নয়। যেন একটা কান্নার বাষ্প, দীর্ঘশ্বাসের কণা মেঘ হয়ে জমাট বেঁধে আছে।
কিন্তু সোনার লোভ বড়ো লোভ।
স্যাঁতসেঁতে পথ ধরে বনের গভীরে নামতে নামতে আর্থার একবার পিছন ফিরে তাকাল। সমুদ্রের অংশটা আর দেখা যাচ্ছে না। ঢেউয়ের গর্জনের শব্দ অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বারবার পা পিছলে যাচ্ছে শ্যাওলাধরা পাথরে। খুব সাবধানে গোড়ালি চেপে আর্থার হাঁটতে লাগল। ও জানে জায়গাটা দেখলেই চেনা যাবে। পাথরের দুর্গের ভগ্নাবশেষ। তাকে ঘিরে পরিখা। আর পরিখা পার হওয়ার পাঁচটা সেতু আছে। পশ্চিমের সেতুটি এখনও অক্ষত। ওটি পার হয়ে একবার ঢুকে যেতে পারলেই হল।
কিন্তু দুর্গের তিনটে কুয়োর মধ্যে কোনটাতে নির্দিষ্ট করে সেই পাতালখনির দরজা, তা আর্থার জানে না। বিস্তর পরিশ্রমের ব্যাপার। সে হোক। আখেরে যা পাওয়া যাবে, তার আর্ল কি ভাইকাউন্ট হওয়া আটকায় কে?
**
কান্নাটা আবার শোনা যাচ্ছে।
কী জঘন্য কান্নাটা! আর্থারের মনে হল কেউ যেন কান্নাটাকে আটলান্টিকে ভিজিয়ে নিয়েছে। স্যাঁতসেঁতে পেছল পেছল কান্না। কেউ যদি হাসিমুখে নাটুকে মরাকান্না কাঁদে ঠিক ওরকম শব্দ হয়। একবার থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতল ও। অনেকসময় পাথরের খাঁজে বা বেরি জুনিপারের ঝোপে হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে ঠিক এই শব্দ সৃষ্টি করে।
কিন্তু তার সঙ্গে ওই বিলাপ?
খাঁটি মেয়েলি গলায় জড়ানো উচ্চারণ।
আর্থাআআআর… আর্থাআআআআ… বাড়ি আয়, বাড়ি আয়… দুর্, মায়ের পিছুডাকটাই কানে বাজছে। দাঁড়া বুড়ি, বাড়ি ফিরি, তোকে আর-একটা বাকিংহাম বানিয়ে দেব।
“তুমি কি কিছু খুঁজছ?”
আর্থার চমকে উঠল। হাত থেকে গাঁইতি আর লম্বা দড়িটা পড়ে গেল। ঘাড়ের ঠিক ওপরেই নিঃশ্বাস ফেলেছে কথাটা।
একটা মেয়ে। একটা কালো মেয়ে জ্বলজ্বলে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য আর্থার নিথর হয়ে গেল। আইরিশদের মধ্যে এমন কালো আর নিখুঁত কাটা কাটা চোখমুখের মেয়ে দেখেনি আর্থার। অবশ্য মায়ো কাউন্টির বাইরে কোনোদিন সে যায়ওনি। মেয়েটা অপেক্ষা করছিল। টানা টানা চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে মেয়েটা অপেক্ষা করছিল। আর্থার আমতা আমতা করল,
– ইয়ে, ওই ভাঙা কাসল দেখতে যাচ্ছিলাম আর কি। তুমি কে? এই জঙ্গলে কী করছ?
মেয়েটি ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
– আমিও পাহাড়ের অনেক নিচ থেকে এখানে এসেছি কাসলের খোঁজেই। ওইদিকটা দেখেশুনে ফেরার সময় এখন দেখছি অন্ধকারে আর পথ খুঁজে পাচ্ছি না। তোমাকে দেখে আশার আলো পেলাম।
– না না, কোনও ভয় নেই। ওই দ্যাখো, ঠিক ওই ঢাল বেয়ে উঠে সোজা বাঁয়ে ঘুরে যাও, ফেরার রাস্তা পেয়ে যাবে। তুমি কি বাইরে থেকে এসেছ?
– না না, আমি ভিতরগাঁওয়েরই মেয়ে। তবে অনেকদিন এদিক-ওদিক ছিলাম।
হাওয়াটা আবার কেঁদে উঠেছে… আর্থাআআর… বাড়ি যাআআ..
.
মেয়েটা চমকে উঠে আর্থারকে জড়িয়ে ধরল। বড়ো বুকটায় মুখ চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, “ও কে? ও কে?”
আর্থারের সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। নরম শঙ্খের মতো দুটো বুক চেপে বসেছে দীর্ঘদেহী লোকটার পাঁজরের নিচটাতে। আগুনের মতো গরম গা। মাংসের নিচে প্রবল আন্দোলন। ঠিক যেন একটা আগুনের দলা বেরিয়ে আসতে চাইছে। অস্ফুট গলায় বলল, “তোমার গায়ে কি জ্বর?”
মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল। চোখেমুখে সুস্পষ্ট আকুতি।
– এখন ওই দুর্গের দিকেই চলো না গো। সকাল হলে নাহয় একসঙ্গে ফিরব।
সোনা! সোনা! এই তো সোনা। আর্থারের চোখে চিকন কালো মাংস, ত্বক, নরম গরম বুক যেন একখনি সোনা হয়ে উঠল। কোমর ছাপিয়ে যাওয়া বেণিতে হাত বুলিয়ে সে বলল,
– অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে রাত কাটাবে? ভয় নেই তোমার?
চকচক করে উঠল মেয়েটার চোখ। ঝলমলে। নরম গলায় বলল, ‘না।’
**
মেয়েটা আগে আগে পথ দেখিয়ে চলল। এদিকটা বেশ ভালোমতোই চেনা তার। লম্বা কালো চুল বেণি পাকানো। সেটা কোমরের নিচের চওড়া অংশ ছাড়িয়ে হাঁটুর কাছে দোল খাচ্ছে। লাইকেনের ঝোপটার পাশে একটা কালো কুকুর। মিশমিশে কালো রং। হলুদ চোখে আর্থারের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখটা আকাশের দিকে তুলে করুণ সুরে ডেকে উঠল। অবিকল মানুষের কান্না। মেয়েটা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। সে আবার দৌড়ে পিছিয়ে এল কান্নাটা শুনে। আর্থার তার হাত ধরে আশ্বস্ত করল।
কুকুরটা একটানা ডেকে চলেছে। তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আর্থার গাঁইতিটা শক্ত করে ধরল। খুব কাছে বাজ পড়ল একটা। আকাশ থেকে নীল বিদ্যুতের শিখা আছড়ে পড়ল ওকগাছের ডালে, পাতায়। বনের একটা অংশে আগুন লেগে গেল।
মেয়েটা হঠাৎ খুশির সুরে বলে উঠল, “বাহ্, কী সুন্দর আগুন!”
আর্থার কিছুটা অবাক হল,
– তোমার আগুন ভালো লাগে?
– হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে। আগুনে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। গরম হয়ে ওঠে একদম ভিতরদেহ পর্যন্ত।
শেষের দিকে কথাগুলো ফিসফিস করে বলল মেয়েটা। একটা চাপা চাহিদা যেন এই শীত শীত ভেজা ভেজা সন্ধ্যায় আর্থারকে দূর থেকে জোর করে ছুঁয়ে দিল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। ছিপছিপে এক মেয়ের দুর্নিবার আহ্বানে তার রিপুগুলো একটা একটা করে জেগে উঠতে লাগল। কিন্তু আর্থার ঠিক বোঝাতে পারবে না, ওর চাহিদাগুলো কেমন একটা কদর্যতা মাখা, শুধু যেন শারীরিক টান নয়। আরও আরও বেশি কিছু, কিন্তু তাতে ঘৃণার প্রলেপ দেওয়া। পচাপাতা বা কাদার মধ্যে সিডারের ফল পড়ে থাকলে যেমন লোভ হয়, এ অনেকটা তেমন।
“এই তো, এসে গেছি”, মেয়েটার ডাকে মেয়েটাকে ছেড়ে আর্থারের চোখ দুটো সামনের আকাশের দিকে পড়ল। প্রথমে কিছু দেখতে না পেলেও, ঘন ঘন বিদ্যুতের চমকে আকাশের গায়ে আঁকা দুর্গটার অস্তিত্ব বোঝা গেল।
.
দুর্গটা প্রস্থ বরাবর অশেষ মনে হয়। আটটা মিনারের মাথায় মাথায় লোহার বিদ্যুৎবাহ। ওকগাছের ডাল ঝুঁকে পড়েছে গবাক্ষের গায়ে। চুল্লি থেকে হঠাৎ ডানার শব্দ। কিছু একটা উড়ে গেল শব্দ মেলে।
‘পাথরগুলো হলুদ, জানো?’ মেয়েটা ঘোষণা করল।
– তোমার নাম কী?
– অ্যাঁ, কী বলছ?
– কী নাম তোমার?
মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবল। আর্থার অবাক হয়ে বলল,
– নিজের নাম কী অত ভাবছ?
মেয়েটা হেসে উঠল। একটু কষ্ট কষ্ট হাসি।
– আমার বাবা মা বলে কেউ নেই। তাই নিজের নাম নিজেই রেখেছি। একটু অদ্ভুত শুনতে লাগে, সবাই বলে।
– সে হোক, তুমি বলো।
– মায়দেন।
– মায়দেন!
– বললাম না, একটু অদ্ভুত।
– না না। অদ্ভুত নয়, তুমি ওই কী বলে, সত্যিই এখনও মায়দেন?
মায়দেনের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটু কেঁপেও উঠল যেন। আলতো, পাতা ঝরার শব্দে বলল, “জানি না।”
এদিকের দরজাটা দিয়ে ঢুকলে একটা খুব নিচু ছাতওয়ালা জায়গা পার হতে হয়। আর্থারকে মাথা নিচু করে যেতে হল এ অংশটুকু। নিকষ অন্ধকারে মায়দেনের পায়ের শব্দটুকু শোনা যাচ্ছে। বনের মধ্যে আর্থার আলো জ্বালায়নি অন্য কারও চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। প্রাচীরের আড়ালে পৌঁছে আর সে ভয়টা নেই। কোমরে গোঁজা টর্চটা জ্বলে উঠল। মায়দেনের কালো স্লিপার। গোড়ালির চকচকে চামড়া। কালো ক্লোকের ঝুল বেয়ে আলোটা উঠে কোমরের ঠিক নিচটায় আটকে গেল। দুটো মাংসল স্তূপ পর্বত আন্দোলিত হচ্ছে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে। গ্রস্ত উপত্যকা বরাবর সর্পিল বেণি নেমে এসেছে। আর্থারের গলাটা শুকিয়ে এল আবার। মায়দেন কিছু একটা আঁচ করতে পেরে ঘুরে দাঁড়াল। আলোর ফোকাস সে অবসরে স্থান পরিবর্তন করে নিতে পারেনি। মায়দেন তীব্র সুরে বলে উঠল, “দ্রখভেইসা!”
পাথুরে চাতালটায় একবার টর্চের আলোটা ঘুরিয়ে নিল। ঘুরিয়ে দিল কথাটাও।
– তুমি তো আগেও এসেছ এখানে, কোনও কুয়ো-টুয়ো চোখে পড়েছে?
মায়দেন আবার রেগে গেল।
– তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না। কী বলতে চাইছে বলো তো?
অতর্কিত অপ্রত্যাশিত জবাবে আর্থারের কান দুটো গরম হয়ে গেল। সেও একটু গরম স্বরেই বলল,
– দ্যাখো, অত অবিশ্বাস থাকলে এই নাও টর্চ, তুমি তোমার মতো চলে যাও। অত নখরা আমার ধাতে সয় না। কুয়ো মানে সত্যিই কুয়ো। কাঠি দিয়ে মাপার কুয়ো দেখতে চাইনি আমি।
একদৃষ্টিতে আর্থারকে কিছুক্ষণ দেখে নিল মায়দেন। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল।
– এসো। আছে ওরকম তিনটে কুয়ো।
– তার মধ্যে কোনোটার মুখে বা পাশে কোথাও তারা আঁকা আছে?
– হ্যাঁ হ্যাঁ, সবচেয়ে বড়োটার। কেন বলো তো?
বুকটা ধ্বক করে উঠল আর্থারের। একদম ঠিক। ওইটাই সোনানদীর পথ। বলবে, মায়দেনকে ও সব বলবে। আগে বিপুল সে ভাণ্ডার খুঁজে পাক, সব বলবে।
দুটো ছোটো ছোটো ঘর ছুঁয়ে অলিন্দ শেষ হয়েছে দেয়ালঘেঁষা সিঁড়ির কাছে। চওড়া পাথুরে সিঁড়ি। বাইরের দেয়াল হলুদ পাথর দিয়ে তৈরি হলেও, অন্দরের সব কাজ নিকষ কালো পাথরের। সিঁড়ির ডানদিকে দেয়াল। তার বাঁদিকে কোনও বাধা নেই। তেরোটি ধাপ পার হলে একটা গোল উঠোন মতো জায়গায় পড়তে হয়। ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে একটা কুয়ো। আর্থার ছুটে গেল সেদিকে। কুয়োর গভীরে আলোটা নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। মায়দেন কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আর্থার টের পায়নি। একটা ফিসফিসে গলা,
– এটায় নেমে, আরও একটা। তারপর সেই গহ্বরও পার হয়ে, শেষে আসল জায়গা।
জায়গাটা গরম হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। আর্থার গলাবন্ধ জ্যাকেটটা খুলে কুয়োর পাশে রেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কতদিনের অব্যবহৃত সিঁড়ি কে জানে! কিন্তু মনে হয় এখানে কেউ আসে না। ধুলোবালি বেশ কম। তেরোটা সিঁড়ি নেমে দ্বিতীয় কুয়োর মুখ। টর্চটা কিছুক্ষণের জন্য নিভিয়ে রাখল আর্থার। নিস্তব্ধ জায়গায় আলোরও যেন একটা শব্দ শোনা যায়। আলোটা নিভে যেতেই মায়দেনের পায়ের শব্দ শোনা গেল ঠিক পিছনে। উদ্বিগ্ন গলায় সে বলল, “কি গো থামলে কেন?”
– একনাগাড়ে টর্চ জ্বললে সেল বসে যাবে। ওকে একটু বিশ্রাম দাও।
অবাক গলায় মায়দেন বলল,
– এ কোথাকার বোকা রে! টর্চ জ্বালতে কে বলেছে? আমার তো পুরো চেনা জায়গাটা। আমার হাত ধরে এসো। আর সোজা সিঁড়ি, দুনম্বর কুয়ো হয়ে নেমে গেছে। পা বাড়ালেই তেরো-তেরো ছাব্বিশ সিঁড়ি পার হলেই পৌঁছে যাব।
কেমন একটা সন্দেহ হল আর্থারের। মৃদু গলায় বলল,
– তুমি জানো আমি কোথায় যেতে চাই?
– আরে তুমিই তো বললে তারা আঁকা কুয়োর মধ্যে নামবে। নিজের কথা নিজেই ভুলে যাচ্ছ, নাকি?
– আচ্ছা, চলো।
.
মায়দেনের হাতটা গরম। আশ্চর্যরকম গরম। নির্ঘাত জ্বর বাধিয়েছে মেয়েটা। সিঁড়ি বেয়ে নামছে ওরা। এক, দুই, তিন, আট, তেরো… পায়ের আঘাতে কিছু একটা গড়িয়ে ঠং ঠং করে নামতে লাগল ওদের আগে সিঁড়ি বেয়ে। টর্চ জ্বালানোর কথা ভুলে গেছে লোকটা। একটা দমবন্ধ করা অথচ তীব্র আরামের গরম আর্থারের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব, খুব কাছেই একটা উষ্ণতার বিরাট উৎস রয়েছে। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও আর্থার দেখতে পাচ্ছে সে গলিত সোনার স্রোত, পাথরের খাঁজে আটকে থাকা বিরাট বিরাট সোনার শিরা। বাইশ.. তেইশ.. আর মাত্র দুটো ধাপ… ছাব্বিশ!
এ কী!
**
ঠান্ডা জল! গলা পর্যন্ত ডুবে গেল আর্থারের। সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে জলে ছিটকে পড়ার সময়ই মায়দেনের হাত তার হাত থেকে ছিটকে গেছে। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে আর্থার টর্চটা জ্বালল। নীলচে আলো কালো জলে প্রতিফলিত হয়ে ভূকন্দরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। একটি ক্ষীণ সাতরঙা আভা ছড়িয়ে রইল পাথুরে দেওয়ালে বিক্ষিপ্তভাবে।
“পেয়েছ সোনার কুয়ো?”
ঠিক পিছনে মায়দেনের ফিসফিসে গলা। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল আর্থার। কেউ নেই। একটা জলজ সাপ এঁকেবেঁকে চলে গেল দেয়ালের দিকে। খিসখিস করে একটা নোংরা হাসি ভেসে বেড়াতে লাগল চতুর্দিকে। গাঁইতিটা মুঠো করে চতুর্দিকে আলো ফেলতে লাগল আর্থার। আঁশটে গন্ধ একটা। নিথর জল এত ভারী যে সাড়ে ছ-ফুটি লোকটার নড়াচড়ায় তাতে যে ঢেউ উঠছে, সে প্রায় দেখাই যায় না।
“আর্থাআআর… ওওও আর্থার। ব্যানশি-র কথাটা শুনতে পারতে।”
শব্দ লক্ষ্য করে আলো আছড়ে পড়ল।
মায়দেন!
সারা দেহে কোনও পোশাক নেই। উদ্ধত বুকে বাঁদিকের চামড়ার নিচে ধকধক করে জ্বলছে একটা সোনালি আগুনের পিণ্ড।
– জানো না, ব্যানশি কখন কাঁদে? মৃত্যু এলে মহামারি এলে সে কেঁদে কেঁদে সবাইকে জানান দেয় অগ্রিম। এতবার সে বলল তোমাকে ফিরে যেতে। কী যে করলে লোভী পুরুষ! তোমরা এমনই করো যুগে যুগে।
নীল চোখ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো আলোর কণা বেরিয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে জলের উপরিতলে। সেই আলোতে আর্থার দেখল অসংখ্য লোহার পাত্র ভেসে আসছে তারা দিকে। তাদের কোনোটিতে সোনার মুদ্রা, কোনোটিতে সোনার তলোয়ার, টিউনিক। শয়ে শয়ে সোনার পাত্র ভেসে আসছে। নীল, সোনালি রঙের ঠান্ডা আলোয় আর্থারের চোখের মণিও জ্বলজ্বল করে উঠল।
মায়দেন এগিয়ে এসেছে। দু-চোখে দুরন্ত তৃষ্ণা তার, অপার খিদে। জলতল গরম হয়ে উঠছে। আর্থারের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে সে উষ্ণতা। নির্বাক আর্থার শুধু শুনতে পাচ্ছে ফিসফিস কামঘন ডাক,
– সব সোনা তোমার, আর্থার। সব তোমার… আমিও তোমার। আমার কাছে এসো, এ প্রাচীন মৃত কূপে সৃষ্টি করো জীবন।
একটা ঠান্ডা সরীসৃপ আর্থারের কোমরে জড়িয়ে গেল। তাকে টেনে নিয়ে চলল মায়দেনের দিকে। মায়দেন ঠোঁট বাড়িয়ে ভেসে রইল জলের ঠিক ওপরটায়। মিশে গেল দুটো ঠোঁট, বুক। দুটো মোম মোম পা দিয়ে আর্থারের কোমর জড়িয়ে ধরল মায়দেন।
**
রোঁদ থেকে ফিরছিলেন শেরিফ জেরোম ও’কনর। ওয়েস্ট পোর্ট শহর তথা মায়ো কাউন্টির পশ্চিমে আটলান্টিক। স্যাঁতসেঁতে হাওয়া লেগেই থাকে সারা বছর। আজ একটু বেশি ঝোড়ো। এত ঝড়ের মধ্যেও একটা অসহ্য গরম। এমন তো হওয়ার কথা নয়।
শূন্য পথ। একটা ক্ষীণ কান্না কান্না হাওয়ার শব্দ দক্ষিণের বন থেকে ভেসে আসছে। শেরিফের এটাই শেষ রোঁদ। এরপর ভূমিকম্প কি সুনামি এলেও তিনি বেরোবেন না।
গাড়িটা সিরিয়াম অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন ও’কনর। পর্চ থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আগেই দক্ষিণ দিক থেকে ভয়ানক গর্জন ভেসে এল। কোমরের রিভলভারটা হাতে নিয়ে বাউন্ডারি ওয়াল পার হয়ে রাস্তায় এসে পড়লেন জেরোম।
অক্স পাহাড়ের চূড়ার ওপর একটা সোনালি আলো ঝলসে উঠল। আবার গর্জন। অনেকগুলো সিংহ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলে অমন শব্দ হয়। সোনালি আলোটা প্রচণ্ড বেগে উড়ে এল জনপদের দিকে। জেরোমের হাত থেকে রিভলভারটা পড়ে গেল প্রচণ্ড ভয়ে। আলোটা আছড়ে পড়ল চার্চের চূড়ায়। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ক্রসটা। প্রচণ্ড শব্দে দুলে উঠল বেইলফ্রি ঘণ্টা।
সোনালি আলোটা আবার উড়ে গেল অক্স পাহাড়ের চূড়ার দিকে। জেরোমের বুক চিরে বেরিয়ে এল আর্তনাদ,
“ও সেন্ট প্যাট্রিক… এগেইন!”
২
বছরে একবার বিদেশ ঘুরতে যান বন্দনা। একটি সরকারি স্কুলের চাকুরে হিসেবে বছরে মোটামুটি টানা লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। মিতব্যয়ী বন্দনার শখ দুটি। বই আর ভ্রমণ। পার্থক্য শুধু এটুকুই, লাইব্রেরি বা স্টাডিতে যে চশমা থাকে চোখে, বেড়াতে গেলে তা উঠে যায় মাথার উপর। হালে ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ পড়ে বন্দনা সম্পূর্ণ হকচকিয়ে গেছেন। একটা ছোট্ট একাঙ্ক নাটক এত শক্তিশালী হতে পারে তাঁর ধারণা ছিল না।
নাটকের পটভূমিকা অ্যারন দ্বীপপুঞ্জ। তিনটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। গলওয়ে উপসাগরের ঠিক মুখে অবস্থিত দ্বীপমালাটি আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। কাউন্টি গলওয়ে। নাটকের ঘটনা মর্মান্তিক হলেও এমনটা বিরল নয়। এক বিধবা মহিলার ছয় ছেলেকেই এক এক করে সমুদ্র কেড়ে নেয়। স্বামীও ওইভাবেই মারা গিয়েছিলেন। দুই মেয়ে নিয়ে দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও আলো জ্বালিয়ে যান তিনি।
নাটকটির সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হল এর স্থান নির্বাচন। উত্তাল আইরিশ উপসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের ঠিক সংযোগস্থলে অবস্থিত অ্যারন দ্বীপপুঞ্জ। একদিকে বিক্ষুব্ধ সাগর, অন্যদিকে কার্বনিফেরাস যুগে সৃষ্টি চুনাপাথরের অনুর্বর ভূমি। চাষ-আবাদ নেই বললেই চলে। দ্বীপবাসীর প্রধান জীবিকা মাছ ধরা। মাঝে মাঝে গলওয়ের বাজারে সবজি, মাংসও বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সে বছরে মাত্র দুবার।
রুক্ষতা বা বিপদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আদিম। সৃষ্টির আদি থেকেই বারবার বহ্নিআকৃষ্ট পতঙ্গের মতো সে উড়ে গেছে ভয়ানক বিপদ উপেক্ষা করে। ভয়ংকর সুন্দরের সামনে নত হয়েছে নতমস্তকে। তবুও ছুটে গেছে তার অমোঘ আকর্ষণে।
রবিবারের সকালের জলখাবারটা পার্থই তৈরি করেন। ফুলকো লুচি আর আলুর দমের ট্রে-টা সুদৃশ্য টি-টেবিলে রেখে পার্থ খেয়াল করলেন আয়ারল্যান্ডের ম্যাপটা। বন্দনার কম্পিউটারের স্ক্রিন জুড়ে জুম করা আছে গলওয়ে কাউন্টি আর অ্যারন দ্বীপপুঞ্জের অংশটা। মুচকি হেসে বললেন,
– বীরেন ভদ্র ছেড়ে বার্নার্ড শ নিয়ে পড়লে যে বড়ো?
বন্দনা এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে পার্থের কথা তিনি শুনতেই পেলেন না। পার্থ আর অপেক্ষা করলেন না। নিজের প্লেটে চারটে লুচি আর আলুর দম নিয়ে বসে পড়লেন। আলুর দমের মশালাদার সুগন্ধটা কাজ করল। বন্দনা চশমাটা মাথার ওপর তুলে দিয়ে পার্থের দিকে তাকালেন। ছদ্মরাগের ভ্রূকুটি করে বললেন, হায় রে প্রেম, বউ ফেলে লুচি নিয়ে পড়লে? বলি ডাকতে হয় না গা?
পার্থ একটা গোটা লুচিতে গাঢ় ঝোল মাখিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি এখন আটলান্টিক নিয়ে পড়েছ, গঙ্গাপাড়ের খাবার তোমার চোখে পড়বে কেন?
বন্দনা উঠে এলেন। তরল কথাবার্তা চালিয়ে গেলেও ভ্রূ কোঁচকানো। তাঁকে অন্যমনস্কভাবে লুচি আর আলুর দম হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে পার্থ বিরক্ত হলেন।
– দ্যাখো বাপু, ওইভাবে অচ্ছেদ্দা করে খেলে আমি কিন্তু জীবনেও কড়া খুন্তিতে হাত দেব না। সে তুমি যতই কুঁড়ে-টুঁড়ে বলো।
– টানছে গো, দ্বীপটা টানছে। এই এবার ওদিকটায় ঢুঁ মেরে আসি চলো। বেশ একটা ইয়েমতন ছ্যাঁকছেঁকে ভয় ভয় ভাব আছে কিন্তু।
– কিন্তু পিকু যে স্কটল্যান্ডের বায়না ধরেছে তার কী হবে? ব্যাগপাইপ দেখবে।
– সে আমি ম্যানেজ করে নেব। তুমি রঞ্জনদাকে ফোন করো। দশমীর পরদিনই বেরিয়ে পড়ব।
খাওয়াদাওয়া সেরে বন্দনা এঁটো ট্রে-টা নিয়ে চলে গেলেন। সিংকে বাসনগুলো রেখে ময়দার লেচিগুলো একটা ঝাঁঝরি দিয়ে ঢেকে রাখলেন। আধখাপচা কাজ করা পার্থর অভ্যাস। পিকু এলে গরম গরম ভেজে দেবেন বন্দনা নিজেই। তিনি জানেন লোকটা এখন আয়ারল্যান্ড নিয়ে বসবে। পাক্কা দু-তিন ঘণ্টার ব্যাপার। ফেলুদার মানসশিষ্য বলে কথা। কোথাও যাওয়ার আগে সে জায়গা নিয়ে রাতদিন পড়াশোনা করে নেওয়া নাকি খুব সুবিধাজনক। সে বন্দনা নিজেও জানেন। তা বলে ছুতোর, মুচি, চারণ, কর্পোরেট, ক্যাবওয়ালার ঠিকানা কপি করে নেন না তিনি। এত নিখুঁতভাবে ভ্রমণ হয় নাকি? নতুন জায়গার প্রথম থ্রিলগুলোই হাতছাড়া হয়ে যায়।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বড়ো রাস্তার একটা অংশ দেখা যায়। নীল হলুদ বাস। রবিবারের সকালে গাড়ির সংখ্যা বেশ কম। শান্ত নিশ্চিত যাপনের কলকাতা। এখানে বসে অ্যারন দ্বীপের কথা ভাবার চেষ্টা করলেন বন্দনা। বিস্তীর্ণ বিরলতৃণ পাথুরে জমি। আটলান্টিকের প্রচণ্ড গর্জন। অসহায় বিধবার কান্না। সকালের রোদে ঘোর লেগে গেল। জানালার সামনের শিউলি গাছটা ঝাপসা হয়ে এল। ঝিমঝিম চোখ।
ডোরবেলের কর্কশ শব্দে বাস্তবে ফিরে এলেন বন্দনা। পিকু এসেছে। গ্যাস ওভেনের নীল আলোটা দপ করে জ্বলে উঠে ছড়িয়ে গেল বার্নারে। শুনতে পেলেন পিকু চিৎকার করছে,
– নাআআআআ, স্কটল্যান্ড। ড্যাফোডিল… ব্যাগপাইপ.
.
পার্থ বোঝাচ্ছেন,
– ড্যাফোডিল ওখানেও আছে চল দেখবি। সাগর, কাসল্, চার্চ… ব্যানশি।
বন্দনার বুকটা ধক্ করে উঠল। লোকটা ব্যানশির নাম বলছে কেন পিকুকে? ভাজা চারটে লুচি নিয়ে বন্দনা ডাইনিং রুমে এলেন। পিকুকে ডাকলেন,
– পিকু, খেতে আয়।
মাকে ভয় পায় পিকু। ভয়ও ঠিক না। বন্দনা লক্ষ করে অবাক হন। ছেলেটা বাপের কথা যখনতখন হেলাফেলা করলেও, তাঁর কথা কখনও অমান্য করে না। ঘামে ভেজা গেঞ্জি নিয়েই বসতে যাচ্ছিল পিকু। বন্দনা স্বাভাবিক গলায় বললেন,
– জিম থেকে এলি, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়।
পিকু উঠে গেল বিনা বাক্যব্যয়ে।
.
ব্যানশি… ব্যানশি। বন্দনার বুকটা আবার কেঁপে উঠল। সেলটিক অতিপ্রাকৃত জীব। প্রেতিনীও বলা চলে। বিভূতিভূষণের রঙ্কিনী দেবীর সঙ্গে মিল আছে অনেকটা। মৃত্যুর খবর আগাম জানান দিয়ে যায়। কেঁদে কেঁদে আগামী মৃতের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। পার্থটার জীবনে বোধবুদ্ধি হবে না।
লুচির একটা টুকরো ছিঁড়ে মুখে দিল পিকু।
– মা, আমরা স্কটল্যান্ড যাচ্ছি না?
– আরে ঋদ্ধসত্ত্ব বাবু, পরের বার যাব। এবার আয়ারল্যান্ড চলো।
পিকু আর কিছু বলল না।
অদ্ভুত ছেলে একটা, বন্দনা ভাবলেন, মায়ের কাছে বায়না বলেও কি ওর কিছু নেই? আমি কি ওর মা না মালিক?
মনটা কেমন একটা অদ্ভুতরকম অনুভূতিতে ভরে গেল বন্দনা সরকারের। বারবার ঘুরেফিরে ব্যানশি নামটা মনের আনাচেকানাচে উঁকি দিতে লাগল।
**
লন্ডভন্ড অবস্থা। দক্ষিণের একটা জানালা খোলা পেয়ে কালবৈশাখীর একটা শাখা ঢুকে পড়েছিল। স্কুলে পুজোর ছুটি হয়ে গেল আজ। ছ-তলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন বন্দনা। এটা ওঁর অভ্যাস। নামার সময় লিফটে নামলেও, ওঠার সময় সিঁড়িই বেছে নেন।
ঘরের এমন অবস্থা দেখে মনটা খিঁচড়ে গেল বন্দনার। পার্থটা কাজপাগল। ছেলেটাও হয়তো ঘরের কোনও একটা জানালায় বসে হাঁ করে আকাশ দেখছে। পশ্চিমের জানালায় গিয়ে দাঁড়াতেই নিচের পর্চে দাঁড়ানো লোকটা নজরে এল। লম্বা, দোহারা গড়ন। ন্যাড়া মাথা। সাদা ধুতির ওপরে আর-একটা সাদা কাপড় দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা। সারা দেহে অজস্র উল্কি। লোকটা হাত নেড়ে ডাকল। কাকে কী জানি!
বন্দনা জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে লক্ষ করলেন লোকটার হাতে চিড়েতনের মতো দেখতে সাদা কাগজ। থমকে গেলেন তিনি। ওই চিড়েতন স্যামরকও বটে। আয়ারল্যান্ডের প্রতীক। একইসঙ্গে ওটি সেন্ট প্যাট্রিকের চিহ্ন, যা দিয়ে সাধারণ মনুষ্যজীবনে ঈশ্বরের উপস্থিতি বোঝানো হয়। বন্দনার একটা খটকা লাগল।
আয়ারল্যান্ড যাত্রার প্রাক্কালে এমন সমাপতন!
লোকটা দাঁড়িয়েই আছে। ভাসা ভাসা চোখ। একটা মুচকি হাসিও কি ঠোঁটে? পার্থের স্টাডির পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে ফিরে যাওয়ার সময় পার্থ কিছু একটা বলল, বন্দনা দাঁড়ালেন না। অনেকটা যেন ঘোরের মধ্যে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন লিফটের দরজা ভুলে। তা ছাড়া লোডশেডিং চলছে। হাউসিংটা লোডশেডিংয়ে মাঝে মাঝে ভোগে। জেনারেটর হয়তো দিয়ে দেবে এখনই। গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সিঁড়ির অংশটায় আলো আসার উপায় নেই। গুনে গুনে নামতে লাগলেন বন্দনা। তাঁর মুখস্থ। ছ-তলায় ছিয়ানব্বইটা সিঁড়ি। গুনে গুনে ওঠেন তিনি। কসরতের সঙ্গে সঙ্গে সময়টাও কেটে যায়। অন্ধকারে পা গুনে গুনে নামতে নামতেও বন্দনা গুনতে লাগলেন।
এক, দুই, তিন, চার… তেরো নম্বর সিঁড়ির পর পাঁচতলার ল্যান্ডিং। আরে, সব এত অন্ধকার কেন? আর একটা বিচ্ছিরি গরম চেপে বসে আছে চারিদিকে। আবার সিঁড়ি। এক, দুই, তিন, চার.. তেরো নম্বরে চারতলা। উফ্, এ তো সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো গরম। দমবন্ধ হয়ে আসছে অভাবনীয় উষ্ণতায়।
সামনেই খোলা দরজার বাইরে একতলার পর্চ। একগাদা গম্ভীর মুখের বাচ্চা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ন্যাড়ামাথা লোকটার সাদা পোশাকের একপ্রান্ত উড়ছে। হাতে ধরা চিরিতনটা একবার ঝলসে উঠল যেন। বন্দনা দরদর করে ঘামতে ঘামতে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। সম্পূর্ণ আকাশ ছেয়ে ফেলেছে ঘন কালো মেঘ। গাঢ় কালচে গাছের পিছনের পটভূমিকায় কালো মেঘ যেন মিশে গেছে গাছের গায়ে। বন্দনা লোকটার কাছে পৌঁছোতেই, তার চোখ দুটো ঝলসে উঠল যেন। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বন্দনা বললেন,
– আমাকে ডাকছিলেন?
লোকটা নিরুত্তর। ঘন কালো চোখে বন্দনার অন্তর্দেশ পর্যন্ত দেখে নিচ্ছিল সে। বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন,
– ডেকেছিলেন কেন?
লোকটার চোখ দুটো আবার ঝলসে উঠল। কড়কড় একটা বাজ পড়ার শব্দ হল খুব কাছে কোথাও। বন্দনা ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন। কয়েক মুহূর্ত পরে চোখ খুলতে বাধ্য হলেন হাতের তালুতে তীব্র জ্বালা নিয়ে। দেখলেন অন্যমনস্ক অবস্থার সুযোগ নিয়ে লোকটা কখন যেন ধাতব চিড়েতনটা ধরিয়ে দিয়েছে, আর তারই ছোঁয়ায় তাঁর বাঁ হাতের তালুতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পর্চের বাচ্চাগুলো তাঁর দিকে একসুরে তীব্র কণ্ঠে ‘মাআআআআ’ চিৎকার করে উঠেছে। পুতুলের মতো তারা বন্দনার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
আতঙ্কগ্রস্ত বন্দনা দেখলেন প্রতিটি শিশুর চোখের মণি অসম্পূর্ণ। ন্যাড়ামাথা লোকটাও আশেপাশে কোত্থাও নেই। ভয় পেলেন বন্দনা। লিফটের দিকে ছুটতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলেন, দুটি বাচ্চা তাঁর পা চেপে ধরে “মা মা” করে চলেছে কল দেওয়া পুতুলের মতো।
এক ঝটকায় পা ছাড়িয়েই তাঁর খেয়াল হল জানালার পাশে একটা বেতের চেয়ারে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অদ্ভুত স্বপ্নটা মাথায় আসতেই একটা মৃদু হাসি খেলে গেল বন্দনার ঠোঁটে। তেরো তেরো ছাব্বিশটা সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করার মতো সুখ তো আর তাঁর কপালে নেই। আর বাচ্চাগুলো কী ভয়ানক। লোকটার কথা মনে পড়তেই বন্দনা আবার জানালার কাছে গেলেন, তখন আর কেউই নেই।
– মা, আলো জ্বালাওনি কেন? সেই কখন তো জেনারেটর ব্যাক আপ চালিয়েছে।
– আয়, একটু বোস, কথা বলি।
আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে পিকু বসল বটে, কিন্তু উশখুশ করতে লাগল কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই। বন্দনা বুঝলেন ছেলেটার বসার ইচ্ছে নেই, শুধু মায়ের মন রাখার জন্য সে বসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– যা, ঘরে যা।
পিকু লাফিয়ে উঠে এক বান্ডিল তাস মেলে ধরল,
– মা, যে-কোনো একটা তাস বেছে নাও।
– কেন রে, কী হবে?
– আমার অনলাইন সব ব্যবসার একটা লোগো বানাচ্ছি। তুমি যেটা বাছবে সেইটাই হবে ওই লোগো। চোখ বুজে টানবে কিন্তু।
ব্যাপারটা বেশ মজাদার মনে হল বন্দনার। চোখ বুজে একটা তাস টেনে নিয়ে চোখের সামনে নিয়েই চমকে উঠলেন।
স্যামরক। চিড়েতনের বিবি!
ঋদ্ধসত্ত্ব চিড়েতনের কালো বিবিটার দিকে কিছুক্ষণ থম ধরে তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নিচু করে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
বন্দনা কিছুক্ষণ বসে পার্থের ঘরের দিকে গেলেন। কেনাকাটার লিস্টটা বেশ লম্বা।
৩
দক্ষিণে লিফি নদী দেখা যায়। পিকু সেদিকেই চেয়ে আছে নিষ্পলক। অ্যাবে কোর্ট হস্টেল ২৯, ব্যাচেলর্স স্ট্রিটের সবচেয়ে বড়ো অ্যাকোমোডেশন। তুখোড় গ্লাস ইন্টিরিয়র। জাত মিউজিক সিস্টেমে কেনিজি বেজে চলেছে। পার্থর এটা তিন নম্বর অ্যাপল কেক। বন্দনা তিনবার এমব্যাসিতে ফোন করে বিরক্ত হয়ে রেখে দিয়েছেন।
স্বামী লোকটার নির্লিপ্ত ভাব দেখে বন্দনা বিরক্ত হতেও বিরক্ত হচ্ছেন এখন। কোথায় ডাবলিন বে-র স্বপ্নালু রিসর্ট আর কোথায় এই ভিড়ভাট্টার আধখাপচা আইরিশ ইংলিশ পল্লি। নিশ্চয়ই বুকিংয়ের সময় লোকটা কিছু গণ্ডগোল করেছে। যদিও আইরিশ ট্র্যাভেল এজেন্সি বারবার ক্ষমা চেয়ে আশি শতাংশ খরচ বহন করছে, তবুও বন্দনা এই কিলোমিটার কিলোমিটার দূরত্বের বঞ্চনা মাফ করতে পারছিলেন না। তার ওপর কোর্ট হস্টেলের লবি করিডর লোকে গিজগিজ করছে যেন। গুচ্ছের স্যুট টাই পরিহিত গুঁফো, দেড়েল, শুঁটকো, মোটা লোক ভারী ভারী জুতো মসমস করে এমন গম্ভীর মুখে সবসময় চলাফেরা করছে, যেন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে আর যাবতীয় দায়িত্ব এখানকার বোর্ডারদের ঘাড়েই বর্তেছে। ডেকোরেশন যতই আহামরি হোক না কেন, বাইরের গুজগুজ ফিসফিস ঘরের ভেতরেও অনবরত ভেসে বেড়াচ্ছে।
.
একসময় অতিষ্ঠ হয়ে ছেলে বরকে ঘরে রেখে রিসেপশনে হাজির হলেন বন্দনা। চোস্ত ইংরেজিতে আইরিশ রিসেপশনিস্টকে বললেন,
– আই খ্যনট ঠলারেট ইওর ফিশমঙ্গার্স এনিমোর। প্রভাইড মি আ বেঠার অ্যকমডেশন।
সোনালিচুলোর চোখ কপালে উঠে গেল। অত্যন্ত পালিশ করা ভদ্রতায় সে বলল,
– পার্ডন।
ঝাড়া একঘণ্টা বাগবিতণ্ডার পর বন্দনা বুঝলেন মায়ো কাউন্টির দিকে কোথাও বিরাট স্বর্ণখনির হদিশ মিলেছে এবং গুচ্ছের আইরিশ, ইংলিশ আর জার্মান জিওলজিস্টের দল অ্যাবে কোর্ট হোস্টেলে।
বন্দনার মনে একটা চাপা আনন্দ খেলে গেল। একটা চোরা হাসি। রিসেপশনিস্টের চোখ থেকে উদ্বেলিত আনন্দ গোপন রেখে, একটু কড়া গলায় বললেন,
– সোনাখুঁড়োদের জন্য আমাদের প্রাইভেসি হ্যাম্পার করা কি এজেন্সির উচিত হচ্ছে? আমরা এখনই চেক আউট করব।
হাঁ হাঁ করে উঠল অল্পবয়সি ছেলেটি। কলকাতা হলে এ অবস্থায় খদ্দেরলক্ষ্মীর হাতে পায়ে ধরাই দস্তুর। খাঁটি আইরিশ ভদ্রতা আর মার্জিত দক্ষতায় কতটা চিঁড়ে ভিজল বেচারা নিজেও বুঝল না, ম্যাডামজি যেন খুব তাড়াতাড়িই গলে গেলেন, এবং ভুবনমোহিনী একটি হাসি হেসে বললেন, “দ্যেন, অর্গানাইজ আস আ ফ্রি ঠ্রিপ ঠ্যু মায়ো।”
তড়িঘড়ি একটি নম্বর ডায়াল করল ছেলেটি। বোধহয় পার্সোনাল নম্বরই। নইলে ব্যক্তিগত সেলফোন ব্যবহার করত না। মিনিট পাঁচেক ধরে বাঙালি গেঁয়ো ছোঁড়ার মতো সেও ‘ইয়েস নো ভেরি গুড’ করে চলল অনবরত। তারপর ফোনটা পকেটে পুরে হাসিমুখে বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ইটস্ কনফার্মড ম্যাম। বাট..
.
বন্দনা চলে আসছিলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন,
– বাট?
– ইটস ডেঞ্জারাস, মে বি.
.
বন্দনা চশমাটা কপালে তুলে কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখে ছেলেটিকে দেখলেন। তারপর খিলখিল করে সজোরে হেসে বললেন, “দূর্ বোকা।”
**
বুসারাস বাস স্টেশনে বাসের ঠিক জানালার পাশেই জাঁকিয়ে বসেছেন বন্দনা। পার্থ এখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেননি ভ্রমণের লক্ষ্য পরিবর্তনের। পিকু নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে বাবা-মায়ের মাঝখানে। ল্যাপটপ খোলা তার কোলে। অনবরত টাইপ করে যাচ্ছে। হেডটপে ঘুরছে চিড়েতনের বিবি। সাড়ে চার ঘণ্টা পর বাস ব্যালিনায় পৌঁছোলে বাস বদলের জন্য সবাই নামল। জিওলজিক্যাল সার্ভের বোদ্ধাগুলোও নেমে এসেছে। মিনিট ত্রিশেক লাগবে এখান থেকে মায়োর রস ওয়েস্ট, ক্লাইদ্যাঘ ব্রিজ পৌঁছোতে।
রস ওয়েস্টের বাসে উঠে পিকু বন্দনাকে বলল,
– মা, ধনতেরাসে ইনভেস্ট করলাম।
– সে কী রে! কত?
– পাঁচ হাজার মতো।
বন্দনার পছন্দ নয় এগুলো। তবে ছেলের ট্যুশনের নিজস্ব টাকা। কিছু বললেন না। পার্থ চশমার উপর দিয়ে বললেন, “দুটোই জুয়োখোর।”
.
গাইড-কাম-কনডাক্টরগুলো এ দেশে বেশ বোলচালের হয়। জিওলজিক্যাল সার্ভের বাস বলেই হয়তো এ বাসের ওই লোকটি গম্ভীর আর চুপচাপ। পাদরিদের মতো পোশাকে আগাপাশতলা মোড়া। শুধু মাথার হুডটা খোলা। ঘাড়ে আর ডানদিকের গলায় উল্কি। শক্ত ঘাড়ের পাশে দড়া পাকানো শিরার কারিকুরি। বন্দনার কিছু মনে পড়ছিল। মিনিট কুড়ি পর রাস্তার দুপাশে মনোরম ওকগাছের বনভূমি দেখা যেতে লাগল। বন্দনা সেদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন।
খুব সম্ভবত এই সেই ব্র্যাকলুন বনভূমির একটা অংশ। এর বনের মধ্যেই কোনও একটি শৃঙ্গের নাম অক্স মাউন্টেন এবং তার নিচে বিশাল স্বর্ণখনির অস্তিত্ব সম্ভবত খুঁজে পেয়েছেন ভূতত্ত্ববিদরা।
.
ছোট্ট শহর ওয়েস্ট পোর্ট। রস ওয়েস্ট বাস স্টপেজ থেকে শুরু হয়ে আয়ারল্যান্ডের পশ্চিমি আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত ছুটে গেছে। আটলান্টিক এখানে দেশের ভিতরে ঢুকে এসেছে। ক্যারোবেগ নদী শহরের মধ্য দিয়ে ছুটে গেছে পোস্টকার্ডের ছবির মতো। গ্রেগরিয়ান যুগের পাথরের সেতু। ষোড়শ শতাব্দীর দুর্গ। একিল আইল্যান্ড পর্যন্ত প্রস্তরনির্মিত হাঁটাপথ।
সব মিলিয়ে আধুনিক ইয়োরোপের বুকে এক টুকরো মধ্যযুগ জেগে আছে। জিওলজিক্যাল সার্ভের লোকগুলো বোঁ বোঁ করে ভাড়ার গাড়ি চেপে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। একগাদা হতভম্ব লটবহরের ওপর বসে পার্থ চিনেবাদাম চিবুতে লাগলেন পড়ন্ত বিকেলে। পিকু পটাপট ছবি তুলছে। বাপব্যাটার নির্লিপ্ত ভাব দেখে বন্দনা চশমাটা কপালে তুলে স্টপেজ থেকে বেরিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে হাঁটলেন।
খোলামেলা পরিষ্কার শহর। যানজটের বালাই নেই। ধুলোধোঁয়া নেই। সমুদ্রের নোনা বাতাস মুখে ঝাপটা মারছে। হঠাৎই চার রাস্তার মোড়ের গির্জার চূড়ার দিকে চোখ গেল বন্দনার। কখন যেন পার্থ আর পিকু পিছন পিছন এসে দাঁড়িয়েছে। বন্দনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তারা গির্জার চূড়ার দিকে তাকাল।
ক্রস এবং গির্জার স্পায়ার অংশটি ভেঙে পড়েছে। ল্যান্টার্ন অংশের মাত্র দুটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর গির্জাটি এক বীভৎস ভগ্নস্তূপের রূপ নিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো ভয়ের ব্যাপার হল গির্জার সারা দেহে অজস্র কালো পোড়া ছোপ। যেন কোনও বিরাট উল্কাপিণ্ড সজোরে আছড়ে পড়েছিল শান্ত দেবালয়ে।
গির্জার ল্যান্টার্ন অংশের অবশিষ্ট স্তম্ভের ওপর পশ্চিম থেকে রোদ পড়েছে আর তার ছায়া পড়েছে গির্জার সমাধিস্থলের সবুজ ঘাসে। বন্দনার দৃষ্টি হঠাৎ ঘুরে গেল সেদিকে।
শিউরে উঠলেন তিনি। বাসের অদ্ভুত সেই কন্ডাক্টরের এখন হুড তোলা মুখের ওপর। হাতে অদ্ভুত একটা গাছের ডাল। তার গায়ে লেগে থাকা তিনটি সবুজ পাতা এত দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
স্বপ্নে আঘাত পাওয়া হাতের অংশটিতে পোড়া ঘায়ের ব্যথা করে উঠল বন্দনার। তাঁর মনে হল তাঁর হাতের তালুর সে অংশটিতেও তিনটি পাতা ঝলমল করে উঠল সবুজ আগুনে।
স্যামরক!
.
চোখ তুলে দেখলেন পাদরি কনডাক্টর উধাও। ব্র্যাকলুন বনভূমির ওপর একটা ছায়া ঘনিয়ে আসছে দ্রুত।
জনবিরল পথের সামান্য শব্দ ছাপিয়ে মাদি কুকুরের কান্নার মতো একটা ককিয়ে ওঠা ডাক শুনতে পেলেন বন্দনা। ঝটিতে কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। পার্থ ছুটে এসে তাঁকে ধরলেন। একটু সময় নিলেন ধাতস্থ হতে।
একটা ছোটোখাটো সরাইখানা সামনেই। পিকু আগে আগে হাঁটছে। তার পিছনে মালপত্র নিয়ে পার্থ। বন্দনা খুব ধীরে হাঁটছেন।
গির্জার পিছনের একটা অংশ এখনও দৃশ্যমান। একটামাত্র চেস্টনাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে অনাগত সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার প্রতিফলন মেখে। গোড়ার দিকটা প্রায় পুরোটাই অন্ধকার। উপরের ডালপালায় কিছুটা আলো তখনও রয়ে গেছে। আর সেই আবছা আলো থেকে একটা অদ্ভুত কুকুর টিকটিকির মতো গাছ বেয়ে অন্ধকারের দিকে নেমে আসছে। চোখের দৃষ্টি বন্দনাকেই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে চাইছে। গুঁড়ি বেয়ে একদম নিচে নেমে একটি সুতীব্র কান্নার সুর ছেড়ে ডেকে উঠল জন্তুটা।
তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পার্থের পিঠটা হাতের মুঠোয় ধরতে গিয়েও হারিয়ে ফেললেন বন্দনা। সজোরে আছড়ে পড়লেন সরাইখানার দরজায়। কপালটা সজোরে ঠুকে গেল দরজার পাশে ঝোলানো লোহার ক্রুশচিহ্নে।
পিকু আর পার্থ সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল।
৪
ও’কনর এক গ্লাস জল খেলেন ঢকঢক করে। তারপর আর-এক গ্লাস। আরও এক গ্লাস খেতে গিয়ে বিষম খেলেন। অস্থিরভাবে হাত পা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে টেবিলের ফাইল, পেপারওয়েট উলটে দিলেন একবার। হাত কাঁপছে প্রবলভাবে। কিছুতেই স্থির রাখতে পারছেন না নিজেকে। সামনের স্ক্রিনে চলছে মাউন্ট অক্সে জিওলজিক্যাল সার্ভেয়ারদের দু-দিন আগের ভয়ংকর অবস্থার ভিডিয়ো সম্প্রচার।
অফিসের দরজা দিয়ে দুজন প্রবেশ করল। একজন পুরুষ। মধ্যযুগীয় পাদরির সাদা পোশাক। মাথার ওপর সাদা হুড টানা। দ্বিতীয়জন মহিলা। মাথার বাঁপাশে স্টিচের চিহ্ন। একপেশে কাচের দরজা খুলে তারা ও’কনরের কেবিনেই এল। ততক্ষণে শেরিফ নিজের চেয়ারে ফিরে গেছেন, এবং সামনের টিভিটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
পুরুষটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। হাতে একটি অদ্ভুতদর্শন গাছের লম্বা ডাল আর তার একদম মাথায় তিনটি সবুজ পাতা। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে অত্যন্ত মার্জিত গলায় বললেন,
– মাইদিন মহাইথ শেরিফ।
উত্তরে প্রতি সুপ্রভাত জানানোর অবস্থায় ছিলেন না শেরিফ ও’কনর। শুকনো মুখে সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা চেয়ারে বসে ভাঙা গলায় বললেন,
– বি আ ইন গ্রেভ ডেইঞ্জা শেরিফ। আমাদের বাঁচাও।
ও’কনর এক লহমায় ইন্ডিয়ান মহিলাকে চিনতে পারলেন। বন্দনা সরকার। গত পরশু গভীর রাতে তাঁরই ছেলে আশ্চর্যভাবে উধাও হয়ে গেছে গলওয়ের একটা হসপিটাল থেকে। ভদ্রমহিলা চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে গত রাত্রে স্বামীর সঙ্গে শেরিফ অফিসে আসতে পারেননি। তা ছাড়া গলওয়ে শেরিফ মরগ্যানও তাঁকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছেন। বর্তমান বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর আয়ারল্যান্ডে বিপদে পড়া আয়ারল্যান্ডের পক্ষে খুব একটা সুখের নয়। গলওয়ের সঙ্গের লোকটির দিকে একটি সন্দিহান দৃষ্টি ছুড়ে তিনি বললেন,
– বন্দনা, তুমি শান্ত হও। মায়ো পোলিস তদন্ত শুরু করেছে। তুমি এ অসুস্থ শরীরে এতদূর না এলেও পারতে। সবচেয়ে বড়ো কথা তোমার ছেলের অন্তর্ধানের সময় তুমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলে আর সে বিষয়ে তোমার কোনও ধারণা নেই..
.
– আমি সব জানি। শুধু তোমরা আমায় সঙ্গ দাও।
– হোয়াঠ্!
– হ্যাঁ, মানছি আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো ওই লোকটির দৌলতে আমি সব জানতে পেরেছি।
– আচ্ছা! এই ব্যাপার? তা ওই লোকটি নিজে কেন কিছু বলছে না? অদ্ভুত গেঁয়ো পোশাক, সেই মধ্যযুগের মতো। ও নিজেই তোমার ছেলেকে সরিয়ে সাধু সাজতে আসেনি তো?
পাদরির মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। বন্দনা স্বপ্নাহত ডান হাতটি দিয়ে ও’কনরের ডান হাতটি ধরলেন আর তখনই পাদরি এগিয়ে এসে বন্দনার মাথার দুপাশের দুটি রগ চেপে ধরল দুটি বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে। তারপর গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করল,
“ইয়ত ইয়ত নিশ্চরতি মনশ্চঞ্চলমাস্থিরমহঃ।
ততস্তত নিয়াম্যৈতাদাত্মম্যেভ বশম নয়েথ।”
ও’কনরের দেহের সব বোধ যেন একরোখা স্রোতে স্নায়ু বেয়ে ছুটে গেল চোখের দিকে। এক আশ্চর্য আকস্মিক ক্লান্তিতে তাঁর চোখ দুটি বুজে এল আর মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল এক অন্ধকার গিরিগুহা। অন্ধকার থিয়েটারে বসে নাট্যাভিনয় দেখার মতো তিনি দেখতে পেলেন সব কিছু।
চকচক করছে এক আশ্চর্য জলাশয়। তার জল নীলচে সোনালি। টুপটাপ করে অসংখ্য সোনার মুদ্রা ঝরে পড়ছে জলে। তার আদি নেই অন্ত নেই। ঝরে পড়ছে তো পড়ছে। অন্তহীন সম্পদের আলোয় ঝলমল করছে ভূগর্ভস্থ জলাশয়। হঠাৎ গুহার মুখের কাছে বিরাট কিছু আছড়ে পড়ার মতো শব্দ হল। একটা বিস্ফোরণের শব্দ আর চতুর্দিকে ছিটকে পড়ল অজস্র সোনালি আগুনের টুকরো। জল থেকে একটা শব্দ উঠল। ছপছপ শব্দ করে কেউ নামল জলে। বিরাট বিরাট পায়ের চাপে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ল জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ। অন্ধকার গুহার গর্ভে যে উজ্জ্বল আলো ছিল, তাতে দেখা গেল বিরাটদেহী এক পুরুষকে। পরণে সাধারণ আইরিশ চাষির পোশাক, কিন্তু তার বুকে সাজানো ঝলমলে সোনার বর্ম। খুব ক্লান্ত হয়ে সে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। বুক চিরে একটা কান্না বেরিয়ে এল তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,
– মা, আর কত, মা? কেন ওদের মারতে হচ্ছে আমাকে? আমার তো রক্ত একদম ভালো লাগে না মা।
জলে খুব নরম একটা আন্দোলন দেখা গেল। দেওয়ালে দেওয়ালে ভেসে বেড়াতে লাগল খুব নরম একটা সুর। খুব নরম একটা হাসির শব্দ।
– ম্যাকআর্থার, তুমি জানো না, এ সমস্ত সম্পদ তোমার পিতার?
দানব বলল,
– হ্যাঁ মা, আমি জানি। তাই তো প্রাণ দিয়ে রক্ষা করি ওই লোভী মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু মা, আমি তোমার মতো শক্ত নই, আমি পিতার মতো নরম। রক্ত দেখলে ভয় পাই। রক্তের গন্ধে আমার কষ্ট হয়। আর এত রক্ত! এত এত ছেঁড়া মাথা… আমার একটুও ভালো লাগে না মা। আমাকে একটু ঘুমোতে দাও। আমাকে দরজার ওপারে তোমার কোলে ঘুমোতে দাও। দাও না মা গো।
যে মৃদু হাসিটা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেটা একটু একটু করে জমাট বাঁধতে শুরু করল যেন। দেওয়ালে দেওয়ালে তার প্রতিফলন আর অনুরণিত তরঙ্গ একীভূত হয়ে ক্রমশ এক তীব্র শব্দপুঞ্জের সৃষ্টি হতে লাগল। স্বর্ণবর্ম পরা দানবের দেহটি কুঁকড়ে যেতে লাগল সে শব্দের অভিঘাতে। তার কোমরবন্ধনী থেকে ছিটকে পড়ল অজস্র ছিন্ন নরমুণ্ড। সদ্যই ছিঁড়ে আনা হয়েছে তাদের।
ও’কনর শিউরে উঠলেন। জিওলজিক্যাল সার্ভেয়ারদের ছিন্নমস্তক দেহগুলির কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। প্রবল আতঙ্কে তাঁর দমবন্ধ হয়ে এল। কিন্তু গলা দিয়ে একটা আতঙ্কের চিৎকার অবধি বেরিয়ে এল না।
তাঁর চোখের সামনে ঘটতে থাকা অলৌকিক চলচ্চিত্রের গভীর নীল জলের এক দিকে থেকে ছুটে এল বিরাট এক অগ্নিময় হাত। তার আকার এতটাই বড়ো যে, স্বর্ণবর্ম দানবের দেহ তার তালুর বেষ্টনীতে ধরা পড়ে গেল। ঠেলে বেরিয়ে এল তার দুই চোখ। ঝলমল করতে লাগল বিস্ফারিত দুই মণির বুকে অজস্র স্বর্ণবস্তুর চমক।
সম্পূর্ণ নগ্ন যুবতি একটি মেয়ে জলের ওপর ভেসে উঠল। মুখে ভুবনমোহিনী হাসি। তার দেহ থেকে বেরিয়ে আসা বিরাট অগ্নিময় ডান হাতটি দিয়ে সে ম্যাকআর্থারকে শূন্যে তুলে ধরল। দানবের দেহ কুঁকড়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে লালারক্তের পরিবর্তে গড়িয়ে পড়তে লাগল গলিত সোনা। গান গাওয়ার মতো নরম গলায় মেয়েটি বলল,
– তুমি তোমার পিতার মতোই দুর্বলচিত্ত ম্যাকআর্থার। আর আমি নির্বোধ তোমাকে কিনা পৃথিবীর রাজা করব ভেবেছিলাম। তোমার মতো সন্তান আমার ব্যথা বুঝবে না পুত্র। তুমি, তুমি নিশ্চিহ্ন হও। আমার পরবর্তী পুত্র আমার অতীত অপমানের, অতীত পরাজয়ের জবাব দেবে। তুমি ঘুমোতে যাও বাছা। আমি তোমাকে পরম ঘুম দিলাম।
নরম মুখটি খুলে গেল। তুলি আঁকা ঠোঁট দুটি ফাঁক হল। মুখের গভীর থেকে একজোড়া বিশাল সরীসৃপের মতো আগুন জিভ বেরিয়ে এসে বেষ্টন করল হতভাগ্য দানবের দেহ। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। মায়ময় দুটি কালো চোখে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে এল। জল গড়িয়ে এল দানবের চোখেও।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র।
পরমুহূর্তেই সরীসৃপ জোড়া জিভের এক প্রবল টানে হতভাগ্য ম্যাকআর্থারের দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটির মুখের মধ্যে। আর এক তীব্র ভয়ংকর গর্জনমিশ্রিত কান্নায় চতুর্দিক পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লেন ও’কনর। বন্দনাও হয়তো পড়তেন। কিন্তু তাঁর মাথা অদ্ভুত পাদরির হাতে থাকায়, প্রচণ্ড এক তরঙ্গবিক্ষেপ অনুভব করা সত্ত্বেও তিনি অনড় রইলেন।
পাদরির হাতে ধরে রাখা গাছের ডালের পাতাগুলো ঝলমল করে উঠল। বন্দনা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
– রাক্ষসী শেষ কথাটা কী বলল?
ও’কনর মন্ত্রমুগ্ধ সুরে বললেন,
– ঋদ্ধসত্ত্ব, হে প্রাণনাথ, তুমি আমার অতুল ভাণ্ডারে এসো।
পাদরি কেঁপে উঠলেন।
**
বঁ সিকিওরস গলওয়ে হসপিটাল আটলান্টিকের একদম পাশেই। যানবাহনের শব্দ বা দূষণ থেকে বেশ দূরে বলেই দু-দিন আগে আশি কিলোমিটার দূরে পার্থ এখানেই নিয়ে এসেছিলেন বন্দনাকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরপর। এদের সিস্টেম খুব ভালো আর নার্ভাস ডিপার্টমেন্ট উচ্চমানের। রোগীর সঙ্গে যারা থাকে তাদের একজনের থাকার ব্যবস্থাও আছে। শুধু ভিজিটিং আওয়ার্স অন্যদের মতোই মেনে চলতে হয়। উত্তরে করিব নদীর নীল জল বয়ে করিব হ্রদ থেকে আটলান্টিকে পড়েছে, যেখানে একটা সাদা মিনার। তাকে ঘিরে সিগালের ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে।
পিকু একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আনমনা নদীতীর, সমুদ্র তীর বিকেলের রঙে একটু লালচে বিষণ্ন লাগছে। মায়ের জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে। পরশু বিকেলে পড়ে যাওয়ার পর থেকে একবার মাত্র জ্ঞান ফিরেছিল। একবার ‘ব্যানশি, পিকু, ব্যানশি। আমার কাছ থেকে কোত্থাও যাবি না’, বলেই আবার ঝিমিয়ে পড়েছিল। তারপর সেই বিকেলের গির্জার পাদরি। কী অদ্ভুত দেখতে! বাদামি চোখ। ইংরেজি হরর মুভির প্রিস্টদের মতো মধ্যযুগীয় ইয়োরোপীয় পোশাক। হাতে গাছের ডাল।
সাদা পাখিগুলোর মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ করল পিকু। ওগুলো আগের মতোই উড়ছে বটে, কিন্তু কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে, একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, পালিয়ে যেতে চাইছে সমুদ্রের দিকে, কিন্তু আবার কীসের যেন টানে নদী আর সমুদ্রের সংগমের দিকেই উড়ে আসছে। একসময় পাখিগুলো টুপ টুপ করে আকাশ থেকে খসে পড়তে লাগল নিচের জলভাগে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আকাশ সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে গেল। সূর্য ডুবে গেছে। কালো জলের মাথায় শুধু একটা রক্তাভ স্তর ভেসে রয়েছে। সেটা রক্ত না আলো বোঝা মুশকিল।
পিকুর অসহ্য গরম লেগে উঠল। গায়ের পুলওভার খুলে ফেলল। তারপর দুটো ফুলস্লিভ টিশার্টও। ওদিকে ঘরের থার্মোইন্ডিকেটর দেখাচ্ছে 48০। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখনও ফারেনহাইট স্কেলই রয়ে গেছে।
আবার জানালার কাছে এসে দাঁড়াল পিকু। জানালায় তার পেশিবহুল সদ্যযুবা দেহের প্রতিফলন পড়েছে। আর সেই অবয়বের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে জলভাগের যাবতীয় অবশিষ্ট রক্তাভা। তাকে দেখেই যেন আলোকতরঙ্গ চলকে উঠল। আস্তে আস্তে তারা জড়ো হতে শুরু করল এক জায়গায়। এঁকেবেঁকে, সাপের মতো অজস্র টকটকে লাল আলোর কণা মিলিত হতে লাগল। জলের ভেজা ভাব, পান্নাদ্বীপের পাথুরে জমির সৌন্দর্য, সাগরবলাকার পেলবতা নিংড়ে নিংড়ে তারা সংঘবদ্ধ হতে লাগল। একসময় পড়ে রইল এক অন্ধকারময় জলভূমি আর মাটি থেকে কিছু উপরে ভেসে রইল এক অনিন্দ্যসুন্দর আগুন রঙের আলোকপুঞ্জ।
হঠাৎই পিকুকে চমকে দিয়ে আলোর একটি সরীসৃপের মতো সেটি উড়ে এল পিকুর দিকে। আছড়ে পড়ল জানালার বন্ধ কাচের ওপর আর ফেটে পড়ল নীল সাদা আর লাল আলোর কণিকায়। বিস্ফোরণে কোনও শব্দ হল না, শুধু অজস্র আলোর কণিকা দ্রুতগতিতে পিকুর চোখের সামনে উড়ে বেড়াতে লাগল। পিকু প্রথমে চমকে পিছিয়ে এসেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করল। পায়ে পায়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল। স্লাইডিং শার্সিটা খুলতেই একটা লাল আলোর কণা তার সামনে এল। ডান হাতের তর্জনী মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটির দিকে বাড়িয়ে দিল পিকু। আলতো করে ছুঁয়ে দিতে আলোকবিন্দুটা যেন শিউরে উঠল। বাতাসে ভাসতে ভাসতে অন্য আলোকণিকাগুলোও এক এক করে ঘরে এল। পিকুর সারা দেহ জুড়ে তারা খেলে বেড়াতে লাগল। হাত, পা, বুক, পেট, কোমর, পা। শিরশিরে এক সুখের অনুভূতিতে তার সারা দেহ পুড়ে যেতে লাগল। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। অগ্নিময় সুখের অনুভূতিতে সদ্যযুবার চোখ বুজে এল।
কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিল পিকু জানে না। চোখ খুলল উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত ঘরে। চোখের সামনে দুটো কালো সুন্দর চোখ। ছলছলে চোখ। একটা মেয়ে। পরনে মধ্যযুগীয় গেঁয়ো টিউনিক। পিকুর মনে হল না একবারও মেয়েটি তার অচেনা। আলতো করে মেয়েটার গালে সে হাত রেখে নরম সুরে বলল, “কাঁদছ কেন?”
মেয়েটির ভারী বুক দুটো দীর্ঘশ্বাসের দমকে ফুলে উঠল। ভাঙা গলায় বলল,
– আমার উনিশ দিনের বাচ্চা ছেলেটা এই একটু আগে আমার হাতের মধ্যে মারা গেল।
– সে কী! তুমি এ অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?
মেয়েটা হাহাকারের সুরে বলে উঠল,
– সবাইকে লুকিয়ে লেক করিবে যাচ্ছিলাম। ওখানেই আমার মরণ। তারপর তোমাকে দেখলাম খোলা দরজা দিয়ে। মেঝের ওপর মড়ার মতো শুয়ে আছ। এত সুন্দর ছেলে, নিজেকে সামলাতে পারলাম না গো। তোমার কাছে এলাম।
– তুমি ঘরে এসে অন্য কিছু দেখতে পাওনি?
– আর কী দেখব?
– এই যেমন অনেক জোনাকি। সোনালি আলো দিয়ে তৈরি অনেক জোনাকি।
মেয়েটি পিকুকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তীব্র বেগে। জোর গলায় বলল,
– সেই সোনা! আবার সোনা? তোমরা সোনা ছাড়া কিছু চেনো না? এই সোনা সোনা করেই আমার বর পাগল হয়ে গেল। আর ফিরল না মাউন্ট অক্স থেকে।
– মাউন্ট অক্স? যেখানে অনেক সোনার খোঁজ পেয়েছে জিওলজিক্যাল সার্ভে?
– তুমিও জানো দেখছি। তবে ওরা কেউ পাবে না। যার জন্য আমি স্বামী ছেলে হারিয়েছি, তা ওরা পাবে না। এ মেয়ের চোখের জল বৃথা যাবে না। আমি আসি।
পিকু এ সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। মেয়েটির হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। চমকে উঠল মেয়েটি। গাঢ় স্বরে পিকু বলল,
– তুমি চেনো ওই জায়গা, মানে মাউন্ট অক্সের যেখানে সোনা পাওয়া গেছে?
– হ্যাঁ, একটা প্রাচীন দুর্গের অনেক গভীরে দুটো কুয়োর নিচে। আমার স্বামীর কাছেই দেখেছি নকশা। আর জায়গাটা চিনেছি ওকফল কুড়োতে গিয়ে। কেন জানতে চাইছ এসব আবার? এসব আমার অভিশপ্ত স্মৃতি।
পিকু মেয়েটিকে বলিষ্ঠ হাতে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে এল। নরম বুক দুটো মিশে গেল পিকুর পেশল বুক আর পেটের সংযোগস্থলে। মাথা নামিয়ে এনে মেয়েটির নিচের ঠোঁট আলতো করে কামড়ে ধরল সে। তারপর শুষে নিতে লাগল আর্দ্র ঠোঁটের সব জলীয় অংশ। মেয়েটি কিছুক্ষণ ছটফট করে শান্ত হল। তারপর সেও পরম আশ্লেষে পুরুষালি দেহটাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ভেজা জিভ দিয়ে খুঁজে নিল অন্য জিভের অস্তিত্ব।
কয়েক মুহূর্তের তীব্র মৌখিক আবেগের আদানপ্রদানের পর পিকু মেয়েটিকে ছেড়ে দিল। মেয়েটি হাঁফাচ্ছে তখনও। চোখ দুটো আগুনের মতো গনগনে লাল হয়ে উঠেছে।
সে আবার এগিয়ে এল পিকুর দিকে।
পিকু মেয়েটির বুকে হাত রেখে তাকে নিরস্ত করল। বলল,
– শান্ত হও। কথা আছে।
মেয়েটি হাতের মুঠোয় নিজের পোশাকের দীর্ঘায়ত নিম্নাংশটি সজোরে খামচে ধরে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে পিকুর দিকে অভিমানের দৃষ্টিতে তাকাল। পুরুষের হাতে নরম উদ্ধত বুক দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল।
কয়েক মুহূর্ত।
মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে একটি কাউচের ওপর বসে ছোটো রুমাল দিয়ে মুখ মুছে স্বাভাবিক সুরে বলল,
– বলো।
দু-এক পা পায়চারি করে পিকু বলল,
– তুমি আমাকে অক্স মাউন্টেনে নিয়ে যাবে। তার পরিবর্তে আমি তোমাকে যথাসম্ভব প্রাইজ দেব।
– প্রাইজ?
– হ্যাঁ, যাতে তোমার বর্তমান অসুবিধে কিছু লাঘব হয়।
মেয়েটি অবাক হতেও যেন ভুলে গেল। কিছুক্ষণ হাঁ করে পিকুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করল,
– তুমি ভিজিটর্স রুমে রয়েছ, তার মানে তোমার কোনও পরিজন গুরুতর অসুস্থ। কে তিনি?
পিকু একটু সময় নিল। তারপর সহজভাবে বলল,
– আমার মা।
– মা! মা অসুস্থ! আর তাঁকে ফেলে তুমি অক্সে যেতে চাইছ? মাকে ভালোবাস না?
গম্ভীর হয়ে পিকু বলল,
– আমার সোনার লোভ নেই। এই গোল্ড মাইন বা এনিথিং এলস্ দ্য সোর্স অব গোল্ড ইজ, দেখার ইচ্ছে মূলত আমার মায়েরই। মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি সেখানে যেতে চাইছি, যাতে ওই জায়গার এক বিশদ বর্ণনা বা কিছু ছবি, সম্ভব হলে ক্লিপিংস আমি মাকে দেখাতে পারি। ভুল বুঝো না আমাকে।
মেয়েটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। শ্বাস গাঢ় হল। কাউচ থেকে উঠে সে আবার পিকুর সামনে এল। নরম অথচ গাঢ় গলায় বলল,
– তুমি মাকে খুব ভালোবাস। তার মানে তুমি তোমার মায়ের সব কথা শোনো? কোনও কথা অমান্য করো না?
মেয়েটির চোখে চোখ রেখে পিকু বলল,
– আজ পর্যন্ত জ্ঞানত কোনও কথা অমান্য করিনি।
মেয়েটি পিকুর দু-কাঁধে হাত রেখে হিসহিস করে বলল,
– তার মানে, তোমার সন্তানও তার মাকে এমন ভালোবাসবে আর কোনও কথা অমান্য করবে না?
পিকু কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে, হো হো করে হেসে উঠল।
– যত্তসব উদ্ভট চিন্তা। তুমি নিয়ে যাবে কি না বলো?
আচমকা হাসির শব্দে মেয়েটি লজ্জা পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। তুমি এগারোটা নাগাদ গলওয়ে ওল্ড ওপন ফেয়ার মার্কেটে এসো। আমার গাড়ি আছে।
– ঠিক আছে।
পিকু পিছু ডাকল।
– তোমার নাম বলোনি এখনও। আমি ঋদ্ধসত্ত্ব সরকার।
মেয়েটি লম্বা বেণি ঝামটে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ দুটোতে অমোঘ আহ্বান। ঘাড় বাঁকিয়ে ঋদ্ধসত্ত্বের সারা দেহে প্রণয়ের স্পর্শ বুলিয়ে দিল। তারপর অশ্রুতপ্রায় কিন্তু তীক্ষ্ণ উচ্চারণে কেটে কেটে উচ্চারণ করল,
– মা-য়-দে-ন..
.
৫
জ্ঞান ফেরার পরই পার্থর মুখে পিকুর চিঠির কথা শোনেন বন্দনা। তাতে লেখা ছিল, “ব্র্যাকলুন যাচ্ছি, কয়েকটা ছবি আর ক্লিপিংস নেওয়ার চেষ্টা করব। কালকে বিকেলের মধ্যে ফিরছি। ইতি – পিকু।”
পার্থকে রওনা করিয়ে দিয়ে বন্দনা আবার চললেন ওয়েস্ট পোর্ট শেরিফ অফিসের উদ্দেশে। গত পরশু রাতেই যদিও পার্থ শেরিফ ও’কনরকে সব জানিয়েছে, তবুও বন্দনার মন বলছে শেষ বিকেলে ওয়েস্ট পোর্ট গির্জার ঘটনাগুলো তাঁর জানানো উচিত। রাস্তা দিয়ে উড়ে চলেছে ভাড়াগাড়ি। ভোরের ফাঁকা রাস্তা করিব হ্রদের তীরের এ অংশটার স্পিড লিমিট ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। চল্লিশ মিনিটের বেশি লাগানোর কথা নয়।
আচমকা ব্রেক কষল ড্রাইভার। সিটবেল্ট সুদ্ধ তিনজন ছিটকে সামনের দিকে এসেই আবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনির মধ্যে সোজা হল। কপালের স্টিচগুলো টাটিয়ে উঠল।
হেডলাইটের সাদা আলো পড়েছে কালো রাস্তার ওপর। বাঁদিকে করিব হ্রদের কালো জলে রাস্তার আলো পড়েছে। আলোর রেখা দুটো কেটে অন্ধকারের বুক থেকে সেই অদ্ভুত পাদরি এগিয়ে এল। বাঁদিকে বসা বন্দনার জানালার কাছে নিচু হয়ে কাচে টোকা দিল। কাচ নেমে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে লোকটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আমাকেও যেতে হবে আপনাদের সঙ্গে। আপনার ছেলের সঙ্গে আমার প্রাচীন সম্বন্ধ।”
বন্দনা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কিন্তু কে আপনি?
– বিবস্বান রুদ্র।
ওয়েস্ট পোর্ট পৌঁছে বিবস্বান আর বন্দনা শেরিফের সঙ্গে যাবতীয় ছক কষে নিলেন। পার্থ চারজন স্থানীয় কাঠুরে জোগাড় করে ব্র্যাকলুন চলে গেছেন বেশ খানিকক্ষণ হয়েছে।
ও’কনর দশজন শক্তপোক্ত কনস্টেবলকে ট্রাকে তুলে নিলেন। তিনি নিজেও জানেন না পাদরির কথায় এত ভারী অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা তিনি করলেন কেন।
শুধু মায়ো গির্জার পোড়া ভাঙা অংশটা চোখে পড়ল। চোয়াল শক্ত করে তিনি শেরিফের গাড়িতে উঠলেন।
**
পার্থ কাটা গাছের গুঁড়িগুলোর তদারকি করছিল।
হাত দশেক লম্বা লম্বা টুকরো। সেগুলোকে গড়িয়ে ফেলতে হবে ব্র্যাকলুন বনের অন্তঃস্থল দিয়ে বয়ে যাওয়া সোঁতাটির ওপরে এবং তা এমনভাবে যেন আকাশপথ থেকে কোনও বিষাক্ত বা নোংরা জিনিস জলে না পড়তে পারে। আবার গুঁড়িগুলির অবস্থান একে অপরের ওপরে যোগচিহ্নের মতো হতে হবে। এতে তারা স্থিতিশীলও হবে আর সময় এলে একজন মানুষও যেন গুঁড়িগুলোকে গড়িয়ে সরিয়ে দিতে পারে। সাজানো শেষ হলে সবার ওপরে ঘন কালো ফাইবার প্লাস্টিকের আবরণ।
ওকগাছগুলো পাদরির নির্দেশ অনুযায়ী কাটানো হলে পার্থ দেখলেন একটা গোল শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকটা অ্যাম্ফিথিয়েটারের অ্যারেনার মতো লাগছে জায়গাটা।
এদিককার ব্যবস্থাপনা শেষ করে কিলোমিটার দু-এক দক্ষিণে, সোঁতাটির একটি অংশ যেখানে করিব হ্রদে পড়েছে, সে জায়গাটি পাথর ও গাছ দিয়ে এমনভাবে আটকে দিল ওরা, যেন কিছুক্ষণ বা দিনের জন্য উভয়দিকের জল পরস্পরের সঙ্গে মিশতে না পারে।
আটলান্টিকের দিকের অংশটি খোলা পড়ে রইল।
আবার বনতলির সে অংশে ফিরে এলেন পার্থরা।
সেখানে এখন অনেক মানুষের জমায়েত। বিবস্বান রুদ্র, ও’কনর, দশজন শক্তসমর্থ আইরিশ যুবক পুলিশ।
আর সিডার কাঠের তৈরি বেসবল ব্যাট হাতে নিয়ে স্পোর্টস শু আর স্ট্রেচেবল জিনস পরা যে মহিলা এগিয়ে এসে পার্থকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “য়্যু আর মাহ্ হিরো”, পার্থ একটু দেরি করে হলেও বুঝলেন ইনি তার বিয়ে করা বাঙালি মাস্টার বউ।
সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। ওকগাছের শ্যাওলাধরা গুঁড়ির রঙের মতোই নিরুত্তাপ সকাল। সমুদ্র, হ্রদ, নদী, সোঁতা থেকে ভিজে হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
বিবস্বান বললেন,
– দুর্গের দিকে এগিয়ে যাও তোমরা।
বন্দনার ইশারা পেয়ে ও’কনর জোর গলায় নির্দেশ দিলেন,
– ল্লিগ দুঁইদ্দুল!
সাইক্লিস্ট দুজন, বিবস্বান রুদ্র আর কাঠুরের দল বাইরে রয়ে গেল।
৬
পিকু গলওয়ে ফেয়ার গ্রাউন্ড থেকে মায়দেনের সঙ্গে যখন গাড়িতে ব্র্যাকলুনের দিকে রওনা দিল, রাত তখন ঠিক বারোটা। দূরে বাঁদিকে লেক করিবের জলে আছড়ে পড়ছে বিভিন্ন গাড়ির আলোর রেখা। ঝলসে উঠে সে আলোর প্রতিফলন ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে।
মায়দেনের পোশাক আজ সম্পূর্ণ কালো। আরও বেশি সুন্দরী মোহময়ী লাগছে তাকে। অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পিকু। মায়দেন মুচকি হেসে বলল,
– এত কী দেখছ গো? আগেও তো দেখেছ।
পিকু উত্তর দিল না। তাকিয়েই রইল। নির্লিপ্ত মুখে কামবাসনা ফুটে ওঠেনি। এক অপার বিস্ময় আর সৌন্দর্যপিপাসু অভিব্যক্তি। মায়দেন আশ্চর্য হল। অনন্ত জীবন তার। অপার তার যৌবন। পৃথিবীর লাভা সৃষ্টির সময় তার সৃষ্টি। লক্ষ কোটি অযুত পুরুষ তার যৌবনের অন্ধকারে জ্বলে পুড়ে মরতে এগিয়ে এসেছে যুগে যুগে। কিন্তু পুরুষের চোখে যখনই এমন নির্লিপ্ত শ্রদ্ধা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা দেখেছে, তখনই তার সর্বনাশ হয়েছে। পুরুষের চোখে ঘৃণ্য কাম, লালসা দেখতেই তার ভালো লাগে। ওতেই তার আসল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়।
মায়দেন। চিরকুমারী অথচ সকল নিকৃষ্ট পাপের সে মা। খোদ শয়তান তার সন্তান। নরক আর জীবন্ত পৃথিবীর যোগসূত্র হল তার যোনিপথ। সকল পাপকে সে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান শয়তানের রাজত্বে পাঠায় আর শক্তিশালী করে তোলে পাপের সাম্রাজ্যকে। শেষ বিচারের দিন এই পাপী আত্মার সৈন্যদল শয়তান কাজে লাগাবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। সেদিন মায়দেন নিজেও শেষ হবে ঈশ্বরের রক্তে স্নান করে। কারণ সর্বপ্রথম ওই লোকটিই সুন্দর পবিত্র মুগ্ধতায় বলে উঠেছিল, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’, আর মায়দেনের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তার সুন্দর সৃষ্টির দিকে আর কোনোদিন ফিরেও তাকায়নি নিষ্ঠুর পুরুষ। যুগ যুগ ধরে ক্লেদ, কাম, লোভ, লালসা ছেনে ছেনে মায়দেন ক্লান্ত।
– লেট দেয়ার বি লাইট, মায়দেন।
মায়দেন চমকে উঠল। সামনে থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা আলোর থুতু ছিটিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল, নইলে মুখোমুখি বড়ো সংঘর্ষ ঘটত একটা। ঋদ্ধসত্ত্বের মুখে অদ্ভুত কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল মায়দেন। পিকুও মায়দেনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে অবাক হল খুব। বোকা বোকা গলায় বলল,
– গাড়ির ভেতরে আলো জ্বালাওনি, তাই বললাম। এতে এমন কী অনাচার হল শুনি?
মায়দেন চিড়বিড় করে উঠল,
– তাই বলে অমন করে বলবে?
– কী করে বললাম?
– এ তো আচ্ছা বোকা! কিছু না।
ওয়ালনাট গাছটা পথের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মায়দেনের চোখে পড়ল একটি মাদি কুকুর গাছের ডালে বসে আছে। প্রেতিনী ব্যানশি। কুকুরের রূপ নিয়ে মৃত্যুর পরোয়ানা শুনিয়ে যায় ইনিয়েবিনিয়ে কেঁদে।
শেষবার, অর্থাৎ আর্থারের সময়ও দিয়েছিল।
নরকমাতা মায়দেনের বুকটা ভয়ে ধক্ করে উঠল। না, তার পরিচিত কোনও মানুষের মৃত্যুসংবাদ সে শুনতে চায় না এ মুহূর্তে। কিন্তু, এমন হচ্ছে কেন তার? কেন সে মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে? মৃত্যু তো তারই সন্তান।
কুত্তিটা কাঁদল না। তার দিকেই তাকিয়ে যেন মৃদু হাসল। লজ্জায় লাল হয়ে মায়দেন গাড়ির ভেতরের আলো জ্বালিয়ে দিল।
পিকু মৃদু হেসে বলল,
– মায়দেন, বড়ো সুন্দর তুমি। আমার আসল মায়ের মতো সুন্দর।
পিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়দেন শিউরে উঠল। এত নীল আলোকময় চোখ! এমন তো ছিল না আগে।
ভোরের ব্র্যাকলুন বন জাদুপান্নার বন মনে হয়। কত রঙের সবুজ এ বনের আঁকেবাঁকে লুকিয়ে থাকে তা বোধহয় বনের অলৌকিক সর্বজ্ঞ ড্রায়াডরাও বলতে পারবে না। মায়দেন ঝলমল করছে এত সবুজ দেখে। ওকপাতার গাঢ় সবুজ, নরম সবুজ, রোদচোঁয়ানো সবুজ, ভেজা ছায়ার সবুজ।
মায়দেন বাচ্চা মেয়ের মতো দু-হাত মেলে ঘুরতে লাগল, নাচতে লাগল। আজ সে শুধু নারী নয়, সুন্দরী পৃথিবীর এক অধিবাসীও। পিছন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল প্রিয়তম পুরুষকে। নীল নরম চোখের পুরুষ, একান্ত তার নিজের। মায়দেন ভুলে গেছে পুরুষকে তার ভালোবাসতে নেই। পুরুষ তার সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র। না, ঋদ্ধসত্ত্ব তার কাছে তা নয়। সে চায় না ঋদ্ধসত্ত্বের সন্তান। কারণ তার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের পর পুরুষ আর বেঁচে থাকে না। সে ঋদ্ধসত্ত্বের সঙ্গে এ চরম খেলা কিছুতেই খেলবে না। এ চিন্তা তার মনে নারীত্বের পূর্ণতা নিয়ে এল। আনন্দে চিৎকার বলে উঠল মায়দেন,
– ঋদ্ধসত্ত্বওওওও, তোমার জন্য আমার কত যুগ পর সকাল দেখা হল। তুমি আমার জীবনের আলো।
পিকু নিঃশব্দ সুন্দর হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠল।
– তোমার জন্য সারাজীবনে এই প্রথম আমি নারীর প্রেমে পড়লাম মায়দেন। শুধু বাবা-মাকে ঘিরেই এতদিন আমার বিশ্ব ছিল। তুমি আমাকে মুক্তি দিয়েছ।
দুটি তরলমতি শিশুর মতো তারা ঘুরে বেড়াল বনময়। সারাটা দিন কেটে গেল ব্র্যাকলুনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। সন্ধ্যা নেমে এলে তারা মাউন্ট অক্সের দুর্গে প্রবেশ করল।
মায়দেনের মুখে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। তার নিজের সাম্রাজ্য দেখে সে ভয় পেতে লাগল। চমকে উঠতে লাগল। পিকু মায়দেনকে কাছে টেনে নিল। নরম গলায় বলল,
– তোমার কী হয়েছে মায়দেন? এমন কেন করছ?
রুদ্ধ কণ্ঠে মায়দেন বলল,
– আমি জানি না গো, আমার খুব ভয় করছে। ত্ তুমি… আমার কাছে এসো না ঋদ্ধসত্ত্ব, তুমি জানো না আমি কে।
ততক্ষণে পিকুর ঠোঁট দুটো মায়দেনের নরম ঠোঁট দুটো শুষে নিয়েছে। মায়দেনের মনে হচ্ছে ছ-জোড়া প্রবল অতিমানবিক ঠোঁট দিয়ে ঋদ্ধসত্ত্ব তার সকল বিষের আগুন শুষে নিচ্ছে নিজের মধ্যে। এক প্রবল পবিত্র সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে শয়তানের মায়ের সুপ্ত হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে।
নিজেকে অনাবৃত করল মায়দেন। প্রিয় পুরুষের মাথা টেনে নিল বুকের উপত্যকায়। তার প্রবল শীৎকারধ্বনিতে জেগে উঠল বনভূমির যাবতীয় সরীসৃপ। তারাও মিলিত হল আপন আপন সঙ্গীর সঙ্গে। মুছে গেল ব্র্যাকলুন বনের নিশীথসংগীত। শুধু বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল অজস্র সরীসৃপের অপার্থিব শীৎকার। সংগমের অভিঘাতে মায়দেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। স্বর্ণাভ হয়ে উঠল বুকের বাঁদিকের হৃৎপিণ্ডের উপরিতল। জেগে উঠতে লাগল কোটি কোটি বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা হৃৎপিণ্ড। রাত্রির প্রহর বয়ে যেতে লাগল সংগমের কালক্ষেপে।
মায়দেন আশ্চর্য হল ঋদ্ধসত্ত্বের বীর্যধারণ ক্ষমতা দেখে। এমন তো হওয়ার কথা নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনভাবে কেটে যাওয়া সম্ভব নয়। যোনিদ্বারে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ঋদ্ধসত্ত্বের চোখের দিকে সে তাকাল। ময়ূরপেখমের মতো নীল চোখ। নির্ভেজাল হাসি ভরা মুখ। মায়দেন চমকে উঠল। পুব আকাশ লাল হয়ে আসছে। আর ঋদ্ধসত্ত্বের পিছনে দুর্গের ভাঙা প্রাকারের ওপর বসে আছে একটি বহুবর্ণময় পেখমওয়ালা একটি ময়ূর।
ঋদ্ধসত্ত্বকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মায়দেন উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল,
– তুমি কি নির্বীর্য? বীর্যহীন তুমি?
পিকু ম্লান হাসি হেস বলল,
– এবার যে তোমাকে ফিরতে হবে মায়দেন। তোমার প্রথম সন্তানের কাছে। ওই অন্ধকার দরজার ওপারে আর-কোনো পুরুষ যাবে না। আর আমি নির্বীর্য নই। পিতা আদেশে আমি বীর্যপাতরহিত। ফেয়ার নেমফোস্তা। হ্যাঁ, তুমি যেমন মায়দেন, আমিও ফেয়ার নেমফোস্তা। চিরকুমার। তোমার অন্ধকারের দরজাকে ধ্বংস করতেই হত মায়দেন। সে পুরুষের বীর্যে ঋদ্ধ হয়ে বিশ্বের ধ্বংসসাধন করে। অশুভ শক্তির বৃদ্ধি ঘটায়। একমাত্র উপেক্ষা ও ফলহীনতার অভিজ্ঞতাই তার ধ্বংসের কারণ হতে পারত, ও আমি তাই করেছি।
মায়দেন তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে চাইল। কিন্তু তার গলা থেকে একফোঁটা রক্তের মতো হাহাকার বেরিয়ে এল,
– কিন্তু আমি যে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম ঋদ্ধসত্ত্ব।
মলিন স্বরে ঋদ্ধসত্ত্ব বলল,
– আমাদের ভালোবাসতে নেই মায়দেন। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সৈনিক। তুমি সকল অভিশাপের জননী, আমি দেবসেনাপতি।
– তুমি মাইকেল! না গ্যাব্রিয়েল!
– যে নামে ডাকো আমি তাই-ই। আমাদের সৃষ্টিকর্তা একই মানুষ।
মায়দেন পাথুরে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তার দেহের বিভিন্ন অংশ বিকৃত হতে লাগল। কোমরের নিচের অংশটি প্রলম্বিত হতে হতে এক বিশাল সাপের রূপ নিল। চামড়া ফেটে বেরিয়ে এল কালো কালো রক্ত। সুন্দর মুখে জেগে উঠল কালো কালো ছোপ। এঁকেবেঁকে দুর্গের দরজার দিকে এগিয়ে চলল।
বুক ফেটে কান্না আসছে মায়দেনের। জীবনের প্রথম ভালোবাসার দিকে সে ফিরেও তাকাবে না। চোখ ভেসে যাচ্ছে অশেষ চোখের জলে। সব কিছু শূন্য হয়ে যাচ্ছে। বন পাথর দুর্গ মহাসাগর বিশ্ব কাল… সব শুধু শূন্য।
দুর্গের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সবার হাতে অস্ত্র। শেষ করে দিক ওরা অভাগিনিকে। ওই তো বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে। এইবার আসবে শান্তির মরণ।
নাঃ, আবার নামিয়ে নিল মারণাস্ত্র। এখনও বয়ে বেড়াতে হবে এই দুঃসহ পঙ্কিল শরীরটাকে। একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে। চোখ ঝাপসা লাগছে, তবুও মায়দেন নামিয়ে আনল মাথাটা ভালো করে মেয়েটিকে দেখার জন্য। থরথর করে কাঁপছে সারা দেহ। সামনের সেতুটাও কাঁপছে। গভীর পরিখা। অনেক নিচে পাথুরে জমি।
হঠাৎই কে যেন বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “তিষ্ঠ… তিষ্ঠ… তিষ্ঠ।” মায়দেন চোখ তুলে তাকাল।
এ কী! এ কে? এ তো তার প্রথম ভালোবাসার পুরুষ, যে তাকে সৃষ্টি করেছিল একটিমাত্র কথা বলে, ‘লেট দেয়ার বি লাইট!’
.
এবার তবে সত্যিই আলো এল।
**
পার্থ হাঁপিয়ে উঠছিলেন। পাথুরে পথ দুর্গের প্রান্তে পশ্চিমের সেতুর কাছে এসে শেষ হয়েছে। এই সেতু পার হলেই কুয়োর মুখ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে সিঁড়ির ধাপ শুরু।
বন্দনা পার্থকে বললেন,
– তুমি আর দুজন কনস্টেবল সেতুটাকে সিকিওর করো। আমরা ভেতরে যাই।
পার্থ মুচকি হাসলেন,
– আমায় ফেলে মৃত্যুমুখে যাচ্ছ?
বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলেও মুখে নির্লিপ্ত সহজ হাসি হেসে বন্দনা বললেন,
– আমরা আয়ারল্যান্ডে বেড়াতে এসেছিলাম। যাবও সেই ভ্রমণের শেষে আনন্দঘন মনেই। কেউ রয়ে যাবে না এখানে।
– এই পৃথিবীতেও আমরা বেড়াতেই এসেছি। কেউ রয়ে যাবে না। এক কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের জন্য আমি তোমাকে হারাতে পারব না বন্দনা।
বন্দনার ওপর যেন বজ্রপাত হল। কিছুক্ষণের জন্য তিনি মৃতদেহের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর পাশের কনস্টেবলের হাতের ইনসাস রাইফেলটি কেড়ে নিয়ে পার্থকে হিসহিস করে বলে উঠলেন,
– পিকু আমার সন্তান। তোমারও সন্তান, পার্থ সরকার। আমার সন্তানের সম্বন্ধে যে অমঙ্গল চিন্তাকারী, সে মানব, দেব, দানব যে-ই হোক না কেন, আমি তার চিহ্নমাত্র রাখব না। আমার নিজের স্বামীরও না।
ও’কনর বন্দনার হাত থেকে ইনসাসটি কেড়ে নিয়ে বললেন,
– চলো বন্দনা। সময় বিশেষ হাতে নেই। পার্থ, সিকিওর দ্য এনট্রি। নিজেরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হোয়ো না। দানবী কিন্তু তাই-ই চায়।
বন্দনা পিছু ফিরলেন। এগিয়ে চললেন দুর্গের মূল প্রবেশদ্বারের দিকে। পিছন থেকে নিষ্ঠুর ঠান্ডা হাসিতে ব্যঙ্গ মিশিয়ে পার্থ বলে উঠলেন,
– যাও, বন্দনা সরকার, যাও। পলাশবনি পাখিরালয়ের নদীতীরে কুড়িয়ে পাওয়া বেওয়ারিশ বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসো। তবে ও আমার সন্তান নয়। ওই বেজন্মাটার জন্যই আমি এখনও প্রকৃত পিতা হয়ে উঠতে পারিনি। তুমি পারোনি আসল মা হয়ে উঠতে।
বন্দনা এক লাফে পার্থের কাছে এসে সিডারের ব্যাটটা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁর মাথায় মারলেন। একটা ম্লান হাসি হেসে পার্থ কাটা গাছের মতো পড়ে গেলেন।
সামনের কনস্টেবলটি আর্তনান করে উঠল। দুর্গের দরজায় আবির্ভূত হয়েছে এক অদ্ভুত নারীমূর্তি। তার কালো পোশাক পরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত দুর্গের দরজা ছাড়িয়ে দুলছে আকাশে আর, কোমরের নিচের অংশটুকু বিশাল সাপের মতো আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে সেতু, দুর্গপ্রাচীর আর দুর্গপ্রাঙ্গণ জুড়ে। কিন্তু তার মধ্যে আক্রমণের স্পৃহা নেই, বরঞ্চ তার অসুস্থ সরীসৃপ দেহ যে-কোনো মুহূর্তে আছড়ে পড়তে পারে গভীর পরিখায়।
ও’কনরের নির্দেশে কনস্টেবলের দল বন্দুক তুলল। বন্দনা আর্তনাদ করে উঠলেন,
– শেরিফ, ডোন্ট য়্যু ডেয়ার শ্যুট। আমার ছেলেকে আমি এখনও খুঁজে পাইনি।
ও’কনর থামলেন। বন্দনা সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন। সাপিনির বিশাল স্খলিত দেহের চাপে দুলছে সেতু। যে-কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।
হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে উঠল সাপিনির চোখ। মুখ দিয়ে গাঢ় সোনালি ফুটন্ত তরল বেরিয়ে এল।
পিছন থেকে রুদ্র বিবস্বানের চিৎকার ভেসে এল, “তিষ্ঠ… তিষ্ঠ… তিষ্ঠ।”
সাপিনির চোখ সেদিকে পড়তেই সে স্থাণু হয়ে গেল পাথরের মূর্তির মতো।
প্রচণ্ড গতিতে বন্দনাকে অতিক্রম করে গেলেন বিবস্বান। মায়দেনের সরীসৃপ অংশটি ডান হাতে ও মানবী অংশটি বাঁ হাতে ধরলেন। সংকুচিত হল দেহটি। মানবীর আকৃতি ফিরে পেতেই বিবস্বান সেতুপথে ফিরে চললেন।
বন্দনা বললেন,
– বিবস্বান, আমার ছেলে?
বিবস্বান বললেন,
– আমার সঙ্গে চলুন দেবী, আপনার কিচ্ছু হারাবে না। যা হারায় এ বিশ্বে, শুধু আমারই হারায়।
কাঠের আস্তরণের নিচের বিশুদ্ধ জলে মায়দেনকে ডুবিয়ে দিলেন বিবস্বান। কালো হয়ে উঠল সে জল। গাঢ় কালো জল ঢাল বেয়ে ছুটে চলল জলধারা বেয়ে মহাসাগর অভিমুখে। লেক করিবের পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিষাক্ত জলের অংশ ফিরে এসে আবার ফিরে চলল মহাসমুদ্র অভিমুখে।
আকাশ বন ভেসে যাচ্ছে স্বর্গীয় আলোয়। বিবস্বানের দেহ থেকে আসছে সে আলো। আসছে ও’কনরের দেহ থেকে। জ্ঞান ফিরে আসা পার্থ, আইরিশ যুবক, বন্দনা… সবাই ঝলমল করছে এক অপার ঐশ্বরিক আলোয়।
মায়দেনের দেহটি বনতলের ফাঁকা জায়গায় শুইয়ে রাখলেন বিবস্বান। পরম প্রশান্তি তার মুখে। মুদিত দুই চোখে সুখনিদ্রার আবেশ।
ঘুমিয়ে পড়েছে অভিশপ্ত মায়দেন।
হাতের গাছের ডালটি মায়দেনের বুকে ছোঁয়ালেন বিবস্বান। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “All life begins in the Trinity, comes from the Trinity, and is destined to seek eternal rest in the Trinity. Even damned souls, by suffering punishment for having rejected love, finally do glorify My justice.”
ধীরে ধীরে মাটির বুক খুলে গেল। মায়দেনের দেহটি ভেসে ভেসে নেমে যেতে লাগল অগ্নিগর্ভ ভূকন্দরে। সবার চোখের সামনে অক্স মাউন্টেনের বিশাল স্বর্ণভাণ্ডার উন্মোচিত হল। কিন্তু কারও চোখে লোভের লেশমাত্র নেই। একমনে সবাই গাইছে প্রভুর বন্দনা।
মাটির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বনের উলটো দিক থেকে হেঁটে এল পিকু। হাতে একটি ছোট্ট ওকগাছের চারা।
মায়দেনের দেহটি যেখানে শোয়ানো ছিল, সেখানে চারাটি রোপণ করে ফিসফিস করে সে বলল,
‘অভাগিনি, সুখে ঘুমোও… আর এসো না।”
বিবস্বান এগিয়ে এসে ঋদ্ধসত্ত্বের কাঁধে হাত রাখলেন। উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো।
– ঋদ্ধসত্ত্ব, মায়ের কাছে সাধারণ মানুষের মতো থেকো কয়েকটা দিন। ফেরার সময় গঙ্গাস্নান সেরে এলেই হল।
পিকু হেসে বলল,
– যথা আজ্ঞা পিতা।
বন্দনা এগিয়ে এলেন। বিবস্বানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আমার সন্তানকে রক্ষা করেছেন আপনি, আমার বিনম্র প্রণাত গ্রহণ করুন।
আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন বিবস্বান। তারপর হাত তুলে বরাভয়ের মুদ্রায় বললেন, “আনন্দময়ী হউন দেবী।”
.
মাউন্ট অক্সের বনের গভীরে হারিয়ে গেলেন বিবস্বান রুদ্র। বন্দনার মনে হল বিবস্বানের ত্রিপত্র ডালটি রোদে ধাতব দণ্ডের মতো ঝলসে উঠল আর পাতাগুলি তিনটি ফলার মতো।
পিকু সজোরে হেসে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, খিদে পেয়েছে, চলো কিছু খাই।”
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বন্দনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
.
ব্র্যাকলুন বনের গভীরে চারা ওকগাছটি বেড়ে উঠতে লাগল। ওয়েস্ট পোর্টে আর ব্যানশি কাঁদে না। ক্রোয়াঘ প্যাট্রিক চার্চে গং বেজে ওঠে মধুর সুরে।
আর মাটির অনেক অনেক নিচে হয়তো দুটি নীল চোখের নরম ভালোবাসা খোঁজে অন্ধকার দরজার মা, চিরকুমারী মায়দেন।
চিরকুমারের একমাত্র নারীসঙ্গ, চিরকুমারী মায়দেন।
.
[মাইদিন মহাইথ — সুপ্রভাত,
ল্লিগ দুঁইদ্দুল — এবার যাওয়া যাক (let’s go)]