নিষিদ্ধ গাণ্ডিব

নিষিদ্ধ গাণ্ডিব

এক

চার প্রহর পার হতে চলল, তবুও রোদ উঠল না। চৈত্রারম্ভের নিম হলুদ বাটতে বসেছিল বাড়ির মেয়েরা। তারাও কাজ ফেলে ঘোমটা টানা মেঘ করে বসে রইল।

এখন শুধু চুপ করে বসে ঘুম পায় না। ছোটনের জলপাই খুঁজতে গিয়েও ঘুম পায়। পুরোনো প্রতাপ রাজার এক ভাঙা গড় রয়ে গেছে জলপাই বনের উত্তর দিকে। শুকনো পরিখা, ভাঙাচোরা ইটের পাঁজা রয়ে গেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দুর্গের একটা বড়ো অংশ অবশ্য এখনও রয়ে গেছে অক্ষত। সে অংশটা হলুদ আর কালো পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি। পলাশের বাবার মুখে ছোটন শুনেছে প্রতাপরাজার একটা গুপ্তধন ওখানে আজও রয়ে গেছে। গল্পটা শোনার পরই ওদের জলপাই কুড়োনোর দলটা ভেঙে গেছে। এখন যে যার নিজের মতো জলপাই কুড়োতে আসে।

জলপাই গাছগুলোর নিচটায় কাঁচাপাকা জলপাই বিছিয়ে আছে। টকমিষ্টি গন্ধে ম-ম করছে নিঃশব্দ দুপুর। পশ্চিমের পদ্মবিল থেকে এক গা-কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া ছুটে আসছে। পাতার গায়ে সে হাওয়া আছড়ে পড়ে অদ্ভুত ছমছমে শব্দ উঠছে। শিরশির করে উঠল ছোটনের গা।

ভাঙা প্রাচীরের গর্ত দিয়ে গড়ের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে গেল ছোটন। ভিজে ভিজে মাটি। শীতকালে তো বটেই, প্রচণ্ড গরমেও এখানে সরাসরি রোদ পড়ে না। মাথার ওপর বট, জাম, হিজল, আম, কাঁঠাল, কৃষ্ণচূড়া গাছ জড়াজড়ি করে একটা ছোটো ছোটো ছিদ্রভরা ছাঁকনির সৃষ্টি করেছে। সেই ঘনবুনট পার হয়ে যেটুকু রোদ আসে, তাতে মাটির গা তাতে না। আজ তো একে মেঘলা, তার ওপর সময়টা ফাল্গুনের সবে শেষ দিক। রোদ এখনও ঘনিয়ে ওঠা শুরু হয়নি।

সরু শ্যাওলা ঢাকা পথ। পচা পাতা থেকে ঝাঁজালো একটা গন্ধ উঠে আসছে। একটা মরচে ধরা লোহার বর্শা উঁচিয়ে আছে পাথুরে চাতাল থেকে। তার নিচটায় গুচ্ছের ঘেঁটুফুল হয়ে আছে। হালকা সাদাটে বেগুনি ফুল ফুটে আছে। বাড়ি ফেরার সময় দু-মুঠো ঘেঁটুফুল নিয়ে যাবে ছোটন। ছোটোবোনটা খুব খোসপ্যাঁচড়ায় ভোগে। ঘেঁটুফুলের রস অব্যর্থ ওষুধ।

ফুলগুলো থেকে চোখ তুলতেই লোকটাকে দেখতে পেল ও। লোহার বর্শাটার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত কালো একটা পোশাক। চোখ দুটো খুব জ্বলজ্বলে। ছোটন খুব অবাক হয়ে গেল। ভরা দুপুরবেলায় লোহার বর্শার পাশে একটা অদ্ভুত পোশাক পরা অচেনা জলজ্যান্ত মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে অবাক হওয়ারই কথা। খুব করে চোখ দুটো ডলে নিয়ে আবার তাকাল। নাঃ, কেউ নেই।

এই এক দুপুর আলোর মধ্যে ও ভুল দেখল?

নারকেল গাছগুলোর মাথায় মেঘ ঘন হয়ে জমাট বেঁধে আছে। তবে বেশ হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি নামবে না।

কালো পাথরের ঘোরানো পথ গড়ের বাইরের দিকে প্রাচীরের গা বেয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। পাথরের দেয়ালের গায়ে ছোটো ছোটো চারকোনা জানালা। বিপজ্জনকভাবে পাথরের টুকরো ঝুলে আছে নিচের দিকে। কোনো-কোনোটা আবার নড়বড়ে। জোরে চলতে গেলে পাথর ভেঙে পড়তে পারে।

এখান থেকে পদ্মবিলের অনেকটা অংশ দেখা যায়। মেঘের ছায়া পড়ে কালো হয়ে আছে বিলের জল। দু-একটা বক ওড়াউড়ি করছে জলের ওপর। অন্য পাড়ে পলাশবনির ঘরবাড়ি দেখা যায়। বিরাট দোতলা সাদা বাড়িটা স্পষ্ট বোঝা যায় এখান থেকেও। সিংহবাড়ি। পলাশদের বাড়ি। প্রতাপরাজার সময় সিংহরা রাজবংশের অনুগত ছিল বলে লোককথা প্রচলিত। সিঁড়ির খাড়া ঢাল বরাবর ঠিক নিচেই একটা খসখস শব্দ হল। একটা বড়োসড়ো কালো কুকুর। এত বড়ো কুকুর এ অঞ্চলে আগে দেখেনি ছোটন। সবুজ সবুজ চোখ। ছোটনের দিকে তাকিয়ে একবার ঠোঁট চাটল কুকুরটা। তারপর একটু দূরে বঁইচি গাছের ঝোপে ঢুকে গেল। কুকুরটার দিকে চোখ রাখতে রাখতে সিঁড়ি দিকে মুখ ঘোরাতেই এক ঝলক দমকা গরম বাতাস ছুটে এসে ধাক্কা দিল পিছন থেকে।

চমকে উঠল ছোটন।

সেই লোকটা। বড়ো বড়ো কালো দাঁত। তার একদম সামনে দুটো ধাপ নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা কালো চোখ দিয়ে ওকে দেখছে। প্রচণ্ড ভয় পেল ছোটন। অসতর্ক পায়ে একটু পিছিয়ে যেতেই, সিঁড়ির একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। ডান পায়ের গোড়ালিটা পড়ল একটা নড়বড়ে পাথরের ওপর। প্রাণপণে কিছু একটা ধরতে চাইল ওর হাত দুটো।

তারপর আকাশ হাতড়াতে হাতড়াতে ছোটন পড়ে গেল ঘেঁটুফুলের ঝোপের ওপর। মাথার পাশ থেকে একটা গরম তরল গড়িয়ে নামল। প্রাণপণে উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগল ছেলেটা। হঠাৎই একটা বুনো গন্ধ নাকে এসে লাগল ওর।

ঝাপসা চোখে দেখল, বঁইচি ঝোপের অন্ধকার থেকে কালো কুকুরটা বেরিয়ে এসেছে। ঘন সবুজ রঙের চোখ। লাল টকটকে জিভটা দিয়ে একবার নিজের মুখটা চেটে নিল জন্তুটা। দু-সারি ছুরির ফলার মতো দাঁত।

খুব ধীর পায়ে একটু একটু করে কুকুরটা এগিয়ে আসতে লাগল মৃতপ্রায় ছোটনের দিকে।

ছোটনের নীল প্যান্টটা প্রথম চোখে পড়ে রতনের। প্রায় একই সময়ে সেও গড়ের উত্তর দিক দিয়ে এদিকটায় এসেছিল। সামনের ফলসা ঝোপটার আড়ালে একটা গোঙানির আওয়াজ কানে আসতেই সেদিকে চোখ পড়ল। নীল রঙের প্যান্ট আর দুটো পা ঝোপের বাইরে বেরিয়ে আছে। অল্প অল্প নড়ছে পা দুটো। প্যান্টটা এখন কাদামাখা হলেও রতন ভালোমতোই চেনে ওটা। পা টিপে টিপে সেদিকে এগোতেই একটা গজরানির শব্দ শোনা গেল। একটা চাপা গর্জন। তাতে কুকুরের ডাকের আদল আছে, কিন্তু আরও গম্ভীর। ওটা যদি কুকুরের ডাক হয়, রতন নিশ্চিত তার আকার সাধারণ কুকুরের প্রায় পাঁচ গুণ। আর সাহস হল না এগিয়ে যাওয়ার। পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল রতন। ভস করে একরাশ ধোঁয়া বেরিয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে। ছায়া ছায়া বিকেলে সেই ধোঁয়ার পেট থেকে ঠিকরে পড়ল কিছু আগুনের ফুলকি। রতন আর দাঁড়াল না।

পিছন ফিরে ছুটতে লাগল।

একটা ফিসফিসে হাসি প্রাচীরের সীমা পর্যন্ত তাড়া করে এল ওকে। প্রাণপণে ছুটে রতন বড়ো রাস্তায় উঠল। বুকটা ধড়ফড় করছে। আর-একটু ছুটতে হলে বুকটাই ফেটে যেত। প্রতাপগড়ের ওদিকের গাছগুলো যেন মেঘ মেখে আরও কালো হয়ে আছে। সেদিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতে তাকাতে রতন গ্রামের দিকে হাঁটল দ্রুত পায়ে।

.

সিংহবাড়ির ছেলে পলাশ। ছোটন, রতন দুজনেরই বন্ধু সে। তাকে খবরটা দেওয়া উচিত মনে করল রতন। পলাশের মা উঠোনে দাঁড়িয়ে কাজের লোককে কিছু বলছিলেন। রতনকে সন্ধ্যাবেলায় দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না। ও মাথা নিচু করে পলাশের ঘরে ঢুকে গেল।

অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছিল পলাশ। রতনকে দেখেই থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে তেড়ে এল রতনের দিকে। গলার কাছে জামাটা খামচে ধরে বলল, খুব সাহস বেড়েছে, না?

রতন হকচকিয়ে গেল। ছোটনের ব্যাপারটা দেখে এমনিতেই তার স্নায়ু কাজ করছিল না। তার ওপর পলাশের হঠাৎ আক্রমণে খাবি খেতে লাগল। কোনোমতে পলাশের হাতটা ছাড়িয়ে বলল, ‘আমাকে একটু জল দে। নইলে মরে যাব।’

পলাশ জামাটা ছেড়ে ঘরের কোণে রাখা জলের বোতলটা দেখিয়ে দিল। রতন ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে থামল একটু। তারপর আবার জল খেতে গিয়ে বমি করে ফেলল। এবার পলাশের হকচকিয়ে যাওয়ার পালা। রতনকে ধরে না ফেললে ও পড়েই যেত। ওকে বিছানায় বসিয়ে পাখাটা চালিয়ে দিল পলাশ। একটু রাগ রাগ গলাতেই বলল, ‘প্রতাপগড়ে ঢুকেছিলি কেন?’

রতন কিছুক্ষণ চোখে হাত দিয়ে মড়ার মতো পড়ে রইল। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। পলাশ অস্থিরভাবে পায়চারি করল ততক্ষণ। অনেকক্ষণ পর রতন উঠল। একটু সহজ হয়ে বলল, ‘তুই কী করে জানলি?’

– ছাদ থেকে দেখলাম তোকে।

– কেন, তুইও তো যাস…!

পলাশ আবার রতনের গলাটা খামচে ধরতে গিয়েও থেমে গেল। হিসহিস করে বলে উঠল,

– আমি যাই না, যেতাম। ওই বইটা পাওয়া পর্যন্ত।

– বই!

– হ্যাঁ বই। নিষিদ্ধ গাণ্ডিব।

– কোথায় পেলি?

– বাবার পুরোনো বাক্সপ্যাঁটরার মধ্যে ছিল। তবে বাবা বলেন তিনিও ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছেন বইটা। চল দেখাচ্ছি। একটু রাত হোক। বাবা একটু পরেই ক্লাবে চলে যাবেন, মা-ও বেলাকাকিমার বাড়ি, তখন।

– ছোটন ওখানে পড়ে আছে বঁইচির ঝোপে! এই কথাটা তোকে এতক্ষণ বলা হয়নি।

– ছোটন! গড়ে ঢুকেছিল?

– হ্যাঁ।

– বড়ো কুকুর ছিল কোনও ওখানে?

রতনের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন।

– তুই কী করে জানলি?

– এখনই গড়ে যেতে হবে, বই দেখার সময় নেই। এখনও বাঁচানো যাবে ছোটনকে। তাড়াতাড়ি চল।

– এই রাতে? কী করে?

– চল, যেতে যেতে বলছি।

দুটো শক্তিশালী টর্চ, মোটা দুটো লাঠি নিয়ে রতন আর পলাশ চলল প্রতাপগড়ের দিকে। ঝিঁঝি ডাকছে রাস্তার দুপাশের ঝোপে ঝাড়ে। হাওয়াটা ভিজে ভিজে।

রাত্রির পথ শুনশান। এখনও মেঘলা করে রইলেও পদ্মদহের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। ভেজা ভেজা। পলাশ ফিসফিস করে রতনকে বইটার ব্যাপারে বলছিল।

– ওঁ জলবিম্বায় বিদ্যহে নীলপুরুষায় ধীমহি।

ত্রো বরুণঃ প্রচোদয়াৎ।।

বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি শুরু হয়েছে বরুণ মন্ত্রটি দিয়ে। কারণ পরে বলছি। মহাভারত আর পুরাণের একটু বলি। সংক্ষেপে বুঝে নে। দধীচি মুনির নাম শুনেছিস নিশ্চয়ই।

– পিপ্পলাদের গল্পে পড়েছি।

– তবে তো দধীচি মুনির হাড় থেকে তৈরি দিব্যাস্ত্রের নামও শুনেছিস নিশ্চয়ই?

– হ্যাঁ, বিশ্বকর্মা তৈরি করেছিলেন।

– সেই অস্ত্রগুলি, মানে, কালদণ্ড, বজ্র, পাশ ইত্যাদির সঙ্গে গাণ্ডিবও তৈরি হয়েছিল। ব্রহ্মা প্রথম তার মালিকানা পান। তারপর প্রজাপতি, বরুণের হাত ধরে খাণ্ডব দাহনের সময় অর্জুনের হাতে আসে। অর্জুনকে দুবার এই ধনুক ত্যাগ করতে দেখা যায়। এক, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়। গীতার ১:৪৭ অধ্যায়ে। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অবশ্য সে ধনুক তিনি তুলে নেন শেষ পর্যন্ত। আর শেষবারের মতো তিনি গাণ্ডিব ত্যাগ করেন শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকা নগরী সমুদ্রে ডুবে গেলে। সে মহাপ্রস্থানের ঠিক আগে।

তা, প্রতাপরাজারা প্রচণ্ড অত্যাচারী ছিলেন। সেইসঙ্গে অত্যন্ত ধূর্তও। প্রজাদের বিভিন্ন উপায়ে অত্যাচার, খুনজখম, বলপূর্বক রাজস্ব আদায় তো করতেনই। সবচেয়ে বড়ো ভয়ের ব্যাপার ছিল, কোনও একজন অমর ভয়ানক পুরুষ নাকি তাঁর সহায় ছিলেন।

– অমর পুরুষ তাঁর সহায় হতে যাবেন কেন?

– শোনা যায় মানবজাতির ওপর তাঁর প্রচণ্ড রাগ ছিল, প্রতিশোধস্পৃহা ছিল। নিজের বীরত্ব আর অধিকারের যোগ্য সম্মান না পেয়ে তিনি উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। অমর অপ্রাপ্তির জ্বালা বড়ো জ্বালা। রাজা প্রতাপ তাঁর এই দুর্বলতাটুকু কাজে লাগালেন। যিশুর জন্মেরও ৩০৬৭-৩০৭৫ বছর আগে থেকে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে ঘুরে বেরিয়েছেন প্রতিশোধস্পৃহা বুকে নিয়ে। বিশ্বের সবকটি কোণ তাঁর চেনা। যতগুলি দিব্যাস্ত্রের এখনও পর্যন্ত অস্তিত্ব আছে, তার খোঁজ ছিল তাঁর নখদর্পণে। প্রতাপরাজা তাঁর সাহায্যে অর্জুনের গাণ্ডিব খুঁজে বার করেন দ্বারকা সমুদ্রের অতল থেকে। আর এখানেই শুরু হয় ব্যাপারটা।

পলাশের হাতটা রতন চেপে ধরল,

– তার মানে আমরা যে গুপ্তধনের খোঁজ করতে আসি, তা কোনও ধনরত্ন নয়?

– না, সেটাই বলা আছে ওই বইতে। তার সন্ধানও বলা আছে। প্রতাপগড়ের ভিত্তির অনেক নিচে একটি গোপন কুঠুরিতে রাখা আছে সেই গুপ্তধন।

– গাণ্ডিব!

– নিষিদ্ধ গাণ্ডিব।

– নিষিদ্ধ কেন হল?

– তা তো বলতে পারব না। তবে যতদিন পর্যন্ত না ও গাণ্ডিব আবার জলে বিসর্জন দেওয়া হবে, তা নিষিদ্ধই হয়ে থাকবে এবং অযোগ্য কেউ তার খোঁজে গেলে এক ভয়ংকর কুকুরের সামনে পড়বে।

– কুকুর? কুকুর আসবে কেন?

– শ্‌শ্‌শ্‌, পলাশ তর্জনী ঠোঁটে ঠেকাল।

সামনেই প্রতাপগড়ের বিরাট প্রাচীর আকাশের গায়ে আঁকা। সাঁই সাঁই করে পদ্মদহের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে এল কয়েকটা মেঘছেঁড়া বালিহাঁস। পলাশ রতনের কাঁধ খামচে ধরে বলল,

– রতন, কোনও কুকুরের সামনে পড়লে যেন তার পিছনে কোথাও এগিয়ে যাবি না। মুখোমুখি থাকবি। আর অজ্ঞান হওয়া বা হতাশ হওয়া বা মরে যাওয়ার মতো কোনও ভাব দেখাবি না। মনে থাকবে?

মনে থাকবে কি না রতন জানে না। তবুও মাথা নাড়ল। দুর্গের ভাঙা ফাটল দিয়ে ওরা গড়ের চৌহদ্দিতে ঢুকে গেল।

দুর্গের টিকে থাকা অংশটা প্রস্থ বরাবর অশেষ মনে হয়। আটটা মিনারের মাথায় মাথায় লোহার বিদ্যুৎবাহ। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল ঝুঁকে পড়েছে গবাক্ষের ওপর। গড়ের চূড়া থেকে হঠাৎ শোনা যায় ডানার শব্দ। কিছু একটা উড়ে গেল শব্দ করে।

– পাথরগুলো হলুদ, জানিস? রতন বলল।

– তোর এখন পাথরের রং মনে পড়ছে?

রতন হেসে উঠল। একটু কষ্ট কষ্ট হাসি।

– আমার বাবা মা তো কেউ নেই। তোদের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করি। ছোটনকে ওভাবে দেখে মাথাটা ঠিক নেই।

পলাশ এগিয়ে এসে রতনের কাঁধে হাত রাখল। আশ্বাসের সুরে বলল, ‘চল। হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।’

পশ্চিমের দরজাটা দিয়ে ঢুকলে একটা খুব নিচু ছাতওয়ালা জায়গা পার হতে হয়। ওদের দুজনকে মাথা নিচু করে যেতে হল এ অংশটুকু। নিকষ অন্ধকারে পরস্পরের পায়ের শব্দটুকু শোনা যাচ্ছে। বনের মধ্যে পলাশ আলো জ্বালায়নি, অন্য কারও চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বা কুকুরটার নজরে পড়ে যাওয়ার ভয়েও হয়তো। প্রাচীরের আড়ালে পৌঁছে আর সে ভয়টা নেই। কোমরে গোঁজা টর্চটা জ্বলে উঠল এবার।

পাথুরে চাতালটায় একবার টর্চের আলোটা ঘুরিয়ে নিল পলাশ। রতনকে ফিসফিস করে বলল, ‘একদম উল্লম্ব তিনটে কুয়ো আছে। পরস্পরের সঙ্গে লম্বালম্বি তেরোটা করে সিঁড়ি দিয়ে জোড়া। একদম শেষ কুয়োর গহ্বরে আছে ওটা।’

বুকটা ধ্বক্ করে উঠল রতনেরর। এই কি সেই গাণ্ডিব দেখার মুহূর্ত?

দুটো ছোটো ছোটো ঘর ছুঁয়ে অলিন্দ শেষ হয়েছে দেয়ালঘেঁষা সিঁড়ির কাছে। চওড়া পাথুরে সিঁড়ি। বাইরের দেয়াল হলুদ পাথর দিয়ে তৈরি হলেও, অন্দরের সব কাজ নিকষ কালো পাথরের। সিঁড়ির ডানদিকে দেয়াল। তার বাঁদিকে কোনও বাধা নেই। তেরোটি ধাপ পার হলে একটা গোল উঠোন মতো জায়গায় পড়তে হয়। ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে একটা কুয়ো। পলাশ ছুটে গেল সেদিকে। কুয়োর গভীরে আলোটা নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। রতন ওর পিছনে এসে দাঁড়াল। বইটা খুলল পলাশ। একদম শেষ পাতায় কালো স্কেচে আঁকা ছবি। ভালো করে আলোটা ছবির ওপরে বুলিয়ে পলাশ বলল, ‘এটায় নেমে, আরও একটা। তারপর সেই গহ্বরও পার হয়ে, শেষে আসল জায়গা।’

জায়গাটা গরম হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। পলাশ জামাটা খুলে কুয়োর পাশে রেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কতদিনের অব্যবহৃত সিঁড়ি কে জানে? কিন্তু মনে হয় এখানে কেউ আসে না। ধুলোবালি বেশ কম। তেরোটা সিঁড়ি নামার পর দ্বিতীয় কুয়োর মুখ। টর্চটা কিছুক্ষণের জন্য নিভিয়ে রাখল পলাশ। নিস্তব্ধ জায়গায় আলোরও যেন একটা শব্দ শোনা যায়। আলোটা নিভে যেতেই রতনের পায়ের শব্দ শোনা গেল ঠিক পিছনে। উদ্বিগ্ন গলায় সে বলল, ‘কী রে থামলি কেন?’

– একনাগাড়ে টর্চ জ্বললে সেল বসে যাবে। এবার তোর হাতেরটা জ্বালা।

অবাক গলায় রতন বলল, ‘এ কোথাকার বোকা রে! টর্চ জ্বালতে কে বলেছে? এ তো আর আঁকাবাঁকা গলি নয়। আর ছবিতে তো দেখাই গেল সোজা সিঁড়ি দুনম্বর কুয়ো হয়ে নেমে গেছে। পা বাড়ালেই তেরো-তেরো ছাব্বিশ সিঁড়ি পার হলেই পৌঁছে যাব।’

একটা দমবন্ধ করা অথচ তীব্র আরামের গরম পলাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব, খুব কাছেই একটা উষ্ণতার বিরাট উৎস রয়েছে। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও পলাশ দেখতে পাচ্ছে বিরাট এক ধনুক। সোনার ধনুক। যার একটিমাত্র আঘাতে দশ লক্ষ জীবিত মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

এই তো বাইশ… চব্বিশ… পঁচিশ। রতন গুনছে। আর মাত্র কয়েক পা।

একটা চাপা গর্জন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল কোথাও। দশটা রাজগোখরোর আফসানির মতো সে শব্দ। দুটো টর্চ জ্বলে উঠল।

উঃ, কী ভয়ানক!

বিরাট কালো কুকুরটা বিরাট বিরাট দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাইরে ঝুলে পড়েছে লাল টকটকে জিভ। নিঃশ্বাসবাষ্প থেকে ছিটকে পড়ছে আগুনের ফুলকি। একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো গরম হয়ে উঠেছে জায়গাটা।

পলাশ মোটা লাঠিটা এগিয়ে ধরল। গম্ভীর গলায় কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘যা, আমি যাব না।’

আশ্চর্য হয়ে রতন দেখল কুকুরটা আর পলাশের দিকে তাকালও না। রতনের দিকে এগিয়ে এল। রতনের হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। পলাশ চেঁচিয়ে উঠল, ‘খবর্দার রতনা, মরার ভয় মনেও আনবি না। ও কিচ্ছু করতে পারবে না।’

রতনের চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। টলছে রতন। কাঁপছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে পড়ে যাবে। আর তখনই ওই কুকুর তাকে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর পথে। কিন্তু পলাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মনে মৃত্যুভয় এলে হবে না বিন্দুমাত্র।

তখনই লোকটা বেরিয়ে এল একটা দেওয়ালের পাশ থেকে। অদ্ভুত একটা কালো পোশাক তার গায়ে। পলাশের হাত ধরে সে নিয়ে চলল রতন যেখানে আছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। একটি আলো, যার কোনও উৎস নেই, পথ দেখাচ্ছে ওদের। অনেক অলিন্দ গলিঘুঁজি পার হয়ে ওরা পৌঁছোল প্রতাপরাজার প্রাচীন অস্ত্রাগারে। মরচে ধরা বর্শা, তলোয়ার, সড়কি, লোহার দণ্ড, শূল ছড়িয়ে আছে। তারই মধ্যে পড়ে থাকা একটা ধুলোর আস্তরণ পড়া ছিলাছেঁড়া ধনুক দেখিয়ে লোকটা বলল, ‘এখনই ওটা পদ্মদহের জলে ফেলে এসো। তিনবার বরুণমন্ত্র উচ্চারণ করবে বিসর্জনের আগে।’

এই তবে সেই গাণ্ডিব! এমন ছন্নছাড়া দিব্যাস্ত্র! অবাক হয়ে পলাশ ভাবছিল এই ধনুকই এক মুহূর্তে দশ লক্ষ মানুষ ধ্বংস করে দিতে পারত!

লোকটা হিসহিস করে বলে উঠল, ‘সময় কম, যাও। নইলে তোমার বন্ধুদের বাঁচাতে পারবে না।’

পলাশ ধনুকটা হাতে নিল।

গাণ্ডিব!

নিষিদ্ধ গাণ্ডিব!

তখনই পাতালপুর পূর্ণ হয়ে গেল এক ভয়ানক গর্জনে। আর ভারী পায়ের শব্দ ছুটে আসতে লাগল অস্ত্রাগারের দিকে। পলাশ বিহ্বল অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে লাগল। লোকটা ওকে প্রাণপণে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘তোমার মনেও মৃত্যুভয় ঢুকেছে পলাশ। গাণ্ডিব বিসর্জন না হলে তুমিও বাঁচবে না। যাও!’

একটা গলির মধ্যে পলাশকে ঢুকিয়ে দিল লোকটা। পলাশ ছুটছে। প্রচণ্ড বেগে ছুটছে। রাস্তাটা ঢালু হয়ে আসছে ক্রমশ। পিছনে ভয়ানক গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে বিশাল কুকুরটা। একসময় পলাশ পড়ে গেল। গড়াতে লাগল ঢাল বেয়ে। হাত পা ছড়ে যাচ্ছে।

হাত থেকে ছিটকে গেল ধনুকটা!

অর্ধমৃত অবস্থাতেও পলাশের প্রথম যা মনে হল, তা হল, ছোটন আর রতনকে বাঁচানো গেল না। নিজেও হয়তো বাঁচবে না আর। পিছনে প্রায় উড়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

ঢালটা শেষ হল। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। পদ্মদহের জলে তার ছায়া পড়েছে। এসব আর দেখতে পাবে না ও। অবসন্ন পলাশ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল। ভর দিয়ে উঠে বসতে গিয়েই হাতটা একটা ধাতব বস্তুকে ছুঁয়ে গেল।

এই তো! এই তো গাণ্ডিব!

শরীরে দুনো বল এল পলাশের। দু-হাতে ধনুকটা তুলে নিয়ে চিৎকার করে পরপর তিনবার বলল,

“ওঁ জলবিম্বায় বিদ্যহে নীলপুরুষায় ধীমহি।

তত্রো বরুণঃ প্রচোদয়াৎ।।”

.

তারপরই ধনুকটা ছুড়ে দিল পদ্মদহের জলে। ভয়ানক কুকুরটাও পলাশের কানের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে জলে পড়ল। বীভৎস একটা চিৎকারে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল পলাশ।

লোকটা ওর ঠিক সামনে বসে মুখে একটা সবুজ তেতো রস ঢেলে িদচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসল পলাশ। ফোয়ারার ঠিক পাশটায় বসে আছে রতন আর ছোটন। ছোটনের মাথায় একটা কাপড় বাঁধা। তাতেও সবুজ সবুজ একটা তরলের ছোপ।

পলাশ লোকটাকে বলে উঠল,

– কুকুরটা নেই তো?

– না, সে আর আসবে না।

– ওটা কী জন্তু?

লোকটা মৃদু হাসল।

– জন্তু নয়। গাণ্ডিব ওরও সম্পদ। আর দেবতাদের মধ্যে এ কলিযুগে পৃথিবীতে আসার ক্ষমতা একমাত্র ওরই আছে।

– ও দেবতা? তিনজন সমস্বরে বলে উঠল।

– হ্যাঁ, তোমরা চেনো ওকে। মহাপ্রস্থানের ঠিক আগে অর্জুন গাণ্ডিব বিসর্জন দিয়েছিলেন। তখন কুরুপাণ্ডবকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ও এসেছিল। মৃত্যুইচ্ছা মনে জেগে উঠলেই ও আসে। আসে হতাশা বা জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠলেও।

– মহাপ্রস্থানের কুকুর, মানে ধর্মদেব?

– হ্যাঁ, তাঁর আর-এক নাম যমও বটে। ব্রহ্মা, প্রজাপতি, বিষ্ণু ও শিবের পর গাণ্ডিব যমেরই সম্পদ ছিল। তারপর বরুণ পান। বরুণের হাত থেকে অর্জুন।

রতন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– রাজা প্রতাপ এ ধনুক সংগ্রহ করেছিলেন কেন?

– সে মূর্খ! ভেবেছিল ওই ধনুক সে মানুষের ধ্বংসের কাজে লাগাবে। সে জানত না গাণ্ডিব একমাত্র পাপের বিরুদ্ধেই কাজে লাগে। পাপকাজে ব্যবহার করলে তার সব দৈবী শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। দেখলে না সাধারণ লোহার ধনুকের মতোই ওটাকে লাগছিল। প্রতাপের কোনও কাজে লাগেনি। আর ওরই বা দোষ কী? সাধারণ লোভী মানুষ। সব বেদ, উপনিষদ, ব্রাহ্মণ, বিজ্ঞান জানা আমিও তো তার প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে গাণ্ডিব তুলে এনেছিলাম পশ্চিম সমুদ্রের গভীর থেকে। আমার কারণেই তো গাণ্ডিব নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ওই ভয়ানক কুকুরের রোষে পড়ে সবংশে ধ্বংস হয়েছে প্রতাপ। সেও তো আমারই কারণে।

.

শিউরে উঠল ওরা তিনজন। এই ভোরের আলোতেও ওরা শিউরে উঠল। লোকটা মৃদু হাসল। করুণ হাসি।

– ভয় পেয়ো না। আমি দানব বা প্রেতাত্মা নই। এক সাধারণ অভিশপ্ত অমর মাত্র। যম আমাকে নিয়ে যেতে পারেননি, কারণ ব্রহ্মার বরে আমি অমর।

পলাশ বলল, ‘তুমি যদি সে হও, তোমার তো সব অস্ত্রের ব্যবহার, মন্ত্রশাস্ত্র জানা। তুমি কেন গাণ্ডিব বিসর্জন দিলে না?’

লোকটার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। ভেজা গলায় সে বলল, ‘বাবার অভিশাপে। ক্রোধকে তোমরা জয় করতে শিখো। ওর চেয়ে বড়ো ভুল আর হয় না। আসি।’

.

লোকটা চলে গেল। লম্বা লম্বা পায়ে জলপাই বন পার হয়ে গেল। সেই অদ্ভুত কালো পোশাকটা বনের মধ্যে হারিয়ে গেল যেন চিরকালের মতো।

রতন ফিসফিস করে বলল, ‘লোকটা কী ভুলভাল বল? ও ঠিক পারত ধনুকটা বিসর্জন দিতে।’

পলাশ রতনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহারের অপরাধে ব্রহ্মা ওঁর সব অস্ত্রজ্ঞান কেড়ে নিয়েছিলেন। উনি তাই পারেননি। নিষিদ্ধ গাণ্ডিব বিসর্জন দিতে পারেননি অশ্বত্থামা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *