বিপত্তারণের বিপদ

বিপত্তারণের বিপদ

ভোরের দিকে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়াটা বেশ আসছিল। পাশ ফিরে বালিশটা চেপে ধরতেই জানালা ঘেঁষে কেউ খুব স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল, ‘ক্লেশ।’

এত জোরালো সে উচ্চারণ যে বিপত্তারণ ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘুমের একদম গভীর থেকে সরাসরি জাগরূক অবস্থায় পৌঁছে গেছে সে। উচ্চারণের ধরনটিও বড়ো অদ্ভুত। শুধুমাত্র গলা দিয়েই যেন কথাটা বলা। ঠোঁট, দাঁত, জিভ দিয়ে বলা কথা শুনতে এমনটা হয় না।

বাইরে একটু মাজা মাজা অন্ধকার। ঝোপঝাড়গুলো ঠিক স্পষ্ট হয়ে না উঠলেও, একটা আঁকা আঁকা আকার বেশ বোঝা যাচ্ছে তাদের। বিপত্তারণ বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে যে সে স্বপ্ন দেখেনি। তার কারণ সে দেখতে পাচ্ছে জানালার ওপাশেই অস্পষ্ট অন্ধকারে একটা অদ্ভুত মূর্তি একটু কুঁজো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝলঝলে একটা পোশাক তার দেহের দুপাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে। হাতে একটা লম্বা লাঠির মতো কিছু আছে লোকটার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা বাঁকাচোরা বুড়ো গাছ উঠোনময় পায়চারি করছে। কপাল আর গলার কাছটায় একটা ঠান্ডা ভেজা ভেজা ভাব বুঝতে পারছিল বিপত্তারণ। তাড়াতাড়ি উঠে ঢকঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে নিল। পা টিপে টিপে বিছানায় ফিরে এসে দেখল উঠোনে কেউ নেই। শ্বেত স্থলপদ্ম আর করবী গাছগুলো চুপ করে কালো হয়ে আছে। আলো ফোটার আগে জানালা থেকে চোখ ফেরানোর আর সাহস হল না বিপত্তারণের।

.

গোলোকপুরে এসে জীবনে এই প্রথম ভয় পেল বিপত্তারণ। জায়গাটা এমনিতে তার খুব পছন্দের। তিন মাস হল সে এখানে এসেছে। প্রথম দেখাতেই জায়গাটা তার ভালো লেগে গিয়েছিল। পাথর আর ঘাসে মেশানো বিরাট বিরাট মাঠ সোজা উত্তর-পশ্চিমে ছুটে গেছে কালো কালিতে আঁকা দিগন্তপাহাড়ের দিকে। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো শাল সেগুনের বন। পাহাড়ের ওপর ছোট্ট সাদা মন্দির। গোলোকপুরের বাজার খুব বিখ্যাত। বড়ো বড়ো কাপড়ের দোকান, সবজি বাজার, মাছ বাজার, ফলের দোকান মিলিয়ে গোলোকপুর বেশ জমাটি জায়গা। খুব ধুমধাম করে কালীপুজো হয় দীপাবলির সময়। বাজার এলাকাতেই প্রায় সাতটা পুজো। তারপর গ্রামের আনাচেকানাচে তো আরও আছেই। পুজোর ঠিক চার-পাঁচ মাস আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে মূর্তির কারিগর গোলোকপুরে এসে হাজির হয়। এখানেই থাকা খাওয়া, মূর্তি বানানো। দীপাবলির ঠিক এক সপ্তাহ পরে পারিশ্রমিক আর বকশিশ নিয়ে যে যার দেশে ফিরে যায়।

বিপত্তারণ বর্ধমানের পুবদিকের কোন গ্রাম থেকে গোলোকপুরে এসেছিল। তার দলের সে সর্দার। অন্য কারিগরের পল্টন মূর্তি তৈরির ওয়ার্কশপের লাগোয়া ঘরে রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া করে। সর্দার মূর্তিকারের খাতির একটু আলাদা। রাতটুকু সে কারখানা থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথের দূরত্বে একটা ছোট্ট দু-কুঠুরির বাড়িতে ঘুমুতে আসে। ছোট্ট বাগান। পশ্চিমে ছোট্ট একটা নদী। পাহাড়ের রেখা উত্তরে। পুবদিকে বাগান পার হয়ে রাস্তা আর শালবন।

যে ক্লাবের পুজোর হয়ে সে মূর্তি গড়তে এসেছে, তার সেক্রেটারি রামজীবন সেন। জাঁদরেল পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন একসময়। এখন রিটায়ার করে পুজো, ক্লাব আর মাছধরা নিয়ে বেশ আছেন। দোতলা ছড়ানো বাড়ি। বাগান পুকুর ফুলফলের গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িটা দেখার মতো।

সকাল আটটা নাগাদ বিপত্তারণ শুকনো মুখে রামজীবনের বাড়িতে হাজির হল। এ সময়টা রামজীবন বাজারের ফর্দ তৈরি করেন। রামজীবনের ফর্দ তৈরি করা যে দেখেনি, সে বিশ্বাসও করবে না এমনভাবে বাজারের ফর্দ তৈরি করা যায়। এক এক করে মালি, দারোয়ান, রাঁধুনি, গিন্নি, ছেলে, বউমা, নাতি, নাতনিকে তিনি ডেকে পাঠান। তারপর তাঁদের প্রতিদিনকার দরকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লিখে নেন জবানবন্দি লেখার মতো করে। লেখা শেষ করে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে স্টেপলার দিয়ে সেঁটে পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে নেন। এরপর বাজার যাওয়ার পালা। টানা দু-ঘণ্টা ধরে বাজার সেরে দুই চাকরের মাথায় বাজার চাপিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসার আগে বাজারের পুরো হিসেব করে পৃষ্ঠার গোছা একটা বিশাল বাঁধানো খাতায় সেঁটে রাখেন। প্রতি বছর সংক্রান্তিতে সেই খাতা চলে যায় চিলেকোঠায়। নতুন খাতা আসে সিঁদুর হলুদ মেখে।

বিপত্তারণ যখন পৌঁছোল রামজীবনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আদ্যাশক্তি দেবীর তুমুল বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। ব্যাপারটা তিন কেজি বেগুন নিয়ে। রামজীবন গলা ফাটিয়ে বলছেন,

– তুমি নিজে মুখে বললে তিন কেজি বেগুনের কথা, আর আজ বলছ আমি মিছিমিছি বেগুন এনেছি?

আদ্যাশক্তি দেবীও কম যান না। তিনি অবশ্য গলা তুলে চিৎকার চেঁচামেচি করেন না। গলা মোটা করে বললেন,

– এ লোকটা কিছুত্তেই কানের যন্ত্রটা সকালবেলায় পরবে না। বলছি বিন-সুজি-বেসন, এ চেঁচিয়েই যাচ্ছে তিন কেজি বেগুন… তিন কেজি বেগুন। আমি চললুম রান্নাঘরে, তোমার পাগলামির খোরাক হওয়ার সময় নেই আমার।

আদ্যাশক্তি দেবী আঁচল ঘুরিয়ে অন্দরমহলের দিকে চলে গেলেন। রামজীবন আবার চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বিপত্তারণ এগিয়ে এসে খাতাটায় বিন, সুজি আর বেসনের নাম তিনটে লিখে দিয়ে রামজীবনের চেয়ারের পাশে রাখা বেতের ঝুড়িটায় বসে পড়ল। রামজীবন এহেন দুঃসাহসে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বিপত্তারণের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপরের চিৎকারটা ঢোক গিলে নিয়ে খাতাটা দেখলেন। ভারী অপ্রস্তুত হয়ে সেগুন কাঠের আরামকেদারাটায় বসে কানের যন্ত্রটা পরে নিলেন। কিছুই যেন হয়নি এমন একটা ভাব করে বেশ কিছুক্ষণ পা নাচানোর পর বিপত্তারণকে যেন হঠাৎই দেখতে পেয়েছেন এমনভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,

– আরে বাবা বিপদ যে, সাতসকালে কী মনে করে?

বিপত্তারণ শুকনো মুখে বলল,

– আজ্ঞে, আমার বড়ো বিপদ।

রামজীবন সোজা হয়ে বসলেন,

– বলো কী হে? তুমি আমার অতিথি, তোমার আবার বিপদ কী হে?

– আজ্ঞে ক্লেশ মানে তো কষ্ট, নাকি?

– হ্যাঁ, তাই তো। তাতে কী? তুমি কি গোলোকপুরে ব্যাকরণের ক্লাস করতে এয়েচ, না কালীদাস মাস্টার তোমাকে আবার হেনস্থা করেছে? চলো দেখি, তার একটা ক্লাস নিই আজ।

– দাঁড়ান দাঁড়ান, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। শুনুন মন দিয়ে।

বিপত্তারণ যে ছেঁদো কথার লোক নয়, সেটা রামজীবন বিলক্ষণ জানেন। ঘটনাটা আনুপূর্বিক শুনে রামজীবন গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দারোয়ান এসেছিল ততক্ষণে বাজারের জবানবন্দি লিখিয়ে নিতে। তাকে বিদেয় করে ছেলের হাতে বাজারের দায়িত্ব দিলেন রামজীবনবাবু। তারপর পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিয়ে বিপত্তারণকে বললেন,

– চলো।

– কোথায়?

– ঠিকুজি কুষ্ঠি বংশলতিকা কিছু আছে সঙ্গে?

– আজ্ঞে না, ভোটার আর আধার কার্ড আছে।

– অ। তবে খালি হাতেই চলো। দেখি কী করা যায়।

তাঁকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

শুভময় ভট্টাচার্যের বাড়ি গোলোকপুরের পশ্চিম সীমানায়। তিনি মিশুকে না আত্মকেন্দ্রিক সেটাই আজ পর্যন্ত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। নিজের মতো থাকেন ছোট্ট বাড়িটায়। যেচে কারও সঙ্গে আলাপ করতে যান না। কিন্তু কেউ দৈবাৎ তাঁর কাছে গিয়ে পড়লে এত সুন্দর আপ্যায়ন করেন, আগন্তুক অবাক না হয়ে পারে না। রামজীবন আর বিপত্তারণ যখন শুভময়ের বাড়ি পৌঁছোলেন, তিনি বারান্দায় বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা পুরোনো পুথি দেখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাতেই তাঁর মুখে একটা অনাবিল হাসি খেলে গেল। মিষ্টি গলায় বললেন,

– আরে রামজীবন যে, এসো ভাই, এসো। সঙ্গে উটি বিশ্বকর্মা না?

রামজীবন কিছু বললেন না। বারান্দায় সারি সারি বেতের চেয়ার রাখা ছিল। তার একটিতে বসে পড়লেন। বিপত্তারণ বসল না। শুভময় একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,

– রামজীবন, এত গম্ভীর কেন? কিছু হয়েছে?

রামজীবন বিপত্তারণের দিকে তাকালেন। বিপত্তারণ হাত জোড় করে বলল,

– ঠাকুরমশাই বড়ো ভয় পেয়েছি, উদ্ধার করতে হবে।

শুভময় হাত ধরে বিপত্তারণকে বসালেন। কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,

– তুমি শান্ত হয়ে বসো, তারপর ঘটনাটা আমাকে বলো।

বেলা গড়িয়ে গেল অনেকটা। শুভময়ের মেয়ে কাজলি তিনজনের জন্য চা দিয়ে গেল। সঙ্গে ঘরে ভাজা মুচমুচে নিমকি। কিন্তু বিপত্তারণের ঘটনা শোনার পর কারও হাত উঠল না। খুব চিন্তিত গলায় শুভময় বললেন,

– ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না হে রামজীবন। কিছু একটা অশুভ ঘটতে চলেছে বিপত্তারণের জীবনে। আর এমন কোনও ব্যাপার আগে আমি শুনিনি, তাই নিদানও অজানা।

বিপত্তারণের মুখটা ছাইয়ের মতো দেখাচ্ছিল। রামজীবন নিরীহ ছেলেটিকে খুব ভালোবাসতেন। আকুতির সুরে বললেন,

– কিছু করা যায় না কি শুভময়? প্রেত পিশাচ তো তোমার হাতের মুঠোয়।

মাথা নাড়লেন শুভময়।

– উঁহুঁ, এ প্রেত পিশাচ নয়। আরও গভীর কিছু।

বিপত্তারণ বলে উঠল,

– আমি আজই বাড়ি চলে যাব, এখানে থাকব না।

একটা করুণ হাসি হেসে শুভময় বললেন, নিজেকে ছেড়ে কোথায় যাবে বিপত্তারণ? ক্লেশ, আনন্দ সবই তো নিজেরই। তুমি যেখানে যাবে, ও তোমার পিছু নেবে। পালানো কোনও সমাধান নয়। রুখে দাঁড়ানোটাই আসল ব্যাপার। আর আমরা তো আছিই সঙ্গে। তুমি কাজে যাও। রোজগার বন্ধ হওয়াটাও তো কাজের কথা নয়। তুমি সাহস রাখো। একটা কিছু করা যাবেই। সবার অশুভর ওপরে তিনি আছেন। ভরসা রাখো।

.

বাজারের মুখটায় এসে রামজীবন বাড়ির দিকে চলে গেলেন। হঠাৎই বিপত্তারণ দেখল সে খুব একা। চারিদিক লোকে লোকারণ্য, বাজাড়ু লোকের আসাযাওয়া, সাঁ সাঁ করে ছুটে যাওয়ার ট্রাকের শব্দ— কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।

বাজারে ঢোকার মুখে একটা বিশাল বটগাছ। তার নিচে বেদিটার ওপর এক সাধু। সোজাসাপটা চেহারা। অতিরিক্ত ভড়ং নেই। গালে হালকা কাঁচা দাড়ি। গেরুয়া পোশাক। বিপত্তারণের মনে হল তাকে দেখেই যেন একটু মুচকি হেসে সাধু গেয়ে উঠলেন,

“দুঃখ যদি নাই পাবে গো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?”

বেশ বেলা করে বিপত্তারণ কারখানায় ঢুকল। সারি সারি মূর্তি তৈরি হচ্ছে। মেলা লোক। কেউ বাঁশ দিয়ে কাঠামো তৈরি করছে। কেউ আবার তাল তাল মাটি মাখছে। জল কম বেশি হচ্ছে। আবার তাতে নতুন কাদা বা জল ঢালা হচ্ছে। তিনটি মূর্তি বেশ শুকিয়ে এসেছে। কারখানার এক কোণে সেগুলি রাখা। তিনটি কর্মচারী তাতে রঙের পোঁচ দিচ্ছে। বিপত্তারণ কারখানার এক কোণে রাখা কাঠের চেয়ারটায় বসে কাজ দেখতে লাগল। দেখা ওই নামমাত্রই। তার চোখ সার সার মাটির মূর্তি, লোকজন, কারখানার দেওয়াল ভেদ করে চলে গেছে অনেক দূরে। কে একজন সেই বলেছিল না, ‘আমি দেখছি না, তাকিয়ে আছি’, বিপত্তারণের হয়েছে সেই অবস্থা। বেশ খানিকটা সময় থুম মেরে বসে থাকার পর তার অন্যমনস্কতার পর্দাটা ছিঁড়ে গেল বৃন্দাবনের চিৎকারে। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল বিপত্তারণ। চিৎকারটা এসেছে মূর্তিগুলো যেখানে রং করা হচ্ছে, সেদিক থেকে।

হনহন করে সেখানে পৌঁছে বিপত্তারণের চক্ষুস্থির। বৃন্দাবন বিপত্তারণকে দেখে আরও তেতে গেল।

– দ্যাকো বাবা বিপত্তারণ, দ্যাখো, হতচ্ছাড়া নিবারণের কাজ দ্যাখো। আকাটটা শ্যামা মায়ের গায়ে লাল রং চড়িয়ে রেখেছে। এ যে চরম অকল্যাণের লক্ষণ গো।

নিবারণ কাজের ছেলে হলেও, বয়সটা অল্প। মাথা নিচু করে গোলাপি কালীমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের তুলিটা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সিঁদুরে লাল রং। বিপত্তারণ বেশ বুঝতে পারল তার ‘ক্লেশ ‘শুরু হয়ে গেছে। নিবারণকে হাতের ইশারায় তার চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বৃন্দাবনকে বলল, “কাকা, মায়ের মূর্তিতে পুরো সাদা রং মেরে দাও, তারপর আমি দেখছি।”

চেয়ারে বসে আছে নিবারণ। বাকিদের কাজ বুঝিয়ে বিপত্তারণ তার কাছে গেল। মুখ তুলল ছেলেটা। চোখে জল। বিপত্তারণ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

– কাঁদিস না। কী হয়েছে বল তো? তুই তো এমন ভুল করিস না।

নিবারণ চোখের জল মুছে যা বলল, সেটা শুনে এই দুপুরবেলাতেও বিপত্তারণের গায়ে কাঁটা দিল।

গোলোকপুর ছাড়া অন্য কোথাও মূর্তি তৈরির কাজে গেলে সাধারণত লাল রঙে গাঢ় বাদামি রং মিশিয়ে কালীর জিভের রং তৈরি করে। গোলোকপুরে কালীর গায়ে বিন্দুমাত্র লাল ছোঁয়ানো বারণ। নিবারণের কথা অনুযায়ী ধারেকাছে কোথাও ওই দুটি রঙের একটিও ছিল না। শুধু তুলিতেই ওই রংটি দেখে সে নিজেও খুব অবাক হয়েছে। এরপর আর কথা হয় না। বিপত্তারণ নিজেও জানে, নিবারণ খুবই দক্ষ রংশিল্পী। আর খুব অল্প বয়স থেকে ও এ কাজ করছে। নিবারণের বাবা সারদাচরণ ছিলেন বিপত্তারণের নিজের গুরু। তাঁর আশীর্বাদ আর শিক্ষার গুণেই বিপত্তারণ আজ প্রধান কারিগরের জায়গায় পৌঁছোতে পেরেছে। নিবারণকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়ে বিপত্তারণ আবার মূর্তিগুলোর কাছে গেল। বৃন্দাবন বাদে বাকি সবাই সেখানেই আছে। একমনে তারা কাজ করে চলেছে বাকি দুটি প্রতিমার ওপর।

লাল কালীমূর্তি এক বিঘত লম্বা মেটেরঙের জিভ করে হাসছে।

প্রতিমার পায়ের সামনে মেঝের ওপর পড়ে আছে নিবারণের লাল রঙে ভেজা তুলি।

আর তার পাশে রঙের কৌটো। তাতে গাঢ় কালো রং।

বিপত্তারণ শিউরে উঠল আবার। শরীরটা খারাপ লাগছে। বৃন্দাবন সাদা রং নিয়ে ফিরে আসছে। তাকে দেখে বিপত্তারণ বলল, ‘কাকা, আজ আপনারা কাজ চালিয়ে নিন। আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি।’

বৃন্দাবন একটু ধরা গলায় বলল, ‘যাও। আর কী করবে? আমরা দেখে নিচ্ছি।’

.

কয়েক পা হেঁটে দরজার দিকে এগোতেই বৃন্দাবনের গজগজানি শুনতে পেল বিপত্তারণ। কথাগুলো তিরের মতো বিঁধল তার কানে।

‘সারদাচরণের যে কী ভীমরতি হয়েছিল যে এ ছোঁড়াকে প্রধান কারিগর করে চোখ বুজল! খেটে আমরা মরব আর বাবু পায়ের ওপর পা তুলে বেশির ভাগ টাকা পকেটে পুরবে।’

আজ আর কিছুতেই আশ্চর্য হচ্ছে না বিপত্তারণ। যে বৃন্দাবন তাকে এত আগলে রাখে, বাবা বাছা ছাড়া কথা বলে না, তার মুখে এত কড়া কথা শুনেও সে আশ্চর্য হল না। খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিপত্তারণের কেন যেন মনে হচ্ছিল, দুটো সাপের মতো চোখ তাকে দেখছে। শুধু দেখছে না, তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত ছ্যাঁদা করে ফেলছে। বুকের ভিতরটায় একটা অসহ্য যন্ত্রণা। একবার কারখানার ভিতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল সে।

নাহ্, কেউই তাকে দেখছে না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। নিবারণ মাথা নিচু করে চোখ মুছছে। মাটি, কাদা, জল, রং, তুলি, বাঁশ, খড়— সব আগের মতোই রয়েছে।

শুধু বিপত্তারণেরই বড়ো বিপদ। বড়ো ক্লেশ।

গলার ভিতরের দলা পাকানো কান্নাটা চোখ উপচে বেরিয়ে আসার আগেই, প্রায় দৌড়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে গেল বিপত্তারণ।

রাস্তার বেরিয়ে বাজার এলাকায় পৌঁছোতেই রামজীবনের নাতি বাঁশির সঙ্গে বিপত্তারণের দেখা। বাঁশির হাতে একটা প্রজাপতি ধরার জাল। বিপত্তারণের কোমর ধরে প্রায় ঝুলে পড়ে সে বলল, “আমাকে একটা মাটির লাল ভালুক বানিয়ে দেবে গো বিপদদাদা?”

বিপত্তারণ বুঝল লাল কালীমূর্তির খবর চাউর হতে আর বাকি নেই। নৃসিংহ সিংহের কানে কথাটা গেলে কী হবে ভেবে তার কপালে বড়ো বড়ো ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। তাঁর নির্দেশে এ অঞ্চলের কালীর জিভ পর্যন্ত হালকা গোলাপি রঙের রাখা হয়। জবাও দেওয়া হয় গেরুয়া রঙের। অনেকটা দূরে বলি হয়, যাতে লাল রক্ত ছিটকে মায়ের মূর্তিতে লাগতে না পারে। গোলোকপুরের কালীমূর্তিতে লাল রং ছোঁয়ানো বারণ।

ভোরবেলায় দেখা আবছা কুঁজো মূর্তিটার সঙ্গে সে যেন কোথায় নিজের মিল খুঁজে পেল। ধুঁকতে ধুঁকতে অনিশ্চয়তার আবছা অন্ধকার বুকে নিয়ে সে বাড়ির পথে চলল।

ছোট্ট নদীটা গোলকুণ্ডপুরকে পশ্চিম দিক দিয়ে কিছুটা ছুঁয়ে চলে গেছে দক্ষিণে। সেখানে, নদীর পশ্চিম পাড়ে শালবন। তার গভীরে একটি ছোট্ট গ্রাম। কবে যেন অন্য রাজ্য থেকে আসা একদল বীর ব্রাহ্মণ জাতি বসতি স্থাপন করেছিল। তবে তাদের বংশগৌরব বিশেষ কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তারা এখানে পৌঁছোনোর পর এক বিরাট রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পায়। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিশাল রাজবাড়ির এখন ছন্নছাড়া দশা। দিনেদুপুরে শেয়াল ঘোরে। বাঘ ডাকে। রাজবাড়ির একটা দিক পরিষ্কার করে বসবাস তারা শুরু করল বটে, কিন্তু অন্নসংস্থানের কোনও সুরাহা হল না। আদি বংশগৌরব দিয়ে তো আর পেট ভরে না। তাই যতদিন পার হতে লাগল, বহিরঙ্গের আভিজাত্য ত্যাগ করে তারা নদীর পূর্বপাড়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করল।

সে নদী অবশ্য নামেই নদী। বর্ষায় হাঁটু অবধি ঘোলাজল উন্মাদ স্রোতে বয়ে যায়। শীত গ্রীষ্মে সে খটখটে শুকনো নালা। নদীর পাড় চন্দন রঙের পাটকিলে বেলেপাথর দিয়ে তৈরি বলে তারা ওই নদীর নাম দিল চন্দননালা।

সে আজ পাঁচশো বছর আগের কথা।

গোলকুণ্ডপুর তখন বেশ উন্নত শহর। সেখানে বড়ো বাজার বসে। দেশের বিভিন্ন দিক থেকে বস্ত্র, সুগন্ধি, ফলফুল আমদানি হয়। আর স্থানীয় ধূপ, চন্দন, শালকাঠ, গামার কাঠ রপ্তানি হয় দূর দেশে। কঠিন লালমাটিতে চাষ-আবাদের অসুবিধা। তাই গোলকুণ্ডপুরের সাপ্তাহিক হাট থেকে চন্দননালার পশ্চিমের নবাগতরা কিছু দুধেল গাই সংগ্রহ করে পশুপালন শুরু করল। বাড়ির ছোটো ছেলে দিয়েই রাখালি করা যেত বলে, দলের যুবকরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দূর দেশে পাড়ি দিল।

হেমন্ত এমনই এক রাখাল। সে দিনের বেলায় গোরু চরায় চন্দনালার তীরের ঘাসজমিতে। গোরুগুলিও খুব বেশি দামাল। কাছাকাছির মধ্যেই তারা ঘুরেফিরে ঘাস খায়, বা রোদে ছায়ায় দাঁড়িয়ে জাবর কাটে চোখ বুজে। শালবনের ছায়া বড়ো মিঠে। আর পাতার মধ্যে হাওয়া খেলে গেলে বেশ ঝমঝম শব্দ হয় একটা। পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে চন্দননালা।

হেমন্ত গোরুগুলোকে একবার দেখে নিয়ে শালগাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ল। বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। একফালি রোদ এসে পড়ল বসন্তের মুখে।

পাশের রাস্তা দিয়ে এক সন্ন্যাসী যাচ্ছিলেন। অল্প বয়স। গেরুয়া বসন। মুখে অল্প কাঁচা দাড়ি। হেমন্তের দিকে হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি গেল। পথের পাশে এমন অনেক রাখালই ঘুমিয়ে থাকে। এ নতুন কোনও দৃশ্য নয়। কিন্তু ছেলেটার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন।

হেমন্ত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। শুধু হঠাৎ এসে পড়া দুপুরের রোদে চোখে পাতা কুঁচকে যাচ্ছে তার। একটু একটু নড়েচড়েও যেন উঠছে। সন্ন্যাসীর খুব মায়া হল। তবে তিনি কিছু করে ওঠার আগেই পাশের পাথরের গর্ত থেকে বিরাট একটি সাপ হেমন্তের মাথার ওপর ফণা তুলে দাঁড়াল।

সন্ন্যাসীর দেহের রক্ত জল হয়ে গেল।

ওই বিশাল সাপ যদি হেমন্তের মাথায় ছোবল দেয়, সে মুহূর্তের মধ্যে মারা যাবে। তিনি প্রাণপণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন ছেলেটি যেন নড়ে না ওঠে। স্থির বস্তুকে সাপ লক্ষ্য করতে পারে না। এক-একটা মুহূর্ত এক-একটা দিনের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। সাপটি একভাবে ফণা ধরে আছে।

কতক্ষণ কেটে গেল সন্ন্যাসী বুঝলেন না। আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তে লাগল। রোদের রেখা হেমন্তের মুখ ছেড়ে শালবনের ছায়ায় প্রবেশ করল। সন্ন্যাসী অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, সাপটিও আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে আবার পাথরের ফাঁকে হারিয়ে গেল।

সন্ন্যাসীর গায়ে কাঁটা দিল।

তিনি বুঝলেন, সাপটি একমাত্র ছেলেটির মুখে পড়া রৌদ্র আড়াল করতেই বিবর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল।

এ তো রাজলক্ষণ!

ছেলেটির কপালে তিনি নিশ্চিত রাজযোগ দেখতে পেলেন। তিনি ছেলেটিকে জাগিয়ে তুললেন। ঘুম থেকে জেগে হেমন্ত হকচকিয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই এতটা বেলা হয়ে গেছে। তার উপর অচেনা সন্ন্যাসীকে চোখের সামনে দেখে কিছুক্ষণের জন্য সে কিছুই ভেবে উঠতে পারল না। সন্ন্যাসী নরম গলায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার গলায় পইতে আছে দেখছি। তুমি কে গো ছেলে?

হেমন্তের ঘোর তখনও কাটেনি। সে অবাক চোখে সন্ন্যাসীকে দেখতে লাগল। সন্ন্যাসী তার অবস্থা বুঝলেন। তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন। ইতিমধ্যে হেমন্ত গোরুগুলোকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটল। নাছোড়বান্দা সন্ন্যাসীও তার পিছু নিলেন।

চন্দননালার পাড় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা ছোটো মাঠ পার হলে আবার শালবন শুরু হয়। সরু আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে গোরুগুলো পথ চিনে দিব্যি চলেছে। তাদের পিছনে হেমন্ত। সে বারবার পিছু ফিরে বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে সন্ন্যাসীকে। চলতে চলতে একসময় বনের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছোলেন তাঁরা। বিরাট রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ চোখের সামনে ভেসে উঠল।

সন্ন্যাসীর ভ্রূ কুঁচকে গেল। হেমন্তের মধ্যে রাজলক্ষণ দেখে তিনি যতটা না বিস্মিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলেন ভগ্ন রাজপ্রাসাদের অবশেষ দেখে। লক্ষণ দেখে যা বোঝা যায়, এ প্রাসাদ প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো। তবে কি এ রাজপাটের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যই হেমন্তের জন্ম?

গোরুগুলো একটা ঘরে রেখে হেমন্ত ভারী দরজা বন্ধ করে দিল। পুরোনো লোহার দরজা। বাঘ কেন, হাতির পক্ষেও তা ভাঙা অসম্ভব। উঠোনের একপাশে ডাঁই করা আছে মেহগনির ফল, আঁশফল, বঁইচি, করমচা। নিচু দরজা দিয়ে হেমন্তে ঘরে ঢুকে গেল। ছোট্ট চাতালের চারধাপ সিঁড়ির নিচে সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছু পরে একজন ঘোমটা-টানা মহিলা ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। সন্ন্যাসীকে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করে বললেন,

– ভেতরে আসুন বাবা।

সন্ন্যাসী গম্ভীর গলায় বললেন,

– আমার গৃহে প্রবেশ বারণ। সময়ও কম। তোমাকে কয়েকটি কথা বলার ছিল।

– বলুন বাবা?

– নাম কী তোমার ছেলের?

মহিলা নাম বললেন। সন্ন্যাসী আবার প্রশ্ন করলেন,

– হেমন্তের দীক্ষা, উপনয়ন কে করেছেন?

– আমাদের কুলগুরু।

– তিনি কোথায় এখন?

– তিনি আমাদের পুরোনো বাসভূমিতেই রয়ে গেছেন। বৃদ্ধ মানুষ তিনি, তাই আসতে পারেননি।

– তুমি কি জানো মা যে তোমার ছেলের রাজযোগ রয়েছে?

মহিলা কেঁপে উঠলেন।

– না না, রাজযোগে দরকার নেই তার। এই রাজত্বের হানাহানিতেই আমাদের সব গেছে। কোনোমতে প্রাণে বেঁচেছি জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে এসে। আর ও কথা তুলে অবলার চোখে জল আনবেন না ঠাকুর।

সন্ন্যাসী মৃদু হাসলেন।

– মা গো, ইষ্ট বোঝো? ভবিতব্য? সে তো খণ্ডানো যায় না। তার বিরোধিতা করলে আরও বড়ো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। তার চেয়ে অখণ্ড সত্যকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মহিলা হাত জোড় করে বললেন,

– তাহলে আর কী করতে পারি বাবা? আপনিই বলে দিন কী করতে হবে।

– আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো মা। তোমার ছেলের রাজযোগ আমি নিজের চোখে দেখেছি। আবার এও দেখেছি, সে সামান্য গোপালক। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তার ইষ্টমন্ত্রে কোনও ত্রুটি আছে। সেই ত্রুটি খণ্ডন করতে হবে। এ কাজ কুলগুরুর। কিন্তু তিনি যখন অনুপস্থিত, এ কাজ আমাকেই করতেই হবে। আপনি হেমন্তকে বলুন তার ইষ্টমন্ত্রটি আমাকে বলতে। তার ত্রুটিটি আমি সংশোধন করে দেব।

মহিলা নতজানু অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ ভর করে এল। তীব্র গলায় বললেন,

– ইষ্টমন্ত্র বলবে আপনাকে? আপনি সন্ন্যাসী! ইষ্টমন্ত্র গুরু ও শিষ্য ছাড়া তৃতীয় কাউকে বলা যে মহাপাপ, সে তো আপনিও জানেন। তবুও এ কথা বললেন কী করে?

সন্ন্যাসীর মুখ মৃদু হাসিতে ভরে গেল। হেমন্তের মা দেখলেন তা বড়ো নির্মল, পবিত্র। নরম গলায় সন্ন্যাসী বললেন,

– দীক্ষা কী মা গো, কী-ই বা ইষ্টমন্ত্র?

“দীয়ন্তে জ্ঞানমত্যন্তং ক্ষীয়তে পাপসঞ্চয়ঃ।
তস্মাদ্ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।
দিব্যজ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কৃত্যা পাপস্য সংক্ষয়ম্।
তস্মাদীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্ববেদিভিঃ।।”

অর্থাৎ, পাপক্ষয় করে যে ইষ্টলাভ করায় তা হল ইষ্টমন্ত্র। ঈশ্বর বলে কি আলাদা কিছু হয়? তুমি যেমন করে অক্ষর জুড়ে তাঁকে ডাকো, তিনি তোমার কাছে ঠিক তা-ই। তাই নাম আর নামীর মধ্যে তো পার্থক্য নাই মা। তুমিই ভেবে দ্যাখো, হেমন্ত রাজপুরুষ হয়েও আজ সামান্য গোপালক। আর সে দেশত্যাগী হয়েছে তার ইষ্টমন্ত্র গ্রহণের পরেই। তার মানে যে শব্দ জুড়ে সে তার ইষ্টদেবতাকে ডেকেছে, তাতে ঈশ্বরের নাম উচ্চারিত হয়নি গো। সে তার ইষ্টমন্ত্র আমাকে না বলুক, তাকে বলো মন্ত্রটি একটি বটপাতায় লিখে জলে ভাসিয়ে দিতে। আমি তাকে নতুন মন্ত্র দিয়ে যাব। বিশ্বাস করো মা। আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। রাজানুগৃহীত কুলগুরু নই। আমার পাওয়ার বা হারানোর কিছু নেই।

মহিলার ঠোঁট কেঁপে উঠল,

– যদি কিছু অনিষ্ট হয়?

– এর বেশি আর কী হবে? এই পরিত্যক্ত খণ্ডহর, বনবাস, অনিশ্চয়তার জীবন, এর বেশি আর কী হবে বলো? নিয়তি কে ন বাধ্যতে?

আজ রাতে আর ঘুমোয়নি বিপত্তারণ। মাঝরাতে যখন জানালার ওপাশে সেই আগের দিনের মতো গলাতেই কেউ ‘দেশ’ বলে উঠল, সে চমকাল না। খুব প্রস্তুত হয়েই বেশ ভয় পেয়ে গেল। ফুটিফাটা জ্যোৎস্না। আজ আর আবছা মূর্তিটা কুঁজো হয়ে হাঁটছে না। হাতের লাঠিটা আকাশের দিকে তুলে পাগলের মতো নেচে চলেছে একনাগাড়ে। গায়ের ঝোল্লা পোশাকের প্রান্তগুলো আকাশে উড়ছে। অনেকটা সময় লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বিপত্তারণের মনে হল লোকটা জ্যোৎস্না আর ছায়ার ফাঁকে কোথায় যেন মিশে আছে। দেখা যাচ্ছে, অথচ দেখা যাচ্ছে না। নাচটা বন্ধ হয়ে গেছে।

পিছনের দরজায় কয়েকটা আলতো পায়ের শব্দ আর মৃদু ফিসফাস শুনতে পেল বিপত্তারণ। খুব আলতো শব্দ। শেষ রাতের হাওয়া আর পাতা ঝরাই হয়তো মনে হবে। কিন্তু সারা রাত জেগে কাটানোয় বিপত্তারণের স্নায়ুগুলো খুব সজাগ ছিল। সে বুঝতে পারল বেশ কয়েকজন নিশাচর লোক তার বাড়ির পিছনে জমা হয়েছে এবং তাদের উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো নয়।

পিছনের দরজায় একটা মৃদু টোকা শোনা গেল হঠাৎ। পরপর তিনবার। একটা নরম গলা, ‘বিপত্তারণবাবু, দরজাটা খুলুন তো। খুব প্রয়োজন।’

বাক্সে তিন লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। ছটি মূর্তি তৈরি আর সে বাদে বাকি সাতাশজন কারিগরের চার মাসের খাইখরচ। ব্যাংকে না রাখাটা যে কী বোকামির কাজ হয়েছে, সেটা ঠিক এই সময়েই মাথায় ঢুকল বিপত্তারণের। নিজেকে মনে মনে আচ্ছা করে জুতোপেটা করে বিপত্তারণ ঠিক করে নিল, নাহ্, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে এবং তার সে ছাড়া কেউ নেই।

এবার দরজার ধাক্কাটা একটু জোরে। লোকটার গলা আরও মিহিন হয়ে এসেছে। নিশুতি রাতে দরজার জোর আওয়াজের পর গলাটা সাপের হিসহিসানির মতোই লাগছে বিপত্তারণের কানে।

– বলি ও বিপত্তারণবাবু, কাজটা যে বড়ো অনুচিত হচ্ছে। এই দশ-বারোজন খোকা মিলে কি আর আপনার আধ আঙুল চওড়া দরজা ভাঙতে পারবে? দরজাটা খুলে দিন না বাপু। এত পর পর ভাবলে কী করে চলে বলুন তো?

বিপত্তারণের দেহে কী করে যেন একটা অবিশ্বাস্য শক্তি চাড়া দিয়ে উঠল। কান দুটো অসহ্য গরম হয়ে উঠল। চৌকি থেকে নেমে দরজাটা হাট করে খুলে ফেলল এক টানে।

এদিকটাই পাহাড়ের দিকটা। কিছুদূর সমতলে সে পথ এগিয়ে ঢালু হয়ে গিয়েছে চন্দননালার দিকে। আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে যে কজন নিথর ঝোপের মতো দাঁড়িয়ে আছে, আড়েদিঘে তারা খুব একটা কম নয়। বিপত্তারণের কেন যেন একটুও ভয় হল না। জোর গলায় বলল,

– টাকা নিতে এসেছেন তো? আমাকে মেরে তারপর নিয়ে যান। ও টাকা সাতাশজন শ্রমিকের অন্নসংস্থান। প্রাণ থাকতে আপনাদের হাতে তুলে দেব না।

একটা লম্বাটে নিরেট অন্ধকার আলো-আঁধারি চিরে বিপত্তারণের কাঁধের ওপরে নেমে এল। সে ছিটকে পড়ে গেল। একটা খিসখিস হাসি,

– রাজাকে টাকা দেখাতে নেই খোকা। তোমার হিসেব আলাদা। এই, তোরা কী দেখছিস? এটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে চল আমার দরবারে।

অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে চন্দননালার ঢালের দিকে চলল বিপত্তারণ। সামনের লোকটা সোজা হয়ে হেঁটে চলেছে। পিছনে ভারী ভারী পায়ের শব্দ। কাঁধটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। চোখের সামনে খোলা মাঠ, জ্যোৎস্না, নিঃসঙ্গ নদীতীর একবার ঝাপসা হয়ে আসছে, একবার খুব বেশিরকম স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে হাত আর কাঁধের পেশিগুলো ফুলে উঠছে প্রচণ্ড উত্তেজনায়। যেন ওর মধ্যে একইসঙ্গে দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষ পাঁয়তারা কষছে।

বিদ্যুতের মতো বিপত্তারণের মাথায় খেলে গেল একটা ব্যাপার। আবছা লোকটা মাঝরাতে মোটেও ‘দেশ’ বলেনি, বলেছে ‘দ্বেষ’। আর এই লোকগুলোই তার প্রমাণ।

.

শুকনো নদীর খাত পার হয়ে যখন বিপত্তারণ পুরোনো রাজবাড়ির কাছে পৌঁছোল, সে বুঝতে পারল এরা খোদ নৃসিংহ সিংহেরই লোক। তাহলে কেউ তাঁর কানে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপারটা হল, এই উপলব্ধিতে বিপত্তারণের হাতে পায়ে খিল ধরার কথা হলেও, সে নিজে বেশ বুঝতে পারছে তার মধ্যে একটা উদ্দাম পাগলামি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোনও বীর রাজা শত্রুশিবিরের খবর পেয়ে যেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ঠিক তেমনটাই লাগছে বিপত্তারণের বুকের মধ্যে।

রাজবাড়ির চাতালে অনেকগুলো সাদা আলো জ্বলছে। একটা হোম জেনারেটরের শব্দ আসছে। বড়ো মণ্ডপের ওপরটায় একটা বড়ো চেয়ার। কুচকুচে কালো রং তার। বিপত্তারণের সামনের লোকটা তিন ধাপ উঠে গেল। বিপত্তারণও উঠতে যাচ্ছিল। পিছন থেকে দুজন কাঁধ ধরে তাকে থামিয়ে দিল। বিপত্তারণ একটা ঝটকা দিল হাতবাঁধা অবস্থাতেই। লোক দুটো চার হাত দূরে ছিটকে পড়ল। বাকিরা এতটাই অবাক হয়ে গেল যে, বিপত্তারণের দিকে তেড়ে আসার কথা ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

চেয়ারে বসা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। লম্বা লম্বা পা ফেলে বিপত্তারণ চাতালটায় উঠে গেল। লোকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো একপাশে সরে গেল। বিপত্তারণ চেয়ারটার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

– হাত খুলে দাও।

চাতালের নিচ থেকে একজন এগিয়ে এল। কোমর থেকে একটা বিরাট ছুরি বার করে বিপত্তারণের কাছে এসে দাঁড়াল। সে নির্বিকার গলায় ধমক লাগাল, “তাড়াতাড়ি করো মূর্খ।”

হাতের দড়ি কেটে লোকটা নেমে যেতেই বিপত্তারণের চেয়ারটায় পায়ের ওপর পা তুলে বসল। তারপর আগাপাশতলা কাপড়ে মোড়া লোকটার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল,

– নৃসিংহ সিংহ! হা হা হা… চালাকির জায়গা পাও না?

বিকেল থেকেই রামজীবনের মনটা খচখচ করছিল। বিপত্তারণ ছোঁড়া এমনিতেই বড়ো ম্যাদামারা। তার ওপর এই কালীর রং নিয়ে বিপত্তি। বেমক্কা কিছু একটা করে বসলে, তিনি ওর বাড়ির লোককে জবাব কী দেবেন? ওঁর ভরসাতেই ছেলেটা অতদূর থেকে এখানে মূর্তি বানাতে আসে। শুধু তাই নয়, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো নৃসিংহ সিংহ রয়েছে, আর রয়েছে তার ফতোয়া। কস্মিনকালেও তিনি শোনেননি কালীমূর্তিতে লাল রং ছোঁয়ানো যায় না। কিন্তু ওই একটি লোককেই রামজীবন ভয় খান। যদিও তাকে গোলোকপুরের কেউ কোনোদিন মুখোমুখি দেখেনি, তবুও তার কথাকে লোকে অক্ষরে অক্ষরে মানে। নদীর পশ্চিম পাড়ে শালবনের মধ্যে প্রাচীন রাজবাড়িতে সে তার দলবল নিয়ে থাকে। বিরাট শক্তিশালী লোক। শোনা যায় তন্ত্রসার গুলে খেয়েছে সে। গ্রামের একদম পশ্চিম প্রান্তে শুভময়ের বাড়ি। গভীর রাতে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে কেউ একজন বিভিন্ন আদেশ লেখা কাগজ তাঁর জানালা দিয়ে ফেলে যায়। শুভময়ই গোলোকপুরের সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেন।

বিপত্তারণের কথা ভেবে ভারী চিন্তা হতে লাগল তাঁর। চিন্তা না বলে দুশ্চিন্তা বলাই ভালো। নাতি এসে টানাটানি করছিল অনেকক্ষণ থেকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। আর দেরি না করে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিয়ে আবার শুভময়ের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন রামজীবন।

বটতলার সাধুটিকে তো আগে দেখেননি। বেশ হাসি হাসি মুখ। অল্প বয়স। পরিষ্কার গেরুয়া পাঞ্জাবি। ধুতিও ওই রঙেরই। মুখে অল্প অল্প কাঁচা দাড়ি। দু-একবার তার তাকিয়ে রামজীবন বটতলাটা পার হয়ে গেলেন।

হঠাৎ মনে হল, কেউ বলে উঠল, ‘শেষ’।

চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন রামজীবন। সাধু তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। তিনি হকচকিয়ে গেলেন। একটু শুকনো গলায় বললেন,

– আমাকে কিছু বলছেন?

সাধু হাসল,

– হ্যাঁ। আপনার নাতিটি বেশ। বেশ চনমনে ছেলে।

রামজীবন কি ভুল শুনলেন তবে?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নাতির সঙ্গে টুকটুক করে শুভময়ের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। পশ্চিম আর উত্তরের পাহাড় খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়। শালবনের আরামদায়ক ঝিরিঝিরি হাওয়াটাও বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

বাঁশি দাদুকে জিজ্ঞাসা করল,

– দাদু, দরবেশ কী?

রামজীবন চমকালেন।

– কী বললি?

– দরবেশ কী?

.

– সে তো একধরনের মিষ্টি। কোথায় পেলি?

– ঘণ্টুস্যার যে বললেন, দরবেশ মানে একরকম সন্ন্যাসীও হয়।

ঘণ্টু বাঁশি আর মিশি দু-ভাইবোনকে পড়ায়। রামজীবন কথা বাড়ালেন না। এই, ‘ক্লেষ’, ‘শেষ’, ‘দরবেশ’, শব্দগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। বাঁশির হাত ধরে একটু তাড়াতাড়িই হেঁটে চললেন।

শুভময় অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন বাগানে। রামজীবনকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

– তোমার বিপত্তারণ কী ঘটিয়েছে শুনেছ?

রামজীবন চুপচাপ বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসলেন। বাঁশি একটা প্রজাপতির পিছনে ছুটে গেল। শুভময় ভারী আশ্চর্য হয়ে বললেন,

– কিছু বললে না যে? নৃসিংহ কিন্তু বিপত্তারণকে ছেড়ে কথা কইবে না।

রামজীবন বড়ো একটা শ্বাস ফেললেন,

– ব্যাপারটা যেন তেমন ততটা সহজ ঠেকছে না হে। নৃসিংহ নাহয় কিছু একটা করেই ফেলল। কিন্তু তা বলে কি সে বুড়ো কুঁজো লোক পাঠিয়ে বিপত্তারণকে ভয় দেখাবে? আর ওই ভূতুড়ে দৈববাণী শোনার দিনই রঙের বিপত্তি। ব্যাপারটার অনেকগুলো প্যাঁচ রয়েছে শুভময়। আমার বত্রিশ বছরের পুলিশি বুদ্ধি তো তাই বলে। অনেকগুলো দিক ওই বিপত্তারণের সঙ্গে জুড়ে আছে। একটা দিক তো ওই রঙের গণ্ডগোল, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সে তো মোটা দাগের দেখা। আরও কী কী যেন চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে তা খোলতাই হচ্ছে না।

শুভময় উদ্বিগ্ন সুরে বললেন,

– সে নাহয় হল, কিন্তু ভরদুপুরে যে আমার বাড়ি বয়ে নৃসিংহের লোক ফতোয়া দিয়ে গেল, তার কী হবে শুনি?

রামজীবন চমকে গেলেন।

– নৃসিংহের লোক দুপুরবেলায়। কিন্তু তারা তো শুনেছি রাত ছাড়া বেরোয় না।

– সেইটেই তো আসল ভয়ের ব্যাপার। আমারও তো জানো ওই একটিমাত্র মা-মরা মেয়েসন্তান নিয়ে বাস। এই অখেদ্য শহর থেকে থানা আবার বারো কিলোমিটার দূরে। আমার কিছু একটা হয়ে গেলে, মেয়েটা যে পথে বসবে ভাই। কিছু একটা করো।

রামজীবনও জানেন নৃসিংহের ফতোয়া ভয় পাওয়ার মতোই। বাঘা বাঘা ডাকাত-মাফিয়া ঘেঁটে এই গোলোকপুরের নৃসিংহ তাঁকে একেবারে দমিয়ে দিয়েছে। ধরাছোঁয়ার একেবারে বাইরে সে। ছায়ার মতো চলে, সাপের মতো বলে। লোকাল থানা-পুলিশ তার টিকিটিও খুঁজে পায়নি। নিঃশব্দে কাজ সেরে সে বেরিয়ে গেছে। ভাঙা গলায় তিনি শুভময়কে বললেন,

– দেখি কাগজটা।

শুভময় কাগজটা রামজীবনের হাতে দিলেন। বেলে কাগজ। তার ওপর নীল রং দিয়ে স্পষ্ট করে লেখা,

.

বিপত্তারণের বাড়ি থেকে দূরে থাকুন।

অন্যথায় শাস্তি অনিবার্য।

 আদেশানুসারে,

 শ্রী নৃসিংহ সিংহ

.

কাগজটা শুভময়কে ফেরত দিয়ে রামজীবন আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। চিন্তিত গলায় বললেন,

– শুভময়, এ তোমার আমার কাজ নয়। সবাইকে জড়িয়ে নিতে হবে। প্রয়োজন হলে পুলিশ, ওঝা, চোর, সাধু, সব। হয় এসপার নয় ওসপার। শত্রু কিন্তু আমাদের দুটি। একটি তো অশরীরী বটেই, অন্যটিও শরীরী হয়েও অদৃশ্য। লোকবল চাই হে। ব্যবস্থা করতে হবে সবাই মিলেই। আজকালের মধ্যে একটা মিটিং ডেকে ফেলি ক্লাবে। সভাপতি আবার সেই হতচ্ছাড়া কালীদাস। তুমি এক কাজ করো, আজ একবার সন্ধের দিকটায় নবীন কবরেজের দোকানে এসো তো। দেখি কী করা যায়।

শুভময়ের মেয়েটা বাঁশির হাত ধরে কী একটা নিয়ে আসছিল এদিকেই। কাছে এসে মেয়েটা রামজীবনকে বলল, “হাত পাতো তো জেঠু।” বড়ো ভালো মেয়ে। মুখের দিকে চাইলেও মন ভরে যায়। ডাগর চোখ। কালো কোমরছাপানো চুল। আহা, মা গো। রামজীবন সস্নেহ চোখে মেয়েটিকে একবার দেখে নিয়ে হাত বাড়ালেন। বাটি থেকে একটি গরম আলুর চপ তুলে রামজীবনের হাতে দিল মেয়েটি।

প্রচণ্ড গরম। রামজীবনের হাতটা ছ্যাঁক করে উঠল। তাঁর মুখ দেখে হয়তো মেয়েটি কিছু বুঝেছিল। সঙ্গে সঙ্গে শুভময়ের হিসেবের খাতা থেকে একটি কাগজ ছিঁড়ে সে রামজীবনের দিকে এগিয়ে দিল।

শুভময় রেগে লাল, “হ্যাঁ রে মেয়ে, আমি মরলে কি তোর বুদ্ধি হবে? জেঠুকে ওই গরম চপটা সরাসরি হাতে দিয়ে দিলি? আমি যে তোকে নিয়ে কী করব?”

কাগজে মুড়ে গরম চপের একদিক কামড়ে চোখ বুজে চিবুচ্ছিলেন রামজীবন। তৃপ্তি চোখেমুখে স্পষ্ট। চোখ যখন খুললেন, সে এক স্বর্গীয় ভাব।

– ভাই শুভময়, চিরটা কাল আকাশের তারা নক্ষত্রই হাঁটকে বেড়ালে। নিজের ঘরে যে সাক্ষাৎ জগত্তারিণী বসে আছেন, তা আর খেয়াল করলে না। এমন রান্নার হাত, আহা, যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী!

শুভময় হেসে ফেলেছেন। বাঁশিও। সে রামজীবনকে বলে উঠল,

– ও দাদু, সে তো অন্নপূর্ণা হবে। সরস্বতী তো বিদ্যাদেবী।

রামজীবন একহাত জিভ কেটে নিজের দু-কানে হাত দিলেন। মেয়েটির চোখ দুটো দিয়ে হেসে বললেন,

– আরে মায়ের আবার নাম কী? তাই তো, মা বিপত্তারিণী?

.

কাজলির চোখ দুটোতে আলো জ্বলে উঠল যেন।

নবীন কবিরাজ আর অরবিন্দ সেন যে আগের জন্মে কোষ্ঠকাঠিন্য আর ইসবগুল ছিল, সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। একে অপরের চরম শত্রু, কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহূর্ত কাটাতে পারে না।

বাপের অ্যালোপ্যাথের ধারেকাছে না ঘেঁষে যখন নবীন কবরেজি নিয়ে পড়ল, সবাই একবাক্যে স্বীকার করল ঘোর কলি ঘুরতে শুরু করল বলে। দ্বাপর ত্রেতা পার করে এই স্রোত সরাসরি সত্যযুগে নিয়ে ফেলবে সবাইকে। বাজারের ঠিক মাঝখানে নবীন একটা দু-কুঠুরির ছোট্ট ঘরে থাকে। একটি রিসেপশন আর অন্যটি চেম্বার। চেম্বারে অবশ্য কেউ থাকে না। রিসেপশনে নবীন সারাদিন বসে থাকে অরবিন্দের সঙ্গে। অরবিন্দ আবার আর-এক কাঠি সরেস। নামমাহাত্ম্য বজায় রেখে সে পাশ করা আই.সি.এস-টি ছেড়ে শালকাঠের ঠিকেদারিতে লেগেছে। কাজকম্মো বিশেষ কেউই করে না। নবীনের দোকানেই দু-বেলা দাবায় মুখ গুঁজে বসে থাকে দুজন, আর বাজার বা পথচলতি লোক মাঝে মাঝেই চমকে ওঠে দুজনের চিলচিৎকারে।

বিকেলের দিকটায় দাবা খেলতে খেলতে নবীন সরু চোখে লক্ষ করল, অরবিন্দ একটা ঘোড়াকে নৌকোর চালে এগিয়ে দিল। নবীন অরবিন্দের দিকে কটমট করে তাকাতেই সে ভারী অবাক হওয়ার ভান করে ভুরু দুটো তুলে দিল। নবীন বলল,

– সে তুই যদি আমলা-টামলা হতিস, তখন নাহয় হাতি ঘোড়া নৌকো ইচ্ছেমতো চালাতে পারতিস। তা তো আর নস, তাই বলছি কী, ঘোড়াটাকে আড়াই চাল দিলেই ভালো হত না কি?

অরবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলল,

– সারাজীবন ওই বাঁধাধরা নিয়মেই আটকে থাকবি। কোনোদিন নিয়মের বাঁধন ছেড়ে বেরোতে পারবি না। বিদেশে দেখ গা, নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। ছোঃ, এই তোদের মতো লোকের জন্যই আমি সিভিল সার্ভিস ছেড়ে এসেছি। তোরা নতুন কিছু প্রকল্প মেনে নিতেই পারবি না। উন্নয়ন, নবায়নের কিস্যু বুঝিস না অনগ্রসর দেশবাসী।

নবীন বক্তৃতাটাকে হজম করে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করল,

– তোর এই উন্নয়নশীল চালটা কাসপরভ যেন কোন খেলাটায় দিয়েছিল?

একটা লম্বা লোক আখ চিবুতে চিবুতে অনেকক্ষণ ধরে অরবিন্দ আর নবীনকে দেখছিল। আখটা শেষ করে একটা কলার ঠেলাগাড়ির মালিককে জিজ্ঞাসা করল, “দাদা, এখেনে ভালো কবরেজি অষুধ কোথায় পাওয়া যাবে?”

ঠেলাওয়ালার গাড়ির সামনে বিস্তর খরিদ্দার ছিল। কলার ফানাগুলো সাজাতে সাজাতে সে নবীনের দোকান দেখিয়ে দিল। লোকটা ভারী বশংবদ হয়ে যখন নবীনের দোকানের সামনে দাঁড়াল, তখন দাবার বোর্ড ওলটানো। কালো ঘোড়া সাদা নৌকোর ঘাড়ের ওপর পড়ে আছে।

খুব আলতো পায়ে লোকটা ‘রিসেপশন’ লেখা কাঠের টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। দুই বন্ধুর ধুন্ধুমার ঝগড়া চলছে। নরমসরম কথা পার হয়ে এখন ‘উল্লুক-বাঁদর-খচ্চর’-এর পর্যায়ে নেমে বা উঠে এসেছে তারা। লোকটা খুব করুণ সুরে নবীনকে ডাকল। নবীন একবার তার দিকে তাকিয়ে, ‘ডাক্তারখানা বন্ধ’ বলে আবার ঝগড়া শুরু করল।

লোকটা এবার মেঝেতে বসে পড়ে বিকট গলায় তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ওগোওওওও ধন্বন্তরি ঠাকুর গোওও, তোমার কি দয়া হবে না গো?”

দুই বন্ধুই চমকে উঠে থেমে গেল। এমনধারা রোগী তারা কোনোদিন দেখেনি। এর আগেও তারা বিস্তর রোগী বিদেয় করেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন আগে কোনোদিন হয়নি। অরবিন্দ এতটাই অবাক হয়ে গেল যে, সে নবীনকে বলে বসল, “ভাই, একবার দেখ, এর বোধহয় শরীর খুবই খারাপ। “

নবীন আর অরবিন্দ লোকটাকে ধরাধরি করে চেয়ারে বসাল। হাঁপাতে হাঁপাতে হাতের ইশারায় লোকটা জল চাইল। ফ্রিজের জলে একটু কুঁজোর জল মিশিয়ে লোকটার হাতে দিল রবীন। জলটা ঢকঢক করে খেয়ে লোকটা বলল,— যা বলল শুনে রবীনের চক্ষুস্থির।

.

ব্যাপারটা ঘোরালো, না লোকটা ঘোড়েল, তা বুঝতে নবীন আর অরবিন্দ ঘেমে নেয়ে একশা। ব্যাপারটা হল লোকটির কাছে নাকি বিনি পয়সায় কুষ্ঠরোগ সারিয়ে তোলার নিদান আছে। তা সে নবীন কোবরেজকে দিতে পারে, কিন্তু তার দুটি শর্ত আছে। এক, আজ রাতের মধ্যে লোকজন জুটিয়ে পশ্চিমের গড়ে রাজার থানে যেতে হবে। আর দ্বিতীয়টি বড়ো অদ্ভুত। তাকে নবীনদের বাড়ি, অর্থাৎ রামজীবন সেনের বাড়ির চোরকুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতে হবে। আর তার মুখ সে একমাত্র রাজাকেই দেখাবে। অরবিন্দের কেমন একটা খটকা লাগল। সে জিজ্ঞাসা করে বসল,

– রাজা-টাজা এখন আবার কে আছে?

লোকটা হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল,

– যে বাসস্থান দেয়, রোগ নিরাময় করে, অন্নসংস্থান করে, নির্মাণ করে— সে-ই রাজা।

নবীন একটু ভেবে বলল,

– রাজার মতো একজন আছে বটে গোলোকপুরে। নৃসিংহ সিংহ নাম। তবে তুমি যেমন বললে, ঠিক তেমন নয়। একটু অন্যরকম।

লোকটা মুচকি হেসে বলল,

– তবে সে রাজাও নয়। ওসব এখন থাক কবরেজমশাই। ভবিষ্যৎকে টেনে পিছিয়ে আনতে নেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই আপনিও পিছিয়ে অতীতে চলে যাবেন। তার চেয়ে যেমন বলি, করুন। যে সেরা সেরাই হবে/রাজা রাজার থানেই রবে।

– দ্যাখো বাপু, ঠকাচ্ছ না তো?

অরবিন্দ মুচকি হাসি হাসল একটা। তাতে আনন্দ, মশকরা কিছুই নেই। শুধু একটা অবাক হওয়া ভাব। একটু থেমে থেমে সে নবীনকে বলল,

– ও কি তোর কাছে টাকাপয়সা কিছু চেয়েছে?

নবীনের মাথাটা হঠাৎ খুব চুলকোতে লাগল।

রামজীবন আর জীবন ডাক্তার যখন গোলোকপুর থানায় পৌঁছোলেন, হাবিলদার রামরিখ থানাবাড়ির বারান্দায় বসে ময়দা মাখছিল। এস.আই সুরেন কুমড়ো আর ঝিঙে কেটে কেটে জমা করছিল বড়ো অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে। দুজনের পরনেই লুঙ্গি আর গামছা। রামজীবন ভারী অবাক হয়ে রামরিখকে জিজ্ঞাসা করলেন,

– বাপু হে, গোলোকপুর থানাটা কোনদিকে?

রামরিখ ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

– হামি কছু না জানবে হজোর। হামি গরিব হাবিলদার আছে। এসাই সাহিব বাতিয়াতে পারবেন।

রামজীবন বুঝলেন তিনি গোলোকপুর থানাতেই এসেছেন। আর গোলোকপুরে নৃসিংহের বাড়বাড়ন্তের কারণটিও খোলতাই হয়ে ধরা পড়ল চোখে। জীবন ডাক্তারের সঙ্গে থানাবাড়ির ডিউটি অফিসারের টেবিলে পৌঁছে তাঁর চোখ আরও ছানাবড়া হয়ে গেল। দুটি অল্পবয়সি ছোকরা বারমুডা পরে টেবিলের ওপরে বসে আছে। আর দু্জন মাঝবয়সি লোক উঁচু বেঞ্চের ওপর প্রথম দুজনের ঠিক বিপরীতে বসে আছে। চারজনের মাঝে টেবিলের ওপর একটা নীল স্ক্রিন জ্বলে আছে আর মাঝে মাঝেই ফসসসস্, টকটকটকটক করে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে। রামজীবন মৃদু গলাখাঁকারি দিলেন। কেউ ফিরেও তাকাল না। শুধু ছোকরা দুটির মধ্যে একজন, ‘ছক্কাআআআ… গুটি কাটা!’ বলে চিৎকার করে উঠল। রামজীবনের মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠল। ব্যাটাচ্ছেলেরা ডিউটি অফিসারের ঘরে বসে লুডো খেলছে। ডি.এস.পি হয়ে রিটায়ার করেছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে মালপত্র বড়ো কম নেই। কিন্তু থানার এমন রূপ জীবনে চোখে পড়েনি। ভেতরের পুলিশটা আর-একবার জেগে উঠল। দুম্ করে টেবিলের ওপরে একটা ঘুসি মেরে চিৎকার করে উঠলেন, “অ্যাইওওওও!”

ম্যাজিকের মতো কাজ হল। লোকগুলো সটান সোজা হয়ে গেল। ছেলে দুটো টেবিলের ওপরেই দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে দেওয়ালের ছবির দিকেই স্যালুট করল। জীবনডাক্তার আলতো করে রামজীবনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

– রামু, কন্ট্রোল কর, তোর হাই বি.পি!

ধুতি পাঞ্জাবি পরা রামজীবনের চেহারাটা সম্ভ্রম জাগানোর মতোই বটে। লোকগুলো অ্যাটেনশন পজিশনেই দাঁড়িয়ে ছিল। রামজীবন গুলির মতো প্রশ্ন করলেন,

– ডিউটি অফিসার কোথায়?

– স্যর, ওই নীল পর্দা দেওয়া ঘরে আছেন, স্যর।

দুই বন্ধু ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকগুলো তখনও ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। রামজীবন তাদের দিকে ঘুরে ‘অ্যাট ইজ’ বলে নীল পর্দা সরিয়ে ঘরটায় ঢুকলেন। জীবন ডাক্তার শুনতে পেলেন টেবিলের দিকটায় আবার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে।

‘আমার নীল গুটি ছিল… অ্যাই আমার লাল কে সরাল!’

ডিউটি অফিসারের পোশাকে সাঁটা নামটা পড়লেন রামজীবন। পড়লেন মুখের ভাষাও। একটা উৎকণ্ঠা। একটা উদ্বেগ। দুজন সম্ভ্রান্ত প্রবীণ মানুষকে দেখে তিনি কেতাদুরস্ত একটা স্যালুট ঠুকে ফেললেন। দুই বন্ধু টেবিলের উলটোদিকের গদিআঁটা চেয়ার দুটোতে বসলেন। রামজীবন ডিউটি অফিসারকে বললেন,

– বসুন অঞ্জনবাবু।

ভারি কুণ্ঠিতভাবে তিনি বসলেন। মিনমিন করে বললেন,

– স্যর, দই-রাবড়ি-চা-কোল্ড ড্রিংকস?

জীবন ডাক্তারকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে রামজীবন অঞ্জনকে কাটা কাটা সুরে বললেন,

– দুটো প্রশ্ন আগে করি?

– হ্যাঁ স্যর, করুন স্যর।

– আপনি দুজন অচেনা লোককে স্যালুট করলেন কেন? আর এটা থানা না গ্রুপ থিয়েটার?

– আজ্ঞে, ইয়ে মানে..

.

– চুপ করুন! মেরুদণ্ডটাও কি নৃসিংহ সিংহের কাছে বন্ধক রেখেছেন?

অঞ্জনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল একবার। পরক্ষণেই আবার মিইয়ে গেল। রামজীবন একটু ঠান্ডা হয়ে বললেন,

– গোলোকপুরে কী হচ্ছে জানেন আপনি?

অঞ্জন টেবিলে রাখা জলটা খেয়ে নিলেন ঢকঢক করে। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন,

– আপনারা কে আমি জানি না, তবে গত তিন বছরের মধ্যে কেউ প্রথম থানায় এল।

– আপনারা পেট্রলিংয়ে যান না?

– না, ফতোয়া আছে, থানা আর কোয়ার্টার ছাড়া আমাদের বাইরে যাওয়া বারণ।

– তবে বাজারহাট, ওষুধপত্তর?

– বাজারহাট পৌঁছে যায়। আর ডাক্তার কবিরাজের কাছে যেতে হলে সাধারণ মানুষ সেজে যেতে হয়।

– আপনাদের লজ্জা করে না? আপনারা যে পুলিশ!

– তাই? আমরা পুলিশ? তবে আমাদের কাছে মানুষ আসে না কেন? আমরা তো মার্ভেলের সুপারহিরো নই যে মানুষ ডাকার আগেই অকুস্থলে হাজির হয়ে সবাইকে উদ্ধার করব। অভিযোগ না শুনে স্টেপ নিলে আবার আপনারাই আন্দোলনে নামবেন, বা উপরওয়ালার কাছে ফোন যাবে। আমরা অপারগ।

– আচ্ছা। এই যে আমরা এলাম, আপনি তবে আমাদের অভিযোগ নেবেন!

ক্যাঁঅ্যাঅ্যাচ করে চেয়ারটা পিছিয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে যে উঠে দাঁড়াল, সে লোকটার মেরুদণ্ডটা টানটান, সোজা। কমপ্লেইন্ট ডায়রি আর কলমটা নিয়ে তিনি রামজীবনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– বলুন স্যর, গোলোকপুর পুলিশ আপনার জন্য কী করতে পারে?

আধঘণ্টা পরে ডিউটি অফিসারের চেম্বার থেকে যখন দুই বন্ধু বেরিয়ে এলেন, তখন চারজন ফিটফাট পুলিশ টেবিলের সামনে বসে বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘাঁটছে। খুশি খুশি মনে বাইরে বেরিয়ে এলেন তাঁরা। রামজীবন সোজা হেঁটে চললেন প্রধান দরজার দিকে। হাবিলদার রামরিখ একটা স্যালুট ঠুকল। অবাক জীবন ডাক্তার দেখলেন, তার বলিষ্ঠ দেহে আঁটো খাকি পোশাক। আর স্যালুট করার ধরনটি সম্মান প্রদর্শন যেমন করছে, তেমন সম্ভ্রম আদায়ও করে নিচ্ছে।

মনে মনে একবার ‘সাবাশ’ বলে তিনিও রামজীবনের সঙ্গে বড়ো রাস্তার দিকে হাঁটলেন।

গোলোকপুরের বটতলায় ভিড়টা জমেছে মন্দ না। সাধুবাবাও রয়েছেন একপাশে। তাঁর পাশেই চাতালের ওপর রামজীবন, জীবন ডাক্তার, শুভময়। চাতালের নিচটাতে সারি সারি চেয়ারে নবীন, অরবিন্দ, সুরেন, অঞ্জন, রামরিখ, নিবারণ, বৃন্দাবন, আরও বেশ কয়েকজন। সাধুবাবার পাশে বসে আছে বাঁশি। একটা বই দেখছে একমনে।

রামজীবন মুখ খুললেন সর্বপ্রথম।

– দেখুন, খুব বেশি কিছু বলার সময়ও যেমন নেই, নেই বিষয়ও। ব্যাপারটা গোলোকপুরের মোটামুটি সবাই জানেন, কিন্তু আংশিকভাবে। একসঙ্গে ব্যাপারটা না জানলে এর প্রতিকার সম্ভব নয়।

বিপত্তারণ বলে ছেলেটির এক কারিগর, সে এখানেই উপস্থিত আছে, তার হাত ধরে একটি বিপত্তি আজ দুপুর নাগাদ ঘটে গেছে। সেটিও সবাই জানেন। এখন প্রশ্ন হল, কেন, কীভাবে? নিবারণের কথা অনুযায়ী, সম্পূর্ণ অতিপ্রাকৃতভাবেই তা ঘটেছে। তার নিজস্ব কোনও ভূমিকা নেই এখানে। এবার অঞ্জনবাবু যদি তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান, তো করতে পারেন।

অঞ্জন উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়াল নিবারণ। অঞ্জনের ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। ইউনিফর্মটা ঝকঝক করছে। চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি। নিবারণকে তিনি সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে জেরা শুরু করলেন।

– তুমি কতদিন বিপত্তারণের কাজ করছ?

নিবারণ তাকাল অঞ্জনের দিকে। একবার বৃন্দাবনকেও দেখে নিল। তারপর অনেক মেপে মেপে বলল,

– আমি সারদাচরণের সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই ছিলাম। বিপত্তারণ এসেছে বছর পাঁচেক আগে।

– আচ্ছা। তা বিপত্তারণ এত তাড়াতাড়ি প্রধান কারিগর হয়ে উঠল, দলের দায়িত্ব পেয়ে গেল, তোমার রাগ হয়নি?

– কেন রাগ হবে? সে ভালো কারিগর, তাই সে জায়গা পেয়েছে। দাদুর সিদ্ধান্ত কখনও ভুল হতে পারে না।

রামজীবন চমকে উঠলেন। এ খবরটি তিনি জানতেন না। নিবারণ তবে সারদাচরণের নাতি!

অঞ্জন আবার বলল,

– কিন্তু নিবারণ, তোমার আশেপাশে তো কোনও লাল রং খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও কী করে?

– সে ব্যাপারটাই তো আমিও বুঝতে পারছি না। তাই ভয় পেয়ে আছি প্রচণ্ড।

অঞ্জন ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঠান্ডা গলায় তিনি নিবারণকে বললেন,

– দেখো নিবারণ, তোমার কথাই যেন সত্যি হয়। এই রং নিয়ে বিপত্তারণের যদি কোনও বিপদ হয়, তার আঁচ তোমার গায়েও লাগবে।

রামজীবন গলা তুলে বললেন,

– অঞ্জনবাবু, আপনাদের বোধহয় এখানকার কাজ ফুরিয়েছে।

অঞ্জনবাবু তাঁর সিপাহিদের নিয়ে চলে গেলেন।

সবাই চুপ। শুধু বাঁশির গলা শোনা যাচ্ছে, “সাধুবাবা, এটা কী ফুল গো?” সাধু নরম গলায় বললেন, “লালপদ্ম।”

নবীন প্রশ্ন করল,

– রামজীবনকাকা, এখন আমাদের কী করণীয়?

রামজীবন বললেন,

– ওই অচেনা লোকটি তোদের কী একটা রোগের ওষুধ লিখে দিয়েছে, সেটা সবাইকে একবার পড়ে শোনা।

– ওষুধ ঠিক নয়, আবার ওষুধও।

– যা হোক, পড়ে শোনা।

পকেট থেকে একদিস্তা কাগজ বার করল নবীন। তারপর চাতালের ওপর আলোর সামনে এসে সেটি জোরে জোরে পড়তে লাগল।

**

নদীর এ অংশটুকু সাঁতরেই পার হওয়া যায়। খাড়া পাড় ভেঙে ঝপঝপ করে পড়ছে আর তীরবর্তী গ্রামের ঘুমন্ত প্রহর চমকে চমকে উঠছে নিঃশেষিতপ্রায় দীপশিখার সঙ্গে।

এক সদ্যযুবা ঘাটের একপাশে রাখা ডিঙি নৌকোটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বালি চিকচিক করছে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়। এ ঘাটের কাছাকাছি কোনও গাছপালা নেই। যতদূর চোখ যায় বিপুল জলরাশি চকচক করছে। ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে উত্তুরে বাতাসের তাড়নায়। ডিঙি চালিয়ে এই বাঁকের মুখের শীর্ণা গঙ্গা পার হওয়া খুব সহজ।

কিন্তু তা হওয়ার নয়। নদী সাঁতরে পার হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শ্রমণ।

ধুতির কোঁচড়ে রাখা ছোট্ট পাত্রের সর্ষের তেলটা গায়ে মেখে হাড়হিম করা জলে নামল যুবক। প্রচণ্ড ঠান্ডার অনুভূতিতে হাত পা অসাড় হয়ে এল যেন। প্রবল বেগে হাত পা নাড়তে লাগল সে। অঙ্গসঞ্চালন বন্ধ হওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু। ঠান্ডা জলে দম বন্ধ হয়ে মরার কথা ভাবতেই তার গায়ে দুনো বল এল। আরও জোরে জোরে জল ঠেলে সে এগিয়ে চলল। ক্রমে পুব পাড়ের গাছপালার রেখা দিগন্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

তীরে পৌঁছোতে খুব বেশি দেরি নেই আর। অগভীর জলের নিচে বেলেমাটির ছোঁয়া লাগল হাতে। যুবক কোমরজলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে জলের উপরিতলে উঠে আসতে লাগল।

শীতঋতুর আগমনে নিঃঝুম পারপুর পল্লি যেন অপার্থিব কোনও স্থান। গাছের ফাঁকে ছেঁড়া ছেঁড়া জ্যোৎস্না কুয়াশা জোনাকি মাখামাখি। নদী থেকে পথটি পল্লির মধ্যে কিছুদূর প্রবেশ করে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। একটি পথ পূর্বে পারপুরের লোকালয়ের দিকে প্রসারিত। পথের অন্য অংশটি দক্ষিণে চলে গেছে জ্যোৎস্নাপ্রান্তরে।

যুবকের দেহ ঠান্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠল। ভেজা কাপড় গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকায় ঠান্ডাটা আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে ক্রমশ।

শূন্য প্রান্তরের উঁচুনিচু অংশ পার হয়ে যুবক একটি প্রাচীরের সম্মুখীন হল। তার গায়ে গায়ে কিছুটা পুবে গিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিতেই প্রাচীরের গায়ে দরজা। দরজা অতিক্রম করলে শিয়াকুল আর আশশ্যাওড়ায় আবৃত পথ।

কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর ঝোপজঙ্গল ক্ষীণ হয়ে এল। পায়ের নিচে ইটের তৈরি চাতাল অনুভব করল যুবক। চাঁদ মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সামনে বিরাট বিহারের ছায়া কিছুটা পশ্চিমে হেলে। দক্ষিণ-পুবের জ্যোৎস্নালোকিত গাছগাছালির ফাঁকে ভাগীরথীর প্রবাহ চিকচিক করছে।

সোজা উঠে গেছে প্রশস্ত সোপান। একটানা ছাব্বিশটি সোপান পার হয়ে যুবক বিহারের দ্বারে উপস্থিত হল।

ন্যাড়ামাথা শীর্ণকায় একজন বুড়ো মানুষ এই প্রচণ্ড শীতেও নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটি মাটির প্রদীপ। মৃদু কম্পমান আলোয় তাঁকে পাথরের তৈরি মূর্তি বলে মনে হয়।

যুবককে দেখে মৃদুস্বরে বৃদ্ধ বলে উঠলেন,

– আসুন ব্রাহ্মণ।

যুবক ঠান্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠল একবার। কম্পিত কণ্ঠে বলল,

– আমাকে একটু আগুন দিতে পারেন? নইলে ঠান্ডায় মরেই যাব।

বৃদ্ধের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল,

– তা হওয়ার নয় মুকুট রায় মহাশয়। আপনার আগমনের সাফল্য প্রমাণ করে, আপনার পথ চলা এখনও অনেক বাকি।

– বুঝলাম না ভিক্ষু।

– আসুন ভিতরে। সত্য উন্মোচিত হোক।

মঠের মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে উজ্জ্বল দীপালোকে চতুর্দিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। চারশো বছর আগে তৈরি মঠের প্রাধান্য, আধিপত্য কমলেও ভাস্কর্য, স্থাপত্যের কোনোরকম হানি ঘটেনি। কুলুঙ্গির দীপাধারে স্বর্ণাভ আলো। বৃদ্ধ আলোকিত স্থানে এসে ঘুরে দাঁড়ালেন যুবকের দিকে। মন্দ্রস্বরে বললেন,

– বস্ত্র উন্মোচন করুন ব্রাহ্মণ।

আঁটো আঙরাখা আর ধুতি খুলে গেল। বীরোচিত পেশল শরীরটি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। প্রদীপ হাতে ভিক্ষু অগ্রসর হলেন। দেখা গেল যুবকের দেহে অজস্র ফোঁড়া। লাল হয়ে আছে ফোলা অংশগুলি। দেহের লোমশ অংশ বাদে সর্বত্র সেই ভয়ানক মারণরোগের চিহ্ন দৃশ্যমান। ভিক্ষুর অচঞ্চল মুখেও দেখা দিল উদ্বেগের রেখা। একবার যেন শিউরেও উঠলেন। আর-একটিও কথা না বলে যুবকের হাত ধরে দ্রুত টেনে নিয়ে চললেন মঠের গর্ভগৃহের দিকে।

পদ্মের সুমিষ্ট গন্ধে গর্ভগৃহ পরিপূর্ণ। বৃত্তাকার গর্ভগৃহের পশ্চিম দেয়ালের ঠিক সামনেই বিরাট সাদা একটি মূর্তি। লম্বায় সেটি প্রায় পাঁচ হাতের কাছাকাছি। ত্রিনেত্র। মাথায় বিরাট জটাজালের ওপর স্বর্ণমুকুট, অথচ দেহের বাকি অংশে কোনও অলংকার নেই। দেবতা সিংহের পিঠে আসীন। ডানপাশে একটি ধাতব ত্রিশূল। ত্রিশূলটির দেহে সাদা পাথর কেটে বানানো বিরাট একটি নিথর সাপ। বাঁদিকে সুবর্ণভাণ্ডে রাখা পদ্মকোরক। মূর্তির বাঁ হাতে একটি পিত্তলনির্মিত পদ্ম এবং তার ওপরে স্থাপন করা হয়েছে একটি রুপার তৈরি খড়্গ।

ইটের তৈরি পট্টটি লাল কাপড়ে ঢাকা। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে ভিক্ষু বললেন,

– শুয়ে পড়ুন।

যুবক এগিয়ে গিয়ে তার উপর শুয়ে পড়লেন উর্ধ্বমুখ হয়ে। বৃদ্ধ একটি ধূপ জ্বালিয়ে দেবতার সামনে রাখলেন। পাঁচটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলেন বেদির সামনে।

নতজানু হয়ে বসলেন শ্রমণ। বাঁ হাত হাঁটুর উপর রেখে, ডান হাত দিয়ে আলতো ছোঁয়ায় মুকুটের চোখ দুটি বন্ধ করে দিলেন। তারপর মৃদু গম্ভীর স্বরে বলতে লাগলেন,

– হে বীর বিপ্র। আপনি শীতঋতুর প্রবল শৈত্য হেলায় পার হয়ে এসেছেন। অবলীলায় পার হয়েছেন বিশাল জাহ্নবী। বীর্য ও স্থৈর্যে আপনি সুমহান। দেব সিংহনাদ আপনার সম্পূর্ণ নিরাময় সাধন করুন।

মূর্তির পায়ের কাছে একপাশে গোময় স্তূপ করা ছিল। সেখান থেকে একমুঠো তুলে নিয়ে নিজের মুখের কাছে আনলেন ভিক্ষু। জনশূন্য নিঃশব্দ স্তূপের গর্ভগৃহে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল তাঁর মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ— “নম আর্যাবলোকিতেশ্বরায় বোধিসত্ত্বায় মহাসত্ত্বায় মহাকারুণিকায়।/ তদ্যথা ওঁ অকটে বিকটে নিকটে কটংকটে করোটে করোটে বীর্যে স্বাহা।।”

পরপর তিনবার উচ্চারণ করলেন মন্ত্রটি। তারপর মন্ত্রপূত গোময় মাখিয়ে দিলেন মুকুটের মুখে। সম্পূর্ণ মুখ গোময় লিপ্ত হলে, কপালে ওপর রাখলেন একটি পদ্মপাপড়ি। আবার আর-এক মুঠো। আবার মন্ত্রোচ্চারণ। এবার বুক আর পেটে প্রলেপ দিলেন। নাভির ওপর রাখলেন একটি পদ্মপাপড়ি। সবশেষে পা দুটিতে মন্ত্রলব্ধ গোময় লেপন শেষ হলে দুই ঊরুতে দুটি পদ্মপাপড়ি রাখলেন।

এইভাবে সম্পূর্ণ দেহে প্রলেপ দেওয়ার পর শ্রমণ করজোড়ে সিংহনাদ মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন।

চোখ বুজে একমনে জপ করতে লাগলেন, “ওঁ মণিপদ্মে হুম্… ওঁ মণিপদ্মে হুম্…”

রাত্রির নিঃশব্দ প্রহরে গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ ধূপের গন্ধে ভর করে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। পর্ণমোচীর পতনোন্মুখ পাতায় পাতায় জ্যোৎস্নার অক্ষরে লেখা হতে লাগল পুনর্জীবনের নিয়তিলিখন। নিঃশেষ হতে লাগল দীপাধারের ঘি, সঞ্চিত শিশিরের ফোঁটা।

রাতের অন্তিম প্রহরে চোখ মেলে চাইল মুকুট।

ভিক্ষু তখনও চোখ বন্ধ করে জপ করে চলেছেন মহামন্ত্র। শুধুমাত্র ঠোঁট দুটি সচল। মুখের অন্য একটি রেখাও কাঁপছে না। মুকুট আশ্চর্য হয়ে দেখল তার দেহের বিষাক্ত রোগচিহ্নগুলি সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। গোলাপি রক্তাভা ফুটে উঠছে চামড়ার নিচে। এক আশ্চর্য আলোকিত শক্তি সে অনুভব করছে শরীরে। ভিক্ষুর পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে, সে অপেক্ষা করতে লাগল তাঁর ধ্যানভঙ্গের।

সকালের পূর্বাকাশের পাতলা অন্ধকার চিরে দুটি পাখির ডানা আরও পূর্বে উড়ে গেছে সবে। শ্রমণ চোখ খুলে তাকালেন। মুকুটের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন তিনি। তাঁর পা দুটি জড়িয়ে ধরে মুকুট বলে উঠল,

– হে মহান শ্রমণ, আপনি ধন্য, বলুন কী উপায়ে আপনার ঋণশোধ করি আমি?

সর্বত্যাগীর মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। মুকুটকে দু-হাতে ধরে ভূমাসন থেকে তুললেন। বেদির পাশে বসিয়ে দিলেন আস্তে আস্তে। ঘরের কোণে রাখা একটি পাত্র এনে মুকুটের হাতে দিলেন। মুকুট দেখল তাতে দুরকম সিদ্ধ কন্দ রয়েছে। ভিক্ষু বললেন,

– পথ্য গ্রহণ করুন বিপ্র। তারপর বলছি আমার কী চাই।

পরম ভক্তিভরে সাধকের দেওয়া পথ্য গ্রহণ করল মুকুট। ভোজন শেষ হলে, হাত মুখ ধুয়ে মুকুট আবার ভিক্ষুর সামনে বসল। বৃদ্ধের চোখ দুটি স্বপ্নালু হয়ে এল। তিনি মন্দমধুর সুরে বলা শুরু করলেন,

– এই বিহার জগদীশ্বর দেবপাল নির্মাণ করেন নবম শতকের মধ্যভাগে। রাজা নিজে বৌদ্ধ ছিলেন। ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। পূর্ব, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে তিনি অসংখ্য মঠ নির্মাণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী গুণীজন তাঁর রাজসভায় স্থান পেতেন, অন্নবস্ত্রের সংস্থান হত তাঁদের। দেবপালের সভাকবি ছিলেন বজ্রদত্ত। ‘মহাক্ষপাতালিক’ গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। তাতে অবলোকিতেশ্বর মহাবুদ্ধের শ্লোকটি তিনি রচনা করেন।

এই শ্লোক উচ্চারণেই আপনার নিরাময় সম্ভব হল। বজ্রদত্ত নিজেও এই মারণরোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মহামহিম অবলোকিতেশ্বর মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই। দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে রাজা রামপালের শাসনকালেই গৌড়দেশে সেন বংশের উত্থান শুরু হয়। পাল বংশের শাসন রাজধানী মুদগগিরিকে কেন্দ্র করে অল্প কিছু অংশে অবস্থান করতে থাকে। ঘোর ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী সেনরাজাদের দাপটে গৌড়ের বৌদ্ধবিহারগুলির আভা ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত ধরে মহাযান ধর্মমত তিব্বত পাড়ি দেয়। শুধুমাত্র পশ্চিমে মুদগগিরি এবং পার্শ্ববর্তী বিহারগুলিতে বৌদ্ধমত ছিন্নসলিতার শিখার মতো জ্বলতে থাকে।

এই দুই অঞ্চল, ভাগীরথী-বিধৌত সরস ভূমি এবং সুহ্মদেশ রাঢ়, দুইয়ের মধ্যে আপনাকে যোগসাধন করতে হবে বীর।

মুকুট আশ্চর্য হলেন। শ্রমণকে বললেন,

– আমি ক্ষুদ্র ভূস্বামী। এ কাজ কোনও মহান পুরুষের। আমার পক্ষে এ কাজ কি সম্ভব হবে?

– মুকুট রায়, মহত্ত্ব কখনও জন্মলব্ধ হয় না। কর্ম ও সাধনার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। আর আপনার কাজ হবে শুধু যোগসূত্র স্থাপন করা। সে অঞ্চলে স্থানে স্থানে বজ্রযানী বৌদ্ধবিহার রয়েছে গুপ্ত অবস্থায়। অতিরিক্ত তন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ায় ভগবান বুদ্ধের অবলোকিতেশ্বর কারুণিক রূপটি অন্তর্হিত হতে চলেছে।

আপনি সেখানে বজ্রদত্ত প্রণীত অবলোকিতেশ্বর বন্দনার এই পুথিটি নিয়ে যাবেন। ধীরে ধীরে বৌদ্ধ সমাজে অবলোকিতেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করবেন। বাকি ঘটনা নিয়তির নির্দেশেই ঘটবে। আর আপনার বন্দনায় সবসময় এক লালবর্ণের মাতৃমূর্তি আপনার মার্গদর্শন করবে।

.

মুকুট ফিরে চলেছেন। সকাল ছড়িয়ে আছে গাছের গায়ে গায়ে। ঘাটের নৌকা পারাপারের জায়গায় অনেকগুলি নৌকো মাঝিসহ অপেক্ষা করছে। বজ্রদত্তের পুস্তিকাটি ছাড়াও আরও একটি ছোটো কাগজের টুকরো দিয়েছেন শ্রমণ। তা আসলে উল্লিখিত সুহ্মরাঢ়ের পথনির্দেশিকা।

হাতে আঁকা মানচিত্র। লাল রঙে পথের দিশা। শিরোনামে লাল রঙে লেখা আছে,

“বীরভূঃ কামকোটি স্যাৎ প্রাচ্যা জলান্বিতা।
আরণ্যকং প্রতিচ্যাঞ্চ দেশোদার্ষদ উত্তরে।।
গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশ প্রকীর্ত্তিতঃ।।”

মুকুট রায় বহমান জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জলজ শুশুকের দল খেলা করছে ঢেউয়ের মাথায়।

লালবর্ণের দেবী। এমনটি তো তিনি শোনেননি কোনোদিন।

**

নবীনের পড়া শেষ হল। শুভময় অস্ফুট স্বরে বললেন, “পাণ্ডরা!”

গাছের পাতা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দু-এক ফোঁটা জল পড়ার শব্দও যেন শোনা গেল। নিঃশব্দ প্রহর। রাত নটার বেশি নয়। তবুও এতগুলো মানুষের মধ্যে শ্মশানের নীরবতা।

সাধু প্রথম কথা বললেন।

– হ্যাঁ, পাণ্ডরা। রক্তবর্ণের দেবী। তাঁর আশীর্বাদধন্য হয়েই একসময় সাধারণ রাখাল রাজা হয়েছিলেন। তাঁর সত্য আমি জানি।

আবার চমক। জীবন ডাক্তার প্রশ্ন করল, “তার সঙ্গে এ ঘটনার সম্পর্ক কী?”

স্মিত হাসি সাধুর মুখে।

– বিশ্বের সবকটি বড়ো ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে ছোটো ছোটো ঘটনার মাধ্যমে যুক্ত। এক টুকরো মৌসুমি মেঘে আসামের বন্যার ভূমিকা লেখা থাকে, তা জানেন তো?

– আচ্ছা, শুনি তবে সে ঘটনা।

হেমন্তের মা বড়ো দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন। একে অনির্দিষ্ট জঙ্গুলে জীবন, তায় জনমানুষবিবর্জিত অঞ্চল। দিনেদুপুরে বাঘ ডাকে। ইতিউতি উঁকি মারে সাপখোপ। গভীর রাতে অজানা সব শব্দে বুক কেঁপে ওঠে। গোষ্ঠীর পুরুষরা দূর দেশে। একটা বড়ো বিপদ হলে রক্ষা করার কেউ নেই। প্রাসাদের দরজা শক্তপোক্ত বটে। কিন্তু নিজস্ব শক্তি না থাকলে, শুধু দরজার ভরসায় কতদিন বেঁচে থাকা যায়? ছেলেটা বনবাদাড়ে গোরু চরিয়ে বেড়ায়, সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।

মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা খচখচ করে, তা হল, অচেনা সন্ন্যাসীর কথায় ইষ্টমন্ত্র ভাসিয়ে দেওয়া। কুলগুরুর ইষ্টমন্ত্র তো আর যা-তা ব্যাপার নয়। তিথি নক্ষত্র সময় দেখে তা ঠিক করা হয়। তবে সন্ন্যাসীর মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল, হেমন্তের মা তাঁর কথা অমান্য করতে পারলেনই না। সেও তো আজ দু-মাস হতে চলল। কোথায় হেমন্তের রাজযোগ?

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বন থেকে কুড়িয়ে আনা জলপাইগুলো কাটছিলেন তিনি। এমন সময় পাশের ঘরের সুরঞ্জনা ঘরে এল। এসেই চাপা গলায় বলে উঠল,

– ও দিদি, শুনেছ!

হেমন্তের মা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। ভরাদুপুর, ছেলেটা বাইরে। বুকটা কামড়ে উঠল। দমবন্ধ করে বললেন,

– কী রে! বিপদ হয়েছে কিছু?

– আরে না গো। তা নয়। কোন এক বিরাট বাদশা আমাদের এই চন্দননালার পাশেই তাঁবু ফেলেছে।

হেমন্তের মা আবার কাজে মন দিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিরে। এক কালে তাঁরাও রাজারানি ছিলেন। জাফরিকাটা অলিন্দের দেওয়াল চুঁইয়ে সোনার বিকেল যেত। সকাল আসত। সোনার দীপদান। শত শত সৈন্য। আজ সব গেছে। এক অচেনা প্রাসাদের ভগ্নস্তূপে রোজ নতুন নতুন ভয় জমা হচ্ছে তহবিলে। অমন রাজা বাদশা কত যায় পথ বেয়ে। মুখে বললেন,

– বাদশা ফাঁকা জায়গা পেয়ে শিবির ফেলেছে। তাতে হলটা কী?

সুরঞ্জনা আবার বলে উঠল,

– আরে সেখানেই তো ব্যাপার। তা সঙ্গে বেগমও চলেছেন, আর চলেছে বেগমের পেয়ারের পাখি ‘বাজবাহাদুর’। তার নাকি সোনার পালক, সোনার শিকল। হতচ্ছাড়া পাখি কোন ফাঁকে শিকলি কেটে উড়ে পালিয়ে গেছে, প্রহরীদের খেয়াল নেই। বেগম কেঁদেকেটে নাওয়া খাওয়া ফেলে দিনরাত্রি শুয়ে আছেন মড়ার মতো। বাদশার ঘুম গেছে উড়ে। তিনি চতুর্দিকে সেনা পাঠিয়েছেন পাখি খুঁজে আনতে।

হেমন্তের মা আবার পড়লেন দুশ্চিন্তায়। ছেলেটা রয়েছে বাইরে। বাদশার সৈন্য যদি তাকে পেয়ে অত্যাচার করে? হাতের কাজ পড়ে রইল। কিছুক্ষণ অনর্গল বকবক করে সুরঞ্জনাও চলে গেল।

দরজায় ঠেস দিয়ে হেমন্তের মা পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

**

দূর থেকে দামামার কর্কশ আওয়াজ শুনে গোরুগুলোর মধ্যে একটা চমকে গিয়ে শালবনে ঢুকে পড়ল। হেমন্ত চমকে উঠল। ভয়ও পেল প্রচণ্ড। জঙ্গলের এদিকটা লোকজন খুব একটা আসে না। তাই জংলি জন্তুজানোয়ারও খুব বেশি এ অঞ্চলটায়। হাতি, বুনোবেড়াল তো আছেই। চিতাবাঘ থাকাও আশ্চর্য নয়।

ভয় পেলেও হেমন্তকে ঢুকতেই হবে বনের গভীরে। গোরুটাকে বাঁচাতেই হবে।

বড়ো বড়ো শালগাছ ছাড়াও হিজল, মহুল গাছও রয়েছে বেশ কয়েকটা। খোলা জায়গায় যেমন রোদের তাপ, বনের ছাউনির নিচে এ অংশটায় একেবারেই রোদ পড়ে না। হাওয়াও তেমন নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। নিস্তব্ধ বনভূমিতে, সে-ই মনে হচ্ছে গোলাবর্ষণের শব্দ।

শ্যাওলাধরা পাথরের ফাঁক দিয়ে চন্দননালা বয়ে যাচ্ছে কুলকুল শব্দ তুলে।

ঘাসের ওপর খুব মৃদু একটা শব্দ হল। খুব হালকা। একটা ভারী মসৃণ দেহ ঘাসের ওপর গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। সামনের স্বর্ণলতা ঝোপটা নড়েচড়ে উঠছে। গোরুর কথাটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল হেমন্ত। পা টিপে টিপে ঝোপটার দিকে এগিয়ে গেল সে।

একটা ঝটপট শব্দও ভেসে এল যেন।

ঝোপের সামনেটায় শিয়াকুলের ঝাড়। কাঁটা কাঁটা। সেটাকে ঘুরে ঝোপের ফাঁকা ফাঁকা দিকটায় পৌঁছেই হেমন্তের হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এল লাফিয়ে।

একটা ধূসর রঙের পাখি। খুব একটা বড়ো না। কিন্তু বাঁকানো ঠোঁট আর বড়ো বড়ো নখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, এ পাখি শিকারির জাত। ওড়ার জন্য বারবার ডানা ঝাপটাতে গিয়েও সে পড়ে যাচ্ছে। কোনও একটা কারণে তার ওড়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। আর সেই সুযোগেই একটা বিরাট সাপ একটু একটু করে হাঁ মেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সাপটাও হয়তো শিকারি পাখিটাকে চিনতে পারছে বলেই তাড়াহুড়ো করছে না। কিন্তু হেমন্ত বুঝল বেশিক্ষণ নখ বা ধারালো ঠোঁট দিয়ে সাপটাকে আটকে রাখা যাবে না। সে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে পাখিটাকে তুলে নিল। আর সেই মুহূর্তে ডান পায়ের গোড়ালির ওপর বসে গেল দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত।

ওই অবস্থাতেই ছুটতে লাগল হেমন্ত। তার মাথায় একটাই কথা ঘুরছে তখন। তার মা অনেক ওষুধপত্র জানে। মায়ের কাছে পৌঁছোতে পারলেই সে বেঁচে যাবে। গোরুর কথা বেমালুম উবে গেছে তার মাথা থেকে।

বনের ভিতর থেকে ফাঁকা জায়গায় টলতে টলতে বেরিয়ে এল হেমন্ত। কোলের পাখিটা শান্ত হয়ে বসে আছে। আপাতত ওড়ার সাধ আর তার নেই।

হেমন্তের চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে কি? তাহলে নিশ্চয়ই বিষ মাথায় উঠেছে। তবে! সে আর বাঁচবে না? মাকে দেখতে পাবে না আর? গোরুগুলো…?

ছায়া ছায়া কতগুলো লোক। হাতে লম্বা লম্বা তলোয়ার। এগিয়ে আসছে। যমদূত নিশ্চয়ই।

আঃ, মা গো..

.

হেমন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

মূর্ছিতপ্রায় হেমন্ত শুনতে পেল তলোয়ারগুলো খাপে ঢুকে যাওয়ার শব্দ। টুকরোটাকরা কথা।

– হুজৌর, ইয়ে দেখিয়ে, বাজবাহাদুর।

-অউর ইয়ে লেড়কা?

– বেহোঁশ হ্যায় শায়দ, ইসে ভি লে চলো পাদশাহ কে দরবার মে।

**

হেমন্তের ডাক শুনে মা চমকে উঠেছিলেন। কখন যে দুপুর গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে, মায়ের খেয়াল ছিল না। হেমন্তের ডাক শুনে বাইরে এসেই মা হকচকিয়ে গেলেন। যে ছেলেটা তাঁকে মা নামে ডাকছে, তার মুখ, গলার স্বর সবই হেমন্তের মতোই বটে, কিন্তু গায়ের ঝলমলে পোশাক, বহুমূল্য মোতির মালা আর একশোরও বেশি হাতিয়ারবন্দ সৈন্য অন্য কথা বলছে। আনন্দে ঝলমল করছে তার মুখ।

মা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,

– তুমি কে বাবা?

ছেলেটা ছুটে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পিছনের সৈন্যরাও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। হেমন্ত কলকল করে উঠল,

– মা, আমি বাদশার বউয়ের পাখি খুঁজে দিয়েছি বলে তিনি খুশি হয়ে আমার নামে এ পুরো অঞ্চলের পাঞ্জা দিয়েছেন। আমরা আজ থেকে আর এ ভাঙা গড়ে থাকব না। আমি গোলকুণ্ডপুরের রাজা এখন। আর তুমি রাজমাতা।

মা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। দুজন সৈন্য বনের পথ বেয়ে গোরুগুলোকে নিয়ে এসে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে দিল। সুরঞ্জনা প্রদীপ আর তিলক নিয়ে এসেছে।

গোয়ালঘরের দরজা আজ আর বন্ধ হল না। দুজন সৈন্য তার সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল।

১০

রামজীবনের কঠোর নির্দেশ ছিল, চরম বিপদ না দেখলে যেন অঞ্জন ও তাঁর পুলিশ বিন্দুমাত্র সাড়া না দেয়। বিপত্তারণের কাঁধে লাঠিটা পড়ার পর রামরিখ বন্দুক বাগিয়ে ধরেছিল বটে, কিন্তু অঞ্জনের ইশারায় সেটি আবার নেমে এল। রামরিখ আর সুরেন বিপত্তারণ আর অপহরণকারীদের পিছু নিল। অঞ্জন আর দুজন কনস্টেবল রয়ে গেল বিপত্তারণের বাড়ির আশেপাশেই।

দলটা চন্দননালার দিকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই একজন কনস্টেবল উঠে দাঁড়াচ্ছিল। কিছু একটা দেখে অঞ্জন তাকে টেনে বসালেন। রাস্তার দিক থেকে দুজন লোক চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়িটার পিছনের খোলা দরজার দিকে চলে গেল। পা টিপে টিপে অঞ্জনও তাদের পিছু নিলেন। লোক দুটো কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রুত বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আর তখনই অঞ্জনের টর্চের তীব্র আলো গিয়ে পড়ল একজনের গামছাবাঁধা মুখের ওপর। হাসতে হাসতে অঞ্জন বললেন,

– বাবা নিবারণ, আমার বারণের কারণ বোঝোনি মনে হচ্ছে। তাই অকারণ হানাদারিটা করে ফেঁসে গেলে। আরে, বেন্দাবন খুড়ো যে! চলো চলো, বেন্দাবন যাত্রাটা এবার শ্রীঘরেই সেরে নেবে চলো।

**

গোপন কুঠুরি থেকে লোকটা বেরিয়ে রামজীবনের বৈঠকখানার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা আলোয় ভরে যাচ্ছে বাগান, বাড়িঘর। অঞ্জন, রামজীবন, জীবন ডাক্তার, নবীন, অরবিন্দরা চুপ।

অঞ্জনকে রামজীবনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন,

– বাবা অঞ্জন, নিবারণ আর বৃন্দাবন কিছু বলল?

– ওরা আর কী বলবে? ওরা সামান্য বোড়ে। নৃসিংহের ফতোয়া অনুযায়ী কাজ করেছে। আর বিপত্তারণের ঘর ফাঁকা পেয়ে মূর্তি তৈরির যাবতীয় টাকা চুরি করা চেষ্টা করেছিল। আমরা যদি বিপত্তারণের পিছনে যেতাম, এরা ধরা পড়ত না।

লোকটা মুখ খুলল হঠাৎ,

– বিপত্তারণের পিছনে গিয়েও লাভ ক্ষতি কিছুই হত না। সে তো আর যে-সে লোক নয়।

অঞ্জন তার দিকে তাকাল। সবাই চুপ।

– বিপত্তারণের বাড়ি কোথায় আপনারা জানেন কেউ? লোকটা বলল। ‘জানেন না, আমি বলি শুনুন।’

রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। লোকটা ক্ষীণ নরম সুরে বলে চলল,

– বিপত্তারণের বাড়ি বর্ধমানের পূর্ব সীমানায়, নবদ্বীপের একদম কাছে। ওই যে ওষুধের কথা আমি নবীনবাবুকে বলেছি, সেও ওই অঞ্চল থেকেই এসেছিল এই বীরভূমে। কে এনেছিলেন? মুকুট রায়। বিপত্তারণের পুরো নাম কী? জানেন না কেউ। বিপত্তারণ রায়। মুকুটনারায়ণ এখানে এসে বন কেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন স্থানীয় সাঁওতালদের নিয়ে। সে প্রায় চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। পরে কোনও এক যুগাবতারের খোঁজ পেয়ে তাঁর উত্তরপুরুষেরা ফিরে যান নিজের আদি বাসভূমিতেই। ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়ে যান প্রজাবর্গের মধ্যে। সঙ্গে নিয়ে যান ওই মহামূল্যবান পুথিটি, যাতে বহু রোগ নিরাময়ের কথা লেখা আছে।

অরবিন্দ আশ্চর্য হয়ে বলল,

– তাতে নৃসিংহ সিংহের কী যায় আসে? সে কেন বিপত্তারণকে বিপদে ফেলতে চাইবে?

– নিশ্চয়ই কোনও কারণে সে বিপত্তারণের মুখে আশ্চর্য পুথিটির কথা শুনেছে। এও শুনেছে মুকুট রায়ের লালবর্ণের দেবীর সহায়তা নেওয়ার কথা পুথিতে আছে। তাই হয়তো বিপত্তারণের কাছ থেকে পুথিটি হাতানোর জন্য নিবারণ আর বৃন্দাবনের সাহায্যে কালীমূর্তিতে লাল রং দিয়ে সে পথ পরিষ্কার করেছিল নৃসিংহ। হাতাতে চেয়েছে অসামান্য অ্যান্টিবায়োটিকের ফর্মুলা।

– কিন্তু কালীমূর্তিতে লাল রং ব্যবহার না করার ফতোয়া তো অনেক আগে থেকেই সে জারি করেছে গোলোকপুরে। তাহলে সেটি কী করে সম্ভব?

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বড়ো শ্বাস টেনে বলল,

– আয়নার এদিকটা আমার দেখা। ওদিক আমার অজানা। হয়তো সত্য আর অতিপ্রাকৃত মিলিয়েই নৃসিংহের চিন্তার সত্তা। লালবর্ণের দেবীর সাধক হওয়াও আশ্চর্য নয়। তিনি তো এ অঞ্চলের প্রাচীন রাজবংশেরই অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

অঞ্জন লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

– তুমি লোকটা কে শুনি?

লোকটা মুচকি হেসে বলল,

– আমার নাম জগৎতারণ রায়। আমি বিপত্তারণের দাদা। আমাকে সে সব জানিয়েছে।

– তুমি কী করে জানলে তারা বিপত্তারণকে জঙ্গলপ্রাসাদেই নিয়ে গেছে?

– বিপত্তারণই জানিয়েছে।

– সে কী করে জানল আগে থেকেই?

– জানি না।

**

রামরিখ আর সুরেন খোলা বন্দুক তাগ করেই যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনের প্রত্যেকটা লোকের হাতে ধারালো অস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্র আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে থাকাও আশ্চর্য নয়। খুব সাবধানে, পা টিপে টিপে তারা এগোচ্ছিল। বিপত্তারণ ছেলেটার জন্য রামরিখের খুব মনকেমন করছিল। তার ছেলেটাও ওই বয়সিই কিনা।

তারপর প্রাসাদের চাতালে পৌঁছে বিপত্তারণের হাবভাব দেখে দুজনেই চমকে গিয়েছিল। হুকুমের সুরে হাতের বাঁধন কাটতে বলা, বড়ো চেয়ারটায় বসে নৃসিংহের নাম করে জোরে হেসে ওঠা— সুরেন আর রামরিখ দুজনেই ভাবল, এ কোনও অশৈলী কাণ্ড।

নৃসিংহ লোকটা এগিয়ে এসে জোর গলায় বলল,

– ইয়ার্কি, কীসের ইয়ার্কি? আমিই নৃসিংহ সিংহ। আমি এই অঞ্চলের রাজা হেমন্ত সিংহের বংশধর। ওই রোগনিয়ামক পুথিতেও আমারই অধিকার। কারণ লালবর্ণের দেবী পাণ্ডরা আমাদের একান্ত নিজস্ব কুলদেবী। তুমি কালীমূর্তিতে লাল রং দিয়ে আমাদের সে কুলদেবীর অপমান করেছ। তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।

বিপত্তারণের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। সে প্রচণ্ড জোরে গর্জন করে উঠল,

– চোওওওওপ্, ব্যাটা দারোয়ান, রাজা সাজা হচ্ছে? ভুলে গেছিস তোদের পরিবারের কুলগুরুর কথা? হেমন্তের মায়ের কাছে পুথি না থাকা সত্ত্বেও রোগ নিরাময়ের এত জ্ঞান এল কোথা থেকে জানিস? সে আমাদের পরিবারের মেয়ে। মুকুট রায়ের পরিবারের মেয়ে সে।

নৃসিংহ কেঁপে উঠল থরথর করে। মনে পড়েছে তার। সে শুনেছে ইষ্টমন্ত্র পরিবর্তন করার জন্য কুলগুরু হেমন্ত সিংহকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, রাজা হয়েও হেমন্ত ও তার পরিবার চিরকাল সামান্য রক্ষক হয়ে থাকবে। একমাত্র যার তত্ত্বাবধানে দেবীমূর্তির দেহে লাল রং উঠবে, তাকে হত্যা করে সর্বরোগনিরাময়কারী পুথি হস্তগত করতে পারলেই রাজত্ব ও রাজপদ আবার ফিরে পাওয়া যাবে।

সঙ্গের লোকগুলো অনেক আগেই অস্ত্র ফেলে দিয়েছিল বিপত্তারণের গলা শুনে। নৃসিংহ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপত্তারণের ওপর।

বিপত্তারণ বাঘের মতো ডান হাত বাড়িয়ে নৃসিংহের গলাটা ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। মুহূর্তে তার জিভ বেরিয়ে এল। রামরিখ আর পারল না। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, “উসে ছোড় দে বেটা, খুন-উন হো গ্যয়ে তো বিপত্তারণ ফাস যায়েগা, মুকুট রায় নেহি।”

হাতের মুঠোটা খুলে গেল তার। ধপ করে নৃসিংহ পড়ে গেল বাঁধানো চাতালের ওপর। আর কাঁচা ঘুম ভাঙা অপ্রস্তুত চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল বিপত্তারণ।

নৃসিংহের মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে সুরেন অবাক হয়ে বলে উঠল,

– এ কী! শুভময়বাবু, আপনি?

১১

‘নৃসিংহই যে শুভময় আমি অনেক আগে জানতে পেরেছিলাম।’

রামজীবনের কথায় অবাক হয়ে অঞ্জন বলল,

– কী করে!

রামজীবন পকেট থেকে দুটি কাগজ বার করলেন। একটি শুভময়ের পাওয়া নৃসিংহের ফতোয়া। আর-একটি কাজলির দেওয়া তেলেভাজার তেল মাখানো কাগজটি।

অঞ্জন দেখলেন দুটি কাগজই অবিকল এক। রামজীবন বললেন,

– কাজলি সব জানত। তাই সে আমাকে জানাতে চেয়েছিল বাপের জোরে রূপের কথা।

– তাহলে আপনি আগে বলেননি কেন আমাদের? ব্যাপারটা আগেই মিটে যেত।

– তোমাকে পুলিশের চাকরি কে দিয়েছে বলো তো? হাতেনাতে প্রমাণ না পেলে কাজ হত কিছু? শুভময়কে কী বলে গ্রেপ্তার করতে?

– তাও তো একটা ব্যাপার খোলসা হল না। শুভময় বা নৃসিংহ কি সত্যিই রাজা হেমন্ত সিংহের বংশধর? নাকি শুধুমাত্র পুথিটি হাতিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের ফর্মুলা হস্তগত করা তার উদ্দেশ্য ছিল? আর বিপত্তারণ আসলে কে, মুকুট রায়ের পুনর্জন্ম?

রামজীবন জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। দূর পাহাড়ে রোদ খেলছে। শালবনে ছায়ার টুকরো কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে দুপুর বিকেল হচ্ছে।

– সব জানতে নেই হে ছোকরা। এই জানা-অজানাটুকুর মধ্যেই তো জীবনের স্বাদ। নইলে এ জীবনে বেঁচে থাকার আছেটা কী?

.

বটতলায় সাধু ঝোলাটি কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বিপত্তারণ দাঁড়িয়ে আছে পথের মোড়ে। সাধু থমকে দাঁড়ালেন। বিপত্তারণ এগিয়ে এসে তাঁকে বলল,

– আর আসবে না রাতের দিকে?

সাধু মুচকি হাসলেন।

– আছি তো তোমার সঙ্গে সেই বৌদ্ধ স্তূপ থেকেই। আমি তোমার চিন্তার কায়িক রূপ।

– এত এত বেঁচে থেকে কী হবে? কী রয়ে যাবে আমার নিজস্ব ভাঁড়ারে?

সাধু তাঁর কাঁধে হাত রেখে সুন্দর করে হেসে নরম গলায় বললেন,

– রেশ রয়ে যাবে গো। তোমার উপস্থিতির রেশ। সব ক্লেশ, দ্বেষের শেষে, বাঁচার ইচ্ছের রেশ রয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *