দীপাবলি
বিল্বভদ্রের দুই বউ। বড়োবউ বাঁজা। ছোটোবউ একটি ছা বিইয়েছে, আর সেও জন্মে ইস্তক মায়ের দুধ আর বাপের রক্ত সমানে চুষে চলেছে। ওদিকে ব্যাটার গায়ে গত্তি লাগার নামটি নেই।
সংবৎসরকাল চাষ হয়নি। বৃষ্টি নেই। রাজার ছেলেরা গাধায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশ জুড়ে মেঘের দল কালো হাতির রূপ নিয়ে লড়াই করছে।
পারুলবনের কোণে ধূপ জ্বেলে বসেছেন এক সাদা কাপড় পরা মানুষ। কোনও এক বড়ো শহর থেকে তিনি এসেছেন ঐশ্বর্যের বোঝা এড়াতে। কেউ তাঁর কাছে যায় না। উলটে তিনিই আসেন ভোর না হতে সবার বাড়ি। চেয়েচিন্তে কচুঘেঁচু যা পান, তাই দিয়ে উদরপূর্তি করেন। চাহিদা বা খিদে খুব একটা আছে বলে মুখ দেখে তো বোঝা যায় না।
আজ দু-দিন হল বিল্বভদ্রের ছোটোবউয়ের বুকের দুধ শুকিয়েছে। খাবার না পেলে মায়ের বুক কি আর পুরন্ত হয়? গাভিন গোরুর বাঁটে ভনভন করছে মাছি। ফসল হয়নি, সে কুঁড়ো, খোল কোথায় পায়? ঘাসই বা পায় কোথায়? তাই তারও বুকের দুধ শুকোল।
.
নদের জেলে আর মাঝিরা গাঙের পুব পাড় জুড়ে বসত করে আছে। সেখানে তো আর জলের অভাব নেই। নদী, পুকুর, জলা, বাঁওড়, হাওরে ভরভরন্ত। সমুদ্র গিয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। মাছ সেঁকা, মাছ পোড়া, মাছ শুকনো খেয়ে তাদের ছেলেমেয়ের গা তেলচুকচুকে, পুরুষ্ট। চাল, গম তারা নৌকো চাপিয়ে চালান করে পাটলিপুত্র, মগধ…।
তাদের জাল টানায় সারাদিন সাহায্য করে চারটি চাল আর ফলফলাদি নিয়ে এসেছেন বিল্বভদ্র। মাছ তাঁদের বাড়িতে ওঠে না। বড়ো কবিরাজ ছিলেন বিল্বভদ্রের ঠাকুরদাদা। তাঁর মতে মাংস বুদ্ধিভ্রংশ করে, শুধু অবয়বে বাড়ায়।
সবে চালের গুঁড়ি করে তাতে গরম জল মিশিয়েছে ছোটোবউ। এমন সময় সেই ন্যাড়ামাথা ভিখারি এসে দাঁড়াল উঠোনে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। নদের রসালো ঘাস খেতে লেগেছে গোরু। ছানাটিরও খাবার তৈরি। এমন সময় যদি শুকনো মুখে বাপ-মা-স্বজনহারা কেউ এসে দুয়ারে দাঁড়ায়, কী করে ব্যাটাকে খাওয়ায় বলো দেখি?
ছোটোবউ ছেলের ভাগের থেকে একটু তরল চালের গুঁড়ো পাত্রে ঢেলে লোকটিকে দিল। ছলছল চোখে সেটুকু খেয়ে, সাদা উত্তরীয়তে সে মুখ মুছে নিল। তারপর নরম গলায় বলল, ‘মা গো, তোমার তিনি বাড়ি ফিরলে ওই বটতলায় একবার পাঠিয়ে দিয়ো তো…’
– কেন গা ঠাকুর?
– সে আমাদের পুরুষমানুষের কথা মা, তুমি বুঝবে না।
ছোটোবউ চুপ করে গেল।
সেকালে পুরুষমানুষের কথায় বউমানুষেরা ভারী লজ্জা পেত। নাকি ভয়ই পেত, কী জানি!
বিল্বভদ্র সন্ধে নাগাদ ঘরে ফিরে শুকনো মুখে বলল, ‘আর বুঝি ঠাকুরদাদার কথা রাখা যায় না… মাছ, পাখি বোধহয় হেঁশেলে ঢুকবেই।’
একহাত ঘোমটা মাথায় বড়োবউ বলল, ‘অলুক্ষুণে কথা বন্ধ করো সতিনভাতার… মাছ, মাংস আনলে খোকা মোর খাবে কী? আর ওই আবাগির বেটিই বা কী গিলে আমায় উদ্ধার করবে? ও তুমি আমার ঘরে ঢুকিয়ো না…’
বিল্বভদ্র অবাক হয়ে বললেন,
– খাওয়া জুটবে না গো শর্বরী, কিচ্ছু জুটবে না.
.
– কেন, আমাদের ফল, মেটে আলু, কাঁঠাল, সে কী হবে?
– কিচ্ছু থাকবে না গো বড়োবউ। এই পৃথিবীর রাজা কী এক স্বপ্ন দেখেছেন, সারা বিশ্ব জুড়ে নেমে আসবে অন্ধকার। ঈশ্বরে ঈশ্বরে লড়াই বাধবে। মহাজনেরা আলাদা আলাদা হয়ে নানা দেবতার পক্ষ নেবেন। মাটি শুকিয়ে যাবে। শুকিয়ে যাবে ন-দের নদী, পারুলবনের ফুল। ফসল জ্বলে যাবে। মরা মাছ ভাসবে নদীতে নদীতে। পাখির ঝাঁকে মড়ক লাগবে আর তারা উড়ে উড়ে ছড়িয়ে দেবে বিষাক্ত হাওয়া… সব শেষ হয়ে যাবে গো.. সব..
দরজার পাশে ছোটোবউয়ের মৃদু গলাখাঁকারি শোনা গেল,
– শুনছেন?
বিল্বভদ্র তাকালেন।
ছোটোবউ আস্তে আস্তে বলল, ‘বটতলার সেই সুন্দর ঠাকুরটি আপনাকে একটিবার যেতে বলেছিলেন।’
বিল্বভদ্র আশ্চর্য হলেন। তিনি তো সচরাচর কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করেন না। জিজ্ঞাসা করলেন,
– কারণ কিছু বলেছেন?
– না, কইলেন, পুরুষমানুষের কথা।
– ও..
সশঙ্ক মনে বিল্বভদ্র চললেন নাওয়া খাওয়া ভুলে। প্রাচীন বোধিবৃক্ষের নিচে বসে আছেন নির্বিকার সর্বত্যাগী। কে যেন একটি মাটির প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে গিয়েছে। তার আলোয় তাঁর মুখখানি বড়ো শান্ত মনে হয়।
বিল্বভদ্রকে দেখে তিনি বললেন,
– বসুন ভদ্র..
– আপনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন?
– হ্যাঁ, বিল্বভদ্র, বড়ো গুরুদায়িত্ব দেব আপনাকে।
বিস্মিত হলেন শ্রমিক।
– আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষ কী করে পালন করবে গুরুদায়িত্ব? আপনি ভুল করছেন না তো সাধক?
মৃদু হাসলেন সন্ন্যাসী।
– না বিল্বভদ্র, আমি ভুল করছি না। আপনি অভাবী, তাই পূর্ণতার আশা আপনার নিখাদ। আপনি শূন্য, তাই পরিপূর্ণ হওয়ার পরিসর আপনার বেশি। আপনিই পারবেন।
একজন দুজন করে ষোলোটি মেয়ে বোধিবৃক্ষের তলে দীপ জ্বেলে দিতে আসছে। অন্ধকার আকাশ। ছায়াপ্রাচীরের মতো গাছের মাথায় উল্কা আর জোনাকির ছুট এক হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে স্নিগ্ধতার অলোক অমল গন্ধ।
বিল্বভদ্রের মনটি কেমন যেন করে উঠল। এত নিরেট নৈঃশব্দ্য আগে কোনোদিন তিনি অনুভব করেননি। দীপ হাতে যে মেয়েরা প্রদক্ষিণ করে চলেছে স্থিতধী বোধিবৃক্ষকে, তাদের পায়ের শব্দ উঠছে না পাতার বুকে। শব্দ নেই নিঃশ্বাসের। ঝিল্লিরব শোনা যায় না ঝোপের নরম অন্ধকারে। চরমতম অন্ধকার যেন প্রাণবন্ত হয়ে চেপে ধরছে দু-কান।
তিনি বধির হয়ে আসছেন যেন।
কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
– ঋষি, কী সেই কাজ? আর এত সুকঠিন নিস্তব্ধতা কেন চরাচরে?
– সসাগরা ধরিত্রীর সম্রাটের স্বপ্নের কথা আপনি শুনেছেন?
– হ্যাঁ, শুনেছি। তবে সে তো শুধু স্বপ্ন… তার সত্যতা কই?
– না ভদ্র, সে শুধু স্বপ্ন নয়। আগামী অশনি সংকেতের পূর্বাভাস। নরপতির স্বপ্নে মিশে থাকে দেশ-কালের চেতনা। উদ্বেগ। তা বহুলাংশে সত্য হয় তাই।
এক অসম্ভব ভয় গ্রাস করল বিল্বভদ্রকে। রুগ্ন সন্তানটির কথা মনে পড়ল তাঁর। গৃহিণীর শুকনো মুখ। ভারী গলায় বললেন,
– কী সেই স্বপ্ন মহাজ্ঞানী?
– স্বপ্ন নয়। স্বপ্নবন্ধ। ষোলোটি স্বপ্ন।
– ষোলোটি!
– হ্যাঁ, ষোলোটি ভয়াল দুঃস্বপ্ন। প্রথম, দিবামধ্যে সূর্যাস্ত।
– দিবামধ্যে সূর্যাস্ত! সে কি সম্ভব?
– হ্যাঁ সম্ভব। সকল জ্ঞান, শুভবোধ যখন লুপ্ত হয়, তখন দিবামধ্যেই সূর্যাস্ত হয়।
– তারপর?
– দ্বিতীয় স্বপ্ন, কল্পবৃক্ষের শাখার পতন। রাজবংশ তথা রাজ্যের পতন, ধর্মের বিপর্যয়। তৃতীয় স্বপ্নে রাজন দর্শন করেন, একটি স্বর্গীয় রথ স্বর্গদ্বার থেকে ফিরে আসছে শূন্য হয়ে।
.
দীপহস্ত মেয়েরা থমকে দাঁড়াল। কান্নার সুর বেরিয়ে এল তাদের গলা চিরে। ঘোমটা টানা মুখে আধো আলো আধো অন্ধকার। বাঁশির মুখে একটানা ফুঁয়ের মতো কান্না।
বিল্বভদ্র কেঁপে উঠলেন।
ঋষি বলে চললেন,
– এর অর্থ, স্বর্গ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারতভূমি। দেব, দেবর্ষি, আদিত্য, বসু, গ্রহ, ভাগ্যনির্ধারক তারকা, কৃত্তিকা ত্যাগ করেছেন এই দেশ।
– চতুর্থ স্বপ্ন?
– পূর্ণচন্দ্র দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, যে চিন্তন সৎমার্গ, সৎচিন্তা আর সৎযাপনের পূর্ণতা দান করেছিল, তা দ্বিধাবিভক্ত হতে চলেছে। পঞ্চম স্বপ্ন, যুযুধান কৃষ্ণ হস্তীযূথ।
– হাতির যুদ্ধ! তাতে ভয়ের কী, চিন্তার কী প্রভু?
– বুঝলেন না আপনি ভদ্র। উর্ধ্বে ব্রহ্মা আর পাতাললোকের নারায়ণ ছাড়া বাকি আটদিক রক্ষা করেন আট মহাহস্তী। তাঁরা হলেন ঐরাবত, পুণ্ডরীক, বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পদন্ত, সার্বভৌম এবং সুপ্রতীক। আট দিকের জল, বায়ু, তেজ এঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। ভাবুন দেখি এঁদের মধ্যে মনোমালিন্য, মতপার্থক্য হলে কী হতে পারে।
আর্তনাদ করে উঠলেন বিল্বভদ্র,
– ঠিক, ঠিক তাই-ই হচ্ছে প্রভু… মরে গেছে সব ফসল… বৃষ্টি নেই… শুকিয়ে গেছে মায়ের দুধ… এখন, এখন কী হবে?
– ধৈর্য ধরুন ভদ্র। আমার ব্যাখ্যা শেষ হয়নি এখনও। বিপর্যয়ের এই সবে শুরু।
– এর চেয়েও ভয়ানক!
– শুনুন। বিচার করুন। এরপর গোধূলির মলিন আলোয় দেখা গেল কিছু জোনাকির ফুটকি। বৃহৎ জ্ঞানের আলো সব নিভে যাবে। তার পরিবর্তে সীমিত নগণ্য স্ফুরণের শূন্য আস্ফালনে আরও বেশি অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে সমাজ। সপ্তম স্বপ্নে শুষ্ক হ্রদ জুড়ে ছটফট করছে মাছ। অধর্ম, পাপাচারের কাদা ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। ভক্তির শেষ আর তার সঙ্গেই শুরু অপশক্তির আবির্ভাব।
বিল্বভদ্র কান পাতলেন। কান্নার শব্দ থেমে গেছে। হিংস্র শ্বাপদের চাপা গরগর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘোমটা খুলে গেছে ষোলোটি মেয়ের। টকটকে লাল চোখ। গলার শির ফুলে উঠেছে।
বিল্বভদ্র লাফিয়ে ওঠার উপক্রম করতেই তাঁর হাত চেপে ধরলেন সন্ন্যাসী।
– খবরদার, এ স্থান ছেড়ে উঠবেন না। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মঙ্গলামঙ্গলের এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে আপনি আবদ্ধ হয়েছেন। স্থানত্যাগ করলে মৃত্যু অনিবার্য। ধী রাখুন।
বিল্বভদ্র বসে পড়লেন আবার। চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল তাঁর ভয়ার্ত দৃষ্টি।
– অষ্টম স্বপ্নে শুধু ধোঁয়া। নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো ধোঁয়া। অপশক্তি নিজের রূপ উন্মোচিত করল। নবম, সিংহাসনে উপবিষ্ট বানর। যোগ্য রক্ষকের পতন। তার পরিবর্তে অযোগ্য শাসকের অভ্যুত্থান। দশমে, সোনার পাত্র থেকে কুকুর পায়েস খেয়ে যাবে।
বিল্বভদ্র চিৎকার করে উঠলেন,
– তাই তো হচ্ছে, তাই-ই হচ্ছে। চাষি, শিল্পী, কারিগর, স্থপতির উন্নয়নের পরিকল্পনা না করে, চাষবাসে সহযোগিতা না করে রাজকোশ পরিপূর্ণ হচ্ছে অতিরিক্ত কর আদায়ের মাধ্যমে। শুষে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের রক্তের শেষ বিন্দুটুকু। আর ভয় নেই, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর ভয় পাই না, বলুন ঋষিবর। আমি আর উঠব না এ আসন ছেড়ে।
– একাদশ স্বপ্ন। শিশু ষাঁড়ের দল উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটোছুটি করছে। অস্যার্থ, সঠিক প্রশিক্ষণহীন অজ্ঞান যুবক সন্ন্যাসীরা ধর্মের ভার অযোগ্য কাঁধে তুলে নেবে। তবে, কিছুদূর গিয়েই তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। ধর্মের পথ ছেড়ে আবার গতানুগতিক জীবনে তারা ফিরে যাবে। পথের ধুলোয় লুটোপুটি খাবে চক্র, পদ্ম, নাম, জপ। দ্বাদশ স্বপ্নে রাজপুরুষ গাধার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করছেন। উচ্চবর্গীয় জ্ঞানীরা সাধারণ, অর্বাচীনের জীবন যাপন করবেন। তারপর, বানরযূথ ভঙ্গ করছে রাজহংসের সুখযাপন। অশিক্ষা, কুশিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে পণ্ডিতসমাজ… চতুর্দশ ও পঞ্চদশে যথাক্রমে গো-শাবক সাগর লঙ্ঘন করছে ও শেয়ালের দল বৃদ্ধ ষাঁড়ের সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হচ্ছে। এক অশেষ অন্ধকারের সূত্রপাত। জ্ঞানী, অজ্ঞানী, রাজা, লুণ্ঠনকারী, পাপাচারী, ধার্মিক নির্বিচারে এক ও অভিন্ন জীবন যাপন করবে।
পরনের বস্ত্র খুলে গেছে ষোলোটি নারীমূর্তির। শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের দুপাশ থেকে। গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে তাদের নাক থেকে।
.
হতাশ কণ্ঠে বিল্বভদ্র বললেন,
– ষোড়শ স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমি জানি। সে অতি ভয়ানক। দিকে দিকে লুঠতরাজ। রক্তস্রোত। মহামারি। খরা। ভূমিক্ষয়। বছরের বারোটি মাসই নিরন্ন উপবাস। মৃত্যু… মৃত্যু… মৃত্যু… শুধু মৃত্যু।
– হ্যাঁ ভদ্র, তাই। বারোটি মাথাঅলা সাপ গ্রাস করছে পৃথিবীকে। তবে ভদ্র, এতে একটি আশার বাণীও রয়েছে। এবং সেখানেই আপনার সার্থকতা।
– আশা? এখনও আশা আছে? কীভাবে ঋষি?
– সর্বাঙ্গীণ ধ্বংসের পরই শুরু হয় সৃষ্টি। ছাইয়ের রাশি থেকেই উঠে আসেন শিব-সুন্দর। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে সেই পরাক্রমশালী সম্রাটের, যিনি ছয়শত যোজন জুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য স্থাপন করবেন। দক্ষিণে কর্ণাট থেকে উত্তরে কপিলাবত্থ, পশ্চিমে পুষ্কলাবতী থেকে পূর্বে জয়ন্তীয়া শৈলমালা পর্যন্ত সকল মনুষ্য, দানব, কিন্নর, যক্ষ তাঁর পদানত হবে। ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত তাঁর গাথা রচিত হবে ভিন্ন ভিন্ন লিপিতে। প্রাকৃত থেকে হেলেনিক সকল লেখ-তে তিনি হবেন বন্দিত, গীত।
এ দেশের নাব্য নদীকূল শেষে সমুদ্রের তীরে তাঁর বিজয়রথ পৌঁছোলে দেবভাষায় রচিত হবে,
“পৌরস্ত্যান্ এবম্ আক্রামংস তাংস্ তানজনপদান্ জয়ী।
প্রাপ তালীবনশ্যামম্ উপকণ্ঠং মহোদধেঃ।।”
অর্থ,
“প্রাচ্যদেশগুলি এইভাবে আক্রমণ ও জয় করতে করতে বিজয়ী তালগাছপূর্ণ মহাসমুদ্রের উপকূলে পৌঁছোবেন।”
“অনম্রাণাং সমুদ্ধর্তুসতস্মাৎ সিন্ধুরয়াদ্ ইব।
আত্মা সংরক্ষিতঃ সুম্হৈর বৃত্তিম্ আশ্রিত্য বৈতসীম্।।”
“যারা নম্র নয় তাদের উৎপাটনকারী বিজয়ীর কাছ থেকে— যেমন সমুদ্রের বেগ থেকে— সুমহেরা নিজেদের রক্ষা করবেন বেতগাছের ধর্ম অর্থাৎ অবনতি অবলম্বন করে।”
আপনাকে এই বোধিবৃক্ষের নিচে অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হবে তাঁর আগমন পর্যন্ত।
বিল্বভদ্রের ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল। করজোড়ে তিনি বললেন,
– ততদিন যদি আমি না থাকি প্রভু?
– তবে আপনার বংশজাতক জ্বালিয়ে রাখবে। তার অনুপস্থিতিতে আরও অন্য আতুর, অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্বল মানুষের দল রক্ষা করবে এই দীপালোক।
আভূমি আনত হয়ে বিল্বভদ্র বললেন,
– যথা আজ্ঞা প্রভু।
ষোড়শ নারীমূর্তির হাতের প্রদীপগুলি একত্রিত হয়ে এক নিবাত নিষ্কম্প শিখা হয়ে জ্বলে রইল বোধিবৃক্ষের পদমূলে।
দুটি হাত দিয়ে তার শিখা আড়াল করলেন বিল্বভদ্র।
***
সন্ন্যাসী ভদ্রবাহু চললেন দেশান্তরে।
অন্ধকারময় পথে তাঁর পিছনে চলল চৌদ্দটি আলোর বিন্দু।
দুটি আলোর বিন্দু মিশে গেল ঋষির চোখের তারায়।
…বিল্বভদ্রের আসন্নপ্রসবা গাভীটি প্রসব করল একটি ঘন কালো রঙের বাছুর।
বোধিবৃক্ষের প্রদীপটির পাশে বসে বিল্বভদ্র যেন কার নূপুরের শব্দ শুনতে পেলেন।