ভাইকিংদের দেশে

ভাইকিংদের দেশে

ই-মেল খুলতেই মনটা নেচে উঠল। একটা নেমন্তন্ন চিঠি এসেছে সুইডিশ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে। সুইডেন? সারা সুইডেন দেশে আমি মাত্র দুজন মানুষকে চিনি, একজন সুইডিশ জার্নালিস্ট লেনা, আরেকজন পাঞ্জাবি লেখক সতীকুমার কপিল। কিন্তু এই চিঠিটা তাঁদের কেউই লেখেননি,লিখেছেন সম্পূর্ণ অচেনা একজন। অদ্ভুত চিঠি। বাংলায় এরকম শোনায়—

আপনার হয়তো আমাকে মনে নেই। কিন্তু কয়েক বছর আগে একটি সুইডিশ লেখকদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমি ভারতে গিয়েছিলাম। দিল্লিতে আমাদের দুজনের পরিচয় হয়েছিল। আমাদের স্টকহোম শহরে আগামী ১৮ মে থেকে যে বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে একটি অনুবাদ-কর্মশালা থাকবে। আমি আপনার কয়েকটি কবিতা ইংরিজি থেকে অনুবাদ করেছি, ওই কর্মশালায় সেগুলি পাঠ করা হবে। আমাদের খুব ইচ্ছে ওই সময়ে আপনিও আমাদের সঙ্গে থাকেন ও মূল কবিতাগুলি বাংলায় পাঠ করেন। সম্মেলনে অনেক সুইডিশ লেখক আসবেন। আপনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলে তাঁদের ভালো লাগবে। আমাদের কমনফ্রেন্ড মিঃ কপিল বলছিলেন আপনি মে মাসে ইংল্যান্ডে আসছেন। কষ্ট করে যদি একটু সুইডেনেও ঘুরে যান, তাহলে খুব ভালো হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের টাকাকড়ি বিশেষ নেই, কিন্তু আপনার লন্ডন-স্টকহোম এয়ারফেয়ারের এবং ১৭ থেকে ২৩ সাতদিন স্টকহোমের থাকা-খাওয়ার সব ভার আমাদের। ২২ তারিখ আমাদের শহরের প্রথম আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগার ভবন-এর উদ্বোধন হবে। সেই উৎসবে আপনার মতোই একজন বিদেশি লেখককে আমরা চাইছি। ভিসার জন্য স্পন্সরশিপপত্রও পাঠিয়ে দিচ্ছি, যাতে দেরি না হয়।

বারবার খুব মন দিয়ে চিঠিটা পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না স্বাক্ষরকারিণীর মুখখানা। যিনি আমাকে ভালোবেসে আমার কবিতা অনুবাদ করেছেন, এবং আরও ভালোবেসে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। যেতে ইচ্ছে তো ষোলো আনা, কিন্তু যাই কেমন করে? এত দেরিতে ডাকলে হয়? আমার ইংল্যান্ড যাত্রার দিনটা তাহলে এগোতে হবে। ভেবেছিলাম মে মাসের শেষের দিকে যাব, মাঝামাঝি সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ-কর্মশালা শেষ হচ্ছে। স্টকহোম ১৭ তারিখে পৌঁছতে হলে, ১৪ তারিখ কলকাতা ছাড়তে হবে। ১৫ তারিখ লন্ডন। ১৬ তারিখ স্টকহোম রওনা। কিন্তু এত দেরিতে আমার ইচ্ছামতো সস্তা ফ্লাইট পাওয়া বেশ কঠিন হবে। ইংল্যান্ড যাত্রার সস্তাতম পন্থাটাই আমি খুঁজছি। অ্যারোফ্লোট ১৫ তারিখ ছাড়ছে। সপ্তায় মাত্র একটা। হবে না। বিমান, এমিরেটস, রয়্যাল জর্ডন, সিঙ্গাপুর, থাই, রয়্যাল ব্রুনেই, ব্রিটিশ এয়ার, কে এল এম, লুফটহানসা, এস এ এস সর্বত্র খোঁজ নিয়ে দেখা গেল ১৮ তারিখের সাহিত্য সম্মেলনে পৌঁছনোর কোনওই সম্ভবানা নেই।

ইতিমধ্যে মহোৎসাহে আমাকে ভিসার জন্য স্পন্সরশিপপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে সুইডিশ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সময়েই দুদিনের জন্য দিল্লিতে আমার একটা মিটিং ছিল, সেই সুযোগে ঝটপট সুইডিশ এম্ব্যাসি থেকে আমি ভিসাও করিয়ে ফেললাম। নিয়মমাফিক সুইডিশ ভিসাতে বাহাত্তর ঘণ্টা লাগে, কিন্তু সুইডিশ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন আগ বাড়িয়ে এম্ব্যাসিতেও আমার জন্য চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল বলে, যাওয়ামাত্রই ভিসা হয়ে গেল। হাতে ভিসা, পকেটে নেমন্তন্নপত্র, কিন্তু টিকিট যে পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনমতো দিনে। বেশি টাকার টিকিট হয়তো পাওয়া যেত, কিন্তু তার চেষ্টাই করিনি। এবারে যে নিজের খরচেই আমেরিকা যাচ্ছি লন্ডন হয়ে। আমার অতি প্রিয় ভাগ্নেটি আছে সেখানে, তার খুব বেশি অসুখ। তাকেই দেখতে অ্যালাবামাতে যাচ্ছি এই গরমের ছুটিতে। ইংল্যান্ড দিয়ে আমেরিকা যাতায়াতের সস্তা টিকিটের খোঁজ করছি অনেকদিন ধরেই। মুশকিলটা গোপনে তবে বলি : নিজের খরচে বিদেশ যাওয়ার তো অভ্যাস নেই আমার! সর্বদাই যাই ডাঁটের মাথায়, পরের পয়সায়, নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে অন্যেরা টিকিট কেটে দেয়। নিজের পকেট অটুট থাকে। কবি নিসিম ইজিকিয়েল বলেছিলেন, ‘পরের পয়সায় ভ্রমণ করে করে এমনই স্বভাব খারাপ হয়েছে যে বাসে উঠলেও কন্ডাক্টর যখন পয়সা চায় তখন পাশের লোকটার দিকে আমার চোখ চলে যায়’, আমারও প্রায় সেই অবস্থা! নিজের খরচে যেতে হলে সস্তা টিকিটের খোঁজ না করেই উপায় নেই।

সুইডিশে যা বিরগিট্টা, ইংরিজিতে সেটাই ব্রিজেট, ফরাসিতে ব্রিজিত (যেমন ব্রিজিত বারদো) ইত্যাদি। ‘বিরগিট্টা’ খুব শ্রুতিমধুর নয় বাঙালির কানে, চুপিচুপি একটা অস্বস্তিকর প্রতিধ্বনি ওঠে, গিরগিট্টির।

শেষপর্যন্ত বিরগিট্টাকে দুঃখের সঙ্গে ই-মেল করলাম, ‘১৮ তারিখ আসা অসম্ভব। খুবই দুঃখিত। সুইডিশ লেখকদের সঙ্গে এযাত্রায় আর পরিচয় হল না। কী আর করা? অনুবাদ কর্মশালার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা।’

বিরগিট্টা সঙ্গে সঙ্গে ই-মেল করলেন, ‘১৮ তারিখ আসা হল না বলে দুঃখিত। কিন্তু ২২ তারিখ আসতেই হবে, তার সময় আছে এখনও। স্টকহোমের প্রথম আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা আপনাকে প্রধান অতিথি করেছি। ২২ তারিখ রাত ৮টায় ব্যাঙ্কোয়েট সহ উদ্বোধন উৎসব। আফটার-ডিনার স্পিচটা আপনাকে দিতে হবে। সেইসঙ্গে স্থির হয়েছে সুইডিশে আপনার কবিতার অনুবাদগুলি ওখানেই পাঠ করা হবে এবং বাংলা কবিতাগুলি পড়বেন আপনি স্বয়ং।’ এই চিঠিটা পেয়ে উঠে পড়ে কোমর বেঁধে লেগে পড়লাম। চরম চেষ্টা করলে বাংলাদেশ বিমানে একুশে সকালে পৌঁছনো যাচ্ছে লন্ডন। বাইশে যেতে হবে সুইডেন। সমগ্র পৃথিবীতেই মানুষের নির্ভরযোগ্য বন্ধুর বিশেষ অভাব-অথচ শুধু লন্ডনেই আমার নির্ভরযোগ্য বন্ধু আছেন বেশ কয়েকজন। ঈশ্বর আমাকে অনেক করুণা করেছেন, তার মধ্যে প্রধান কৃপা আমার এই বন্ধুভাগ্য। লন্ডনের ডাক্তার নীরেন দত্ত এমনিই এক বন্ধু। ওঁকে ফোনে অনুরোধ করতেই নীরেন সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটে খুঁজে পেতে ২২ তারিখে আমার জন্য ‘রায়ান এয়ারে’ সাতদিনের রিটার্ন টিকিট কেটে ফেললেন। দুপুরবেলা লন্ডন থেকে রওনা, বিকেলে স্টকহোম।

লন্ডনে ২১ তারিখ নামলাম, সেদিন রাতেই সেখানে অজিত পাঁজা তাঁর কলকাতা হাইকোর্টের আইনজ্ঞ বন্ধুদের নিয়ে ‘নটী বিনোদিনী’ নাটক মঞ্চস্থ করছেন। তিনি নিজে সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভূমিকায়। মাত্র একটি রাতই লন্ডনে বাস, তারই মধ্যে এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়ে আমি তো খুব খুশি। সত্যিই দেখার মতো অভিনয়। শুধু শ্রীরামকৃষ্ণই নন, গিরিশ ঘোষও অনবদ্য। পরদিন কবিতা-বগলে ছুট ছুট ছুট স্টকহোম।

নীরেনের স্ত্রী পৃথাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলে। হিথরো নয়, অন্য একটা ছোট এয়ারপোর্ট। ওদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়। স্টকহোমে নামলামও অমনিই একটি ছিমছাম ছোট্ট এয়ারপোর্টে। কিন্তু স্টকহোম থেকে এটি অনেক দূর। ‘রায়ান এয়ার’ ইউরোপের সস্তাতম বিমানসংস্থাগুলির মধ্যে একটি। এরা ছোট ছোট প্লেনে ছোট ছোট এয়ারপোর্ট থেকে ওড়ে। প্লেনে কিছুই খেতে দেয় না, চা পর্যন্ত নয়। সঙ্গে মালপত্রও নিতে দেয় যৎসামান্য। শহরে পৌঁছতে দেরি হবে ভেবেই পৃথা আমার সঙ্গে খাবারদাবার দিয়ে দিয়েছিল টিফিন বাক্সতে ভরে, ট্রেনে যেমন পরটা আলুর তরকারি নেওয়া নিয়ম, অবিকল সেই স্টাইলে। জলের বোতল তো আছেই। প্লেনে উঠে দেখি, আমি একা নই। সকলেরই আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স বেরচ্ছে, বোতল বেরুচ্ছে, বিয়ারের ক্যান বেরচ্ছে। প্লেনেও অবশ্য বিক্রি হচ্ছে স্যান্ডউইচ, বার্গার, চা-কফি-কোকাকোলা, বিয়ার, ওয়াইন, যে যা কিনতে চাইবে। চারঘণ্টার ফ্লাইট। তারপর বাসে দেড়ঘণ্টা, স্টকহোম শহর।

সুইডেনে যাবার আগে থেকেই মন কেমন শুরু হয়েছিল। মা-বাবার জন্য। ছেলেবেলার জন্য। সেই সময়টার জন্য, যখন প্রথমবার স্টকহোম গিয়েছিলাম। তখন আমার নেহাৎ বালিকা বয়েস। সবে চোখ মেলতে শুরু করেছে মন—পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি পড়ছে, প্রশ্ন জাগছে, তেমন সন্ধিলগ্নেই মা-বাবার সঙ্গে প্রথম ইউরোপ দর্শন। তারপরে অজস্রবার। স্বামীর সঙ্গে। একলা। একলাই বেশি। কিন্তু সুইডেনে আর যাওয়া হয়নি। এতদিনে একবারও না। সেই মা-বাবার সঙ্গে যাত্রার পরে এই যাওয়া। মাঝে অর্ধ শতাব্দীর নিঃশব্দ বয়ে যাওয়া।

বাবা ছিলেন স্বভাবেই ভ্রাম্যমাণ—সুইডেন থেকে আমরা গিয়েছিলাম নরওয়েতে। অসলো, অসলো থেকে নারভিক। নারভিক থেকে ট্রমসো। মধ্যরাতের সূর্যের সঙ্গে দেখা করবার অদম্য আগ্রহে ক্রমশ উত্তরে, আরও উত্তরে, শেষ পর্যন্ত একেবারে আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে পৌঁছে গেলেন বাবা। সেখানে আকাশে তখন সারা রাত-দিনের আলো ফুটে থাকে। ছ মাস দিন, ছ মাস রাত। ঘন রঙের মোটা পর্দার চাদর টেনে দিয়ে, ঘরে রাত ডেকে এনে, তবে ঘুমোতে হয়। রাত দুটোর সময়ে সূর্য উঠেছিল সেদিন, বাবা-মা আমাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়েছিলেন,

খুকু! ওঠ, ওঠ, ওই দ্যাখ, কি সুন্দর মধ্যরাতের সূর্য উঠছে! সেই শিহরণ এখনও আমার সারা শরীরের স্মরণে আছে।

স্টকহোম বলতে আমার শুধু মনে পড়ে জল। জাহাজ আর জল। আর একটা পুতুল। সোনালি চুল, সাদা ব্লাউজ, আকাশ-নীল টিউনিক, হলুদ রঙের এপ্রন পরনে সেই পুতুল আমার সঙ্গে কলকাতাতে গিয়েছিল স্টকহোম থেকে। এবার স্টকহোমে গিয়ে তাকে একবারটি খুঁজতে হবে। কিন্তু সেই মেয়েটাকে তো আর খুঁজে পাব না, পুতুলটা যার খেলার সঙ্গী ছিল।

সবুজ ঘাস, সবুজ বনভূমি, মাঝে মাঝেই কানায় কানায় ভরা টলটলে জলের তন্বী নদী, আর ভারি মেঘলা আকাশের মধ্যেই এসে পড়লাম শহর স্টকহোমের মধ্যবিন্দুতে। বাসস্টেশনে আমাকে নিতে এসেছেন আমার বন্ধু সতী কপিল, আর তাঁর পিতৃপ্রতিম প্রকাশক দিল্লির প্রীতম সিং। এঁকে সতী ‘পাপাজি’ বলেই সম্বোধন করেন। আমিও তাই শুরু করি। প্রথমেই তিনি জানালেন তাঁর বয়স ছিয়াশি। দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, আমার ছোট্টখাট্ট সুটকেসটা টানাটানিও করলেন, ‘ছোড়ো বেটি, মুঝে দে দো’ বলে। নিপাট ভালোমানুষ। ওঁরা জানালেন, সভার ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত বলে বিরগিট্টা নিজে আসতে পারেননি। তাই সুইডিশ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেই সতী আমাকে নিতে এসেছেন। তিনিও তার সক্রিয় সদস্য, পাঞ্জাবি এবং সুইডিশ দুই ভাষাতেই গদ্য লেখেন। সতী আমার পূর্বপরিচিত বন্ধু, পাঞ্জাবি লেখিকা অজিত কৌর আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন একবার দিল্লিতে। অন্য বন্ধুটি সুইডিশ জার্নালিস্ট, লেনা হেনেল। লেনা স্টকহোমের বৃহত্তম প্রচারিত খবরের কাগজে (ভেনস্কা ডাগেনব্লাডেট) কাজ করেন। একবার কলকাতায় এসে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। সেই থেকে আমার বন্ধু। অমর্ত্য যখন নোবেল পেলেন, লেনা তখন গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে পিকো-টুম্পার সঙ্গে দেখা করে ভালোবাসা জানিয়ে এসেছিলেন। লেনার সঙ্গে আমার ই-মেলে যোগাযোগ হয়েছে। তিনিও বিরগিট্টাকে চেনেন। বিরগিট্টা সুইডেনের বুদ্ধিজীবীমহলে রীতিমতো পরিচিত, লেনা জানিয়েছেন, একটি নামী পত্রিকা প্রকাশ করেন বিরগিট্টা–নাম, ক্যারাভ্যান। তাতে কলকাতার লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে শেষতম সংখ্যায়। বিরগিট্টা তাঁর পত্রিকাকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে পেরেছেন সম্পূর্ণ একারই চেষ্টায়। অনেক বছর ধরে বের করে চলেছেন এই সাহিত্যপত্রটি।

সতী ও পাপাজির সঙ্গে ট্যাক্সিতে আমরা স্টকহোমের নতুন সম্পদ, ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগার’-এ হাজির হলাম। পুরনো রয়্যাল লাইব্রেরিরই শাখা এটি। নতুন বাড়িটি মূল বাড়ির পাশেই।

দেরি হয়ে গেছে, সুটকেস সুদ্ধ দৌড়তে দৌড়তে প্রবেশ ঘটল প্রধান অতিথির। ক্লান্ত বিধ্বস্ত মূর্তি—পথের শাড়িটা আর বদল করবার সময় পাইনি। যদিও সযত্নে সুটকেসে গুছিয়ে এনেছিলাম প্রধান অতিথির উপযুক্ত ‘মিটিং কা কাপড়া’।

ঢুকেই রিসেপশনের দেওয়ালের ডেকরেশনে দেখলাম পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার অক্ষরের সঙ্গে সযত্নে বাংলায় ‘ড়’ আর ‘ক্ষ’ আঁকা রয়েছে। রয়েছে দেবনাগরী হরফও। ‘ক্ষ’ আর ‘ড়’ ওদের দৃষ্টিতে নান্দনিক মূল্য পেয়েছে, উচ্চারণের কাঠিন্য ওদের তো শ্রুতিতে জানা নেই। আদর করে ওপরে নিয়ে যাওয়া হল প্রধান অতিথিকে, বিরগিট্টা খবর পেয়ে ছুটে এলেন লিফটের কাছে। ভালো করে দেখলে মনে হয় চল্লিশের ঘরে বয়স, ছটফটে, রোগা পাতলা। এলোমেলো চুল, তরুণী শরীর, একগাল হাসি। হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাক্সপ্যাঁটরা রেখে দেওয়া হল চোখের আড়ালে, আমি সোজা বাহিত হলাম খাবার ঘরে। দেরি হয়ে গেছে। দেড়ঘণ্টার ককটেল আওয়ার সমাপ্ত, এখন মূলভোজ শুরু হচ্ছে, আটটায়। টেবিল সাজানো, খাবার প্রস্তুত। আকাশে অবশ্য এখনও দিনের আলো। সন্ধ্যা সবে নামব নামব করছে। ভোজের অন্তে, পৌনে নটায় আমার বক্তৃতা। এই ঘরেই।

ব্যাঙ্কোয়েটের ব্যবস্থা চমকদার। চার রকমের ওয়াইন, বিয়ার আর পাঁচ রকমের মাংস চিকেন, হ্যাম, বিফ, হর্স-মিট, ল্যাম্ব। এবং পাঁচ রকমের মাছ। টুনা, স্যামন, প্রন, ক্র্যাব, আর নাম না-জানা একরকমের কুচো মাছ। প্রচুর শাকসব্জি এবং অজস্র রংঢংয়ের পনির। সুইডিশ তো আছেই, পরন্তু ডেনিশ, ডাচ, ফরাসি, সুইস, ইংলিশ—নানান দেশের চিজের সমাহার। সাজিভর্তি অনেক ধরনের ফল। ভোজন টেবিলে বসে, অতিথিদের প্রত্যেকের জন্যই পাতা সাজানো আছে মূল্যবান প্লেট, রঙিন কাপড়ের কড়কড়ে ন্যাপকিন, দুটো করে ক্রিস্টাল ওয়াইন গ্লাস দিয়ে। খাদ্য কিন্তু অন্যত্র। লম্বা, সুদৃশ্য, ফুলফলে সজ্জিত টেবিলে সাজানো। বুফে নিয়মে স্বয়ংসেবার ব্যবস্থা। পরিবেশন করবার জন্য হোস্ট, হোস্টেসরা সেই দীর্ঘ টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, অতিথির অভিরুচি মাফিক খানা প্লেটে তুলে দেবেন। প্লেট হাতে যেতে হবে টেবিলে।

‘ঘোড়ার মাংসটা খেয়ে ফেলো না যেন, ওই যে ওই পাতলা কোল্ড কাটটা, লাল রঙের’, সতীকুমার সতর্ক করে দেন।

–কেন? খাব না কেন?

—ওটা ঘোড়ার মাংস না? খাবে তুমি?

—তুমি বিফ খাও না?

—বিফ আর ঘোড়ার মাংস এক হল?

—মোটেই নয়। ঘোড়ার দুধ আমি কখনও খাইনি।

সতী একটু থেমে রইলেন।

—খাও তাহলে হর্স-মিট। পেটে সহ্য হবে তো?

-বেশ তো ফিনফিনে পাতলা পাতলা পরত দেখছি, হজম হবে না কেন?

খেতে অবশ্য তেমন কিছু নয় হর্স-মিট। যে কোনও মাংসের মতোই। না খেলে ঠকতাম না।

মাংস ভক্ষণ ব্যাপারটাই বড় কুরুচিকর। একটা নিরীহ প্রাণী, যে আমার মতোই মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে, তাকে মেরে, কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলে ঢেকুর তুলে ‘আঃ’ বলে পান মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। এ বাতাপি-ইম্বলের চেয়ে আলাদা আর কী। শিক্ষা, ধর্ম, রুচি, মানবিকতা, কোনও দিক থেকেই মাংস ভক্ষণ ব্যাপারটাকে মার্জিত, সংস্কৃত আচরণ বলে মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃত অর্থে সভ্য মানুষের উচিত শাকভোজী হওয়া। আর মাংসই যদি খেলাম তাহলে তো গরু ঘোড়া ছাগল ভেড়া সবাই এক! আমার বন্ধু একদা শাকভোজী এ কে রামানুজন যখন আমেরিকাতে গিয়ে আমিষাশী হলেন, আমি তখনও বিফ খাই না। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মাংসই যদি খেলে, তাহলে বিফ আর ল্যাম্বে, মাটন আর পর্কে কোনও ফারাক নেই, সবাই তো প্রাণী। আমাদের নিষ্ঠুরতার, হৃদয়হীনতার ধরনটা তো একই থাকছে।’

খাবার টেবিলে দুজনের সঙ্গে পরিচয় হল। দুজনেই প্রকাশক, একজন খুব প্রতিষ্ঠিত, পেটারসোন, তাঁর প্রসিদ্ধ প্রকাশনীর নাম ওর্ডফ্রন্ট’। এক ডাকেই চেনে তাঁকে সুইডেনের মানুষ অন্যজনের নাম গুস্তাফসোন, তিনি ‘ট্রানান’, বলাকা, নামের ছোট প্রকাশন সংস্থা চালান। দুজনেই মাঝবয়সী, মিষ্টভাষী, সুদর্শন, সৌম্য স্বভাব মানুষ। পেটারসোন বললেন, তাঁরা একটি পোষ্যকন্যা নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে, তার নাম পরমা। এর মধ্যে একদিন কি পরমার সঙ্গে আমি লাঞ্চ খেতে পারব? তার নিজের শহরের মানুষকে দেখুক পরমা। তার বয়স এখন দশ। ঠিক করা হল দেখা হবে কালই। তার স্কুল থেকে সে আসবে তার বাবার অফিসে।

আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সতী কপিলের বাড়িতে। পাপাজিও আছেন, আর আছে সতীর কলেজপড়ুয়া ছেলে, মাইকেল। কিন্তু ওঁরা থাকেন একটু দূরে, খুব সুন্দর একটি অঞ্চলে, ‘সোলনা’তে। স্টকহোমের উপকণ্ঠে। মেট্রো ট্রেনে চড়ে ঠিক পনেরো মিনিটে শহরের কেন্দ্র থেকে সুন্দরী সোলনায় পৌঁছনো যায়। সেখানে হ্রদের তীরে য়ুংফ্রাও ডানসেন রাস্তাতে ওঁদের বাড়ি। ‘যুবতী নারীর নৃত্য’ নামের রাস্তা এর আগে দেখিনি আমি। যদিও সুইজারল্যান্ডে ইন্টারলাকেন থেকে আল্পসের একটি শিখরে যাওয়া যায়, প্রাচীন ফুর্নিকুলার রেলগাড়ি চেপে, সেই শিখরের নাম য়ুংফ্রাও। যুবতী নারী। মা-বাবার সঙ্গে যেবারে সুইডেনে আসি, সেই বছরে আমি সুইজারল্যান্ডের য়ুংফ্রাওতেও চড়েছিলাম। এত বরফ, এত বরফ, এত তুষার—আমি তার আগে কোনওদিন দেখিনি। সবদিক শুধু শাদা। সেই য়ুংফ্রাও খুবই শীতল নারী। ফ্রিজিড। সোলনার যুবতী নারী নাচের রাস্তা একেবারেই ভিন্ন গল্প। যেমন নাম, তেমনই রূপ। নীলাকাশ, নীল হ্রদ, আর সবুজ বন, গাছগাছালি, তার ওপরে মে মাস!—বসন্তের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে দিগ্বিদিক, পরিচ্ছন্ন ফাঁকা পথঘাট ফুলের কেয়ারি দিয়ে ঘেরা। ঝরা ফুল না মাড়িয়ে পথচলা যাবে না। পরমার সঙ্গে দেখা করতে সোলনা থেকে আমাকে আনার ব্যবস্থা পেটারসোনই করবেন।

খাওয়া শেষে কফি আর পেস্ট্রি খেতে খেতে লোকে কবিতা শুনবে। এটা ভালো লাগল না আমার মোটেই। সুরাপান করতে করতে শোনে যদি, ঠিক আছে। তার ঐতিহ্য পুরনো। ‘কফিহাউসে মহাকাব্য গাওয়ার ইতিবৃত্তও যথেষ্ট প্রাচীন’, আমার মন আমাকে বকুনি দেয়। আহা, কফি না হয় চলবে, কিন্তু পেস্ট্রি?

মাইক ফিট হয়ে গেল, মঞ্চ প্রস্তুত। বিরগিট্টা নয়, মাইকে গেলেন প্রধান গ্রন্থাগারিকা মহিলা স্বয়ং। আমাকে স্বাগত জানালেন। এবং আমার পরিচয় দিলেন উপস্থিত অভ্যাগত সুধীজনকে। সুইডিশ ভাষাতে কী কী বললেন, আমার বোধগম্য হল না। তার পরে বিরগিট্টা মাইকে গেলেন, আমাকেও ডেকে নিয়ে যাওয়া হল। বিরগিট্টা একেকটা কবিতার নাম প্রথমে ইংরিজিতে, তারপর সুইডিশে তার অনুবাদ পড়েন, তাঁর পিছু পিছু আমিও পড়ি মূল কবিতাগুলো বাংলায়। শ্রোতৃমণ্ডলী যথেষ্ট মনোনিবেশ করে কবিতা পাঠ শুনলেন। তারপর আমাকে বক্তৃতা করতে বলা হল। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুইডেনের সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম কারণ, সেহেতু শ্রোতৃমণ্ডলী থেকে অনুরোধ এল, ‘আজকের ভারতীয় জীবনে ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের স্থান কী ও কতটা?’ আমি সবিনয়ে বললাম, ‘এক নিশ্বাসে ভারতীয় জীবন বলে কিছু বলা শক্ত ভারতীয় সাহিত্যের পক্ষেও একটাই খোপ যথেষ্ট নয়। ভারতবর্ষ বাইশটা ভাষা নিয়ে বিশাল দেশ, বাংলার ওপরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এখনও যতটা প্রবল, তাঁর মৃত্যুর পরে ভারতের অন্যান্য ভাষায় ঠিক ততটা নেই। কিন্তু বাঙালির (ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশে) রবীন্দ্রনাথ চিরজাগ্রত। জীবনের ভাষার মধ্যে ঢুকে গেছেন, প্রবাদের মধ্যে ঢুকেছেন, চিত্রকল্পে জাল পেতেছেন। সুখে, দুঃখে আমরা তাঁরই গান গাই।’

সে তো হল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তোমার ওপরে তাঁর প্রভাব কীরকম?

‘ও বাবা। আমার তো নাম থেকেই শুরু! বাবা-মায়ের বিবাহের প্রস্তাবনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঢুকে পড়েছেন আমার জীবনে। যাঁর সঙ্গে বিয়ে হল আমার, তাঁর নামকরণও রবীন্দ্রনাথের করা। আর ব্যক্তিগতভাবে এখনও সারা বিশ্বভুবনে বাংলা সাহিত্য গড়ে তুলতে অন্তরাল থেকে শক্তি জুগিয়েছেন। তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে গেছেন তিনি-ভারতবর্ষ, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, প্রেম করি, যেভাবে কাপড় পরি, নাচি, গাই, সবই তাঁর তৈরি করে দেওয়া। আমাদের রুচিপছন্দও ওঁর গড়ে দেওয়া। মার বিধবাবিবাহের পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামকরণ করেন ‘নবনীতা’, কেননা তিনি নতুন জীবনে আনীতা হলেন। কিন্তু আমার মা সেই নামটি সবিনয়ে ফেরত দিলেন, তাঁর রাধারানী নামটাই আঠাশ বছরের চেনা বলে। এর আট বছর পরে আমার জন্মের সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই, কোনও অনুরোধ ছাড়াই, ওই নামটিকে একটি চিঠিতে লিখে, আমাকে ওঁর আশীর্বাদসহ উপহার দেন। এই নামটি আমার গুরুদেবের কাছে পাওয়া আশীর্বাণী। আমি আমার লেখাতেও সবচেয়ে ঋণী রবীন্দ্রনাথেরই কাছে। যদিও আমাদের সকলেরই প্রধান প্রয়াস রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে না লিখতে চেষ্টা করা।’

অনেক প্রশ্ন-উত্তর হল।

ইংরিজিতে রচিত ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন হল। মেয়েদের লেখা নিয়ে প্রশ্ন অনুবাদ প্রসঙ্গ। তসলিমা নাসরিন। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন হচ্ছিল, তাই উত্তর দিতেও ভালো লাগছিল। অচিরেই আলোচনাসভা জমে উঠল। কখন কফি শেষ হয়ে ব্র্যান্ডি চলে এসেছে। এক সময়ে চলে যাবার সময় হল। আলোচনা সাঙ্গ করে আমার কয়েকটি বই আমি গ্রন্থাগারকে উপহার দিলাম। গ্রন্থাগার থেকে আমাকে দিলেন একটি বই বইবার ব্যাগ। আমার অতি প্রিয় বস্তু। তাতে স্টকহোম আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগারের নাম লেখা।

ইয়ান পিটারসোনের মেয়ে পরমা একবর্ণ বাংলা জানে না, ইংরিজিও নয়। অত্যন্ত সুন্দর একটি অষ্টাদশ শতকের বাড়িতে নিয়ে গেলেন ইয়ান, বাড়ির ভেতরে বারোক স্টাইলের স্থাপত্য, সাদা-কালো মার্বেলের সঙ্গে সোনালি কাঠের কারুকার্য। দালান পেরিয়ে খোলা উঠোন। সেই উঠোনে ফুলের ঝাড়, বাগান, বেঞ্চি, টেবিল চেয়ার। ঝোপে ফুটেছে লাইল্যাক আর রডোডেনড্রন, রঙে সুরভিতে ভরিয়ে রেখেছে উঠোনটুকু। লাঞ্চে একটিও কথা কইল না শ্যামলী পরমা, লজ্জা লজ্জা মুখে চুপ করে রইল। আমি ওর জন্য কাঠের পুঁতির তৈরি মালা, বালা, আর দুল নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো পেয়ে এক মুখ মিষ্টি হাসি ফুটল, নম্র গলায় সুইডিশ ভাষায় ধন্যবাদ দিল সে আমাকে। ইয়ানের শত চেষ্টাতেও আর কথা বলানো গেল না তাকে দিয়ে। শেষপর্যন্ত না। কে জানে, কলকাতার শাড়ি পরা মনুষ্যটিকে দেখে পরমার কীরকম লাগল? তার মনের খবরটি জানা গেল না।

সোলনাতে সতীর ফ্ল্যাট পাঁচতলাতে, একেবারে হ্রদের ওপরে। সব ঘরের জানলাতেই নীল জল ঢালা। বারান্দাটি খোলা, সুন্দর। সতীর যুগোশ্লাভ স্ত্রীয়ের কিছুকাল হল মৃত্যু ঘটেছে। মেয়েটি থাকে স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায়। ছেলে নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠে যাবার যোগাড় যন্তর করছে, একাজে তার বাবাই তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করছেন। এ দেশের এটাই রকম। ছেলে চলে গেলে খুব একা হয়ে পড়বেন সতীকুমার, অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। অমৃতা প্রীতমের সঙ্গে এককালে সতীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সেই বন্ধুতা ভেঙে যাবার পরেই সতী বিদেশে চলে এসেছিলেন, সে প্রায় ত্রিশবছর আগেকার কাহিনী। পাঞ্জাবি লেখকমহলে এই কিসসা এখনও জাগ্রত।

সোলনায় সতীর ফ্ল্যাটটায় বসে আমার কেবলই মনে পড়ছিল কেম্ব্রিজে (ম্যাসাচুসেটসে) টুম্পার ফ্ল্যাটের কথা। ‘রিভারভিউ’–চালর্স নদীর পাড়ে—অবিকল এই রকমই দৃশ্য সেই ব্যালকনি থেকে। অথচ সে অন্য এক মহাদেশ, অন্য শহর। নদী, আকাশ, পিচঢালা পথ, সবুজ গাছপালা, জলের বাতাস, এরা কিন্তু একই।

পরদিন লাঞ্চে নেমন্তন্ন লেনার সঙ্গে। সতী আমাকে মেট্রোতে (বস্টনের মতোই এখানেও বলে ‘T’) তুলে দিলেন, পাখি-পড়া করে বুঝিয়ে দিলেন কোথায় নামতে হবে, বেরিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে লেনার জন্য। পাপাজিও এলেন হেঁটে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত। অসম্ভব এনার্জি পাপাজির এবং ততটাই উষ্ণতা স্নেহ মমতার।

সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে ওপরে উঠতেই দেখি লেনা দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা বেশ ভারি ভারি লাগছে, সন্তানসম্ভবা? সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু। সেদিনের ভোজসভায় ওর নিমন্ত্রণ ছিল না, শুধুই লেখক-প্রকাশকদের ব্যাপার ছিল সেটি। অনেকদিন পরে দেখা, যদিও ই-মেলে যোগাযোগ আছে, কখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে পড়েছি দুজনে।

এখান থেকে বাসে করে আমাকে নিয়ে কিংসগার্টেনের স্টপে গেল লেনা। অনেকগুলি দ্বীপের সমষ্টি। এখানে নদী আছে, হ্রদ আছে, সমুদ্রও আছে। আর আছে সেতু। সেতুর পর সেতু। এবং নৌকো। নৌকো আর জাহাজ। একটি ভাইকিং জাহাজও রাখা আছে বন্দরে। পালতোলা ইয়ট যেমন আছে, তেমনই আছে নানান সাইজের স্টিমার, এবং বড় বড় জাহাজও ছাড়ে স্টকহোম বন্দর থেকে, ফিনল্যান্ডে যায় বলটিক সমুদ্র দিয়ে। এখনও এই জাহাজে ফিনল্যান্ড ভ্রমণ সুইডেনের মানুষদের কাছে একটি লোভনীয় ছুটি কাটানোর উপায়। পাপাজিরও খুব ইচ্ছা ছিল ওইভাবে ফিনল্যান্ডে যাবেন। শরীরটা তেমন ভালো নেই বলে এবারে যাত্রা হল না। সামনের বারে প্ল্যান রয়েছে।

আমরা গিয়ে হ্রদের ধারে বেঞ্চিতে বসলাম। অল্প অল্প ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে। পিছনেই মস্ত গ্র্যান্ড হোটেল, সুইডেনের একমাত্র ফাইভ স্টার হোটেল, যেখানে নোবেল বিজয়ীরা, এসে ওঠেন। ‘তোমার মেয়েরাও তাদের বাবার সঙ্গে এসে এই গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছিল’, লেনা জানায়, ‘আমি এখানেই এসে ওঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। যাবে, গ্র্যান্ড হোটেলের ভেতরটা দেখতে?’ ‘নাঃ, হোটেলের ভেতরে আর দেখবার কী আছে। বরং টাউনহলটা দেখতে যাব, যেখানে নোবেল পুরস্কারের ভোজসভা হয়, উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি হয়। সিটি হল দেখতে যাবার মানে আছে।’ ‘আজকেই যেতে চাও? আমি ভেবেছিলাম আজ তোমাকে নিয়ে নৌকোতে ঘুরিয়ে স্টকহোম দেখাব, তারপরে পুরনো শহরে, গামলাস্টানের কোনও রেস্তোরাঁয় আমরা লাঞ্চ খাব। গামলাস্টান স্টকহোমের প্রাচীনতম অঞ্চল, ১৩ শতকে যার পত্তন হয়েছিল।’ আমার খুবই মনের মতো হল লেনার প্ল্যান! বোটট্রিপের টিকিট কিনে আমরা বসে আছি, লেনা দেখাচ্ছে, ‘ওই যে ওই পাশে রাজপ্রাসাদ, এখনও আমাদের রাজারানি ওখানেই বাস করেন।’ এমন সময়ে কোথা থেকে চলে এল ছয় ঘোড়ার ফিটন গাড়ি, রাজার রথ। লেনা বলে ওঠে, কোনও কারণে আজ বেরিয়েছে। পর পর দুটি গাড়ি গেল, সামনে পিছনে উর্দিপরা ঘোড়ায় চড়া সাজুগুজু করা পুতুলের মতো রংচঙে সেপাই সান্ত্রীর সারি।

-ভেতরে রাজবাড়ির কেউ আছেন? ‘কি জানি? মনে হয় না! এমনি হয়তো প্র্যাক্টিসে বেরিয়েছে।’

বোট-ট্রিপের সময় হল, আমরা নৌকোতে উঠে পড়ি। প্রত্যেকের সামনে হেডফোন আছে। কানে লাগিয়ে বসি, আমি ইংরিজিতে যাত্রার বর্ণনা শুনব।

নানা ধরনের বোট-ট্রিপ রয়েছে। একটি নিয়ে যায় রাজপ্রাসাদ প্রদর্শনে। একটি ১৫টি সেতুর তলা দিয়ে গিয়ে স্টকহোমকে চেনায়, আরেকটি নিয়ে যাবে বহু দূরে, স্টকহোম আর্কিপেলাগোর দ্বীপপুঞ্জ দেখাতে। একটি জাহাজে আবার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ বাঁধা আছে। খোলা কাঠের নৌকো। গাইডের পরনে ১৯৩৫-এর পোশাক, তাতে চড়ে দেখা যায় আধুনিক স্টকহোম। (এর যে মজাটা কোথায়, তা বোঝা শক্ত। পুরো শহরকেও যদি ১৯৩৫-এর পোশাক পরিয়ে দেওয়া যেত তাহলে বুঝতাম!) আমরা যে ট্রিপটা নিয়েছি, তাতে স্টকহোমের সঙ্গে মোটামুটি একটা সর্বাঙ্গীণ পরিচয় হবে।

ভাইকিংদের যুগ বাদ দিলে, বর্তমানের খ্রিস্টান স্টকহোম শহরের বয়স সাতশো বছর। যদিও আজকের এই ঝকঝকে ঝলমলে আধুনিক স্টকহোম মাত্র একশো বছরের তৈরি, এই শহর ১৪৩৬ থেকেই সুইডেনের রাজধানী। গামলাস্টান, পুরনো শহরের পত্তন হয়েছিল মধ্যযুগে, দ্বাদশ শতকের শেষে। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি স্টকহোমের নগর প্রাচীরটি গড়া হয়। মেল্যারেন হ্রদ আর বলটিক সাগরের মাঝখানে একগুচ্ছ দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে এই সুন্দর স্টকহোম শহর। এক সময়ে উত্তর ইউরোপের লোহার আর তামার ব্যবসা নিয়ে সমস্ত বাণিজ্য জাহাজকেই স্টকহোম বন্দর দিয়ে যেতে হত বাধ্যকরীভাবে। সুইডেনের ওপরে সেই সময়ে জার্মানির প্রভাবটাই বেশি ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে ডেনমার্কের রাজা সুইডেন আক্ৰমণ করে, সিংহাসন অধিকার করে নিলেন। শুধু তাই নয়, দেশের যে কজন প্রতিপত্তিশালী মানুষ ছিলেন, কি চার্চে, কি ব্যবসা-বাণিজ্যে, কি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে, কিংবা রাজসভাতে, প্রত্যেককে এক বিপুল বিজয়োৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে নিয়ে এসে প্রাসাদতোরণ বন্ধ করে দিয়ে, নির্মমভবে হত্যা করলেন। যাতে সুইডেন সবদিক থেকে বলহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু অত্যাচারীর উদ্দেশ্য বিফল করে দিলেন নিহত রাজন্যবর্গের মধ্যেই একজনের সন্তান। ক্ষেপে উঠে, বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রবল যুদ্ধে ডেনমার্কের রাজাকে সুইডেন থেকে বিতাড়িত করলেন সেই তরুণ নেতা। কৃতজ্ঞতায় সুইডেনের জনগণ তাঁকেই রাজসিংহাসনে বসালেন। সুইডেনে পার্লামেন্টের জন্ম যদিও পঞ্চদশ শতাব্দীতে, কিন্তু নানা স্তরের মধ্য দিয়ে এসে সুইডিশ পার্লামেন্টের আধুনিকীকরণ হল অষ্টাদশ শতকে, যখন রাজা এবং পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হল। অবাক লাগে যখন দেখি অষ্টাদশ শতাব্দীতেই সুইডেনে প্রথম প্রেস-স্বাধীনতার বিল পাশ হয়েছিল। উনিশ শতকে সুইডিশ পার্লামেন্ট অ্যাক্ট নবীকরণের পরে পরেই প্রধানমন্ত্রীর পদটি সৃষ্টি করা হল। ১৯৯৫তে সুইডেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে। বর্তমান রাজা কার্ল গুস্তাফ তাঁর উদারনীতির জন্য খ্যাত, ১৯৭৪-এ তিনি সিংহাসনে বসেছেন। ইনি সুইডেনের ৭৪তম নৃপতি

‘সুইডেন’ শুনলে আমাদের, কলকাতার বাসিন্দাদের, কী কী মনে পড়ে? আগেই তো মনে পড়ে ডিনামাইট প্রসঙ্গ। অর্থাৎ আলফ্রেড নোবেল ও তাঁর স্মৃতি চিহ্নিত নোবেল প্রাইজের কথা। রবীন্দ্রনাথ। অমর্ত্য সেন। তারপরে? অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ ও তাঁর নাটক। ইঙ্গমার বার্গম্যান ও তাঁর ফিল্মগুলি। এবং খবরের কাগজে পড়া পশ্চিমী সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত। সুইডেনের উদারপন্থী সমাজ সাধারণ পশ্চিমী জগতের মধ্যেও যৌন স্বাধীনতার দিক থেকে অনেক দূর এগিয়ে আছে। বিবাহ প্রথা সেখানে প্রায় অদরকারি হয়ে পড়েছে। অন্য একদিকে—এ সমস্ত ছাড়িয়ে, ‘সুইডেন’ শুনলেই আমাদের কিন্তু মনে পড়ে যার ‘বোফর্স অস্ত্রচুক্তির’ তিক্ত প্রসঙ্গ। অদ্যাবধি যার সমাধান হল না রাজনীতির ঘোরপ্যাচ যাকে চাপা দিয়ে রাখছে, কিন্তু নিভিয়ে দিতে পারছে না। পাশাপাশি একঝলকে মনে ভেসে যায় সুইডেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওলোফ পালমের নিহত হবার নাটকীয় মুহূর্তটি। পৃথিবীর কোনও দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রধানমন্ত্রী, সঙ্গে কোনও প্রহরী না নিয়েই রাতের শো-য়ে সস্ত্রীক সিনেমা দেখে, খোলা রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরেন নিশ্চিন্তমনে? সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী তাই করেছিলেন। এবং ঠকে গিয়েছিলেন। ওলোফ পালমের মৃত্যুর কারণ এখনও রহস্যাবৃত, খুনিরাও ধরা পড়েনি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে ঘটনাটি বিদ্ধ হয়ে আছে সুইডেনের ফর্সা কপালে একটি কালো রক্তের ছোপ হয়ে।

ক্যানাল বেয়ে, হ্রদ পেরিয়ে, সেই সমুদ্র পর্যন্ত আমাদের নিয়ে চলল নৌকো। নতুন ও পুরনো শহরের কথা বলতে বলতে, আশপাশের অঞ্চলের সঙ্গে, বাড়িঘরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে। কত বন, উপবন, কুঞ্জবন, কত সেতু, বাগান, বাজার, কত প্রাসাদ, অফিস, ডিপ্লোম্যাটদের পাড়া, ভাইকিং-যাদুঘর, রয়্যাল অপেরা হাউস, সুইডিশ পার্লামেন্ট, নদী, উপনদী, বন্দর জাহাজ। ভাইকিং জাহাজের নকল। বিশাল যুদ্ধজাহাজ যাদুঘর। তাদের বিচিত্র ইতিহাস। কত কাহিনী শুনতে শুনতে এক সময়ে নৌকো ফিরে এল, সেই রাজপ্রাসাদ, সেই গ্র্যান্ড হোটেল আবার দেখা গেল। চেনা ঘাটে এসে ভিড়ল বোট।

নেমে লেনা বলল, চলো পুরনো শহরে যাই, গামলাস্টানে। নৌকোর ঘাট থেকে খুব বেশিদূর হাঁটতে হল না, খানিকটা গিয়ে একটা চত্বর, সেখান থেকে ডাইনে গেলেই পুরনো স্টকহোমের অলিগলি। নুড়িপাথর বসানো সরু রাস্তা, সবই পায়ে হাঁটাপথ। দুধারে শিল্পীদের স্টুডিও, ছবির দোকান, এমনই একটা রাস্তা পেরিয়ে এসেই দেখি ফ্যাশনেবল পোশাক-আশাকের দোকানভর্তি একটা গলি। তারপর পুরনো বই, নতুন বইয়ের দোকান, স্যুভেনির আর ফটোকপির দোকান। আর সর্বত্রই প্রচুর রেস্তোরাঁ। পথের মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের বেঞ্চি, পাথরের ফোয়ারা, তার চারপাশে ফুল ফুটে আছে। লেনার শরীর এখন ভারি, আর আমি তো এমনিতেই উঁচু নিচু রাস্তায় হাঁটতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, আমরা দুজনে বেঞ্চি দেখলেই থুপ করে একটু না বসে পারছি না। তখন চেয়ে চেয়ে দেখছি কী সুন্দর এই পুরনো শহর। প্রাচীন বাড়িগুলি ঝকঝকে রং করা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার, রেস্তোরাঁগুলির স্টাইলিশ আধুনিক সাজসজ্জা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট চক আছে। তিন-চারদিক থেকে গলিপথ বেরিয়ে গেছে। এমনই একটি চক-এ, সুন্দর এক রেস্তোরায়, আমরা বাইরে ছাতার তলায় লাঞ্চ খেতে বসি। কিন্তু ঝিরঝির বৃষ্টিটা জোর হয়ে উঠল, অমনি আমাদের দৌড় দৌড়, ভেতরে চলো। ভেতরটা আরও সুন্দর। কাঠের পুরনো আসবাব দিয়ে সাজানো। স্মোকড স্যামন খেলাম দুজনে। চমৎকার। বৃষ্টি ধরে গেল খাওয়া শেষ হতে হতে। বেরিয়ে হাঁটা লাগাই, ‘T’ ধরতে হবে, সোলনা ফিরে যেতে হবে। লেনা সঙ্গে চলল, আমাকে যথাস্থানে পৌঁছে না দিলে তার স্বস্তি নেই।

হাঁটতে হাঁটতে স্টকহোমের দোকানপাটের ভিড় রাস্তার মধ্যে হঠাৎ শুনি ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ গান! চমকে দেখলাম খোল করতাল বাজিয়ে নাচতে নাচতে চলেছেন একসারি বৈষ্ণব স্ত্রী-পুরুষ। তাঁদের পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি, শাড়ি, শাল গোটা স্টকহোমে শাড়ি পরা মানুষ দেখিনি এ কদিন, এইবার স্বগোত্রীয়দের দেখা পেলাম। এঁরা সকলেই সুইডেনের মানুষ, অন্তরে নদীয়ার বাসিন্দা।

সতীর ফ্ল্যাট দেখে লেনার কি আনন্দ। এমন সুন্দর ফ্ল্যাটে থাকলে কত শান্তি। সতী লেনাকে চা-পেস্ট্রি খাইয়ে, হাতে ছাতা দিয়ে ‘T’ ট্রেনে তুলে দিতে গেলেন। বৃষ্টি তখন পুরোদমে ঝেঁপে এসেছে। লেকের জল আর আকাশের জল মিলেমিশে একাকার। জানলার ধারটিতে পাপাজি নিয়মিত দুপুরে পা ছড়িয়ে (পায়ে কম্বল ঢেকে) বসে বই পড়েন। আজও বসেছিলেন। চায়ের পর সতী লেনাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে, মুখ ফিরিয়ে পাপাজি বললেন, বৃষ্টি হলেই যেন সব দেশগুলো একই দেশ হয়ে যায়। তাই না বেটি?

পরদিন দুপুরে বিরগিট্টার নিমন্ত্রণ, শহরের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ, গনডোলেনে লাঞ্চ। সতী বললেন, গনডোলেন নাকি খুবই মহার্ঘ্য্য ঠাই। আমি বিরগিট্টাকে ফোন করে বললাম, অত দামি জায়গাতে আমাকে খাওয়াতে হবে না। সাধারণ মানের কোনও রেস্তোরাঁয় যাই চল। বিরগিট্টা হেসেই অস্থির। রহস্যটা স্পষ্ট হল দেখা হবার পর। স্টকহোমে এরকম কিছু রেস্তোরাঁ আছে, যারা নিশীথে বাঘিনী, দুপুরে গৃহিণী। রাতে প্রচণ্ড দামি। ডিনার বা ডিনার পূর্ব ড্রিংক, সবই সেখানে আকাশচুম্বী, কিন্তু লাঞ্চটা যে কোনও সাধারণ ভালো দোকানের মতোই। লাঞ্চে ভিড় হয় না বলে। কিন্তু রাতে তার পুরো ব্যাপারটাই বদলে যায়।

গনডোলেনের বৈশিষ্ট্য তার অবস্থানে। লেকের ধারে, মোড়ের মাথায়, কত তলার ওপরে? ঠিক মনে নেই। মোট কথা, খুব উঁচুতে। নীচে গাড়ি ঘোড়া, রাস্তাঘাট, হ্রদের জলে নৌকো, জাহাজ, সেতু—সব কিছুই যেন অবাস্তব দেখায় এখান থেকে। লেক মেল্যারেন এবং বলটিক সাগর যেখানে লকগেটে মিলেছে, সেখানে, কাটেরিনা লিফটের ধারেই এই রেস্তোরাঁ। স্টকহোমের অপূর্ব একটা প্যানোরামিক ছবি দেখা যায় এই গনডোলেনে বসে, খোলা জানলা থেকে। এখনে আমরা হাল্কা লাঞ্চ খেলাম। সাদা সুরা সমেত। শেষ পাতে চকোলেটের নাড়ু। খেতে খেতে বিরগিট্টা আমাকে নানা প্রশ্ন করছিলেন, আর মাঝে মাঝে নোটবইতে উত্তরগুলো সংক্ষেপে টুকছিলেন। তাঁর ক্যারাভ্যানের জন্য এটাই নাকি আমার সাক্ষাৎকার। এমন ধারা সাক্ষাৎকারের ফল কেমন হবে, জানি না। বর্তমান সংখ্যায় মহাশ্বেতাদির সাক্ষাৎকার আছে। ছাদের ওপরে দাঁড়ানো মহাশ্বেতাদির অপ্রস্তুত, অখুশি ছবিটা মোটেই পছন্দসই হয়নি আমার ওটা বিরগিট্টার নিজেরই তোলা। কিন্তু আমার বেলায় অন্য ব্যবস্থা। বিরগিট্টার বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক স্বামী আমাদের সঙ্গে কফিতে এসে যোগ দিলেন, এবং লেনাও। বিরগিট্টার স্বামী আমার ছবি তুলবেন। তুললেন অবশ্য আমাদের সকলেরই। খেয়ে দেয়ে বেরিয়েই লিফটে চড়ে এই বিল্ডিংয়ের ছাদে চললাম সদলবলে। শহর সন্দর্শনের জন্য লোকে এখানে ওঠে। বিরাট, ব্যাপ্ত ছাদ, অতি সুরক্ষিত। তখন ছাদে কেউ নেই। বিরগিট্টার স্বামী মনের আনন্দে ফটাফট ছবি তুলতে লাগলেন। ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে একটিমাত্র ছবি যাবে। উনি খরচ করলেন পুরো একটা রোল!

এই ছাদ থেকে সারা স্টকহোম দেখা যায়। ওঁরা আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন ওই যে সিটি হল, ওই যে রাজপ্রাসাদ, ওই সেই সৌধটি, যেখানে নোবেল প্রাইজ প্রদত্ত হয়—ওই পার্লামেন্ট, ওই যে লেনার বিখ্যাত কাগজের অফিস ইত্যাদি।

ওখান থেকে বেরিয়ে আমি লেনার সঙ্গে তাদের বাড়িতে চললাম বাসে চড়ে। শহরের খুব ফ্যাশনেবল পাড়াতে চমৎকার পুরনো ফ্ল্যাট কিনেছে ওরা। পথে যেতে যেতে একটি উঁচু বাড়ি দেখিয়ে লেনা বলে, ‘সুইডেনের বিশ্ববিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক শ্রীমতী অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রেন এখানেই থাকতেন। পৃথিবীতে সব ভাষায় এঁর বই অনূদিত হয়েছে, আর কোনও শিশু সাহিত্যিকের জীবিতকালে এমনটি হয়নি।’ আমি ওঁর লেখা পড়িনি, লজ্জায় চুপ করে থাকি। বাংলাতে কি ওঁকে আনা হয়েছে? না বোধহয়!

চলো, একটুখানি ওই পার্কে বসি। খুব সুন্দর বিকেল। বলল লেনা। দুজনে মিলে সামনের সবুজ পার্কে গিয়ে বসলাম। বাচ্চারা খেলছে। মায়েরা সতর্ক প্রহরায়। এখনও রাস্তায় ভিড় শুরু হয়নি। একটু পরেই আমাকে ‘T’ ধরতে হবে। লেনা বলল, ‘না, আজ তাড়া নেই-—আমার স্বামী আসছেন। আমরা সপ্তাহান্তে আর্কিপেলাগোর ছোট্ট একটা দ্বীপে আমাদের গ্রামের খামার বাড়িতে যাই। পথে তোমাকে সোলনাতে নামিয়ে দিয়ে আমরা চলে যাব।’

.

সতীকুমার বললেন, ‘চলো, আজ তোমাকে সিটি হল দেখিয়ে আনি। অমর্ত্য সেনের নোবেল ডিনার ওখানেই হয়েছিল। দেখবে না?’ স্টকহোমে যাই দেখছি আমার বন্ধুরা তাতে নোবেল-মাহাত্ম্য এবং পারিবারিক মহিমা মিশিয়ে অতিরিক্ত সুস্বাদু করে পরিবেশন করছেন।

চললাম সিটি হল পরিদর্শনে। ‘T’ থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় সিটি হলের প্রবেশপথ পর্যন্ত। জলের কিনারায় এই সিটি হল, জল ঘেঁসে সুন্দর এক চিলতে বাগান আছে, সেখানে বহু মানুষের ভিড়। আজ রবিবার। বাচ্চারা বেলুন ওড়াচ্ছে, প্রেমিকরা প্রণয়বিহ্বল, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা রোদ পোয়াচ্ছেন, হুইল চেয়ারে করে সঙ্গীসমেত রোগীও এসেছেন হাওয়া খেতে। সপরিবারে কোথাও পিকনিক হচ্ছে। সতী দেখালেন, খুব সুন্দর বাঁকা চাঁদ ও নক্ষত্র রয়েছে সিটি হলের দুটি মিনারচূড়ায়। আর বাগানে আছে বিরাট এক নগ্ন, শক্তিমান মর্মরমূর্তি, নাট্যকার স্ট্রিন্ডবার্গের। রদার নগ্ন বালজাক-এর মূর্তির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বাগানে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আমরা হলের ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করি। তক্ষুনি বিরাট একটি জাপানি ট্যুরিস্ট দল বেরচ্ছেন, আমাদের প্রবেশের পথ নেই। অধৈর্য আমি একটি দড়ি তুলে, যেই পা বাড়িয়ে হলটির মধ্যে ঢুকেছি একজন মহিলা প্রহরী এসে আমাকে সবিনয়ে বললেন, আগে টিকিট কিনে আনুন, তারপর নিয়মমাফিক সিটি হল পরিদর্শন করুন। আমি বলি, আমি তো পুরো সিটি হল দেখতে চাই না, শুধু এই ঘরটা। সতী কোথা থেকে উদয় হয়ে সুইডিশ ভাষাতে তাঁকে শোনালেন কিছু অমোঘ বার্তা। যার ফলে প্রহরী মহিলা হঠাৎ যাদুবলে সুর বদলে আমার গাইড বনে গেলেন। সসম্মানে বললেন, এই যে ম্যাডাম, এখানেই হয়েছিল আপনার স্বামীর নোবেল ডিনার। এই সিঁড়ি দিয়েই নেমেছিল অপেরা গাইয়েরা। আমি ‘স্বামী নন, প্রাক্তন স্বামী’ বলে একটু ঘুরে ফিরে হলটি দেখে বেরিয়ে আসি। হাসিমুখে সতী বলেন, ‘১৯৯৮তে নোবেল ডিনারে যা মেনু ছিল, তা কিন্তু তুমি এই সিটি হলের নিজস্ব রেস্তোরাঁতে অর্ডার দিলেই খেতে পার। ১৯১৩ ডিনারটাও অর্ডার দেওয়া যায়। এটাই এই রেস্তোরাঁর বৈশিষ্ট্য। খাবে নাকি?’

‘নো থ্যাংক ইউ’ বলে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াই।

সামনে সেতু, শহর, নৌকো, আকাশ, জল, নৌকো, সেতু, শহর। স্টকহোম। না, নোবেল ব্যাঙ্কোয়েটের মেনু আস্বাদন করবার ইচ্ছা নেই আমার। কিন্তু স্টকহোম ছেড়ে যাবার আগে ইচ্ছে ছিল স্ট্রিন্ডবার্গের শেষ ঘরসংসার যে বাড়িতে, সেই ব্লু টাওয়ার, নীল মিনার দেখতে যাবার। তাঁর কাজের জায়গা, বিশ্রামের জায়গা দেখব। আমার বাবার মতোই আমারও শখ আছে তীর্থদর্শনের মতো করে লেখক, শিল্পীদের বাসস্থান, কর্মস্থান চোখে দেখবার। দুদিনের জন্য মস্কো গিয়ে যেমন টলস্টয়, গোর্কি, চেখভের বাড়িতে ঢুঁ মেরেছিলাম, গ্যোয়টের শহরে গিয়ে গ্যোয়টে,,হের্ডের, শিলারের ঘরবাড়ির খোঁজ নিয়েছিলাম—এও তেমনই। ইচ্ছা ছিল জাহাজে ভেসে স্টকহোম আর্কিপেলাগোয় ঘুরে আসবার, স্ক্যানসেনের উন্মুক্ত যাদুঘর দেখবার। আর ইচ্ছে জাহাজে চড়ে ফিনল্যান্ডে যেতেও।

ছোটবেলাতে দেখা উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়টিও দেখে যাবার ইচ্ছা ছিল। লেনার মা ওখানে অধ্যাপনা করেন, তিনি নিমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন আমাকে, কিন্তু সময়ে কুলোল কই? দৌড়ে দৌড়ে লন্ডন গিয়ে নিউ ইয়র্কের প্লেন ধরতে হবে যে আমাকে? সস্তা টিকিট কাটা রয়েছে, তার তারিখ অদলবদল হয় না!

সেতু, শহর নৌকো, আকাশ, জল, বাগান, হাঁস, সেতু, শহর, জল। হঠাৎ দেখি, একটা সেতুর পাশে বাগানের একটি নির্জন কোণে, খালি পায়ে, শ্মশ্রুগুম্ফে অদৃশ্য, এক তরুণ নেশাড়ু, শিশি বোতল, ছেঁড়া কম্বল, নোংরা কোট, কাগজের কার্টন, এইসব নিয়ে গুছিয়ে সংসার পাতবার চেষ্টা করছে, অতি বিপজ্জনকভাবে, জলের কোল ঘেঁসে। সেই দেখে দুটি হাঁস ব্যস্ত হয়ে জল থেকে উঠে এসে, তারই দিকে চেয়ে ঘোরতর আপত্তি জানাচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক শব্দে। বোধহয় ওকে বলছে, ‘পুলিশ দেখতে পেলেই তোমাকে তুলে দেবে। সিটি হলের বাগিচায় কেউ ঘর বাঁধতে পারে? বোকা!’ জলের ধার ঘেঁসে ঘর বাঁধবার এই ইচ্ছে আমারও চিরকালের। কিন্তু সত্যিকারের নেশাড়ু না হলে বোধহয় ওটা পারা যাবে না।

প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ অক্টোবর ২০০০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *