বোর্নিওর জঙ্গলে
গোড়ার কথা
হ্যাঁ সত্যি সত্যি গিয়েছিলাম একবার, ১৯৯১ সালে। টোকিও থেকে ফেরবার পথে কুয়ালা লামপুরে থেমেছিলাম, মানিকদা আর বৌদি আছেন, সুপ্রিয়া আর শামসুল বারি আছেন–অনেকদিনের শখ ও আছে। সেই যে উষাদেবীর কবিতার দুটো লাইন শুনেছিলাম স্কুল থেকে ফেরার পথে, রেডিওতে বাজছিল—‘কুয়ালা লামপুর…কুয়ালা লামপুর…এলাম কতদূর’ সেই থেকে আমার একটা মায়াবী টান রয়েছে কুয়ালা লামপুরের ওপরে। ১৯৯১-এ তখনও ইদানিংকার মতো এমন বাণিজ্যিক উন্নয়ন হয়নি সেখানে, টুইন টাওয়ারও তৈরি হয়নি—কুয়ালা লামপুরের শান্তশ্রী ছিল একটি। ওই বছর আমি সিঙ্গাপুরেও গিয়েছিলাম—আমার মেয়ের তামিল বান্ধবীর পিসি সেখানে থাকেন, তাঁদের বাড়িতে। আর জাকার্তাতেও গিয়েছিলাম সেবার, বুড়ির ননদের বাড়িতে। বুড়ি হল রুবিদির ছোট বোন, খুব সুন্দর নাচত, বোধহয় ওর ভালো নাম বনশ্রী। ওরাও থাকে সিঙ্গাপুরে। এসব যাতায়াতগুলো তো খুবই চমৎকার—কিন্তু এসবের চেয়েও আরও চমৎকার ভ্রমণ হয়েছিল দ্বীপময় ভারতে। বালিদ্বীপ আর জাভাদ্বীপে। সিঙ্গাপুর থেকে গিয়েছিলুম এইসব দ্বীপে। কিন্তু জাহাজে নয়—উড়োজাহাজে। সেই সব একক ভ্রমণের স্বাদ আলাদা। বালির গল্প আর জাভার গল্প আরেকদিন হবে। আজ বরং বোর্নিওর জঙ্গলের গল্পটা বলি।
আরম্ভেরও আরম্ভ আছে। মূলের আগে বীজ। একবার দিল্লি থেকে ইউরোপ যাবার জন্য লুফৎহানসার প্লেনে চড়েছি, বিপুল একদল জার্মান ট্যুরিস্ট উঠলেন সেই প্লেনে। সর্বস্ব ছাপিয়া ব্যাপিয়া তাঁরাই প্রতিষ্ঠিত হলেন। আমার পাশেও ছিলেন একজন সাড়ে ছ’ফুট বৃদ্ধ পালোয়ান। তাঁরা দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণ করে ফিরছেন জার্মানিতে।
‘সবচেয়ে ভালো কী লাগল? তাজমহল?’
‘হ্যাঁ, তাজমহল তো ভালোই—অপরূপ শিল্পকর্ম–কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে বোর্নিওর জঙ্গলে লং হাউস। তাজমহলের চমৎকারিত্বের সঙ্গে তার তুলনাই চলে না।’
শুনে তো আমি হতবাক। বোর্নিওর অরণ্যে কী সেই অসাধারণ মহিমময় বস্তু, যার সৌন্দর্যের সঙ্গে তাজমহলের তুলনাই চলে না? সবিনয়ে জানতে চাইলুম, লং হাউসটি কী বস্তু। জঙ্গলের মধ্যেই বা তার দেখা মিলল কীভাবে?
উচ্ছ্বসিত হয়ে ভদ্রলোক হাত-পা নেড়ে বললেন, ‘অকল্পনীয় ঘটনা, জঙ্গলের মধ্যে একখানা পুরো গ্রাম, ৩০-৪০টা জংলী পরিবার সবাই মিলে একটাই ছাদের নীচে শান্তিতে বসবাস করে। একসঙ্গে থাকে গ্রামসুদ্ধু সকলে। একেকটা মস্ত বড় বাড়িই হচ্ছে একেকটা গ্রাম। বাড়ির কর্তা হচ্ছেন গ্রামের মোড়ল। সত্যি-সত্যিই বাঁশ দিয়ে তৈরি করা মাচার ওপরে অত্যন্ত দীর্ঘ একটা বাসগৃহ, তাকেই বলে ‘লং হাউস’, ওদের বন্য ভাষায় ওটাই নাম। ‘আমার বয়েস এখন প্রায় সত্তর বছর। পৃথিবী পর্যটন করাই এখন আমার নেশা হয়েছে, গত দশ বছরে অবসর নেওয়ার পর থেকে দেশ-বিদেশে ঘুরছি। কত কিছুই তো দেখেছি—কিন্তু এরকম জিনিস সত্যি দেখিনি!’ তৎক্ষণাৎ মনে মনে একটা নোট করে নিলুম ‘লং হাউসটা দেখতেই হবে’-ঠিক যেমন সুদীপ্তার দক্ষিণমেরু ভ্রমণের স্লাইড দেখে মনে মনে স্থির করেছিলুম, ‘মেরু অঞ্চলে যেতেই হবে।’ দক্ষিণমেরু দেখা তো হবে না অবৈজ্ঞানিক আমার দ্বারা, দেখি উত্তরমেরুটাই ট্রাই করব। ১৯৮৬তে সেইটে সম্ভব হয়েছিল। ‘তুন্দ্রার তৃণ’ কাহিনী আপনাদের জানিয়েছি। দক্ষিণমেরু যাত্রা তখনও বিজ্ঞানী-অভিযাত্রীদের জন্যই বাঁধা ছিল। সাধারণ যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। মাত্র সেদিন অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর অপূর্ব ভি সি ডির কল্যাণে জানতে পারলুম দক্ষিণে আজি খুলিয়াছে দ্বার।
এবার মনস্থির করে ফেলেছি। কভি না কভি তো বোর্নিও যানা হি পড়েগা। লং হাউস দেখনা হি পড়েগা। আমরা বাঙালিরা জোর দিয়ে কিছু বলতে হলেই হিন্দি বা ইংরিজির সাহায্য নিই। যেমন, ‘গেট আউট’, যেমন ‘কভি নেহি’, এও তেমনই জোর দিয়ে নিজেকে একটা শপথ নেওয়াচ্ছি তো, হিন্দি ছাড়া চলবে না! গালিগালাজও জোরালো করে দিতে হলে তো বাংলায় তেমন সুবিধে নেই, এই তো দেখি চতুর্দিকে। হিন্দি ঢের ঢের বেশি শক্তিমান! ‘লং হাউস’ মাথায় ঢুকল—দেখার সুযোগ তো সেবারে হল না—ইউরোপেই যাত্রার গন্তব্য ছিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রইল-কভি ন কভি। কী ন কহী। বিশ্ব ভ্রমণের জন্য নিজের তো পয়সা নেই। সর্বদা অন্য কোনও ভ্রমণের সঙ্গে জুড়ে নিতে হয় এসব। এবারে জাপান থেকে ফেরবার পথেই পড়ছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুর। কোথাও আলাদা টিকিট কিনে যেতে হচ্ছে না। কোথাওই থাকতে হোটেল খরচ লাগছে না। সর্বত্র বন্ধুবান্ধব, চেনাশুনো, দু-তিনদিনের আতিথ্য দিতে আপত্তি নেই কারোরই। ব্যস, ইটিনেরারি প্রস্তুত হয়ে গেল মনে মনে। সিঙ্গাপুর থেকে যাব বালি। বালি থেকে জাভা। জাভা থেকে জাকার্তা। জাকার্তা থেকে কুয়ালা লামপুর। কুয়ালা লামপুর থেকেই লং হাউস দেখতে যেতে হয়—উড়ে যেতে হয় বোর্নিও দ্বীপে, কুচিং শহর বোর্নিও দ্বীপে। সারাওয়াক প্রদেশে। কুচিং মানে বেড়াল। (কুচিং শহরে একটা বেড়ালের স্মৃতিস্তম্ভও আছে) সারাওয়াকেই সেই জার্মান ভদ্রলোক ‘লং হাউস’ দেখতে গিয়েছিলেন। অতএব চলো তো আগে সারাওয়াক! সেখানে গিয়ে বাকি সব ডিটেইলসের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু যাবার ব্যবস্থাটাও তো করা চাই। স্ত্রীলোকের স্বাধীন ভ্রমণে ঝামেলা কম নয়। সুপ্রিয়ার স্বামী আমাদের বন্ধু শামসুল বারি ওখানে ইউনাইটেড নেশনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তি। তাঁর অফিসের সেক্রেটারিকে যদি একটা কুচিংয়ের টিকিট করে দিতে অনুরোধ করি? তিনি একটু বলবেন? বারি নিজেই বেঁকে বসলেন।
‘পাগল নাকি? একা একা বোর্নিওর জঙ্গলে যাবেন? কেউ যায় না। ট্যুরিস্ট গ্রুপ হিসেবে যায়। দাঁড়ান, দেখি কবে কী গ্রুপ যাচ্ছে, তার খবর করি।’
প্রথমত, আমি গ্রুপ ভ্রমণে বিশ্বাসী নই, সংসারে তো যূথবদ্ধ জীবনই যাপন করছি—আবার বেড়াতে বেরিয়েও বিকল্প পরিবার? দ্বিতীয়ত, আমার হাতে সময় খুব কম। নো, থ্যাংক ইউ। (এখানে আবার ঠিক ইংরিজি না হলে জমে না!) আমি নিজেই টিকিটের ব্যবস্থা করছি তবে। এবার অবশ্য টিকিট হল, কিন্তু বারি এবং সুপ্রিয়া এবং মানিকদা-বৌদি সকলেই কিঞ্চিৎ বিব্রত (বিরক্তও?) বোধ করতে লাগলেন আমার এ হেন জেদীপনায়। কিন্তু ওসব ভাবলে আর বোর্নিওর জঙ্গলে যাওয়া হয় না। আমার হাতে মোটেই বেশি সময় নেই। যাদবপুরে ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছি ক’দিন। টোকিওর কম্প্যারেটিভ লিটারেচার কনফারেন্সের সঙ্গে যোগ করে। টোকিওর MER সাহিত্য পত্রিকা যে আমাকে কবিতা পাঠের জন্য হঠাৎ এত টাকা দেবেন, আগে তাও জানিনি। তাই রীতিমতো পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা লাভ হয়েছে। মহোল্লাসে বেড়ানোর খরচ উঠে আসবে—ইয়েন খুব স্ট্রং কারেন্সি। বালি, জাভা, বোর্নিওতে তো আমার কোনও আত্মীয় বন্ধুর ঠিকানা জানি না। তবে ঈশ্বরের করুণায় বিশ্ব জুড়েই বন্ধু জুটে যায় আমার, কোথাও নিজেকে একা মনে হয় না, সঙ্গীহীন মনে হয় না।
সেবারের অসামান্য অভিজ্ঞতার কথা—আমার বালিদ্বীপ, জাভাদ্বীপ বেড়ানোর কাহিনী লিখব-লিখব করেও লেখা হয়নি কখনও। কাজের চাপে ভুলেই গেছি লেখার কথা। ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার জন্মও হয়নি যে তখন। মহাশ্বেতার মতো তাগিদেশ্বরী সম্পাদিকার পাল্লায় না পড়লে এইসব অমূল্য স্মৃতিগুলো চিরদিনের মতোই হারিয়ে যেত। কামার্গ, তুন্দ্রা, সবই তাঁর একক প্রয়াসে লিখিত হয়েছে আমার দ্বারা। এই বোর্নিও-ও তাই। জাভা, বালিও হয়তো কোনওদিন লেখা হবে। হয়তো লেখা হবে আমার ১৯৮৬-তে হংকং থেকে হঠাৎ ফেরি জাহাজে চড়ে ম্যাকাওদ্বীপে চলে যাবার গল্পটাও। বন্ধু রাজেশ্বরী আর তুষার ঘোষের বাড়িতে যে-ঘরে শুয়েছিলাম হংকংয়ে, সেই ঘরে একটি বই ছিল। শোবার সময়ে বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে দেখি, আরে? ম্যাকাওদ্বীপে কেমন করে যেতে হয় সেই সব খোঁজখবর তাতে দেওয়া রয়েছে। ব্যস পরদিন ভোরে উঠেই ম্যাকাও যাত্রা। রাজেশ্বরী, তুষার যে যার অফিসে চলে যাবেন, আমার তো করার কিছু নেই। চালাও পানসি ম্যাকাওদ্বীপ। এখন হংকং আর সেই ইংরেজদের হংকং’ নেই, ম্যাকাওদ্বীপও আর পর্তুগিজদের ম্যাকাও নেই। তারা সবাই এখন চরিত্র পালটে Postcolonial জাতের অন্য শহর হয়ে উঠবে নিশ্চয়।
বোর্নিওদ্বীপে পদার্পণ
কুচিংয়ে নেমে একটা হোটেলে উঠলাম—ছোট হোটেল কিন্তু খুব ভালো জায়গায়—বড় রাস্তার ওপর। ট্র্যাভেল এজেন্সির কাছেই। হেঁটে হেঁটে Water front-এও যাওয়া যায়—City cen—tre-এও যাওয়া যায়। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে গিয়ে ‘লং হাউস’ দেখতে যাব বললাম। তারা বলল, সকাল ৮টা নাগাদ বাস ছাড়বে কাল—যদি আটজন (নাকি দশজন বলেছিল? মনে নেই। যাত্রী পাওয়া যায় তবেই। তার কম হলে ট্রিপ ছাড়বে না। আজ আমি বরং কুচিং বেড়াই, ফোর্ট দেখি, প্যালেস দেখি, মিউজিয়াম দেখি, অস্ত্রশস্ত্র দেখি, রাস্তাঘাট দেখি, নদীর তীরে ঘুরি—চাইলে নৌকোভ্রমণও করতে পারি। কাল সকালে স্ক্র্যাং নদীর তীরবর্তী একটি ইবান জাতির লং হাউসে আমাকে নিয়ে যাবেন তাঁরা, যাত্রী জুটলে। ‘দুগগা-দুগগা’ বলে আমি তো সীট বুক করে এবার কুচিং ভ্রমণে মন দিই। ছোট শহর। হেঁটেই ঘোরা যায়—ফোর্ট বা প্যালেস, যাই বলো, সেটা নদীর মধ্যে বেশ ইন্টারেস্টিং—কিন্তু ভেতরে ঢুকে তেমন কিছু ভালো দ্রষ্টব্য নেই। বন্দুক, কামান, গুলিগোলা, বর্শা, তীর-ধনুক, বর্মচর্ম, এই সবই কেবল দেখেছি—শিল্পকর্ম কিছু তেমন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে মজা লেগেছিল ব্রুক সাহেবের ছবিযুক্ত স্মৃতিফলকটি দেখে। ‘The White Rajah of Sarawak’—লেখা আছে সেই স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে, এবং তাঁর রাজত্বের সাল তারিখও। আমার সেগুলি মনে নেই, শুধু ওই ‘সারাওয়াকের সাদা রাজা’ বর্ণনাটিই ভুলতে পারিনি কোনওদিন। বেড়ালের স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে, নদীর ধারে এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়ে, ডিনার খেয়ে হোটেলে ফিরে এসে পরদিনের জন্য প্রস্তুত হলাম—ওরা একটা ফর্দ দিয়ে দিয়েছে কী কী লাগবে। তুন্দ্রা অঞ্চলে যদিও শাড়ি পরেই গিয়েছিলাম। আহা, শাড়ি তো আর কখনও দেখতে পাবে না তুন্দ্রার হরিণ, হাঁস, বাদামি ঘাসেরা! কিন্তু কুচিং শহরে শাড়ি পরে ঘুরলেও বোর্নিওর জঙ্গলে শাড়ি পরে যেতে সাহস পাইনি। তার জন্যে জিনস কুর্তা আর জুতো-মোজাই শুভ! ফর্সতে ছিল রাত্রিবাস, এক সেট extra পোশাক, টর্চ, বেসিক ওষুধপত্তর, প্রসাধনী, পোকা-মাকড়-বিতাড়ক মলম, সাঁতারের পোশাক, বর্ষাতি, ছাতা, রোদ আটকানোর সানব্লক লোশন, আর মিনারেল ওয়াটার।
লং হাউসের সঙ্গেই যুক্ত আছে এদের অতিথিশালা। বিদেশি যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে তৈরি। ইচ্ছে করলে কেউ লং হাউসেও রাত্রিবাস করতে পারি—অবিকল ইবানদের মতো করে। অথবা এইখানে—এখানে আছে ফর্সা বিছানা, বালিশ, তোয়ালে, টয়লেট, শাওয়ার আর খাদ্য। সবই বেসিক, যা নইলে না, সেটুকু। কিন্তু সভ্য জগতের কোলে। চয়েসটা ওখানে গিয়ে করলেই হবে। সানব্লক আর সুইমসুট ছাড়া বাকি সব জিনিস যোগাড় করে ফেলেছি। সঙ্গেই ছিল, শুধু কিনেছি পোকার মলম। রাতে টিভি খুলেই কী আনন্দ—বম্বের হিন্দি ছবি চলছে।—কলকাতায় যা জীবনেও দেখতুম না, এখানে হাঁ করে সেই গাছ-ধরে নাচগান কিছুক্ষণ মুগ্ধনয়নে নিরীক্ষণ করে, ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। কাল কপালে কী আছে কে জানে?’
সকালে ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিসে গিয়ে দেখি আরে বাঃ। ছোট স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে এবং এক দঙ্গল সোনালি চুলওয়ালা স্ত্রী-পুরুষ গুলতানি করছেন। সবাই আমরা লং হাউসমুখী। ট্র্যাভেল এজেন্সির মহিলা হেসে বললেন, ‘আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন! আমাদের প্রথম ভারতীয় যাত্রী আপনি। এযাবৎকালে আমরা একজনও ভারতীয় যাত্রী পাইনি—ইউরোপ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান—এসব দেশ থেকেই আমাদের যাত্রীরা আসেন। আশা করি ভারতের আসা এইবার শুরু হল।’
আমি তো অবাক! কেউ আসেনি? সিঙ্গাপুর, কুয়ালা লামপুর তো ভারতীয়তে ভরপুর—তাঁরা আসেন না? পরে মনে হল আমরা নিজেরাইতো বনে-বাদাড়ে বন জঙ্গলের দেশে থাকি। উন্নত দেশের লোকেরাই বনদর্শনে বেড়াতে আসবে। আমরা বেড়াতে যাব বড় বড় শহরে। বাণিজ্য কেন্দ্রে। খামকা জঙ্গলে যেতে ইচ্ছে করবে কেন? যদি সেই জার্মান যাত্রীর পাশে বসে ইউরোপ না যেতাম সে বছর, তাহলে আমিও কি আসতাম?
বাস ছাড়ল, গ্রামপথ দিয়ে খেতখামার পেরিয়ে। রবার চাষ আর গোলমরিচের চাষ দেখানোর জন্যে বাস থামানো হল। গোলমরিচ যে তলায় ফলে, গুচ্ছে গুচ্ছে, ছোট ছোট সবুজ আঙুরের মতো, সে জড়িয়ে ধরবে বলে তার জন্য ঠেঙা পুঁতে অবলম্বন তৈরি করে দেওয়া হয়—এসব জানা ছিল না। আমাদের অল্পস্বল্প কাচাকাচি সবুজ গোলমরিচ তুলতেও দিল। নিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়। মালয়শিয়াতেই অন্য এক পথে যাবার সময়ে, মনে পড়ে পাহাড়ি রাস্তাটি যাচ্ছিল লবঙ্গ বনের মাঝখান দিয়ে। লবঙ্গের গন্ধে বাতাস মাতাল, লবঙ্গফুল ফুটে আছে বড় বড় বৃক্ষে। অনেক লবঙ্গফুল (সেও কচি সবুজ রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ) তুলে এনেছিলাম পাতাসুদ্ধ। সেসব অনেকদিন পরে, ক্রমশ কালো হয়ে সত্যিকারের লবঙ্গ হয়ে গেল।
পথে এক জায়গায় থেমে লাঞ্চ করা হল। গল্প জমল অল্পবয়সী এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে। বাকিরা দলবেঁধে। জর্মনে ও ফরাসিতে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। একা কেউ নেই, শুধু আমিই। ঠিক মনে নেই আমরা কতজন ছিলাম, আট-ন’জনের বেশি নয়—গাড়িটাও ছোট, আমরা যেখানে গিয়ে উঠলাম, সেখানে ডর্মিটরিতেও জনা আট-দশের বেশি সীট ছিল না। ছোট গ্রুপ বলেই বেশ ভালো লাগছিল। একজন গাইড ছিলেন সঙ্গে।
গাড়ি গিয়ে থামল একটি সরু, তীক্ষ্ণস্রোতা নদীর তীরে। বালি-কাদা-নুড়িপাথর পার হয়ে আমরা হেঁটে গিয়ে উঠলাম নদীতে অপেক্ষমাণ দুটি, নৌকোতে। সরু লম্বা ডিঙি টাইপের নৌকো—কিন্তু মোটর লাগানো আছে। সুন্দরবনের ভটভটিয়ায় যেমন থাকে। কিন্তু নৌকোর গড়ন অন্য রকমের। দুজন মাঝি আছেন। পরনে নেংটি। মাথায় ফেট্টি বাঁধা। পাথর কোঁদা কালচে বাদামি রোদে-পোড়া নগ্নদেহ। নুলিয়াদের চেহারা মনে পড়িয়ে দেয়। সম্ভবত এরাও পেশায় মাছ ধরে। দুটো নৌকোতে ভাগ হয়ে আমরা উঠে পড়ি। নৌকো ছেড়ে দিল, ফ্র্যাং নদীর স্রোতে। আমরা গভীর অরণ্যের দিকে চলেছি। দুই তীরেই উঁচু উঁচু, অন্ধকার গাছ, ঘন অরণ্য, লতাপাতা, ঘাস—ঝোপ, ঠিক যেন বানানো কোনও খেলাঘরের অরণ্য—যেন ডিজনিল্যান্ডে নৌকো চড়ে বনে ঢুকছি। এ তো সত্যিকারের রেনফরেস্ট, আদিম বনরাজি—মানুষের সভ্যতার কুঠার যাকে খণ্ডিত করেনি পুরোপুরি—কিন্তু এই যে আমরা ধেয়ে আসছি, সেটাই ধ্বংসের শুরু। এবারে আস্তে আস্তে ওদের জীবনযাত্রার ধরন-ধারণও হয়তো দর্শকদের মনোরঞ্জনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে শুরু করবে। দু’দিকের নদীতীরের অরণ্য কেবলই ঘন হচ্ছে, নদী সরু হচ্ছে, নদীর স্রোত দ্রুততর হচ্ছে—খুব উত্তেজিত লাগছে। এসব বনে জীবজন্তু আছে? আছে বৈকি। নদীতে জল খেতে আসেও। কিন্তু ভটভটির শব্দে তারা এদিকে এখন ঘেঁসবে না। (কীভাবে অরণ্যবাসী প্রাণকে বিরক্ত এবং ব্যক্তিব্যস্ত করে তুলছি আমরা!) এক সময়ে নৌকো থামল।
অন্য নৌকোটি আগেই পৌঁছেছে। তীরে দাঁড়িয়ে আমাদের গাইড আমাদের হাত ধরে টেনে টেনে ডাঙায় তুলছেন। ব্যাগগুলি আগেই, কেউ তুলে নিয়ে গেছে। খানিকটা বনপথে হেঁটে গিয়ে সামনেই দেখতে পেলাম, লং হাউস। সত্যি অদ্ভুত একটা অতি দীর্ঘ, রেলগাড়ির মতো দীর্ঘ, বাঁশের কুঁড়েঘর। অসংখ্য খুঁটির ওপর বসানো বিশাল একটি বাঁশের মাচার ওপরে তৈরি। তার পাশেই আছে ঠিক ওই রকমই দেখতে ছোট একটি কুটির। মাচার ওপর সেটিও। আমাদের অতিথিশালা। সকলেই এখানে রাত্রিবাস করবেন স্থির হল। আমি ‘একযাত্রায় পৃথক ফল’ করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু একা যদি ওখানে শুই, তাহলে হঠাৎ দরকার হলে বাথরুমে যাব কোথায়? আর দুই—ওরা ওখানে রাতে ধোঁয়া দেয়—ধোঁয়াতে তো আমার তক্ষুনি হাঁপানি হয়ে যাবে! নাঃ লং হাউসে না শোয়াই মনস্থ করলুম। অন্য সকলের সঙ্গে গেস্টহাউসেই থাকব আমিও। সুন্দর, পরিচ্ছন্ন পশ্চিমী টয়লেট আছে সেখানে। আমার মাচার ওপরে বাথরুমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাওয়াংয়ে লামার বাড়িতে। এখানেও, মাচার তলায়, দেখলাম দিব্যি শুয়োর এবং মুরগি পোষা হচ্ছে।
এদের খেতে আসে না বাঘ-টাগ? নাঃ আর বাঘ সিংগি নেই এখানে। তবু মানুষ সন্ধে বেলায় মাচার বাড়িতে উঠে পড়ে, মইটা তুলে নেয়। হিংস্র পশুরা হঠাৎ হঠাৎ চলেও আসে রাতে। দিনেরবেলায় তারা বেরোবে না—নিশাচর প্রাণী তো। নিশিকালেই বেরোয়। তাই ইবানদের সর্বদা সতর্ক হয়ে থাকতে হয়—বনে-জঙ্গলে বাস করতে হলে সদাসতর্ক না থেকে উপায় নেই। আশৈশব এদের কান খাড়া রাখার ট্রেনিং হয়ে যায়।
একটু চা-খেয়ে নিয়েই আমরা ‘লং হাউস’ দেখতে যাই বেলাবেলি।
লং হাউস
লং হাউসে উঠতে হল দীর্ঘ একটি মই বেয়ে—খোঁটার ওপরে বসানো বাড়িটাতে সত্যি সত্যি ঊনপঞ্চাশটি পরিবারের বসতি একই ছাদের নীচে। বিভিন্ন প্রজন্ম আছে। ভিন্ন ভিন্ন সংসার, প্রত্যেকের আলাদা ঘরদোর, রান্নাঘর, শোবার ঘর, বাথরুম আছে। লং হাউসে দীর্ঘ একটি করিডর আছে—তার একপাশে সারি সারি বন্ধ দরজা। শক্ত কাঠের দরজা, কোনও কোনওটাতে সামান্য কারুকার্য করা। কোনওটায় স্টিকার সাঁটা। দরজায় নাম নেই কোনও। করিডর মাঝখান দিয়ে চলে যাচ্ছে, তার অন্য পাশটিতে বারান্দা মতোন ঢাকা বারান্দা—সেখানেই সংসার যাত্রা যাপিত হচ্ছে। তারও ওপাশে, বাঁশের বেড়ার বাইরেও আকাশের নীচে মাচা ছড়িয়ে আছে। সেটি খোলা উঠোন। সেখানে বাচ্চারা খেলা করছে—কাচাকাপড় শুকোচ্ছে, ধান চাল রোদে দেওয়া হয়েছে। বারান্দায় বুড়ি ঠাকুমা বসে ঝুড়ি বুনছেন, নাতি পাশে মাদুরে ঘুমিয়ে আছে। ঠাকুমার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। নিম্নাঙ্গে রঙিন ছাপা লুঙ্গি বা সারঙ। ১৯৯৮-র সাম্প্রতিক ছবিতে দেখলাম লং হাউসের মেয়েরা উঁচু করে সারঙটি বেঁধেছেন, বাহুমূল থেকে বুক আবৃত করে। আমি কিন্তু তা দেখিনি। শুধু বৃদ্ধা নয়, অল্পবয়সী মায়েরা স্তন্য পান করাচ্ছেন শিশুদের—কিংবা একমনে বসে ধান-চাল বাছছেন মাদুরের ওপরে ঢেলে। সকলেই নিঃসঙ্কোচে সপ্রতিভমুখে আমাদের চেয়ে দেখছিলেন—অনাবৃত বুক নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সচেতনতা ছিল না। আমারও একটুও লজ্জা করেনি, নিজে নারী হয়েও। সেই সহজ প্রকৃতির কন্যাদের দেখে এক মুহূর্তের জন্যও কুচিন্তা মনে আসবে না। গভীর সারল্যই তাদের আবৃত করে রেখেছে। বৃদ্ধারা দুয়েকজন দেখলুম চুরুট খাচ্ছেন, ঝুড়ি বুনতে বুনতে। অল্পবয়সী মেয়েদের ধূমপান করতে দেখিনি। দুপুরবেলায় গিয়েছি আমরা, ছেলেরা সবাই কাজে বেরিয়েছে তখন, মাঠে, খেতে খাটছে। ধানের খেত আছে এদের, প্রত্যেক পরিবারের ছোট ছোট রুমালের মতো ধানজমি। সেখানে বছরের খাদ্য ফলে। কিন্তু বাংলার মাটি তো নয়—যদিও প্রবলবর্ষা এখানে, তবু জমি ভালো নয়। দু-তিন ঋতু শস্য ফলানোর পরেই সে জমি নিষ্ফলা হয়ে যায়। তখন অন্যত্র জায়গা খুঁজতে বেরোয় ইবান পুরুষরা। আগে তারা বনে বনে ঘুরে বেড়াত। ‘ইবান’ শব্দের মানে নাকি ইবানদের ভাষাতে, ‘ইমিগ্র্যান্ট’–দেশান্তরী। এখন ওদের যাযাবর বৃত্তি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সরকার। ওখানেই বাস করতে হবে। আমি ওদের লং হাউসের দীর্ঘ করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে দেখছি একেকটা দরজার সামনে ছাদ থেকে ছোট ছোট, ছাইরঙের, প্রাচীন নরমুণ্ডের মতো দেখতে মলিন বস্তুগুচ্ছ টাঙানো আছে। গত বছরের ক্রিসমাস সজ্জার মতো। মাটির পুতুল? না কী ওগুলো? জানতে হবে। আমাদের সঙ্গে এবার গাইড কিন্তু অন্য—এই লং হাউসের কর্তা তিনি, এদের সর্দার। এরা বলে ‘তুয়া রুমা’। আসার আগে গতকালই ট্র্যাভেল এজেন্সির মেয়েটি আমাকে বলেছে, সর্দারের জন্য কিছু সিগারেট নিয়ে যেও। ওরা বিলিতি মদ সিগারেট পেলে খুব খুশি হয়। ওর কথা শুনে দশ প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস নিয়ে এসেছি। সর্দারের সঙ্গে আলাপ হতেই দিয়ে দিলাম। তিনি খুবই খুশি হলেন। জার্মান, ফরাসিরা বোতল দিলেন। ইংরেজ দম্পতিকে কিছু দিতে দেখলাম না। ছেলেটি লন্ডন টাইমসের সাংবাদিক। ওরা সদ্য বিবাহিত—এই তাদের মধুচন্দ্রিমা। কেবলই ফটো তুলছে। সর্দার দেখছি তাতেও খুব খুশি। মহানন্দে পোজ দিচ্ছেন। অর্ধনগ্ন ঠাকুমা-দিদিমারা ঝুড়ি বুনছেন, কারুর পাশে ট্রানজিস্টর রেডিওতে গান বাজছে। হিন্দি গান। কারুর কব্জিতে সস্তা ইলেক্ট্রনিক হাতঘড়িতে জ্বলজ্বল করছে আধুনিক বিশ্বের সময়। বোর্নিও দ্বীপের অরণ্যমানুষ এঁরা—কালিমানতান অঞ্চল ঠিক এরই পাশে। ওরাং উটাংদের ঘরদোরও বেশি দূরে নয়—কিন্তু এই বনে তারা নেই। দেখা যাবে না। ‘তুয়া রুমা’কে জিজ্ঞেস করেই ফেলি, ‘এই গুচ্ছগুলো কিসের? কী বস্তু?’ তুয়া রুমার চোখেমুখে গর্ব ফুটে বেরোল। এগুলো? হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছ। এগুলো সব মানুষের মুণ্ডু। আমরা তো হেড-হান্টার জাতি। ভালোমানুষের মুণ্ডু নয়, এগুলো জলদস্যুদের মুণ্ডু, ‘সমুদ্র-ডায়াক’দের—যারা জলদস্যুতা করত, দুশো বছর আগে এখানে এসেছিল। তাদের মুণ্ডু কেটে নিয়ে ধোঁয়া দিয়ে স্মোকড এবং প্রোসেসড করে, শ্রিংক করিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যার পরিবারে যতকটা কাটামুণ্ডু আছে, তার তত সম্মান। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ছবি তুললাম (আমার অতি বাজে ক্যামেরা ছিল) সেই কাটামুণ্ডুর গুচ্ছটির, ওগুলো ‘Shrunken smoked skulls of sea dayaks’ বললেন আমাকে সর্দারজি। সগৌরবে। ‘এখন আমরা আর হেডহান্টিং করি না। জলদস্যুরাও নেই।তাছাড়া ওটা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে—ইংরিজিতে বলে ওঠে সঙ্গের ছেলেটা পাশ থেকে। ‘তুমি ইংরিজি জানো?’ ‘ও ওর বাবার সঙ্গে শহরে থাকে যে!’ জিনস আর টি শার্ট পরা কিশোরটি সলজ্জ হাসে। সর্দারের নাতি সে। তার টি শার্টেও নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন, টুইন টাওয়ার ছিল তখনও, সেটা ১৯৯১।
ইবান পুরুষদের মধ্যে বিদেশযাত্রার একটা প্রাচীন রেওয়াজ আছে—সর্দার বললেন (পোজালাই বলেই তো মনে হল শব্দটা)—যুবকরা অরণ্য ছেড়ে দূর দেশে (অর্থাৎ শহরে) যাত্রা করে। কাজকর্ম জুটিয়ে নিয়ে অর্থ উপার্জন করে। আত্মীয়স্বজনদের জন্য উপহার, উপঢৌকন নিয়ে ফিরে আসে গ্রামে। শরীরে অজস্র উল্কিতে লেখা থাকে তার ভ্রমণ কথা, তার অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যপ্রমাণ। সর্দারের হাতে পিঠে অজস্র উল্কি, ভাষা জানি না সে ছবির—কুমির? সাপ? ড্রাগনজাতীয় কিছু? কী জানি কী কী বস্তু!
এইগুলো সত্যি সত্যিই মানুষের কাটামুণ্ডু? তোড়ায় বাঁধা? দেড়শো বছরের আগেকার? ধোঁয়া দিয়ে আর জড়িবুটি দিয়ে শুকিয়ে হাড় এরকম ‘Shrink? করানো যায়? আমরা যে-দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে এই গৌরবময় ‘ট্রোফি’ দর্শন করছি, মুখ নামাতে সেই দরজার দিকে চোখ পড়ল। দরজাতে দুটো স্টিকার সাঁটানো-একটা সবিনয়ে বলছে : Thank you for not smoking’ তেরচা চোখে তাকিয়ে দেখলুম, সর্দারের হাতে আমার দেওয়া সিগারেট। অন্যটি ঘোষণা করছে : ‘IN.Y.’ এবং একটি পুরুষ্টু লাল আপেলের ছবি। আরেকবার ফিরে দেখি। লং হাউসের দীর্ঘ করিডরে এমন ঊনপঞ্চাশটি দরজা আছে। না জানি কী কী দেখতে পাব! আমি মহোৎসাহে আমার সস্তা ক্যামেরায় অর্ধনগ্ন, রংচঙে পালকের মুকুটপরা, তরবারি হাতে উল্কি অলংকৃত বুড়ো সর্দারের পাশে তার টি শার্ট-জিনস পরা নাতি, মাথার ওপরে তোড়ায় বাঁধা মড়ার খুলি, দরজায় ‘IVN.Y.’ এবং ‘Thank you for not smoking’ স্টিকার লাগানো দরজার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ পাশের দরজায় দেখি DANGEROUS লেখা—এবং সঙ্গে কার ছবি? কার আবার, ওই Dangerous যাঁর গানের অ্যালবাম। তিনিই পোস্টারে নৃত্যরত। মাইকেল জ্যাকসনের বিশাল পোস্টার। তোল তোল ছবি তোল—এমন বিষয়বস্তু! একদিকে অনাবৃতবক্ষ নারীকুল গৃহকর্মে নিরতা, অন্যদিকে মাইকেল জ্যাকসন তার নীরব সাক্ষী। অল্পবয়সী ছেলেটি হাসল আমার দৃষ্টি অনুকরণ করে। ওবাড়ির ছেলেটা জাকার্তা থেকে এনেছে। ওদের আমেরিকান বন্ধুরা দিয়েছে। ‘সে বুঝি জাকার্তায় থাকে?’ ‘সেইখানে কলেজে পড়ছে এই ফ্র্যাং নদীর লং হাউসের ছেলেটি।’
‘তারপর? ওখানেই থাকবে? না ফিরবে?
সর্দার বললেন, সেটা জানা সম্ভব নয়। আমি বলি, এই দরজার ভেতরে ঢুকতে পারি? আপনাদের ঘর সংসার কেমন সেটা তো দেখা হল না।’ একটুক্ষণ তিনি ভাবলেন। ‘এই ঘরটির গৃহকর্ত্রীকে তাহলে জিজ্ঞেস করতে হবে।’ ইতিমধ্যে বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছেন। জ্যাকসনের চিত্রাঙ্কিত দরজাতেও নরমুণ্ডগুলি যথাযথ মহিমায় বর্তমান। ট্রাডিশন ও মডার্নিটির অপূর্ব মিলন! বৃদ্ধা দোর খুলে দিলেন। ‘আসুন’ বলে ডাকলেন। এই সংসারটিই এই লং হাউসে সবচেয়ে বেশি আধুনিক। ভেতরে ঢুকে দাঁড়াই। সরু লম্বা একটি ঘর। তিন ভাগে বিভক্ত। বাঁশের কাজ করা দেওয়াল, মেঝে, ছাদ। বিভাগগুলিও বাঁশের, অর্ধেক পর্দা। সামনের অংশটিতে দুটো অত্যন্ত নিচু, বাচ্চাদের স্কুলের টেবিল চেয়ারের মতো ছোট ছোট সোফা। তাতে গোলাপি ফুল ফুল কভার পরানো। অত্যন্ত বিতিকিচ্ছিরি, এই পশ্চাৎপটে। কে বসবে খেলনার মতো ওই আসনে? কেনই বা? মনে হচ্ছে বসলেই ভেঙে যাবে। কাঠের না বাঁশের তাও জানি না, ঢাকনি—পরানো। সগর্বে ওই সোফার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন সর্দার। মহিলা কিছুই বলছেন না। ঘরের কোণে অত্যন্ত সুদৃশ্য একটি দীর্ঘ দীপখণ্ড দাঁড়িয়ে আছে। সর্দার সেটি দেখিয়ে বললেন—প্রত্যেকটি বিবাহিত দম্পতির একটি করে এমনি পিতলের কারুকার্যখচিত দীপদান থাকেই—কারুরই বেশি বড়, কারুর অত বড় নয়। কারুরটাকে বেশি কারুকার্য, কারুর সাদাসিধে—কিন্তু থাকা চাইই। প্রতি ঘরেই একটি পরিবার, আর প্রতি দম্পতির একটি দীপদণ্ড। প্রতি দম্পতির একটি ঘর। দুটি বিবাহিত প্রজন্ম এক ঘরে থাকে না। এই দীপদণ্ড নিয়েই ইবান পুরুষ তাঁর পছন্দ করা কন্যাকে প্রেম নিবেদন করে অর্থাৎ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বৃদ্ধার মুখ একটু রক্তিম হল কি? এই দীপদণ্ড তাঁরই বিবাহের। বাঁশের দেওয়ালে নানাধরনের বাজনা টাঙানো ড্রাম, বাঁশি, সবই বাঁশের তৈরি। নাচ-গান হলে, তখনই এগুলির কার্যকারিতা জানা যায়। ভারি সুদৃশ্য বাদ্যযন্ত্রগুলি—আমার তো নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল! অবশ্য নরমুণ্ডের গুচ্ছও নিয়ে আসতে খুবই ইচ্ছে করছিল, কলকাতা শহরে ওগুলি ভালোই মানাবে। মানুষগুলোও এখানে ধুলো ধোঁয়াতে শুকিয়ে ধূসর হয়ে যাচ্ছে তো! ‘Shrink’ও করছি আমরা নিশ্চয়ই।
ঘরের পরবর্তী অংশে (বাঁশের আধা দেওয়ালে ভাগ করা—দরজা নেই, খানিকটা খোলা) কিচেন। রান্নাঘরটি আধুনিক-গ্যাসের উনুন রয়েছে, ছোট একটি গ্যাস সিলিন্ডারও আছে। সগর্বে এইসব সম্পত্তির দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিরাজ করছে একটি বড়সড় কেরোসিনের স্টোভ। তার ওপরে চড়ানো আছে ভুশুণ্ডি কালিমাখা একটি বড় কেটলি। কিছু সেরামিকের মগও ঝুলছে দেওয়ালে। তারই সঙ্গে আছে এমন কিছু বাসনকোসন, যেগুলি দেখলে মনে হয় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মাটি খুঁড়ে বের করেছেন। বঁটি, ছুরি দেখলাম না বটে। কিন্তু কুঠার রয়েছে।
আর দেওয়ালের গায়ে হেলানো আছে এক গাদা ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রশস্ত্র। সেগুলো এঁরা ‘এথনিক টাচ’ দেওয়ার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন বলে মনে হল না। তীর, তৃনীর, ধনুক, বর্শা, ব্লো-পাইপ-তীর, বর্শার ফলাগুলো শাণিত। আলো পড়ে ঝকঝক করে উঠছে। নিয়মিত ব্যবহার হয় বলেই মনে হল।
পিছন দিকে আছে তৃতীয় অংশ। অ্যাটাচড টয়লেট। আমি তৃতীয় ভাগাঢ়র দিকে রওনা হতেই কেউ আমার হাত চেপে ধরে। ‘বড় অন্ধকার’। সর্দার বলেন, হাত ছেড়ে দিয়ে।—’আর, একটা গর্ত রয়েছে ওখানে। না যাওয়াই ভালো। গেস্টহাউসের পশ্চিমী টয়লেটই ভালো হবে।’
উপসংহার
লং হাউস পরিদর্শনের অস্তে আমরা আমাদের শর্ট হাউসে ফিরে বিছানায় পা এলিয়ে দিই। ফর্সা বিছানা, ফর্সা তোয়ালে। ঝরনাধারায় স্নান, বিলিতি টয়লেট—এই মহারণ্যে এর প্রত্যেকটি বস্তুই বেমানান। সবচেয়ে বেমানান আমরা। আমি যদিও বা চামড়ার রঙে ইবানদের আত্মীয়, অন্যরা তো প্রবল বিজাতীয়। সেই ‘White Rajah of Sarawak’-এর স্বজন। সন্ধ্যায় নদীতে বেড়াতে যেতে উৎসাহ ছিল না কারুরই—বিয়ারের ক্যান খুলে বসলেন অতিথিবৃন্দ। কিন্তু অনতিবিলম্বে এসে পড়ল ‘তুয়াক’, ইবান অরণ্যবাসীদের হাতে-তৈরি ধান্যসুরা। বিয়ার ছেড়ে তুয়াকের স্বাদ গ্রহণে ব্যস্ত হলেন সকলে। বিয়ারে আমার রুচি নেই, কিন্তু তুয়াক কী বস্তু, সেটা জানতে আমার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ধানই আমাদের এশীয় মানুষদের দেখাশুনো করে—বাংলার ‘ধেনো’ মদ থেকে জাপানের ‘সাকে’ পর্যন্ত। এখানে ‘তুয়াক’-কে অযত্নে অবহেলায়, অনাস্বাদিত রাখা ঠিক নয়। পরিচয় দরকার। দু-এক চুমুক খেয়ে দেখলাম, খারাপ না, কিন্তু না, ‘সাকে’-র মতো ভালো নয়। ‘ধেনো’ তো খেয়ে দেখিনি। তখনই মনে করেছিলাম দেশে গিয়ে ‘ধেনো’-টা চেখে দেখতে হবে। সেটা ছিল ১৯৯১-এটা ২০০৫—সেই ইচ্ছা আজও পুরণ হয়নি। অন্তত একচুমুক তো খেয়ে দেখা দরকার? তুয়াকের সঙ্গে তুলনা চলে কিনা? তুয়াক খেতে খেতে গাইডের মুখে গল্প শুনছিলাম। লং হাউসের পাণ্ডা এই ‘তুয়া রুমা’ হচ্ছেন গোষ্ঠীপতি, কেননা তিনি এই জাতির এতিহ্যটা পুরোপুরি ভালো করে জানেন। সব নিয়মকানুন, সব আচার-বিচার, সব আইন-শাস্তি, বিধিবিধান, তাঁর নখাগ্রে। আর এই অপরিসীম জ্ঞানই তাঁকে সর্বজনসম্মত গ্রামপ্রধান করেছে। তিনি আদাত’ জানেন। ‘আদাত’ হচ্ছে শাস্ত্র, নিয়ম, কানুন, আইন। অনুশাসন। আমার তো মনে হল ওই শব্দটা হয়তো ‘আদত’-ও হতে পারে? ‘উর্দু-হিন্দি’র অভ্যাস? ইবানদের ভাষা নাকি মূলত অস্ট্রোনেশিয়ান, তাতে কিছু মালয়, কিছু চিনে, এবং কিছু সংস্কৃত শব্দও আছে—গাইড বলছিলেন, ইবানদের ভাষাটা মিশ্র চরিত্রের। ওদের ধর্মও মজার। আসলে ওরা পূর্বপুরুষের পূজারী—পূর্বপুরুষরাই ওদের দেবতা। কিন্তু সাহেব মিশনারিদের চাপে কোনও কোনও লং হাউসে নাকি খ্রিস্টধর্মকেও এরা জুড়ে নিয়েছে এদের নিজস্ব আদিম অরণ্যের ধর্মাচরণের সঙ্গে সঙ্গে—নিজেদের মতো অদলবদল করে নিয়ে। আমাদের ভাগ্যদোষে এই লং হাউসের ‘তুয়া বুরং’ এখন এখানে নেই। তিনিই পূজারী, তিনিই এদের পুরোহিত। তিনিই প্রাকৃতিক লক্ষণ দেখে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করে দেন। তিনি শাকুনশাস্ত্রবিদ—অর্থাৎ পাখিদের ভাষার মানে, ও আচরণের লক্ষণ পড়তে পারেন।
‘তুয়া বুরং’ এই মুহূর্তে অন্যত্র গেছেন দুদিনের জন্য। আরও একজনকেও আমরা দেখতে পাইনি। তিনি এই লং হাউস গ্রামের চারণ কবি, ‘লেমামবাং’, তাঁর কাছে জমা আছে এদের পূর্বপুরুষের কীর্তিকাহিনী। সাধারণত সব ইবান পুরুষই হয় ধানচাষী এবং শিকারি এবং যোদ্ধা। কেবল দুয়েকজন স্বপ্নাদেশ পেয়ে লেমামবাং (চারণকবি) হয়ে যায়। কিম্বা মানাং (ওঝা) হয়ে যায়। মানাংরা নানারকমের ঝাড়ফুঁক জানে, শমানদের জাতভাই। এই ইবান আদিবাসীরা এখন নেহাত শান্তিপ্রিয়, যদিও ওরা এককালে নরমুণ্ড শিকারি ছিল বলে ভয়ানক দম্ভ ওদের অনেকদিনই ছেলেরা শহরে যাচ্ছে, লেখাপড়া শিখছে, বাইরে কাজকর্ম করছে, কিন্তু মেয়েরা কেউ বাইরে যায় না। তারা অরণ্যেই বাস করে। অরণ্যের আইনকানুন বজায় রাখে সংসারে। তাদের পোশাকে তাদের বোনা কাপড়ের ডিজাইনে, তাদের বোনা ঝুড়ির গড়নে তাই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরা থাকে। কেউ চায় না মেয়েরা শহরে গিয়ে বদলে যাক। তাহলে ঐতিহ্য ধরে রাখবে কে? তাহলে শিকড় হারিয়ে যাবে যে। মেয়েরা থাকুক রক্ষণশীল হয়ে, ঘরদোর সামলাক তারা। পুরুষ যাক দেশ-বিদেশে, উপার্জন করে আনুক প্রীতি উপহার। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। এদের মধ্যে অর্থ সঞ্চয়ের ইচ্ছে বা ধনসম্পদ, হীরে মাণিক, সোনা রুপো সঞ্চয়ের কোনও প্রবৃত্তি, নজরে এল না। এখনও এদের বাঁচার ধরনের মধ্যে সৎ, প্রাকৃতিক সারল্য ঝলমল করছে।
.
পরের দিন সকালে প্রাতরাশ (ইংলিশ ব্রেকফাস্ট, চা-কফি দুধ কর্নফ্লেক্স টোস্ট ডিম) খেয়েদেয়ে আমরা ‘তুয়া রুমা’-র সঙ্গে বনভ্রমণে বেরোলাম। তিনি নিজের যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে চললেন—খুবই চোখ ধাঁধানো রংচং, যদিও অর্ধনগ্নই। হাতে বর্শা, হাতে ব্লো-পাইপ। আমরা চললাম বন্য বরাহের সন্ধানে। এঁরা মাঝে মাঝে বন্য বরাহ শিকার করে ফিস্ট করেন। ঘন অরণ্যে বনের পথে পথে লতাগুশ্ম কাঁটাঝোপ পেরিয়ে জলাজমি, এঁদোডোবা পেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি হল বনের মধ্যে—খুব রোমহর্ষক, কিন্তু বরাহ এল না। কিছু কীটপতঙ্গ, আর একটা নির্বিষ সাপ শুধু দেখা গেল।
আমাদের আনন্দ দিতে ব্লো-পাইপে ফুঁ দিয়ে বিষাক্ত তীর ছুড়লেন সর্দার। ব্যাপারটা কেমন দেখা গেল স্বচক্ষে। তীরে অবশ্য বিষ ছিল না, এবং সেটা ছোড়া হল বৃক্ষকাণ্ডের উদ্দেশে। অ্যাডভেঞ্চার শেষ হল এখানেই।
এরপরে বিদায় নিয়ে আমরা আমাদের লম্বা লম্বা ডিঙিনৌকো দুটোয় এসে উঠলুম। অন্য একটা জায়গা থেকে উঠতে হচ্ছে এবারে—কেননা যে-ঘাটে নৌকো থেকে নামা সোজা, সে ঘাটে কিন্তু নৌকোতে ওঠা সোজা নয়।
সুন্দরবনে নৌকোতে চড়ার প্রসঙ্গে প্রচণ্ড আছাড় খাওয়ার স্মৃতি জাজ্বল্যমান ছিল তখনও—কিন্তু এখানে অমনধারা কালো এঁটেলমাটি নয়। গাছপালা আছে সবখানে, কেউই পড়ে-টড়ে যাইনি আমরা
আসবার সময়ে নৌকো এসেছিল উজান বেয়ে স্রোতের উল্টোমুখে। অরণ্য হৃদয়ের দিকে। এবার ফেরত রওনা নদীর স্রোত বেয়ে, সমুদ্রের দিকেই। অনেক সহজ হবে সভ্যসমাজে ফিরে যাওয়া—বেরিয়ে পড়াটা সহজ ছিল না।
কেন যে তিনি তাজমহলের চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন লং হাউস দেখে, বুঝতে পারি। একটি তো উচ্চমানের মানবসভ্যতার অবদান। মৃত্যুকে কত সম্মান করা যায়, প্রেমকে যে মৃত্যুর চেয়ে বড় করে তুলবার শক্তি রাখে শিল্প—শিল্পের মাধ্যমে মৃত্যুকে যে হার মানানো সম্ভব—তারই উদাহরণ তাজমহল। লং হাউস তার বিপরীত। জীবনই এখানে মৃত্যুকে হার মানাচ্ছে। মানবসভ্যতার প্রাথমিক যৌথ অস্তিত্বের কাহিনী লং হাউসের সামাজিক নিয়মে একসঙ্গে, এক ছাদের নীচে শান্তিতে মিলেমিশে ঊনপঞ্চাশটি পরিবার বসবাস করছে, তাদের বিভিন্ন জীবনযাপনের পথ—কেউ বিদেশে চাকরি করছে, কেউ শহরে পড়ছে, কেউ মাঠে চাষ করছে, কেউ নৌকো বাইছে, কেউ মাছ ধরছে। প্রসঙ্গত, মালয়দের শুকনো শুটকি মাছ ইবানরা খেতে খুব ভালোবাসে, কিন্তু নাকি নিজেরা তৈরি করতে পারে না। অথচ দিবি শুটকি নরমুণ্ড তো তৈরি করার কায়দা রপ্ত করেছিল এককালে? একসঙ্গে এতগুলি পরিবারের সংসার করা, এতেই উচ্চস্তরের মানবসভ্যতার পরিচয় আছে। জীবনকেই শিল্প করে তোলার অত্যাশ্চর্য প্রমাণ এখানে। ইউরোপের মানুষটির কাছে এ জীবন ‘তাজ্জব’ মনে হতেই পারে। পাথরে ফুল ফোটানোর সৌন্দর্যকে সত্যিই হার মানাতে পারে সমস্ত আদিম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার এই সংগ্রাম। পরস্পরকে ভালোবেসে! মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে, অরণ্যের বুকের মধ্যে মানুষের একসঙ্গে বেঁচে থাকার উৎসব-এরই নাম ‘লং হাউস’।
প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৫