জলের ধারে ঘর

জলের ধারে ঘর

‘চিরকালের ইচ্ছে’ বলে একটা কথা আছে না? আমার তেমনই একটা চিরকালের ইচ্ছে ছিল। মা বলতেন, প্রাণপণে যদি ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়া যায়, সেটা শেষপর্যন্ত তিনি দিয়ে দেন। তবে ছোট জিনিস চাইতে নেই, অন্যের ক্ষতি চাইতে নেই, এমন কয়েকটা নিয়মকানুনও আছে বৈকি চাইবার। জীবনভর তো আমি নিয়ম মেনে কিছুই ঠিকঠাক করে উঠতে পারলাম না। হঠাৎ ঈশ্বরের কাছে চাওয়ার বেলাতেই বা পারব কেন? তবে এই ‘চিরকালের ইচ্ছে’-টা আমার ‘ছোট জিনিস’ না ‘বড় জিনিস’ তা আমি নিজেই জানি না। ইচ্ছেটা হল, ‘জলের ধারে ঘর’। শহরের মেয়ে আমি, হিন্দুস্থান পার্কে ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির তিনতলায় জন্মেছি। আমার ছোটবেলাতে কেয়াতলার অস্তিত্ব ছিল না। বারান্দা থেকে লেকের জল, লেকের ওপরের কু ঝিক ঝিক ট্রেন দেখা যেত। লেক হাসপাতালের মাথার ওপর দিয়ে। লেকের জলের দূরবর্তী ক্ষীণ রুপোলিতে আমার মন ভরত না। কেবল মনে হত এই বাড়িটা কেন এক লাফে ওই জলটার ধারে চলে যেতে পারে না? গাছপালা, মাটি, জল আমি ছোট থেকে ভালোবাসি। খুব ইচ্ছে ছিল গঙ্গার তীরে একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকব। কিংবা যে-কোনও জলের ধারে। বারবার চেষ্টা করেছি, গত বিশ বছর ধরে। কোন্নগরে, বারাকপুরে, চন্দননগরে, শান্তিনিকেতনে তালতোড় বাঁধের ধারে, কোপাইয়ের ধারে–কোথাও হয়নি। প্রত্যেকটি চেষ্টা বিফল হয়েছে।

কিন্তু ঈশ্বর করুণাময়। তিনি জলের ধারের নিজস্ব বাসাটি বাঁধতে কোনওদিনই দেবেন কিনা জানি না বটে কিন্তু জলের ধারে বাস করার আকাঙ্ক্ষা বারবার পূর্ণ করেছেন।

দিল্লির মডেলটাউনে আমাদের ছোট্ট ভাড়াটে বাড়ি ছিল একটা হ্রদের ওপরেই। সামনে আবার একটা ছোট্ট দ্বীপ। ভোরবেলা তা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যেত। আর সন্ধেবেলা কিচিরমিচির ডাকে পাড়া মাতিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ফিরত। সারাদিন সূর্যের সঙ্গে খেলা চলত জলের-কতরকমই যে রং বদল হত। বন্ধুরা বলেছিল, ‘সারাদিন তো আমি তোর এই বারান্দাতেই বসে থাকতে পারি রে! এতরকম রং! তুমি কাজকম্মো করো কী করে?’ সেই বাড়িতে বছর দেড়েক। রাস্তা পেরোলেই জল।

আবার জলের ধারের বাসায় থাকা হল ছোট মেয়ের কাছে বেড়াতে গিয়ে। কেম্ব্রিজ ম্যাসাচুসেটসে—চার্লস নদীর তীরেই তার চারতলার ফ্ল্যাট—’রিভার ভিউ’ নদীর সুন্দর দুটি বাঁকের মাঝখানে। একেক ঋতুতে নদীর একেকটা রূপ। দুধারের গাছের সারির রূপ বদল হয়, রং বদল হয়, নদীর জলেরও চেহারা পাল্টে যায়। হেমন্তের লাল-হলুদ পাতার ছায়া বুকে নিয়ে তার রং লাল-সোনালি। শীতের সময় তো চার্লস নদীর বুকে বরফের স্থির চাদর ঢাকা পড়ে, যেন আয়না। বুকে আকাশটা ধরে রাখে। মাঝে মাঝে জলের ঝিরঝিরে কাঁপনের টুকরোতে বন্দী হাঁসেরা আশ্রয় নেয়। নৌকোবাইচ বন্ধ থকে। পুরোটা নদী, তার ওপারে বস্টন শহর দেখা যায়, গাছেরা তখন নগ্ন, আকাশ তখন উন্মুক্ত। আবার বসন্তে কচিপাতার সময়ে, বরফ গলে গিয়ে নদীর যেন নবীন প্রাণ আসে। আয়নার স্থির অংশটা ক্রমশ কমতে থাকে। ঝিরঝিরে জলের ফিতেটা বাড়তে থাকে। আর গাছে যত পাতা ঝরে, নদী ততই ঢাকা পড়তে থাকে সবুজ পর্দার আড়ালে। একসময়ে গ্রীষ্ম আসে, জলের নৌকোবাইচের ভিড় জমে, ভ্রমণকারীদের স্টিমার চলে, জলের রং ছায়াঘন সবুজ হয়ে যায় গাছের ছায়া বুকে নিয়ে। হাঁসেরা আবার মুক্ত! বস্টনও লুকিয়ে পড়ে। ওই বারান্দাটা আমার স্বপ্নের বারান্দা, সেই আমার ‘চিরকালের ইচ্ছের বারান্দা। চারতলা নেমে, রাস্তা পেরিয়ে গেলেই নদীর তীর। ওটা আমার আস্তানা নয় বটে, ওখানে আমার চিরকালের ঠিকানা নেই, তবু যতটুকু সময় থাকি খুব আহ্লাদে কাটে। নদীর ধারের বাসা! ঈশ্বর অল্প-অল্প করে কিস্তিতে ইচ্ছাপূরণ করেন। সেই ভালো। একসঙ্গে নাইবা হল। আমার নিজস্ব বলে সত্যি তো জগতে কিছু নেই। নাইবা থাকল জলের ধারে নিজস্ব বাসা। জলের ধারে বাস করার শখটা তো মিটিয়ে দিচ্ছেন!

‘ভিলা সেরবেলোনি’-তে পাঁচ সপ্তাহের রাকিফেলার ফাউন্ডেশনের রেসিডেন্ট ফেলো হয়ে গিয়েছিলাম এই বসন্তকালে। বেলাজিও গ্রামটি কোমো হ্রদের তীরে। লেক কোমোর পাড়াটাই সারা ইতালীতে বিখ্যাত অঞ্চল, লম্বার্ডির সেরা জায়গা, ইউরোপের ধনীদের সামার প্যালেসে ভর্তি, সেই মধ্যযুগ থেকে। এমনকি আরও আগে, রোমান যুগ থেকেই লেক কোমোর তীরে বিলাসী মানুষের বাগানবাড়ির শখ ছিল। প্লিনির দু-দুটো বাড়ি ছিল এদিকে। প্লিনি থেকে এই সেদিনের মুসোলিনি পর্যন্ত—পণ্ডিত থেকে সৈনিক সকলেরই স্বপ্নের পাড়া ছিল এটা। নেপোলিয়নও এসেছেন, আবার লংফেলোও এসেছেন। লেক কোমোর জলের ধারে ধারে মধ্যযুগীয় গ্রামের ফাঁকে ফাঁকে বিশাল বিলাসবহুল প্রাসাদ, আর প্রাসাদ মানেই তো বাগান! আগে বাগান, তারপরে বাড়ি। বাগান গড়িয়ে নেমে আসে জল অবধি।

এই ভিলা সেরবেলোনিও তেমনই ইতিহাসে নাম লেখানো প্রাসাদ। এর অবস্থিতি পাহাড়ের চুড়োয়। একটা ছোটখাটো নিজস্ব পাহাড়ের চুড়োয়। টিলাও বলতে পারা হয়তো যেত, তবে হাঁপানিরুগীর কাছে পাহাড়ই। কলকাতার লোকের কাছেও পাহাড় বটে! ষাট একর বাগানের একটা দিক নেমে এসেছে নিজস্ব সৈকতের ধারে। সেখানে ভিলার নিজস্ব সাঁতারের জায়গা, নৌকো বাঁধার ঘাট রয়েছে। কিন্তু গ্রামে যেতে হলে অন্য পথ ধরতে হবে। সেই পথে নেমে গেলে, হাট-বাজার, পোস্ট অফিস। এবং ফেরিঘাট!

এখানে দুটো ঘর আমার, একটা পড়ার ঘর, একটা শোবার ঘর (রাজকীয় ব্যবস্থা, বলাই বাহুল্য, বাড়িটা যখন প্রাসাদ!) একসঙ্গে লাগোয়া—আর বিলাসবহুল স্নানঘরও নিজস্ব। আমার ঘরগুলোতে তিনটে আশ্চর্য সুন্দর জানলা আছে। ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর মতোই বিশাল মেঝে থেকে দরজার সমান উন্মুক্ত জানলা, কিন্তু তাতে বারান্দার মতো কোমর পর্যন্ত রেলিং দেওয়া। যেন তিনটি ব্যালকনি কেউ আমার ঘরের মধ্যে ভরে দিয়েছে। আর জানলা দিয়ে সামনে সমুদ্দুরের মতো লেক কোমো। লেক কোমোর ধারে এই প্রাসাদ, অনেক উঁচু না হলেও বেশ উঁচুতে। যখন-তখন ছুটে জলের ধারে চলে যাওয়া যায় না। দিনে একবারও যেতে পারব কিনা, প্রথমে ভাবতে পারিনি। কিন্তু জল আমাকে ডাকে।

১৯৮৮-তে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সামার ইনস্টিটিউট অব সোমিওটিক অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল স্টাডিজ’-এ গিয়েছিলাম যখন, সেখানেও তাদের সেই নকল দুর্গের মতো হোস্টেলে আমাকে দুটি ঘরের যে অ্যাপার্টমেন্টটি দিয়েছিল, ছ-সপ্তাহের জন্য—এমনই বিশাল সমুদ্র পাহাড়ের স্বপ্নদৃশ্যে আঁকা পিকচার-উইন্ডো ছিল তাতেও। শুধু তফাত এই, সে-জানলা জানলাই। সে কাচগুলো খোলে না। আর সেই যে আশ্চর্য নীল সমুদ্র, আর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বিখ্যাত ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ভরা সবুজ দ্বীপপুঞ্জ, আর দূরে ভেসে যাওয়া জাহাজ—অতখানি আকাশ, অতটা জল, সবই যেন সিনেমার মতো দেখাত। কেমন যেন সুদূর, অবাস্তব, আমার সঙ্গে অসংযুক্ত। জানলাই খোলা যেত না, সমুদ্রের বাতাস বইত না ঘরে, ঘর থেকে বেরিয়ে জলের কাছে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। যদি টিলটিলরা গাড়ি নিয়ে এসে কোনওদিন বেড়াতে নিয়ে যেত, তবেই। সমুদ্র, দ্বীপ, আকাশ সবই জানলার মধ্যে বাঁধা পড়লেও নাগালের মধ্যে ছিল না। তবু, সেইবারও আমার চোখের তৃষ্ণা মিটেছিল বৈকি—সারাদিনে সমুদ্রটা নীল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে গোলাপি, সোনালি, বেগুনি হয়ে যেত সূর্যের সঙ্গে জোড় মিলিয়ে। আর তারপর কালো। শুধু অজস্র জাহাজের আলোকবিন্দু রাতভর ভেসে যেত। দূরে একটা লাইহাউসের অদৃশ্য আলোর ছন্দ থেকে থেকে ঝলসে উঠত। তাই জানি, সমুদ্রটা আছে।

লেক কোমোতে তা নয়। সারা রাত সেখানে আলোর মেলা বসে। এ তো অকূল সমুদ্র নয়! পাড়ে ঘেরা হ্রদ। চারদিকে গ্রামভর্তি। রাস্তার আলো সারারাত জ্বলে। আর হ্রদের জলে তাদের লম্বা লম্বা রঙিন ছায়া সারারাত কাঁপে। আমি যখন নৈশ আড্ডার পরে ঘরে ঢুকি, তিনটে খোলা জানলা দিয়ে রঙিন আলোর উৎসব আমাকে একসঙ্গে অভ্যর্থনা করে। প্রত্যেক রাতেই আমার হঠাৎ মনটা খুশি হয়ে ওঠে। ‘একলা আছি’ এমনটি মনেই হয় না। ‘এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে, কী উৎসবের লগনে/সব আলোটি ফেল আমার মুখের পরে/তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে’।–একলা কোথায়? একমনে চাইলে সবই পাওয়া যায়। অল্পদিনের জন্য পেলেই বরং বেশি ভালো। তার দামটা বেড়ে যায়। বুকের মধ্যেটা বেশি করে ভরে ওঠে। আবার যখন ফুরোয়, বুকের মধ্যেটা বেশি করে ফাঁকা হয়ে যায়। আমার তাতে আপত্তি নেই। এটাই তো আমাদের হওয়ার কথা। চিরকাল তো কেউই থাকে না, কিছুই থাকে না। না প্রেম, না ঘৃণা। জলের ধারের ঘরই বা চিরকাল থাকবে কেন? মাঝে মাঝে যে আসে, আমাকে ভরে দিয়ে যায়, এই তো যথেষ্ট। ‘চিরকালের ইচ্ছে’ তাই চিরকাল ধরেই রয়ে যায়। এই তো ভালো!

জলের ধারে আরেকবার ঘর বেঁধেছিলাম—দুদিনের জন্য। ভূপালে গিয়ে একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তখন ছিলাম একটি গেস্টহাউসে। গেস্টহাউসটি ঠিক বড়া তালাওয়ের ওপরে, এক টিলার মাথায়। আমার ঘর থেকেই দিনভর জলে রঙের খেলা দেখতাম, রাতে ঠিক এমনই দীর্ঘ রঙিন আলোর রেখা ভাসত বড়া তালাওয়ের অন্য পারের জলে। ওপারে রাস্তা, ওপারে নগরী। আর এপারে? ঠিক আমার বারান্দার নীচে ছিল জেলেদের গাঁ, জাল বোনার আর জাল শুকুতে দেওয়ার ছবি। ছোট্ট ছোট্ট জেলে নৌকোগুলি ছাড়ত সারাদিন। ভ্রমণকারীদের প্রশ্নই নেই! সরু রাস্তা দিয়ে কলসি মাথায় রঙিন মেয়েরা হেঁটে যেত। সাইকেলে তিনজন বসে মাথায় বড় খাট নিয়ে যেত। আর আমার ঝুলবারান্দার ঠিক বাইরে একজোড়া কালো নাম না-জানা ছোট পাখি ঝগড়া করতে-করতে উড়ে বেড়াত। বোধহয় বাসা বেঁধেছিল বারান্দার আলসেতে। সবচেয়ে আশ্চর্য ছিল ওই বড়া তালাওয়ের বুকের প্রত্যেকটি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। সূর্যের মতিগতি বোঝার জন্য আবার একটা আশ্চর্য নৈসর্গিক ব্যবস্থাও ছিল। একটি নিঃশব্দ সবুজ দ্বীপ। তাতে জেলেরাও যায় না। দ্বীপটি ভোরের আলোর সঙ্গেই ভেসে উঠত যেন সূর্যিঠাকুর বসবেন বলে আসন পেতে দিচ্ছে। আর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো হতে হতে মিলিয়ে যেত। যেন সেও জলে ডুবে গেল। একটিও আলো ছিল না তাতে। সূর্যই তার অস্তিত্বের পরিচয়বাহক। এই লেক কোমোতেও একটি দ্বীপ আছে। ইসোলা কোমাচিনা। সেটি এখান থেকে দেখা যায় না। কিন্তু তার ইতিহাস জানি।

লেক কোমোর ধারে ধারে যেমন প্রাসাদের সারি, তেমনই প্রাসাদের আশপাশে ছোট্ট-ছোট্ট খুব পুরনোদিনের গ্রামও আছে। আর সেইসব গ্রামের অনেকগুলি এখনও মধ্যযুগীয় চেহারাতে রয়ে গেছে। জল থেকে সোজা পাহাড়ের গায়ে তাদের পথগুলি উঠে গেছে খাড়া সিঁড়ির মতো, গাড়িটাড়ি চলবে না। শুধুই পায়ে চলার পথ। এই সিঁড়িপথের দুধারে দোতলা বাড়ি—হলুদ আর মেরুন রঙের দেওয়াল, প্রায় প্রত্যেক বাড়ির জানলা-দরজার তিনধারে আলপনার মতো কী সুন্দর ছবি আঁকা। গাড়িটাড়ি নেই। সাইকেলও চলে না। আজকাল এইসব গ্রামেও একটা করে বড় রাস্তা হয়েছে—ফেরিঘাট থেকে খানিকদূরে যায়—যেখানে ট্যুরিস্টদের যাবার কথা, সাধারণত সেখান পর্যন্ত। কেননা সব ট্যুরিস্ট তো হাঁটতে চায় না! ফেরি-নৌকোতে তাদের গাড়ি, কিংবা সাইকেল চাপিয়ে নিয়ে আসে তারা। এই অঞ্চলটা গরিব নয়, কিন্তু ভ্রমণকারীদের ওপরে নির্ভর করে আছে সেই মধ্যযুগ থেকেই। প্রধানত জেলেদের গ্রাম, কিছু গ্রামে মদ তৈরি হয়। কিছু গ্রামে মদের পিপে, জেলেদের নৌকো (এখন আবার আসবাবপত্তরও), আর এখানকার প্রসিদ্ধ রোদে শুকোনো মাছ। আমার ভিলা সেরবেলোনির ঘর থেকে বাঁয়ে ফেরিঘাটটা দেখা যায়, আর ডাইনে বেলাজিও গ্রামের গির্জার গোল চুড়ো। নীল রং তার। এখানে সমস্ত গির্জার ঘণ্টাগুলো সুরে বাঁধা, সেই ঘণ্টা বাজানো শিখতে হয় অন্যসব বাদ্যযন্ত্রের মতো। সারাদিন কী যে সুন্দর বাজনা বাজে এখানে ঘণ্টায়, আধ ঘণ্টায়। রাতে বন্ধ। জলে নৌকো নিঃশব্দে ভেসে যায়। গাড়ির শব্দ আসে না। (কটাই বা গাড়ি বেলাজিওতে?), মাঝে মাঝে অবশ্য প্রচণ্ড ভটভট শব্দে স্পোর্টস মোটরবোট নিয়ে লেক কোমোর জল তোলপাড় করে রেসিং প্র্যাকটিস করে কেউ-কেউ। আকাশ-বাতাস মনপ্রাণ যেন ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করে দেয়। মানায় না, মানায় না, তোমাকে একদম মানায় না হে এখানে। কোথা থেকে যে তেড়ে আসো তুমি, এই শান্ত ঘুমন্ত গ্রামগুলোকে মনে মনে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যাও। জানি না একটাই মোটরবোট, না অনেকের—পাঁচ সপ্তাহে হয়তো তিনদিন এসেছে। কিন্তু অসহ্য কষ্ট দিয়েছে। যেমন ওই যখন খুশি জলে নেমে পড়তে পারা, তলপেটে নৌকো আঁটা হেলিকপ্টারগুলো যখন উড়ে যায়, অদ্ভুতদর্শন কোনও প্রাগৈতিহাসিক ফড়িংয়ের মতো। গুনগুন শব্দই করে, কিন্তু সেটা গুঞ্জন নয়, গর্জন। এ পাড়ায় গর্জন একদম বেমানান। এখানে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কেবল অশ্রুত এক গুঞ্জন ধ্বনিত হচ্ছে, ইতিহাসের সঙ্গে নিসর্গ এখানে হাত মিলিয়েছে। আর তার সঙ্গে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে, ঈশ্বরের করুণা। নইলে আজ আমি এলাম কেমন করে? ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সমুদ্র, দ্বীপ, আকাশ, জাহাজ, পাহাড়, বনমালা—দূর থেকে দেখেও ঠিক মনে হয়েছিল অহৈতুকী কৃপা। টুম্বার বারান্দায় বসেও মনে হয় এ কী করুণা। আর এই ভিলা সেরবেলোনিতে তো প্রতিটি বাসিন্দাই সর্বক্ষণ মুখে উচ্চারণ করছেন, ‘কী সৌভাগ্য! আমি কি এর যোগ্য?’ আস্তিক-নাস্তিকে এখানে ভেদ নেই, মনের কথাটা একই, সেখানে শুধু পৌঁছনোর পথ দুটো আলাদা। একটা যুক্তির, আরেকটি ভক্তির। এখানে যে জনা বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি আছি—কেউ বৈজ্ঞানিক, কেউ সঙ্গীতজ্ঞ, কেউ আইনজ্ঞ, কেউ চিত্রকর, কেউ বা কবি—সকলেই স্পষ্টত কৃতার্থ বোধ করছি। কোনও ‘যেন’-র প্রশ্ন নেই।

জলের ধারে ঘর। ঘরের মধ্যে ব্যালকনি। ব্যালকনিতে লেক কোমো। আর অজস্র ফেরিনৌকো খেয়া পারাপার করছে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাবার তো এটাই রাস্তা। যেমন শুনেছি বরিশালের নদীতে নদীতে। যেমন দেখেছি ভেনিসে। এখানে কেবল নদীও নয়। নালাও নয়। একটিই বিস্তৃত জলরাশি—লেক কোমো। হ্রদটি অবশ্য খুব চওড়া নয়। সবদিকেই তো পাহাড়ঘেরা। পাহাড়গুলি আবার ফার, পাইন, জুনিপার গাছের বনে সবুজ। সেইসব পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে ছোট ছোট যেন পুতুলখেলার বাড়ি। সে বাড়ির জানলায় আর কাঠের বারান্দায় ফুলগাছের টবে রঙিন ফুল উপচে পড়ছে। পাহাড়টাকে বলে Pre—Alps, কিন্তু বাড়িগুলি দিব্যি Alpine Cottageই। যদিও জলের ধারের বাড়ির চরিত্র একেবারেই আলাদা পাহাড়ি বাড়ির চেয়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু সরু পায়ে-হাঁটাপথ আছে, আর সেইসব পথ উঠে যায় পাকদণ্ডীর মতো আশ্চর্য সব মধ্যযুগীয় পাথরের গির্জায় অথবা দুর্গে। দুর্গের চৌকো মিনারে, আর গির্জার ঘণ্টাবাঁধা রঙিন মিনারে পাহাড়ের ঢালু গা যেন গয়না পরে আছে। যে দুটি শক্তি মধ্যযুগের ইতিহাস, রাষ্ট্র এবং ধর্ম, এখানে তা প্রত্যক্ষ দৃশ্যমান। ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতসব দেখা যায়, যেমন দেখা যায় আকাশে রোদ-মেঘের খেলা। এখন এখানে ক্ষণে রোদ ক্ষণে বৃষ্টি; এই বসন্তকালের এটাই বৈশিষ্ট্য।

আমার জানলার সামনে একসারি জারুলগাছ ফুলে ফুলে ছাওয়া। নাম ইন্ডিয়ান চেস্টনাট। সত্যিই জারুল কিনা জানি না বাপু। আমি তো বটানিস্ট নই, তবে ঠিক জারুলের মতোই মঞ্জরী। জানলার নীচের রাস্তাটার একদিকে আমাদের বাড়ি, অন্যদিকে জারুলবীথি। আর এদিকে, ঠিক আমার জানলার তলায় দুটি ঘনশ্যাম গুল্ম। লালচে-সবুজ পাতা—কী গাছ? আমার চেনা গাছ নয় তো? মালির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেছে—কানের দুল পড়ে গিয়েছিল বাগানে। ষাট একর জমির ওপর বাগান। সেখান থেকে সোনার মাকড়ি খুঁজে এনে দিয়েছে মালি পাওলো। পাওলোর কাছে নাম জানা গেল। (দোভাষীর মাধ্যমে। পাওলো বাংলা বলে না, আমিও ইতালীয় বলি না। সে ইংরিজিও বলে না!) লরেল। যে লরেলপাতার মালা পরিয়ে ‘পোয়েট লরিয়েট হয়? সেই লরেল। যে ঘন লরেল ঝোপের ছায়া দেখলে পেত্রার্কের মন কেমন করে উঠত লরা-র জন্য, সেই লরেল। সেই ‘মহান লরেল’। লরেল আবার দুরকমের হয়। মহান এবং হীন। হীন লরেলের নাম বে-লিফ্। ভালগার লরেল। বে-লরেলও বলে। এখানেও রান্নাবান্নার কাজে লাগে। বাংলা দেশেও তাই। তেজপাতা আর কি! মহান লরেলের মতো রহস্যময় নয় তার রূপ। হালকা সবুজ, সাধারণ চেহারা। এ পাড়ায় বেড়া দেওয়া হয় বে-লরেলে। গিন্নি বেড়া থেকেই তেজপাতা ছিঁড়ে রান্নায় ফোড়ন দেন।

এ অঞ্চলে অলিভ বাগানও কম নয়। আমাদের এই ভিলাতেই আছে অলিভবাগান, নিজস্ব অলিভ অয়েল তৈরি হয়। ইতালীয় রান্নার গুণ তো অলিভ তেলেই। ভিলার বাগানে আছে দ্রাক্ষাকুঞ্জও। নিজস্ব ওয়াইনও তৈরি করে এই ভিলা সেরবেলোনি। এ এক আশ্চর্য ঠাই। এখানে ছোট্ট একটা মধ্যযুগীয় গির্জা আছে বাগানের মধ্যে, সেটা এখন আর কাজে লাগে না। মধ্যযুগীয়ও নেই। যুগে যুগে তাকে ভেঙে নতুন করে গড়া হয়েছে। সতেরো শতকের বেশ কজন পাদ্রীকে কবর দেওয়া হয়েছে তার ‘ক্রিপ্ট’-এর দেওয়াল। তাঁদের নাম, সাল-তারিখ সমেত। শুধু ক্লয়েস্টারটি এখনও আছে মধ্যযুগীয় চেহারার—আর বাইরের দেওয়ালে সূর্যঘড়ির চিহ্ন। ওপরে যেখানে কামরায় কামরায় পাদ্রীরা বসবাস করতেন সেখানে এখন বাস করেন ভিলা সেরবেলোনির কর্মীরা। এতবড় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন দুজন। শ্রীমতী জিয়ানা চেল্লি থাকেন এখানেই। আর শ্রী পাসকোয়ালে পেসকে থাকেন অন্য একটি ছোট বাড়িতে, সেই বাড়ির হলুদ দেওয়াল বেয়ে উঠেছে রকমারি গোলাপি—সোনালি—লাল-হলুদ-কমলা রঙের গোলাপের লতা। বড় বড় গোলাপগুলি প্রস্ফুটিত হয়ে আছে, যেন পদ্মফুল। আর যেখানেই দাঁড়াই, জল দেখতে পাব। সামনে তাকালেই লেক কোমো। নীলে নীল। জলের ধারের ঘরে থাকার সাধ আমার বারে বারেই মিটিয়ে দেন তিনি। মানুষের সব সাধ পূরণ করা যাঁর হাতে।

বাগানের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয় এঁদের। পাহাড় কেটে বাগান তো? ইতালিয়ান ফরমাল গার্ডেন—সেই যার কথা বোকাচ্চিওর ডেকামেরনে পড়েছি। যেরকম ভিলাতে ডেকামেরনের গল্প সাজিয়েছেন বোকাচ্চিও এ যেন ঠিক তেমনই, পাহাড়ের ওপরে ধনীর বাগানবাড়ি। উদ্যানবাটিকা। সাজানো বাগান। আর মর্মর প্রাসাদ। আর ঠিক ঘণ্টা ধরে, নিয়মমাফিক দিনযাপন।

এরই ফাঁকে ফাঁকে জল। আর আকাশ। বাগানের অনেকখানি জংলা রাখা আছে ইচ্ছে করে—সেখানে জংলী ফুল ফুটে আলো করে আছে। পাহাড়ি অংশটাতে যেখান দিয়ে উঠে গেলে দুর্গ প্রাচীর—এই বেলাজিওতে ভিলা সেরবেলোনির পাহাড়ের চুড়োতে দুর্গ ছিল। এর আরেকটি জোড়া দুর্গ আছে ভারেন্না গ্রামে। ভারেন্না গ্রামের দুর্গটি এখনও অক্ষত, সম্পূর্ণ, মধ্যযুগীয় অহংকারে অবস্থান করছে পাহাড়চূড়োতে। বেলাজিওর দুর্গ ভেঙে গেছে। চুড়োতে ছোট্ট সবুজ লন, সেখানে নিয়মিত ঘাস কাটা হয়। কেমন করে লন মোওয়ার নিয়ে যাওয়া হয় সেই পাহাড়চুড়োয়, সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে। সেখানে আমি কষ্ট করে পাকদণ্ডীর মতো পথ দিয়ে উঠি, পাওলোরা সেই পথে অত ভারি যন্ত্র ঘাড়ে করে ওঠে। একবার শিখরে উঠে এলে কিন্তু আশ্চর্য দৃশ্য। সিন্ধুসারসের বাসা পাহাড়ের গায়ে গায়ে, গাছের ডালে। ডিম দেওয়ার সময় এটা। পাখিরা বাসার কাছাকাছি উড়ছে। আর লেক কোমো তো দুভাগে ভাগ হয়ে যায় ঠিক এই বেলাজিও থেকেই। একটা দিক যায় কোমো শহরের দিকে অন্যটা লেক্কো শহরের দিকে, অনেকটা নীল একটা পাজামার মতো দেখতে লেকটার মানচিত্র। এখান থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়। দুদিকই দেখতে পাওয়া যায় সেজন্য এখানে দুর্গ তৈরি করা খুবই স্বাভাবিক ছিল। ভারেন্নার দুর্গের সঙ্গে বেলাজিওর দুর্গের সংকেত বিনিময় হত এককালে। ভারেন্নায় এখনও দুর্গটি রয়ে গিয়েছে এবং ভারেন্না নিজেও এখনও রয়ে গেছে শান্ত, মধ্যযুগীয় গ্রাম হিসেবে। ভিলার মধ্যে, পাহাড়ি পথের মধ্যে কত গুহা, ছোট ছোট ঝরনা (আবার নকল গুহাও আছে, নকল ঝরনাও!) যাকে ‘গ্রোটো’বলে, ইতালীয়দের অতি প্রিয় সেই গুহা বাগানের শোভা বাড়াচ্ছে ইতি-উতি। আছে টানেল, পঞ্চমুখী সুড়ঙ্গ। কী নেই? মাঝে মাঝে কুঞ্জবন, ফোয়ারা, পাথরের বেঞ্চি। কমলার গাছে কমলালেবু ফলে আছে, গাছে যেন আলো জ্বলছে দিনেরবেলায়। ছোট ছোট পাথরের চৌবাচ্চা, যেন জলকুণ্ড পাহাড়ের গায়ে। তাতে লাল মাছেরা আনন্দে সাঁতার কাটছে বলেই বুঝতে পারি জলকুণ্ড নয়, চৌবাচ্চা। ছোট ছোট নিরীহ বন্যপ্রাণীও ঢের আছে। যা নিরীহ নয়, তা একমাত্র আমরাই। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়ি, শরীর ভালো লাগলে নেমে যাই, সোজা ফেরিঘাটে। একটা টিকিট কেটে উঠে বসি—খোলা ডেকের বেঞ্চিতে। ওঠার আগে হ্রদের পাড়ে যে-কোনও একটা গ্রামের নাম বলি, সেই নামটা পাঞ্চ করে দেয়, নইলে সর্বত্রই একই দাম টিকিটের। আট হাজার দুশো লিরা। যদি না বড় নৌকোয় চড়ো—যা উড়িয়ে নিয়ে যাবে, ময়ূরপঙ্খী নাও। তার ভাড়া তিনগুণ।

এই অঞ্চলটা মধ্যযুগের এবং রেনেসাঁসের ইতালির সমস্ত রং-রস ইতিহাস নিয়ে জেগে বসে আছে। এই সব প্রাসাদ সেই সময়কার সাক্ষী, সেইসব পারিবারিক শত্রুতার আর কলঙ্কের, অবৈধ, উন্মত্ত প্রণয়ের। আর ধনৈশ্বর্যের প্রতিযোগিতার, যথেচ্ছ লুঠতরাজ আর হিংস্র অত্যাচারের, দম্ভের আর দারিদ্রের। ইসোলা কোমাচিনা যখন আক্রান্ত হয়েছিল সেই ভীত, দরিদ্র, উদ্বাস্তু মানুষগুলি এসে গড়েছিল ছোট ভারেন্না গ্রাম, জলের ধারেই ঘর বেঁধেছিল আবার। দ্বাদশ শতকে তৈরি এই গ্রামটির বাড়িগুলির তাই একই চেহারা। গলির ভেতরদিকে তিনটে করে জানলা, লেকের দিকে দুটো। গায়ে গায়ে লাগা দোতলাবাড়ির সারি। শুনতে যেমন বোরিং, দেখতে কিন্তু তেমন নয়। আজকের আকাশচুম্বী যত মৌচাকে বাসা বাঁধা শহুরে মানুষের চোখে ভারেন্নার এই ছোট ছোট বাড়ি, তথাকথিত দারিদ্রের সাক্ষী নয়, শান্তির ছবি।

একদিন চলেই গেলাম ভারেন্নায়। বেলাজিওর মতো দোকানদারের হই-হট্টগোল নেই। জল থেকে গ্রামে সরু সরু ‘সালিতো’ খাড়া সিঁড়ি-গলি উঠে গেছে। বাড়িগুলো পরস্পরের গায়ে গা এলিয়েই শুধু নেই, ঘন লতায়-পাতায় ফুলে—সুবাসে পরস্পরকে জড়িয়ে আছে বাড়িতে-বাড়িতে মাঝে মাঝে ছোট সেতু, সিঁড়িপথের মাথার ওপরে। তোরণের মতো দেখায়। সেগুলো কখনওবা খুব ছোট সরু প্রায় গোপন সুড়ঙ্গের মতো সমান্তরাল গলিপথ। আর কী সব বেড়াল এখানে! কুকুর দেখি না কোথাও। শুধু আহ্লাদী, লোমফোলানো বেড়াল রাজকীয় চালে পাঁচিলে হাঁটছে।

ফেরি-নৌকো নিয়ে হঠাৎ ভারেন্নায় চলে এসেছি, ফেরার তাড়া আছে আজ-অথচ এত সুন্দর গ্রামে কি আমি আগে কোনওদিন গেছি? মনে তো পড়ে না। বেগুনি, ফুল্ল-কুসুমিত সুগন্ধী উইস্টেরিয়ায় ঢেকে আছে বাড়িঘর, পথ, রেলিং। হ্রদের ধারে ধারে চলেছে একটি রট আয়রনের কারুকার্যকরা রেলিং ঘেরা, পুরনো পায়ে হাঁটার পথ। সন্ধেবেলায় বেড়ানোর রাস্তা—প্রমেনাদ। এ রাস্তা ভেঙে যায় মাঝে মাঝেই। সৈকতে, সিঁড়িতে, নৌকোবাঁধা ছোট ছোট ঘাটে। ঘাটলা বলাই ভালো। জলের ধারে ছোট ছোট কাফে। নুড়িবিছানো একটুখানি ছোট বেলাভূমিতে রঙিন রঙিন নৌকো উল্টোনো। তাদের নামই কত রকমের। কিছু ইতালীয়, কিছু ফরাসি, কিছু বা মার্কিন। রেসের ঘোড়াদের যেমন নাম থাকে, এই নৌকোদের নামের চরিত্রও অনেকটা তেমনই চম্‌কিলী। আমি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ি। নামগুলোর ম্যাজিকে আটকে থাকি খানিকক্ষণ। কখনওবা উইস্টেরিয়ার গন্ধে মাতাল হয়ে প্রাণ ভরিয়ে শ্বাস টানি, সৌরভ আমার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে, নেশা ধরায়। এক জায়গায় একটা তীব্র, অতি পরিচিত গন্ধ পেয়ে খুঁজে দেখি, গলির মধ্যে ছোট একটুকরো বাগানে ফুইলতা। যুঁইফুলের মতো দেখতে নয়, মালতীর মতো দেখতে, কিন্তু সুবাসটি যুঁইয়ের। কী নাম? কী নাম? ‘জামিন’। বলেন টুলে বসে নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে খবরের কাগজ-পড়ুয়া বৃদ্ধ।

ভারেন্না গ্রামের মাঝখানে সবচেয়ে পুরনো অঞ্চলে গ্রামের চক, তার দুদিকে দুটো প্রাচীন গির্জা। একটা গোল, পুরোপুরিই রোমানেস্ক, দ্বাদশ শতাব্দীর। অন্যটিতে এতবার হাত পড়েছে যে, তার নিজস্ব আর কোনও চরিত্র নেই। খানিক রোমানেস্ক, খানিক গথিক, দেওয়ালে (বাইরের) যিশুর ফ্রেস্কোতে কাচের ঢাকা দেওয়া হয়েছে, ভেতরের ফ্রেস্কোতেও নানা যুগের রং। মার্বেল, ইট, কাঠ, নানান উপকরণের মেলা। সদ্য এখানে একটা বিয়ে হয়েছে মনে হয়—তাজা ফুলে ফুলে সাজানো এখনও বেদিগুলো। গ্রামের পথের ধারে ধারে জলসত্রের ব্যবস্থা। পাথরের বেসিন আর নল থেকে জল পড়ছে। বেসিনের গায়ে দাতার নাম আর বছরটি খোদাই করা। বেশি পুরনো নয়। এই আঠারো শতক-উনিশ শতক।

আমি হাঁটতে হাঁটতে থামি। অঞ্জলি পাতি, জলপান করি। পাহাড়ের জল। ঠান্ডা। তেষ্টা মেটে। একজনকে জিজ্ঞেস করি, রোমানেস্ক গির্জাতে চাবি দেওয়া কেন? এটা একটা কাঠের কারখানা, যাঁকে জিজ্ঞেস করি তিনি কলের করাত চালাচ্ছেন। বললেন, ‘ওই বড় গির্জার বেল বাজাও, চাবি খুলে দেবে।’ না। ভাঙা ইংরিজিতে নয়, অঙ্গভঙ্গির ভাষাতে। আমিও সেইভাবেই প্রশ্ন করেছি। বেল বাজাই। কেউ দরজাটাই খোলে না। হঠাৎ দেখি একজন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির নামলেখা গাড়িতে উঠছেন—দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ধরি। তিনি ইংরিজি জানেন কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু গাড়িতে না উঠে, কোথাও চলে গেলেন, আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। একটু বাদেই চাবি নিয়ে ফিরে এলেন। এবং গির্জা খুলে দিলেন। আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম—ভেতরে গির্জার ইতিহাস ৪টে ভাষায় লেখা আছে ছোট করে। প্রচুর ফ্রেস্কো আছে অক্ষত অবস্থায়। রাজবেশী যিশুর ছবিটিই প্রধান। ১২ শতকে তৈরি, ১৪ শতকে একবার সারানো হয়েছিল, ১৭ শতকে আরেকবার। এই ইতিহাসও তখনকার তারিখেই লেখা। ভালো করে দেখা হল না গ্রামটা, ছুটে পালাতে হল। ফেরি-নৌকোর সময় হয়ে যাচ্ছে, দে দৌড় ঘাটের দিকে। এখনও মস্ত মস্ত না দেখা বাগানে অজস্র সৌরভ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, আর অনেক মূর্তি। এখানে কি কেবল উদ্ভিদেরই উদ্যান? মর্মর মূর্তিরও উদ্যান আছে না? আবার ফিরে আসতেই হবে এই জলের ধারের গ্রামে, এই সুন্দরী ভারেন্নায়। ফেরি-নৌকো চলল বেলাজিওর দিকে, মনটা ছুঁয়েই রইল ভারেন্নায় মাটি। যতক্ষণ চোখ যায়। নৌকো বাঁক নিল। তৃপ্তি হল না। আসব, আবার ফিরে আসব, ভারেন্না, তোমার জলের ধারের ঘর দেখতে

প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ অক্টোবর ১৯৯৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *