বাড়িয়ে দাও তোমার হাত…

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত 

দিন শেষে লড়াইটা আপনার নিজের। আমরা হয়তো আপনার হাতে তুলে দেবো ঢাল-তলোয়ার, আপনার বন্ধু হয়তো আপনায় পরিয়ে দেবে বর্ম আর শিরস্ত্রাণ, কিন্তু আসক্তির বিরুদ্ধের ডুয়েলটী লড়তে হবে আপনাকেই। 

একা একা।

মুসার মতো হতে পারেন না আপনি?

সামনে অথৈ জলরাশি। পালাবার পথ নেই। পেছনে প্রবল বিক্রমে, ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ধেয়ে আসছে ফিরাউনের সেনাবাহিনী। মুসা অরি আঁর কওমকে কচুকাটা করার জন্য। মুসার চোখ বলছে ধ্বংস অনিবার্য। মুসার (ধgal) কান বলছে ধ্বংস অনিবার্য। যুক্তি বলছে ধ্বংস অনিবার্য। মুসার কওম বার বার মুসাকে প্রশ্ন করছে “কোথায় তোমার আল্লাহ্? কোথায়?” মুসা অবিশ্বাস করলেন তাঁর চোখকে, তাঁর কানকে, একেবারেই পাত্তা দিলেন 

তাঁর কওমের লোকদের কথায়। সকল ইন্দ্রিয়ের সতর্কবার্তার বিপরীতে তিনি আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করলেন। বিশ্বাস রাখলেন। চরম তাওয়াক্কুলের পরিচয় দিয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই আমাদের রব আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের উদ্ধার করবেন-ই।” আল্লাহর  ওপর ভরসা করার এই প্রতিদান আল্লাহ্  দিয়েছিলেন মুসা (cel) এবং তাঁর কওমকে ফিরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করে আর ফিরাউনের সলিলসমাধির মাধ্যমে। আল্লাহর তরফ থেকে সাহায্য এসেছিল অকল্পনীয় এক উৎস থেকে।

ভাই, ভরসা করুন আল্লাহ্ ওপর, ভয় করুন তাঁকে। তিনিই তাঁর বান্দাদের জন্য সাহায্যকারী হিসাবে যথেষ্ট। তিনি আপনার জন্য অবশ্যই অবশ্যই ব্যবস্থা করে দেবেন, যেকোনো বিপদ, যেকোনো প্রতিকূলতা, যেকোনো আসক্তি কাটিয়ে ওঠার। মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো তাওয়াক্কুল। আল্লাহ্ বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলার ওপরেই ভরসা রেখ যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও” 

(সূরা মায়িদা; ৫:২৩) “আর আল্লাহরই ওপর মুমিনদের ভরসা করা উচিত।” 

{সুরা তাওবাহ; ৯:৫১)

যুগে যুগে এই তাওয়াক্কুলের জোরে মুমিনরা এমন কিছু অর্জন করেছে যা স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব, যুক্তি-তর্কের অগম্য, বিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে যা কোনোমতেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ চলছে তৎকালীন সুপারপাওয়ার পারশিয়ান সাম্রাজ্যের। অবিশ্বাস্যভাবে টানা বেশ কিছু যুদ্ধে সুপারপাওয়ার হার মেনেছে। আবারও পরাজয়ের আশঙ্কায় নারশীর থেকে মাদাইনে ছুটছে পীরশিয়ানরা। পিছু ধাওয়া করছেন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস ($)। মুসলিম বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে পারশিয়ান বাহিনী পিছু হটতে হটতে পীর হয়ে গেল টাইগ্রিস নদী। মুসলিম বাহিনী যখন নদীর তীরে উপস্থিত ততক্ষণে নিকৃষ্ট অগ্নি-উপাসক পারশিয়ান বাহিনী সব নৌকা নিয়ে নদীর অপর তীরে চলে গিয়েছে। মুসলিমদের কোনো উপায়ই রইল না নদীর অপর পাশে যাবার। সব রকমের চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো নৌকার ব্যবস্থা করা গেল না। শেষমেষ আল্লাহ্র (৪) ওপর ভরসা করে তাঁরা ঘোড়ার পিঠে চড়েই নদীতে নেমে গেলেন। মুসলিম বাহিনীর অনেকেই নদী দেখা তো দুরের কথা এর আগে কখনো কোনো পুকুরই দেখেননি। তাঁদের কাছে বিশাল টাইগ্রিস নদী ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের মতো। চিন্তা করুন একবার, সেই মুহূর্তে তাঁদের সাইকোলজিটা বোঝার চেষ্টা করুন। আপনাকে যদি বলা হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে মহাসমুদ্র পাড়ি দিতে হবে, আপনি কি কখনো রাজি হবেন? আর কোনো উপায় না পেয়ে তাঁরা শুধু আল্লাহ্  ওপর ভরসা করে ঘোড়াসহ নদীতে নেমে গেলেন। তাওয়াক্কুলের প্রতিদান আল্লাহ্  দিলেন বিজ্ঞানের সকল সূত্রকে ভুল প্রমাণ করে। ঘোড়ার পিঠে বসেই সাদের বাহিনী নদী পার হলো। পারশিয়ান বাহিনী যখন দেখল মুসলিমরা এভাবে ঘোড়ার পিঠে চড়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা ভাবল এরা মানুষ না, জিন। ভয়ে তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল। মুসলিম বাহিনী পেল বিজয়ের স্বাদ। 

ইমাম ইবন কাসির , আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭:১২২ (ইফা) 

তাওয়াক্কুলের দুইটি পূর্বশর্ত রয়েছে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অচল।

১. সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ ওপর আস্থা রাখা, বিশ্বাস রাখা।

২. আপনার হাতের কাছে যেসব মাধ্যম বা উপায় আছে সেগুলো ব্যবহার করে নিজে সর্বোচ্চ ও সর্বাত্মক চেষ্টা করা। 

মনে করুন, আপনি মসজিদে ফজর পড়ার নিয়্যত করলেন। আল্লাহ্ ওপর পরিপুর্ণ আস্থা রাখলেন যে, আল্লাহ অবশ্যই ফজরের নামাজ মসজিদে আদায় করার ব্যবস্থা করে দেবেন। এই গেল তাওয়াক্কুলের প্রথম শর্ত। এখন দ্বিতীয় শর্ত হলো আপনার নিজেকে চেষ্টা করতে হবে যেন আপনি ফজরের নামাজ মসজিদে আদায় করতে পারেন, তাড়াতাড়ি ঘুমুতে হবে, দরকার পড়লে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হবে অথবা কাউকে জাগিয়ে দেয়ার কথা বলতে হবে। এই হলো দ্বিতীয় শর্ত। তাওয়াক্কুলের ফল পেতে হলে আপনাকে এই দুটো শর্তই পূরণ করতে হবে। আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন কিন্তু ঘুমুতে গেলেন। মধ্যরাতের পর, অ্যালার্মও দিলেন না, কাউকে জাগাতেও বললেন না, ফজরের ওয়াক্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে থাকলেন… এর নাম তাওয়াক্কুল নী। আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে কোলে করে আপনাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন না। আপনার কাজ আপনি করে যাবেন যতটুকু সম্ভব, তারপর বাকিটুকু আল্লাহ্ দেখবেন। তাওয়াক্কুল এটাই। নিজের সাধ্যমতো সবটুকু করা, তারপর সাফল্যের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করী। মুসাকে আল্লাহ্ কেন বলেছিলেন যে তুমি তোমার হাতের লাঠি দিয়ে সমুদ্রে আঘাত করো? আল্লাহ্ কেন তারপর সমুদ্রের ভেতর রাস্তা তৈরি করে দিলেন? মুসার সামান্য লাঠির আঘাত বিশাল সমুদ্রের কী এমন করতে পারে? মুসাকে (88) সমুদ্রের পানিতে আঘাত করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্ মানবজাতিকে এটাই শিক্ষা দিতে চাইলেন যে, প্রথমে তোমার অংশটুকু তুমি করো, বাকিটা আমি দেখছি। আগে আপনাকে সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করতে হবে। আর সাফল্য দেয়ার মালিক আল্লাহ্ । যে আল্লাহ্ মুসার জন্য সমুদ্রের বুকে রাস্তা তৈরি করেছিলেন, যে আল্লাহ্ , ইবরাহীমের জন্য আগুনকে প্রশান্তিদায়ক করেছিলেন, মুহাম্মদের জন্য চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন, সে একই আল্লাহ্ তো আমাদেরও আল্লাহ! সেই আল্লাহ্ কি পারেন না আমাদের এই ভয়ঙ্কর আসক্তিগুলো থেকে মুক্তি দিতে? অবশ্যই পারেন। কিন্তু আমরা তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করি না দেখেই অথবা আন্তরিকভাবে মুক্ত হতে চাই না দেখেই ফলাফল পাই না। 

আল্লাহর কসম! আল্লাহর কসম! শুধু আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে পর্নহস্তমৈথুন/চটিগল্পের আসক্তিসহ যেকোনো আসক্তি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আপনি আল্লাহ্  ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখুন যে, তিনি আপনাকে এই অন্ধকার পৃথিবী থেকে রঙ, রূপ, রস, গন্ধ আর আলোতে ভরা পৃথিবীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দেবেন। তারপর আপনার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, সত্যিকারভাবে, আন্তরিকতার সাথে ততটুকু করুন। ইন শা আল্লাহ্ দেখবেন যেকোনো ধরনের আসক্তি পালিয়ে যাবার দরজা পাবে না। কিন্তু শুধু আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে বসে থাকলেন, নিজে কোনো চেষ্টাই করলেন না, মেয়েদের দেখে চোখ নামিয়ে ফেললেন না, আইটেম সং দেখা বাদ দিলেন না, বন্ধুদের সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে রসালো আলাপ করা বন্ধ করলেন না– তাহলে কখনোই আপনি আসক্তি থেকে মুক্তি পাবেন না, কখনোই না। আপনাকে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহ আছেন, আপনার অপেক্ষায় আছেন কখন আপনি ফিরে আসবেন তাঁর কাছে। হাত বাড়িয়ে দিন, তিনি আপনাকে নোংরা এই জগৎ থেকে টেনে তুলে জান্নাতে স্থান দেবেন। আপনার প্রতিপালকের ওপর, আপনার মালিকের ওপর ভরসা করুন। এই সময় শীঘ্রই কেটে যাবে ইন শা আল্লাহ…