পর্দার ওপাশে

পর্দার ওপাশে

কিছুক্ষণ হলো ভেতরের পশুটী গেঙ্গিীতে শুরু করেছে। কোনোমতেই দমীতে পারছেন না। এক সময় সবকিছু ফেলে ছুটে গেলেন পিসির কাছে। নেট কানেক্ট করে লগ ইন করলেন আপনার পছন্দের এক্স-রেইটেড ওয়েবসাইটে। পাগলের মতো একের পর এক পেইজ ব্রাউয করে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটা পেইজের পর্ন অভিনেত্রীদের ছবি, ভিডিও আপনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, ক্রমাগত ঢোঁক গিলছেন। ফ্যান্টাসির জগতে রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছেন প্রতিটি দেহ। এমন সময় কোনো এক পর্ন অভিনেত্রীর ছবি আপনাকে উত্তেজনার চরমে পৌঁছে দিলো। পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো কামের আগুনে। তার শরীরের স্বাদ আপনার চাই-ই চাই। শরীরের খাঁজগুলো থেকে বহু কষ্টে চোখ সরিয়ে আপনি তাকালেন তীর মুখের দিকে এবং আবিষ্কার করে বসলেন–এ আপনার বোন! চিন্তা করুন সেই মুহূর্তে আপনার কেমন লাগবে! ভাই আমার, নীল পর্দার ওপাশের নারীরাও কারও না-কারও বোন, কারও না কারও মেয়ে। তাদেরও একটা পরিবার ছিল বাবা-মার আদর, মায়া-মমতা ছিল ছোটভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি ছিল, প্রিয় মানুষটার জন্য তাদের বুকেও ছিল এক সমুদ্র ভালোবাসা। ছিল ঝগড়া, আড়ি দেয়া, মান-অভিমান। কিন্তু হঠাৎই এক দমকা বাতাসে বদলে গেছে তাদের জীবন। পরিণত হতে হয়েছে অন্যের লালসা পূরণের বস্তুতো কখনো কি জানতে চেয়েছেন পর্দার ওপাশের গল্পগুলো? এক একটা ছবি, এক একটা ভিডিওতে আটকা পড়ে আছে আপনারই কোনো এক বোনের, কোনো এক ভাইয়ের হৃদয়ের হাহাকার। সেলুলয়েডের পর্দার আড়ালে পর্ন ভিডিওর হতভাগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কংক্রিটের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী যতসব আর্তনাদ আর দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতাগুলোর সবটুকু আমরা হয়তো বুঝতে পারব না। কিন্তু তারপরেও এ অদেখা ভুবনের গল্প কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করতে দোষ কী! চলুন ঘুরে আসা যাক পর্ন ইন্ডাস্ট্রি নামের সেই নরক থেকে। 

সাবেক পর্ন অভিনেত্রীদের স্বীকারোক্তি 

…অন্যসব পর্ন অভিনেত্রীদের মতো আমিও সব সময় মিথ্যাটা বলি। আমাকে যখন মানুষজন প্রশ্ন করে, ওই ভিডিওর ওই হার্ডকোর সিনটা করার সময় আপনার কেমন লেগেছিল? আমি হাসি হাসি মুখ করে বলি, “ভালো না লাগলে কি আমি ওই সিনটা করতাম? আমার ভালো না লাগলে আমি কোনো কাজই করি না, পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের ক্ষেত্রে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।” এভাবেই দিনের পর দিন আমাকে মিথ্যা বলে যেতে হয়। আসল সত্যটা হচ্ছে আমি কখনোই চাই না এসব দৃশ্যে অভিনয় করতে। কিন্তু ওইসব দৃশ্যে অভিনয় না করলে আমি কখনোই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাব না।” “১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়েও আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুটিং করতে হয়েছে। আমি কাঁদছিলাম। খুব করে চাইছিলাম বাসায় চলে যেতে। কিন্তু আমার এজেন্ট চাচ্ছিল। 

শুটিং অসমাপ্ত রেখে আমি বাসায় চলে যাই। নিরুপায় হয়ে প্রচণ্ড শরীর খারাপ নিয়েই কাজ করতে হয়েছে।” “…(পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে) আমার শুরুটা হয়েছিল গণধর্ষণের ভিডিও দিয়ে। পাঁচ জনকে দিয়ে মি. ট্রেইনর আমাকে ধর্ষণ করিয়েছিলেন। এ ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তিনি হুমকি দিয়েছিলেন এসব কাজ না করলে আমাকে গুলি করবেন। এর আগে আমার কখনো অ্যানাল সেক্সের অভিজ্ঞতা ছিল না। এ কাজটা আমাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল। ওরা আমার সাথে এমন আচরণ করেছিল, যেন আমি বাতাস ভরা একটা প্লাস্টিকের পুতুল; আমাকে শূন্যে তুলে যাচ্ছেতাইভাবে ছুঁড়ে ফেলছিল। আমার শরীরের সব অঙ্গ নিয়ে রীতিমতো মিউযিকাল চেয়ার খেলেছিল। আমি জীবনে কখনো এ রকম ভয় পাইনি, এত লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইনি।” “…বিভিন্ন রকম শারীরিক, যৌন ও জীবাণুঘটিত অসুস্থতার জন্য আমাকে ১০ বারেরও বেশি ইমার্জেন্সি চিকিৎসা নিতে হয়েছিল, তারপরও আমি পর্নোগ্রাফি ছাড়িনি, কারণ পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে এগুলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমি ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়াসহ অন্যান্য যৌনবাহিত রোগে (STD–Sexually Transmitted Disease) আক্রান্ত অনেক মেয়েদের দেখেছি। এসব দুরারোগ্য ও ছোঁয়াচে রোগকে তারা খুব স্বাভাবিক মনে করে।” “…আমি এমনো দৃশ্যে কাজ করেছি যেখানে আমাকে মৃত মানুষের অভিনয় করে অন্যকে আমাকে ধর্ষণ করতে দিতে হয়েছে। শরীরে থেঁতলানো ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। 

বেশি উগ্র দৃশ্যে কাজ করলে রক্তপাতও হতো। শুটিংয়ের সময় ওরা আমাকে চড় মারত, গায়ে থুতু ছিটাত আর নোংরা গালি দিত। আমি বমি করে ফেলতাম আর সেই অবস্থায়ই শুটিং চালিয়ে যেতে হতো… নাকে বমি ঢুকে যেত, নিশ্বাস নিতে পারতাম না!” “…সত্যি কথা বলতে আমি আমার জীবনকে ঘৃণা করি। নিজেকেও প্রচুর ঘৃণী করি। আমি বেঁচে থাকতে চাই না। বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি। “

নির্যাতন

 ইদানিং পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে জনপ্রিয় হলো চড়-থাপ্পড়, অমানবিক নির্যাতন, থুতু ছিটানোসহ রাফ আর পেইনফুল সেক্সের দৃশ্য। এমনকি পুরুষ অভিনেতারা সেক্সের পর টয়লেটের কমোডের ভেতরে অভিনেত্রীর মুখ চেপে ধরে ফ্ল্যাশ টেনে দেয়। এই ইন্ডাস্ট্রিতে এটাই ক্লাইম্যাক্স! সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ৮৮% পর্ন ভিডিও ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ভরপুর।

উচ্চ মৃত্যুহার 

অবস্থিত পর্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রায় ১৫০০ যৌনকর্মীর ২২৮ জন মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের মৃত্যুর কারণ? এইডস, আত্মহত্যা, আর মাদক সেবন। অনেককে হত্যাও করা হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো ইন্ডাস্ট্রির–এমনকি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, যা কিনা পর্ন ইন্ডাস্ট্রির চেয়েও ১০ গুণ বড় এবং যেখানে মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সেখানকার অবস্থা এত ভয়াবহ না। যেখানে একজন সাধারণ অ্যামেরিকানের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭৮.৬ বছর, সেখানে একজন পর্ন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল মাত্র ৩৬.২ বছর। 

যৌনরোগ

লস অ্যাঞ্জেলেসের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০-২৪ বছর বয়সী সাধারণ মানুষদের তুলনায় পর্ন অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের প্রাণঘাতি ক্ল্যামিডিয়ী ও গনেরিয়া সংক্রমণ আশঙ্কা ১০ গুণ বেশি। পর্নস্টারদের মধ্যে এ রোগগুলোর সংক্রমণের আশঙ্কা কল্পনাতীতভাবে বেশি। একজন মহিলা চিকিৎসক, যিনি একইসাথে একজন সাবেক পর্ন অভিনেত্রী ও AIM (Adaalt Indiastry Medical Healthcare Foundation) এর প্রতিষ্ঠাতাও, পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যৌনরোগের প্রাদুর্ভাবের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “৬৬% যৌন অভিনেতা হারপিস এ ভোগেন, ১২-২৮% আক্রান্ত STD তে, আর ৭% আক্রান্ত HIV তো” যৌনরোগ আছে কি না সেটা পরীক্ষা পর্নশিল্প আইনের আওতাভুক্ত নয়। কর্মীদের নিজ খরচে পরীক্ষা করাতে হয়। 

মাদকাসক্তির উচ্চ হার

পর্ন ভিডিওতে বিকৃত যৌনাচারের দৃশ্যে অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওপর প্রচুর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ভেতরটা ফাঁপা, ঠনঠনে বানিয়ে দেয়। প্রবল অবসাদ আর বিষণ্ণতা জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। জীবনের গ্লানি ভুলতে তারা আঁকড়ে ধরে মদের বোতল। গাঁজা, হেরোইন, কোকেইন, ক্রিস্টালমেথ–কিছুই বাদ পড়ে । তা ছাড়া মাদকের নেশীয় ডুবে থাকা ছাড়া পর্ন ভিডিওর কিছু বিশেষ দৃশ্যে “আমরা সবচেয়ে বেশি যেসব মাদক ব্যবহার করি সেগুলো হলো এক্সটেসি, কোকেইন, মারিজুয়ানা (গাঁজা), য্যানাক্স, ভ্যালিয়াম, ভাইকাডিন আর অ্যালকোহল।”

২০১২ সালে ১৭৭ জন পর্ন অভিনেত্রীদের ওপরে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ৭৯% পর্ন অভিনেত্রী জীবনে একবার হলেও গাঁজা খেয়েছেন, hallucinogens ব্যবহার করেছেন ৩৯%, এক্সটেসি ব্যবহার করেছেন ৫০%, ৪৪% অভিনেত্রী কমপক্ষে একবার কোকেইন ব্যবহার করেছেন, ক্রিস্টালমেথ বা মেথঅ্যাফেটামিন। ব্যবহার করেছেন ২৭% অভিনেত্রী, বিভিন্ন ধরনের ট্রাংকুলাইযার ব্যবহার করেছেন ২৬% আর হেরোইন ব্যবহার করেছেন ১০% অভিনেত্রী।

জানুয়ারি ২০০৮-এ এক পুরুষ পর্ন অভিনেতা তার ব্লগে লেখেন, “মাদক আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে খুব বড় একটা সমস্যা। কেউ যদি আপনাকে অন্য কিছু বলে, তবে সে মিথ্যা বলছে। শুধু এই মাদকের জন্য অসংখ্য মেয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা-উদ্যম সব হারিয়ে ফেলেছে। এ বাস্তবতা চিন্তা করাটাই খুবই কষ্টের আর তাদের এ অধঃপতন খুবই বেদনাদায়ক, অন্তত আমার কাছে। এটা মানতেই হবে যে, বেশির ভাগ মাদকাসক্ত প্রফেশনাল সাহায্য ছাড়া তাদের অভিশপ্ত জীবন থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। আমি শুটিং সেট থেকে শুরু করে পাটি, এমনকি গাড়িতেও ড্রাগের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখেছি। পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আনুমানিক ৯০% জনবল (পারফরমার, ড্রাইভার, এজেন্ট, মালিক ইত্যাদি) গাঁজায় আসক্ত। কিছুদিন আগে সেটে আমার সাথে যে মেয়েটি “অভিনয়” করছিল সে আচমকা অজ্ঞান হয়ে যায়। সে অক্সিকন্টিনে আসক্ত ছিল। আরেকটি মেয়ে GHB ওভারডোজ হয়ে সেটেই লুটিয়ে পড়ে (GHB-পাটি ড্রাগ যেটা অভিনয়ের জন্য “সম্মানসূচক পুরস্কার” (Prestigious Award) পেয়েছে কিন্তু সে এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, পুরস্কার আনতে যেতেও পারেনি। প্রশ্ন হলো এখানে মাদক এত সহজলভ্য কেন? প্রথমত, এখানে কাজ করে মূলত ১৮-২১ বছরের মেয়েরা, যাদের অনেকেই অশিক্ষিত নয়তো অল্প শিক্ষিত। অনেকেই আসে যারা বলতে গেলে এর আগে কপর্দকশূন্য ছিল অথবা পিৎযার দোকানে সস্তায় কাজ করত। এখানে এসে তারা মাসে ১০ হাজার ডলার আয় করে। মাসে ১০-১২ দিন ৫ ঘণ্টা করে কাজ করলেই হয়। মাদকের দালালরা হাওরের মতো তাদের শিকার করে। এ মেয়েদের হাতে থাকে প্রচুর অবসর সময় আর কাঁচা টাকা। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা বাজিমাত করে নিতে ভুল করে না। “আমরা অনেকেই ভাবি পর্ন অভিনেতাদের কাজ বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে মজার কাজ। তারা মজা পাচ্ছে আবার টাকাও পাচ্ছে! ধারণাটা ভুল। পর্ন অভিনেতাদের অভিনয় করার জন্য প্রচুর পরিমাণ যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ সেবন করতে হয়। পরিণতিতে ভুগতে হয় বিভিন্ন রকমের জটিল অসুখে। সাথে অবসাদ, হতাশী, গ্লানি তো আছেই। মারাত্মক রকমের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পর্ন ভিডিওতে অভিনয় করে যে টাকা উপার্জন করে, তার বেশির ভাগই চলে যায় মাদকের পেছনে। নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। কোনো নারীকেই তারা ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসা কী, এটাই ভুলে যায়। নারী ছাড়া কীভাবে একজন পুরুষ সম্পূর্ণ হতে পারে? সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত নারীর কাছে পুরুষেরা ঋণী। নারীর জলে স্নান করেই তো পুরুষ হয়েছে বিশুদ্ধ, সভ্য, পবিত্র। জীবনের বন্ধুর পথে নারী বন্ধু হয়ে হাত ধরে রেখেছিল বলেই না পুরুষ পেয়েছে জীবনের বন্ধুর পথে চলার সাহস। পর্ন অভিনেতারা কোনো নারীর সঙ্গেই ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতে পারে না, জীবনের কী করুণ পরিণতি! পুরুষত্বের কী নিদারুণ অপমান।

মানবপাচার 

ভয়ঙ্কর এ ইন্ডাস্ট্রিতে কেন কাজ করতে আসে মানুষ? এর পেছনে কয়েকটা ফ্যাক্টর কাজ করে। অল্পবয়স্ক, দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ কিশোরী-তরুণীদের চোখ ধাঁধিয়ে যায় পর্ন ইন্ডাস্ট্রির গ্ল্যামারে। খ্যাতি, টাকা, উদ্দাম যৌনজীবনের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তারা পা বাড়ায় এই অন্ধকার জগতে। প্রেমে প্রতারণী, ধর্ষণ, ছোটবেলায় যৌন-নিপীড়নের শিকার হওয়া, বাবা-মার ডিভোর্স এগুলোও কারণের অন্তর্ভুক্ত। টিউশন ফি, ড্রাগের টাকা জোগাড় করা কিংবা বেকারত্বের হতাশী থেকেও অনেকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে আসে। তবে পর্ন অভিনেত্রীদের বেশ বড়সড়ো একটা অংশ ইন্ডাস্ট্রিতে আসে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে। মাদক বাণিজ্যের পর মানবপাচার হলো বর্তমান আধুনিক সভ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সুসংগঠিত ইন্ডাস্ট্রি। মানবপাচারের ব্যবসায় প্রতিবছর লেনদেন হয় প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারের। 

অ্যামেরিকাতে নারী ও শিশু পাচার করা হয় শুধু সেক্স ইন্ডাস্ট্রিগুলোর চাহিদা মেটানোর জন্য। যৌন বাণিজ্যের চাহিদা মেটাতে মানবপাচারের যে ভয়াবহতা সেটা ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছু তথ্য জানা দরকার : National Center for Missing and Exploited Children এর প্রেসিডেন্ট আনি অ্যালেনের মতে শুধু অ্যামেরিকাতেই সেক্স ইন্ডাস্ট্রির (পতিতাবৃত্তি, পর্ন ইন্ডাস্ট্রি) জন্য প্রতি বছর এক লাখের মতো শিশু পাচার করা হয়। অ্যামেরিকার Department of Health and Human Services 47 a Human Trafficking Proga] এর সাবেক ডাইরেক্টর স্টিভ ওয়াগনারের মতে এ সংখ্যা প্রায় সোয়া এক লাখ। প্রতিবছর পুরো পৃথিবীতে ছয় থেকে আট লক্ষ নারী ও শিশু মানবপাচারের শিকার হয়। এদের বেশির ভাগেরই জায়গী হয় ইউরোপ-অ্যামেরিকার সেক্স ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে (পতিতালয়, পর্ন ইন্ডাস্ট্রি, স্ট্রিপ ক্লাব ইত্যাদি)।

পর্নোগ্রাফি যেভাবে আদম ব্যবসায়ীদের জন্য চাহিদা সৃষ্টি করছে

কোন কোন ফ্যাক্টর সেক্স ট্র্যাফিকিং-কে প্রভাবিত করে তার ওপর অ্যামেরিকান সংস্থা Shared Hope International একবার একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। প্রতিবেদনে দেখা গেল পর্ন ইন্ডাস্ট্রি হলো সেই ফ্যাক্টরগুলোর একটি যেগুলোর কারণে কিছু অমানুষ মানবপাচারে (যাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু) জড়িয়ে পড়ে। পাচারকৃত এসব মানুষগুলোর বেশির ভাগেরই শেষ ঠিকানা হয় ইউরোপ বা অ্যামেরিকার মত কোনো সভ্য মহান দেশের (?) পতিতালয়, স্ট্রিপ ক্লাব বা পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যৌনদাসী হিসেবে। আবার কোনো কোনো সময় শুধু পর্ন ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা মেটানোর জন্যই নারী ও শিশু পাচার করা হয়। কিন্তু কেন পর্ন ইন্ডাস্ট্রির সাথে মানবপাচার জড়িত? 

এ প্রশ্নের উত্তর পাবেন পর্নোগ্রাফি কীভাবে একজনের মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে, তার মাঝে। বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের মস্তিষ্কে “মিরর স্নায়ু” নামে একধরনের মস্তিষ্ক কোষ আছে। যখন আমরা নিজেরা কোনো কিছু করি অথবা অন্যরা যা করছে তা দেখি তখন এ স্নায়ুগুলো উদ্দীপ্ত হয়। এই কারণেই চলচ্চিত্রের দৃশ্য আমাদের কাঁদায় অথবা ভয় পাওয়ায়। এ কারণেই কিছু লোক টিভিতে ফুটবল 

চিন্তা করুন, খেলার মাঠে তারকা ফুটবলারের পায়ের জাদু দেখে আপনার কি মনে হয় না, ইশ! ওদের মতো আমিও যদি এ রকম খেলতে পারতাম! ফুটবলার বলুন, সিনেমা বা সিরিয়ালের নায়ক বলুন, না চাইলেও অবেচতনভাবেই আপনি কিন্তু তাদের অনুকরণ করেন–পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা, হাঁটাচলা, হেয়ারকাট… তাই না? একজন মানুষ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পর্ন ভিডিও দেখে, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যায়, তখন সেও চায় পর্দায় দেখা জিনিসগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে। আমরা আগেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আর যে প্রজন্মের যৌনশিক্ষীর, যৌনতা সম্পর্কে ধারণী পাবার একমাত্র অথবা প্রধান মাধ্যম পর্নোগ্রাফি, যে প্রজন্মের পর্নোগ্রাফিতে হাতেখড়ি হচ্ছে শৈশবেই, সেই প্রজন্মের কাছে যৌনতার অর্থ একটাই–পর্ন ভিডিওতে দেখা যৌনতা। কিন্তু এই পর্ন গল্প। 

এমনভাবে যৌনতাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব না। যদিও পর্নোগ্রাফি দেখতে দেখতে এখন অধিকাংশ মানুষ এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছে। আর সেই সাথে নারীদের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার তো আছেই। একজন পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি যখন পর্দায় দেখা জিনিসগুলো বাস্তবে করতে যায় তখন তাকে বেশ কয়েকটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। 

কিশোর-কিশোরীরা বাস্তব যৌনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিয়ে বা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মাধ্যমে দৈহিক চাহিদা মেটাতে না পারলে বাধ্য হয়ে তাদের যেতে হয় পতিতালয়ে। এভাবে পতিতার চাহিদা বাড়ে, বাড়ে মানবপাচার। দ্বিতীয়ত, পর্ন-আসক্তদের সঙ্গিনীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেডরুমে পর্ন অভিনেত্রীদের মতো নির্লজ্জ হতে পারে না। পর্ন ভিডিওতে দেখানো দৃশ্যগুলোর অনুকরণ করতে চায় না। কিন্তু একজন পর্ন-আসক্ত ব্যক্তির এমন অবস্থা হয় যে, পর্নে দেখা যৌন আচরণগুলো না করতে পারলে, সে কোনোভাবেই তৃপ্ত হতে পারে না। বাধ্য হয়ে একসময় তাঁকে যেতে হয় পতিতালয়ে। পতিতালয়গুলো তাদের খদ্দেরদের চাহিদা পুরণের জন্য হাত পাতে মানবপাচারকারীদের কাছে আর মানবপাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয় লক্ষ লক্ষ অসহায় নারী ও শিশু। যারা পর্ন ভিডিও দেখেন তাদের এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে। কিন্তু এমন হাজার হাজার পর্ন-আসক্ত পাওয়া যাবে যাদের পন-আসক্তির শেষ পরিণতি ছিল পতিতালয়ে গমন। নয়টি দেশের ৮৫৪ জন পতিতাঁকে নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ পতিতা জানিয়েছে, তাদের খদ্দেররা তাদের ঠিক সেটাই করতে বাধ্য করে যেটা তারা আগে পর্ন ভিডিওতে দেখেছে। Oral History Project এর জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৮৬ জন পতিতা বলছে তাদের খদ্দের তাদের পর্ন ভিডিও দেখিয়ে বলে তোমরা পর্দার এই অভিনেত্রীকে হুবহু অনুকরণ করো। মানবপাচারের ব্যাপারে ইউএস স্টেইট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অ্যাডভাইযীর লরা লেডারার তো সোজাসাপটা বলেই ফেলেছেন, পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে বাণিজ্যিক যৌন-নিপীড়নের (কমার্শিয়াল সেক্সের জন্য মানবপাচার) মার্কেটিং করা হয়। তৃতীয়ত, পর্ন-আসক্তরা তার সঙ্গিনীদের মধ্যে পর্ন অভিনেত্রীদের মতো দৈহিক সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ায়। মনে মনে পর্ন অভিনেত্রীদের দেহের সাথে নিজেদের সঙ্গিনীর দেহের তুলনা করে সব সময়। কিন্তু তাদের হতাশ হতে হয়। পর্ন অভিনেত্রীরা সার্জারিসহ অন্যান্য বিভিন্ন উপায়ে তাদের দেহে কৃত্রিম সৌন্দর্য নিয়ে আসে, যেটা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো মানুষের মাঝে সচরাচর পাওয়া যায় না। কাজেই পর্ন-আসক্তরা তাদের সঙ্গিনীর “পানসে শরীরের বদলে পর্ন। অভিনেত্রীদের মতো শরীরের অধিকারিণী পতিতাদের কাছে যায়। আর পতিতার জোগান দেয়ার জন্য চলে মানবপাচার। 

চতুর্থত, মানবপাচারের শিকার হওয়া হতভাগ্যদের জোর করে পর্ন ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে হার্ডকোর পর্নোগ্রাফিতে। মানবপাচারের শিকার শতকরা ৭০ জন ভিকটিম জানায় যে, তাদের পর্ন ভিডিওতে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। পর্নোগ্রাফিকে ঘিরে চলছে নব্য দাসপ্রথা। মানবপাচারের শিকার নারীদের বানানো হচ্ছে যৌনদাসী। অথচ “ইসলাম নারীকে যৌনদাসী বানায়” বলে তারস্বরে চিৎকার করা পশ্চিমা বিশ্ব আর তাদের আদর্শিক সন্তান বাদামি চামড়ার ফিরিঙ্গিরা এ আধুনিক দাসত্ব নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। সফটকোর পর্ন থেকে মানুষ ধীরে ধীরে হার্ডকোর পর্নের দিকে ঝুঁকছে। বাড়ছে। আরও বেশি এক্সট্রিম, নারীদের ওপর আরও বেশি অত্যাচার, আরও বেশি বিকৃত যৌনতার চাহিদা। সেই সাথে বাড়ছে লাইভ ওয়েবক্যাম সেক্স, লাইভ ধর্ষণ। “স্বাধীন” নারীদের তুলনায় মানবপাচারের শিকার যৌনদাসী বানানো নারীদের দ্বারা এই কাজগুলো করানো যেমন কম ঝামেলার, তেমনই কম খরচের। এককথায় বলতে গেলে সেক্স ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে মানবপাচারকারীদের টাকা কামানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বিষয়টা হলো পুরুষদের শিক্ষা দেয়া যে, নারীরা হলো কেবল ভোগের মাল। তাদের যেভাবে ইচ্ছে চেটেপুটে, খাবলে-ছিড়ে খাবার অধিকার তোমার আছে। আর পুরুষের মস্তিষ্কে এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য পর্নোগ্রাফির চেয়ে ভালো আর কোনো মাধ্যম কি আছে? 

একবার এক যুবক রাসূলের () কাছে এসে বলেছিল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমাকে যিনা করার অনুমতি দিন।” এ কথা শুনে উপস্থিত সবাই চমকে উঠলেও রাসূলুল্লাহ স্নেহ ভরে তাকে কাছে ডাকলেন। তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি তোমার মায়ের জন্য এটা পছন্দ করবে?” যুবকটি বললো, “না ইয়া রাসূলুল্লাহ। আল্লাহ আমাকে আপনার প্রতি উৎসর্গিত করুন। কোনো মানুষই তার মায়ের জন্য এটা পছন্দ করবে না।” 

রাসূলুল্লাহ (ছ) একে একে যুবকটিকে প্রশ্ন করলেন, তাহলে তোমার মেয়ের জন্য? তোমার বোনের জন্য? তোমার ফুফুর জন্য? তোমার খালার জন্য? যুবক প্রতিবারই বললো, কোন মানুষই এটা পছন্দ করবে না। তারপর রাসূলুল্লাহ তার শরীরে হাত রাখলেন এবং দু’আ করলেন- “ইয়া আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করুন, তার অন্তর পবিত্র করুন এবং তার চরিত্র রক্ষা করুন।” নবীর কাছ থেকে এ শিক্ষা পাবার পর, যুবকটি পরবর্তী জীবনে রাস্তায় চলার সময়ও কোন দিকে চোখ তুলে তাকাতো না। ভাই আমার, বিশ্বাস করুন, প্রতিটি পর্ন ভিডিওর ফ্যান্টাসির পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক নরনারীর অসহায় আর্তনাদ, বুকের একেবারে গভীর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস, না-জানা অনেক স্বপ্ন ভাঙার গল্প। আপনি ও আপনার মতো অসংখ্যরা পর্ন ভিডিও দেখেন বলেই, আপনি নেট থেকে পর্ন ডাউনলোড করে চাহিদা সৃষ্টি করেন বলেই এসব অসহায় নারীদের, শিশুদের পড়তে হয় মানবপাচারকারীদের কবলে, বেছে নিতে হয় ভয়াবহ জীবন। পর্ন ওয়েবসাইটে করা আপনার প্রতিটি মাউস ক্লিকের কারণে হয়তো একজনের পৃথিবীটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আপনার কোনো নিকটাত্মীয়া, আপনার বোনও যেকোনো দিন এ রকম ভয়াবহতার শিকার হবে না, তা কি আপনি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেন?  কী দরকার ক্ষণিকের আনন্দ, সাময়িক উত্তেজনার জন্য এ পৃথিবীর মুক্ত নির্মল বাতাসটীকে বিষাক্ত অশ্লীল করে ফেলার?