পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি

পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি 

কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছি…

এই তো কয়েকদিন আগেই হাফপ্যান্ট পড়া দশ বছরের কোঁকড়া চুলের এক বালক তার স্কুলমাঠের কড়ই গাছের নিচে বসে নদীর দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকত। পায়ের কাছে আছড়ে পড়ত দলবেঁধে অনেক দূর পাড়ি দেয়া ঢেউ। মাঝে মাঝে সে ঢেউ গোনার ব্যর্থ চেষ্টা করত। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলত একটু পরেই। আবার উদীস হয়ে তাকাত নদীর দিকে। কখনো-বা আকাশের দিকে। দুপুরের বৃষ্টিভেজা রোদে মাঝে মাঝে একটা সোনালি ডানার চিল উড়ে বেড়াত। করুণ সুরে ডেকে উঠত হঠাৎ হঠাৎ। বালক আরও উদাস হয়ে যেত।

কখনো কখনো বালক স্কুল থেকে ঘরে ফেরার সময় অবাক হয়ে দেখত, আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। বালকের ছাতা ছিল না। কাজেই সেই ঝুম বৃষ্টির কবল থেকে বইখাতা বাঁচাতে এক হাতে স্যান্ডেল আর এক হাতে বই নিয়ে ভোঁ দৌড় দিত। মাঝে মাঝে রাস্তার কাদায় পিছলে পড়ে যেত। কাদামাখা ভুত হয়ে ফিরত বাসায়। মা ব্যর্থ চেষ্টা করত আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দেয়ার। মায়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বালক দৌড়ে লাফিয়ে পড়ত পুকুরে। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা অদ্ভুত শব্দ করত। বালক অবাক হয়ে শুনত সে শব্দ। দীর্ঘ সময় পুকুরে দাপাদাপি করার পর চোখ লাল করে সে ফিরত। মা আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিত। শান্ত ছেলের মতো পুঁটি মাছের ভাজি দিয়ে গোগ্রাসে গরম ধোঁয়াওঠা ভাত গিলে, গল্পের বই নিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ত বালক।

টিনের চালে তখন একটানা বৃষ্টি পড়ত। বাইরে সজনে গাছটা উড়ে চলে যেতে চাইত হাওয়ার সাথে। কলাগাছের পাতায় চলত বাতাসের দাপাদাপি। বালক গল্পের বইয়ে ডুবে যেত৷ দুষ্ট বাবার কবল থেকে নৌকা নিয়ে পালাচ্ছে হাকলবেরি ফিন… সে কি নিরাপদে পালাতে পারবে? না ওর বাবা ওকে ধরে ফেলবে? টান টান উত্তেজনা! একসময় ঘুমিয়ে পড়ত বালক। ঘুমের ঘোরেই ভয় পেত বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে। মা মাঝেমধ্যে পাশে এসে শুয়ে থাকত। ঘুমের ঘোরে সে জড়িয়ে ধরত তার মায়ের গলা–এই পৃথিবীতে তার সবচেয়ে আপন মানুষটিকে…

এখনো সেই কড়াই গাছটার নিচে বহুপথ পাড়ি দিয়ে আসা ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে। সেই কড়াই গাছের নিচে বসে আজ কেউ কি ঢেউ গোনে? সেই নিঃসঙ্গ চিলটা আজও হয়তো কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। এখনো আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। টিনের চালে এখনো বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টির সেই শব্দ কি কেউ কান পেতে শোনে?

আমাদের প্রজন্মটাই বোধহয় সর্বশেষ প্রজন্ম যারা আবহমান বাংলার ক্ল্যাসিকাল শৈশব, কৈশোরের স্বাদ কিছুটা হলেও পেয়েছিল। অলৌকিক,নিষ্পাপ, মানবিক। একই পাড়ার সব ছেলেমেয়ে যেন সবাই নিজেদেরই ভাই-বোন। হই-হুঁল্লোড়, পুকুরে দাপাদাপি, চৈত্রর দুপুরে পায়ে পায়ে ঘোরা, আমচুরি, আচারচুরি, আখিচুরি, গোল্লাছুট, রূপকথার আসর… এক অদ্ভুত সরলতায় জড়িয়ে ছিল আমাদের শৈশব। শৈশবকে বিদায় জানিয়ে কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে যখন পৌঁছালাম আমরা, তখন থেকেই যেন সুপারসনিক গতিতে অধঃপতনের দিকে যাত্রা শুরু হলো এই সভ্যতার। আসলে অধঃপতন শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, আমরা তখন টের পেলাম। অদ্ভুত এক আঁধারে ছেয়ে গেল এই বুড়ো পৃথিবী। ডিশ এন্টেনা আকাশ থেকে নামিয়ে আনল অভিশাপ, ড্রয়িং রুমে বাড়তে থাকল বোকা বাক্সের বোকামি। হাইস্পিড় ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, প্রযুক্তির বিষাক্ত প্রলোভনে ঠেলে দেয়া হলো আমাদের কোনো নির্দেশনা ছাড়াই। অক্টোপাসের মতো শক্তিশালী পুঁড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল এই নব্য ‘দানো’। আমরা হারাতে থাকলাম শৈশব-কৈশোরের মৌলিক উপাদান; খেলার মাঠ, পুকুর, নদী, অখণ্ড অবসর। আকাশছোঁয়া দালানগুলো অনুপ্রবেশ করল আমাদের স্বাধীনতার আকাশে। ভূমিদস্যু, কারখানা, ব্রয়লার ফার্ম, মাছচাষীরা কেড়ে নিল আমাদের জলাভূমি। শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা, অভিভাবকদের অসুস্থ মানসিকতা কেড়ে নিল আমাদের অবসর। আমরা যাব কোথায়? উঠোনকোণের জায়গাটুকুও তো নেই!

যে জীবন ছিল ঘাসফুল আর মাতৃসম রুপালি জলের ঘ্রাণ নেয়ার, ফাগুনের অনন্ত নক্ষত্রবীথির নিচে দাঁড়িয়ে তারা গোনার, ফড়িং আর প্রজাপতির পেছনে দৌড়ে বেড়ানোর, যে জীবন ছিল আলিফ লায়লা আর সিন্দাবাদের, যে জীবন ছিল ফাঁদ পেতে শালিক ধরার, পুকুরে বঁড়শি ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার, যে জীবন ছিল রূপকথার খেলাঘরে হারিয়ে যাবার, সেই জীবনে ভর করল অনেক জটিলতা, অস্থিরতা। অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষাগুলো একে একে আবিষ্কৃত হলো, সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো বিকৃত উপায়ে পূরণ করে দিতে এগিয়ে এল প্রযুক্তি।

আমরা ভাঙতে থাকলাম। আমরা হারিয়ে গেলাম ভুল স্রোতে।

এক আকাশ শ্ৰীবণের সঙ্গে আজীবন সখ্যতা হলো আমাদের।

আমরা নষ্ট হলাম। 

.

দুই.

সাঁই সাঁই করে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো বাসটা উড়ে চলছিল কালো পিচে মোড়ানো প্রশস্ত রাজপথের বুকের ওপর দিয়ে। জানালার পাশের সিটে বসেছিলাম। বাতাসে উড়ছিল মাথার কোঁকড়া চুল। পথের পাশের বাবলীর গীছ, ভাঁটফুল, নাম না-জানা জংলি লতার নীল নীল ফুল, আর ১১ কেভি ইলেক্ট্রিক লাইনের পুল, সবকিছু নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছিল চোখের সামনে থেকে। বাসের ভেতরে নীরবতা জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। একটু আগেও বেশ হইচই হচ্ছিল। আমার আশেপাশে বসেছিল পনেরো-ষোলো বছর বয়সের বেশ কয়েকজন কিশোর। কেউ গল্প করছিল, কেউ উদাস হয়ে বাইরে চেয়ে ছিল, কেউ কেউ সিটে বা এর ওর ঘাড়ে মাথা রেখে মুখ হা করে ঘুমাচ্ছিল। শেষের ছেলেগুলো বেশ ক্লান্ত। একটু আগেও হাই ভলিউমে “বুরখী পড়া মেয়ে পাগল করেষ্টে” টাইপ গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জটলা বেঁধে কী নাচটাই না এরা নাচছিল। এ রকম নাচ দেখার সৌভাগ্য (না দুর্ভাগ্য?) আগে কখনো হয়নি। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে আফ্রিকান গহীন অরণ্যের কিছু জংলিদের নাচ দেখেছিলাম। সেই নাচের সাথে এই ছেলেগুলোর নাচের বেশ মিল আছে! যাই হোক ছেলেগুলো আমার বন্ধু, আমরা সবাই একই ক্লাসে পড়তাম। স্কুল। থেকে আমরা বনভোজনে যাচ্ছিলাম মুজিবনগর। বসন্তের এক অসহ্য সুন্দর দিন ছিল সেটি।

সামনের সিটগুলোতে স্যারেরা বসেছিলেন। তাদের ঠিক পেছনেই জটলা বেঁধে বসেছিল ছেলেদের এবং মেয়েদের কয়েকজন। বাস থেকে নামার পরে বেশ কয়েকজনের মুখে শুনলাম, এই ছেলেমেয়েগুলো বাসের মধ্যে প্রায় পুরোটা রাস্তা একসাথে মোবাইলে পর্ন দেখেছে! প্রচণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে ছিলাম সেদিন। তারপর আস্তে আস্তে এ রকম অনেক ঘটনা দেখে বিস্মিত হতে হতে আমার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল। 

আমি জানলাম আমার স্কুলের সবচেয়ে সেরা বন্ধু ভয়ঙ্কর রকমের পর্ন-আসক্ত। কলেজে আমার পাশে বসা ছেলেটার হার্ডডিস্ক ভর্তি পর্ন। পেছনের বেঞ্চের ছেলেটা সারা রাত মোবাইলে পর্ন দেখে আর ক্লাসে এসে ঘুমায়। কাছের একজন বন্ধু, খুবই ভদ্র, লাজুক ছেলে, পর্ন-আসক্তির কারণে প্রচণ্ড নির্লজ্জ হয়ে উঠল। আমি দেখলাম। ক্লাস রুমের দরজা আটকে স্কুলের বন্ধুরা পর্ন দেখছে, কলেজের বন্ধুরা মোবাইলের লাউডস্পিকারে পর্ন ছেড়ে দিয়ে ম্যাডামকে বিরক্ত করছে, ম্যাডামদের নিয়ে রসালো আলাপে পার করে দিচ্ছে টিফিনের সময়টী। ফেসবুকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে ট্রল বানাচ্ছে। ভার্সিটির র‍্যাগিং এ নবাগত ছাত্রদের পর্নস্টারদের অনুকরণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। পাশের রুমের ভদ্র ছেলেটাও যখন কলেজের ব্যাগে চটিগল্পের বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, নামাজে যাওয়া ছেলেটাও যখন রুমমেটের সঙ্গে পর্নস্টারদের নিয়ে মজা করে, তখন আমি কি আর বিস্মিত হব? 

খুব বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম ২০১১ সালের রমাদ্বানে। ২৭ শে রমাদ্বানের রাতে গ্রামের মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ পড়ার মাঝে বিরতিতে খেয়াল করলাম বারো-তেরো বছরের কিছু ছেলে মসজিদের বাইরের উঠোনের আমগাছের নিচে বসে জটলা বেঁধে মোবাইলে পর্ন দেখছে। হাতেনাতে ধরা। ইয়া আল্লাহ! রমাদ্বান মাসে! ২৭ শে রমাদ্বানের রাতে! লা হাওলা ওয়ালা কুউ’আতা ইল্লাহ বিল্লাহ!

ভার্সিটিতে আমি নিজে অনেক অনুনয় বিনয় করে কয়েকজনকে রাজি করাতে পেরেছিলাম হার্ডডিস্ক পরিষ্কার করতে। এদের কারও কারও হার্ডডিস্কে শত গিগাবাইটের ওপরে পর্ন ছিল! আমরা যখন বেড়ে উঠেছি তখনো বাংলাদেশে মোবাইল, ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না।

তখনই এ রকম ভয়ঙ্কর অবস্থা ছিল!

এখন কী অবস্থা হতে পারে চিন্তা করে দেখুন একবার! 

.

তিন.

পৃথিবীর এখন গভীর, গভীরতর অসুখ। আজকের মতো অসভ্য অশ্লীল কলুষিত বাতাস হয়তো পৃথিবীর শত সহস্র বছরের ইতিহাসে আর কখনো প্রবাহিত হয়নি। পর্ন ভিডিওর কথা ছেড়েই দিলাম, টিভি বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, ম্যাগাযিন, মুভি, মিউযিক, আইটেম সং, সাহিত্য, কবিতা সবকিছুই আজ চরম যৌনায়িত। সবখানেই কেবল নারীকে পণ্য করা, নারীর দেহকে পুঁজি করা। নারী-পুরুষের পবিত্র ভালোবাসা আজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে পশুর মতো যততত্র যার-তার সাথে দৈহিক মিলনে। পুরুষরা আজ আর নারীদের চোখের তারায় ভালোবাসা খোঁজে না, তারা ভালোবাসা হাতড়ে বেড়ায় নারীর শরীরের ভাঁজে। সমকাম আর অজাচারের (নাউযুবিল্লাহ) মতো জঘন্য বিষয়গুলোও আজ মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এ রকম এক প্রতিকূল পরিবেশে কী এক অস্থিরতার মধ্যে কিশোর, তরুণদের দিন কাটাতে হয়, সেটা আমাদের আগের প্রজন্ম কখনো ঠিকমতো বুঝতে পারবে কি না সন্দেহ! 

আমাদের বাবা-মারা হয়তো কখনোই জানতে পারবেন না, তাদের আদরের, নিরীহ, ভদ্র ছেলেটার পিসির হার্ডডিস্কের শত শত গিগাবাইট পর্ন ভিডিও দিয়ে বোঝাই! বাবা-মারা কি আদৌ বিশ্বাস করতে পারবেন, আমাদের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে দলবেঁধে পর্ন ভিডিও দেখে? বিয়ের আগেই শারীরিক অন্তরঙ্গতা এদের কাছে ডালভাত, গ্রুপ সেক্সও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার? যে ছেলেটার দুধের দাঁতও সব কয়টা পড়েনি সেও এখন ওরাল সেক্স, অ্যানাল সেক্স–এর মতো শব্দগুলোর সাথে পরিচিত?

নীল বাতাসে বিষাক্ত এ সময়ে বেড়ে উঠেছি আমি, বিষাক্ত বাতাস বার বার হানা দিয়েছে আমার জীবনে। জাহাজ মাস্তুল তছনছ করে দিয়েছে। তবু আল্লাহ্র (d) ইচ্ছায় ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখেছি, দুরবিনে চোখ রেখে খুঁজে বেড়িয়েছি বেঁচে থাকার মানে। শৈশব-কৈশোর-প্রথম তারুণ্যে দীর্ঘ দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, অজস্র বিশুদ্ধ মানবাত্মা পর্নোগ্রাফি, হস্তমৈথুন আর চটিগল্পের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। এখনো চারপাশের কোটি কোটি বিশুদ্ধ ফিতরাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে এ সমাজ, এ পৃথিবীটাকে ওলট-পালট করে দিতে। চলন্ত ট্রেনের জানালা, সোনালি ডানার বুড়ো চিল আর উঠোন কোণের সেই নিম গাছটাকে কতবার আমি আমার ইচ্ছের কথা বলেছি। তারা মুখ বাঁকিয়ে হেসেছে। আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে। নিষ্ফল ক্রোধে মাথার চুল ছিঁড়েছি, পুকুরধারে নির্জন দুপুরে চোখ ভিজিয়েছি বাংলা ভাষায়।

চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি! কিচ্ছু না!

আমার একটা ছোট ভাই আছে। কোঁকড়া চুলের এই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে কৈশোরের চৌকাঠে। ওর দিকে তাকালে এক নিমিষেই আমার অতীত আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আর একরাশ ভয় এসে ঘিরে ধরে আমাকে। বেড়ে ওঠার সময় আমাকে, আমার বন্ধুদের বা আমাদের বয়সী একটা ছেলেকে যে যুদ্ধ করতে হয়েছে, ডিজিটাল এই যুগে তার চেয়েও তীব্র যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে আমার ছোট ভাইটিকে। নাম না-জানা আমার আরও কোটি কোটি ভাই অনবরত যুদ্ধ করে যাচ্ছে এই “দানোর” সঙ্গে। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে আমরা তেমন কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি, কিন্তু আমার এই ভাইগুলো যেন দিকনির্দেশনার অভাবে হারিয়ে না যায়, সে চিন্তা থেকেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। অনেক ভাইয়ের অশ্রু আর ঘাম ছড়িয়ে রয়েছে এই বইজুড়ে। আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান দিন, ফিরদাউসের ফুলবাগানে সবুজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোর তৌফিক দিক। সায়েন্টিফিক ফ্যাক্টগুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন পিয়ার রিভিউ জার্নালের রেফারেন্স এনেছি। পরিসংখ্যানসহ আনুষঙ্গিক সংবাদের জন্য আমরা জানলের পাশাপাশি, সুপরিচিত বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্য নিয়েছি। রেফারেন্সের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে হওয়ার কারণে বইয়ের কাজ শেষ করতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে নির্ভুল রাখার। তারপরেও ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আশা করি, আমাদের ভুলত্রুটিগুলো পাঠকেরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে শুধরে দেয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের লেখাগুলোর নিয়মিত আপডেট পেতে চোখ রাখতে পারেন এই ফেসবুক পেইজে এবং এই ওয়েবসাইটে।

নাটক, সিনেমা, মিডিয়া, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি মানুষের মনোজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। এই মিডিয়াই ঠিক করে দেয় আমরা কাকে নিয়ে চিন্তা করব, কীভাবে চিন্তা করব, কার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসাব, কীর আনন্দে আনন্দিত হব, কী পোশাক পড়ব, কী খাবার খাব, সবকিছু। মানুষ হিমুর মতো পাগল সেজে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। ফুটবলারদের মতো হেয়ারকাট দেয়, রুপালি পর্দার নায়কদের মতো প্রেম করে, বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতো পোশাক পড়ে। মিডিয়া মানুষের সামনে যেটা হাইলাইট করে দেখায় সেটা তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একজন মানুষ যখন নিয়মিত পর্ন ভিডিও দেখতে থাকে তখন তার আচার আচরণ যে পর্দায় দেখা দৃশ্যগুলো দ্বারা প্রভাবিত হবে তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। অথচ, এই সহজ কথাটাই কেন জানি আমরা বুঝতে চাই না। অনেক সময় নিজেদের অজ্ঞতার কারণে, আবার অনেক সময় নিজেদের পর্ন দেখাকে জাস্টিফাই করার জন্য আমরা দাবি করে বসি, “পর্ন দেখা ক্ষতিকর না, আমি তো শুধুই দেখছি, কিছু করছি না”, ইত্যাদি ইত্যাদি…

পর্ন-আসক্তি কত ধ্রুপদী প্রেমিক, মৌলিক মানুষ আর স্নিগ্ধ নারীদের হৃদয় ভেঙেছে, কত মমতাময়ীদের পাখির নীড়ের মতো চোখে অশ্রুর ঝুম বৃষ্টি নামিয়েছে, কত রঙিন স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেছে এই আসক্তির কারণে, তার কোনো হিসেব কি কেউ কোনোদিন করেছে?

শিশুনির্যাতন, ধর্ষণ, অজাচার, হত্যা, মানবপাচার, মাদক, এইডস, সমকামিতা, হতাশী, আত্মহত্যা, বিবাহবিচ্ছেদ, হত্যা… এটি এমনই এক নির্দয় পৃথিবী। পাঠক আপনাকে স্বাগতম!