॥ নয়।।
বাকী চঘানীয়ানীর বিদায় বাবরের ভাগ্য ও পরিবেশকে তার নিজের মুঠোয় এনে দিলো। রাজ্যের উপর, আমীরদের উপর প্রতিষ্ঠিত করলো তার অপ্রতিহত কৰ্ত্তৃত্বে। সারাজীবন এই-ই চেয়ে এসেছেন বাবর। এতদিনে তার সে আকাঙ্খা পূর্ণ হলো।
এবার তিনি মন দিলেন রাজ্যকে আরো দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে। তার সাম্রাজ্য গঠনের আকাঙ্খা রূপায়ণের পথ সাবলীল ক’রে তুলতে। ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি যাযাবর তুর্কেমান হজারাদের দমন অভিযানে বার হলেন। এদের দস্যুবৃত্তিমূলক
পাঞ্জাব যাতায়াতের পথ নিরাপত্তাবিহীন ক’রে তুলেছিল। একটি ছোট ন্যদল নিয়ে তিনি জঙলীকে তাদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেখানে তারা শীতের ছাউনি ফেলে বাস করছিল তখন। সমগ্র ছাউনি ঘেরাও
ক্রিয়াকলাপ কাবুল থেকে
ক’রে প্রচুর সংখ্যায় ভেড়া ও ঘোড়া ছিনিয়ে নিলেন। যে
তা পুরো সফল হলো।
উদ্দেশ্যে এ অভিযান
কিন্তু ঠাণ্ডায় ও কঠিন পথশ্রমের ফলে তার স্বাস্থ্যে ভাঙন দেখা দিল। ১৫০৬ অঙ্গের ৭ই ফেব্রুয়ারী সায়েটিকায় গুরুতর ভাবে আক্রান্ত হলেন তিনি। পুরো চল্লিশ দিন বিছানায় পড়ে থাকলেন।
সেখানে
অসুস্থ থাকাকালে জহাঙ্গীর মীর্জার কার্যকলাপ বাবরকে উদ্বিগ্ন ক’রে তুললো! জহাঙ্গীর মীর্জার মনে ধারণা দেখা দিয়েছে, তার প্রতি বাবর ন্যায় বিচার করেননি। তাকে যথেষ্ট কম জায়গীর দেয়া হয়েছে। তার এই অসন্তোষের আগুনে ধুনো দিয়ে চলেছেন আয়ুবের দুই ছেলে য়ূসুফ ও বুহলুল। এরা দু’জনেই মুঘল।
এদের প্ররোচনায় জহাঙ্গীর কাবুল থেকে গজনী পালিয়েছেন। নানি দুর্গ আক্রমণ ক’রে তাকে দখল ক’রে নিয়েছেন। সকলের ধন সম্পদ লুটপাট ক’রে তাদের মধ্যে কতককে হত্যা করেছেন। ক্রমশঃ দুশ্চরিত্র হয়ে উঠেছে সে। হয়ে উঠেছে মদপ ও নারী সঙ্গ লোলুপ! হজারা অঞ্চল পেরিয়ে গিয়ে সে কতক মুঘল গোষ্ঠীর সাথে যোগ দিয়েছে। চেষ্টা ক’রে চলেছে আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের সক্রিয় ক’রে তুলতে। বাবরের মনে দুশ্চিন্তা দেখা দিল, তার শত্রুরা এই সুযোগে জহাঙ্গীর মীর্জাকে তাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে আবার না তৎপর হয়ে;ওঠে।
বাবর নামা
এমন সময় খুরাসান থেকে সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকারার দূত এল. শইবানি খানের উপর তৈমূরবংশীয়দের সম্মিলিত আক্রমণের জন্য তিনি বাবরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ বাবরের নিজের মনের কথা। অতএব সাথে সাথে সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পরিকল্পনা নিলেন, যাবার পথে জহাঙ্গীর মীর্জার মুখোমুখি হবেন। হয় তার বিরুদ্ধাচরণের পথ রুদ্ধ করবেন, নয়তো তাকে অনুগত ক’রে তুলবেন। কিন্তু, বাবর নসৈন্যে এ গেয়ে আসছেন শুনে বামিয়ান থেকে পালিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিলেন জহাঙ্গীর
মীর্জা।
সহসা পিছন থেকে আক্রমণ ক’রে যাতে কোন ক্ষতি করতে না পারে এজন্য উশ তুর শহরে কোষাধ্যক্ষ ওয়ালীর জিম্মায় ভারী তল্পিতল্পা রেখে বাবর এগিয়ে চললেন। খমার্দ পৌঁছে আইমাকদের ভীত-সন্ত্রস্ত ক’রে জহাঙ্গীর মীর্জার সঙ্গে তাদের যোগ দেবার পথ রুদ্ধ করলেন। অবশেষে জহাঙ্গীর মীর্জা ও তার আনুগত্য স্বীকার ক’রে নিলেন। খমার্দে তার সৈন্যবাহিনী যখন ঘুরী ও দহান এলাকায় খাদ্যশস্যাদি সংগ্রহে ব্যস্ত এমন সময় বাবর খবর পেলেন সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকারা মারা গেছেন। তবুও খুরাসান এগিয়ে চললেন তিনি। পথে তিনি খবর পেলেন তার ছোট ভাই নাসির মীর্জা বদকশান থেকে ( সে ইতিমধ্যে বাবরকে ছেড়ে বদকশান গিয়ে সেখানকার স্বাধীন সুলতান হয়েছে ) শইবানি খানের উজবেগ সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছে ও হুসেন মীর্জার উত্তরাধি- কারীরা শইবানি খানের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বদ্ধপরিকর। শুনে উৎসাহের সাথে এগিয়ে চললেন বাবর। সুলতান হুসেন মীর্জার উত্তরাধিকারী বদী-উজ্জমান মীর্জা ও মুজফফর হুসেন মীর্জাও বাবরের কাছে দূত পাঠালেন অবিলম্বে এগিয়ে
এসে তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য।
১৫০৬ অব্দের ২৬শে অকটোবর মুরঘ-আব নদী তীরে বদী-উজ্জমান ও মুজফফরের সৈন্য শিবিরে পৌঁছলেন তিনি। দুই নতুন সুলতানের সাথে দেখা হলো বাবরের। তারা বেশ ধূমধামের সাথে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন তাকে। কিন্তু কতক আভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য তারা তাদের আক্রমণ পরিকল্পনা পিছিয়ে দিলেন। ফিরে চললেন রাজধানী হীরাটে। বাবরকেও আমন্ত্রণ জানালেন যাবার জন্য। হীর’ট দেখার জন্য খুবই উৎসুক ছিলেন বাবর এ আমন্ত্রণ
গ্রহণ করলেন তিনি। গেলেন হীরাট। কুড়ি দিন কাটালেন সেখানে।
সুলতান হুসেন মীর্জার উত্তরাধিকারীদের সংস্পর্শে এসে বাবর অনুভব
৮৪
বাবর নামা
করলেন তারা অতি রুচিবান ও সংস্কৃতিবান হলেও রাজনীতির অনুপযুক্ত। তারা কষ্টসহিষ্ণুও নন, যুদ্ধেও অভিজ্ঞ নন। ভোগবিলাসে অতিমাত্রায় অভ্যস্ত। সুতরাং শইবানি খানের সাথে প্রতিযোগিতায় এরা এঁটে উঠতে পারবেন না। শইবানি খান অতি সহজেই খুরাসান দখল ক’রে নেবেন। অথচ এদের সেজন্য যেন কোন দুশ্চিন্তাই নেই। সুতরাং নিরাশ হয়ে কাবুল ফেরার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন তিনি। মীর্জারা তার আদর আপ্যায়নে কোন ত্রুটি না করলেও তার সৈন্যদের জন্য শীতকালীন আবাসের কোন ব্যবস্থা করলেন না। এ জন্যও তার পক্ষে হীরাট বাস কষ্টকর হয়ে পড়লো। অবশেষে ১৫০৬ অব্দের ২৪শে ডিসেম্বর শীতকালীন আবাস সন্ধানের অজুহাতে হীরাট ত্যাগ করলেন তিনি।
হিম বরফের জন্য পথে নিদারুণ কষ্টভোগ ক’রে, ত:শেষ দুর্গতির মধ্যে পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে ১৫০৭ অব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী বাবর য়ক-আউলাঙ এসে পৌঁছলেন। পরের দিনই যাত্রা শুরু ক’রে বামিয়ানের মধ্য দিয়ে এলেন- জঙলীক। অল্প বিশ্রাম নেবার পর ঠিক করলেন তুর্কেমান হারাদের শীতকালীন ডেরা আক্রমণ করবেন তিনি। বাবরের আগমন সংবাদ তাদের কাছে অজ্ঞাত থাকায় তারা তার যাবার পথের ধারেই ছাউনি ক’রে ছিল। চুরি, ডাকাতি ক’রে জনজীবন বিত্রস্ত ক’রে চলছিল। আচমকা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। ঘোড়া ও জিনিষপত্র ফেলে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবর্গকে নিয়ে তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। কতক বন্দী হলো সৈন্যদের হাতে।
পাহাড়মালা ডিঙিয়ে উপত্যকা পার হয়ে বাবর এরপর তৈমুর বেগের লঙরে পৌঁছলেন। এখানে এসে ঠিক করলেন হজারা চোর ডাকাতদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তিনি এই উপজাতিদের সতর্ক ক’রে দেবেন। কিন্তু কাসিম বেগের হস্তক্ষেপের ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের প্রাণদণ্ড মকুব ক’রে মুক্তি দিয়ে দিলেন!
হঙ্গারাদের দমনকালেই বাবরের কাছে কাবুলের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক উদ্বেগজনক খবর পৌঁছালো। তিনি জানতে পারলেন তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে যেখানে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। কতক আমীর মুহম্মদ হুসেন মীর্জা দুঘলাতের সাথে যোগ দিয়ে মীর্জা খানকে সুলতান ঘোষণা ক’রে কাবুল দুর্গ
অবরোধ করেছে।
‘তারিখ-ই-রসিদি’ ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মীর্জা হায়দার দুঘলাতের পিতা মুহম্মদ হুসেন মীর্জা দুঘলাত ছিলেন মাসীকেও বিয়ে করেছিলেন তিনি।
সম্পর্কে বাবরের কাকা : বাবরের এক খুরাসান যাবার বেল৷ বাবর তার উপরেই
বাবর নামা
be
কাবুলের শাসনভার চাপিয়ে গিয়েছিলেন। মুহম্মদ হুসেন মীর্জা দুলাত ছিলেন অতি সৎ প্রকৃতির লোক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধে বাবরের শেষপর্যন্ত শাসন- দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন লেখকের বিবরণ পর্যালোচনা করলে এ বিদ্রোহের জন্য কোনমতেই তাকে দায়ী করা চলে না। পাকেচক্রে শেষ পর্যন্ত তিনি এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর মূল উৎস ছিলেন বাবরের সৎ-মাতামহী শাহ বেগম। তার বড় মেয়ে সুলতান নিগর খনীমকেই বিয়ে করেছিলেন সুলতান হুসেন মীর্জা।
বাবরের দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং খবরা-খবর আদান প্রদান না চলার সুযোগ গিয়ে হজারা তুর্কেমানরা রটিয়ে দেয় যে বাবরকে খুরাসানের নতুন উত্তরাধিকারীরা বন্দী করেছেন। তিনি ইখতিয়ার-উদ্দীন দুর্গে বন্দী ভাবে দিন কাটাচ্ছেন। বাবরের মুঘল আমীররা এ খবর পেয়ে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত হয়ে ওঠে। শীতকাল শুরু হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাবর যখন ফিরলেন না কিংবা তার কাছ থেকে কোন সংবাদ এলো না, তখন শাহ বেগম ও মুঘল আমীরদের অনেকেই ধরে নিলেন, বাবর প্রকৃতই খুরাসানে জ্ঞাতিশত্রুর হাতে বন্দী হয়েছেন এবং বেঁচে নেই। এই পরিস্থিতিতে শাহ বেগম তার প্রিয় নাতি, মীর্জা খানকে কাবুলের সিংহাসনে বসাবার জন্য ব্রতী হলেন। যে উদ্দেশ্যেই হোক, মীর্জা খানও এসময় বাবরের সাথে অভিযানে না গিয়ে শাহ বেগমকে দেখাশোনার জন্য কাবুলেই ছিলেন। মুঘল আমীররা প্রায় সকলেই শাহ বেগমের এই ইচ্ছায় সায় দিলেন। কিন্তু সুলতান হুসেন মীর্জা দুঘলাত এতে সায় দিতে না পেরে দূরে সরে রইলেন। মীর্জা খানের সমর্থকরা তার নামে ‘খুতবা’ পাঠ ক’রে তাকে সুলতান ঘোষণা করলেন। বাবরের অনুগামীদের হাত থেকে রাজ্যের দখল নেবার জন্য করা হলো কাবুল দুর্গ অবরোধ। সুলতান হুসেন মীর্জার উপরও শাহ বেগম ও অন্যান্যর চাপ দিয়ে চললেন মীর্জা খানকে সমর্থনের জন্য। পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত তিনি মীর্জা খানের পক্ষ নিলেন। বাবরের অনুগামীরা দুর্গ রক্ষা ক’রে চললেন। চললো উভয় দলের মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ।
এরূপ অবরোধ চলার পর বাবর এসে পড়লেন।
২৪ দিন
আগেই বলেছি, এ ঘটনার খবর যখন বাবরের কাছে পৌঁছয় তিনি তখন হজারাদের বিরুদ্ধে অভিযানে রত। সাথে সাথে তিনি পদক্ষেপ নেবার জন্য তৎপর হলেন। কাশিম বেগের ভৃত্য অন্দিজানের মহম্মদকে পাঠানো হলো
৮৬
বাবর নামা
কাবুল দুর্গে। খবর দেয়া হলো : সাহায্যের জন্য ক্ষিপ্র গতিতে তিনি এগিয়ে অসিছেন। ঘুর-বন্দ গিরিপথ পার হয়ে তিনি অতর্কিতে বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। মিনার পর্বত পার হবার পর আগুন জ্বালিয়ে তিনি তার আগমন সংবাদ দুর্গের অনুগামীদের জানিয়ে দেবেন। তারাও যেন দুর্গের চূড়ায় আগুন জ্বালিয়ে তার প্রত্যুত্তর দেয়। তারপর উভয়ে একসাথে বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে।
।
ওই পরিকল্পনা মতো আক্রমণ ক’রে বিদ্রোহীদের ঘায়েল করা হলো। মনে মনে প্রচণ্ড ভাবে ক্ষুব্ধ হলেও শাহ বেগম, সুলতান মুহম্মদ হুসেন মীর্জা দুঘলাত বা মীর্জা খান কারো উপর কোন প্রতিশোধ নিলেন না বাবর। শাহ বেগমের সাথে আগের মতোই ভালোবাসা মাখা ব্যবহার করলেন তিনি। আগের মতোই শ্রদ্ধা ও সৌজন্য দেখালেন। সুলতান মুহম্মদ হোসেন মীর্জা দুঘনাতকে খুরাসান চলে যাবার অনুমতি দেয়া হলো। মীর্জা খানকে প্রথমে তার বড় বোনের সাথে বাস করার অনুমতি দিলেন ও পরে কন্দহার গিয়ে সেখানে বাস করার নির্দেশ দিলেন।
শাহ বেগম ও মাতৃকুলের আত্মীয় পরিজনদের মুখে কিছু না বললেও কিংবা আচার-ব্যবহারে কোন বিরূপ ভাব প্রকাশ না করলেও, জীবনী গ্রন্থ মধ্যে কিন্তু বাবর তাদের এ আচরণের জন্য তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ বিদ্রোহের জন্য শাহ বেগম ও তার আত্মীয় পরিজনদেরই তিনি দোষী করেছেন। এই ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি যে সব কথা বলেছেন তা থেকে আমরা জানতে পাই, বাবরের দুর্দিনের সময়ে তার ও তার মায়ের প্রতি মামাদের আচরণের তুলনায় তাদের দুর্দিনে মাতৃকুলের প্রতি তার আচরণ কতো উদার ও শালীন ছিল। মোঙ্গল খান-ভাইদের দুর্বিপাকের পর মাতৃকুলের যারাই তার কাছে কাবুলে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি সসম্মানে স্থান দিয়েছিলেন, সম্মান অনুযায়ী জায়গীর প্রদান করেছিলেন। কিন্তু বাবর যখন তার চরম দুর্দিনে মামাবাড়ি আশ্রয় নেন তখন তারা তাকে তো দূর কথা তার মাকেও সসম্মানে থাকার জন্য একখানি গ্রামও মঞ্জুর করেননি। ক্ষোভের স্বরেই প্রশ্ন তুলেছেন বাবর ‘ কেন? আমার মা কি য়ূনস খানের মেয়ে নন? আমি কি তার নাতি ছিলাম না “
বিদ্রোহ নিমূ”ল ক’রে প্রজাদের দুঃখকষ্ট লাঘবের দিকে মনদিলেন বাবর। রাজ্য মধ্যে স্বাভাবিক শাস্তি ও শৃঙ্খলার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে, নজর দিলেন
বাবর নামা
৮৭
তারপর বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন পার্বত্য উপজাতিদের বশে আনার দিকে। এদের ক্রিয়াকলাপ প্রায়ই তার রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্টের কারণ হয়ে উঠছিল। এজন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আক্রমণ করলেন বারান, চাষ-তুপ এবং গুল-ই-বহার অঞ্চল। অভিযান সফল হলো তার
এ সময়েই মৃত্যু হলো দ্বিতীয় ভাই জহাঙ্গীর মীর্জার। ফলে, তাকে ঘিরে অহরহ যে দুশ্চিন্তার পাকে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল তা থেকে রেহাই পেলেন বাবর। ছোট ভাই নাসির মীর্জার দিক থেকেও দুশ্চিন্তার অবসান ঘটলো। যে আমীররা তাকে নিয়ে বদকশানের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন তারাই আবার তার প্রতি বিরূপ হয়ে সেখান থেকে হটালেন তাকে। তাড়া খেয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় আবার তিনি বাবরের আশ্রয় নিলেন। পূর্ব অপরাধ মার্জনা ক’রে বাবর আবার তাকে কাছে টেনে নিলেন। আগে জহাঙ্গীর মীর্জাকে যে অঞ্চল দিয়েছিলেন সেই গজনীর শাসন-কর্তৃত্বে তাকে অর্পণ করলেন বাবর। আপন রাজ্যে বাবরের কত্ত্ব ত্ব এবার প্রশ্নাতীত হয়ে উঠলো।
ইতিমধ্যে খুরাসান সম্পর্কে বাবরের অনুমান ও আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলো নতুন উত্তরাধিকারী দু-ভাইয়ের রাজনৈতিক ও সামরিক অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে শইবানি খান পুরাসান দখল ক’রে নিলেন। এরপর তিনি মসহদ-ও জয় ক’রে নিলেন আবুল মহসিন মীর্জা ও কূপক মীর্জার কাছ থেকে।
শইবানি খানের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্য অবশিষ্ট রাজাদের আতঙ্কিত ক’রে তুললো। তার দৃষ্টিও এবার পড়লো গিয়ে জমিনদাওয়া ও কন্দহারের প্রতি। এ জুটি এ পর্যন্ত প্রাসানের অধীন রাজ্য ছিল। কাবুলের স্থিতি নিয়েও দুশ্চিন্তা দেখা দিল :
কন্দহারের শাহ বেগ ও মুকীম বেগ অররুন এইবানি খানের আক্রমণ আশঙ্কা ক’রে বাবরের কাছে দূত পাঠালেন। প্রস্তাব দিলেন জোটবদ্ধ হয়ে উজবেগদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য। আমীরদের সাথে পরামর্শ ক’রে বাবর এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। অবিলম্বে প্রস্তুত হয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্র| করলেন
কন্দহার।
যখন কলাত পার হয়ে শিবির ফেললেন, মীর্জা খান এবং অবদুর রজ্জক মীর্জা এসে তার সাথে যোগ দিলেন। একদা তারা কাবুলের সিংহাসনের দাবীদার হয়েছিলেন বটে। কিন্তু বর্তমানে বাবর সম্পূর্ণ সুপ্রতিষ্ঠিত।
।
তার
সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস ও যোগ্যতা কোনটাই তাদের নেই। সুতরাং
বাবর নামা
তাদের আশ্রয় দিতে কুণ্ঠিত হলেন না বাবর। এখান থেকে তিনি তার আগমন সংবাদ দিয়ে কন্দহারে দূত পাঠালেন অরঘুন ভাইদের কাছে।
অরঘুন ভাইরা আক্রমণ আশঙ্কায় তটস্থ হয়ে বাবরের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর সাথে সাথে শইবানি খানের সাথেও আলোচনা জুড়ে দিয়েছিলেন। কেননা, বাবর যে এতো সহজে তাদের প্রস্তাব গ্রহণ ক’রে প্রস্তাবিত অভিযানে তাদের সামিল হতে চাইবেন তা তারা কল্পনা করতে পারেননি। ফলে বাবরের উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মনে গভীর সংশয় দেখা দিল। তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া অপেক্ষা শইবানি খানের আধিপত্য মেনে নেয়াই এক্ষেত্রে তারা বেশি নিরাপদ বলে বিচার ক’রে বসলেন। এবং সেই মতোই কাজ করলেন তারা।
বাবরের এতো সব কথা জানবার নয়। তিনি অরঘুন ভাইদের ক্রমাগত চাপ দিয়ে চললেন দেখা ক’রে অভিযান পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য। কিন্তু তারা এমন ভাষায় উত্তর দিতে বা চিঠি দিতে শুরু করলেন যেন বাবর তাদের অধীন কোন আমীর। বার বার এভাবে প্রত্যাখ্যাত হবার পর বাবর মেজাজ হারিয়ে ফেললেন, এগিয়ে চললেন এর সমুচিত উত্তর দেবার জন্য। খলিশকের উলটো- দিকে, খাল পেরিয়ে কন্দহারের তৃণাঞ্চলে পা দিয়ে তিনি তার চরের মুখে খবর পেলেন, শত্রু বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে। বাবর মাত্র দু’ হাজার সৈন্য নিয়ে এসেছেন। তার মধ্যে অর্ধেক ভেড়া, গরু ও অন্যান্য খাদ্যাদি সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থানে গেছে। সঙ্গের এক হাজার সৈন্যও পথশ্রমে ক্লান্ত ও অপ্রস্তুত অবস্থায়। কিন্তু দমে যাওয়া বা ভয় পাওয়া বাবরের স্বভাব বিরুদ্ধ। সুতরাং সেই সামান্য সৈন্যকেই এক একজন নায়কের অধীনে দশ ও বিশজনের দলে ভাগ ক’রে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। এ সৈন্যরাও ছিল আবার বহু জাতি ও উপজাতিতে বিভক্ত। প্রতিপক্ষ শাহ বেগের অধীনে ছয় থেকে সাত হাজার
সৈন্য।
তারা বাবরের শিবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু বাবরের সেনারা অবিচল ভাবে তাদের প্রতিহত ক’রে চললো। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে শাহ বেগের সৈন্যেরা পালাতে শুরু করলে। দুর্গের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে য!বার দরুন, দুর্গ রক্ষার জন্য এগিয়ে যাওয়াও শাহ বেগ ও মুকীম বেগের পক্ষে সম্ভব হলো না। বাবর এ সুযোগে কন্দহার দুর্গের দিকে এগিয়ে চললেন। যুদ্ধে বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে সেখানকার সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। বেশিক্ষণ দুর্গ প্রতিরোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। দু রক্ষক আহমদ আলী তরখান নিরাপদে চলে যেতে দেবার সর্তে দুর্ণ সমর্পণ
বাবর নামা
করলেন। বিপুল ধনসম্পদ বাবরের অধিকারে এলো। তিনি উদার ভাবে তা অনুগামীদের মধ্যে বেঁটে দিলেন। এই ধনসম্পদের মধ্যে ঘোড়া, উট, খচ্চর, প্রচুর মূল্যবান রেশম বস্ত্র, মিহি সূতীবস্ত্র, মূল্যবান পোষাকাদি ও অঢেল রৌপ্য মুদ্ৰা ছিল।
এতো মুদ্রা যে গণনার বদলে ওজন ক’রে বেঁটে দেয়া হলো। অবশ্য দুর্গের মধ্যে যে সম্পদ ছিল তা আহমদ আলীর দখলে রাখার অনুমতি দেয়া হলো। বিজিত দেশের ভার নাসির মীর্জার হাতে দিয়ে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কাবুল ফিরে
এলেন বাবর।
কাবুল ফিরে বাবর জানতে পেলেন, শাহ বেগ ও মুকীম বেগের অনুরোধে শইবানি খান কন্দহার এগিয়ে চলছেন হীরাট ও কন্দহারের মধ্যবর্তী পার্বত্য এলাকা দিয়ে। যে বিপুল ধনসম্পদ বাবরের হাতে পড়েছে তা কেড়ে নেবার জন্য শইবানি খান অতি দ্রুত এগিয়ে চলছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী ও বিশ্বস্ত অনুগামী কাশিম বেগের পরামর্শে বাবর সোজা কাবুল চলে আসায় তার সে পরিকল্পনা সার্থক হয়নি। কন্দহার পৌঁছে শইবানি খান দেখলেন বাবর ধনসম্পদ নিয়ে তার পূর্বেই কাবুল ফিরে গেছে। তবু তিনি দুর্গ অবরোধ করলেন। মাত্র কিছুদিন হলো দুর্গ নাসির মীর্জার দখলে এসেছে। সুতরাং দুর্ধর্ষ উজবেগ বাহিনীকে প্রতিরোধ ক’রে দুর্গ দখলে রাখা অসম্ভব বুঝে তিনি কিছু বিশ্বস্ত অনুগামীর হাতে দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে কন্দহার ত্যাগ করলেন। চলে এলেন গজনী। কিন্তু দুর্গ যখন দখলে আসার অবস্থায় ঠিক তখনই সবাইকে অবাক ক’রে দিয়ে শইবানি খান অবরোধ তুলে নিয়ে কন্দহার ত্যাগ করলেন। কন্দহার এসে তিনি জানতে পারলেন তার কতক আমীর নীরহ-তু-তে বিদ্রোহ করেছে ও তার হারেম ও দুর্গ দখল ক’রে নিয়েছে। এ সংবাদে বিচলিত হয়েই তিনি সম্ভবতঃ এ সময়ে কন্দহার ত্যাগ করেন। এছাড়া ধনসম্পদ লুণ্ঠিত কন্দহারের এরূপ একটি দূরবর্তী দুর্গও তিনি সম্ভবতঃ নিজ দখলে রাখার জন্য ব্যগ্র ছিলেন না। কিন্তু তার প্রস্থানের ফলে বাবর এক বিরাট বিপদের হাত থেকে বাঁচলেন। তার রাজ্যের অবস্থানের দিক থেকে তার কাছে কন্দহারের মূল্য ছিল অপরিসীম। এটি শইবানি খানের মতো দুর্ধর্ষ ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়া মানেই কাবুলের স্থিতি বিপন্ন হয়ে পড়া
শইবানি খানের কন্দহার আক্রমণের খবর বাবরের মতো দুঃসাহসীকে পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ‘ক’রে তুললো। শক্তির দিক থেকে শইবানি খানের কাছে তিনি শিশু। কন্দহার বিজয়ের পর তিনি নিশ্চয়ই কারুল বিজয়ের জন্য এগিয়ে
So
বাবর নাম।
আসবেন। সুতরাং এ সময়ে কাবুলে থাকা তিনি মোটেই নিরাপদ মনে করলেন: না। কী করবেন তা ঠিক করার জন্য তিনি আমীরদের নিয়ে মন্ত্রণায় বসলেন। কাশিম বেগ ও শেরীম তঘাই তাকে বদকশান চলে যাবার পরামর্শ দিলেন। অন্য কতক পরামর্শ দিলেন হিন্দুস্তানে চলে যাবার জন্য। শেষ অবধি ১৫০৫ খ্রীষ্টাব্দের সেপটেমবরে বাবর হিন্দুস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বেলা তিনি অবদুর রজ্জক মীর্জার উপর কাবুল দুর্গের ভার অর্পণ করলেন। আর শাহ বেগমের অনুমতি নিয়ে মীর্জা খানকে পাঠালেন বদকশানে।
যাবার
বাবরকে রাজ্য ছেড়ে সিন্ধুনদের দিকে পালাতে দেখে কাবুল ও লমঘ!নের মধ্যবর্তী আফগান উপজাতিরা তার পথ অবরোধের জন্য তৎপর হয়ে উঠল। একদিন ভোরে যখন তিনি জগদালিক থেকে এগিয়ে চলেছেন, দেখলেন খিজর খইল, শিমু খইল, খিরিলচী ও গুগীয়ানী উপজাতির আফগানরা জগদালিক গিরিপথ দিয়ে তার যাবার পথ অবরোধ ক’রে রয়েছে। তারা উত্তর দিককার পাহাড়মালার উপরে তাদের সৈন্য সমাবেশ করেছে। রণভেরী বাজিয়ে, গভীর কোলাহল তুলে এগিয়ে আসছে। বাবর সাথে সাথে তার বাহিনীকে পাহাড়ে চড়ে সব দিক থেকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। বাবরের সৈন্যদের ওই ভাবে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে আফগানরা একটা তীরও না ছুড়ে রণভঙ্গ দিল। বাবর এবার পাহাড় থেকে নেমে এলেন। থামলেন এসে নিঙ-নহা তুমানে থাকা অদীনপুর ( জালালাবাদ ) দুর্গে। দৈবাহিনীকে চার দলে ভাগ ক’রে তিনি এবার তাদের বিভিন্ন দিকে অফগান
দিকে আফগান সঞ্চলা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের জন্য পাঠালেন। এবং এই পন্থায় তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে তুলতে চাইলেন। এভাবে তিনি শামুকের গতিতে আফগান অঞ্চল পার হয়ে চলতে থাকলেন। মন্দ্রাবর উপস্থিত হয়ে তিনি সেখানে মুকীমের মেয়ে মাহ-দুটুকের সাবে কাশিম কুকুলদাসের বিয়ে দিলেন। কিছুদিন পরে পশাঘরের মোল্লা বাবাকে পাঠালেন সেখানকার খবর আনবার জন্য। এ সময়ে চাঘান-রাই নদীর পশ্চিম পারে থেকে, তিনি আতর, শীব, কুনার ও নূর-গল অঞ্চল লুটপাট ক’রে চললেন। শীতের মাঝামাঝি তার কাছে খবর এলো, দুর্যোগ কেটে গেছে, শইবানি খান কন্দহার অধিকার না করেই ফিরে গেছেন। তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বদ-ই- পিচের সড়ক ধরে কাবুল ফিরে এলেন বাবর
1
রাজ্যে ফিরে এসে আবার বাবর প্রশাসনিক দিকে মন দিলেন। নাসির মীর্জা ও আবদুর রজ্জক মীর্জার কাবুল উপস্থিতি তার নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও
বাবর নামা
স্থিতির পক্ষে ক্রমশ বিঘ্নের কারণ হয়ে উঠছে দেখে নাসির মীর্জাকে আবার গজনী পাঠিয়ে দিলেন সেখানকার শাসনভার অর্পণ করে। অবদুর রজ্জাককে পাঠালেন নতুন বিজিত আফগান অঞ্চলে সেখানকার শাসনভার দিয়ে।
তার
তিনি কন্দহারে অরঘুনদের পরাজিত করেছেন। আফগানরাও বশ্যতা স্বীকার ক’রে নিয়েছে। বর্তমানে একমাত্র তিনিই তৈমূরবংশীয়দের নেতৃস্থানীয়। শইবানি খান ফিরে যাবার ফলে বহির্শত্রুর হাত থেকেও তিনি নিরাপদ। এই সব কারণ থেকেই সম্ভবতঃ তিনি এ সময়ে গৌরবসূচক ‘পদিশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এসময়ে, ১৫০৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ৬ই মার্চ পুত্র হুমায়ূনেরও
জন্ম হয়।
।
বেশিদিন শান্তিতে কাটানো বাবরের ভাগ্যে ঘটলো না। কিছুকালের মধ্যেই কাবুলের দক্ষিণ-পশ্চিমে সীমান্তের মেহমন্দ আফগানরা মুকুরের কাছে বিদ্রোহের পতাকা তুললো। সাথে সাথে তাদের দমনের জন্য সেখানে ছুটে গেলেন বাবর। অভিযান থেকে ফিরে আসার বেলা ক্রুজ বেগ, ফকীর আলী, করীম দাদ, বাবা চুহরা ও অন্যান্য মুঘল বেগেরা জোটবদ্ধ হয়ে বাবরকে ছেড়ে চলে যাবার চক্রান্ত সময়মতো খবর পেয়ে চক্রান্তকারীদের বন্দী করলেন বাবর তাদের প্রাণদণ্ডের হুকুম দিলেন। শেষে কাশিম বেগের হস্তক্ষেপের ফলে তিনি তাদের প্রাণদণ্ড মকুব ক’রে বন্দী ক’রে রাখলেন।
করলো।
এর পরে পরেই আর এক বিরাট চক্রান্তের শিকার হলেন বাবর; এর ফলে তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবার আশংকা দেখা দিল। তার কাবুলে অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে হিসার ও কুন্দুজ থেকে আসা, গুসরাউ শাহের পূর্বতন অনুগামী মুঘল ও চাঘতাই বেগের দল এবং দু থেকে তিনহাজার তুর্কেমান সৈন্য নিয়ে সিউনদুক ও শাহ-নজর গে জোটবদ্ধ ভাবে বাবরের আনুগত্য বর্জন করে, অবছর রজ্জক মীর্জাকে কাবুলের সিংহাসনে বসাতে মনস্থ করলেন। এছাড়া কুণ্ডুজ ও খুটলান সহ ঘুসরাউ শাহের পূর্বতন রাজ্যও তার হাতে অর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই প্রথম চাঘতাই, মুঘল ও তুর্কেমানরা সম্মিলিত ভাবে বাবরের বিরুদ্ধে পতাকা তুলল! এর কারণও ছিল। বাবর সর্বদাই ওদের লুটপাটের প্রবৃত্তিকে কঠোর ভাবে দমন ক’রে এসেছেন। শাসনক্ষেত্রেও তিনি তাদের কোনরকম হস্তক্ষেপ বা প্রাধান্য অর্জনের সুযোগ দিতেন না। তিনি সর্বদাই সেনাবাহিনী মধ্যে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যস্ত। ইদানীং তিনি আবার ‘পাদিশাহ’ উপাধিও গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে তার
অধীনে থেকে
বাবর নামা
তারা যে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবেন না, তা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন সকলে। সুতরাং বাবরকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য ক্রমেই অধীর হয়ে উঠছিলেন তারা।
১৫০৮ অব্দের মে মাসে মেহমন্দ আফগানদের দমন করার অভিযান থেকে ফেরার পথে বাবর এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলেন। কিন্তু প্রথমে তিনি এ সংবাদের উপর কোন গুরুত্ব আরোপ করলেন না। কিন্তু একদিন রাতে তিনি চার-বাগে দরবার কক্ষে থাকা কালে মুসা খাজা এসে খবর দিলেন মুঘলরা সত্যিসত্যিই বিদ্রোহ করেছে। বাবর সাথেসাথে বাগ-ই-নূরুন চক ও বাগ-ই- খিলওয়াত ছুটলেন হারেম রক্ষার জন্য। অতি কষ্টে তিনি শেষ অবধি সেখানে পৌঁছতে পারলেন। দেখলেন, তার অনুগামীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চারদিকে বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। সকলেই পাগলের মতো কাবুল ছুটে চলেছে নিজেদের পরিবারবর্গকে রক্ষার জন্য। ঠিক এরূপ নাটকীয় পরিস্থিতিতেই বাবরের কলম আবার থেমে গেছে। এবং দীর্ঘ এগারো বছরের জন্য। এতএব এ সময়কার ঘটনা জানার জন্য আমাদের অন্যদের বিবরণের
শরণাপন্ন হতে হয়।
ফেরিস্তা ও কাফী খানের বিবরণ থেকে জানা যায় : ব্যাপক দলত্যাগ ফলে তার সেনাবাহিনী ক্ষীণ হয়ে গেলেও তিনি অবিলম্বে তাদের সংঘবদ্ধ ক’রে এই অভ্যুত্থান রুখতে এগিয়ে যান। দীর্ঘকাল মরিয়া সংগ্রামের পর বিদ্রোহীদের ছত্রভঙ্গ ক’রে দিতে তিনি সফল হন। আবদুর রজ্জক তার হাতে বন্দী হলেও
কিন্তু কিছুকাল পরেই তিনি আবার বাবরের
미
পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। ক’রে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। মুঘলরা এ সময় থেকে কখনো আর বাবরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক’রে সফল হতে পারেনি। চাঘতাই মুঘলরাও ক্রমশঃ তাদের প্রাধান্য খোয়াতে থাকে! মুঘলেরা ছাড়া অন্যান্য সব উপজাতির প্রজারাই বাবরকে তার সহজাত প্রতিভা, গুণাবলী ও হৃদয় বৃত্তির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে
এবার বাবর আর তাকে ক্ষমা করলেন না। বন্দী
সমর্থন ক’রে চলেন।
১৫০৮ অব্দের শেষ ভাগ ও ১৫০৯ অব্দে বাবর কোন অভিযানমূলক ক্রিয়াকলাপে ব্রতী হয়েছিলেন এরূপ খবর পাওয়া যায় না। এ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে যে এ সময়ে তিনি আপন রাজ্যের প্রশাসন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। অপরদিকে বুখারাতে গিয়ে মীর্জা খান সেখানকার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন।
বাবর নামা
১৩
এ সময়কার স্মরণীয় ঘটনা মধ্যে একটি হলো ছোটমামা সুলতান আহমদ খানের এক ছেলে সুলতান সৈদ খান চাঘতাইয়ের বাবরের কাছে আশ্রয় গ্রহণ। আরেকটি হল সুলতান হুসেন মীর্জা দুখলাতের ছেলে মীর্জ। হায়দার দুঘলাতের
বাবরের কাছে আগমন। হায়দার তখন মাত্র এগারো বছরের বালক। শইবানি খান তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু আপন এক ভৃত্যের
· সহযোগিতায় পালিয়ে এসে তিনি বাবরের শরণার্থী হন।
১৫১০ অব্দের ২রা ডিসেম্বর একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটলো। পারস্যের শাহের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে মার্ভেতে শইবানি খান শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হলেন ও মর্মান্তিক ভাবে তার মৃত্যু হলো।
এ ঘটনার খবর বাবর প্রথম পেলেন মীর্জা খানের কাছ থেকে। অবশ্য শইবানি খান মারা গেছেন কিনা সে খবর সে নিশ্চিতভাবে জানাতে পারলো না। সে তার চিঠিতে লিখলো : “শাহি বেগ (শইবানি) খান মারা গেছেন কিনা সে কথা জানা নেই। সব উজবেগরা আমু নদীর ওপারে চলে গেছে। মূঘল ঔরুস দুরমান পর্যন্ত কুন্দুজ থেকে পালিয়েছে।
প্রায় কুড়ি হাজারের মতো মুঘল উজবেগদের দল ত্যাগ ক’রে মার্ভ থেকে কুন্দুজে এসেছে। আমিও সেখানে এসেছি। এই সুযোগে পৈতৃক রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টার ব্রতী হবার জন্য সে বাবরকে তার সাথে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানালে। এর চেয়ে আনন্দকর আমন্ত্রণ বাবরের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। সাম্রাজ্যের স্বপ্ন তার মনে আবার বিচিত্র বর্ণ হয়ে দেখা দিল। নাসির মীর্জার উপর কাবুলের ভার দিয়ে তিনি সাথে সাথে সমরকন্দের দিকে যাত্রা করলেন। প্রখর শীতের মধ্যে সাধ্য মতো দ্রুত গতিতে আব-দর গিরিপথ পার হয়ে বামিয়ানে গিয়ে ঈদ-উৎসব পালন করলেন। কুন্দুজ পৌঁছলেন গিয়ে জানুয়ারী ১৫১১ অব্দের আরম্ভে।
শেরিম তঘাই আয়ূব বেগচিক প্রভৃতি যে সব মুঘল আমীর এ সময় পর্যন্ত বাবরের অনুগামী ছিলেন তারা বর্তমান রাজনৈতিক ওলট-পালট পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আবার মূঘল রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী হয়ে উঠলেন। হাতের কাছে বাবরের নিকট অশ্রিত সুলতান সৈদ চাঘতাই-কে পেয়ে তাকে মুঘলদের খান পদে বসাবার নিষ্পত্তি গ্রহণ করলেন। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে কিন্তু সুলতান সৈদ চাঘতাইয়ের
বাবরকে হত্যার চক্রান্ত শুরু করলেন তারা। কাছে এ প্রস্তাব রাখতেই তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। উপকারী বাবরের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হতে রাজী হলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে তারা বাবরকে
১৪
বাবর নামা
হত্যার পরিকল্পনা ছেড়ে দিলেন। সৌভাগ্যের বিষয়, ঠিক এ সময়েই অন্দিজান থেকে হায়দার মীর্জা দুঘলাতের কাকা বাবরের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। তিনি তখন উজবেগদের তাড়িয়ে অন্দিজান অধিকারের জন্য চেষ্টা ক’রে চলছিলেন। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে বাবর সুলতান সৈদ ও মুঘল আমীরদের সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। ১৫১১-র ১৩ই মে তারা সেখানে সুলতান সৈদকে
খান-পদে বসালেন।
বাবর কিছুকাল কুন্দুজে বিশ্রাম নিয়ে, শীতকাল পার হবার পর মীর্জা খানকে সাথে নিয়ে আমুনদী পার হয়ে হিসার দুর্গ— অধিকারের জন্য অভিযান শুরু করলেন। কিন্তু সে চেষ্টায় বিফল হলেন তিনি। ফিরে এলেন আবার
কুন্দুজে।
এ সময়ে পারস্যের শাহ ইসমাইল সফবীর দূত বাবরের বড়ো বোন খানজাদা বেগমকে নিয়ে কুন্দুজে বাবরের কাছে উপস্থিত হলেন। খানাজাদা বেগমের প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামী শইবানি খান ও সঈদ হাদী দুজনেই মার্ভের যুদ্ধে মারা যান। খানজাদা বেগম পড়লেন পারসিকদের হাতে। শাহ তাকে বাবরের বোন বলে জানতে পেরে সসম্মানে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন তার সম্পত্তি ও পরিচারিকা
সহ।
শাহর কাছ থেকে শুভেচ্ছার নিদর্শন পেয়ে বাবর এই সুযোগে তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে মন দিলেন। বোনের প্রতি শাহ যে সম্মান ও সৌজন্য দেখিয়ে- ছেন সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে উপযুক্ত উপহারসম্ভার-সহ মীর্জা খানকে তার কাছে পাঠানো হলো। অভিনন্দন জানাতেও ভুললেন না উভয়ের চরম শত্রু শইবানি খানকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করার জন্য। সহযোগিতা চাইলেন পৈতৃক রাজ্য উদ্ধার কল্পে।
শাহ ইসমাইল ফবী রাজী হলেন। চুক্তি সম্পাদিত হলো। কিছুদিনের মধ্যেই সৈয়দ মহম্মদ মীর্জার কাছ থেকে খবর এলো, তিনি ফরঘান থেকে উজবেগ- দের হটিয়ে দিয়েছেন। বাবর উৎসাহিত হলেন। হিজরী ৯১৭ বা ১৬১১-১২ অব্দে তিনি কুন্দুজ ছেড়ে সসৈন্যে আবার হিসার অভিযানে এগিয়ে চললেন। সুরখ-আব নদী তীরে ছাউনি ফেলে অপেক্ষা ক’রে চললেন শাহের সাহায্যের জন্য। প্রায় মাস খানেক অপেক্ষা করার পর মীর্জা খান শাহের কাছ থেকে এক বিরাট সাহায্যকারী সেনা নিয়ে বাবরের সাথে যোগ দিলেন।
শইবানি খানের মৃত্যুর পর তার ছেলে তৈমূর সুলতান উজবেগ প্রধান
বাবর নামা
।
১৫
নির্বাচিত হলেন না। উজবেগরা তাদের প্রচলিত প্রথা মতো আবুল থৈর-এর ছেলে কুচুন সুলতানকে প্রধানের পদে বসালেন। শইবানি খানের বিশাল সাম্রাজ্য যাতে তাদের হাতছাড়া না হয় এজন্য শইবানি খানের বংশধর ও পরিবারের অন্যান্যদের মধ্যে তা বেঁটে দেয়া হলো। সুতরাং অপ্রতিরোধ্য শইবানি খানের মৃত্যু হলেও তার ফলে উজবেগরা দুর্বল হয়ে পড়লো না। বরং একের বদলে অনেকে এবার ঐক্যবদ্ধ হলেন তার সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য। হিসার ও চঘানীয়ান পড়েছিল হম্জ সুলতান ও মেহদী সুলতানের ভাগে। সুলতানের ভাগে।
।
আর সমরকন্দ তৈমুর
উজবেগরা বাবরের অগ্রগতির খবর পেলেন। জানতে পেলেন শাহের সাথে তার চুক্তির কথাও। সুতরাং শাহের পাঠানো মূল সেনাবাহিনী বাবরের সাথে যোগ দেবার আগেই তারা বাবরকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এজন্য প্রায় মাসখানেক পর একদিন ভোরে তারা সুরথ-আব নদী সাঁতরে পার হলেন। বিকাল নাগাদ গুপ্তচরের মুখে সে খবর জানতে পেলেন বাবর। সাথে সাথে আব-দরার খাড়া ও সংকীর্ণ পর্বতমালা মধ্যে সরে গেলেন তিনি। সারা রাত ও পরদিন দুপুর পর্যন্ত পিছু হটে যুদ্ধের উপযুক্ত একটি স্থানে পৌঁছে সেখানে সৈন্য সমাবেশ করলেন। উজবেগ বাহিনীর একাংশ তৈমুর সুলতানের অধীনে এগিয়ে এসে পাহাড়ে চড়ার চেষ্টা শুরু করলো। প্রায় দশহাজার সৈন্য। তাদের বাধা দেবার জন্য বাবর সাথে সাথে মীর্জা খানের অধীনে এক বাছাই সেনা- দল পাঠালেন! উজবেগরা আক্রমণ ক’রে মীর্জা খানকে পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ ক’রে দিল। এমন সময় বাবরের নির্দেশে মীর্জা হায়দারের অনুগামী মীর্জা মুঘল সেনাবাহিনী তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। এরা সংখ্যায় ছিল প্রায় তিন হাজার। এরা মূলতঃ মুহম্মদ হুসেন মীর্জা দুঘনাতের অনুগামী।
। তার মৃত্যুর পর থুরাসান থেকে পালিয়ে কুন্দুজে এসে তার ছেলে মীর্জা হায়দারের সাথে যোগ দিয়েছিল। মীর্জা হায়দার তখন সবে ১২ বছরের বালক। তাই তাকে নিজের সাথে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়ে তার সেনাবাহিনীকে বাবর মীর্জা খানকে সাহায্যের জন্য যাবার আদেশ করলেন। জানি আহদম আটকার নেতৃত্বে এই বাহিনী মীর্জা খানকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়ে উজবেগদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আসন্ন সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পেলেন মীর্জা খান। জানি আহমদ আটকার আক্রমণে উজবেগরা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে পিছু হটে গেল। কয়েকজন উজবেগ নেতা বন্দী হলেন। বাবরের কাছে নিয়ে আসা হলো তাদের।
১৬
বাবর নামা
একে শুভ লক্ষণ রূপে বিচার ক’রে বাবর বন্দীদের মীর্জা হায়দার দুঘলাতের নামে উৎসর্গ করার আদেশ দিলেন।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চললো। দুই পক্ষই হেস্তনেস্ত করার জন্য মরিয়া। বাবর যেখানে আস্থান নিয়েছেন সেখানে যাবার পথ খুবই সংকীর্ণ। কাজেই প্রতিপক্ষ সহজে তাকে ভেদ করার সুযোগ পেল না। এ ছাড়া এখানকার ভূ-প্রকৃতিও সহজভাবে চলাফেরার উপযুক্ত ছিল না। জলের অভাবেও উজবেগ- দের দুর্গতির সীমা রইলো না। তারা যেখানে সমবেত হয়েছেন তার চার- দিকে চার পাঁচ মাইলের মধ্যে কোথাও জল নেই। বাধ্য হয়েই রাতে পিছু হটলেন তারা হজ সুলতানের নেতৃত্বে। যে উজবেগ বাহিনী মীর্জা খানের বিরুদ্ধে লড়াই ক’রে চলছিল তারা মূল বাহিনী নিয়ে হজ সুলতানকে পিছু হটতে দেখে দমে গিয়ে নিজেরাও সেই পথ ধরলো। সুযোগ পেয়ে মীর্জা খান এবার প্রবল বিক্রমে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করলো তৈমুর সুলতানের বাহিনী। মূল বাহিনীও ওই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। তারাও এবার পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। যুদ্ধে জিতে গেলেন বাবর। হজ সুলতান, মেহদী সুলতান, হজ সুলতানের ছেলে মামক বন্দী হলেন। মুঘল, থাকান ও চাঘতাই সুলতানদের প্রতি উজবেগরা যে রকম আচরণ করেছে ঠিক সেই আচরণই করা হলো তাদের প্রতি। রক্তের বদলে রক্তে তার প্রতিশোধ নেওয়া হলো। প্রাণ দিতে হলো বন্দীদের। রাত থেকে শুরু ক’রে সকাল পর্যন্ত সমান ভাবে পিছু তাড়া ক’রে দরবন্দ- ই-অহীনন ( লৌহ ফটক )-এর দেয়াল পর্যন্ত হটিয়ে দেয়া হলো উজ- বেগদের। হিসার-সাদমর, খুটলান, কুন্দুজ ও বাঘলানের দুগ গুলি বাবরের অধিকারে এলো।
এই বিজয় সংবাদ জানিয়ে বাবর এবার শাহের কাছে সমরকন্দ জয়ের জন্য সহযোগিতা চাইলেন। শাহ সর্ত সাপেক্ষে তাকে সাহায্য করতে রাজী হলেন। সমরকন্দ সহ তার রাজ্যের সর্বত্র বাবরকে শাহের নামে
এই সর্তগুলি হলো :
‘খুতবা’ পাঠ করতে হবে। মুদ্রারও প্রচলন করতে হবে শাহের নামে। এছাড়া রাজ্য মধ্যে সিয়া মতবাদের প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
সমরকন্দ জয়ের স্বপ্ন সফল করতে হলে শাহের সাহায্য জরুরী বুঝেই সম্ভবতঃ বাবর তার শর্ত মেনে নিলেন। নতুন বিজিত রাজ্যসমূহে তিনি শাহের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলনে রাজী হলেন। শাহকে এক পত্ৰ দিয়ে
বাবর নামা
১৭
জানালেন, তিনি মুদ্রার উপর শুধু দ্বাদশ ইমামের মূর্তিই ছাপবেন না, নিজেও শীয়া পোষাক পরবেন ও উজবেগদের ধ্বংস করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। শাহ এতে সন্তুষ্ট হয়ে বাবরকে সাহায্যের জন্য আহমদ বেগ সফবী, আলীখান ইস্তিলঙ্গ, ও শাহরুখ সুলতান আফশার প্রভৃতির অধিনায়কত্বে ছয় হাজার সেনার এক বাহিনী পাঠালেন তার কাছে।
ষাট হাজার সেনার বিরাট এক বাহিনী নিয়ে বাবর এবার বুখারা ও সমরকন্দের দিকে এগোলেন। আতঙ্কিত হয়ে উজবেগরা পালিয়ে যেতে থাকলো। অনায়াসে খোজার ও অন্যান্য অঞ্চল অধিকার করলেন তিনি।
উজবেগ প্রধানরা পিছু হটে সমরকন্দ গিয়ে’ বাবরকে প্রতিরোধ করার উপায় নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
বাবর এবার বুখারায় প্রবেশ করলেন। যুদ্ধে পরাস্ত ক’রে উবায়েদুল্লাহ খানকে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য করলেন। তার ও তার বাহিনীর সর্বস্ব লুটে নেয়া হলো। উজবেগরা পালিয়ে গিয়ে তুর্কীস্তানের মরু অঞ্চলে আশ্রয় নিলো। উবায়েদুল্লাহ খানের পরিণতি সমরকন্দে জমায়েত উজবেগ প্রধানদেরও ভীত-সন্ত্রস্ত ক’রে তুললো। বাবরকে বাধা দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেললেন তারা। তাড়াতাড়ি সমরকন্দ ত্যাগ ক’রে তারাও তুর্কীস্তানের মরু অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। ‘ ১৫১১ অব্দের ৯ই অকটোবর বাবর তৃতীয়বার সমরকন্দ প্রবেশ করলেন। সেখানকার সর্বস্তরের অধিবাসীরা তাকে উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনা জানালেন, আনন্দের সঙ্গে বরণ ক’রে নিলেন। সবাই আশা করলেন- তার অধীনে এবার তারা সুখে-শান্তিতে দিন কাটাবেন।
বিরাট জাকজমকের সঙ্গে সমরকন্দ প্রবেশ করলেন বাবর। দ্বাদশ ইমামের নামে খুতবা পাঠ করা হলো, মুদ্রা প্রচলিত করা হলো। পারসিক সৈন্য- বাহিনীকে উদারভাবে পুরস্কৃত ক’রে বিদায় দিলেন তিনি। মধ্যে পরবর্তী আটমাস সেখানেই কাটালেন।
আনন্দ উৎসবের
সমরকন্দের সিংহাসনে বসার পর পারস্যের শাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাবরকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। এখানকার অধিবাসীরা মূলতঃ সুন্নী সম্প্রদায়ের। তারা বাবরের শীয়া প্রীতিকে মোটেই ভালো চোখে দেখল না। বাবর নিজের ভুল বুঝতে পারলেও তিনি অসহায়। একা একা উজবেগদের দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা তার নেই। সুতরাং রাজ্যের স্বার্থে শাহের সঙ্গে সম্প্রীতি রক্ষা ক’রে চলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ফলে তার কার্যকলাপ দিন দিন প্রজাদের
٩
১৮
বাবর নামা
অথুসী করে চললো। তার প্রতি বিরাট শ্রদ্ধা, তার কাছ থেকে বিরাট আশা মুছে গেল তাদের মন থেকে। দীর্ঘকালের প্রচেষ্টায় তিনি তার যে বিরাট ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন সমরকন্দবাসীদের মধ্যে তা এবার শূন্যে মিলিয়ে গেল। দিন দিন অপ্রিয় হয়ে চললেন তিনি। বাধ্য হয়েই তিনি এবার তুর্কেমানদের সমর্থনের দিকে ঝুঁকে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা সুরু করলেন।
সমরকন্দবাসীদের মনোভাব প্রকৃত পক্ষে বাবরকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিল। তিনি না পারছেন শাহের সাথে চুক্তির শর্তগুলি আন্তরিক- ভাবে পালন করতে, না পারছেন প্রজাদের বোঝাতে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুনই তাকে বাধ্য হয়ে এ পথ বেছে নিতে হয়েছে, সুযোগ পেলেই তিনি শাহের আনুগত্য বর্জন করবেন। ফলে প্রজাদের সাথেও যেমন তার ঠাণ্ডা লড়াই সুরু হলো, তেমনি ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হলো, পারস্যের শাহের সাথেও। বাবরের উপর তার আধিপত্য প্রদর্শনের জন্য অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই শাহ তার এক সভাসদকে সমরকন্দ পাঠালেন। তার মাধ্যমে তিনি বাবরকে তার পদ – মর্যাদার উপযুক্ত খেতাব দান করলেন এবং সমরকন্দ ও বুখারার শাসক রূপে স্বীকৃতি জানিয়ে ফরমান জারী করলেন। মীর্জা খানকে স্বীকৃতি দিলেন শাদমান, খৃটলান ও বদকশানের শাসক রূপে। এতে বাবর এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়লেন। কিন্তু পরিস্থিতিকে আপাততঃ নীরবে মেনে নিলেন তিনি। আহমদ বেগ ও সাহরুথকে দিয়ে শাহের কাছে উপহার পাঠালেন। শাহের সভাসদ মুহম্মদ জান ইসাককে ইচ্ছে ক’রেই আটকে দিলেন তিনি।
শাহ প্রথম থেকেই কতক পারসিককে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সমরকন্দে মোতায়েম রেখেছিলেন। তারা যখন দৈনন্দিন শাসনকার্যেও নিয়মিত হস্তক্ষেপ সুরু করলো তখন বাবর অতিষ্ঠ হয়ে মহম্মদ জান ইসাককে জানিয়ে দিলেন যে শাহ তার প্রতি যে সব অনুগ্রহ দেখিয়েছেন তাতে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন।
ইসাক গোপনে সে সংবাদ শাহকে জানালেন। তার কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ থেকে শাহ ধারণা করলেন বাবর বিদ্রোহ করার সুযোগ খুঁজছে।
এদিকে সমরকন্দের সুন্নী অধিবাসীদের প্রতি পারসিকদের নৃশংস মনোভাব, পীড়নমূলক কার্যকলাপ ও ধর্মীয় অন্ধ উন্মাদনামূলক ক্রিয়াকলাপ বাবরকে ব্যথিত ও অসহিষ্ণু ক’রে তুললো। তিনি এবার জোর ক’রে তার পারসিক সমর্থকদের বরখাস্ত করলেন। সুন্নী সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ও সন্তু ব্যক্তিদেরও তিনি অভিযুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গী ও শাহের
বাবর নামা
হাতের পুতুল হয়ে কাজ ক’রে চলার অনিচ্ছার কথা বুঝতে পেরে ইসাক শাহের কাছে এ সম্পর্কে খবর পাঠালেন। শাহ সাথে সাথে বাবরকে বশে আনার জন্য সেনাপতি নজম-উস-সানিকে আদেশ দিলেন।
এগারো হাজার সৈন্য নিয়ে নজম-উস-সানি, জইনুল অবদিন বেগ সফৰী, পীর বেগ কজর ও বিদিনজান রুমূলূ সমরকন্দ যাত্রা করলেন। তারা সমরকন্দ যাত্রার অল্পকাল মধ্যেই সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন গতি নিলো। পারসিকদের বিতাড়িত করা হয়েছে ও শাহের সাথে বাবরের বিরোধ চলছে এ খবর উজবেগদের কাছে পৌঁছতে দেরি হলোনা। উবায়েদুল্লহ খান সাথে সাথে তার নষ্টরাজ্য উদ্ধারের জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। তারা তাসকিণ্ট ও বুখারা আক্রমণের জন্য এগিয়ে এলেন। এই দ্বিমুখী অভিযানের ফলে দুই রণক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলা করার চাপের মধ্যে পড়ে গেলেন বাবর। তখন তার বিশ্বাস- ভাজন অনুগামীর সংখ্যা সীমিত। তবু উজবেগদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তাদেরই একাংশকে পাঠালেন তাসকিন্ট, তৈমুর সুলতানের গতিরোধ করার জন্য। বাবর নিজে যত যা সৈন্য সংগ্রহ করতে পারলেন তা নিয়ে এগোলেন বুখারার দিকে। মুহম্মদ মজীদ তরখান অবশ্য বারবার তাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি শুনলেন না তা।
বাবর ভেবেছিলেন উজবেগরা সংখ্যায় খুব অল্প। তিনি দ্রুত এগিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে সহজেই কাবু ক’রে ফেলতে পারবেন তাদের। তার অনুমান অবশ্য সত্য হলো! উবায়েদুল্লহ খান বাবরের অগ্রগতির সংবাদ পেয়েই তাড়াতাড়ি পিছু হটতে থাকলেন। বাবর তাকে পিছু তাড়া ক’রে চললেন এবং কুল-ই-মলিক পৌঁছে ধরে ফেললেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন যে এই পিছু পালিয়ে আসা বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি ঘটাতে ইতিমধ্যে তৈমুর সুলতান ও জানি বেগ একটি শক্তিশালী দল নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
।
বাবর পিছু তাড়া ক’রে এখন এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন যে তার পিছু হটা বেশ কষ্টকর। যা হয় হবে, এই মনোভাব থেকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যুদ্ধে প্রচুর উজবেগ সেনা প্রাণ হারালে।। বন্দী হলো ঊরুস বেগ, কুপুক বেগ, আমীর খাজা কিকরাত এবং আরো কতক উজবেগ নেতা। বাবরের নির্দেশে তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হলো। অপরদিকে উজবেগরাও শত্রুপক্ষের লোকদের গায়ের চামড়া তুলে নিলো, বধ ও বন্দী করলো। শেষ
১০০
বাবর নামা
পর্যন্ত বাবর নিদারুণ ভাবে পরাজিত হলেন এ যুদ্ধে। বুখারায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হলেন তিনি। ১৫১২ অব্দের এপ্রিল-মে মাসের ঘটনা এসব।
উজবেগরা প্রচণ্ডভাবে পিছু তাড়া ক’রে আসার দরুন বুখারায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লো বাবরের পক্ষে। রাজধানী সমরকন্দে চলে এলেন তিনি। এসে দেখেন সেখানকার পরিবেশও সম্পূর্ণরূপে তার বিপক্ষে। তাদের কাছে তিনি ইতিমধ্যেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সুতরাং তার সাথে তারা কোনরকম সহযোগিতার মনোভাব দেখালেন না। এ অবস্থায় শত্রুকে বাধা দেবার মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়লো। বাধ্য হয়ে পরিবারবর্গ ও তল্পিতল্পা নিয়ে হিসারের দিকে রওনা হলেন তিনি। দখলে চলে গেল। বাবরের বয়স এ সময়ে তিরিশের নিচে। এ বছরের জুলাই-আগষ্ট মাস নাগাদ তারা বাবরকে হিসার থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য
যাত্রা করলো।
বুখারা আবার উজবেগদের
হিসার পৌঁছে বাবর সেখানে দৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। পরেস্যের শাহ ইসমাইল সফবীর কাছে দূত পাঠালেন এ : বপর্যয়ের খবর দিয়ে।
তাকে সনির্বন্ধ আবেদন জানিয়ে চললেন সাহায্যের জন্য। অগত্যা শাহ নজম-উস-সানিকে নির্দেশ দিলেন বাবরের সাথে সহযোগিতা করার জন্য। ইতিমধ্যে মীর্জা খানের সাহায্য নিয়ে তিনি হিসার নগরীর চার পাশে পরিখা খুঁড়ে ফেলেছেন। বালখের ওয়ালী বা শাসক বৈরাম বেগ করমনলুর কাছে সাহায্যের অনুরোধ করায় তিনিও তিনশো সেনা পাঠিয়েছেন৷ উজবেগরা এসে দেখলে যে বাবর মরিয়াভাবে মরণ-পণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। অতএব আক্রমণ পরিকল্পনা ছেড়ে মুয়ারন-উন-নহরে ফিরে গেলেন তারা।
নজম-উস-সানি যখন খুরাসানে পৌঁছে বালখে ছাউনি ফেলে আছেন এমনি সময়ে তার কাছে শাহের জরুরী নির্দেশ পৌঁছাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবরের সাহায্য করতে এগিয়ে যাবার জন্য। তিনি সাথে সাখে বাবরকে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য, শাহের অপরিমেয় বদান্যতার খবর দিয়ে তার কাছে আমীর ঘয়াসুদ্দীনকে পাঠালেন! অনুরোধ করলেন তার সেনাদল নিয়ে তীরমীদ্ধে পারসিক বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য। দরবন্দ-ই-অহনীনে মিলিত হলেন দুজনে। শাহের পক্ষ থেকে তারা বাবরকে সংবর্ধনা জানালেন! উভয়ে একত্র হয়ে তখন এগিয়ে চললেন খোজার। খোজার দখল ক’রে এগোলেন করশী। বিদ্যুতবেগে ঝাঁপিয়ে পরে তাও দখল ক’রে নিলেন।
বাবর নামা
এরপর মিলিত বাহিনী এগিয়ে গেল বুখারার দিকে। বুখারার নিকটবর্তী এক মরুভূমির কাছে অবস্থিত ঘজদওয়ান পৌঁছে সেখানকার দুর্গ অবরোধ করলেন। তৈমুর সুলতান বিক্রমের সাথে দীর্ঘ চারমাস তাদের প্রতিরোধ ক’রে চললো। বাবরের অগ্রগতি উজবেগদের বিপর্যয়ের কারণ হবে বুঝে উজবেগ শাসকরা জোটবদ্ধ হয়ে ইতিমধ্যে উবাদুয়েল্লহ খান ও জানি বেগের নেতৃত্বে বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে দুর্গরক্ষার জন্য এগোলেন। তৈমুর সুলতানও দুর্গ থেকে সকলের অজানাভাবে এসে তাদের সাথে যোগ দিলেন।
নজম-উস-সানির সেনানায়ক অভিজ্ঞ কামালুদ্দীন মহম্মদ এবং বাবর এ জাতীয় মিলিত আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে তাকে আগে থেকেই সতর্ক ক’রে চলছিলেন। কিন্তু নজম-উস সানি তাদের কথায় প্রথমে কান দিলেন না। যখন দিলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবরোধ প্রত্যাহার ক’রে নিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন পারসিক বাহিনীকে চারদিক থেকে উজবেগরা ঘেরাও করেছে। ১৫১৪ অব্দের ২২শে অকটোবর সংঘর্ষ শুরু হলো। পারসিক বাহিনী বহুক্ষণ ধরে বাধা দিলেও শেষ পর্যন্ত উজবেগদের কাছে এঁটে উঠতে পারল না। নজম-উস-সানি উজবেগদের হাতে বন্দী হয়ে প্রাণ হারালেন। যে সব পারসিক প্রধানরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে খুরাসান ফিরলেন তাদের মধ্যে কতক অসন্তুষ্ট শাহের হাতে বন্দী হয়ে প্রাণ দিলেন।
পারসিক ঐতিহাসিকেরা পারসিক বাহিনীর এ পরাজয়ের জন্য বাবরকে দায়ী ক’রে গেছেন। কিন্তু তা সম্পূর্ণ অযোক্তিক বলেই মনে হয়। কেননা! নজম-উস-সানি প্রথম থেকেই বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর বর্বরোচিত আচরণ ক’রে চলেছিলেন। বাবরকেও তিনি কার্যতঃ প্রায় বন্দীই করেছিলেন। তার কোন অনুরোধ ও উপদেশেই তিনি পূর্বাপর কান দেননি। এ ক্ষেত্রে এই অভিযানে বাবরের ভূমিকা ছিল অতি নগণ্য। তিনি অসহায় দর্শকে পরিণত হয়েছিলেন মাত্র। পারসিক সেনাপতির অদূরদর্শিতাই পারসিকদের বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এ বিপর্যয় তার পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয় বুঝেই সম্ভবত : পারসিক বাহিনীর বিপর্যয় শুরু হতে বাবর যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যান ও শাদমান হিসারে গিয়ে আশ্রয় নেন।
দুর্ভাগ্য ঘিরে ধরলো বাবরকে। নভেমবর মাসে তার অনুগামী মুঘলরা আবার তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো। ইয়াদগার মীর্জা, নাসির মীর্জা, আয়ুৰ বেগচীক ও মহম্মদের নেতৃত্বে তারা হঠাৎ বাবরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বহু
বাবর নামা
অনুগামীকে হত্যা করলো। যা পারলো লুটপাট করে তিগিন প্রস্থান করলো। এ বিদ্রোহের সঠিক কারণ অবশ্য জানা যায় না। ফেরিস্তার বিবরণ অনুসারে মুঘলদের লুটপাটের প্রবৃত্তিই এর মূল কারণ। বাবর কঠোর ভাবে তাতে বাধা দিয়ে চলার দরুনই তারা ক্ষেপে গিয়ে বিদ্রোহ করে।
বহু কষ্টে হিসার দুর্গে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচালেন বাবর। উজবেগদের প্রাধান্য যে সময় অপ্রতিহত ভাবে বেড়ে চলেছে, এবং নিজে গভীর বিপদের আবর্তে, এ সময় দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি বিধান তার পক্ষে অসম্ভব বুঝে সামান্য কিছু অনুগামীকে হিসার রেখে, মীর্জা খানের কাছে কুন্দুজে এলেন বাবর। তিনি স্থান ত্যাগ করার পর হিসারের অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষ, তুষারপাত ও মুঘলদের লুটপাটের দরুন গভীর দুর্দশার কবলে পড়লো। ফলে বুখারার শাসক উবায়েদুল্লাহ খান মুঘলদের তাড়িয়ে হিসার দখল ক’রে নেবার জন্য উদ্যোগী হলেন। সফলও হলেন তিনি।
এভাবে হিসারও হাতছাড়া হয়ে গেল।
বাবরের পরবর্তী কয়েক মাসের কার্যকলাপ নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। খওয়ান্দ-আমীরের বিবরণ অনুসারে তিনি এ সময় খিসুমে অতিবাহিত করেন। কিন্তু মীর্জা হায়দার দুঘলাতের বর্ণনা অনুসারে তিনি কুন্দুজেই থেকে যান। এ সময়ে তাকে গভীর দুর্দশা ও অর্থকষ্ট সইতে হয়। এ অঞ্চল তখন মীর্জা খানের অধীনে। তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে তা দখল ক’রে নিতে চাইলেন না বাবর।
যখন বাবর নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন যে এ ভাবে এখানে অপেক্ষা ক’রে চলা অর্থহীন, বর্তমান পরিস্থিতিতে হিসার ও সমরকন্দ পুনরুদ্ধার তার পক্ষে অসম্ভব, তখন তিনি কাবুল রওনা হলেন। অল্প কিছু অনুগামীকে নিয়ে হিন্দুকুশ পেরিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানে। বিরাট জাঁকজমকের সাথে ভাই নাসির মীর্জা তাকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানালেন।
মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন এভাবেই শেষ পর্যন্ত খান খান হয়ে গেল
বাবরের।
তবে, এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে বাবর একটি পরম শিক্ষা লাভ করলেন। তা হলো : ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করার শিক্ষা। সব ধর্মমতের প্রতি সহিষ্ণু ও উদার দৃষ্টিভঙ্গী অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা।