বাবর নামা – ১১

এগার

হিন্দুস্তানের সিংহাসনে বসে পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দু দিক থেকে দুই প্রবল শত্রুগোষ্ঠীর চাপের মধ্যে পড়ে গেলেন বাবর। পূব থেকে চাপের সৃষ্টি করলো আফগানরা। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে রাজপুতরা।

পানিপথের যুদ্ধে লোদী রাজবংশের পতন ঘটলেও আফগান উপজাতির প্রধানরা সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে ছিলেন। ইব্রাহীম লোদীর পরাজয়কে তারা মুঘলদের হাতে আফগানদের চূড়ান্ত পরাজয় হিসেবে মেনে নিলেন না! নিজেদের অধিকার ও প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য তারা সংঘবদ্ধ হয়ে মুঘলদের এ দেশের মাটি থেকে হটিয়ে দেবার চেষ্টায় ব্রতী হলো। সম্ভলে কাশিম খান সম্ভল, দূলপুর (ধউলপুর)-এ মুহম্মদ জৈতুন, গোয়ালিয়রে তাতার খান সারঙ্গখানী, রাপ্রীতে হাসান খান লোহনী, এটোয়ায় কুতব খান, কনৌজে আলম খান, বিহারে নাসির খান লোহনী ও মরুফ ফরমূলী এবং এরকম আরো বহু আফগান ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রধানরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলো। এদের একাংশ দরয়্যা খান নুহানীর ছেলে বিহার খানকে সুলতান মুহম্মদ নাম দিয়ে বিহারে সিংহাসনে বসালে৷ অন্য অংশ সুলতান হিসেবে ঘোষণা করলে ইব্রাহীম লোদীর ভাই মামুদ লোদীকে।

অন্যদিকে রাজপুত শাসকরাও মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। রাণা সংগ্রাম সিংহ বহুদিন থেকেই আগ্রা পর্যন্ত রাজপুত সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখে আসছেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সাথে কম করেও ১৮টি যুদ্ধ করেছেন এবং সব কটি যুদ্ধেই তার জয় হয়েছে। এর ফলে তার খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও অর্থ-সামর্থ্য সকলের শীর্ষে। তিনি ভেবেছিলেন তৈমুরের মতো বাবরও লুটপাট করেই ফিরে যাবেন। কিন্তু যখন দেখলেন বাবরের মতিগতি কিংবা পরিকল্পনা সে রকমের নয়, তিনি হিন্দুস্তানের বুকে সাম্রাজ্য গড়ে স্থায়ীভাবে এখানে শিকড় গাড়তে চাইছেন, তখন স্বভাবতই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিচার করতে শুরু করলেন। ভালভাবে এখানে শিকড় ছড়িয়ে বসার আগেই তাকে উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট হলেন তাই।

আফগান প্রধানদের প্রথম থেকেই বাবর ছলে কৌশলে নিজের দলে টানবার চেষ্টা ক’রে আসছিলেন। পদ, জায়গীর ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি প্রভৃতির টোপ ফেলেছিলেন সেজন্য। অনেকেই এতে সাড়া দিয়েছিল। বহু

রাবর নামা

১৩১ :

প্রধান তার অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেছিল, অসংখ্য আফগান যোগ দিয়েছিল, তার সেনাদলে। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে নাম করার মতো হলেন কোল বা আলিগড়ের শেখ ফুরন। নিরাপত্তা ও জায়গীরের প্রতিশ্রুতিতে তিনি তিরিশ হাজার সেনা ও তীরন্দাজ নিয়ে বাবরের পক্ষে যোগ দিলেন। এ ভাবে আনুগত্য স্বীকার ক’রে নেয়ার জন্য শেখ বায়জীদ ফরমূলীকে অযোধ্যায় জায়গীর দেয়া হলো। ফিরুজ খানকে দেয়া হলো জউনপুরে। মাহমুদ খান নুহানীকে ঘাজীপুরে অন্যান্য গোষ্ঠীদের ক্ষেত্রেও এই একই নীতির অনুসরণ করলেন বাবর। সূচনায় এ নীতি সুফল দিলেও, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিপদের কারণ হয়ে উঠলো।

বাবর ভেবেছিলেন, আফগান প্রধানদের সকলেই একে অন্যের পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে তার বশ্যতা মেনে নেবে। কিন্তু কার্যতঃ তা হলো না। আফগান ও রাজপুত দুই প্রতিপক্ষই তার সাম্রাজ্যের স্থিতির পক্ষে বিপদস্বরূপ হয়ে দেখা দিল।

দুই প্রতিপক্ষের সাথে একই কালে লড়াই অসম্ভব। পরামর্শ সভা ডাকলেন বাবর। স্থির হলো, আফগানদের বিরুদ্ধেই আগে পদক্ষেপ নেয়া হোক। হিন্দু-প্রধান দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তারা জনপ্রিয় নন, জনসাধারণের সাথে তাদের কোন আত্মিক সংযোগ নেই। সুতরাং প্রথমে তাদের হটানোই সহজ ও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সিদ্ধান্তমতো হুমায়ূনকে পূর্বদিককার আফগান- দের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পাঠানো হলো। ১৫২৬ সনের ২১শে আগষ্ট এজন্য বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রা থেকে রওনা হলেন হুমায়ূন। সফল হলে। তার অভিযান। একে একে জউনপুর, ঘাজীপুর ও কাল্পী দখল ক’রে সেখানে মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু পিতার কাছ থেকে ডাক পেয়ে অভিযানের পরবর্তী অংশ অসমাপ্ত রেখেই পরের বছরের ৭ই জানুয়ারী আগ্রায় ফিরে আসতে হলো তাকে।

এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিককার পরিস্থিতিও বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। সেজন্যই পূব থেকে হুমায়ুনকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বাবরকে হটানোর জন্য ইব্রাহীম লোদীর ভাই মামুদ লোদী ও মেওয়াতের শাসক হাসান খান মেওয়াতী প্রভৃতির নেতৃত্বে আফগানরা রাজপুত রাজ্যসংঘের নায়ক সংগ্রাম সিংহের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছেন। সৃষ্টি হয়েছে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির, রাজপুত-মুঘল অিনবার্য সংঘর্ষের পরিবেশ। রাজপুতদের ঠেকিয়ে রাখার জন্য ব!বর বয়ান

১৩২

দুর্গ অধিকারের সিদ্ধান্ত নিলেন।

বাবর নামা

এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য বয়ান দুৰ্গাধীপ নিজাম খানের বড়ো ভাই থানাগড় দুর্গরক্ষক আলম খানকে তিনি হাত করলেন। তাকে দিয়ে বয়ান দুর্গ আক্রমণ করালেন। তারূদী বেগের অধীনে সেনাবাহিনীও পাঠান হলো।

তাকে সাহায্যের জন্য

৷ কিন্তু ব্যর্থ হলো

তারা। আলম খান তার সমস্ত তল্পিতল্পা সহ বন্দী হলেন।

এর পরেই রাণা সংগ্রাম সিংহ বয়ান অধিকারের জন্য তৎপর হলেন। দুর্গ-অধীশ নিজাম খান উভয় সঙ্কটে পড়লেন এবার। এদিকে বাবর তাকে গ্রাসের জন্য উদ্যত, ওদিকে রাণা সংগ্রাম সিংহ। অতএব যে কোন একজনের কবলস্থ হওয়া অনিবার্য

। জেনে, আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ক’রে তিনি উভয়ের সাথেই আলাপ আলোচনা জুড়ে দিলেন। ঠিক এই আলোচনা কালেই মেওয়াতের শাসক হাসান খান মেওয়াতী সুলতান মামুদ লোদী ও রাণা সংগ্রাম সিংহের সাথে যোগ দিলেন। গড়ে উঠলো আফগান রাজপুত মৈত্রী।

এই পরিস্থিতিতে নিজাম খান তার কার্যকলাপ দ্বারা মুঘল রাজপুত বিরোধের আগুনে ধুনো ছড়িয়ে চললেন। উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অবধারিত হয়ে উঠলো।

জানুয়ারীর শেষভাগে আফগান রাজপুত সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে রাণা সংগ্রাম সিংহ চিতোর থেকে যাত্রা করলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য।

এদিকে বাবরও রাণার পরিকল্পনা ও গতিবিধির বিশদ খবর পেয়ে গেলেন। নিজের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুদৃঢ় ক’রে তার উদ্দেশ্য ভেস্তে দেবার জন্য তিনি বয়ান, জাহান নগর, গোয়ালিয়র ও ধউলপুর দখল ক’রে নেবার সিদ্ধান্ত করলেন। সেই মতো মুঘল বাহিনী ধউলপুর অধিকার ক’রে এগিয়ে গেল বয়ানের দিকে।

রাণাও এ খবর পেয়ে গেলেন। সাথে সাথে তিনিও নিজাম খানের কাছ থেকে বয়ান দুর্গ দখল ক’রে নেয়ার জন্য হাসান খান মেওয়াতীকে পাঠালেন। এ দিকে মুঘল সৈন্যও যে দুর্গ দখলের জন্ম এগিয়ে আসছে নিজাম খান মনে হয় সে খবর রাখতেন না। তিনি তাই রাজপুত-আফগান বাহিনীর অভিযানে সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেই মুঘল দরবারে উপস্থিত হয়ে বাবরের কাছে দুর্গ— সমৰ্পণ করলেন। এ ঘটনার পরে পরেই রাজপুত আফগান সেনাবাহিনী বয়ান দুর্গে হাজির হয়ে সেখানে উপস্থিত মুঘল সেনাদের হটিয়ে দুর্গ দখল ক’রে নিল। তারপর সেখান থেকে তারা মুঘল এলাকায় সামরিক তৎপরতা সুরু করলো।

বাবর নামা

অবস্থা এতো বিপদজনক হয়ে উঠলো যে বাবর তাদের দমন করার জন্য বয়ান অঞ্চলে মেহদী খাজাকে পাঠাতে বাধ্য হলেন। এ সময় পর্যন্তও বাবর জানতেন না যে রাণার সেনাবাহিনী মুঘলদের হাত থেকে বয়ান দুর্গ ছিনিয়ে নিয়েছে। মেহদী খান সেখানে পৌঁছে দুর্গ রাজপুত বাহিনীর দখলে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বাবরকে সব খবর পাঠিয়ে আরো সেনা পাঠানোর জন্য আবেদন জানালেন। বাবর সাথে সাথে সাহায্য পাঠালেন। খবর পাঠালেন তাদের সাহায্যের জন্য অল্পকালের মধ্যে তিনি নিজেও ঐ এলাকার দিকে অগ্রসর হবেন।

এই একই সময়ে রাণার সেনারা গোয়ালিয়র দুর্গ দখলের জন্যও সক্রিয় হয়ে উঠলো। দুগাধীশ তাতার খান সারঙ্গথানী কিছুকাল থেকেই আত্মসমর্পণের ইচ্ছা জানিয়ে বাবরের কাছে সেজন্য দূত পাঠিয়ে চলছিল। কিন্তু বাবর নিজে রাজপুতদের বিরুদ্ধে সমর আয়োজনে বাস্ত থাকায় সেখানে কাউকে পাঠাতে পারছিলেন না। এবার ধরমনকাত ও খান জহানের নেতৃত্বে রাজপুত বাহিনী গোয়ালিয়রে প্রবেশ করলো। দুর্গ দখলের জন্য চেষ্টাও আরম্ভ ক’রে দিল। তাতার খান আবার দুর্গ সমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে দূত পাঠালেন। এবার সাড়া দিলেন ব!বর। কিন্তু মুঘল সেনা যখন সেখানে পৌঁছাল, তাতার খান ভিন্নরূপ ধরলেন। কৌশলে দুর্গ মধ্যে প্রবেশ ক’রে তাকে আনুগত্য স্বীকার ক’রে নিতে বাধ্য করলেন। ব্যতিব্যস্ত ক’রে বাবরের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই একই কালে হামিদ খান সারঙ্গধানী ও অন্যান্য আফগান প্রধানরাও হিসার-ফীরুজের কাছে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তাদের অভ্যুত্থান দমনের জন্য চীন তৈমুর মুলতানের নায়কত্বে সেখানেও এক বিরাট সেনাদল পাঠাতে হলো বাবরকে।

মুঘল সেনাপতি রহিম দাদ তথন

বাবর নিজে ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৫২৭) আগ্রা থেকে যাত্রা শুরু করলেন। পথে, আগ্রা এলাকা পার হবার আগেই তার কাছে খবর এলো, রাণা সংগ্রাম সিংহ তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত গতিতে আগ্রা দখলের জন্য এগিয়ে আসছেন। মেহদী খাজা বয়ান দুর্গ দখল করতে ও রাণার বাহিনীকে হটিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার এক আগুয়া বাহিনীকে রাজপুতেরা ১৬ই ফেব্রুয়ারী শোচনীয় ভাবে পরাস্ত ক’রে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। সব যুদ্ধেই যে সব সময়ে জিত হবে এমন কোন কথা নেই। দুঃসাহসী বাবরের দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালই এরকম। সুতরাং গ্রাহের মধ্যে আনলেন না তিনি। বেপরোয়া এি চললেন বয়ানের দিকে। এমন কি পথে মেহদী খাজার বাহিনীর সাথে দেখা হচ্ছে

08

বার নামা

তাদেরও সাদর সংবর্ধনা জানালেন। তাদের সাথে নিয়ে পৌঁছলেন আগ্রা ও সিজির মাঝে মধুকর এলাকায়। যুদ্ধের জন্য এখানেই ব্যূহাকারে সাজিয়ে নিলেন সেনাবাহিনীকে। তারপর জ ও যুদ্ধের উপযুক্ত খোলামেলা জায়গার সুবিধার জন্য সিক্রির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্যও লোক পাঠান হলো।

রাণার সেনাবাহিনী

তারা খবর আনল,

এখান থেকে মাত্র দু’মাইল দূরে বসাওয়ার হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আরো খবর তিনি। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এ হলো ২১শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা। গ্রামের কাছে অবস্থান নিলেন বাবর। যথাযথভাবে সাজানো হলো। পানিপথের ন্যায় এখানেও মোটামুটি একই যুদ্ধ কৌশল নিলেন, একইভাবে ব্যূহ সাজালেন। সমরাস্ত্রও প্রায় একই ধরনের। এছাড়া বাবর আরো একটি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তা হলো, বাহিনীর প্রত্যেকটি শাখাকে অন্যদের গতিবিধি, পরিস্থিতি এবং সমরকৌশলের পরিবর্তনাদি সম্পর্কে সর্বদা ওয়াকিবহাল রাখা।

নামের একটি স্থানে তারা উপস্থিত সংগ্রহের জন্য আবার লোক পাঠালেন

শত্রু সেনার হাতে ধরা পড়ে গেল তারা। এবার সামান্য একটু সরে গিয়ে থানুয়া পরিখা খননের হুকুম দিলেন। বাহিনীকেও

বাবরের তুলনায় সংগ্রাম সিংহের সেনাবাহিনী অনেক বিপুল। বাবরের দেয়া হিসাব অনুসারে দু’লক্ষেরও বেশি। একে অতিরঞ্জিত বলে মনে হলেও রাজপুত সেনারা যে মুঘলদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল এতে সন্দেহ নেই। সম্ভবতঃ একলাখের কাছাকাছি। বাবরের সৈন্যসংখ্যা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বোধহয় বিশ হাজারের চেয়ে বেশি নয়। বয়ান দুর্গ দখল এবং মেহেদী খাজার অগ্রগামী দলকে পরাজিত ক’রে রাজপুতদের মনোবল নিঃসন্দেহে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অপরদিকে এ দুই ঘটনা, রাজপুতদের সংখ্যাধিক্য ও তাদের শৌর্যবীর্যের খ্যাতি মুঘল বাহিনীর মনোবল বেশ দুর্বল ক’রে তুলেছিল। কাবুল থেকে আগত এক জ্যোতিষীর ভবিষ্যতবাণীও তাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল। বাহিনীকে মনোবলে উদ্দীপ্ত ক’রে তোলার জন্য বাবর বিভিন্ন দিকে জুট-তরাজের জন্য পাঠাতে সুরু করলেন। এতেও যথেষ্ট উদ্দীপনার সঞ্চার হচ্ছে মা দেখে তিনি অতি নাটকীয়ভাবে সুরা পান বর্জনের শপথ নিয়ে এভাবে তাদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলেন। জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ রূপে ঘোষণা করলেন হিন্দু রাজপুদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে। এতে বেশ কাজ হলো। কিন্তু তার কালের মধ্যেই নতুন দুঃসংবাদ ভাৱ সেনাবাহিনীকে আবার দমিয়ে দিল।

বাবর নামা

১৩৫

খবর এল হুসেন খান রাপ্রী দখল ক’রে নিয়েছেন। কুতব খান অধিকার ক’রে নিয়েছেন চান্দোয়ার। সম্ভল ও কনৌজ থেকেও মুঘলদের বিতাড়িত করেছে আফগানেরা। মুঘলদের অধিকৃত গোয়ালিয়র দুর্গ ও অবরোধ করেছে তারা। এই দুঃসংবাদের ঢেউয়ে বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল সেনাবাহিনীর মধ্যে। দলত্যাগ শুরু হয়ে গেল। পরিস্থিতি জটিল হতে চলেছে দেখে বাবর সাথে সাথে তা রোধ করার জন্য যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিলেন।

শনিবার ১৬ই মার্চ ১৫২৭ সকাল ৯ টা থেকে ৯-৩০ এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। রাণ৷ সংগ্রাম সিংহই আক্রমণ করলেন। রাজপুতদের বাম বাহিনী মুঘলদের ডান বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন ক’রে দেবার জন্য বিপুল বিক্রমে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুঘল বাহিনীর বেসামাল অবস্থা দেখা দিল। শুরু হলো বিভ্রাট ও বিশৃঙ্খলা। বাবর তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য চীন তৈমুর সুলতানের অধীনে বাড়তি সেনা পাঠালেন সেদিকে। তৈমুরের প্রচেষ্টা কার্যকরী হলো। তিনি রাজপুতদের আক্রমণ প্রতিহত ক’রে তাদের বামবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিতে সমর্থ হলেন। এর ফলে রাজপুতদের বাম ও মধ্য বাহিনীর মাঝে ফাঁকের সৃষ্টি হলো। এক অভাবনীয় সুযোগ দেখা দিল মুঘলদের জন্যে। গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক মুস্তাফা সাফল্যের সঙ্গে এই সুযোগের সদ্ব্যবহ র করলেন। ছোট কামান ও বন্দুক নিয়ে দ্রুত সেখানে এগিয়ে গিয়ে অগ্নিবর্ষণ শুরু ক’রে দিলেন। এবার রাজপুত বাহিনীর মধ্যে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। অন্যদিকে মুঘলদের মনোবল উজ্জীবিত হলো। দারুণ উৎসাহে তারা রাজপুতদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাবর আরো সেনা পাঠালেন সেখানে একাধিক অধিনায়কের নেতৃত্বে। রাজপুতদের বামবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো। আহতের সংখ্যা ক্রমেই বিপুল হয়ে চললো!

বেসামাল রাজপুতেরা এবার বাবরের বাম বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণের চাপ সৃষ্টি করলো। কিন্তু অণুপ্রাণিত মুঘল বাহিনী দক্ষতার সাথে সে চাপ প্রতিহত ক’রে তাদেরই পাল্টা আক্রমণ করলো। মূঘল গোলন্দাজ বাহিনী সমানে রাজপুতদের উপর আগুন ও পাথর বর্ষণ ক’রে চললো। আহতের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চললেও রাজপুতরা বিপুল সংখ্যাধিক্যের জোরে চাপ বজায় রেখে চলতে থাকলো। কামানের বিরুদ্ধেও তারা তাদের অসামান্য সাহস ও বীরত্বের

পরিচয় রেখে চললো। মুঘলদের সাহায্য করার জন্য সেখানে আরো সেনা পাঠাতে হলো বাবরকে –

১৩৬

বাবর নামা

ক্রমে ক্রমে যুদ্ধ বদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মুঘল গোলন্দাজ বাহিনীর অবিরাম গোলাবর্ষণে রাজপুত সৈন্যদের সংখ্যা ক্রমশঃ কমে চললো।

। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে রইলো। শেষ পর্যন্ত বাবর তার ঘরোয়া বাহিনীকে গোলন্দাজ বাহিনীর দুপাশ থেকে আক্রমণ করার আদেশ দিলেন। ডান বাহিনীর গোলন্দাজ শাখাকেও এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হলো। বিশাল কামান নিয়ে মধ্যভাগ থেকে ওস্তাদ আলী যে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন এরা ডান দিক থেকে তার সেই প্রচেষ্টায় সহযোগিতা ক’রে চললে।। রাজপুত বাহিনীর মধ্যভাগ এবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলো।

একসময়ে রাণা সংগ্রাম সিংহ নিজেও আহত হলেন। অম্বরের পৃথ্বীরাজ, যোধপুরের মলদেব রাও ও শিরোহীর অখাইরাজ রাও প্রভৃতি তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোপনে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এ ঘটনার পরেও কিন্তু যুদ্ধ থামল না। মুঘলদের হারিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে রাজপুত প্রধানরা প্রচলিত প্রথা ভঙ্গ ক’রে হলবাদের রাণ! তজ্জকে অধিনায়কত্বে বরণ ক’রে নিয়ে তার মাথার উপরে ছত্র তুললো। তাকে উদ্দীপ্ত করা হলো শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু রাণা সংগ্রাম সিংহ যুদ্ধক্ষেত্রে নেই এ সংবাদ বেশিক্ষণ চেনাদের কাছে গোপন রইলো না। ফলে রাজপুত সেনাবাহিনী মধ্যে নৈরাশ্য দেখা দিল ও ছত্রভঙ্গ দিয়ে লায়ন শুরু হয়ে গেল। প্রায় দশ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর এভাবে বাবরের স্বপক্ষে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলো।

পরদিন সকালে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করলেন বাবর। মুঘল পক্ষের যারা হতাহত হয়েছে তাদের তালিকা করা হলো। শত্রুপক্ষীয়দের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মাথা কেটে এনে স্তম্ভ তৈরী করা হলো মোঙ্গল প্রথামতো। তারপর বিজয় উৎসবের মধ্য দিয়ে ‘বাজী’ উপাধি গ্রহণ করলেন তিনি।

পানিপথের যুদ্ধে বিজয় অপেক্ষাও এই যুদ্ধে বিজয় বাবরের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধে আফগানদের এবং বিশেষভাবে শৌর্য-বীর্যের গৌরব গরিমার দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রাজপুতদের প্রতিপত্তি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ ক’রে তিনি আপন সাম্রাজ্যের বনিয়াদ পাকা করে তুললেন। এরপর আফগানরা আবার রণক্ষেত্রে তার মুখোমুখি হলেও সফল হতে পারল না। কাবুলের পরিবর্তে দিল্লীই এবার ৰাবরের ক্ষমতা ও প্রতি- পত্তির কেন্দ্রপীঠ হয়ে উঠলো।

সফল হলো কিশোর বয়স থেকে দেখে আসা তার সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *