বাবর নামা – ১০

দশ

মীর্জা খানের ডাকে পৈতৃক রাজ্য উদ্ধারের অভিযানে যাবার বেলা কাবুল শাসনের ভার নাসির মীর্জার উপর দিয়ে যান বাবর। অনুগত থেকে আন্তরি- কতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করার জন্য তার প্রতিদান রূপে বাবর তাকে গজনী প্রদেশ দিলেন! নানারকম সম্মান এবং অনুগ্রহও দেখালেন। গজনী গিয়ে নাসির মীর্জা এবার ভোগ-বিলাস-আনন্দে মত্ত হয়ে উঠলেন। অপরিমিত সুরাপানের দরুন অল্পকালের মধ্যেই তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়লো। পরের বছর ( ১৫১৫ খৃীষ্টাব্দ ) অসুখে পড়ে মারা গেলেন তিনি।

নাসির মীর্জার মৃত্যুর পরে পরেই, সম্ভবত গজনীতে মুঘল প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, মুঘল ও চাঘতাই আমীররা বিদ্রোহ ক’রে বসলো। তবে আগের দুবারের মতো এবারেও তারা শেষ রক্ষা করতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত বাবর

দমন করলেন তাদের।

এরপর কয়েকটি বছর শান্তিতেই কাটালেন বাবর। আনন্দ-উৎসব, সুরা- আসর, শিকার, আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও পার্বত্য-উপজাতিদের অনুগত রাখার জন্য ছোটখাট অভিযানের মধ্যে ডুবে থেকেই সময় কাটালেন তিনি। ১৫১৬ অব্দে গুলরুখ বেগচীকের গর্ভে তার তৃতীয় পুত্র আসকারীর জন্ম হলো।

প্রায় এই একই সময়ে বাবরও স্তাদ আলী নামের এক অটোমান তুর্কীকে সংগ্রহ করলেন। নিয়োগ করলেন তাকে সমরাস্ত্র অধিকর্তা রূপে। এ ঘটনার কিছুদিন আগে থাকতেই তিনি সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেন। কন্‌সতাতিনোপলের সুলতান সালিমের সাথে যুদ্ধে পারস্যের শাহের পরাজয় এ বিষয়ে তাকে সচেতন ক’রে তোলে।

এ যুদ্ধে সুলতান সালিম কামান ও ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। এ সব আধুনিক অস্ত্রের উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পেরে বাবরও এই আধুনিক যুদ্ধকৌশল গ্রহণের দিকে ঝুঁকলেন। তুর্কী গোলন্দাজ ও মাসকেট বন্দুক বা পলতে বন্দুক চালনায় অভিজ্ঞ সৈনিকদের সংগ্রহ ক’রে তিনি নিজের বাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধ- কৌশলে শিক্ষিত ক’রে তুলতে মন দিলেন। ১৫১৬-১৭ অব্দে তার এই নতুন পদক্ষেপ শুধু যে তার ভাগ্যের বন্ধ দুয়ার খুলে দিল তাই নয়, ইতিহাসের পাতায়ও তার নাম চিরস্মরণীয় ক’রে রাখলো।

কাবুল জয় করার পর থেকেই বাবরের মনে হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন

১০৪

বাবর নামা

দানা বেঁধে উঠেছিল। শ‍ইবানি খানের মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষদের রাজ্য উদ্ধারের জন্য মীর্জা খানের ডাক তাকে আবার মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মরীচিকা-আশার পিছনে ছুটিয়ে নিয়ে গেলেও এবারকার তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, সে আশা পূরণ হবার নয়। সেখানকার তীব্র প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক মঞ্চ স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ার উপযোগী নয়। তাছাড়া প্রবল প্রতাপ পারসিক সাম্রাজ্য ও ঐক্যবদ্ধ উজবেগদের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো শক্তি-সামর্থ্যও তার নেই। তাই সে আকাঙ্খা মন

থেকে পুরো মুছে ফেলে হিন্দুস্তানের দিকেই মনকে একাগ্র করলেন তিনি। সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করলেন। তবে তার পুরো পরিকল্পনা বা আকাঙ্খাকে

অন্যদের কাছ থেকে সযত্নে গোপন রেখে চললেন।

আপন পরিকল্পনা সফল করার জন্য প্রথমেই বাবর কন্দহারের উপর নজর দিলেন। ইতিপূর্বে একবার তিনি কন্দহার জয় করলেও শ‍ইবানি খানের আক্রমণের দরুন তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আবার তা অরঘুনদের অধিকারে চলে গিয়েছিল। কিন্তু হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হলে কন্দহার একান্ত জরুরী। হিন্দুস্তানে যাবার সিধান সড়ক এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই চলে গেছে। অতএব ১৫১৭ অব্দে কন্দহার অভিযানে বার হলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতার ফলে সে অভিযান অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে হলো তাকে।

পরের বছর হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অভিযানে বার হলেন বাবর। বিচ্ছিন্ন ভাবে অবস্থিত চাঘান-সরাই দুর্গ অধিকার করলেন। এ বছরের ( ১৫১৮ ) নভেম্বর মাসে কন্দহারের শাহ বেগ অরঘুনও সিন্ধুর দিকে নজর দিলেন। জাম নন্দের মৃত্যু ও তার নাবালক ছেলের সিংহাসনে আরোহণ ফলে যে আভ্যন্তরীণ কলহ দেখা দিয়েছে সেখানে তারই সুযোগ নিতে চাইলেন তিনি। এক হাজার ঘোড়সওয়ারের এক ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠিয়ে কহন ও বাঘবন লুটপাট করলেন তিনি। অর্থাৎ বাবর ও অরঘুন দুজনেই প্রায় এক সময়ে হিন্দুস্তানের প্রবেশ-

পথ পরিষ্কারে মনোযোগী হলেন।

এর কিছুদিন পরেই শাহ বেগ অরয়ূনের ছেলে শাহ হুসেন অরঘুন পিতার সাথে ঝগড়া ক’রে বাবরের কাছে এলেন। বাবরও আগ্রহ দেখিয়ে সৌজ্য সহকারে আশ্রয় দিলেন তাকে। কন্দহার সম্পর্কে নানা খবর তার কাছ থেকে

সংগ্রহ করার সুযোগ পেলেন।

তারপর তাকে কাছে ধরে রাখার জন্য এক চতুর

বাবর নামা

SOG

চাল চাললেন। বিয়ে দিলেন তার সাথে মীর খলীফার মেয়ে গুলবার্গের। ফলে শাহ হুসেন বাবরের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন।

১৫১৮ অব্দের ডিসেম্বরে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন আফগানদের দমন করার জন্য বেরিয়ে ওই সুযোগে বাবর পাঞ্জাব অভিযান করেন। ওই সময়ে তিনি শিয়ালকোট পর্যন্ত এগিয়ে ফিরে আসেন। পরের বছরও আবার তিনি চন্দ্রভাগা নদী তীরে শিয়ালকোট পর্যন্ত গিয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে এলেন। শাহ বেগ অরঘুন কাবুল আক্রমণ করার জন্যই তিনি ফিরে আসতে বাধ্য হন বলে সাধারণতঃ মনে করা হয়। তবে এ ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।

১৫১৯ অব্দের শুরুতে ৪ঠা জানুয়ারী বাবর বাজৌর দুর্গ আক্রমণ করলেন। দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি এক বিশ্বস্ত দিলজাক আফগানকে বাজোর-শাসক হায়দার আলী বা তার ভাইপোর কাছে পাঠালেন, দুর্গ সমর্পণ ক’রে তার অধীনতা স্বীকার ক’রে নেবার জন্য। কিন্তু তা করলো না তারা। ৬ই জানুয়ারী তিনি পদক্ষেপ নিলেন। বাঁ দিকের সেনাবাহিনীকে তিনি নদী পার হয়ে দুর্গ ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে তার উত্তরে গিয়ে দুর্গের কাছে আস্থান নেবার আদেশ দিলেন। মধ্য ভাগকে আদেশ দিলেন নদী পার হয়ে উত্তর পশ্চিমের অসমতল মালভূমিতে জমায়েত হবার জন্য। ডান ভাগের বাহিনীকে পশ্চিম দিককার নিচু ফটকের কাছে জমায়েত হতে বলা হলো। বাঁ ভাগের বাহিনী নদী পার হয়ে তারপর এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই শ’দেড়েক পদাতিক তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করলো তাদের। বাবরের বাহিনী তাদের অনায়াসে হটিয়ে দিলে।

এ যুদ্ধে বাবর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রতিপক্ষ বেশ অসুবিধায় পড়লো। এ নিয়ে বাবরেরও এই প্রথম পরীক্ষা। এর আগে বাজৌরের অধিবাসীরা কখনো তুফঙ্গ বা পলতে বন্দুক দেখেনি। প্রথম প্রথম তারা একে গ্রাহ করলো না। পরে যখন কামান থেকে অগ্নি-উগার হতে দেখলো ভয়ে পিছু হটলো। এ সত্বেও যথেষ্ট সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না তারা। ব্যাপারটাকে উপভোগ্য এক মজার ঘটনা বলেই যেন মনে করলো সকলে। সেদিন উস্তাদ আলী পলতে বন্দুকের সাহায্যে পাঁচ জনকে ঘায়েল করলো। কোষাধ্যক্ষ ওয়ালীও দু-জনকে ঘায়েল করলো। অন্যান্য বন্দুকধারীরাও বেশ সাহস ও কুশলতা দেখালো। দিনের শেষে মোট দশজন বাজৌরী প্রাণ খোয়ালো। এবার তাদের বাহিনী মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক খেলে গেল। কেউ আর তারপর দুর্গের বাইরে আসার সাহস করলো না।

ৰাবর নামা

পরদিন দুর্গ আক্রমণের আদেশ দেয়া হলো। বাঁ ও মধ্য বাহিনীর সেনারা দেয়ালে ম‍ই লাগিয়ে দুর্গ মধ্যে ঢুকে পড়লো। মহম্মদ আলী জাঙ্গজুঙ্গের নেতৃত্বে মূল বাহিনীও দুর্গে প্রবেশ করলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুর্গের বাহিনীকে পরাস্ত ক’রে দুর্গ দখল ক’রে নেয়া হলো। সকলের স্ত্রী পুত্রদের বন্দী করা হলো। প্রায় তিন হাজার বাজৌরীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হলো।

খাজা কলানের উপর বাজৌরের প্রশাসন ভার অর্পণ ক’রে মূল শিবিরে ফিরে এলেন বাবর। তাকে সাহায্যের জন্য সেখানে এক বিরাট সেনাবাহিনীকেও মোতায়েম রাখা হলো।

বাজৌর অধিকার বাবরের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখান থেকেই তার ভাগ্য স্মরনীয় বাঁক নিতে শুরু করে। সামরিক দিক থেকেও এই দুর্গের গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দুস্তানে অভিযান চালাবার জন্য এবার মূল শিবির রূপে ব্যবহার যোগ্য একটি স্থান বাবরের দখলে এলো। বিদ্রোহী আফগান উপজাতিদের বশে রাখবার দিক থেকেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট।

বাজৌরের প্রশাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত ক’রে ৮ই জানুয়ারী যাত্রা শুরু করলেন বাবর। বাজৌর উপত্যকার বাবা করা ঝরনার কাছে এসে ছাউনি ফেললেন। এখানে খাজা কলানের অনুরোধে কতক বন্দীকে ক্ষমা দেখিয়ে ছেড়ে দিলেন তিনি। যে সব প্রধানরা অতি বিদ্রোহ ভাবাপন্ন তাদের হত্যা করা হলো। বাজোর জয়ের নিদর্শন রূপে তাদের ছিন্ন মুণ্ড কাবুল, বদকশান, কুন্দুজ ও বালখ পাঠিয়ে

দেয়া হলো।

এখানে থাকাকালে ইউসুফজাই উপজাতির কাছ থেকে শান্তি-প্রস্তাব নিয়ে অ!গত দূতকে তিনি সম্মানিত করলেন। সম্মান-সূচক পোষাক উপহার দিয়ে তাকে বিদায় করলেন তিনি। তারই মারফত চিঠি দিয়ে ইউসুফজাই উপজাতির প্রধানদের ব্যতা স্বীকার ক’রে নেবার আহ্বান দিলেন। ২১শে জানুয়ারী তিনি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান উদ্দেশ্যে সাওয়াদ (হাত) উপত্যকার দিকে এগিয়ে গেলেন। বাজৌর ও চন্দওয়াল নদীর মধ্যবর্তী স্থানে ছাউনি ফেললেন। দূত মনসূর ইউসুফজাই আবার ফিরে এসে আফগান প্রধানদের অনিচ্ছার কথা জানালো। এগিয়ে এসে বাবর কহরাজ ও পেশগ্রাম উপত্যকার নিকটবর্তী পঞ্জকুরায় এলেন। প্রবেশ করলেন এভাবে সাওয়াদ। এখানকার প্রধান সুলতান আলাউদ্দীন আগেই এসে (১৯শে জানুয়ারী) তার সাথে দেখা করেন। আলাউদ্দীনের প্রতিদ্বন্দ্বী সুলতান ওয়েইস সাওয়াদীও ইতিমধ্যে বাবরের পক্ষে যোগ দিয়েছে।

বাধর নামা

১০৭

এতো

পঞ্জকুরায় এসে বাবর সুলতান ওয়েইস সাওয়াদীর পরামর্শে কহরাজ উপত্যকার অধিবাসীদের উপর তার সৈন্যদের জন্য চার হাজার গাধাবোঝাই চাল কর চাপালেন ও তা আদায়ের জন্য সুলতান ওয়েইসকে পাঠালেন। কর দেয়া সাধ্যের বাইরে বলে কৃষকরা তা দিলনা। সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব দেখে বাবর পঞ্জকুরা লুট করার জন্য বিরাট এক সেনাবাহিনী সহ হিন্দু বেগকে আদেশ দিলেন। তিনি এগিয়ে যেতেই পঞ্জকুরা শহরের লোকেরা ভেড়া, খচ্চর, বলদ ও খাদ্যশস্য ফেলে যে যেদিকে পারলো পালালো। ২৬ ও ২৭শে জানুয়ারীও সন্নিহিত এলাকা থেকে এভাবে লুটপাট ক’রে আনার জন্য কুচ বেগের অধীনে সেনাদল পাঠানো হলো। এই শুট অভিযানকে মদত দেবার জন্য বাবর নিজেও কিছুটা এগিয়ে মানদীশ নামের একটি গ্রামে ছাউনি ফেললেন। এখানে ইউসুফজাই উপজাতির নেতা মালিক সুলেইমান শাহের ছেলে মালিক শাহ মনসূর মালিক তার দেশকে লুট-তরাজের হাত থেকে

তার সাথে দেখা করলো।

সাথে বিবাহ দেয়ার

বাবরকে তিনি খবর

কন্যা বাবরের কাছে

বাঁচাবার জন্য বাবরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনার উদ্যম করলেন। অন্যান্য

প্রধানদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি তার মেয়েকে বাবরের বাবর-উত্থাপিত প্রস্তাব মেনে নিয়ে তা কার্যকরী করলেন। দিলেন যে তার উপজাতিদের কাছ থেকে কর সহ তার আসছে। ১৫১৯ অব্দের ৩০শে জানুয়ারী শাহ মনসুরের ভাই তার ভাইঝি বিবি মুবারিকাকে নিয়ে বাবরের শিবিরে উপস্থিত হলো। সেদিন সন্ধ্যাতেই বাবরের সাথে তার বিয়ে সমাধা হলো। এরপর কয়েকদিন সেখানে থেকে যথেষ্ট খাদ্যশস্য সংগ্রহ ক’রে সাওয়াদ (স্বাত) অঞ্চলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আয়োজন সম্পূর্ণ করলেন তিনি।

৮ই ফেব্রুয়ারী বেগদের ও দিলজাক আফগানদের নিয়ে পরামর্শ সভা বসালেন বাবর। এখানে ঠিক হলো, যেহেতু বসন্তকালীন ফসলের সময় পার হয়ে গেছে, অতএব সাওয়াদ-এর ভিতর অঞ্চলে প্রবেশ করা এ সময়ে ঠিক হবে না। প্রয়োজনীয় খাদ্য নাও মিলতে পারে, গেলে অনর্থক হয়রান হতে হবে হয়তো সেনাদের। এর চেয়ে অম্বহর ও পানী-মানীর সড়ক ধরে এগিয়ে, হস-নগরের উপর-অঞ্চল দিয়ে সাওয়াদ (স্বাত) নদী পার হয়ে মহুরে বসবাসকারী ইউসুফজাই ও মহম্মদী আফগানদের উপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়া যাক। এও ঠিক হলো, পুরো সেনাবাহিনী আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। বাবর

১০৮

বাবর নামা

তখন বাজোর দুর্গে ফিরে এলেন। করলেন। এলেন পানী-মানীতে। পার হলেন। সারারাত ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। পরদিন সকালে গুপ্তচয়ের মুখে খবর পেলেন যে তিনি এগিয়ে আসছেন জানতে পেরে অফ- গানরা পাহাড়ী পথ ধরে চারদিকে পালিয়ে যাচ্ছে। খবর পেয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন বাবর। তাদের ধরার জন্য এক আগুয়া বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন।

তারা ক্ষিপ্রবেগে এগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর। বহু

আফগানকে হত্যা করলো। বন্দীও করা হলো অনেককে। অনেক গরু- বলদ ভেড়া আটক করা হলো। আংশিক ভাবে সফল হয়ে বাবর কাতলাং চলে এসে সেখানে শিবির ফেললেন।

স্ত্রী বিবি মুবারিকাকে দুর্গে রেখে যাত্রা শুরু

তারপর আরো এগিয়ে সাওয়াদ নদী

এবার ভীর-এর দিকে এগিয়ে চললেন বাবর। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বাবর লিখেছেন ‘বাজৌর থেকে ফের যাত্রা শুরুর বেলা আমরা শুধু ভীর-এর কথাই ভাবছিলাম। (প্রথম) কাবুল আসার দিন থেকেই আমার নজর ছিল হিন্দুস্তানে এগিয়ে যাবার দিকে। কিন্তু নানা কারণে তা ক’রে ওঠা সম্ভব হয়নি এতকাল।’

ভীর থেকে যখন মাত্র ১৪ মাইল দূরে এ সময়ে বাবর নীল-আব ও ভীর-এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী জুনজুহা গোষ্ঠীর প্রধান মালিক হস্তের কাছে শান্তি প্রস্তাব দিয়ে লঙ্গর খানকে পাঠালেন। মালিক লঙ্গর খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অতএব তার মন বাবর-অভিমূখী করতে লঙ্গর খানের বিশেষ অসুবিধা হলো না। লঙ্গর খানের সাথে এসে তিনি বাবরের সাথে দেখা করলেন ও বখতার নিদর্শন রূপে একটি সুসজ্জিত ঘোড়া উপহার দিলেন।

এবার ভীর-এর দিকে এগিয়ে চললেন বাবর। বাবর লিখেছেন : ‘অনেকদিন থেকেই আমার মন হিন্দুস্তান এবং ভীর, খুস-আব, চীন-আব (চেনার বা চন্দ্রভাগা), চীনীউত ইত্যাদি যে সব দেশ একসময়ে তুর্কীদের দখলে ছিল তা অধিকার করার দিকে। এ অঞ্চলগুলিকে আমি নিজের বলেই ভাবতে শুরু করেছিলাম। শাস্তিপূর্ণ ভাবেই হোক আর জোর ক’রেই হোক এ অঞ্চলগুলিকে নিজের দখলে আনার সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম।’ ইউসুফজাই আফগান- প্রধান মালিক মনসুর ও মালিক হস্তের ব্যতা স্বীকার তাকে এবার উৎসাহিত ক’রে তুললো। এ পরিকল্পনা সফল ক’রে তোলা সম্ভবপর বলে মনে হলো তার। স্থানীয় জনসাধারণের মন জয় করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি তাই আদেশ

বাবর নামা

১০১.

দিলেন : সাধারণ মানুষের গায়ে যেন ভুলেও হাত তোলা না হয়। একটুকরো কাপড় বা একটা ভাঙ্গা সূচও যেন কেড়ে নেয়া না হয় কারো কাছ থেকে

কলদ-কহার পার হয়ে হমতাতু গিরিপথ ডিঙিয়ে ভাঁর শহরের দোরগোড়ায় পৌঁছলেন বাবর। পথে লোকেরা ‘পেশকাশ’ উপহার দিয়ে তার বণ্ঠতা স্বীকার ক’রে নিলো। আবদুর রহিম শঘাওয়ালকে আগে থেকে ‘ভীর’ পাঠিয়ে তিনি অভয়বাণী শোনালেন, সতর্ক ক’রে দিলেন : ‘এদেশ প্রাচীন কাল থেকে তুর্কীরা শাসন ক’রে এসেছে। অযথা ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি ক’রে সকলের সর্বনাশ ডেকে এনোনা। এ দেশ, এখানকার মানুষদের আমরা আপনরূপে পেতে চাই, আক্রমণ বা লুটপাট করতে চাইনে।’ সেনাবাহিনীকে এবার তিনটি শাখায় ভাগ ক’রে শহরের দিকে এগোতে থাকলেন বাবর। তার এই চাল বাজীমাৎ করলো। শহর-গোড়ায় তিনি পৌঁছতে না পৌঁছতেই আলী খান ইউসুফ খলিলের কর্মচারী হিন্দু বেগ স্থানীয় প্রধানদের নিয়ে বাবরের সাথে দেখা ক’রে তার বশ্যতা মেনে নিলেন।

২১ শে ফেবরুয়ারী বাবর ভীর পরিদর্শন করলেন। সেখানে সংগুর খান জনজুহাও তার বশ্যতা স্বীকার ক’রে নিলেন। দুদিন পরে, ২৩ শে ফেবরুয়ারী ভীর-এর চৌধুরীরা তাদের সম্পত্তির মুক্তিপণ হিসাবে বাবরকে চার লক্ষ শাহরুখী দিতে রাজী হলো। এর পরেই এ অঞ্চলের বালুচীদের বশে আনার জন্য হায়দার আলমদারকে পাঠালেন বাবর। পরদিন তারাও বাবরের সাথে দেখা ক’রে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলো। ২৫ শে ফেব্রুয়ারী শুক্রবার দিন খুস-আবের অধিবাসীরাও তার আধিপত্য মেনে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। খুশী হয়ে বাবর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার জন্য শাহ সুজা অরঘুনের ছেলে শাহ হুসেনকে সেখানে পাঠালেন।

এই অভাবিত সাফল্য বাবরের হিন্দুস্তান জয়ের আকাঙ্খাকে আরো উদ্দীপ্ত ক’রে তুললো। কর্মোৎসাহী ও উচ্চাশী আমীররাও এবার উৎসাহী হয়ে বাবরকে পরামর্শ দিলে : হিন্দুস্তানের যেসব অঞ্চল একদা তৈমুরলঙ্গের সাম্রাজ্যাধীন ছিল সেসব অঞ্চলের বশ্যতা দাবী ক’রে সেখানে দূত পাঠান হোক। এ পরামর্শ মনে ধরলো বাবরের। সেই মতো ওই অঞ্চলগুলি হস্তান্তরের দাবী জানিয়ে সুলতান ইব্রাহিম লোদী ও দৌলত খান লোদীর কাছে পত্র লিখলেন তিনি। মোল্লা মুরশীদ সে পত্র বয়ে নিয়ে গেলেন তাদের কাছে।

১৫১৯ অব্দে ইব্রাহীম লোদী তার ক্ষমতার তুঙ্গে। এ চিঠি পেয়ে তার

“১১০

বাবর নামা

মনে কিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো, কী ধরনের উত্তর দিলেন তা সহজেই অনুমেয়। আর সে উত্তর শুনে বাবরের মনে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল তা তার এই মন্তব্যগুলির মধ্যেই স্পষ্ট। হিন্দুস্তানের লোকেরা, বিশেষ ক’রে আফগানেরা বোধবুদ্ধির ধার ধারে না। বিচার বুদ্ধি ও সদুপদেশের প্রতি তারা পুরো চোখ- কান বোজা। শত্রু হিসাবেও কী ক’রে যে পদক্ষেপ নিতে হয়, শত্রুতাচরণ করতে হয়; তাও তারা জানে না। বন্ধুত্বের বিধিনিয়ম রীতিনীতিও জানা নেই তাদের।’ অন্যদিকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী বাবরের দূতকে কোন সুস্পষ্ট উত্তর দেবার বদলে পাঁচমাস তাকে সেখানে দেরী করিয়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে বাবর বিজিত অঞ্চলে প্রচলিত জরীপ কার্য করলেন। সমগ্ৰ অঞ্চলকে চারভাগে ভাগ ক’রে বিভিন্ন আমীরকে সেখানকার প্রধানদের কাছ থেকে বকেয়া কর আদায় করতে পাঠালেন। ৪ঠা মার্চ তার কাছে চতুর্থ পুত্র হিন্দালের জন্মুখবর পৌঁছল এসে। পরবর্তী কয়েকদিন তিনি আনন্দ পানোৎসব ক’রে কাটালেন। তবে তার মধ্যেও তিনি তার করণীয় কর্তব্যগুলি কিন্তু মোটেই ভুলে ছিলেন না, পুরো সতর্ক ছিলেন সেদিকে।

বিজিত অঞ্চলের শাসনভার হিন্দু বেগের উপর অর্পণ করলেন বাবর সে যাতে সুষ্ঠুভাবে শাসনকাজ চালাতে পারে সেজন্য উপযুক্ত কর্মচারী ও সাহায্য- কারীর ব্যবস্থা ক’রে ১৫১৯ অব্দের ১৩ই মার্চ কাবুল ফিরে চললেন। স্থানীয় আমীর ও প্রধানদের সহযোগিতা সমর্থন লাভের জন্য তিনি তাদের সম্মানিত করলেন, তাদের ভাতাও বাড়িয়ে দিলেন।

ফেরার পথে কল্দ-কহার থামলেন বাবর গখখর উপজাতিকে পরাস্ত ক’রে নিজের বশে আনার জন্য। তাদের প্রধান হাতি গথ খর সামান্য কয়েকদিন আগে এক তাতারকে হত্যা ক’রে পরহাল রাজ্য অধিকার ক’রে নেন। বাবর আরো এগিয়ে গিয়ে পরহাল দুর্গ অবরোধ করলেন। হাতি গখের দুর্গ থেকে আপ্রাণ লড়েও শে। রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন। বাধ্য হলেন বাবরের আধিপত্য মেনে নিতে।

বাবর এবার কাবুল ফেরার জন্য সিন্ধু নদ পার হতে উদ্যোগী হলেন। পথে কুরলুক হজারাদের নায়ক সংগর কুরলুক তার সাথে দেখা করলেন। সংগরের সাথে ছিলেন মীর্জা নরভি কুরলুক ও তাদের উপজাতির আরো তিরিশ থেকে চল্লিশ জন প্রধান। প্রত্যেকেই তার আধিপত্য স্বীকার করে

নিলেন।

বাবর নামা

১১১

২৪শে মার্চ কতক জরুরী এখানে নীল-আবের

২১শে মার্চ বাবর নীল-আব নদী পার হলেন। কাজ সম্পন্ন করার জন্য সেই নদীকূলে থামলেন তিনি। অধিবাসীরাও তার অধীনতা স্বীকার করে নিল।

শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বাবর ভীর ও সিন্ধুর মধ্যবর্তী বিজিত অঞ্চলের শাসনভার মহম্মদ আলী জুঙজাঙের উপর দিলেন। যারা ইতিমধ্যে বঙ্গতা স্বীকার ক’রে নিয়েছে তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া হলো। ৩০শে মার্চ কাবুল ফিরে এলেন বাবর।

কিন্তু তিনি ফিরে আসার ২৫ দিনের মধ্যেই ভীর অঞ্চলের পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিল। বাবর যতদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ততদিন তার অসামান্য ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা সংযত হয়ে ছিল। কিন্তু তিনি সরে আসার সাথেই সাথে তারা বিদ্রোহ শুরু করলো। তাদের দমন বা আত্মরক্ষা ক’রে চলা অসাধ্য দেখে হিন্দু বেগ খুশ- আব সরে এলেন ও সেখান থেকে দীনকে ট ও নীল-আব হয়ে কাবুল ফিরলেন। ভীর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বাবরের কাছে দুঃসহ হলেও, তিনি অসুস্থ। সুতরাং ভীর পুনরুদ্ধারের জন্য সাথে সাথে কোন পদক্ষেপ নেয়া তার পক্ষে

সম্ভব হলো না।

২৩শে মে মালিক মনসূর ইউসুফজাই সাওয়াদ থেকে ৬/৭ জন ইউসুফজাই প্রধানকে নিয়ে কাবুল উপস্থিত হলেন ও বাবরের অধীনতা স্বীকার ক’রে নিলেন আবার। এ ঘটনা থেকে সূচিত হয় যে হিন্দু বেগ যখন ভির-এ কতক হিন্দু ও আফগান উপজাতির বিদ্রোহের মুখোমুখি হন তখন তিনি ইউসুফজাইদের সমর্থণ সংগ্রহের চেষ্টা করেননি। এমনকি মহসুদ আলী জুঙজাঙের সাহায্য নেয়ার চেষ্টাও করেননি তিনি। ইউসুফজাইরা ঐ সময়ে বাবরের অধীনতা অস্বীকারের কোন উদ্যম করেনি। একথা বিবেচনা ক’রে বাবর ৩১শে মে ইউসুফজাই প্রধানদের পোষাক উপহার দিয়ে সম্মানিত করলেন। তাদের সাথে বাবরের এক চুক্তিও সম্পাদিত হলো। স্থির হলো যে তারা বছরের ছয় হাজার গাধা বোঝাই চাল কর হিসাবে দেবেন বাজোর ও সাওয়াদের আফগান কৃষকদের পক্ষ থেকে।

২৭শে জুলাই বাবর আবদুর রহমান আফগানদের বিরুদ্ধে অভিযানে বার হলেন। এরা কাবুল ও বাজোরের মধ্যবর্তী সড়কে যাত্রীদের লুটপাট ক’রে চলছিল। গীরদীজ-এর সীমানা অঞ্চলে বসবাস এদের। আক্রমণ ক’রে এদের

১১২

বাবর নামা

প্রায় পঞ্চাশ জনকে কেটে ফেলা হলো। যুণ্ডগুলি একত্র ক’রে তা দিয়ে গড়া হলো বিজয়স্তম্ভ। ৩১শে জুলাই কাবুল ফিরে এলেন বাবর।

৮ই সেপটেমবর ইউসুফজাইদের বিরুদ্ধে অভিযানে বার হলেন তিনি। সুলতানপুর পৌঁছে দিলজাক আফগানদের কাছে খবর পেলেন যে যাযাবর উপজাতির লোকেরা প্রচুর শস্য নিয়ে বিপুল সংখ্যায় হস-নগরে সমবেত হয়েছে। তাদের আক্রমণ ক’রে হস-নগর কিংবা পেশোয়ার দখল ক’রে সেখানে মূল শিবির ক’রে সাওয়াদের ইউসুফজাইদের বিরুদ্ধে অভিযান করার পরামর্শ দিলে তাৱা। এ পরামর্শ গ্রহণ করলেন বাবর। ২৭শে সেপটেমবর খাইবার গিরিপথের গোড়ায় এসে পৌঁছলেন। এখান থেকে বাজোরে খাজা কলানের কাছে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে খবর পাঠালেন। খাইবারের সংকীর্ণ গিরিপথ অতিক্রম ক’রে এলেন আলী মসজিদে। ভারি তল্পিতল্পা সেখানে রেখে, কাবুল নদী পার হলেন। খবর পেলেন, তার এগিয়ে আসার খবর পেয়ে ইউসুফজাইরা পালিয়ে গেছে। তবু না থেমে এগিয়ে চললেন বাবর। কাবুল ও স্বাত ( সাওয়াদ ) নদী পার হয়ে আফগানদের শস্যক্ষেত্র এলাকায় উপস্থিত হলেন। কিন্তু হতাশ হলেন তিনি। দিলজাকরা যে পরিমাণ শস্যের কথা বলেছিলেন তার এক-চতুর্থাংশও নেই। অগত্যা ফিরলেন তিনি। হস-নগরকে মূল শিবির করার পরিকল্পনা ত্যাগ ক’রে জাম নদী পার হয়ে আলী মসজিদ নদীর কাছে হাজির হলেন। কিন্তু

পেশোয়ার দখল করবার কোন রকম উদ্যম করার আগেই খবর পেলেন বদকশানে

গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। সুতরাং পরিকল্পনা স্থগিত রেখে ২রা অকটোবর কাবুল ফেরার জন্য রওনা হলেন তিনি। পথে খিজির খইল আফগানদের দমন করা হলো। বহু আফগান বন্দী হলো স্ত্রী পুত্র সহ। পরদিন ৫ই অকটোবর কীলাঘ-তে এসে আস্থান নিলেন তিনি : এখানে ওয়জীরী আফগানরা তার বশ্যতা স্বীকার ক’রে নিয়ে বকেয়া কর হিসাবে ৩০০ ভেড়া দিলে তাকে। এরপর খিরিলচী ও শিমু খইল আফগানদের প্রধানরা বহু লোক সঙ্গে নিয়ে তার সাথে দেখা ক’রে তার আনুগত্য মেনে নিলো। দিলজাক আফগানরা তাদের হয়ে তার সাথে মধ্যস্থতা করলো। ফলে তাদের ক্ষমা প্রদর্শন ক’রে বন্দীদের মুক্তি দিয়ে দেয়া হলো। পরিবর্তে তাদের বলা হলো কর হিসাবে চার হাজার ভেড়া দিতে। তা আদায়ের জন্য কর্মচারীও নিযুক্ত করা হলো। ১৭ই নভেম্বর কাবুল ফিরে এলেন বাবর।

২৪শে নভেম্বর কন্দহার থেকে তাজুদ্দীন মাহমুদ এসে তার সাথে দেখা করলো। এ থেকে মনে করা যেতে পারে, এ সময়ে অরঘুনদের সাথে তার সুসম্পর্ক

বাবর নামা

১১৩

চলছিল। ১২ই ডিসেম্বর এল নীল-আব থেকে মহম্মদ আলী জুঙজাঙ। পরদিন ভীর থেকে সংগুর খান জনজুহা এসে দেখা করলো। সুতরাং ভীর পর্যন্ত সমগ্র বিজিত অঞ্চল তার হাতের মুঠোয় আছে জেনে বাবর নিশ্চিত বোধ করলেন নিশ্চয়ই। হালকা মন নিয়ে এবার তিনি কাব্যচর্চার দিকে মন দিলেন আংশিক ভাবে। ১৬ই ডিসেম্বরের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন : ‘আলী শের বেগের চার দিওয়ান-এর গীত ও পদগুলিকে মাত্রানুসারে সাজিয়ে প্রতিলিপি রচনা শেষ করলাম। ২০শে ডিসেম্বর তিনি এক সামাজিক আসরের আয়োজন করেন। এতে আদেশ জারী করা হয়, যদি কাউকে এ আসর থেকে মাতাল হয়ে বার হতে দেখা যায় তবে আর কখনো তাকে আসরে নিমন্ত্রণ করা হবে না। এরূপ কাব্য চর্চা বা আনন্দ উৎসবের মধ্যেও বাবর কিন্তু রাজকার্যের প্রতি আদপেই উদাসীন থাকলেন না। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চললেন তিনি : নজর তখন যতো সম্ভব সম্পদ সংগ্রহের দিকে। তা না হলে হিন্দুস্তানের সুলতান ইব্রাহীম লোদীর

তিনি?

তার

সাথে অস্ত্রের পাল্লায় কী ক’রে মুখোমুখি হবেন

ডিসেম্বর মাসে তিনি প্রমোদ ভ্রমণে বার হলেন কোহদমন, কোহিস্তান ও লমঘান যাবার লক্ষ্য নিয়ে। বলার মতো কোন ঘটনাই ঘটলো না। খাজা শিয়ারান, দর-নমা হয়ে নিজর-আউ এলেন। এখানে এসে ঠিক করলেন লমঘান যাবেন। বাজৌরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললেন তিনি। এ রাজ্য তারই কর্মচারীদের দ্বারা শাসিত তখন। শাসনকর্তা লঙ্গর খান নিয়াজাই তাকে সম্বর্ধনা জানালেন বাগ-ই-ওয়াফায়। কয়েকদিন সেখানে থেকে ভীর অভিযান করলেন তিনি বিদ্রোহীদের দমন করবার জন্য। বিদ্রোহীরা ইতিপূর্বে তার প্রতিভূ হিন্দু বেগকে এখান থেকে বিতাড়িত করেছিল। ভীর আক্রমণ করলেন তিনি। অসংখ্য আফগান মারা পড়লো, অনেকে বন্দী হলো। কৃষকরা এতে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো। তারা এদের হাতে নিপীড়িত হয়ে চলছিল।

এরপর শিয়ালকোটের দিকে এগিয়ে চললেন বাবর। সেখানকার অধিবাসীরা তার বশ্যতা স্বীকার ক’রে নিল। শিয়ালকোট অধিকারে সফল হয়ে এবার তিনি গেলেন সৈয়দপুর। এখানকার অধিবাসীরা অনমনীয় মনোভাব নিয়ে দুর্জয়ভাবে প্রতিরোধ ক’রে চললো। তখন তিনি উদ্দাম আক্রমণ চালালেন। দুর্গ বিধ্বস্ত ক’রে সমগ্র সেনাবাহিনীকে নিঃশেষ করলেন। লাহোর অধিকার করার বাসনা নিয়েই এ অভিযানে বার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না।

১১৪

বাবর নামা

ইতিমধ্যে খবর এল শাহ বেগ অরঘুন তার রাজ্য আক্রমণ করেছে। অভিযান অসমাপ্ত রেখে রাজ্য রক্ষার জন্য কাবুল ছুটলেন সাথে সাথে।

শাহ বেগ অরঘুনের এই খোলাগুলি শত্রুতা বাবরকে সচেতন ক’রে তুললো। তিনি উপলব্ধি করলেন যতদিন কন্দহার অবিজিত থাকবে ততদিন তার রাজ্যের নিরাপত্তা এবং হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তা বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে থাকবে। একে অবিলম্বে জয় ক’রে নেয়া প্রয়োজন। কাবুল ফিরে এসে তিনি অরঘুনদের তার রাজ্য সীমানা থেকে হটে গিয়ে কন্দহার দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলেন। পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হবার জন্য বাবর তাদের পিছু তাড়া ক’রে কন্দহার পর্যন্ত ছুটে গেলেন। অবরোধ করলেন দুর্গ। কিন্তু দেখা গেল এ দুর্গ জয় করা সহজসাধ্য নয়। অতএব অবরোধ ক’রে চলা মূর্খতা বুঝে এক বা দু মাস পরে সৈন্য নিয়ে ফিরে চলে এলেন। ঠিক করলেন, কন্দহারকে দুর্বল ক’রে তার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার জন্য এবার থেকে তাকে নিয়মিত আক্রমণ ও লুটতরাজ

ক’রে চলবেন ;

১৫২০ অব্দে বদকশানের সুলতান মীর্জা খানের মৃত্যু হলো। ছেলে সুপেইনান নাবালক। আমীররা একতাবদ্ধ নয়। যে কোন মুহূর্তে উদবেগরা দেশ আক্রমণ করে বিপদের সৃষ্টি করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে একজন নাবালক কী ক’রে রাজ্য চালাবে? সুতরাং সুলেইমানকে নিয়ে তার মা সুলতান নিগার খানুম কাবুল চলে এলেন। তাদের বাবরের কাছে আশ্রয় নিতে দেখে বদকশানের আমীরাও বাবরকে অনুরোধ জানালেন রাজাশাসন চালাবার জন্য পরিবর্ত কোন ব্যবস্থা করার জন্য। বাবর তদনুসারে তার বড় ছেলে হুমায়ূনকে শাসনভার দিয়ে সেখানে পাঠালেন। মা মাহমিকে নিয়ে হুমায়ূন বাবরের নির্দেশে সেখানে চলে গেলেন।

এদিকে বাবর পূর্ব পরিকল্পনা মতো আবার কন্দহার অভিযান করলেন। অবরোধ করলেন কন্দহার শহর ও দুর্গ। স্থানীয় সৈন্যরা প্রবল বাধা দিয়ে চললেও শেষ পর্যন্ত বেশ দুর্দশার মুখোমুখি হলেন। খাদ্যাভাব ও সংক্রামক রোগের ফলে আক্রান্ত ও আক্রমণকারী দুই পক্ষই চরম দুর্দশায় পড়লেন। অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন দুজনেই। অবরোধ তুলে নিয়ে জুন মাসে কাবুল ফিরে এলেন বাবর।

১৫২০ অব্দের শেষ ভাগে বাবর সস্ত্রীক হুমায়ুনের সাথে দেখা করার জ বদকশান গেলেন। ফিরে এসে পরের বছর আবার কন্দহার অভিযান করলেন।

ধ্বংস ও লুটতরাজ করতে করতে এগিয়ে গেলেন তিনি। তার কার্যকলাপ

1

বাবর নামা

১১৫

কন্দহারের সাধারণ মানুষকে গভীর দুর্দশা ও অন্নকষ্টের মধ্যে ঠেলে দিল। ধ্বংস, লুঠতরাজ ও বর্বর আচরণকে মনে প্রাণে ঘৃণা করলেও এবং এজন্য মুঘলদের দীর্ঘকাল ধরে বাধা ও কঠোর সমালোচনা ক’রে এলেও, কাবুল বিজয়ের পর থেকে একে যে তিনি তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সীমিত ভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন আফগান উপজাতিদের প্রসঙ্গে তা আমরা দেখেছি। এবার

কন্দহারের বেলা তা আমরা আবার দেখলাম। তবে যে-সব অঞ্চল একদা তৈমুরলঙের সাম্রাজ্যের অধীন ছিল ইতিপূর্বে, সে সব অঞ্চলে সর্বদাই তিনি নীতি হিসাবে লুটতরাজকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। এক্ষেত্রে কন্দহার এক বিশেষ ব্যতিক্রম। যাই হোক, এভাবে কন্দহার দুর্গের গোড়ায় পৌঁছে দুর্গ অবরোধ করলেন তিনি। সেখানকার সেনাবাহিনীর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করলেন। শাহ ‘বেগ অরঘুন আক্রান্ত হয়ে পার্যের শাহ ইসমাইল সফরীর সাহায্যপ্রার্থ

হলেন। কারণ জানা না গেলেও এ সময়ে পারস্যের শাহর সাথে বাবরের সুসম্পর্ক ছিল না। সম্ভবতঃ বাবরের অদম্য সাহস ও সংগঠন শক্তি এবং তার সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্নের সাথে তিনি সুপরিচিত ছিলেন বলেই তার ক্রমবর্ধমান শক্তি ও কন্দহার অধিকার প্রচেষ্টাকে তিনি সুনজরে দেখতে পারছিলেন না। তবে এ সময়ে তিনি তুর্কীদের সাথে যুদ্ধে বিশেষ ভাবে বিব্রত ছিলেন বলে অরঘুনদের কোন রকম সাহায্য করার পরিস্থিতিতে ছিলেন না। সুতরাং অরগুনদের বিব্রত না করার জন্য তিনি বাবরকে এক অনুরোধ পত্র পাঠালেন। বাবরও অন্যান্যবারের মতো খুব সুচতুর ভাষায় পত দিয়ে তাকে জানালেন : অরন শাসকেরা পারস্যের শাহের প্রতি আনুগত্যের ভাব দেখালেও তারা আসলে শাহের শত্রুতাচারণ ক’রে চলেছে। তিনি এই কপট আচরণকারীদের শায়েস্তা ক’রে শাহের পদপ্রান্তে পাঠাবেন। এ পত্র শাহের কাছে পৌঁছবার পর হীরাটের আমীররা শাহকে বাবরের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য অনুপ্রাণিত করার অনেক চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির চাপে তাতে তিনি রাজী হলেন না। তবে, যে কারণেই হোক বাবরও অবরোধ তুলে নিয়ে কন্দহার থেকে ফিরে এলেন। হয়তো শাহকে চটানো অদূরদর্শী কাজ হবে মনে করেই তিনি এমনটি করলেন।

তাই বলে সংকল্পচ্যুত হলেন না বাবর। পরের বছর (১৫২২ অব্দ ) আবার তিনি যথারীতি কন্দহার অভিযানে বার হলেন। বার হবার কয়েকদিন পূর্বে তিনি পারস্যের রাজকুমার তাহমম্পের এক কর্মচারী দুরমেশ খানের কাছ থেকে এক পত্র পেলেন। এ থেকে তিনি জানতে পেলেন যে রাজকুমার কন্দহার জয়ের

১১৬

বাবর নামা

জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাবরও এজন্য চেষ্টা করবে ভেবে তিনি শেষ পর্যন্ত তার এরূপ অভিযান থেকে নিরস্ত থাকলেন। এ চিঠি বাবরকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। সবদিক বিবেচনা ক’রে তিনি কন্দহার থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। সুরু করলেন পশ্চাত-অপসরণ। এদিকে শাহ বেগ অরঘুনও বাবরের হাত থেকে কন্দহার বাঁচানো অসম্ভব মনে করে মৌলানা আবদুল বাকীর উপর শহর রক্ষার ভার দিয়ে সিন্ধু চলে গেলেন। সে বছরের জুলাই মাসেই মারা গেলেন তিনি। এক অভাবনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মৌলানা আবদুল বাকী এক বিশেষ দূত মাধ্যমে বাবরের কাছে শহর ও দুর্গ সমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন। বাবর দ্বিধা না ক’রে সাথে সাথে কন্দহার ছুটে গেলেন (৬ সেপবের ১৫২২ )। এভাবে শেষ পর্যন্ত বিনা যুদ্ধেই কন্দহার তার হাতের মুঠোয় চলে এলো। কিছুদিন পরে দ্বিতীয় ছেলে মীর্জা কামরানের উপর তার শাসনভার অর্পণ করলেন তিনি। কামরান হুমায়ুনের চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের ছোট।

এ ঘটনার পর বাবর তার কন্দহার বিজয়-সাফল্যের খবর দিয়ে পারস্যের শাহের কাছে দূত পাঠালেন। পারসিকরা বরাবর কন্দহারের উপর তাদের আইনসঙ্গত দাবীর কথা শুনিয়ে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘটনাকে হজম ক’রে নিতে বাধ্য হলেন। তাদের নির্বিকার মনোভাব বাবরকে আরো উৎসাহিত ক’রে তুললো। তিনি আর এক পা এগিয়ে হেলমুণ্ডের গর্মশীর দুর্গও দখল ক’রে নিলেন। এভাবে পারসিক ও উজবেগ আক্রমণ ব্যর্থ করার পক্ষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দুটি দখল ক’রে বাবর তার রাজ্যের স্থিতি সুদৃঢ় ক’রে তুললেন। স্বস্তির সাথে এবার তিনি হিন্দুস্তানে তার স্বপ্নকে সফল ক’রে তোলার দিকে মন দিলেন।

হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এ সময় ক্রমশই তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির অনুকূল হয়ে চলছিল। দিল্লী মুসলসান অধিকারে যাবার পর থেকে প্রকৃত পক্ষে কোন সময়েই তার সিংহাসনকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের বিরাম ছিল না। আফগান লোদী আমলকেও তা সংক্রামক ব্যাধির মতো ঘিরে ধরেছিল। বহু উপজাতিতে বিভক্ত আফগানদের মধ্যে প্রথম থেকেই ঐক্যের একান্ত অভাব। প্ৰত্যেকেই উদগ্রীব ছিল নিজ নিজ গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য—আত্মস্বার্থ চরিতার্থের জন্য। এমনকি লোদী উপজাতির আফগানরাও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। ফলে নির্ভাবনায় আত্মপ্রত্যয়ের সাথে রাজ্য পরিচালনা যুবক ইব্রাহিম লোদীর পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। নিজেকে কিছুটা দৃঢ় ভাবে

বাবর নামা

১১৭

সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথেই তাই তিনি মন দিলেন বয়স্ক আমীরদের সরিয়ে তার প্রতি অনুগত নবীনদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে। এভাবে রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে নিজের অনুকুলে আনতে। কিন্তু যেরূপ ধৈর্য ও চতুরতার সঙ্গে এ কাজটি করা প্রয়োজন তা তিনি ক’রে উঠতে পারলেন না। ফলে পরিস্থিতি ক্রমশঃ ঘোরালো হয়ে চললো। অধিকাংশ আমীরই তার শত্রু হয়ে উঠলো। এছাড়া আপন কাকা আলম খান এবং পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী তো আছেনই।

বয়স্ক আমীরদের ক্ষমতাচ্যুত হতে দেখে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদীও আশংকায় দিন গুণে চলছিলেন। তার আশংকা সত্যে পরিণত হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে, ইতিমধ্যেই তিনি তার ছেলে দিলাওয়র খানকে কাবুলে বানরের কাছে পাঠিয়েছিলেন তার সাহায্যে ইব্রাহীম লোদীকে বিতাড়িত করার জন্য (১৫২১-২২)।

প্রায় একই সময়ে আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। ইব্রাহীম লোদীর কাকা আলম খান ছিলেন গুজরাটে, সেখানকার সুলতান মুজাফফরের কাছে। এক আমীর তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সুলতান আলাউদ্দীন নামকরণ সহ দিল্লীর সুলতান রূপে ঘোষণা ক’রে বসলেন। কিন্তু ইব্রাহীম লোদীকে সিংহাসন থেকে হটানো তার পক্ষে দুঃসাধ্য দেখে সুলতান আলাউদ্দীনও

সাহায্যের জন্য বাবরের কাছে এলেন।

অল্প কিছুকালের মধ্যে মেবারের রাণা সঙ্গের (সংগ্রাম সিংহ) কাছ থেকেও একটি পত্র পেলেন বাবর। তিনিও যৌথ ভাবে দিল্লী আক্রমণ ক’রে লোদী- বংশের পতন ঘটিয়ে নিজেদের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগাভাগি ক’রে নেবার প্রস্তাব পাঠালেন তার কাছে। ভাগ কিরূপ ভাবে হবে তারও এক স্পষ্ট প্রস্তাব দিলেন তিনি। আগ্রা পর্যন্ত সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ যাবে রাণা সংঘের দখলে এবং দিল্লী পর্যন্ত পশ্চিমাংশ বাবরের দখলে। হিন্দু রাজাদের মধ্যে এ সময়ে রাণা সঙ্গই ছিলেন সব থেকে শক্তিশালী। তিনি তখন রাজপুতদের প্রধান। স্থানীয় এক শক্তিশালী রাজার কাছ থেকে এরূপ এক প্রস্তাব নিঃসন্দেহে লোভনীয়।

বাবর তার চতুর্থ ভারত অভিযানের জন্য উপযুক্ত ভাবে প্রস্তুত হলেন। ১৫২৪ অব্দে তিনি তার কতক আমীরের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠালেন শিয়াল- কোট ও লাহোর অধিকারের উদ্দেশ্যে। সেই সাথে লোদী সাম্রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ ক’রে তার কাছে পাঠাবার নির্দেশ দিলেন।

১১৮

বাবর নাম।

এর মধ্যে দৌলত খান লোদীর চক্রান্তের খবর জানতে পেলেন ইব্রাহীম লোদী। বাবর সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন এ সংবাদও পেলেন। দৌলত খান ও তার ছেলেদের দমন করার জন্য ও কোন বিদেশী শত্রুর অভিযান হলে তা প্রতিহত করার জন্য এক বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন বিহার খান, মুবারক খান লোদী ও ভিকম খান নুহানীর অধীনে।

সুলতানের বাহিনী দৌলত খানকে লাহোর থেকে তাড়িয়ে শহর অধিকার ক’রে নিলেন। কিন্তু এ সাফল্য নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হলো। সুলতানের সেনানায়কেরা যখন পাঞ্জাবে বিদ্রোহীদের নিয়ে ব্যস্ত সেই অবকাশে বাবর সিন্ধু নদ পার হয়ে অতি আচমকা লাহোরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এরূপ অভাবিত আক্রমণের জন্য সুলতানের বাহিনী আদপেই প্রস্তুত ছিলেন না। বিহ!র খান ও মুবারক খান দুর্গে ঠাই নিয়ে প্রতিরোধ ক’রে চলার পরিবর্তে অভিযানকারীদের আক্রমণ করলেন। প্রচণ্ড লড়াই ক’রেও শোচনীয় ভাবে

হেরে গেলেন তারা। বাবর শহর মধ্যে প্রবেশ করলেন। ২২শে ও ২৬শে জানুয়ারী, দুদিন শহর পোড়ান হলো। তারপর এগিয়ে গেলেন দীপালপুর। তাকেও বিধ্বস্ত ক’রে দখলে আনলেন তিনি।

বাবরের কাছ থেকে বিরাট কিন্তু বড়োই হতাশ হতে হলো

বিতাড়িত দৌলত খান এবার তার দুই ছেলে ঘাজী খান ও দিলাওয়র খানকে নিয়ে দীপালপুরে বাবরের সাথে মিলিত হলেন। কিছু প্রতিদান প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। তাকে। তিনি দেখলেন বাবর তার সাথে জোটের শরিকের মতো আচরণ না ক’রে প্রভুর মতো আচরণ করছেন। লাহোর নিজ অধিকারে রেখে বাবর শুধু মাত্র জালন্ধর ও সুলতানপুর দিলেন তাকে। দৌলত খান সাময়িক ভাবে পরিস্থিতিকে অসন্তুষ্ট মনে মেনে নিলেও এর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজতে থাকলেন। বাবরকে আক্রমণ ক’রে পাঞ্জাব থেকে হটিয়ে দেবার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু তার ছেলে দিলাওয়র খান তা পছন্দ করলেন না। তিনি বাবরের প্রতি অনুগত থেকে এ ষড়যন্ত্রের খবর জানালেন তাকে। বাবর দৌলত খানকে আটক ক’রে নজরবন্দী রাখলেন। দিলাওয়র খানকে সুলতানপুরের শাসনভার দিলেন তিনি। সুলতান আলাউদ্দীন বা আলম খানের উপর দেয়া হলো দীপালপুরের ভার। কাবুল ফেরার আগে দৌলত খানকে মুক্তি দিলেন বাবর। তিনি গিয়ে

নিকটবর্তী পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নিলেন।

বাবর কাবুল ফিরে যাবার পরে পাঞ্জাবের পরিস্থিতির অবনতি দেখা

বাবর নামা

১১৯

দিল। দৌলত খান লোদী এবার স্বাধীনভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন বাবরের সাথে জোটবদ্ধ থেকে তার সার্থসিদ্ধির আশা কম। সে পাঞ্জাবকে নিজের দখলে রাখতে চায়। আপন ছেলে দিলাওয়র খানকে পরাস্ত ক’রে দৌলত খান সুলতানপুর দখল করে নিলেন। সুলতান ইব্রাহীম লোদী পাঞ্জাব পুনরুদ্ধারের জন্য বে সৈন্যদলকে পাঠালেন তাকেও পরাজিত করলেন। তারপর আলম খান লোদীর বিরুদ্ধে অভিযান ক’রে তাকেও হটালেন দীপালপুর থেকে। আলম খান আবার বাবরের কাছে কাবুল পালিয়ে গেলেন।

দিল্লীর তখতে বসার স্বপ্ন তখনও ত্যাগ করেননি আলম খান। কাবুল গিয়ে তিনি বাবরের কাছে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি জানাবার সাথে সাথে তার কাছে প্রস্তাব রাখলেন, যদি বাবর তাকে দিল্লীর তখতে বসতে সাহায্য করেন তবে তিনি লাহোর পর্যন্ত হিন্দুস্তানের পশ্চিমাংশ তাকে ছেড়ে দেবেন। পারস্যের শাহকে বালখ থেকে উজবেগদের তাড়িয়ে দেবার কাজে সাহায্য করার জন্য বাবরকে এ সময়ে বালখ যেতে হলো। তিনি তাই তার পাঞ্জাবস্থ কর্মচারীদের কাছে একটি ফরমান সহ আলম খানকে পাঞ্জাব পাঠালেন। দিল্লী বিজয়ে আলম খানকে সাহায্য করার জন্য এ ফরমানে কর্মচারীদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মচারীরা সেই নির্দেশ মতো তাকে সাহায্য করতে অনিচ্ছা দেখাল। কেননা, তারা তাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখে চলছিল। তখন আলম খান ঘাঙ্গী খানের ছেলে শের খানকে তার পিতা ও দৌলত খানের কাছে পাঠিয়ে, বাবরের বাহিনীর বিরুদ্ধে জোট বাঁধার চেষ্টায় মাতলেন। ঘাজী থানও আলম খানকে বাবরের শিবির থেকে সরিয়ে আনার জন্য তার সাথে জোট বাঁধতে রাজী হয়ে গেলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন বিদেশী সাহায্য ছাড়াই তাকে দিল্লীর তখতে বসাবেন।

আলম খান বাবরের দলত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আফগানরা খুশী হলেন। এমনকি দিলাওয়র খানও তার সাথে যোগ দিলেন এবং অন্যদের দলে টানলেন। সকলে এবার ঘাজী খানের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলেন।

প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে দিল্লী অবরোধ করা হলো। কিন্তু ইব্রাহীম লোদীর কাছে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত দোয়াব অঞ্চলে পালিয়ে গেলেন আলম খান। তারপর সেখান থেকে পানিপথ। শতদ্রু পার হয়ে আশ্রয় নিলেন কিনকুল দুর্গে। কিন্তু বাবরের হজারা ও আফগান বাহিনী দুর্গ ঘিরে ফেলে গভীর রাতের অন্ধকারে তাকে পালিয়ে

১২০

বাবর নামা

যেতে বাধ্য করলে। ঘাজী খানের কাছে উপস্থিত হলে তিনি এবার আর তাকে তখন তিনি পেহলুরে বাবরের সাথেই আবার যোগ

আমল দিলেন না।

দিলেন।

তবে এতেদৌলত খান ও ঘাজী খান অথবা আলম খান কারোই কোন সুবিধা হলো না। ইব্রাহীম লোদীর কাছে জোর মার খেলেন তারা। হতাশায় ভেঙে পড়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য আবার তারা সকলে বাবরের দ্বারস্থ হলেন। ১৫২৪-এর অভিযান ও তার পরবর্তী ঘটনাধারা থেকে বাবর বুঝতে পেরেছিলেন যে পাঞ্জাবে তার হৃতগৌরব উদ্ধার করতে হলে আরো তীব্র ও সংঘবদ্ধ সমর অভিযান প্রয়োজন।

এরূপ অভিযানের আয়োজন করা বাবরের পক্ষে খুব সহজ কাজ ছিল না। এজন্য প্রচুর অর্থ, যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সতর্ক পরিকল্পনার প্রয়োজন। দৌলত খান এবং আলম খানের মতো লোকের উপর নির্ভর করাও কোন কাজের কথা নয়। তাছাড়া অন্যের পায়ে হাঁটার অভ্যাস তিনি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ত্যাগ করেছেন। তিনি জেনে গেছেন তাতে অন্যেরাই তাকে মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে দেবে। আবার, কোন বিষয়ে একবার সংকল্পবদ্ধ হলে তা থেকে পিছু হটতে বাবর শেখেননি। হিন্দুস্থানে সাম্রাজ্য গড়ার জন্য তিনি এখন একাগ্র। অতএব যথাসম্ভব প্রস্তুত হয়ে ১৫২৫ অব্দের শেষে ১৫ই সেপটেমবর কাবুল থেকে রওনা হলেন তিনি। বড় ছেলে হুমায়ুনকেও খবর দিলেন বদকশান থেকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে অবিলম্বে তার সাথে যোগ দিতে। দেহ-আকাতে হুমায়ুন ও খাজা কলান বাবরের সাথে যোগ দিলেন। ১৬ই ডিসেমবর সিন্ধু নদ পার হলেন। নীল-আব নদী তীরে পৌঁছে ছাউনি ফেললেন তিনি। বক্সীদের

আদেশ দিলেন সৈন্য সংখ্যা কতো তা গুণে জানাতে। তারা গুণে জানালেন, সংখ্যায় সৈন্যরা মোট বারো হাজার।

নীল-আব নদীতীরে থাকাকালে বাবর খবর পেলেন ঘাজী খান ও দৌলত

খান তাদের কথার খেলাপ করেছেন। তারা ৩০ থেকে ৪০ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেছে ও বিরুদ্ধ কার্যকলাপ করার পরিকল্পনায় রয়েছে। তারা কলনউর দখল ক’রে এগিয়ে চলেছে লাহোর, সুলতান ইব্রাহীম লোদীর আমীর ও অনুগামীদের আক্রমণ করার জন্য। বাবর পাঞ্জ বে থাকা তার আমীরদের কাছে তার আগমন সংবাদ পাঠিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন। নীল আব পার হয়ে এলেন কছকোট। তারপর হরুর নদীতীরে বলনাথ যোগী হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে ভেট-এ।

বাবর নামা

১২১

এখানে এসে খবর পেলেন শিয়ালকোট দুর্গের রক্ষক সরাউ কুকু লদাস ঘাজী খান সসৈন্যে এগিয়ে আসছে শুনে দুর্গ ত্যাগ ক’রে চলে এসেছে। ভ্রূক্ষেপ না ক’রে তবু এগিয়ে চললেন বাবর। খবর এলো ঘাজী খান ও দৌলত খান পথরোধ ক’রে তাকে প্রতিহত করার জন্য ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে ক্রমে নিকটবর্তী হচ্ছে। বাবর ফরমান জারী ক’রে তার আমীরদের জানিয়ে দিলেন, তিনি না পৌঁছান পর্যন্ত তারা যেন আফগান বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেন। দ্রুত চলে চন্দ্রভাগা নদী-তীরে পৌঁছে সেখানে ছাউনি ফেললেন তিনি। ২৯শে ডিসেমবর আবার যাত্রা শুরু ক’রে শিয়ালকোটের দিকে বাঁক নিলেন। অধিকার করলেন শিয়ালকে।ট দুর্গ। সেখান থেকে নূর বেগের ভাই শাহমকে পাঠালেন লাহোর থেকে ঘাজী খানের গতিবিধি সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতে, যুদ্ধের জন্য সুবিধাজনক স্থান নির্ণয় করতে। পশরুর এসে খবর পেলেন তার এগিয়ে আসার খবর পেয়ে ঘাজী খান পিছু হটতে শুরু করেছেন। উৎসাহিত হয়ে আরো দ্রুত লাহোর এগিয়ে চললেন তিনি। আমীর মুহম্মদ কুকুলদাস, আমীর কুতলুঘ – কদম, আহমদী পরওয়ানচী, আমীর ওয়লী খাজিন প্রভৃতিকে বিরাট বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের পিছু তাড়া ক’রে মিলওয়াট ( মলোট ) দুর্গ অবরোধ করার নির্দেশ দিলেন। পরদিন বাবর নিজে সেখানে পৌঁছে দুর্গের বাইরে ছাউনি

ফেললেন।

অল্পকাল মধ্যেই দৌলত খানের অবস্থা

কিন্তু ঘাজী খান সে দুর্গে ছিলেন না। ছিলেন শুধু দৌলত খান ও আলী খান। বাবর আলী খানকে নিজের পক্ষে টানলেন এবং গৃহ-শত্রু রূপে কাজ করার জন্য দুর্গের ভেতরে পাঠালেন। কাহিল হয়ে উঠলো। নিরাপদে জীবন নিয়ে চলে যেতে দেবার সর্তে বাবরের কাছে দুর্গ সমর্পণ করলেন তিনি ( ৭ই জানুয়ারী ১৫২৬ )। তার বিষয় সম্পত্তি তালিকা ক’রে সৈন্যদের মধ্যে বেঁটে দেবার আদেশ দিলেন বাবর আলী খান ও পরিবারের অন্যান্যদের সহ দৌলত খানকে নিরাপদে মীর খলীফার বাড়ি পৌঁছে দেয়া হলো। সেখানেই রইলেন তারা।

বর্তমান বাবর আর আগের বাবর নন, যার কাছে বাস্তবের চেয়ে আদর্শ বড়ো ; যিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে শত্রুকে নিরাপদে ফিরতে দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন। তাই পরদিন দুর্গের প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ক’রে তিনি ঘাজী খানের খোঁজে অনুসন্ধান বাহিনী পাঠালেন। দৌলত খান, আলী খান ও ইসমাইল খানকে ভীর-এ নিয়ে গিয়ে সেখানকার

দুর্গে বন্দী ক’রে রাখার

১২২

বাবর নামা

হুকুম দিলেন। সেই মতো ভীর নিয়ে যাবার পথেই মারা গেলেন দৌলত

থান

ঘাজী খানের সন্ধান চালিয়েও তাকে ধরতে পারলেন না বাবর। তিনি দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাহিনী নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে শিরহিন্দের সীমানায় এসে পৌঁছলেন বাবর। ঘর্ঘরা নদী-তীরে ছাউনি ফেললেন। এখানে তিনি অরইশ খান ও মৌলানা মুহম্মদ মজহবের কাছ থেকে পত্র পেলেন। এরা দুজনেই ইব্রাহীম লোদীর সেনানায়ক! তারা বাবরকে এগিয়ে আসার জন্য প্রেরণাবাণী পাঠিয়ে জানিয়েছেন, তারা সদলে তার সাথে যত তাড়াতাড়ি পারেন যোগ দেবেন। এ পত্র বাবরকে উৎসাহিত করলো। তিনি বন্ধুত্বের আশ্বাস দিয়ে দূত মাধ্যমে তাদের কাছে পত্র পাঠালেন।

আরো দু যোজন এগিয়ে রূপার হয়ে শিরহিন্দ এলেন বাবর। তারপর বনুর ও সনুর নদী পার হলেন। এ পর্যন্ত কোথাও কোন প্রতিরোধের মুখোমুখি হননি তিনি। তার অগুয়া বাহিনীর কাজেও তিনি খুসী। তাকে প্রয়োজনীয় খবর ঘুগিয়ে চলেছে সাফল্যের সাথে।

তারা সারা পথ

ঘুগিয়ে চলেছে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ। বনর নদীতীরে পৌঁছে তিনি গুপ্তচরের মুখে খবর পেলেন ইব্রাহীম লোদী তাকে বাধা দেবার জন্য দিল্লী থেকে এগিয়ে আছেন। যে রণক্ষেত্রে তিনি কিছুদিন আগে আলম খান লোদীকে পরাজিত করেছেন সেখানেই বর্তমানে ছাউনি ফেলেছেন। ইব্রাহীম লোদীর বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত খবর সংগ্রহের জন্য এবার কিট্টা বেগকে পাঠানো হলো। মোমিন আটকাকে পাঠানো হলো ইব্রাহীম লোদীর খাস খইল বাহিনীর খবর নিতে। এই বাহিনীকে হমিদ খান খাস খইলের নেতৃত্বে তাকে বাধা দেবার জন্য হিসার-ফীরুজে জমায়েত করা চলছিল।

বাবর আরো এগিয়ে অম্বালায় ছাউনি ফেললেন। তার সামনে এবার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা! বিজিত অঞ্চলে নিজের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা ও ইব্রাহীম লোদীর সাথে যুদ্ধ করা। উভয় কাজ যথাযথ ভাবে ক’রে চলার জন্য তিনি কাবুল থেকে আলা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি বসালেন। এজন্য যে অঞ্চলগুলিকে বেছে নিলেন তিনি তা হলো বদাম-চশমা, আলী মসজিদ, পেশোয়ার, শিয়ালকোট, পশরুর, কলনউর, মহলোট, বহলোলপুর ও রূপার। এ ব্যবস্থা সূচনা ক’রে বাবর এখন শুধু দুঃসাহসী নন, দূরদর্শীও। আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন ও সমরকুশলী। সম্পূর্ণ এক অজানা,

বাবর নামা

১২৩

অচেনা অঞ্চলে এগিয়ে চলেছেন তিনি, যে-কোন বিপদে পড়তে পারেন, যে-কোন মুহূর্তে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে আগুয়া বাহিনীর কাছ থেকে এ ক্ষেত্রে কাবুলের সাথে যোগাযোগ রেখে চলা তার পক্ষে অত্যাবশ্যক।

হমিদ

কোন রকম প্রতিরোধ

তিনি তখনো অম্বালায়। চর খবর আনলো হমিদ খান তার বাহিনী নিয়ে হিসার-ফিরুজ থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। তাকে বাধা দেবার জন্য হুমায়ূনকে পাঠালেন তিনি। এই বাহিনী যাতে দিল্লী হতে এগিয়ে আসা বাহিনী থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে সেজন্যও ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয়া হলো হুমায়ুনকে খান নিজেকে কাপুরুষ বলে প্রমাণ করলেন এ যুদ্ধে। চেষ্টা না করেই তিনি ভয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে ফিরুজ ও জালন্ধর বাবরের অধিকারে এলো। বিজয় একরকম সম্পূর্ণ হলো বলা যেতে পারে। সামরিক দিক থেকেও এর ফলে তিনি যথেষ্ট সুবিধাজনক পরিস্থিতি লাভ করলেন। সেনাবাহিনীর মনোবলও যথেষ্ট বেড়ে গেল। উৎসাহ ও উদ্দীপনা খেলে গেল তাদের মধ্যে।

গেলেন। ফলে হিসার-

এর ফলে বাবরের পাঞ্জাব

তবু অতি সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন বাবর। যতোই হোক সম্পূর্ণ অজানা! অচেনা দেশে অজানা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলেছেন তিনি। চারদিকে খবর সংগ্রহের জন্য নিপুণভাবে গুপ্তচরের জাল ছড়িয়ে দিলেন। অম্বালা থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণে এগিয়ে এলেন শাহাবাদ। এখানে দিন কয়েক কাটিয়ে পার হলেন যমুনা নদী, পৌঁছলেন সরসোয়া। সংবাদ এলো, পাঁচ-ছয় হাজার সেনা নিয়ে দাউদ খান ও হাতিম খান ইব্রাহীম লোদীর নির্দেশে যমুনা পার হবার উদ্দেশ্যে এগিয়ে এসেছে ও বাবরের বাহিনী থেকে বর্তমানে তারা ছ-সাত মাইল দূরে রয়েছে। সাথে সাথে তাদের আক্রমণ করার জন্য সেনাদল পাঠানো হলো। প্রকৃত পক্ষে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীর সাথে এই প্রথম বাবরের বাহিনীর সংঘর্ষ হলো। এ লড়াইয়ে হাতিম খান হেরে গিয়ে প্রাণ খোয়ালেন। সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ দিয়ে প্রাণভয়ে যেদিকে পারলো ছুট দিল।।

এই পিটুনি ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীর মনোবল যে বেশ দমিয়ে দিয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। অন্য দিকে বাবর ও তার বাহিনী আরো উদ্দীপিত হবার কথা।

সম্পুর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় ব্যূহ রচনা ক’রে এবার এগিয়ে চললেন বাবর আদেশ দিলেন যেখানে যতো শকট মেলে সংগ্রহ ক’রে আনার জন্য। 900 গাড়ি জোগাড় হলো। সেগুলিকে বাঁধা হলো ‘চামড়ার রশি দিয়ে। প্রতি

128

বাবর নামা

জোড়া গাড়ির মাঝে বর্ম আঁটা হলো। তার আড়ালে পলতে বন্দুকধারী- দের আদেশ মাত্র গুলীবর্ষণের আদেশ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো।

এগিয়ে চলে ১৫২৬ অব্দের ১২ই এপ্রিল বাবর দিল্লীর উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি ছোট গ্রাম পানিপথে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভবিষ্যত কর্ম-পরিকল্পনা স্থির করার জন্য এখানে এক পরামর্শ সভা ডাকলেন তিনি। অনেক আলোচনার পর, ভূ-প্রকৃতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দিক বিচার বিবেচনা ক’রে সৈন্য-সমাবেশের স্থান নির্বাচন করা হলো। বাবর নিজে সতর্ক ভাবে স্থান পরিদর্শন করে কোন্ শাখা-বাহিনী কোথায় স্থান নেবে তা নির্দিষ্ট ক’রে দিলেন। সুদৃঢ় প্রতি- রোধ ব্যূহ রচনার জন্য তিনি ডাইনে থাকা পানিপথ শহর বেছে নিলেন। বাঁয়ে পরিখার পর পরিখা কেটে ডালপালা দিয়ে তা ঢেকে দিয়ে ফাঁদ তৈরী করা হলো। মাঝে রাখা হলো ৭০০ গাড়িকে। প্রতি জোড়া গাড়ির মাঝে ঝোলানো হলো ৫।৬ টি ক’রে মেয়েদের ছোট ঢিলে জামা। সারিবদ্ধ গাড়ির ফাকে ফাকে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর একশো থেকে দুশো অশ্বারোহীর যাতায়াতের মতো পথ রাখা হলো। বর্ম ও জামার আড়াল করা গাড়ির পিছনে পলতে বন্দুকধারীরা স্থান নিলো। অশ্বারোহীরা রইলো তাদের পার্শ্বরক্ষক হিসেবে। সেনা সমাবেশের বেলা বাবর বিশেষভাবে নজর রাখলেন যাতে তার বাঁ ও ডানের শাখা বাহিনী পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকে, সম্মুখ বাহিনী যাতে জামার আড়াল থেকে স্বচ্ছন্দে শত্রু সেনার উপর তীর ছুঁড়তে পারে। পরিকল্পনা নেয়া হলো, নির্ধারিত সময়ে আগুয়া বাহিনী অতকিতে শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর সম্মুখ বাহিনীতে থাকা ও পরিখা মধ্যে থাকা বন্দুকধারীরা শত্রুপক্ষ এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে তাদের রুখবে। শকটের সাহায্যে প্রতিরক্ষা ব্যূহ এমনভাবে সাজানো হলো যে প্রয়োজন মতো সেনারা যেমন খুসী এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে পারবে, সহজেই শত্রুসেনাকে ঘিরে ফেলতে পারবে। যে ভাবে বাবর ব্যূহ রচনা করলেন তাতে মধ্য বা কেন্দ্র বাহিনীও বেশ অল্প জায়গার মধ্যে রইলো, তাদের সহযোগিতা করার জন্য রইলো সামনের গোলন্দাজ ও বন্দুকধারীরাও।

এ যুদ্ধে বাবর যে নতুন ধরনের ব্যূহ রচনা ও সমর কৌশল প্রথম হিন্দুস্তানে প্রবর্তন করলেন তার পিছনে রয়েছে তার দীর্ঘকালের সমর-অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞত! তিনি সঞ্চয় করেছেন মধ্য এশিয়ায় সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধে অবলম্বিত কৌশলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীর পক্ষে এ কৌশল এক বিরাট ফাঁদ হয়ে দেখা দিল।

বানর নামা

১২৫

নিজের অসহিষ্ণু ও চতুরতাশূন্য পদক্ষেপের দ্বারা বয়স্ক আমীরদের শত্রু করে তুলে ইব্রাহীম লোদী যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি রচনা করেছিলেন এবার তিনি তার সম্পূর্ণ শিকার হলেন। দিল্লী থেকে যাত্রার বেলা তিনি একলক্ষ সৈন্য ও এক হাজার রণহস্তী নিয়ে বার হলেও ১২ এপ্রিল যখন পানিপথে পৌঁছলেন তখন তার বাহিনীতে এক হাজার রণহস্তী ও পঞ্চাশ হাজারের বেশি সৈন্য ছিল না। আবার শত্রু সেনা থেকে আগে রণস্থলে পৌঁছেও তিনি দর্শকের মতো চুপ দাঁড়িয়ে থেকে বাবরকে সমর-প্রস্তুতির সুযোগও দিলেন। কোনরূপ আক্রমণাত্মক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা সৈন্যবাহিনীর মনোবলকে উদ্দীপিত করার, তাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টাও করলেন না। চেষ্টা করলেন না বাবরের সামরিক শক্তি ও সমরকৌশল জানবারও। শত্রুবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থার উপরও কোন- রকম আঘাত হানার চেষ্টা করলেন না তিনি। আবার রাণা সংগ্রাম সিংহ ও পূর্বাঞ্চলীয় আফগান- প্রধানদের সাহায্য-সহযোগিতা সংগ্রহের চেষ্টাও এব অভিযান কালে তিনি করেননি। এ থেকে মনে করা যেতে পারে, বাবরকে তিনি একজন অসম প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করেছিলেন। বহু সৈন্য দলত্যাগ সত্ত্বেও তার সৈন্যসংখ্যা বাবরের তুলনায় বেশি থাকার দরুন তিনি সম্ভবতঃ বাবরকে সহজে পরাজিত করতে পারবেন, এরূপ এক ধারণায় বিভোর হয়ে ছিলেন। হমিদ খানের রণভঙ্গ ও হাতিম খানের পরাজয় তাকে সতর্ক ক’রে তুলতে – পারেনি।

আট দিনের মধ্যেও যখন অফগানদের দিক থেকে কোন আক্রমণাত্মক ক্রিয়াকলাপ সুরুর লক্ষণ দেখা গেলনা তখন নিজের পরিকল্পনা যাতে ভেস্তে না যায় সেজন্য বাবর সক্রিয় হয়ে উঠলেন। আফগানদের তাতিয়ে দেবার জন্য মেহদী খাজার নেতৃত্বে এক আগুয়া বাহিনীকে পাঠালেন আচমকা তাদের আক্রমণ করার জন্য। ১৯ ও ২০শে এপ্রিল দুদিন ধরে তারা শত্রু শিবিরে হানা দিয়ে তাদের প্ররোচিত ক’রে চললো আক্রমণ করার জন্য। তারা আফগান সেনাদের উপর তীর বর্ষণ ক’রে চললো, তাদের কতক সেনাকে বন্দী ক’রে মুণ্ড কেটে তা যুদ্ধের স্মারক রূপে শিবিরে নিয়ে গেল। কিন্তু এ সত্ত্বেও ইব্রাহীম লোদী নিশ্চুপ বসে রইলেন। তখন, ২০শে এপ্রিল রাতে বাবর এক নৈশ অভিযানের পরিকল্পনা নিলেন। তারা প্রায় ভোর পর্যন্ত তাদের উপর হামলা ক’রে চললেন এবং তারপর রণবাদ্য বাজাতে সুরু করলেন। এতে ব!বরের উদ্দেশ্য সফল হলো। সুলতান তার অবস্থান ত্যাগ ক’রে তার

– ১২৬

বাবর নামা

সৈন্যবাহিনী নিয়ে এবার এগোতে আরম্ভ করলেন। নিজের সুরক্ষিত অবস্থান ত্যাগ ক’রে তিনি শুধু ভুলই করলেন না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবরের পাতা ফাঁকে গিয়ে পা দিলেন আগভর হয়ে।

যুদ্ধ শুরু হলো। কিন্তু বাবরের কৌশলের কাছে সুলতানের বাহিনী দাঁড়াতে পারলো না। তারা বাবরের ডানদিকের বাহিনীকে কেন্দ্র বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। সুলতান নিজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তার ডান ও বাঁয়ের বাহিনীকে বাবরের বাঁ ও ডান দিককার বাহিনী পুরো ঘেরাও ক’রে ফেললো। ফলে সুলতানের কেন্দ্র বাহিনী যেন যাঁতাকলের মধ্যে পড়ে গেল। বাবরের ডান ও বাম বাহিনী এবার যুদ্ধ শুরু করলে। শকটের আড়ালে স্থান নেয়া আগ্নেয়াস্ত্র বাহিনীও সুলতানের বাহিনীকে ব্যূহ রচনা ক’রে এবার চেপে ধরলো। সব দিক থেকে চাপের মধ্যে পড়ে গিয়ে আফগানেরা মাঝে এসে ভিড় জমালো। এক অসহায় পরিস্থিতি তখন। না রইলো ছত্রভঙ্গ দিয়ে পালাবার উপায়, না অশ্বারোহী ও হস্তীবাহিনী দিয়ে মুঘল বাহিনীকে আক্রমণের উপায়। বাহে রচনা শেষ হতে মুস্তাফা ও ওদ আলী আফগান বাহিনীর উপর গুলি বর্ষণ শুরু ক’রে দিলে। রীতিমতো যুদ্ধ আরম্ভ হলে। এবার। ডান বাহিনী এঁটে উঠতে পারছে না দেখে তাকে মদত দেবার জন্য আব্দুল আজিজকে পাঠালেন বাবর। সুলতান এগিয়ে এসে বাবরের নিজস্ব বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার বিন্যাস দেখে দমে গেলেন। না আছে এগোবার উপায়, না পিছোবার। সবদিক থেকে ঘেরের মধ্যে পড়ে অন্য কোন উপায় না দেখে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ ক’রে চললেন তিনি, অনুগামীদের সমানে অনুপ্রাণিত ক’রে চললেন শত্রুব্যূহ ভেদ করার জন্য। কিন্তু সব দিক থেকে চাপ খেয়ে অল্প জায়গার মধ্যে স্থান নিতে বাধ্য হওয়ায় তার বাহিনী মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খল’ দেখা দিল। সুলতানকে দেখতে ন! পেয়েও তাদের মনোবল ভেঙে পড়লো। ইতিমধ্যে তার ডান ও বাম বাহিনীও পিটুনী খেয়ে কাহিল অবস্থায়। তারাও তখন মার খেয়ে মাঝে এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। চলেছে তাদের উপর বাবরের আগ্নেয়াস্ত্র বাহিনীর অবিরাম অগ্নিবর্ষণ। তখন শুধু পড়ে পড়ে মার খাওয়া। দুপুরের মধ্যেই এই হৃদয়- বিদারক দৃশ্যে যবনিকা পড়লো। যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে হাজার মৃতদেহের স্তূপ। খুব অল্প আফগানই প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে। মসুদ খান ইব্রাহীম লোদীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ক’রে

বাবর নামা

১২৭

বীরের মতো মৃত্যুবরণকেই শ্রেয় বলে বিচার করলেন তিনি। যুদ্ধ করতে করতেই একসময়ে লুটিয়ে পড়লেন রক্তেভেজা মাটির উপর। তার মৃতদেহকে ঘিরে প্রায় পাঁচ থেকে ছ হাজার যুবক ও বয়স্ক আফগান যোদ্ধার শবদেহ।

১৫২৬ অব্দের ২০শে এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে এই যে যুদ্ধ হলো এ আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে অসহায় মানুষের অসম লড়াই ছাড়া আর কিছুই না। ইব্রাহীম লোদীর অদূরদর্শী অযোগ্য নেতৃত্বের দরুনই পঞ্চাশ হাজার আফগান সেনাকে অসহায় ভাবে প্রাণ দিতে হলো। অপরদিকে বাবরের বিজয় ও যে

যোগ্যতর নেতৃত্ব ও উন্নততর প্রযুক্তিকৌশলের বিজয় এতে সন্দেহ নেই।

দখল অভিযানে।

এ যুদ্ধে জয়লাভ ক’রে সাথে সাথে বাবর দিল্লী ও আগ্রা অধিকারের জন্য পদক্ষেপ নিলেন।

ছেলে হুমায়ূন ও খাজা কলানকে পাঠানো হলো আগ্রা- দিল্লী দখলের জন্য পাঠানো হলো মেহদী খাজা, মুহম্মদ সুলতান মীর্জা, আদিল সুলতান প্রভৃতিকে ৪ঠা মে আগ্রায় পৌঁছলেন হুমায়ূন। গোয়ালিয়রের শাসক বিক্রমজিতের ও আফগানদের আপ্রাণ প্রতি- রোধকে গুড়িয়ে দিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই আগ্রা দখল ক’রে ফেললেন তিনি। দিল্লী দখল ক’রে নিতেও বিশেষ বেগ পেতে হলোনা।

২৯শে এপ্রিল বাবর পানিপথ ছেড়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চললেন দিল্লীর দিকে। নমুনা নদী পার হয়ে ঢুকলেন নগরে। পরিদর্শন করলেন বিভিন্ন মুসলিম সঙ ও ফকীরদের স্মৃতিসৌধ। তারপর যাত্রা করলেন আগ্রায়। ৯ই মে আগ্রার শহরতলী অঞ্চলে পৌঁছে সুলেইমান ফরমুলীর প্রাসাদে রাত কাটালেন। পরদিন আরো এগিয়ে ঠাঁই নিলেন জলাল খান জিগহাতের প্রাসাদে। তারপর শহরে ঢুকে নিহত সুলতান ইব্রাহীম লোদীর প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন। হিন্দুস্তানের দুই রাজধানী দিল্লী ও আগ্রা দখলের সাথে সাথে হিন্দুস্তান বিজয়ের প্রথম পর্ব সম্পুর্ণ করলেন তিনি।

এই রাজা বদলকে দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে গ্রহণ করেছিল? আফগানদের তারা মনের মানুষ বলে মেনে নিতে না পারলেও তারা ছিলেন ঘরের ছেলে, এই মাটিরই সন্তান। অন্যদিকে বাবর বাইরের ছেলে, পুরো বিদেশী। সুতরাং অফগানদের নিপীড়ণের হাত থেকে রেহাই পাবার স্বস্তি প্রথম পর্বে তাদের ঠিক আনন্দ-উদ্বেল ক’রে তুলতে পারলো না। বরং বাবরের দুর্জয় রণদক্ষতা ও অনলবর্ষী যুদ্ধাস্ত্রের খবর দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাদের মনে আতংকের বন্যা জাগিয়ে দিলো। শহরের পর শহর, বসতির

১২৮

বাবর নামা

পর বসতি জনশূন্য হয়ে গেল। দেশের গভীরে ও দুর্গম অঞ্চলে আশ্রয় নেবার জন্ম ছুটলো সবাই। পথেঘাটে চোরডাকাতের উপদ্রব ও লুটপাটের বিভীষিকাও শুরু হলো সেই সাথে।

পরিণতিতে বীর ও সমরকুশলী হিসাবে দেশে বিদেশে বাবরের খ্যাতি বিদ্যুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লো অবশ্য। কিন্তু বিজিত সাম্রাজ্য সামলাতে, সেখানে শিকড় গেড়ে বসতে প্রথমপর্বে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে গেলেন তিনি। সৈন্যদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ ও শাসনকার্যে সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযোগিতা অর্জন বেশ দুরূহ হয়ে উঠলো তার পক্ষে। কিন্তু হিন্দুস্তান বিজেতা বাবর আর প্রথম সমরকন্দ বিজেতা বাবর এক মানুষ নন। জীবনের পাঠশালায় অভিজ্ঞতা নামের কামারের হাতুড়ির ঘা খেয়ে খেয়ে সবরকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করার মতো তীক্ষ্ণ ও শাণিত কঠিন ধাতুতে পরিণত হয়েছেন এখন তিনি। সবদিক বজায় রেখে সাধারণ মানুষের মন কীভাবে জয় করতে হয়, কী ভাবে নিজের অম্লান ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হয় তার কৌশলও তিনি অiয়ত্ত ক’রে ফেলেছেন। সুতরাং এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে বিরাট সময় লাগলো না তার। অবশ্য এখানে তিনি যে অপর্যাপ্ত ধন ঐশ্বর্য্য লাভ করেছিলেন তা এবং এখানকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সম্পদও তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এদিকে।

সাধারণ প্রজাদের যাতে লুটপাট ও পীড়ন করা না হয় প্রথম থেকেই বাবর সেদিকে সতর্ক ছিলেন। তবে আফগানদের ধনসম্পত্তি লুট ও ভূ-সম্পদ দখল ক’রে নেবার অনুমতি সৈন্যদের তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু যে সব আফগান ও আফগান প্রধান বাবরের আনুগত্য স্বীকার ক’রে নেন তাদের প্রতি উদারতা দেখান হয়। অনেককে তার সেনাদলে ভর্তি ক’রে নেয়া হলো। অনেককে তাদের জায়গীর, জোতজমি ও বৃত্তি ফিরিয়ে দেয়া হলো। সুলতান বংশের যারা যারা জীবিত ছিলেন তাদের প্রতিও প্রতিশোধমূলক আচরণ না ক’রে উদার মনোভাব দেখালেন বাবর। ইব্রাহীম লোদীর মাকে মুক্তি দেয়া হলো। তাকে বার্ষিক সাত লক্ষ টাকা আয়ের এবং পরগণাও দিলেন বাবর। এভাবে সকলের কাছে তিনি দৃঢ়চেতা, উদার ও সুশাসক রূপে নিজের ভাবমূর্তি প্রোজ্জ্বল ক’রে তুলতে চাইলেন। সুশাসন উপহার দিয়ে সাধারণের মন থেকে তার সম্পর্কে অযথা ভীতি দূর করার পদক্ষেপ নিলেন।

অভিষেক অনুষ্ঠান সহ বাবর দিল্লীর সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন কিনা

e

বাবর নামা

১২৯

তা অবশ্য জানা যায় না। তবে এ উপলক্ষে সাধারণতঃ যে ধরনের দরবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তা কিন্তু হয়েছিল। এই দরবারে তিনি হুমায়ূনকে তার কৃতিত্বের জন্য ৭০ লক্ষ টাকা এবং হিসার ফীরুজ ছাড়াও সম্ভল অঞ্চল জায়গীর হিসাবে দেন। তাছাড়া আগ্রায় হুমায়ূন বাবরকে গোয়ালিয়রের রাজবংশের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যে হীরক খণ্ড উপহার দেন সেই বিশ্বখ্যাত ‘কোহিনূর ও এ সময়ে তাকে ফিরিয়ে দেন তিনি। অন্যান্য অনুগামীদেরও তিনি উদার ভাবে জায়গীর, খেতাব, উপহার প্রভৃতি দিয়ে সন্তুষ্ট করেন। সমরকন্দ, খুরাসান, কাশগড় ও ইরাকে থাকা তার আত্মীয় স্বজনদের কাছেও বাবর উপহার স্বরূপ অর্থ পাঠালেন। এছাড়া সমরকন্দ, খুরাসান, মক্কা ও মদীনার প্রত্যেক অধিবাসীর কাছেও অর্থ পাঠান হলো। কাবুলের শহরতলী অঞ্চলে ও বদকশানের বরসক উপত্যকায় বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিককে এক শাহরুখী ক’রে দান করা হলো, তা সে মুক্ত নাগরিকই হোক আর দাসই হোক, স্ত্রী-লোকই হোক আর শিশুই হোক। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বাবর তার সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন

সফল হওয়ায় আনন্দে কতো আত্মহারা হয়েছিলেন—হিন্দুস্তান বিজয় ক’রে. তিনি কী পরিমাণ ধন সম্পদ লাভ করেছিলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *