বাবর নামা – ৩

তিন

ঘটনা ও পরিবেশ নামের বাজীকরদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে তাদের সূতোর টানে টানে এতকাল নেচে চলছিলেন বাবর। তারাই তাকে জন্ম দিয়েছে রাজার ঘরে, বসিয়েছে বালক বয়সে সিংহাসনে। গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে তারাই তাকে নাটকীয় ভাবে উদ্ধার করেছে তার আবর্ত থেকে। কিন্তু, আর তিনি খেলার পুতুল হয়ে থাকতে চাইলেন না।

তার দেহের শিরায় শিরায়

তৈমুরলঙ আর চেঙিস খানের শোণিত-প্রবাহ। সে শোণিত খেলার পুতুল হয়ে থাকতে জানে না। পিতামহীর মুখে এই দুই প্রবাদ, প্রতিমেয় শৌর্য- বীর্যের কাহিনী শুনে শুনে কর্মচঞ্চল ও সাহসী বাবরের মনে ডালিম ফুলের কুঁড়ির মতো সাম্রাজ্যের স্বপ্ন পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে। মাতামহী অইসান দৌলত বেগমের শিক্ষা ও প্রেরণা থেকে তার মনে সঞ্জীবিত হয়েছে পুতুল হয়ে না থেকে বাজীকর হবার বাসনা। পূর্ব-পুরুষ তৈমুরলঙের রাজধানী সমরকন্দের সিংহাসন থেকে ছোট জেঠা মাহমুদ মীর্জার আকস্মিক প্রস্থানের পর সমরকন্দ হয়ে উঠেছে তার কাছে পরম আকাঙ্খার নগরী।

এখুনি সমরকন্দের দিকে হাত বাড়ানো বামন হয়ে চাঁদ পাড়ার জন্য হাত বাড়ানোর সমান। তাই নিজেকে সংযত রাখলেন তিনি। শুধু গভীর আগ্রহের সঙ্গে নজর রেখে চললেন সেখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ ও ঘটনা প্রবাহের উপর।

মন দিলেন নিজের শক্তিকে সংহত ও সংগঠিত করার দিকে। সুলতান মাহমুদ মীর্জার মৃত্যু সমরকন্দের পরিস্থিতি বেশ ঘোলা করে তুলল। শুরু হয়ে গেল ক্ষমতাসীন আমীরদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে নির্লজ্জের মতো কাড়াকাড়ি, লড়াই। সোচ্চার হলো রাজ্যকে ভাগ ভাগ করার দাবি। পাঁচ ছেলে এগারো মেয়ে মাহমুদ মাঁজার। সমরকন্দ আসার সময় প্রথম ছেলে মসুদ মীর্জার উপর অর্পণ করেছিলেন হিসারের শাসন দায়িত্ব দ্বিতীয় ছেলের উপর বুথারা। সুলতানের মৃত্যুর পর বারোদিন বাইরের লোকের কাছে সে খবর গোপন রাখলেন উজীর ধুসরাউ শাহ। তাল করলেন সমরকন্দ ও তার রাজকোষ দখল করে নেবার জন্য। কিন্তু তার সে ফিকির ব্যর্থ হলো। সমরকন্দবাসীরা তাকে ঘৃণার চোখে দেখতো। তারা বিদ্রোহ করে বসলো তার বিরুদ্ধে। আহমদ হাজী বেগ ও অন্যান্য তরঘান প্রধানরা

দমন করলেন সে বিদ্রোহ।

1

অর

উজীর খুসরাউ সাহকেও সমরকন্দ থেকে নির্বাসিত

বাবর নামা

১৫

করলেন। রক্ষীদলের পাহারায় তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো হিসার। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রূপে নির্বাচিত করলেন তারা সুলতানের দ্বিতীয় পুত্র বৈশুঙ্খর মীজাকে।

এই মনোনয়নে মসুদ মীজ ওি তার সমর্থকেরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি সুলতান মাহমুদ মীজার জ্যেষ্ঠ-পুত্র। পূর্বতন সুলতান আহমদ মীর্জার দ্বিতীয় কন্যাকেও বিয়ে করেছেন আবার। তার সমর্থক আমীররা তাকে সিংহাসনে

বসাবার জন্য সাহায্য চাইলেন মেঙ্গিল- প্রধান মাহমুদ খানের কাছে। আবেদনে সাড়া দিয়ে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে সমরকন্দ দখলের জন্য এগিয়ে এলেন মোঙ্গল- প্রধান। কান-বাঈ জয় করার জন্য প্রথম সেদিকে অগ্রসর হলো তার বাহিনী। বৈশুঘর মীজ ́াও চুপ হয়ে রইলেন না। মোঙ্গল বাহি- নীকে বাধা দেবার জন্য তিনিও কান-বাঈ গেলেন তার সেনাবাহিনী নিয়ে। বিরাট রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো। মোঙ্গল সেনাবাহিনী দারুন ভাবে পরাজিত হলো প্রধান সেনানায়ক হায়দার কুকুলদাস বন্দী হলেন। বন্দী হলো অসংখ্য সৈন্য। বন্দীদের কোতল করার আদেশ দিলেন বিজয়ী বৈশুঘর মীর্জা। তার উপস্থিতিতে তার শিবিরের সামনে একের পর এক কোতল করা হতে থাকলো তাদের। বন্দীদের সংখ্যা এরূপ বিরাট যে এভাবে কোতল করার জন্য তিন তিনবার শিবির স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন বৈশুঙ্ঘর মীজ”।।

কান-বাঈয়ের যুদ্ধে বিপুলভাবে জয়লাভের পর নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে মনোযোগী হলেন বৈশুঘর মীর্জা। শুরু করলেন রাজ্যবিস্তার অভিযান। বাবরকেও সতর্ক হতে হলো এর ফলে। ছোট্ট রাজ্যটির উপরও আছড়ে পড়লো। থাকা কয়েকটি ছোট ছোট অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে গেলো।

সে যুদ্ধে।

সে অভিযানের ঢেউ তার তার পৈত্রিক রাজ্য সীমানা মধ্যে

এ সময়ে সুযোগ বুঝে মীঙ্গলীঘ উপজাতির ইব্রাহীম সারুও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা তুললো। “শিশুকাল থেকেই সে আমার পিতার অধীনে কাজ করে আসছিল। এমন কি বেগের পদেও উন্নীত করা হয়েছিল তাকে। পরে কতক দুষ্কর্মের জন্য বার করে দেয়া হয় চাকুরী থেকে। সে এ সময়ে দখল করে নিলো অফর দুর্গ। খুতবা পাঠ করলো সেখানে বৈশুঙ্খর মীজার নামে। শুরু করলো আমার সাথে শত্রুতাচারণ। তার বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রস্তুত হবার আদেশ দিলাম সেনাদের। রওনা হলাম সাবান মাসে। মাসের শেষাশেষি সেখানে পৌঁছে অবরোধ করলাম অফর দুর্গ।”

১৬

বাবর নামা

বেগতিক দেখে ইব্রাহীম সারু সাহায্যের জন্য বৈষ্ণঙ্ঘর মীর্জার কাছে আবেদন করলেন। কিন্তু তাকে সাহায্য করবেন সে পরিস্থিতি তখন বৈশুর মীর্জার নেই। মোঙ্গল-প্রধানকে রুখতে ব্যস্ত তখন তিনি।

‘চল্লিশ দিন ধরে অবরোধ চললো। ‘ অবস্থা কাহিল হয়ে পড়লো ইব্রাহীম সারুর। আর কোন উপায় নেই দেখে খাজা মৌলানা কাজীর মাধ্যমে বিনা- শর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন বাবরের কাছে। শওয়াল মাসে ( জুন, ১৪৯৫) গলায় তুণীর ওত রবারী ঝুলিয়ে দুর্গ থেকে বার হয়ে বাবরের সমুখে উপস্থিত হলেন। সমর্পণ করলেন দুর্গ।

অপরাধ মার্জনা করে আবার ইব্রাহীম সারুকে চাকুরীতে বহাল করলেন

বাবর।

এ সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বাবর এবার এগিয়ে গেলেন খুজন্দের দিকে। খুজন্দ দীর্ঘকাল তার পিতার শাসনাধীন ছিল। মৃত্যুকালে তিনি যে যুদ্ধে ব্ৰতী হন তার ফলে সুলতান আহমদ মীর্জা এটি দখল করে নেন। এবার সুযোগ বুঝে এ অঞ্চলটি দখল করার জন্য অভিযান করলেন বাবর। মীর মুঘলের পিতা আবদুল ওয়হাব শঘাওয়ল তখন এর শাসনকর্তা। বাবর যখন ইব্রাহীম সারুর বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ঠিক সে সময়ে শঘাওয়াল বৈশুঘর মীর্জার আধিপত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু বাবরকে সসৈন্যে উপস্থিত দেখে বিনা প্রতিরোধে ‘তার কাছে দুর্গ সমর্পণ করলেন তিনি।

এ সময় মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খান শাহরুখিয়তে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে বাবর ভাবলেন “দুজনে যখন এতো কাছাকাছি হয়েছি, তখন তার সাথে দেখা করে তাকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসা উচিত। তিনি আমার পিতৃস্থানীয় ও জ্যেষ্ঠ ভাই পর্যায়ের। অতীত ঘটনাবলীর দরুন যদি তার মনে কোন ভুল ধারণা থেকে থাকে তবে তা দূর করে অ’সা দরকার। এই পদক্ষেপ বর্তমান ও ভবিষ্যত উভয় দিক থেকেই সুফলদায়ক হবে। যারা আমার এ প্রচেষ্টা চাক্ষুষ দেখবে অথবা পরে শুনবে সকলের মনেই তা প্রভাব বিস্তার করবে। আরো একটি বিশেষ লাভ হবে এর ফলে। তার দরবারের হালচাল সম্পর্কেও কিছুটা স্পষ্ট ও ঘনিষ্ঠ ধারণা পাওয়া যাবে। *

“মনস্থির করে শাহরুখিয়র কাছে তার সাথে দেখা করার জন্য উপস্থিত হলাম। একটি বাগিচার মাঝখানে তোলা একটি শিবির মধ্যে তিনি বসেছিলেন। ভেতরেপৌঁছে নিচু হয়ে তিনবার কুর্ণিশ জানালাম পরিবর্তে, তিনি আসন

বাবর নামা

১৭

থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। এরপর পিছিয়ে গিয়ে আমি আবার একবার কুর্ণিশ জানালাম তাকে। খান কাছে ডাকলেন আমাকে। পাশে বসিয়ে স্নেহ ও সহৃদয়তার সার্বিক প্রকাশ ঘটালেন। এক কি দুদিন পরে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। যাত্রা করলাম অথসী ও অন্দিজানের দিকে।”

নিজের সম্পর্কে বড় মামার মনে উজ্জ্বল ধারণার সৃষ্টি করে বাবর যে তার বর্তমান পরিস্থিতিতে মোঙ্গল-প্রধানকে তার কল্যাণকামী ও সহায়ক রূপে পেতে চেয়েছিলেন এবং সেজন্যেই এই সাক্ষাৎ-সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন তার বর্ণনা থেকেই এ কথা স্পষ্ট। হয়তো বিরাট কিছু প্রত্যাশাও করেছিলেন তার কাছ থেকে। তবে তার দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকার মৌখিক আশ্বাসের উর্ধে আর কিছু মোঙ্গল-প্রধানের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন কিনা সন্দেহ।

বড় মামার সঙ্গে দেখা করার পর অথসী এলেন বাবর। পিতার সমাধি সৌধে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। যাত্রা করলেন তারপর রাজধানী অন্দিজানের দিকে।

পথে জিগরক উপজাতির লোকদের কাছ থেকে কর আদায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। ফরঘান ও কাশগড়ের মাঝে থাকা পাহাড়ী এলাকায় বাস করতো

এরা। ‘প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার পরিবার। অনেক ঘোড়া আর ভেড়া আছে এদের। রয়েছে সাধারণ ষাঁড়ের বদলে কুটা নামের পাহাড়ী ষাঁড়। দুরারোহ পার্বত্য এলাকায় বাস করে বলে এরা কর দিতে চায় না। শক্তিশালী এক বাহিনী সঙ্গে দিয়ে কাশিম বেগকে পাঠালাম জিগরকদের বিরুদ্ধে। নির্দেশ দেয়া হলো তাদের কতক সম্পত্তি দখল করে নিয়ে আসার জন্য। সৈন্যদের দেয়ার মতো কিছু সম্বল অন্ততঃ পাওয়া যাবে তাহলে। গেল কাশিম বেগ। কুড়ি হাজার ভেড়া আর এক হাজার থেকে এক হাজার পাঁচশো ঘোড়া নিয়ে ফিরে এলো সে। দিলাম বেঁটে সেগুলি সৈন্যদের ভেতর। ‘

ইব্রাহীম সারুর বিদ্রোহ দমন, খুজন্দ পুনর্দখল ও জিগরক উপজাতিদের কাছ থেকে কর আদায় পর পর এ তিন সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন বাবর বার হলেন এবার আউরাটীপা দখলের জন্য।

“দীর্ঘকাল এ অঞ্চলটি ( আমার পিতা ) উমর শেখের দখলে ছিল। তার মৃত্যুর বছরে একে হারাই। ( সুলতান আহমদ মীর্জা জয় করে নেন )। বৈশুঘর মীর্জার প্রতিনিধি রূপে তার ছোট ভাই আলী মীর্জা এখন শাসন করে চলেছে এ

১৮

বাবর নামা

অঞ্চলটি। আমি এগিয়ে আসছি খবর পেয়ে একা একা মচ পার্বত্য এলাকায় পালিয়ে গেলো সুলতান আলী মীর্জা। আউরাটীপা রক্ষার দায় চাপিয়ে গেলো তার গৃহশিক্ষক শেখ জুনুন অরঘুনের উপর। খুজন্দ পার হয়ে যখন এগিয়ে চলেছি, তখন খলীফকে দূত হিসাবে পাঠালাম শেখ জুনুনের সাথে আলোচনার জন্য। কিন্তু সেই একগুয়ে লোকটা কোন সদুত্তর দেয়ার বদলে বন্দী করলো খলীফকে। আদেশ দিল প্রাণদণ্ডের। তবে, ভগবানের ইচ্ছা সে রকমটি নয়। পালিয়ে গেল খলীফ। প্রায় মাস দু-তিনেক পর আমার কাছে ফিরে এলো একদিন। হাজারো রকম দুঃখ দুর্দশা সয়ে, পায়ে হেঁটে একেবারে নগ্ন অবস্থায়। আমি এগিয়ে গেলাম। ঢুকলাম আউরাটীপায়। শীত ঘনিয়ে আসায় যা কিছু ফসল ও পশুখাদ্য ঘরে তুলে নিয়েছে অধিবাসীরা। তাই, কয়েকদিনের মধ্যেই অন্দিজান ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।

“আমি সে অঞ্চল ছেড়ে চলে আসার পরে পরেই মাহমুদ খানের সেনারা আউরাটীপা আক্রমণ করলো। প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়ে অধিবাসীরা শহর সমর্পণে বাধ্য হলো। মুহম্মদ হুসেন কুরকানের উপর খান এখানকার শাসন ভার দিলেন।

৯০৮ হিজরী (১৫০৩ খৃীষ্টাব্দ ) পর্যন্ত তিনিই শাসন করে চললেন এ

অঞ্চল।”

আউরাটীপা উদ্ধারের চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও এজন্য হতাশ হলেন না বাবর। সব প্রচেষ্টাই কি কখনো সফল হয় মানুষের? এর আগে পরপর যে তিনটি সাফল্য তিনি লাভ করেছেন ভাই বা কম কিসে! সুতরাং, মনের সব নিজের শক্তিকে সুসংহত করার দিকে মন দিলেন তিনি।

সহায় সম্বল আছে তাকে গুছিয়ে নিতে,

গ্লানি মুছে ফেলে,

নিজের যতটুকু যা সুষ্ঠুভাবে তাকে কাজে লাগাতে তৎপর এই ব্যর্থতা তাকে সচেতন করে দিল,

হলেন। সুরু করলেন সৈন্য সংগ্রহ। নিজের শক্তি ও যোগ্যতা আরো বৃদ্ধি করতে না পারলে তার ভবিষ্যৎ সপ্ন সফল হবার নয়। আর তা করতে হবে নিজের যতটুকু যা সহায়-সম্বল আছে তা দিয়েই।

এদিকে মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানকে কান-বাঈয়ের যুদ্ধে দারুন ভাবে পরাস্ত করে সাময়িক ভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করলেও শত্রুমুক্ত হতে পারলেন না বৈশুঘর মীর্জা। অপর এক পরাক্রান্ত শত্রুর মুখোমুখি হতে হলো তাকে এবার। ইনি খুরাসা- নের সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকরা। তৈমুর লঙের বড় ছেলের বংশধর। তার ঘর!- নার রাজাদের মধ্যে তিনিই হলেন সব থেকে বিক্রমশালী। বিরাট রাজ্য। হীরাট

বাবর নামা

১৯

তার রাজধানী। পড়শীদের খরচে নিজ রাজ্যের আয়তন বাড়াতে অশেষ ধুরন্ধর তিনি। যেই দেখলেন, বিরাট এক যুদ্ধে জয়ী হলেও সুলতান বৈঙ্ঘর মীর্জা বেশ বিপাকের মধ্যেই আছেন অমনি তিনি বিরাট স্যৈবাহিনী নিয়ে হিসার অভিযান করলেন। শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধ করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত কোন যুদ্ধ না করে হিসারের শাসনকর্তা সুলতান মসুদ মীর্জা সমরকন্দ পালিয়ে এলেন ভাই বৈষ্ণঙ্ঘর মীর্জার কাছে। মসুদ মীর্জা পালিয়ে আসার দরুন দারুণ বিশৃঙ্খলা দেখা দিল বদকশান জুড়ে৷ কিন্তু দমে গেলেন না বৈশুঘর মীর্জা। শত্রুসেনাকে প্রতিহত করার জন্য ওয়ালীকে পাঠালেন খুটলান। আর বাকী চথানীয়ানী, মামুদ বরলস ও সুলতান আহমদকে পাঠালেন বদকশানের রাজধানী হিসার।

শেষে, জয়ের আশা

হিসার দুর্গ অবরোধ করলেন সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকরা। বেশ কয়েক মাস ধরে উভয় সৈন্যদলের মধ্যে থেকে থেকে সংঘর্ষ ঘটলো। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও স্থানীয় বাহিনীকে কাবু করতে পারলেন না তিনি। ছেড়ে দিয়ে শান্তির প্রস্তাব দিলেন। উভয় পক্ষের আলোচনা বৈঠকে শান্তির সর্ত নির্ধারিত হলো। স্থাপিত হলো বৈবাহিক সম্পর্ক। হুসেন মীর্জা বঈকরার ছেলে হায়দার মীর্জার সঙ্গে বিয়ে হলো সুলতান বৈশুঙ্ঘর মীর্জার বোন, মাহমুদ মীর্জার বড় মেয়ে বেগা বেগমের। এ অনুষ্ঠান শেষ হবার পর সুলতান হুসেন মীর্জা অবরোধ তুলে নিলেন। ফিরে গেলেন হীরাট। সমরকন্দের এক ইঞ্চি জমিও তার পক্ষে দখল করা সম্ভব হলো না এ অভিযানে।

এ বছরের রমজান মাসে তরখানী আমীররা বিদ্রোহ করে বসলো সমরকন্দে। তাদের ক্ষোভ, সুলতান বৈজঘর মীর্জা হিসারের অধিবাসীদের অসংগতভাবে বেশি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন, অনুগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাকে হটিয়ে দিয়ে তাই এবার তারা তার ছোট ভাই আলী মীর্জাকে সমরকন্দের সিংহাসনে বসাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিদ্রোহীদের অন্যতম দরবেশ মুহম্মদ আলী মীর্জাকে কুরশী থেকে সমরকন্দ নিয়ে এলেন। সুলতান বলে ঘোষণা করা হলো তাকে। নতুন বাগে গিয়ে ঘেরাও ও বন্দী করা হলো বৈশুঘর মীর্জাকে। নিয়ে যাওয়া হলো দুর্গে। সেখান থেকে তাকে স্থানান্তর করা হলো গুক সরাই। সঙ্গে ছিলেন আলী মীর্জাও। কেননা, এই গুক-সরাই হলো ‘এক দিকে তৈমূর বংশীয় রাজকুমারদের হত্যা-মঞ্চ, অন্যদিকে অভিষেক স্থান।

হত্যার আগেই কৌশল করে পালিয়ে গেলেন বৈশুঘর মীর্জা। আশ্রয় নিলেন খাজাকি খাজার আবাসে। সন্ধান পেয়ে বিরাট দলবল নিয়ে সেখানে হাজির

বাবর নামা

হলেন তরখানীরা। বৈষ্ণবর মীর্জাকে তাদের হাতে সমর্পণ করার দাবী জানালেন। সে দাবী পূরণ করতে অস্বীকার করলেন খাজাকি খাজা তার মান সম্মান প্রতিপত্তি তাদের তুলনায় অনেক বেশি বলে তরখানীরা তার কাছ থেকে বৈঙ্ঘর মীর্জাকে ছিনিয়ে নিতে সাহসী হলো না।

দিন কয়েকের মধ্যেই খাজা আবুল মকারম, আহমদ হাজী বেগ প্ৰভৃতি আমীররা, সেনাদল ও শহরবাসীরা পালটা বিদ্রোহ করে বসলো তরখানীদের বিরুদ্ধে। খাজাকি খাজার আবাস থেকে তারা বৈঙ্ঘর মীর্জাকে নিয়ে গেলো। অবরোধ করলো দুর্গ মধ্যে থাকা আলী মীর্জা ও তরখানী বেগদের। বেসামাল হয়ে তরখানী বেগেরা যে যেদিকে পারলো পলিয়ে গা ঢাকা দিল। আলী মীর্জাকে ছেড়ে দিয়ে গেল তার নিজের ভাগ্যের উপরে। তরখানী বিদ্রোহীদের অন্যতম নায়ক মুহম্মদ মজীদ তরখান পালিয়ে বুখারায় গেলেন। মুহম্মদ তরখান ও আল? মীর্জা বন্দী হলেন বৈশুঙ্ঘর মীর্জার সমর্থকদের হাতে।

আলী মীর্জাকে অন্ধ করে দেবার আদেশ দেয়া হলো। নিয়ে যাওয়৷ হলো সেজন্য গুক-সরাইয়ে। তাতানো শলাকা টেনে দেয়া হলো দু-চোখে। যে শল্য- বিদের উপর এ কাজের ভার পড়েছিল তিনি আলী মীর্জার সমর্থক বলেই হোক বা তার প্রতি অনুকম্পা বশতঃই হোক, কাজটি এমন কায়দায় করলেন যে আলী মীর্জা তার দৃষ্টিশক্তি খোয়ালেন না। সুযোগ মতো পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন খাজা য়াহিয়ার কাছে। দিন কয়েক পর বুখারায় গিয়ে যোগ দিলেন তরখানী বেগদের সাথে

এবার সমরকন্দে সুরু হয়ে গেল জনযুদ্ধ।

আলী মীর্জার পালিয়ে যাবার খবর পেয়ে তাকে ও তার সমর্থকদের দমন করার জন্য বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে বৈঙ্ঘর মীর্জা বুখারায় ছুটলেন। আলী মীর্জা ও তার সমর্থকরাও চুপ রইলেন না। বিরাট ভাবে পরাজয় ঘটলো বৈশুঘর মীর্জার। ধানী সমরকন্দে ফিরে এলেন।

প্রস্তুত হলেন যুদ্ধের জন্য। যুদ্ধে বাধ্য হয়ে পিছু হটে তিনি রাজ-

বালক বাবর সমরকন্দের সিংহাসনে বসার সোনালী স্বপ্ন নিয়ে এতকাল দূর থেকে এখানকার ঘটনাপ্রবাহের উপর সজাগ দৃষ্টি রেখে চলছিলেন। উত্তাল জনযুদ্ধ ও আলী মীর্জার হাতে সুলতান বৈশুঙ্ঘর মীর্জার শোচনীয় পরাজয় তাকে উৎসাহে চঞ্চল করে তুললো। ভাবলেন, সমরকন্দ জয়ের এমন অমৃত-সুযেগা জীবনে কখনো আর আসবে না হয়তো।

বাবর নামা

কতোই বা বয়স তার তখন! সবে তেরো পেরিয়ে চৌদ্দয় পা দিয়েছেন। শক্তিতে, যোগ্যতায় না তিনি আলী মীর্জার সমকক্ষ, না বৈভবর মীর্জার। যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই বা কতটুকু! বলতে গেলে প্রকৃত যুদ্ধ কাকে বলে তাই জানেন না এখন পর্যন্ত। তবু এ সুযোগ নষ্ট করতে চাইলেন না তিনি। দুঃসাহ- সাঁর মতো বেরিয়ে পড়লেন সমরকন্দ অভিযানে (জুন, ১৪৯৬)।

বৈশুঙ্ঘর মীজার বড় ভাই মসুদ মীর্জাও পরম সুযোগ দেখে সিংহাসনের উপর তার হক দাবী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সসৈন্যে সমরকন্দের দিকে যাত্রা করলেন সময়ে। এছাড়া আলী মীর্জা ও তার সমর্থকরা তো আছেনই।

তিনদিক থেকে তিনজনের সেনাবাহিনী অবরোধ করলো সমরকন্দ। “তিন’ থেকে চারমাস এ ভাবে সমরকন্দ তিনদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থায় রইলো। আলী মীর্জার কাছ থেকে খাজা য়াহিয়া সন্ধি ও জোটবাঁধার প্রস্তাব নিয়ে এসময়ে এলো আমার কাছে। অতি নিপুণভাবে সব এগিয়ে নিয়ে গেলো সে। ব্যক্তিগত ভাবে আমরা দুজনে বৈঠকের জন্য সম্মত হলাম। এজন্য সেনাবাহিনী নিয়ে আমি তিন-চার ফারসঙ্গ এগিয়ে গেলাম সোগধ থেকে এগিয়ে সমরকন্দের দুই কি তিন গজ চের-ই ( আট মাইলের মতো) দূরে উপস্থিত হলাম। উলটোদিক থেকে সেও তার সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে এলো। তারপর চার-পাঁচজন সঙ্গী নিয়ে এগিয়ে এলো আলী মীর্জা। আমিও এগিয়ে গেলাম সমান সংখ্যার সঙ্গী নিয়ে। কোহিক নদীর মাঝখানে ঘোড়ার পিঠে বসে মোলাকাত হলো আমাদের। অল্প কিছুক্ষণ সৌজন্যভরা আলাপ-আলোচনার পর সে তার দিকে, আমি আমার দিকে ফিরে

এলাম।

“সুলতান আলী মীর্জার সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের পর শীতঋতু আসন্ন দেখে ও সমরকন্দে ভীষণ খাদ্যাভাব লক্ষ্য করে আমি অন্দিজান ফিরে এলাম। সুলতান আলী মীর্জা চলে গেল বুথারায়। সুলতান মসুদ মীর্জা শেখ আবদুল্লা বরলাসের কন্ঠার গভীর আকর্ষণে পড়ে, নিজের পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে হিসার ফিরে গেলো। অথচ তার সমরকন্দ আসার এটিই কিন্তু একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল

না।

“আলী মীর্জার সঙ্গে আমার বৈঠকে স্থির হয়েছিল, গ্রীষ্ম ঋতু এলে সে বুখারা থেকে, আমি অন্দিজান থেকে গিয়ে সমরকন্দ অবরোধ করব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *