বাবর নামা – ১

এক

‘হিজরী ৮৯৯ সংবতে, রমজান মাসে ( জুন, ১৪৯৪ খ্রী.), বারো বছর বয়সে ফরঘান রাজ্যের রাজা হলাম আমি।’

হিন্দুস্তানের বাদশা হবার পর নিজের অতি বিচিত্র জীবন-স্মৃতি লিখতে বসে তার সূচনা এই কটি কথা দিয়েই করেছেন বাবর।

বাবর (বাবুর) তার ভালো নাম নয়, ডাক নাম। ভালো নাম জহীরউদ্দীন মুহম্মদ। বিখ্যাত পীর হজরত নসীরুদ্দীন খাজা উবাদুয়েল্লা এই নামটিই রাখেন তার। গোষ্ঠীর লোকদের মুখে এ নামটি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে বেশ কষ্ট হতো। তাই, বাবর নামেই তাকে ডাকতেন তারা। আর পরে, সেই নামেই বিখ্যাত, ইতিহাস খ্যাত হয়ে গেলেন তিনি।

কল্পনায় রাজা সাজা বা যাত্রাদলে রাজা সাজা এক কথা আর সত্যিকারের রাজা হওয়া অন্য কথা। তাও আবার মাত্র বারো বছর বয়সে।

যাত্রাদলে যিনি রাজা সাজেন তাকে রাজ্য চালাতে হয় না। অভিনয় দিয়ে দর্শক-চিত্ত জয় করে ফেলতে পারলেই বাজিমাৎ করে ফেলেন তিনি। যিনি কল্পনায় রাজা সাজেন তিনি সারাক্ষণ দিবাস্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকলেও তার রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যায় না। কিন্তু আসল রাজার সে ভয় রয়েছে। তাকে রাজ্য চালাতে হয়, রাজ্য রক্ষার দায়ও কাঁধের উপর তুলে নিতে হয়। আর, শেষ রক্ষা করতে না পারলেই

বাবর যে যুগের মানুষ, রাজ্য রক্ষা করা খুব সহজ কাজ ছিলনা সে যুগে। তিনি যে অঞ্চলে রাজা হয়েছিলেন, বিশেষ করে সেই মধ্য এসিয়ায় তো নয়ই। সেখানে তখন অনেক রাজা, অনেক রাজ্য। প্রায় সকলেই চেঙিস খান অথবা তৈমুর লঙের বংশধর। তারাই তাদের রাজ-আদর্শ। সকলের চোখেই দিগ্বিজয়ের রঙীন নেশা। চেঙিস খান বা তৈমুরের মতন খ্যাতিমান হবার খোয়াব। অথচ পৃথিবী যে মাত্র একটিই। ফলে সব রাজারই ভাগ্য, রাজ্য সীমানা আর স্থিতি রবারের বেলুনের মতোই অনিশ্চিত! হরেক সময়ে হরেক আকার। কখনো বা ফটাস করে ফেটে গিয়ে পুরোপুরি হাওয়া।

পিতামহ আবু সৈয়দ মীর্জা হলেন তৈমুর বংশীয়। তৈমূরের দ্বিতীয় পুত্র মীরান শাহের নাতি। রাজ্যশূন্য অবস্থা থেকে বেশ একটি বড়ো রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি আপন প্রচেষ্টায়। হয়ে উঠেছিলেন তৈমূর বংশীয়দের মধ্যে অগ্রগণ্য।

মাতামহ য়ূনস খান ছিলেন চেঙিস খানের বংশধর। মোঙ্গল প্রধান। আবু সৈয়দ মীর্জাই তাকে মোঙ্গল প্রধানের আসনে বসতে সাহায্য করেছিলেন। অকৃতজ্ঞ ছিলেন না য়ূনস খান। মৈত্রী বন্ধন সুগভীর করার জন্য আবু সৈয়দ মীর্জার চার ছেলের মধ্যে তিন ছেলের সঙ্গে তিনি তার তিন মেয়ের বিয়ে দেন।

বংশীয় রীতি অনুসারে চার ছেলের মধ্যে আপন রাজ্য ভাগ করে দিয়ে গেলেন আবু সৈয়দ মীর্জা। বড় ছেলে এবং য়ূনস খানের বড়ো জামাই আহমদ মীর্জা পেলেন বুখারা ও সমরকন্দ। দ্বিতীয় ছেলে উলুঘ বেগ মীর্জা পেলেন কাবুল ও ঘজনী (গজনী )। বদকশান, খুতলান এবং হিন্দুকুশ ও অসফর পর্বতমালা মধ্যবর্তী অঞ্চল পেলেন তৃতীয় ছেলে মাহমুদ মীর্জা। ছোট ছেলে উমর শেখ মীর্জার ভাগ্যে জুটলো ছোট ফরঘান রাজ্য। এক মায়ের সন্তান ছিলেন না এরা চার ভাই, ছিলেন চার ভিন্ন ভিন্ন মায়ের।

বাবরের পিতা উমর শেখ মীর্জা ছিলেন ছটফটে, খুনসুটে প্রকৃতির মানুষ। উচ্চাকাঙ্খাও ছিল শক্তি ও সাধ্যের তুলনায় বড়ো বেশি। দূরদর্শিতারও অভাব ছিল। দিগ্বিজয়ের নেশা তার দুচোখে রঙ ধরিয়ে দিয়েছিল। পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ছোট ফরঘান রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না তিনি। দিগ্বিজয়ী তৈমুর লঙের তিনি নাতির নাতি। এতটুকু রাজ্যের শামুক খোলসের মধ্যে অলস হয়ে পড়ে থাকা কি তার শোভা পায়? না কি, তাতে তার মান সম্মান বজায় থাকে?

অতএব পড়শী রাজ্যগুলির সঙ্গে বাদ-বিসম্বাদ জুড়ে তাদের এলাকার উপর লোভের কামড় বসাতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু দাঁত শক্ত থাকলে তবে তো কামড়ে খাবেন। তাই, প্রতিবারেই উলটো ফল ফললো। নিজের রাজ্যখানিই একটু একটু করে আরো ছোট হয়ে চললো তার। আর, সব থেকে বড় ক্ষোভের কথা, এই জমির বেশির ভাগই গেল আপন শ্বশুর মোঙ্গল-প্রধান য়ূনস খানের কব্জায়।

ক্ষোভে ফেটে পড়ে শ্বশুরের সঙ্গেই বিবাদ জুড়ে দিলেন উমর শেখ মীর্জা। কিন্তু শক্তিতে তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন কেন? তার সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেলেন তিনি। বন্দী হলেন। শিকলে বেঁধে মোঙ্গল-প্রধানের কাছে হাজির করা হলো তাকে। জামাইকে এ অবস্থায় দেখে উঠে গিয়ে তার বাঁধন খুলে দিলেন মোঙ্গল-প্রধান। নানা উপহারাদি দিয়ে তাকে আদর- আপ্যায়ন করে উপদেশ দিলেন—এখুনি নিজ রাজ্যে ফিরে যাও। নিশ্চয় সেখানে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দিয়েছে, তা সামলাও গিয়ে আগে। শুধু উপদেশই নয়, নিজেও সপরিবারে এলেন তিনি ফরঘানে। জামাইয়ের সঙ্গে দু মাস কাটিয়েও গেলেন।

মোঙ্গল-প্রধান য়ূনস খানের এই ব্যবহার থেকে মনে হয় জামাইয়ের ভূমি গ্রাস করার কোন কুটিল বাসনা সম্ভবতঃ কোনকালেই তার মনে ছিল না। তাকে সংযত রাখার বাসনা থেকেই বোধহয় তিনি প্রত্যেকবার তার সাহায্যের মূল্য হিসাবে উমরের রাজ্যের অংশ বিশেষ তার কাছ থেকে গ্রাস করে নিচ্ছিলেন।

য়ূনস খান মারা যাবার পর তার রাজ্য মুঘলিস্তান তার দুই ছেলে মাহমুদ খান ও আহমদ খানের মধ্যে ভাগ হল। বড় ছেলে মাহমুদ খানই হলেন মোঙ্গল প্ৰধান।

এদিকে বার বার ঘা থেয়েও উমর শেখ মীর্জার চৈতন্য হলো না। এরপরও তিনি তার বড় ভাই সুলতান আহমদ মীর্জা ও বড় শ্যালক মাহমুদ খানের সঙ্গে বিবাদ বাধাতে গেলেন।

আহমদ মীর্জাও য়ূনস খানের জামাই, মাহমুদ খানের (সৎ) ভগ্নিপতি তার উপর ইদানীং তারা বিশেষ মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। এই মৈত্রীকে আরো দৃঢ় করার জন্য মাহমুদ খানের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে আহমদ মীর্জার মেয়ের। উমর শেখ মীর্জার কার্যকলাপে দুজনেই ক্রুদ্ধ হলেন। চিরকালের মতো তার রাজ্যক্ষুধা মিটিয়ে দেবার সংকল্প করলেন তারা। ঠিক হলো দুদিক থেকে দুজনে তারা সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়ে ফরঘান রাজ্য জয় করে নেবেন। সমরকন্দ থেকে সুলতান আহমদ মীর্জা সির নদীর দক্ষিণ দিকের পথ ধরে এগিয়ে ফরঘানে প্রবেশ করবেন। এগিয়ে যাবেন সোজা রাজধানী অন্দিজান। মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খান এগোবেন গিরিপথ পার হয়ে সির নদীর উত্তর দিক থেকে। আক্রমণ করবেন অথসী দুর্গ।

সংকল্প মতো বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে দুদিক থেকে এগিয়ে এলেন দুজনে। পরিকল্পনার প্রথম পর্বটিও কার্যকর করলেন সাফল্যের সঙ্গে। ফরঘান রাজ্যের অস্তিত্বই এবার উবে যাবার দাখিল হলো। কিন্তু উমর শেখ মীর্জা দমে গেলেন না। ধন-সম্পদ-রাজ্য-জীবন বাজী রেখে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। রাজধানী অন্দিজানের রক্ষা ও শাসন ভার শিশু বাবরের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজে এগিয়ে গেলেন অথসী দুর্গ রক্ষার জন্য। বাবরকে সাহায্য করার জন্য রেখে গেলেন খুদা-ই-বীদী ও আরো কয়েকজন বিশ্বস্ত বেগ বা আমীরকে।

অখসী পৌঁছে উমর শেখ মীর্জা সঠিক ভাবে সৈন্য সমাবেশ ও প্রতিরক্ষা আয়োজন সম্পূর্ণ করার আগেই এক অভাবনীয় দুর্ঘটনা ঘটল। উমর শেখ মীর্জা কবুতর পুষতে ও তার খেল-কসরত দেখতে ভালবাসতেন। অখসী দুর্গে একটি কবুতরখানা ছিল তার। এটি তৈরী হয়েছিল একটি খাড়া পাহাড়ের উপর, তার যেদিকটি নদীর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সেখানে। একদিন উমর শেখ মীর্জা যখন সেই কবুতরখানার ভেতর, বাড়িটি আচমকা ধসে পড়লো। ভগ্নস্তূপে চাপা পড়ে সাথে সাথে প্রাণ হারালেন তিনি। বয়স সবে তখন মাত্র ৩৯ বছর। এই শোকাবহ ঘটনার তারিখ ৪ রমজান, ৮৯৯ হিজরী বা ৮ই জুন ১৪৯৪ খ্ৰীষ্টাব্দ।

দুর্ঘটনার খবর পরদিনই চলে এলো অন্দিজানে। শিশু বাবর তখন অন্দিজানের চারবাগে। শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথায়। কিন্তু শোক করার, অশ্রু ঝরাবার অবকাশ কোথায়? রাজ্য রক্ষাই যে এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে উঠেছে এই মূহূর্তে। এক বিন্দু সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে তিনি তার অনুগামীদের নিয়ে ছুটে চললেন অন্দিজান দুর্গের দিকে, দুর্গ রক্ষার জন্য। শুরু হল তার অতি অনিশ্চয়তায় ভরা ঘটনাবহুল রোমাঞ্চকর জীবনের সূচনা যা একদিন নাটকীয় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অতি বিচিত্র গতি নিয়ে অভাবনীয় ভাবে শেষ হয়েছিল দিল্লীর

পর্ব।

মসনদ অধিকারের পর। সেদিন বাবর ও তার পরিজনেরা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন যে এই বালকই একদিন হবে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা? না, তা ভাবতে পারেন নি, পারা সম্ভবও ছিল না।

শিশু রাজার কাছে তখন তো তার অস্তিত্ব রক্ষাই বিরাট প্রশ্ন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *