৯
সম্বলপুর স্টেশনে আমরা পৌঁছোলাম ভোরবেলা।
প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রীতম বলল, এখানকার জিলিপি খুব ফেমাস। আয়, আগে চা আর জিলিপি খেয়ে নিই।
জিলিপি আবার বিখ্যাত-অবিখ্যাত কী? গরম-গরম জিলিপি সব জায়গাতেই ভালো লাগে। বিশেষত সকালের দিকে। কিন্তু প্রীতমের জিলিপির নেশা। যে—
কোনো জায়গায় গিয়ে সে জিলিপির খোঁজ করবেই।
গোটা প্ল্যাটফর্ম ঘুরেও কোথাও জিলিপির সন্ধান পাওয়া গেল না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে কী করে দেবীগড় যাব রে? প্রীতম বলল, দাঁড়া না, সেসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আগে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে নিই। জঙ্গলে তো আর জিলিপি পাওয়া যাবে না!
এত বড় একটা রেল স্টেশনে জিলিপি ভাজা হচ্ছে না, এও তো খুব আশ্চর্য ব্যাপার!
বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সি, রিক্সাওয়ালাদের চিলুবিলু উপেক্ষা করে খানিকটা এগিয়ে একটা দোকান পাওয়া গেল। সেখান থেকে কচুরি ভাজার গন্ধ আসছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, সেই রকম কচুরির সঙ্গে জিলিপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
হ্যাঁ, দোকানটাতে জিলিপিও আছে বটে, কিন্তু ছোট ছোট আর সাদাটে রঙের এই জিলিপিকে মোটেই বিখ্যাত বলা যায় না।
আমি বেশি কচুরি আর কম জিলিপি, প্রীতম দু’খানা কচুরি ও দশখানা জিলিপি খেয়ে নিল। তারপর কফি। এদিকের ট্রেন লাইন ধরে যতই দক্ষিণে যাওয়া যাবে, ততই চায়ের বদলে কফির চল বেশি।
কোথাও একসঙ্গে বেড়াতে গেলে আমরা সব সময়েই খরচ ভাগাভাগি করি। আমি পকেটে হাত দিতেই প্রীতম বলল, তোকে কিছু দিতে হবে না। তুই তোর ট্রেন ভাড়াটা দিয়েছিস, এই ঢের। বাকি সব আমি ম্যানেজ করব।
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম, আমার কাছে টাকা আছে, প্রীতম। প্রীতম বলল, বলছি তো, লাগবে না। এক্সপেন্স অ্যাকাউন্ট!
—সে তো বড় বড় চাকরি যারা করে, তারা পায়। তুই কোথা থেকে পাবি!
—আমাদেরও হয় রে, কনট্রাক্ট সার্ভিস। তুই শুধু আমার ক্যামেরার ব্যাগটার ওপর সব সময় নজর রাখবি। কোথাও ভুলে ফেলে না যাই।
তারপর সে বেয়ারাকে ডেকে বলল, আমাকে একটা বিল কিংবা ক্যাশমেমো দাও!
কচুরি-জিলিপি খেয়ে কোনোদিন বিল চাইতে আমি কারুকে দেখিনি। এই দোকানে সে ব্যবস্থাই নেই। প্রীতম নিজেই একটা সাদা কাগজে লিখিয়ে, রাবার স্ট্যাম্প মারিয়ে নিল মালিককে দিয়ে।
তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে বলল, আমাদের তাড়াহুড়োর কিছু নেই। প্রথম দিনটা পুরো রেস্ট। তারপর কাজ।
—প্রীতম, তুই এখানে কী কাজ নিয়ে এসেছিস, তা আমাকে এখনো বলিসনি কিন্তু।
–বলবও না। সিক্রেট। প্রফেশানাল সিক্রেসি আমাদের মেইনটেইন করতে হয়!
—ফটোগ্রাফারদের আবার সিক্রেট কি? ছবি তুলবি, লোকে দেখবে। ছবি কখনো মিথ্যে বলে না। এর মধ্যে লুকোচুরির তো কোনো স্কোপ নেই।
—আছে, আছে! ছবি কখনো মিথ্যে কথা বলে না, এটা তুই ঠিক ধরেছিস। তোর তো জঙ্গলে বেড়ান নিয়ে কথা? মনের খুশিতে বেড়াবি। এ ছাড়া, যা দেখবি কিংবা যা শুনবি, সেসব একদম চেপে যাবি। কলকাতায় ফিরে কারুকে গল্প করা চলবে না।
—কী ব্যাপারটা বল তো, প্রীতম? তুই যে রীতিমতন রহস্য করে তুললি? নাকি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস?
প্রীতম কোনো উত্তর না দিয়ে হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, চল, একটা জিপ ভাড়া করতে হবে।
স্টেশনের বাইরের চত্বরে বেশ কয়েকটা গাড়ি রয়েছে। প্রীতম এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে দরাদরি করতে লাগল। আমি আর তাতে অংশ নিলাম না।
মা আর বৌদিকে একেবারে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে আমাকে আসতে হয়নি।
সোমবার সকালেই দাদা ফিরে এসেছে দিল্লি থেকে। দাদাকে আমি সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।
বাড়িওয়ালার হুমকির কথা শুনেই দাদা চটে আগুন। যেন আমিই সেই বাড়িওয়ালা এই রকম ভঙ্গিতে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে দাদা বলল, কী, আমরা এতদিনের ভাড়াটে, এক মাসের জন্যও ভাড়া দিতে ফেইল করিনি, আমাদের তুলে দিলেই হলো? মামদোবাজি? দেশে আইন-আদালত নেই! ওর নামে আমি মামলা করব। দশ বছর ধরে ওর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাব!
আমি বললাম, কিন্তু উনি যে করপোরেশানকে ধরে নোটিশ বার করেছেন। এই বাড়ি বিপজ্জনক, ভেঙে ফেলতে হবে!
—ভাঙলেই হলো? বাড়ির লোকজন কোথায় যাবে? সে দায়িত্ব কে নেবে?
—করপোরেশান নেবে না!
-বাড়িওয়ালা তা হলে আমাদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে দিক!
—তা কখনো দেয়? কোনো বাড়িওয়ালা এরকম উদার হয়, তা তুমি কখনো শুনেছ? উনি তো আমাদের তাড়াতেই চান। এ বাড়ি ভেঙে সেখানে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হবে!
—তা হলেও টেমপোরারিলি আমাদের কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। নতুন বাড়িতে ফ্ল্যাট দিতে হবে। এটাই নিয়ম!
—তুমি তপনদাকে চেনো তো! তপনদাদেরও এই একই কেস। বাড়িওয়ালা বেচে দিচ্ছে জমি। নতুন বাড়ি বানাবে অন্য লোক, প্রোমোটার। সে পুরোনো ভাড়াটেদের লায়াবিলিটি নিতে চাইবে কেন? তপনদাদের বাড়িওয়ালা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে।
পঞ্চাশ হাজার টাকার কথা শুনে দাদা একটু থমকে গেল।
ভুরু কুঁচকে গেল, তপনদা পেয়ে গেছে পঞ্চাশ হাজার টাকা?
—নাঃ। তপনদা নেয়নি। রিফিউজ করেছে। তপনদা কলকাতার বাড়ি ছেড়ে বম্বে চলে যাচ্ছে।
–কেন, নিল না কেন? পঞ্চাশ হাজার ইজ নট আ জোক!
—তপনদার যে বড্ড অহংকার।
—অহংকার না ছাই! ভয় পেয়েছে! তপনদাটা বরাবরের ভীতু। কলকাতা ছেড়ে বম্বে পালিয়েছে। আই অ্যাম আ হার্ড নাট টু ক্র্যাক। আমি সহজে ছাড়ছি না। আমি পঞ্চাশ হাজারেও রাজি হব না! অন্তত এক-দেড় লাখ।
—আমাদের বাড়িওয়ালা তো কিছুই দিতে চায়নি। পাড়ার ক্লাবে পাঁচশো টাকা দিয়েছেন শুনেছি এর মধ্যে। উনি শস্তায় মারতে চান!
এই সময় মা এসে বললেন, এ বাড়ির যে ছাদ ভেঙে পড়ছে। এ বাড়িতে আমরা থাকব কী করে?
দাদা ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল, ছাদ ভেঙে পড়ছে? কই না তো? ফাটল-টাটলও দেখছি না, এ তো দিব্যি আছে!
আমি বললাম, পরশু খুব বর্ষায় কার্নিশের খানিকটা ভেঙে পড়েছিল।
দাদা বলল, ও কার্নিশ! সে এমন কিছু না। সব বাড়িতেই ভাঙে!
মা তবু বললেন, না রে, আমার ভয় করে। এত পুরোনো বাড়ি, সারায়-টারায় না, যদি হঠাৎ কোনোদিন ভূমিকম্প হয়!
দাদা চাপা রাগ ও হতাশার সঙ্গে হাত-পা ছুঁড়ে বলল, ওঃ মা, তুমি আবার এর মধ্যে ভূমিকম্প টেনে আনলে! তেমন ভূমিকম্প হলে নতুন বাড়িও ভেঙে পড়তে পারে! অ্যাটম বোমা পড়লে সারা শহরটাই গুঁড়িয়ে যাবে, সেই কথা ভেবে কি আমরা এখনই বাড়ি ছেড়ে পালাব? ওসব কিছু আমি শুনতে চাই না, আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না। দেখি ওই অংশু ব্যাটা কী করে! শিগগিরই একটা খরচের ধাক্কা আসছে, এখন বাড়ি বদলাবার কথা চিন্তাও করো না।
বৌদি সন্তানসম্ভবা। অচিরেই আমার দাদা বাবা-শ্রেণীতে উন্নীত হতে যাচ্ছে। সুতরাং টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করতে তো হবেই। দাদার ইচ্ছে প্রথমে একটি মেয়ে হোক, মা নাতি পাবার আশায় মানত করে রেখেছেন। বৌদির গোপন বাসনার কথাটা জানা যায়নি।
আমি বৌদিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ওপর থেকে রাস্তায় একটা বালিশ ফেলেছিলে?
দাদা চোখ বড় বড় করে বলল, বালিশ? তার মানে?
আমি বললাম, আজ সকালে বাজার থেকে ফিরছি, পাড়ার একটা ফচকে মতন ছেলে বলল, নীলুদা আপনাদের বাড়ি থেকে বালিশ ছোঁড়াছুঁড়ি হচ্ছে, এ সব কী ব্যাপার? পাড়ার মধ্যে এসব…। আমি তাকে ঠিক উত্তর দিতে পারিনি। বৌদি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ওই যে সেই পুরোনো বালিশটা। ফুটো ফুটো হয়ে গিয়েছিল, তুলোও শক্ত হয়ে গেছে, ও তুলো দিয়ে আর কিছু হবে না। তাই ভাবলাম রেখে কী হবে, ফেলে দিলাম আজ সকালে।
দাদা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ওঃ মিনু, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। ফেলতে হবে বলে কি কেউ তিনতলার বারান্দা থেকে বালিশ ফেলে। ধাঙড়কে দিয়ে দিতে পারতে না? কবে তোমার একটু কাণ্ডজ্ঞান হবে!
আমি বললাম, বালিশটা ফেটে গিয়ে সারা রাস্তায় তুলো উড়ছিল। পাড়ার ছেলেদের ব্যাপারে কিন্তু এখন থেকে আমাদের একটু সাবধানে থাকতে হবে, বৌদি!
দাদা বলল, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমার সঙ্গে কেউ বাঁদরামি করতে সাহস পাবে না। যাক গে, মিনু, তুমি ওসব নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। ভালো ভালো গান শুনবে, ভালো ভালো বই পড়বে। পেটের সন্তানের ওপর তার ইনফ্লুয়েন্স পড়ে। এদিককার সব কিছু আমি সামলাব।
যদিও আগে থেকে টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল, ব্যবস্থা সব পাকা, তবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি খুব সাবধানে, নরম গলায় বললাম, দাদা, তুমি তো এখন এসে পড়েছ, আমি দু’-একটা দিন একটু সম্বলপুর ঘুরে আসব? ওখানে আমার একটা চাকরি হতে পারে, একজন ভরসা দিয়েছে।
দাদা বলল, আমি এখন টাকাপয়সা দিতে পারব না। আমার হাতে বিশেষ কিছু নেই।
—টাকা লাগবে না। ওরাই ভাড়া-টাড়া দেবে। হীরাকুদ ড্যামের একজন সহকারি পাবলিসিটি অফিসারের পোস্ট খালি আছে।
–দ্যাখ, নীলু, আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? ওসব গুল অন্য লোকের কাছে ঝাড়বি! ড্যামের আবার পাবলিসিটি অফিসার দরকার লাগে কিসের রে? তার আবার সহকারী? সে জন্য তোকে ভাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
–না মানে, ভাড়াটা আমার এক বন্ধু দিচ্ছে। সে ওখানেই কাজ করে। সে বলেছে, ওখানে যে-কোনো রকম একটা কাজ জুটে যেতে পারে।
—আসলে কলকাতা থেকে কেটে পড়তে চাইছিস তাই বল না! সাধে মা বলে যে তোর পায়ের তলায় সর্ষে? কিন্তু সম্বলপুর কেন? সেখানে কী দেখবার আছে? হীরাকুদ আগে দেখিসনি?
-না।
—যা দেখে আয়। বলে নাকি, মহানদীর ওপর যে বাঁধটা দিয়েছে সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বাঁধ। আর্টিফিসিয়াল লেকটাও খুব বিরাট। ছাগল দিয়ে যেমন হাল-চাষ হয় না, তেমনি এই বাড়ির ব্যাপারটাতেও তুই কোনো কাজে লাগবি না।
আমি খানিকটা নকল অভিমান দেখিয়ে বললাম, দাদা, তুমি ছাগলের বদলে বেড়াল বলতে পারতে। ছাগলটা শুনতে খুব খারাপ না! নিজের ভাইকে বলাটা কি ঠিক!
দাদা কৌতুকে চোখ নাচিয়ে উত্তর দিল, বেড়ালটাই বা কিসে ভালো হলো? আমি বেড়াল দু’ চক্ষে দেখতে পারি না। ঠিক আছে, তোকে বাঁদর বললাম। যা বাঁদর, তোর যেখানে ইচ্ছে যা! দিন সাতেকের মধ্যে ফিরে আসিস!
ট্রেনে চাপার পর অনেকদিন বাদে যেন একটা দারুণ মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। বাড়ির সমস্যা, করপোরেশান-প্রোমোটার, বাঙালি-মাড়োয়ারির সম্পর্ক, এই সব আর আমার একটুও ভালো লাগছিল না। ‘আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায়, ঘাসে ঘাসে, এই আকাশে…’। ওসব বড় বড় ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই। তপনদা ঠিকই বলেছিল, এই সব বড়লোকরাই একালের রাজা, এদের বিরুদ্ধে আমার মতন সামান্য মানুষের লড়বার কোনো ক্ষমতাই নেই।
তপনদার জন্য আমার মনটা ব্যথা ব্যথা করে। কলকাতা শরহটাকে এত ভালবাসে যে মানুষটা, তাকেই এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে একবুক অভিমান নিয়ে। কিন্তু তপনদার মতন জেদি মানুষকে ফেরাবারও কোনো উপায় নেই।
লালুদা আমাকে যে কাজটা দিয়েছিল, সেটাকেও গুরুত্ব দেবার কোনো মানে হয় না। মুমু ড্রাগের নেশা ধরেনি, কোনো অবৈধ প্রেমেও জড়িয়ে পড়েনি। ওদের ক্লাবটায় খানিকটা সখের ধর্মচর্চা, আন্তর্জাতিকতা, গান-বাজনা, ম্যাজিক, ছেলে—মেয়েদের কিছুটা ঘনিষ্ঠ মেলামেশা, এই সব চলে। তেমন দোষের তো কিছু নয়। ক্লাবটাই এক বড়লোক মহিলার উদ্ভট খেয়াল। মুমু খুব বেশি বড়লোকদের সঙ্গে মিশছে, সেটাই স্বভাব ভালো হবে কি না কে জানে! কিন্তু সেটা আটকাবার সাধ্য আমার নেই। ওর বাবা-মায়েরাই ভালো বুঝবে।
আপাতত আমার আর কোনো দায় নেই। অংশুবাবু যদি শেষ পর্যন্ত আমাদের তাড়িয়েই দেয়, না হয় চলেই যাব সোনারপুর কিংবা ঠাকুরপুকুর। তাতে দাদার অফিস যাওয়ার কিছুটা অসুবিধে হবে, বৌদির স্কুলটা দূরে হয়ে যাবে, এরকম অসুবিধে কত লোককে মেনে নিতে হচ্ছে। আমার নিজের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না!
প্রীতম একটা জিপ ঠিক করে ফিরে এল। বেশ ঝকঝকে নীল রঙের জিপ, অল্প বয়েসী ড্রাইভারটি বেশ চালাক চতুর।
প্রীতম নিজে ড্রাইভারের সামনে বসে আমাকে বলল, তুই পেছনে উঠে যা নীলু! ব্যাগ দুটো তুলে নে।
প্রীতমকে নিয়ে এর আগে আমি বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরেছি। তখন ও খানিকটা হাবাগোবা ছিল, আমাকেই সব জায়গায় পথ দেখাতে হয়েছে। কফি হাউসে অনেকেই প্রীতমকে বলত নীললোহিতের এক নম্বর চ্যালা।
হঠাৎ যেন উল্টে গেছে সম্পর্কটা। এবারে সবকিছু ওরই ব্যবস্থাপনায়, তাই আমার ভূমিকাটা যেন ওর সহকারীর। আমার সঙ্গে কথা বলছে খানিকটা হুকুমের সুরে। প্রীতমের চরিত্রটা এত বদলে গেল কী করে? কারণ কি এই যে,
প্রীতম এখন টাকা রোজগার করে, আমি করি না। টাকার টনিকে মানুষের ব্যক্তিত্বও পাল্টায়! যে টাকা রোজগার করে, সে-ই জিপের সামনে বসার অধিকার পায়!
নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি জিপের পেছনে বসা কোনোদিন পছন্দ করিনি। রাস্তা ভালো করে দেখা যায় না। পেছন দিকের পর্দাটা বারবার পড়ে গেলে ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যায়।
প্রীতম মুখ ঘুরিয়ে বলল, জিপওয়ালারা প্রথমে বুঝতে পারছিল না। জায়গাটার নাম আসলে উষাকোটি ফরেস্ট। সেই নামটাই আমার মনে পড়ছিল না।
—তুই আমায় বলেছিলি দেবীগড়।
—ওই একই হলো? জঙ্গল দেখা নিয়ে কথা, নামে কি আসে যায়?—শোন প্রীতম, আগে হীরাকুদ ড্যামটা দেখে গেলে হয় না?—না ভাই, ড্যাম-ফ্যাম দেখার সময় নেই। স্ট্রেট ফরেস্ট বাংলোতে চলে যেতে হবে। যাবার পথে শুধু এক জায়গা থেকে রিজার্ভেশান স্লিপটা নিতে হবে।
প্রীতমের জিপ, সুতরাং আমার ইচ্ছেমতন ঘোরার স্বাধীনতাও নেই। তবে এসেছি যখন, হীরাকুদ বাঁধ আমি দেখে যাবই। আগে প্রীতমের খেলাটা কিছুটা দেখা যাক।
ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি, আমি চোখ বুজলাম।
এক সময় প্রীতমই আমাকে ডেকে জাগাল। এর মধ্যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, তা বুঝতেই পারিনি। যেন কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই রেল স্টেশন আর শহরের ঘিঞ্জি ছেড়ে চলে এসেছি, এক চোখ-জুড়োনো সবুজ দেশে।
জিপ থেকে নামতেই চোখে পড়ল একটা বাংলো। বেশ পুরোনো আমলের, কাঠের তৈরি, দোতলা। জঙ্গলের মধ্যে নতুন বাড়ি দেখতে ভালো লাগে না। যত পুরোনো তত মায়াময় মনে হয়। এটা খুব সম্ভবত ব্রিটিশ আমলের। জায়গা নির্বাচন করার ব্যাপারে সাহেবদের চমৎকার চোখ ছিল।
বাংলোটার পেছন দিকেই একটা বেশ বড় খাদ। তার অনেক তলায় একটুখানি জল। এদিকে এখনো ঠিক মতন বর্ষা শুরু হয়নি। খাদটার ওপাশে ঘন জঙ্গল। মনে হয়, বন্য প্রাণীরা এখানে জল খেতে আসে।
বাংলোটা দেখতে বড় হলেও ঘর মোটে দু’খানা। ওপর তলায়। নীচে শুধু খাবার ঘর আর সাজানো বৈঠকখানা। আমাদের যে ঘরখানা দেওয়া হলো, তার একদিকের জানলা দিয়ে পুরো খাদটা আর পেছনের জঙ্গল অনেকখানি দেখা যায়।
জানলার পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, অপূর্ব রে, প্রীতম। চমৎকার জায়গা, খুব ভালো ব্যবস্থা করেছিস।
প্রীতম বলল, জঙ্গলটা ভালো। তবে একটা অসুবিধে কী জানিস। এর মধ্যে দিয়ে একটা হাইওয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ট্রাকের শব্দ শুনতে পাবি।
এখনো তো একবারও শুনিনি। হাইওয়ে বানাবার কি আর জায়গা পাওয়া গেল না?
—দুপুরে সিম্পল মুরগির ঝোল আর ভাত করতে বলেছি। চলবে তো?
—খাওয়া নিয়ে চিন্তার কি আছে। একটা কিছু হলেই হলো।
–কাল ভালো মাছ আসবে।
-রান্নার তো অনেক দেরি আছে, চল একটু জঙ্গলে ঘুরে আসি!
—আমি এখন একটু গড়িয়ে নেব ভাই। তুই তো গাড়িতে দিব্যি ঘুম মারলি! তুই জঙ্গল দেখতে এসেছিস, তুই যা-না!
প্রীতম প্যান্ট-শার্ট খুলে একটা ঝলমলে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে নিল। আমার অত যখন তখন পোশাক বদলাবার বাতিক নেই। স্নান করার পর আগের জামা—টামা পারতপক্ষে পরতে চাই না, কিছু না পেলে ওতেই চলে যায়।
একাই বেরিয়ে পড়লাম বাংলো থেকে। এই জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ার আছে কিনা জানি না, তবে দিনের বেলা সে-রকম ভয়ের কিছু নেই।
একটা সরু পায়ে চলা পথ চলে গেছে ভেতরের দিকে।
এখানে শাল ও সেগুন গাছই বেশি। আর কিছু গাছ আমার অচেনা। তবে জঙ্গলের খাঁটি বনস্পতি হচ্ছে শিমুল গাছ। যেমন প্রস্থে বৃহৎ, তেমনই লম্বা। সব গাছের মাথা ছাড়িয়ে, ডালপালা মেলে যেন দিকপতি হয়ে থাকে।
কিছু দূর যাবার পর দেখলাম, একদল নারী-পুরুষ পাতা ও ডালপালা কুড়োচ্ছে।
আজকাল সব জায়গাতেই মানুষ। গভীর জঙ্গলেও মানুষ। মানুষ যত বাড়বে, জঙ্গল ততই কমবে, এটাই বোধহয় পৃথিবীর নিয়তি। তবু এরা যে জ্যান্ত গাছ কাটছে না, তলার কুড়োচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট।
সেই নারী-পুরুষ একবার মাত্র আমার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। আর কোনো কৌতূহল দেখাল না। এরা টুরিস্ট দেখতে অভ্যস্ত।
আমি যদি কোনো আদিবাসী পরিবারে জন্মাতাম? তা হলে এ-রকম পাতা কুড়োতাম, কিংবা জংলি শুয়োর মারতাম! নিজের সেই জীবনটা কল্পনায় যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। কিন্তু ক’দিন আমি উপভোগ করতাম সেই জীবন?
ফিরে এসে দেখলাম, খাবার প্রায় তৈরি। প্রীতম স্নান-টান সেরে নিয়েছে। দাড়ি কামাবার পর একটা দামি আফটার সেইভ মেখেছে, ঘরভর্তি সুগন্ধ। আমি দাড়ি কামাব না, আগেই ঠিক করে ফেলেছি। এমনকি প্রীতমের আফটার শেইভটা ব্যবহার করার ইচ্ছে হলেও দাড়ি কামালাম না। স্নান করে নিলাম ঝটপট।
খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরবেলা বেরুবি তো?
প্রীতম বলল, না ভাই আমি ঘুমোব।
আমি খানিকটা ধমকের সুরে বললাম, তুই জঙ্গলে বেড়াতে এসে শুধু পড়ে পড়ে ঘুমোবি নাকি!
প্রীতম খানিকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, আ মোলো যা! তুই ঘোরাঘুরি কর না, যত খুশি—আমাকে টানছিস কেন? আমি তো বেড়াতে আসিনি, কাজে এসেছি!
এই জঙ্গলের মধ্যে প্রীতমের কাজটা যে কী, তা কিছুতেই বোঝা গেল না। সে সত্যিই ঘুমলো প্রায় সন্ধে পর্যন্ত।
আমি একটা বই নিয়ে বসে রইলাম খাদটার ধারে পা ঝুলিয়ে। নিস্তব্ধতাই এখানে সবচেয়ে উপভোগ্য। মাঝে মাঝে দু’-একটা পাতা খসে পড়ছে, কোনো পাখি ডাকছে, সেসবও এই জঙ্গলের নীরবতার অন্তর্গত। বই থেকে চোখ তুলে এক-একবার অনেকক্ষণ গাছপালার সবুজ সংসারের দিকে চেয়ে থাকা এটাই নেশার মতন লাগে।
মাঝে মাঝে ঘাস-পাতার মধ্যে কিসের যেন একটা সর সর শব্দ হয়। পোকামাকড় হতে পারে। গিরগিটি কিংবা সাপও হতে পারে। এমনকি গিরগিটি হলেও ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু সাপের আশঙ্কা মন থেকে তাড়ানো যায় না।
তবু কিন্তু উঠে গিয়ে আমি শব্দের উৎসটা দেখতে যাই না। একই জায়গা বসে থাকি। মনটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কলকাতার কোনো চিন্তা মে ঝিলিক দিলেও জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছি।
এক সময় আলো পড়ে এলে উঠে আসতে হলো। অন্ধকার হলেই জঙ্গলে চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
ঠিক তখনই গাড়ি এল আর একটা। নতুন অতিথি। হিন্দিতে কথা বলছে একজনের গলার আওয়াজে আদেশের সুর। খুব হোমরা-চোমরা কেউ হবে বোধ হয়।
প্রীতম ওদের ঘরে ঢুকে গেল আলাপ করতে। আর বেরুতেই চায় না। প্রীত কবে থেকে এত আলাপী হলো? কিংবা ফটোগ্রাফার হতে গেলে এসব গুণ আয় করে নিতেই হয়।
আমি এখনো নতুন লোকদের সঙ্গে কিছুতেই যেচে আলাপ করতে পারি না
একা একা বসে রইলাম পেছনের বারান্দায়। এখন দূরে অস্পষ্টভাবে দু একটা ট্রাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বটে। বেশ খারাপ লাগছে সেই যান্ত্রিক শব্দ এখানে একেবারেই বেনানান।
এক সময় প্রীতম আমার কাছে এসে বলল, নীলু, তুই ইচ্ছে করলে জিপট নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে আসতে পারিস। আমি ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু কথা বলছি আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোকগুলোর সঙ্গে তোর আগে থেকে চেন ছিল বুঝি?
প্রীতম রহস্য করে উত্তর দিল, চেনা? না, ঠিক চেনা বলা যায় না। আমি আসছি ঘুরে।
জঙ্গলের মধ্যে জিপ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সার্চ লাইট জ্বেলে জন্তু জানোয়া খোঁজার একটুও শখ নেই আমার। তার চেয়ে এই বারান্দায় বসে থাকা অনে ভালো। হয়তো দূর থেকে জন্তু জানোয়াররা আমাকেই দেখছে।
পরদিন সকালে অবশ্য এখানকার একটি প্রাণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো প্রীতমকে না জানিয়ে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম আমি। খাদটার মধ্যে নেমে আবার উঠে গেলাম উল্টো দিকে। খাদটা বেশ চওড়া, এখান থেকে বাংলোটাবে ছোট্ট দেখায়।
ভোরের ঝরনার জলের মতন একটুও ভয় করে না। একটু দূরে উন্মুক্ত স্থান। সেখানে একটা পাথর দেখেই চিনতে পারলাম। সল্ট লিক। এখানে বন প্রাণীরা নুন চাটতে আসে। অন্য জঙ্গলে এরকম দেখেছি। পাথরটার মাঝখানে একটা খোদল মতন হয়ে আছে।
হঠাৎ একটা খড়মড় শব্দ হতেই আমি চমকে পেছন ফিরে তাকালাম।
একটা হরিণ। ছোটখাটো চেহারা স্পটেড ডিয়ার।
আমি হরিণটাকে আগে দেখতে পাইনি, হরিণটাও এখনো আমাকে দেখেনি। মুখ নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। আমি এ পর্যন্ত কোনো জন্তুকে চোখের সামনে নুন চাটতে দেখিনি। নিঃশব্দে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হরিণটা কিন্তু ঘাসই ছিঁড়ে খাচ্ছে, নুন চাটবার দিকে মন নেই। এত কাছে একটা চিত্রল হরিণ। প্রীতম থাকলে কী দারুণ ছবি তুলতে পারত।
কয়েক মিনিট বাদে হরিণটা যেন ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। সোজা মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। কী সরল, নিষ্পাপ তার মুখখানি। এটা যদি হরিণী হয় তা হলে নিশ্চিত কিশোরী। ঠিক যেন কাজলটানা দুটি চোখ।
আমি মনে মনে বললাম, ভয় পেয়ো না। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। আমি তোমাকে মারতে আসিনি। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর কয়েক মুহূর্ত সে থমকে রইল। তারপর স্প্রিং-এর মতন লাফ দিয়ে কী ভাবে পেছন ফিরল বোঝাই গেল না। অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের নিমেষে।
আমিও দৌড়োতে দৌড়োতে ফিরে এলাম বাংলোয়।
প্রীতম জেগে উঠে দাঁত মাজছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, প্রীতম, কী সুন্দর একটা হরিণ দেখলাম। খুব কাছ থেকে। এখানে খাদের ওপাশে একটা সল্ট লিক আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, তোকে দেখাব। তুই খুব ভালো ভালো ছবি তুলতে পারবি। ছবি তোলার আইডিয়াল জায়গা।
ধীরেসুস্থে সাদা ফেনার থুতু ফেলে প্রীতম মুখ ধুলো।
তারপর বলল, পাগল নাকি! আমি ভাই কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফার, কাজের ছবি ছাড়া তুলি না। জঙ্গল-ফঙ্গল, জন্তু-জনোয়ারের ছবি তুললে কেউ পয়সা দেবে? শুধু শুধু ফিল্ম নষ্ট। ওসব একদম ছেড়ে দিয়েছি।
ভোরবেলার মুগ্ধ মেজাজটা আমার নষ্ট হয়ে গেল।
এই ধরনের বিশ্রী, কেজো ধরনের কথা যে বলে, সে আমার বন্ধু হবার যোগ্য নয়। এমন জানলে ওর সঙ্গে কে আসত? ওর মুরুব্বি ভাবটা অনেক সহ্য করা হয়েছে, আর নয়।
ওর গেঞ্জিটা ধরে টেনে বাথরুমের বাইরে এনে আমি বললাম, তুই বড্ড আমার কাছে টাকা টাকা করছিস, প্রীতম। তোর পয়সায় আমি আর এক কাপ চা-ও খেতে চাই না। তুই কোন্ রাজকার্যে এখানে এসেছিস, সেটা আমি জানতে চাই!
প্রীতম বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, বলছি। আগে চা-টা খেয়ে নি। তুই নীচে গিয়ে চা দিতে বলে আয় না!
—চা পরে হবে।
—আরে ব্যাপারটা খুব সিম্পল। একটা পার্টি আমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছে। তারা এই জঙ্গলে এসে আজ পিকনিক করবে। আমাকে সেই ছবি তুলতে হবে।
—বাজে কথা। সম্বলপুরের কাছাকাছি এক জঙ্গলে পিকনিক হবে, তার ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফার আনাতে হবে কলকাতা থেকে? কেন, এখানে ভালো ফটোগ্রাফার নেই? এ আমি বিশ্বাস করি না।
–তুই আমাকে হেলাফেলা করলে কী হয়, প্রীতম মৈত্রের নাম এখন ফটোগ্রাফার হিসেবে হোল ইণ্ডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে। বড় বড় বিজনেস হাউজ আমাকে ডাকে।
–এই পিকনিকের জন্য তোকে কেন ডেকেছে, সেটা আমি জানতে চাইছি!
—জানতুম, তোকে পুরো ধোঁকা দেওয়া যাবে না। কিছুটা বলছি। কিন্তু নীলু, এটা আমার প্রফেশনাল ব্যাপার। তুই কিন্তু আর কাউকে বলতে যাসনি যেন।
—আগে পুরোটা শুনি!
—তুই ঠিকই ধরেছিস। পিকনিকটা একটু স্পেশাল ধরনের। বিজনেসের সঙ্গে প্লেজার মেশানো বলতে পারিস। সেই জন্যই এতটা গোপনীয়তা। মনে কর, ক-বাবু কলকাতার বড় একটা প্রতিষ্ঠানের বড় অফিসার। তুই আমার কাছে নাম টাম জানতে চাসনি। ক-বাবু ইজ ক-বাবু! এই ক-বাবু খুব স্ট্রিক্ট প্রিনসিলের লোক। ঘুষ-টুস খান না। মদ্য পান করেন বটে, তাও নিজের পয়সায়। এই রকম লোককে এক পার্টির হাত করা দরকার। এই সব ক্ষেত্রে কী হয় জানিস, বউদের ধরা হয়। বউরা আফশোস করে ভাবে, আমার স্বামীর চেয়ে জুনিয়ার অফিসাররাও বাড়ি-গাড়ি করে ফেলল, অথচ আমার উনি কিছুই নেবেন না। এই করলে কি সমাজে মান থাকে? এখন মুস্কিল হচ্ছে কি, ক-বাবুর বউ নেই। মানে, বউ আছে, উনি বিয়ে করেছেন, কিন্তু বউ ওর সঙ্গে থাকে না। মানে, তুই অমনি অন্য কিছু ভাবিস না। বউ পালিয়ে যায়নি। বউ প্রেগনেন্ট, বাপের বাড়িতে রয়েছে। বউয়ের বাপের বাড়ি এই সম্বলপুরে। ক-বাবু বউকে মাঝে মাঝে দেখতে আসেন। এখন এসেছেন। আজ তিনি বউকে নিয়ে এখানে পিকনিকে আসবেন।
—তার মানে কলকাতার লোক এখানে পিকনিক করতে আসছে। আর একটা পার্টিও কলকাতা থেকে আসবে?
–আসবে মানে কি, এসে গেছে কাল রাত্তিরে। আমাদের পাশের ঘরেই তো রয়েছেন। খুব বড় পার্টি, স্বয়ং মালিক, ধর ম-বাবু, তিনি নিজে এসেছেন। তার মানে খুব হেভি ব্যাপার। ম-বাবুর সঙ্গে ক-বাবুর মোলাকাত হবে এখানে। এখন ম-বাবু যদি ক-বাবুর বউকে হাত করতে পারে, তাতেই কেল্লা ফতে। শুনেছি, দেড় লাখ টাকার হীরের সেট আনা হয়েছে। এই যাঃ, তোকে বলে ফেললুম। তুই নাক কুঁচকোচ্ছিস কেন, নীলু?
–এসব যে খুব বিশ্রী ব্যাপার রে। তুই এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লি কেন, প্রীতম?
—আমায় টাকা দিচ্ছে, আমি কাজ করছি। নোংরা না ফর্সা, আমি তার কী জানি!
—টাকার জন্যই কি যে-কোনো কাজ করা যায়? নিজের রুচি বলে কিছু থাকবে না? একজন কেউ একটা অন্যায় কাজ করলেও তুই টাকার জন্য তাকে সাপোর্ট করবি?
—ওসব সেণ্টিমেন্ট ছাড় তো! তুই এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছিস, নীলু! আজকের জগতে ওসব ভাবলে চলে না। নিজে কোনো অন্যায় না করলেই হলো। আমি তো কিছু অন্যায় করছি না। ছবি তোলা আমার কাজ। ছবি তুলব। আমার এক মামার মুখে একটা সংস্কৃত কথা প্রায়ই শুনতাম। বর্বরস্য ধনক্ষয়ম! মানে কী জানিস? যারা বিচ্ছিরি ধরনের বড়লোক, তাদের যতখানি সম্ভব টাকা খরচ করিয়ে দিতে হয়। বড়লোকরা যত টাকা বাজে খরচ করবে, তাতে আর পাঁচজনের উপকার হবে। এই দ্যাখ না, ম-বাবু এনতার টাকা খরচের অর্ডার দিয়েছেন বলেই আমি তোকে এখানে নিয়ে আসতে পারলুম। তোরও একটা জঙ্গল বেড়ানো হয়ে গেল বেশ।
—আর এখানে থাকতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। মুখটা তেতো হয়ে গেল!
—আবার সেন্টিমেন্ট! আরে আজকের দিনটা মুখ বুজে থাক না। আজই সব চুকে বুকে যাবে। তারপর কাল থেকে আমরা ইচ্ছে মতন বেড়াব। তবে, আজ তুই একটু আড়ালে থাকিস। হুট করে ওদের সামনে চলে যাস না যেন। ওরা বাইরের লোক থাকাটা পছন্দ করবে না!
আমাদের পাশের ঘরের লোক দু’জন নেমে গিয়ে গাছটার পাশে সতরঞ্জি ও চেয়ার-টেয়ার পাতিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়ারও এলাহি ব্যবস্থা হচ্ছে টের পাওয়া যায়।
আমাদের পাশের ঘরের দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন বেশ স্বাস্থ্যবান, মধ্যবয়স্ক, সাফারি সুট পরা, সোনার ঘড়ি ও সোনার চশমা পরা। বেশ রাশভারি ধরনের মানুষ, তিনিই যে প্রীতম কথিত ম-বাবু তা বোঝা যায়, অন্য লোকটি কর্মচারী ধরনের।
আমি বসে রইলাম দোতলার বারান্দায়। জঙ্গলে বেড়ানো আমার মাথায় উঠে গেছে। এমন ভাবে কোনোদিন আসিনি। আমাকে এখন লুকিয়ে থাকতে হবে?
ভোরবেলা যে কিশোরী হরিণটিকে দেখেছিলাম, তার দৃষ্টিকে যেন এই লোকগুলো অপমান করছে। জঙ্গল তো ওই হরিণীরই জন্য। পিকনিক পার্টিদের জন্য তো নয়। এরা তো যে-কোনো বড় হোটেলে গেলেই পারে।
বারান্দার রেলিং-এ পা তুলে আমি বসে রইলাম একটা ইজি চেয়ারে। হাতে বই। কিন্তু মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে পিকনিক পার্টির দিকে। সকাল দশটার মধ্যেই এসে গেল অন্য দলটি।
ক-বাবুকেও চিনতে অসুবিধে হলো না। ছিপছিপে চেহারা, দীর্ঘাকার পুরুষ, খড়্গগনাসা, রীতিমতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, নীল ট্রাউজার্স সাদা শার্ট পরা। দেখলেই বোঝা যায় বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। এর একটা আলাদা ছাপ আছে।
ওর স্ত্রী গোলগাল, ফর্সা, মোটাসোটা মহিলা। এককালে নিশ্চয়ই সুন্দরী ছিলেন, সেইজন্য বেশ ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু রূপের তীক্ষ্মতা নষ্ট হয়ে গেছে। গর্ভবতী হয়েছেন বলেই যে মুখ ও হাত-টাতও গোল গোল হয়ে গেছে, তা মনে হয় না। সর্বাঙ্গে অনেক গয়না। এটাই লোভের চিহ্ন। নইলে জঙ্গলে পিকনিক করতে আসবার সময়ও এত সোনার গয়না পরার কী মানে হয়? এটা তো বিয়েবাড়ি নয়!
ক-বাবুর সঙ্গে আরও দুটি কম বয়েসী মেয়ে রয়েছে, বোধ হয় তাঁর শ্যালিকা।
আমি যেন একটা নির্বাক ছায়াছবি দেখছি। এখান থেকে ওদের কথা শোনা যায় না, কিন্তু দেখা যায় স্পষ্ট। বারান্দার ঠিক পাশেই একটা বড় গাছ, সেটার ডালপালার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পেলেও ওরা দেখতে পাবে না বোধ হয়।
কিন্তু আমি তো ওদের দেখতে চাই না। আমার বন্ধু প্রীতমকে যাতে বিব্রত না হতে হয়, সে জন্য ওদের সামনেও যাচ্ছি না। ইচ্ছে করলে অন্য পাশ দিয়ে জঙ্গলের ভেতরেও চলে যাওয়া যায়। কিন্তু উষাকোটি অরণ্য সম্পর্কে আমার আগ্রহ চলে গেছে। প্রীতম আগে এর নাম বলেছিল দেবীগড়। কোথায় পেল এই নামটা? তখন ভেবেছিলাম, জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরোনো দুর্গও থাকবে। যেমন আছে পালামৌ-তে। সিমলিপালও আমার খুব প্রিয়। চাহালা, বড়াইপানি, নয়ানা…
ক-বাবু আর তাঁর স্ত্রী বসেছেন পাশাপাশি দুটি চেয়ারে। ম-বাবু ওঁদের মুখোমুখি। হাতে রঙিন পানীয়ের গেলাস, সুরা না শরবত, তা কে জানে! গল্প বেশ জমে উঠেছে, মনে হয়। প্রীতমকে ওখানে দেখা যাচ্ছে না। সে দু’ কাঁধে দুটো ক্যামেরা ঝুলিয়ে দূরে দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেলিফটো লেন্স দিয়ে অনেক দূর থেকে ছবি তোলা যায়।
ওপরের বারান্দা থেকে আমি মাঝে মাঝে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাচ্ছি প্রীতমকে। সে কখনো হাঁটু গেড়ে বসে, কখনো গাছের ডালে চড়ে ফটাফট ছবি তুলে যাচ্ছে।
ক-বাবুকে খানিকটা ছটফটে মনে হয়। মাঝে মাঝে তিনি উঠে যাচ্ছেন চেয়ার ছেড়ে, একা বায়নোকুলার চোখে লাগিয়ে কী যেন দেখছেন। উনি বোধ হয় পক্ষী—প্রেমিক! এ জঙ্গলে আমি এখনো পর্যন্ত ছাতারে, বুলবুলি ও কয়েকটা ঘুঘু ছাড়া অন্য পাখি দেখিনি!
ক-বাবু একবার উঠে যেতেই ম-বাবু তাঁর সেক্রেটারিকে ডাকলেন। সে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে এল। তিনখানা শাড়ি। ম-বাবু সেগুলো তুলে দিলেন তিন মহিলার হাতে। ক-বাবুর স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেখলেন। বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি একেবারে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছেন। ম-বাবু বেশ মজা করতে পারেন মনে হলো।
হাতে হাতে ঘুরছে খাবারের প্লেট। ক-বাবুরা যে আজই এখানে পিকনিকে আসবেন সেটা ম-বাবুরা কী করে টের পেলেন? নাকি এটাও কায়দা করে ব্যবস্থা করা হয়েছে! ক-বাবু হয়তো মনে করেন, পিকনিকে যোগ দিতে দোষ নেই। গেলাসের পানীয়টা ওঁদের বেশ পছন্দ হয়েছে, দু’ তিনবার করে নিচ্ছেন সবাই। নিছক শরবত কি কেউ এত বেশি খায়? ক-বাবুর স্ত্রীও ড্রিংক করেন?
ক-বাবু একবার চেয়ারে এসে বসতেই ম-বাবু বার করলেন একটা বেশ বড় চ্যাপ্টা, চৌকো ভেলভেটের বাক্স। এটাই তা হলে হীরের সেট! বাক্সটা খুলতে রোদ্দুরের আলোয় মালাটা ঝকমক করে উঠল। হীরে বলে কথা! এখান থেকেও আমি দেখতে পেলাম সেই বিচ্ছুরিত আলো।
প্রীতম অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। কত রোল ছবি তুলে ফেলল কে জানে?
ম-বাবু সেটটা তুলে দিলেন ক-বাবুর স্ত্রীর হাতে। অন্য মেয়ে দুটিও ঝুঁকে দেখছে। সব ছবি তোলা হয়ে যাচ্ছে। নিজের সর্বনাশ করছেন ক-বাবু, বুঝতে পারছেন না? ওঁকে কি সাবধান করে দেওয়া উচিত নয়? আমি ছুটে গিয়ে সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেব?
কিন্তু আমাকে ওঁরা ‘পাত্তা দেবেন কেন? ভাববে কোনো পাগল ছাগল। ক—বাবু
কি হীরের অত দামি সেটের মর্ম বোঝেন না? কিংবা কলকাতায় যিনি সৎ, পাঁচশো কিলোমিটার দূরে কোনো জঙ্গলের মধ্যে তাঁর অসৎ হতে বাধা নেই?
ক-বাবু কিছু একটা বলায় তাঁর স্ত্রী বাক্সসমেত হীরের সেটটি ফিরিয়ে দিলেন ম-বাবুকে। ম-বাবু এবার উঠে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনীত ভঙ্গিতে আবার তুলে দিলেন ভদ্রমহিলার হাতে।
অত্যুৎসাহে প্রীতম অনেকটা এগিয়ে গেছে। প্রায় পিকনিক পার্টির সামনে। নাকি এই রকম সময় ওকে কাছাকাছি যাওয়ারই নির্দেশ ছিল। ক-বাবুকে জানানো দরকার যে ছবি তোলা হচ্ছে?
ক-বাবু প্রীতমকে দেখতে পেয়েছেন। তিনি রাগত ভঙ্গিতে স্ত্রীর কাছ থেকে বাক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে ম-বাবুকে ফেরত দিতে যাচ্ছেন। ম-বাবু দু’ হাতে সেটা ঠেলে দিচ্ছেন। তারও ছবি উঠে গেল।
ছবি কখনো মিথ্যে কথা বলে না। কিন্তু ছবির ব্যাখ্যা করা যায়। ক-বাবু জিনিসটা ফেরত দিতে যাচ্ছেন, কিন্তু বাক্সটাতে তাঁর আর ম-বাবু দু’জনেরই হাত ছোঁয়ানো। যদি কেউ বলে, ক-বাবু এখানে ফেরত দিচ্ছেন না, হাত পেতে জিনিসটা নিচ্ছেন, সেটাও অনায়াসে বিশ্বাসযোগ্য হবে।
ক-বাবুর স্ত্রী এমন দামি জিনিস হাতছাড়া করতে চান না। তিনি আবার সেটা স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিলেন। উঠে চলে গেলেন চেয়ার ছেড়ে। ব্যাস, ষড়যন্ত্র সার্থক, আর কিছু করার নেই ক-বাবুর। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
একটু বাদেই প্রীতম হন্তদন্ত হয়ে ওপরে ছুটে এল। ঘরের মধ্যে কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করার পর বারান্দায় মুখ বার করে বলল, এই নীলু, আমার ব্যাগটার চাবি? তুই রেখেছিস? ব্যাটারি। ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে হঠাৎ! শিগগির, শিগগির!
আমি ভেতরে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ওর চাবিটা দিলাম।
ব্যাগ খুলতে খুলতে প্রীতম খুশির সঙ্গে বলল, কেল্লা ফতে। আমারও কাজ প্রায় শেষ। একা একা বসে থাকতে তোর খারাপ লাগছে, না রে? দাঁড়া তোর জন্য কাটলেট আর শরবত পাঠিয়ে দিচ্ছি। শরবতটা যা গ্র্যাণ্ড হয়েছে না। অপূর্ব স্বাদ, এরকম তুই কখনো খাসনি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁরে প্রীতম, ঘুষ দেওয়ার ব্যাপার-স্যাপার তো গোপন রাখার কথা। ছবি তোলবার দরকার কী? তুই একেবারে সামনে এসে ছবি তুললি!
প্রীতম বলল, এর অনেক রকম পারপাজ আছে বুঝলি না! এত দামি জিনিসটা নিয়ে যদি হজম করে ফেলে? পরে অস্বীকার করে? ওই ক-বাবু করপোরেশানের খুব বড় অফিসার। এই যাঃ, তোকে বলে ফেললাম! খুব সিক্রেট কিন্তু। আমিও সবটা জানি না। যতদূর মনে হয়, ওই ক-বাবুকে দিয়ে ব্যাক ডেটে কিছু একটা সই করাতে হবে। সেটা খুবই জরুরি ব্যাপার। ক-বাবু যদি তাতে রাজি না হয়, তা হলে এই সব ছবি দেখানো হবে!
—এটা যে ব্ল্যাকমেইল
—ব্ল্যাকমেইল না হোয়াইট মেইল তা আমি কী জানি! ওদের ব্যাপার। আমি ছবি তুলে খালাস!
—কিন্তু ব্ল্যাকমেইলে যারা সাহায্য করে, তারাও অপরাধী। এটা তুই জানিস না?
—দ্যাখ নীলু, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না তো! তুই পরের পয়সায় খাচ্ছিস—দাচ্ছিস, জঙ্গলে বেড়াচ্ছিস, তোর এত প্রশ্ন করার কী দরকার? ছবির পেছনে কি লেখা থাকবে যে কে তুলেছে কিংবা কোন্ ক্যামেরায় তোলা?
ব্যাটারি খুঁজে পেয়ে প্রীতম আবার ঝড়ের বেগে ছুটে গেল।
আমি গুম হয়ে বসে রইলাম কয়েক মিনিট। প্রীতমটা একেবারে গোল্লায় গেছে। ও আমাকে এমনভাবে অপমান করার সাহস পায়? আমি এইসব হারামজাদাদের পয়সায় খাই?
ঝটপট জামা প্যান্ট পরে নিলাম। পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে চাপা দিলাম টেবিলে। ট্রেনের টিকিট আমি কেটেছি। একা এলেও প্রীতমকে জিপ ভাড়া করতে হতোই। আমার দু’বেলা খাওয়ার খরচ পঞ্চাশ টাকার বেশি হতে পারে না।
একটা সাদা কাগজে লিখলাম দু’লাইন চিঠি।
আমি চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে আর জীবনে যোগাযোগ রাখতে চাই না। আমার ফেরার জন্যও তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক পৌঁছে যাব কলকাতায়। ইতি নীললোহিত।
ব্যাগটায় দ্রুত আমার জিনিসপত্র নিয়ে বেরুতে যাচ্ছি, এই সময় ডাকবাংলোর একজন বেয়ারা একটা প্লেটে দু’খানা কাটলেট ও এক গেলাস শরবত নিয়ে এল। সে বলল, প্রীতমসাব পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে কিছুই খাবার প্রবৃত্তি নেই আমার বেয়ারাটাকে বললাম, আমার খিদে নেই, তুমি ফেরত নিয়ে যাও।
বেয়ারাটি বলল, শরবতটা অন্তত খেয়ে নিন, স্যার। খুব ভালো বানিয়েছে!
তার অনুরোধে গেলাসটা নিয়ে একটা চুমুক দিলাম। সত্যি বেশ ভালো খেতে। এঁটো করলে সবটা শেষ করতেও দোষ নেই। পুরোটাই খেয়ে নিলাম। অপূর্ব স্বাদ।
কিন্তু মুহূর্তের জন্য একটু হতভম্ব হয়ে গেলাম। এই স্বাদ আমার চেনা। এরকম শরবত আমি আগে একবার খেয়েছি। কোথায় যেন?