৪
ইংরিজি ইলেভেন্থ ফ্লোর বাংলা মতে বারোতলা। সেখানে লিফ্ট থেকে নেমে মুমু একটা দরজায় বেল টিপল। দ্বিতীয়বার বাজাবার পর খুলে গেল দরজা। খুলল একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের অত্যন্ত রূপবান যুবক। ছেলেটিকে এতই সুন্দর দেখতে যে ফিল্মস্টার বলে মনে হয়।
সামনেই বিশাল একটি হলঘর।
মেঝেতে পুরু কার্পেট পাতা, অন্য কোনো আসবাব বিশেষ নেই, দেয়ালের ধারে ধারে নিচু বসবার জায়গা। অন্তত গোটা দশেক ফুলদানিতে বিভিন্ন রকমের ফুল সাজানো। একদিকের দেয়ালে বিশাল সমুদ্রের ছবি, খুব সম্ভবত বিলিতি ওয়াল পেপার, এমনই নিখুঁত করে আঁকা যেন ঢেউয়ের ছলাত ছলাত শব্দ শোনা যাবে এক্ষুনি।
কার্পেটের ওপর বারো চোদ্দটি নানা বয়সের ছেলেমেয়ে বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কয়েকজনের হাতে গিটার আর অন্য কিছু অচেনা বাজনা। কেউ ঠিক বাজাচ্ছে না, টুং টাং করছে।
একেবারে পেছনের দিকের দেয়ালের কাছে একটা সিংহাসনের মতন মস্ত বড় চেয়ার। হাতল দুটি সোনালি রঙের কারুকার্য করা, মাঝখানটায় ভেলভেট মোড়া। আসল রাজাদের তো কখনো দেখিনি, সিনেমার রাজারা এই ধরনের চেয়ারে বসে। সেটা অবশ্য এখন ফাঁকা।
জুতো খুলে মুমু আমাকে নিয়ে কার্পেটের একপাশে বসল। এটা কী ধরনের ক্লাব বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে বড়লোকদের ব্যাপার। যেসব ছেলেমেয়েরা বসে আছে, দেখলেই বোঝা যায় উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের। কথা বলছে নিচু গলায়, সবাই ইংরিজিতে। এখানে আমি যে একেবারেই বেমানান।
মুমুর থেকে বয়েসে তিন-চার বছরের বড় একটি মেয়ে আমাদের কাছে এগিয়ে এসে বলল, হাই রম্যি, হাউ হ্যাভ ইউ বীন?
মুমুর ভালো নাম রম্যাণি, সেটা আমার মনেই থাকে না।
ওরা দু’জনে একটুক্ষণ ইংরিজি বাংলা মিলিয়ে কথা বলল। তারপর মেয়েটি আমার দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই মুমু বলল, আলাপ করিয়ে দিই। মিট মাই ফ্রেণ্ড ব্লু। এর নাম ব্লু। আর ব্লু, এর নাম লরা। দারুণ ব্রাইট মেয়ে, খুব ভালো পিয়ানো বাজায়।
ফ্রেণ্ড? আমি মুমুর ফ্রেণ্ড? এখানে বোধহয় কাকা-টাকা বলা চলে না।
আমি মেয়েটির দিকে হাত তুলে নমস্কার করতেই মেয়েটি বলল, ওং মণিপদ্মে হুম্।
এ কী রে বাবা, মেয়েটি বৌদ্ধ নাকি? নাম লরা? একেবারে মেমসাহেবদের মতনই সেজে আছে।
মেয়েটি ইংরিজিতে আমায় জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের এখানে মেম্বার হবে?
আমার বদলে মুমু উত্তর দিল, একদিন ট্রয়াল দিতে এনেছি। সবাই ওকে আগে চিনুক, জানুক!
আমি মিনমিন করে জানতে চাইলাম, কী হয় এখানে, এই ক্লাবে?
লরা বলল, আস্তে আস্তে দেখতে পাবে। এখানে আমরা নিজেকে বদলে নিতে আসি।
-বদলে নিতে মানে?
–বদলে নিতে মানে, বদলে নিতে! আর কোনো মানে নেই!
মুমু ওকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাইরে যাবার প্রোগ্রাম কবে?
লরা বলল, সেটা শিগগিরই ঠিক হবে। তুই পারমিশান পাবি তো?
এটা কার বাড়ি তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। যে-সব ছেলেমেয়েরা ঘুরছে, তাদের কারুরই বয়েস চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়। মুমুর মতন ছোট মাত্র আর দু’জন রয়েছে।
একটি সাদা উর্দি পরা বেয়ারা ট্রে-তে শরবতের গেলাশ সাজিয়ে দিয়ে গেল সবাইকে। বেশ দামী গেলাসে পিংক রঙের পানীয়। আমাকেও দিল একটা, চুমুক দিয়ে বুঝতে পারলাম না কিসের তৈরি। তবে বেশ চমৎকার স্বাদ!
যে-ছেলেটি আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিল, সে এসে এবার আমাদের পাশে বসল। লরা তাকে জিজ্ঞেস করল, রম্যির নতুন বন্ধুর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?
অত্যন্ত ফর্সা রঙ ছেলেটির, মোমের মতন আঙুল। ভুরু দুটো মনে হয় যেন কাজলটানা।
দু’হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে সে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার নাম শংকর জৈন।
পদবী না শুনলেও আমি বুঝতে পারতাম, সে বাঙালি নয়। তার মুখে অন্যরকম একটা ছাপ আছে। ভেবেছিলাম, সে ইংরিজিতে কথা বলবে।
ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র ও বিনীত। গলার স্বর মিষ্টি। মুমু আর লরা নিজেদের নিয়ে খুব ব্যস্ত বলে সে আমার সঙ্গে দু’-একটা কথা চালিয়ে যেতে লাগল। খুব সাধারণ কথা। আজ দুপুরে খুব বৃষ্টি হয়েছে। এ বছর এই প্রথম বৃষ্টি। গরমও খুব। তবে গত সপ্তাহে প্যারিসে কলকাতার চেয়ে গরম বেশি ছিল। চল্লিশ ডিগ্রি! ফ্রান্সে গরমের চোটে পাঁচজন লোক মারা গেছে! খুব আশ্চর্য না? গ্রীণ হাউজ ইফেক্ট!
হঠাৎ শংকর জৈন স্পিং-এর মতন উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও।
হলটার ডানদিকে বাঁদিকে ঘর, সেসব দরজা বন্ধ ছিল, এবার একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা।
ধপধপে সাদা সিল্কের গাউন পরা, গাউনটা এত লম্বা যে তাঁর কাঁধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢাকা। গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষের মালা। মাথার চুল জড়ো করে বাঁধা। হাতে একটা চামর। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক মূর্তি।
মহিলার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। প্রথম দেখে মেমসাহেব মনে হলো। কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিটা অন্যরকম।
তিনি মিষ্টি করে হেসে সিংহাসন মার্কা চেয়ারটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, কিন্তু বসলেন না। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সবার দিকে। অন্য কেউ কোনো শব্দ করছে না। মহিলা চোখ বুজলেন। তারপর গুনগুন করে ধরলেন একটা গান।
সে গানের একটা কথাও বুঝতে পারলাম না আমি। কিছু একটা ইংরিজি গান, মাঝে মাঝে শুধু শোনা যাচ্ছে ও হেলিলুইয়া! ও হেলিলুইয়া!
সবাই চোখ বুজে সেই গান গাইছে। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরে। দেখা যাচ্ছে বহুদূর পর্যন্ত, এক জায়গায় শহরের সীমানা আর আকাশ যেন মিশে গেছে। এত উঁচু থেকে কলকাতা শহর কখনো দেখিনি। বেশ ভালোই তো দেখায়। কত বড় বড় বাড়ি হয়ে গেছে। ক্রমশ সারা কলকাতাই মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এ ভরে যাবে।
গানটা শেষ হবার পর সেই মহিলা হিন্দিতে কিছু বলতে লাগলেন।
আমি মুমুর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাতেই মুমুও ভুরু দিয়ে সম্মতি জানাল। অর্থাৎ ইনিই প্রিসিলা!
প্রিসিলা যা বললেন, তার সারমর্ম হলো, এই যে এই পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি, এ জন্য সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরকে আমাদের প্রতিদিন ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। প্রতিদিন পাঁচ মিনিট তাঁকে স্মরণ করলে আমাদের পরমাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। সময় হচ্ছে নদী। তাতে পাঁচ মিনিট রাখতে হয় স্নানের জন্য। এবার মেডিটেশন!
সবাই আবার ধপাধপ করে বসে পড়ে চোখ বুজল। এখন ধ্যান।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। বেশ বোকা বোকা লাগছে। মুমু এ কোথায় আমাকে নিয়ে এল? এটা একটা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান? এ রকম তো ইদানীং খুবই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মুমুর মতন একটা ছটফটে মেয়ে এখানে ভিড়ল কী করে? এত কম বয়েসে ধর্মের প্রতি টানও তো স্বাভাবিক নয়।
প্রিসিলা তা হলে একটি আধুনিক গুরুমা! ইংরিজি নাম, ইংরিজি গান দিয়ে ভজন, তার সঙ্গে চোখ বুজে ঈশ্বরের ধ্যান। শিষ্য-শিষ্যারা তো দেখছি সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে। এই সমাজটাকে আমি ভালো করে চিনি না। দূর থেকে দেখছি মাত্র। আগে এদের বলা হতো ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ। এখন আর বঙ্গ বিশেষ নেই, মাড়োয়ারি-গুজরাতি-পাঞ্জাবিই বেশি।
প্রত্যেকেরই সাজপোশাকের বেশ বাহার আছে।
এর মধ্যে পাজামা আর পাঞ্জাবি পরা আমার চেহারাটা যে বেশ বেমানান, তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি।
প্রিসিলার শিষ্য-শিষ্যারা সবাই অল্পবয়েসী কেন? এরা কোন্ টানে আসে, সেই রহস্যটা এখনো ধরতে পারছি না। প্রিসিলা কি তবে মেয়ে রজনীশ নাকি?
ধ্যান শেষ হবার পর কেউ কিন্তু প্রণাম করল না। প্রিসিলা হলঘরে ঢোকার পরেও কেউ তাকে প্রণাম বা নমস্কার জানায়নি। এখানে বোধহয় ওসব নিষেধ।
এরপর আবার একটা গান শুরু হলো, তার সঙ্গে নাচ। এবারের গানটা হিন্দি, কিন্তু অনেকে উচ্চারণ করছে ইংরিজির মতন। আজকাল অনেক সাহেব মাথায় টিকি রাখে, ধুতি পরে। অনেক কৃষ্ণভক্ত মেমসাহেব পরে শাড়ি। এখানে কিন্তু ধুতি বা শাড়ি পরা একজনও নেই।
মুমুও নাচছে। শংকর জৈন তার একটা হাত ধরে আছে। হিন্দি সিনেমার পার্টির দৃশ্যে এ রকম নাচ দেখা যায় খুব। না ভারতীয়, না পশ্চিমী।
নাচ শেষ হতেই বেয়ারা এসে দ্বিতীয়বার শরবত দিয়ে গেল সবাইকে। এক চুমুকে সবটা শেষ করে আমার ইচ্ছে হলো আর এক গেলাস নিতে। বড় তোফা খেতে। কিন্তু বেশি হ্যাংলামি করা ভালো নয়।
এতক্ষণে প্রিসিলা বসলেন, সিংহাসন-চেয়ারটিতে।
এক হাতের চামরটা ওপরে তুলে, সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে গুরুমাটি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সবার দিকে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে আমার মুখের ওপর তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। একটু কৌতূহল ফুটে উঠল। তারপর তিনি তাকালেন অন্যদিকে
ইংরিজিতে বললেন, হু ইজ গোয়িং টু ডিথ্রোন মি? হু ইজ গোয়িং টু বি দা কুইন ফর দিস ইভনিং?
সকলের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল।
গুরুমা আবার বললেন, সেলিম, প্লিজ বাক্সাঠো লে আও!
এদের মধ্যে থেকেই একটি যুবক উঠে পাশের একটা ঘর থেকে চৌকো একটা ছোট ভেলভেটের বাক্স নিয়ে এল। গুরুমা সেটা ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন। বোঝা গেল তার মধ্যে কিছু চাকতি আছে।
একটু পরে বাক্সের মুখটা খুলে গুরুমা আবার ইংরিজিতে বললেন, মেয়েরা এক এক করে এসো!
এর মধ্যে ছেলে মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে চব্বিশ-পঁচিশজনে দাঁড়িয়েছে। ছেলে আর মেয়ে প্রায় সমান সমান।
এক একটি করে মেয়ে উঠে গিয়ে বাক্স থেকে একটা করে চাকতি টেনে তুলতে লাগল। লটারির মতন। গুরুমা সেই চাকতি দেখছেন আর হেসে ফেলছেন।
লরা নামের মেয়েটি মুমুকে খোঁচা মেরে বলল, তুই যা! তোর পরে আমি যাব।
মুমু বলল, না, আমি আজ টানব না।
লরা এগিয়ে গেল।
তক্ষুনি চটপট করে হাততালির শব্দ শোনা গেল। গুরুমা একটি মেয়ের হাত ধরে পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, কুইন! আওয়ার নিউ কুইন।
মেয়েটি মুমুরই বয়েসী। সারা মুখ হাসিতে ঝলমল করছে। সে একটা গাঢ় সবুজ রঙের ফ্রক পরে আছে। মাথার চুল শাম্পু করে ফাঁপানো।
মুমু আমার দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলল, এটা একটা খেলা, বুঝতে পারছ তো? এক একদিন এক একজন এখানে রানী হয়। তখন তার নামও বদলে যায়। ঐ মেয়েটাকে তুমি তো চেনো নিশ্চয়ই?
আমি বললাম, না তো? কখনো দেখিনি
—মিলিকে চেনো না? সেদিন তোমার বাড়িতে অংশু জ্যাঠামণিকে দেখলাম, তার মেয়ে। মিলিই তো আমাকে প্রথমে এখানে এনেছে।
–আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে?
—ঐ মিলির দাদা মলয়, সে তো আমার ছোটমামার বন্ধু হয়। আমাদের বাড়িতে আসে মাঝে মাঝে!। আমিও মিলিদের বাড়িতে প্রায়ই যাই। অংশু জ্যাঠামণি আমাকে খুব ভালোবাসে।
সেইজন্যেই অংশুবাবু মুমুকে দেখে হঠাৎ খুব গদগদ হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে ধমক দিতে দিতে থেমে গিয়ে সরে পড়লেন তাড়াতাড়ি।
একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু এই সব ধর্ম-টর্মের স্থানে সিগারেট খাওয়া চলে কিনা জানি না। আর কেউ ধরায়নি।
গুরুমা বললেন, আজকের রানী মিলি। তার নাম দিলাম আমি বাথশিবা। এখন কে ডেভিড হবে? তুমি ডেভিডকে বেছে নাও! দাঁড়াও, দাঁড়াও, সিংহাসনে বসো আগে।
প্রিসিলা নিজে সেই চেয়ার থেকে নেমে এসে মিলিকে বসালেন। তার গলায় পরিয়ে দিলেন একটা ফুলের মালা, হাতে দিলেন চামরটা।
নিজে কার্পেটের ওপর বসে বললেন, বাথশিবা, তোমার ডেভিডকে ডাক। মিলি সোজা হাত তুলে শংকর জৈনের দিকে দেখাল। এখানে ছেলেদের মধ্যে সেই-ই যে সবচেয়ে সুপুরুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই
শংকর আমাদের কাছাকাছি বসে আছে। সে যেন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল।
সামনের দিক থেকে একটি যুবক খানিকটা ঠাট্টা, খানিকটা প্রতিবাদের সুরে বলল, এ কী এ কী! প্রত্যেকদিন শংকর জৈনকে ডাকা হবে কেন? আমরা বুঝি কেউ নই?
শংকর বলে উঠল, আমিও আজ ক্ষমা চাইছি। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আজ অন্য কেউ হোক।
প্রিসিলা আদেশ দিলেন, রানী, তুমি অন্য একজনকে ডেভিড করো।
এবার যেন আমি খেলাটা খানিকটা বুঝতে পারছি।
পুরোটা বোঝা হলো না। আমার আরও দেখার ইচ্ছে ছিল, মুমু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ব্লু, পাঁচটা চল্লিশ বাজে। আমাকে এখন যেতেই হবে।
মুমু চলে গেলে আমার তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
শংকর জৈন বলল, আমিও যাব। চলো, তোমাদের নামিয়ে দিচ্ছি। মুমু বলল, তুমি নামিয়ে দেবে কি! তোমার তো কাছেই রাড়ি। আমরা নিজেরা চলে যাব।
শংকর জৈন বলল, তা হলে বুঝি তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আসতে পারি না? উঠে এসে জুতো পরার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি শংকর জৈনকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বুঝি খুব কাছেই থাকেন?
মুমু বলল, এই তো, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বিরাট বাড়ি। জৈন ম্যানশন, তুমি দেখোনি! সেইখানে ও থাকে।
শংকর জৈন মুখ নিচু করে বলল, এমন কিছু বিরাট নয়। এমনিই সাধারণ বাড়ি। আমি আপনাদের গড়িয়াহাট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি কিন্তু!
ছেলেটির বাংলা একেবারে নিখুঁত। এখানে একমাত্র সে-ই আমার সঙ্গে পুরোপুরি বাংলায় কথা বলছে।
জুতো-টুতো পরে সবে মাত্র পেছন ফিরেছি, এমন সময় কেউ একজন বলে উঠল, হ্যালো, হ্যালো, শ্রীমানজী! শ্রীমানজী!
তিনজনই ফিরে তাকালাম। একটি মেয়ে হাতছানি দিচ্ছে!
মুমু বলল, ব্লু, তোমাকে ডাকছে। প্রিসিলার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি।
আমি একটু কুঁচকে গিয়ে বললাম, আজ থাক না!
মুমু বলল, বাঃ, ডাকছেন যে তোমাকে! চলো।
দেয়ালের পাশ দিয়ে দিয়ে আমরা এগিয়ে এলাম সামনের দিকে।
প্রিসিলা উঠে এসে এক কোণে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মুখখানা সব সময় হাসি মাখা। মিলির পাশে আর একটি চেয়ার এনে রাখা হয়েছে, সেখানে বসেছে সেলিম নামে যুবকটি। সে আজকের ডেভিড।
প্রিসিলা ইংরিজিতে খুব মিষ্টি করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যাচ্ছ, তুমি কে গো? আমাকে তোমার নাম বলবে না?
মুমু বলল, আমার বন্ধু, এর নাম ব্লু।
প্রিসিলা বললেন, শুধু ব্লু? বাঃ কি সুন্দর নাম! আমার নাম রোজ!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, এই যে অন্যরা বলল, তোমার নাম প্রিসিলা? কিন্তু বললাম না, চুপ করে রইলাম। এখানে কেউ নমস্কার-টমস্কার করে না, তবু অভ্যেসবশত আমার হাত দুটো ওপরে উঠে এল, আমি বললাম, নমস্কার।
প্রিসিলা কিংবা গুরুমা কিংবা রোজ আবার বলল, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, তোমার অনেক দুঃখ, তাই না?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, না তো!
প্রিসিলা বলল, হ্যাঁ, আমি তোমার প্রশ্নগুলো দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার বুকের ভেতরে দেখছি, অনেকগুলো প্রশ্ন ঢেউয়ের মতন ঝাপটা মারছে। এসো!
সে আমাকে পাশের ঘরে ঢোকার জন্য ইঙ্গিত করল। হাত তুলল মুমু আর শংকর জৈনের দিকে। অর্থাৎ ওরা বাইরে থাকবে।
পাশের ঘরটাকে প্রথম মনে হলো অন্ধকার। তারপর বুঝতে পারলাম, খুব কম পাওয়ারের একটা নীল বাল্ব জ্বলছে, নাইট ল্যাম্পের মতন। জানলাগুলো বন্ধ।
একটা চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন প্রিসিলা। নিজে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললেন, প্রশ্ন মানেই তৃষ্ণা। আর কষ্ট। বিশ্বাস মানেই আনন্দ
আমি মৃদু আপত্তির সুরে বললাম, আমার সেরকম কোনো কষ্ট নেই। প্রিসিলা কোনো জায়গা থেকে আর এক গেলাস শরবত এনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, খাও। ওগো তৃষ্ণার্ত, এটা খেয়ে নাও!
এই শরবতটা আমার বেশ পছন্দ। বিনা পয়সায় যতটা পাওয়া যায়। আমি হাত বাড়িয়ে নিয়ে গেলাসটা ঠোটে ছোঁয়ালাম। আগের চেয়েও স্বাদটা আরও ভালো মনে হলো।
প্রিসিলা বললেন, তোমার তিনটে প্রশ্নের আমি উত্তর দিয়ে দেব। আমার কাছে সবাই প্রশ্ন নিয়ে আসে, বিশ্বাস নিয়ে ফিরে যায়। যদিও আমি কেউ না, আমি একটা আয়না, আমার মধ্যে সবাই নিজেকেই দেখে।
আজকালকার গুরু কিংবা গুরুমায়েরা কী ধরনের কথা বলে, তা আমি জানি না। শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত ছাড়া আর কোনো ধর্মের বই-টই পড়িনি। প্রিসিলার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে ভোগোলজি। ওসব আয়না-টায়না দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা আমিও বলতে পারি।
প্রিসিলা আমার একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছেন। বয়েস যথেষ্ট হলেও তাঁকে বেশ রূপসী রমণীই বলা যায়। নিটোল স্বাস্থ্য। চমৎকার গন্ধ পাচ্ছি, খুব দামি পারফিউম মেখেছেন।
এত কাছাকাছি কোনো অচেনা মহিলা এসে দাঁড়ালে শরীর শিরশির করে। আমার মাথাটাও একটু যেন ঝিমঝিম করছে। এই শরবতে কিছু মেশানো ছিল নাকি?
জাদুকরীর মতন একটা হাত আমার মুখের সামনে নাড়তে নাড়তে প্রিসিলা বললেন, প্রথম প্রশ্ন, মনের দরজা খোলা না বন্ধ? বলতে পারো, তোমার নিজের মনের দরজা খোলা না বন্ধ?
আমি দু’ দিকে মাথা নাড়লাম।
প্রিসিলা বললেন, তা হলে আগে একটা একটা করে দরজা খোলো। ঠিক এই রকম ভাবে।
ফট করে শব্দ হয়ে পাশের দিকের একটা দরজা খুলে গেল। আমি চমকে উঠলাম। সেখানে কেউ নেই, তবে কি আপনা আপনি খুলে গেল দরজাটা? তারপরেই মনে পড়ল, রিমোট কন্ট্রোলে টিভি চালাবার মতন, রিমোট কন্ট্রোলে দরজাও খোলা যায়। বিলেতে আমেরিকায় অনেক লোক গাড়ি চালিয়ে বাড়ির সামনে আসে, গ্যারাজের দরজা খোলার জন্য তাদের গাড়ি থেকে নামতে হয় না, বসে বসেই রিমোট কন্ট্রোলে খুলে ফেলে। এখানেও সেই রকমই কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই!
প্রিসিলা ফিসফিস করে বললেন, ভালো করে দ্যাখো! মনের সহস্র দরজা। এক এক করে খুলতে হয়!
এবার আমি সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। এ কী ব্যাপার? দরজা শুধু একটা তো নয়। সেই দরজার ঠিক ওপাশে আর একটা দরজা। তারপর আর একটা। তারপর আর একটা। কত যে দরজা তার ঠিক নেই! এটা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। এখানে পরপর এতগুলো ঘর থাকবে কী করে? অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি ঘরের পর ঘর, সব দরজা খোলা।
আমার থুতনিতে একটা আঙুল দিয়ে মুখটা ফিরিয়ে প্রিসিলা বললেন, এবার আমার দিকে তাকাও। আমার নাম রোজ। আমি লাল গোলাপ, না সাদা? তোমার নাম ব্লু। তুমি কি সত্যিই ব্লু না ইয়ালো?
ফস করে কোথা থেকে একটা গোলাপ বার করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি লাল, না সাদা?
এত কম আলোতে বোঝা মুস্কিল। তবে কালচে রঙ দেখে মনে হলো, লালই হবে।
আমি বললাম, লাল, তাই না?
নাচের ভঙ্গিতে এক পাক ঘুরে গিয়ে প্রিসিলা আবার বললেন, এবার দেখো তো? সত্যি লাল?
ফুলটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে।
বুঝতে পারছি, উনি আমাকে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। কিছু ম্যাজিক না শিখলে ধর্মের প্র্যাকটিস ভালো জমে না।
কিন্তু আমি আরও অনেক গোলাপ দেখছি কেন? এই ঘর ছাড়িয়ে আরও শত শত গোলাপ বাগান, সেখানকার ফুলগুলো একবার সাদা, একবার রক্তিম হয়ে যাচ্ছে।
প্রিসিলা ফিসফিস করে বললেন, জোর দিয়ে কি বলা যায়, কোটা সাদা, কোন্টা লাল? মানুষও সেই রকম। কখনো মানুষকে এক রঙ দিয়ে বিচার করতে নেই। মানুষ বহুবর্ণ। ঈশ্বর তাঁর সবগুলো রঙ দিয়ে মানুষকে তৈরি করেছেন।
আমি প্রিসিলার কথা আর শুনতে পাচ্ছি না। আমার চোখে ভাসছে অসংখ্য গোলাপের উদ্যান, একটা ঝড় বইছে, কী মোহময় সেই দৃশ্য। ফুলের বাগানে ঝড় আমি কখনো সত্যি সত্যি দেখেছি কি? অথচ কল্পনায় তা এল কী করে? ফুলের গন্ধও পাচ্ছি, সারা ঘর ভরে গেছে অপূর্ব কুসুমসৌরভে।
প্রিসিলা আমার থুতনিতে আবার আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, এবার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর…
কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমার চোখ বুজে আসছে, কিছুতেই খোলা রাখতে পারছি না চোখ। আমার মাথাটা ঝুঁকে এল, চিবুক ঠেকে গেল বুকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।