বাড়ির খবর – ৮

প্রথম যখন চালু হয়, তখন মিনিবাস ছিল রীতিমতন একটা আরামের গাড়ি। উঠলেই সিট পাওয়া যেত, কারুর দাঁড়িয়ে যাবার ব্যবস্থা ছিল না। বেশ খোলামেলা ভাবে, হাত-পা ছড়িয়ে পাড়ি দেওয়া যেত পথটা। এখন মিনিবাসেও সব সময় গাদাগাদি। দাঁড়িয়ে যাবার সময় ঘাড় নিচু করে থাকতে হয়। এখন চতুর্দিক থেকে আমাদের একটা ঘাড় নিচু করা জাত বানাবার ব্যবস্থা চলছে।

আজ বাদলা দুপুরে বাসটা প্রায় ফাঁকা। ওঠামাত্র জানলার ধারে একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। যেন লটারির প্রাইজ। বেশ মজা করে রাস্তার নানারকম দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।

বেশিদিন আগের তো কথা নয়, আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন প্রায়ই আমরা দল বেঁধে এইরকম বৃষ্টির দিনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম ইচ্ছে করে। আমাদের সঙ্গে বান্ধবীরাও থাকত। কোনো কোনো মেয়ের শাড়ি ভিজিয়ে জলের মধ্যে হাঁটায় বেশি উৎসাহ ছিল। আমরা ঠনঠনে কালীবাড়ির কাছে জল-জমা দেখতে যেতাম। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে হাঁটতাম ঠিক মাঝ রাস্তা দিয়ে।

এখন সেরকম ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা যাচ্ছে না একেবারেই। কিছু লোক ব্যাজার মুখে জলের রাস্তা পার হচ্ছে বটে, কিন্তু বোঝাই যায়, এরা যাচ্ছে নিতান্ত বাধ্য হয়ে।

কলকাতার রাস্তা আর এমনিতেই হাঁটার উপযুক্ত নেই। সব ফুটপাতে হকার। রাস্তার যেখানে সেখানে বড় বড় গর্ত। দু’-এক বছর আগে এক অফিস-ফেরত ভদ্রলোক হঠাৎ গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে ডুবে মরেছিলেন। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা গাড়ি প্রায় নেমে গিয়েছিল পাতালে।

বৃষ্টি আবার বেড়েই চলেছে। আবার জল বাড়বে। বৃষ্টির সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামের একটা বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। দু’ পশলা বৃষ্টি হোক, অমনি কলকাতার বহু রাস্তা অচল। কিছু গাড়ি যেখানে সেখানে খারাপ হবে, বাকি গাড়িগুলো পেছনে দাঁড়িয়ে গজরাবে।

আমার মিনিবাসটা চলছে টিকিয়ে ঢিকিয়ে। তা চলুক। আমার কোনো তাড়া নেই। কলেজ স্ট্রিটে আজ বিশেষ কারুকে আড্ডা মারার জন্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবু একবার ঢুঁ মেরে দেখা যেতে পারে। কোনো বন্ধুকে না পেলে চলে যাব প্রীতম কিংবা বাপ্পার বাড়িতে।

লালুদার সঙ্গে যে দেখা হতোই তার কোনো মানে নেই, তবু মনে হচ্ছে লালুদার হাত থেকে খুব জোর বেঁচে গেছি।

বৃষ্টির জোর যত না বেশি, সেই তুলনায় আকাশ খুব কালো হয়ে আছে। দিনের বেলাতেই অন্ধকার।

বিজলি সিনেমা পার হবার পর মিনিবাসটা একেবারে থেমে যাবার উপক্রম। সামনে নাকি দুটো গাড়ি খারাপ হয়ে আছে, ছোকরা কণ্ডাকটারটি জলের মধ্যে নেমে চ্যাচাচ্ছে। কোনো জায়গা দিয়ে সুরুত করে গলে যাবার সুযোগ পাচ্ছে না।

থেমে গেলেই বেশ গরম লাগে।

রাস্তার বাঁ পাশে, একটু আগে থেমে-থাকা একটা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে দুটি মেয়ে। একজনের শুধু মাথার পেছন দিককার চুল দেখতে পাচ্ছি, আর একজনের মুখের একটা পাশ। অন্ধকারের মধ্যে সেই মুখটা যেন কালো হয়ে আছে।

গরম ও অস্থিরতা কাটাবার জন্য এরকম একটা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাই শ্ৰেষ্ঠ উপায়।

মেয়ে দুটি নিজেদের মধ্যে খুব কথা বলছে। গাড়ির জানলার কাচ বন্ধ। দু’—একবার তাকাবার পরে মনে হলো, ঐ মেয়েটির মুখ যেন চেনা চেনা। কোথাও দেখেছি আগে। কিন্তু শুধু ওর মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, তাও অস্পষ্টভাবে।

মিনিবাসটা ফোঁস ফোঁস করছে বটে কিন্তু এগোচ্ছে কচ্ছপের মতন। একটু পরে মিনিবাসটা সেই গাড়িটার একেবারে পাশে চলে এল। তার ফলে আর ওদের দেখা যায় না। অন্য কোনো গাড়িতে দেখবার মতন কেউ নেই। সেই ভাবে কাটল পাঁচ মিনিট।

তারপর মিনিবাস আর কয়েক ইঞ্চি এগোতেই আমি প্রায় মুখ বার করে সেই মেয়েটিকে একবার দেখে নেবার চেষ্টা করলাম। সত্যিই কি সে চেনা?

তখনই সে গাড়ির জানলার কাচ খুলে গেল, অন্য মেয়েটি চেঁচিয়ে ডাকল, ব্লু! এই ব্লু! নেমে এস!

মুমু!

আমাদের বাসটা খানিকটা ফাঁক-ফোঁকর পেয়ে এবার গতি বাড়াতে যেতেই আমি ঝট করে উঠেই দৌড়ে নেমে পড়লাম।

ঠিকই মনে হয়েছিল চেনা চেনা, মুমুর পাশের মেয়েটি লরা।

আগে লক্ষ করিনি বা বুঝতে পারিনি, ওদের গাড়িটি একেবারে স্থানু, ড্রাইভারের সিটে কেউ নেই, সামনের দিকের হুড খোলা।

মুমু বলল, এই ব্লু, তুমি স্বার্থপরের মতন একলা একলা মিনিবাসে করে কোথায় যাচ্ছিলে?

আমি হাসলাম।

মুমু আবার বলল, বাসটাকে থামাও না, আমরা যাব। দেখছ না, আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে!

মিনিবাসটা ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছে, ওটা আর ধরার আশা নেই!

মুমু আজ শাড়ি পরেছে। ইদানীং নেমন্তন্ন বাড়ি-টাড়িতে গেলে ও মাঝে মাঝে শাড়ি পরে, তখন ওকে অন্যরকম দেখায়। লরাও একটা জমকালো শাড়ি পরা, দু’জনেই সাজগোজ করেছে খুব। দুই ইয়াং লেডি।

—তোরা এই জলের মধ্যে নামবি কী করে?

লরা নাক কুঁচকে বলল, ওরে বাবা, এই নোংরা জলে আমি পা ডোবাতে পারব না!

মুমু বলল, তা হলে আমরা যাব কী করে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই বিচ্ছিরি দিনে তোরা বেরিয়েছিলি কেন? আর এইখানেই সবচেয়ে বেশি জল আর জ্যাম

মুমু বলল, বাঃ, আমরা যে রবীন্দ্রসদনে রাশিয়ান ব্যালে দেখতে যাব। আগে থেকে টিকিট কাটা আছে!

—আজ আর ব্যালে দেখা হয়েছে আর কি!

—আমাদের টিকিট নষ্ট হবে। এই টিকিট সহজে পাওয়া যায় না। লরার বাবা অনেক কষ্টে জোগাড় করেছেন। একটা ট্যাক্সি ধরে দাও না, ব্লু!

—এখন ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। দু’তিনটে ট্যাক্সি জলে বন্ধ হয়ে গেছে!

—তাহলে এখন কী হবে? ইস, ইস! আমি রাশিয়ান ব্যালে কিছুতেই মিস করতে চাই না।

মুমু ছটফট করে বসে বসেই প্রায় নাচতে লাগল।

গাড়ির ড্রাইভার এই সময় হুড নামিয়ে এসে বলল, স্টার্ট নিচ্ছে না, ঠেলতে হবে!

বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমলেই এক দল ছেলে কোথা থেকে হৈ হৈ করে চলে আসে। প্রচুর গড়ি ঠেলতে হয়। কলকাতায় সব জিনিসই সহজে পাওয়া যায়। গাড়ি ঠেলার লোকও নিজে থেকেই চলে আসে। গাড়িওয়ালা লোকদের এই সব দিনে বেশ কিছু টাকা খসে!

আজ ভোর থেকেই কলকাতা অচল। সেই সব ছেলেরা বহু টাকা রোজগার করে ফেলেছে, তাদের আর টাকার লোভ নেই, তারা যেন চলে গেছে কোথায়। এখন আর একজনকেও দেখা যাচ্ছে না।

ড্রাইভারটি দু’জন ময়লা পোশাক পরা লোককে অনুরোধ করতে গিয়ে ধমক খেল। তারা ঠেলার লোক নয়।

এবার আমাকেই প্রস্তার দিতে হলো, আমি ঠেলে দিলে চলবে?

লরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, না, না! আপনি ঠেলবেন কেন? কোনো কোশ্চেনই ওঠে না। আমরা ওয়েট করব।

মুমুর ফর্সা হাতের কবজিতে একটা ছোট্ট সোনালি ঘড়ি। মুমু সেই ঘড়ি দেখে নিল চট করে।

আমি ঘড়ি পরি না, কিন্তু সব সময়েই সময়ের একটা আন্দাজ থাকে আমার। তিনটে বাজতে আর বিশেষ দেরি নেই।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আর আমি দু’জনে মিলে ঠেললে চলবে কিনা দেখুন না।

ড্রাইভার সাহেব বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, চলে যাবে।

লরা বলল, এ কী, ছি ছি, আমার খুব খারাপ লাগছে।

মুমু চুপ করে রইল। যে-কোনো পুরুষমানুষের কাছ থেকেই মেয়েরা এটুকু সাহায্য দাবি করতে পারে।

ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এর দিকে, আমি অন্য পাশে। এর আগেও অনেকবার গাড়ি ঠেলতে হয়েছে আমাকে। আমি অন্য কারুর গাড়িতে চড়লেই যখন তখন সেগুলো খারাপ হয়ে যায়। এই শহরে গাড়ি চড়ে অথচ দু’-একবার গাড়ি ঠেলতে হয়নি, এমন মানুষ দুর্লভ।

অন্য সময় গাড়ি ঠেলা আর হাঁটু জলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ঠেলায় অনেক তফাত। খানিকটা যেতেই আমার জিভ বেরিয়ে যাবার উপক্রম। অথচ মেয়ে দুটিকে দেখাবার জন্য মুখখানা হাসি হাসি করে রাখতে হচ্ছে, দু’-একটা কথাও বলতে হচ্ছে ওদের সঙ্গে।

লরা বারবার নিবৃত্ত করতে চাইছে আমাকে, আর মুমু আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য বলছে, আর বেশি দূর নেই, তাই না?

আসলে এখনো অনেক দূর। গাড়ি ঠেলে ওদের রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে দেওয়া যাবে না।

আমি একটা কথা ভেবে অবশ্য সান্ত্বনা পাচ্ছি। রাস্তার একটা ছেলে এতটা গাড়ি ঠেললে কুড়ি-পঁচিশ টাকা অন্তত নিতই। আমিও পারিশ্রমিক পেয়ে গেছি। মুমুর ওপর নজর রাখার জন্য লালুদা আমাকে পার ডে পঞ্চাশ টাকা হিসেব করে দিয়েছে।

ঘামে ভিজে গেছে আমার জামা। কপাল দিয়েও টস টস করে ঘাম ঝরছে। একেই বলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করা।

এলগিন রোডের কাছটায় জল নেই, রাস্তাও পরিষ্কার। খানিকটা জায়গা যেন দ্বীপের মতন শুকনো।

ড্রাইভারটি বলল, একটু দাঁড়ান স্যার, দেখি এবার স্টার্ট নেয় কি না!

আমি থেমে পিঠ সোজা করলাম। সে উঠে বসল স্টিয়ারিং-এর সামনে। স্টার্ট দিতেই একটা বিশ্রী খ্যারখেরে শব্দ হতে লাগল। মনে হয় কোনো আশা নেই।

দু’তিনবার সে-রকম করার পর ড্রাইভারটি বলল, হবে, হবে, স্যার। আপনি আর একটু ঠেলে দেবেন?

বোঝো ঠ্যালা! আগে ছিল দু’জন এখন তিনজন। আমি কি দারা সিং?

ড্রাইভারটি বলল, সাইড থেকে ঠেললে হবে না, পেছন দিক থেকে একটু যদি।

লরা ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই বিষণ, তুমি ওরকমভাবে বলছ কেন? উনি কেন ঠেলবেন? তুমি লোক জোগাড় করো!

আমি দেঁতো হাসি দিয়ে বললাম, না, না তাতে কী হয়েছে। আমি চেষ্টা করে দেখছি।

গাড়ির পেছনে গিয়ে দিলাম এক রাম ধাক্কা। তাতে গাড়ি একটুও নড়ল না। ভুল হয়েছে, রামের খুব তো একটা গায়ের জোরের খ্যাতি নেই। দিতে হবে ভীম ধাক্কা। মনে মনে টিভি’র মহাভারতের ভীমকে স্মরণ করে আবার দু’হাত লাগালাম।

এবার সত্যিই একটু নড়ল, তারপর আর একটু। ইঞ্জিনের আওয়াজটা ক্রমশ ভদ্রস্থ হচ্ছে। গাড়িটা দু’চার পা এগোতেই স্বাভাবিক হয়ে গেল, হুস করে চলতে শুরু করে দিল।

আমি হাত ঝাড়লাম। কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে। দুটি বড়লোকের মেয়ে রাশিয়ান ব্যালে দেখতে যাবে, তার জন্য আমার কি ঝকমারি। অবশ্য রাশিয়ান ব্যালে বড়লোক ছাড়া আর কেউ দেখার সুযোগ পায় না।

ওদের কার্যোদ্ধার হয়ে গেছে, তাই আমাকে ফেলে চলে গেল!

কিন্তু গেল না, গাড়িটা একটু দূরে গিয়েই থামল। আবার গণ্ডগোল নাকি? আর ঠেলার সাধ্য নেই আমার। এবার পালাতে হবে!

গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল লরা।

আমি পালাবার জন্য পা তুলেও ধরা পড়ে গেলাম। লরা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যেতেই হলো কাছে।

লরা বলল, একি, আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? স্টার্ট নিয়েছে ঠিকঠাক। আপনি গাড়িতে এসে উঠুন!

আমি বললাম, আমি আপনাদের গাড়িতে উঠে কী করব? আমি তো রবীন্দ্রসদনে যাব না!

–তবু উঠুন, আপনাকে এগিয়ে দেব! প্লিজ আসুন।

–না, না। আমার দরকার নেই। আমি ঠিক চলে যাব। আপনারা তাড়াতাড়ি যান, আপনাদের অলরেডি দেরি হয়ে গেছে।

মুমু বলল, অ্যাই ব্লু, ওঠো না। তুমি গাড়ি ঠেললে, তারপর যদি গাড়িতে না ওঠো, তাহলে সবাই ভাববে তুমি রাস্তার কুলি!

আমি বললাম, সবাইটা আবার কে? আমায় তো কেউ দেখছে না, কেউ আমাকে নিয়ে মাথাও ঘামাচ্ছে না। তোরা চলে যা!

লরা বলল, আই ইনসিস্ট! আপনাকে আসতেই হবে। আপনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করলেন, আপনাকে আমার ড্রাইভার নামিয়ে দেবে আমাদের রবীন্দ্রসদনে ছেড়ে…

আমাকে উঠতেই হলো। সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। পায়ে জল-কাদা মাখামাখি। এমন ফুটফুটে, সুশ্রী, খুব সাজগোজ করা মেয়েদের সান্নিধ্যে নিজেকে আরও বেশি নোংরা লাগছে। আগে কোথাও গিয়ে পা ধুতে হবে।

লরা জিজ্ঞেস করল, আপনি রাশিয়ান ব্যালে দেখতে ইন্টারেস্টেড নন!

আমি হেসে বললাম, টিকিট পাব কোথায়? চেষ্টাও করিনি!

-কেন চেষ্টা করেননি কেন? আপনার বুঝি ভালো লাগে না?

—বলশয় ব্যালে ভালো লাগবে না, এমন পাষণ্ড কেউ আছে নাকি পৃথিবীতে? কিন্তু শুনেছি, অনেকে ভোর পাঁচটা থেকে এসে লাইন দিয়েও শেষ পর্যন্ত টিকিট পায়নি। আবার আপনাদের মতন কেউ কেউ লাইন না দিয়েই টিকিট পেয়ে যায়। সুতরাং আমার পাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

লরা মুমুর দিকে তাকিয়ে বলল, শংকরের কাছে একস্ট্রা টিকিট থাকতে পারে।

মুমু বলল, শংকর আমাদের জন্য ওয়েট করবে ওখানে। ওকে জিজ্ঞেস করব, যদি একস্ট্রা থাকে, তা হলে তুমিও যাবে আমাদের সঙ্গে। চলো চলো, ব্লু!

শংকর ধনাঢ্য মাড়োয়ারি। এই সব দুর্লভ টিকিট এরা নিজেদের জন্য আয়াসে পেয়ে যায় তো বটেই, বিলোবার মতন অতিরিক্তও থাকে। এদের সঙ্গে মুমুর এতটা মেলামেশা কি ঠিক হচ্ছে?

বর্ষার দিন বলেই আমি আগের দিনের দোমড়ানো-মোচড়ানো জামা-প্যান্ট পরে এসেছি। সারা শরীর ঘামে ভিজে শপশপে হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কি রবীন্দ্রসদনে ঢোকা যায়? টিকিট থাকলেও নির্ঘাৎ আমাকে গেটে আটকে দেবে!

কোথাকার জল কোথায় গড়ায় বলে একটা কথা আছে না? এক-একটা সামান্য ঘটনা যে আর কত রকম আকস্মিক ঘটনার সম্ভাবনার মধ্যে নিয়ে যায় মানুষকে, তার ঠিক নেই।

সারাদিন বেরুব না ভেবেছিলাম, দুপুরবেলা ঘুমোতে ইচ্ছে হলো না বলেই বেরিয়ে পড়লাম। অকারণে। উঠলাম অন্য বাসে। এর বদলে একটা দেতলা বাসে উঠলে, এমনকি পরের মিনিবাসটায় উঠলেও পরবর্তী সব কিছু অন্যরকম হয়ে যেত। আমার মিনিবাসটা যেখানে থেমে রইল, তার পাশেই একটা বিকল গাড়ি, যার মধ্যে বসে আছে মুমু আর লরা। মিনিবাসটা যদি আর পঞ্চাশ গজ পেছনে থামত, তাহলে আমাকে আর ওদের গাড়ি ঠেলে গলদঘর্ম হতে হতো না। আর গাড়ি ঠেলেছি বলেই তার পুরস্কারস্বরূপ লরা তার গাড়িতে আমায় চাপিয়েছে এবং রাশিয়ান বলশয় ব্যালে, যার টিকিট না পেয়ে কলকাতায় প্রচুর ছেলেমেয়ে দারুণ হতাশ, সেই বিশ্ববিখ্যাত নৃত্য বেমক্কা দেখার সুযোগ আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে।

কোথাকার জল কোথায় গড়ায়ই বটে!

এলগিন রোডের কাছটায় শুকনো ছিল, সার্কুলার রোডের কাছে আবার দারুণ জল। ওদিকের সব জল যেন এখানে গড়িয়ে এসেছে। রবীন্দ্রসদনের সামনে রীতিমতন নদীর ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

লরার গাড়ি কিন্তু আর থামল না, সেই জলের মধ্যে দিয়েই দিব্যি চলে এল। নিশ্চিত আমার ঠেলাঠেলির গুণে।

এত জলের মধ্যেও রবীন্দ্রসদনের সামনে প্রচুর লোকজনের ভিড়। কী যেন একটা গোলমাল হয়েছে।

গাড়ি থেকে নামতে হলো না। লোকজনের মুখ থেকেই খবর পাওয়া গেল যে শো ক্যানসেল্ড। যারা এত কষ্ট করে এসেছে, সবাইকেই ফিরে যেতে হবে।

অনুষ্ঠান বন্ধ হবার দু’রকম কারণ জানা গেল। রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে জল ঢুকে গেছে, সুতরাং অনুষ্ঠান হতে পারবে না। এছাড়া বলশয় ব্যালে গ্রুপের বেশ কয়েকজন নর্তক নর্তকীর আজই সকালের ফ্লাইটে দিল্লি থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু আজ বিমান চলেনি, তাই তারা এসে পৌঁছতে পারেনি।

এই দুটি কারণের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বিচার করে দেখার কোনো দরকার আছে বলে মনে হলো না। একটাই যথেষ্ট।

মুমু আর লরা দুজনেরই প্রায় কান্নার উপক্রম।

আমি তেমন নিরাশ হইনি। এই সব ভালো ভালো জিনিসের টিকিট আমার পাবার কথা নয়। হঠাৎ দুম করে একটা পেয়ে গেলেই হলো নাকি!

এখন শংকরকে খুঁজে বার করতে হবে।

এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? কিছু লোককে বেশ বিক্ষুব্ধ মনে হলো। কিসের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ জানাচ্ছে? বৃষ্টির বিরুদ্ধে? না বিমান চলাচলের অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে? কলকাতার মানুষদের বিক্ষোভ জানাবার এমনই, মহান ঐতিহ্য আছে যে কিছু একটার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ না চালালে ভালো দেখায় না। দুটি ছেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, রবীন্দ্রসদনে জল ঢোকে কেন? আশ্চর্য প্রশ্ন! জল উঁচু থেকে নিচুর দিকে যাবে না? জলের ধর্ম বদলে যাবে নাকি? একে বলে শুধু শুধু জল ঘোলা করা। রবীন্দ্রসদন নিচু হলো কেন? রবীন্দ্রসদনের নক্সা যিনি করেছিলেন তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। এখানে শুধু ঝামেলা করার কী দরকার।

মুমু আর লরা জলে নামবে না। শংকরকে খোঁজার জন্য আমাকেই যেতে হবে।

সবে মাত্র একটা পা জলে দিয়েছি, তক্ষুনি একটা স্টেশান ওয়াগন হুস করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। তার থেকে শংকর মুখ বাড়িয়ে বলল, ব্যাড লাক। আজ শো হচ্ছে না। আমি ভেবেছিলাম, তোমরা এসে পৌঁছতেই পারবে না।

লরা বলল, থ্যাংকস টু নীললোহিত, উনি আমাদের যা সাহায্য করেছেন! আমি এক টুকরো হাসি দিলাম। একদিন শংকর আমার জন্য নিজের গাড়ি অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছিল, আজ আমি তার প্রেমিকার গাড়ি খানিকক্ষণ ঠেলে দিয়েছি, এ আর বেশি কথা কী?

মুমু বলল, তাহলে এখন আমরা কী করব? এখন মোটেই বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না।

লরা বলল, আমাদের তাজ বেঙ্গলে আইসক্রিম খাওয়াবে?

শংকর বলল, চলো!

আমি গাড়ি থেকে নেমে বললাম, চলি।

শংকর আর লরা একসঙ্গে বলে উঠল, না, না, আপনি যাবেন কেন? আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন!

—আমি গিয়ে কী করব? আমি আইসক্রিম খাই না!

লরা বলল, আপনি অন্যকিছু খাবেন।

আমি বললাম, না, থ্যাংক ইউ, আমার অন্য জায়গায় কাজ আছে, আমাকে যেতেই হবে।

মুমু বলল, কোনো কাজ নেই। এই বৃষ্টির দিনে আবার কী কাজ? এই ব্লু, চলো আমাদের সঙ্গে!

শংকর গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার হাত ধরে অনুনয় করল, প্লিজ চলুন, বেশিক্ষণ আটকে রাখব না!

এরপর আর আপত্তি করা চলে না! ছেলেটি সত্যিকারের ভদ্র।

সত্যি কথা বলতে কী, আমার কোনো কাজও নেই, যাবার ইচ্ছেও আছে বেশ। কিন্তু হ্যাংলার মতন তো প্রথমেই রাজি হওয়া চলে না। আগে একটু গুমোর দেখাতে হয়। এই তো বেশ সম্মানজনকভাবে আমন্ত্রিত হওয়া গেল। হোটেলটার কী নাম শুনেছি, বাইরে থেকে দেখেছিও কয়েকবার। কিন্তু একলা ভেতরে ঢুকতে সাহস হয় না, কেউ এ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যেতেও চায়নি। কলকাতা শহরে একটা এত বড় হোটেল হয়েছে—একবার ভেতরে গিয়ে দেখব না?

শংকর বলল, সবাই আমার গাড়িতে চলে এসো। রাস্তায় যদি কোথাও বেশি জল থাকে এটা উঁচু গাড়ি, কোথাও আটকাবে না। লরা, তোমার গাড়ি পেছন পেছন আসুক।

শংকরের কটা গাড়ি আছে কে জানে! এটা বিদেশী গাড়ি। ভেতরে আট—দশজনে বসতে পারে স্বচ্ছন্দে। গাড়ি চালাচ্ছে শংকর নিজেই। এদিকে আর বিশেষ জল নেই, যত জল রবীন্দ্রসদনের সামনে।

খুব জোরে গাড়ি চালায় শংকর। আমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোটই হবে, কিন্তু খুবই সপ্রতিভ। মুখ দেখলেই বোঝা যায় সে অনেক কিছুই পারে। হয়তো প্লেন চালাতেও জানে।

হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকে শংকর পোর্টিকোর কাছে গাড়ি থামাল। বিশাল চেহারার, পাগড়ি মাথায় এক ডোরম্যান তাড়াতাড়ি এসে শংকরকে লম্বা সেলাম দিল। বোধহয় শংকরকে চেনে। তা তো চিনবেই। ওকে চিনবে না তো কি আমায় চিনবে?

ভেতরে ঢুকে এসে এমন একটা ভাব দেখালাম, যেন এরকম কত দেখেছি! আদেখলাপনা করলে একদম চলবে না। মুমু ছেলেমানুষ, সে অনেকটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফেলল। মুমুও এখানে আগে আসেনি।

বিরাট লবিতে কিছু বিদেশী ও বিদেশিনী, আর যারা এদেশী, তাদের একজনকেও বাঙালি মনে হলো না। এসব জায়গায় আসা আর ক’জন বাঙালির সাধ্যে কুলোয়। সংস্কৃতিমান বাঙালির আজ পকেট ফুটো। বাংলার রাজধানী কলকাতার একটা বড় হোটেলে বাঙালির প্রায় প্রবেশ নিষেধই বলা যায়!

নিশ্চিন্ত পায়ে হেঁটে শংকর অনেকটা দূরের এক কক্ষে নিয়ে এল আমাদের। এখানেও একজন স্টুয়ার্ট চেনা ভঙ্গিতে নমস্কার জানাল তাকে, একটা খালি টেবিল দেখিয়ে দিল। শুধু সেই টেবিলটাই খালি। বৃষ্টি-বাদলা অগ্রাহ্য করে অনেকেই এসেছে একগাদা টাকা খরচ করতে।

শংকর জিজ্ঞেস করল, কী খাবে?

দুটি মেয়েই বলল, আইসক্রিম।

শংকর বলল, আইসক্রিম তো খাবেই, তার আগে অন্য কী খাবে?

দু’জন আবার বলল, শুধু আইসক্রিম।

আমি তো আগেই বলে ফেলেছি যে আইসক্রিম খাই না, এখন আর সেটা ফেরাই কী করে? শংকর আমার দিকে তাকাতেই বললাম, আমি লস্যি খাব। নোনতা।

শংকর কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর স্টুয়ার্টকে ডেকে বলল, আপনাদের এখানে লস্যি পাওয়া যাবে?

স্টুয়ার্ট বিনীতভাবে হেসে বলল, না, স্যার। এখানে—

শংকর জোর দিয়ে বলল, যে-ভাবেই হোক ব্যবস্থা করুন। স্পেশাল রিকোয়েস্ট—

আমি একটা বোকামি করে ফেলেছি। চা-কফি কিছু একটা বললেই হতো। এটা কি পাঞ্জাবিদের ধাবা যে লস্যি পাওয়া যাবে?

খুব কায়দা করা পাত্রে আইসক্রিম এল, লস্যিও এল, সেই সঙ্গে একটা এত বড় ডিশ ভর্তি পেস্ট্রি, যা অন্তত দশজন খেতে পারে। লরা আর মুমু তার থেকে দয়া করে একটা টুকরো মুখে তুলল। যতই লোভ লাগুক, আমিও এক টুকরোর বেশি খাব না। বাকিগুলো নষ্ট হবে। অর্ডার দিয়ে খাবার নষ্ট করাই এখানকার কেতা। ওরা তিনজন কথা বলছে, আমি ঠিক যোগ দিতে পারছি না, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্যদের দেখছি।

ঘরখানা বাঙালি কায়দায় সাজানো। কোনো শিল্পী দেওয়ালে পল্লী বাংলার দৃশ্য এঁকেছে। এক জায়গায় একটা বড় ঘটের মধ্যে কৃত্রিম কলাগাছ। কিন্তু অন্য টেবিলগুলিতে যারা বসে আছে, তারা কথা বলছে হিন্দি অথবা ইংরিজিতে কলকাতার বড় বড় হোটেলগুলিতে একটিও বাংলা শব্দ উচ্চারিত হয় না। অনেক বিদেশী এসে জানতেই পারবে না, বাংলা নামে একটা ভাষা আছে।

অন্য টেবিলে অধিকাংশই অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে, কিছু লোক ব্যবসার কথাবার্তা বলতে এসেছে বোধহয়। ভাব-ভঙ্গি দেখলে তাদের বিশেষ এক সম্প্রদায়ের বলে মনে হয়।

আমি মুমুর দিকে তাকিয়ে বললাম, সব মাড়োয়ারি! ওদেরই তো পয়সা, আমরা ছাড়া আর একটাও বাঙালি নেই, দেখেছিস? এরা কলকাতার সব কিছু… লরার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কী যেন একটা কথা বলছিল শংকর, হঠাৎ থেমে গিয়ে তাকাল আমার দিকে।

আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। এ কী বলে ফেললাম আমি? শংকর যে মাড়োয়ারি তা আমার মনেই ছিল না!

শংকর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, থামলেন কেন, বলুন!

আমি মরমে মরে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে লম্বা জিভ কেটেছি। কিন্তু নিক্ষিপ্ত তীরের মতন, যে-কথাটি একবার বলে ফেলেছি, তা তো আর ফেরানো যায় না।

শংকর রাগ করেছে বলে মনে হয় না। কৌতুকের সুরে বলল, বাঙালিরা যে আড়ালে আমাদের সব সময় নিন্দে করে, তা আমি জানি। কেউ কেউ আমার সামনেই করে ফেলে, আমি যে বাঙালি নই তা বুঝতে পারে না। আমি তো বাংলাটা ভালোই বলি, তাই না?

আমি খানিকটা শোধরাবার চেষ্টা করে বললাম, আমি খারাপ সেন্সে বলিনি। বলছিলাম, বাঙালিদের হাতে এখন আর টাকা নেই।

-সেটা মাড়োয়ারিদের দোষ?

মুখে রাগের ভাব না দেখালেও শংকরের আঁতে ঘা লেগেছে। আমি ওকে আঘাত দিতে চাইনি, ও আমার সঙ্গে এত ভদ্রতা করেছে। কিন্তু আজ আমি একটার পর একটা বোকামি করে ফেলছি। এখানে আসাই আমার উচিত হয়নি।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শংকর আবার বলল, আপনারা মনে করেন, সব মাড়োয়ারিই অর্থপিশাচ। লোককে ঠকিয়ে বড়লোক হয়, গভর্নমেন্টকে ঠকায়। গোটা একটা কমিউনিটির নামে আপনারা এই অপবাদ দেন। আপনারা অন্যদিকটা ভেবে দেখেন না! আমি বাঙালিদের শ্রদ্ধা করি। বাংলা ভাষা, বাংলা গান আমার ভালো লাগে। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারের জন্য কষ্টও হয়। বাঙালিদের এক সময় স্পোর্টসম্যান স্পিরিট ছিল। বাঙালিরা ফেয়ার প্লে আর কমপিটিশানে বিশ্বাস করত। সেসব এখন গেল কোথায়? এক সময় বাঙালিদের মধ্যেও বড় বড় ব্যবসায়ী ছিল, তাই না? সেই সব হাউজগুলো গেল কোথায়? নিজেরা নষ্ট করে ফেলেছে। আমরা এখন অনেক এগিয়ে গেছি। বাঙালিরা কমপিটিশানে হেরে গিয়েও হার স্বীকার করতে পারছে না কেন?

আমি এবার মিনমিন করে বললাম, আর একটা কমিউনিটি কমপিটিশানে অনেক এগিয়ে গেছে, তা ঠিক, কিন্তু সবটাই কি ফেয়ার প্লে?

—কেন নয়? প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ, যে-কেউ ব্যবসায় নামতে পারে।

-কিন্তু যারা ইণ্ডিয়ার প্রায় সব ব্যবসা দখল করে নিয়েছে, তারা কি সব সময় এথিকস্ মানে? অতিরিক্ত মুনাফা করার জন্য একটা কমিউনিটি যদি জিনিসে ভেজাল দেয়, তা হলে লোকে তো তাদের সম্বন্ধে বদনাম দেবেই। মনে করুন, কেউ যদি বেবিফুডে ভেজাল দেয়।

–কে বেবিফুড অ্যাডালটারেট করেছে? কে? কবে? নাম বলুন!

—নাম এখন বলতে পারব না। কিন্তু এরকম তো হয়! অনেকবার হয়েওছে।

—ধরে নিলাম, আমাদের কমিউনিটির কেউ বেবীফুড খারাপ করে দিয়েছে। সে লোকটা পাপী, ক্রিমিনাল, অমানুষ। তবু তার জন্য একটা পুরো জাতের নামে বদনাম দেবেন? আপনাদের বাঙালিদের মধ্যে কি চোর-জোচ্চার-বদমাস একজন ও নেই। স্বীকার করবেন নিশ্চয়ই যে যথেষ্টই আছে, কিন্তু সে জন্য কি সব বাঙালিকেই আমরা…। অনেক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী আছে, যারা টপ টু বটম সৎ! শুধু তারা ব্যবসায়ে লাভই করে না, তাদের অনেক দান-ধ্যান আছে, তারা হাসপাতাল বানিয়ে দিয়েছে, স্কুল-কলেজ…

–সে রকম কিছু আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাই শংকর, এ দেশের অনেক বড় বড় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী নানা রকম অসৎ উপায়ে যে বেশি লাভ করে, সেটা মাঝে মাঝে এক্সপোজ্ড হয়ে যায়, সেগুলো এতই বড় বড় ক্রাইম যে লোকে ভুলতে পারে না, সেইজন্যই গোটা কমিউনিটটা সম্পর্কেই—

—যদি তারা ক্রাইম করে, তবে তাদের শাস্তি হয় না কেন? শাস্তি দেবার জন্য আইন আছে, থানা পুলিশ আছে!

—টাকার জোর থাকলে ওসব—

—ঘুষ দিয়ে সবাইকে হাত করা যায়? আচ্ছা মিঃ নীললোহিত, আমার একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দিন। এই পশ্চিম বাংলার পুলিশের মধ্যে কি অবাঙালি আছে? না তারা সবাই মোর অর লেস বাঙালি? কোর্টগুলোর জজেরা অলমোস্ট সবাই বাঙালি। মিনিস্ট্রিতে একজনও মাড়োয়ারি নেই, ঠিক কিনা? বুরোক্র্যাটদের মধ্যেও অন্তত এইট্টি পার্সেন্ট বাঙালি। ঠিক? এরা সবাই যদি জানে যে অনেক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ডিজঅনেস্ট ভাবে ব্যবসা করে, তবে তাদের শাস্তি দিতে পারে না কেন? সবাইকে টাকা দিয়ে হাত করা যায়? তা হলে তো বলতে হবে পুরো জাতটাই করাপ্ট! বাঙালির আইডিয়ালিজম্ সব শেষ! আপনি এটা মানবেন?

—বোধহয় ব্যাপারটা খুব জটিল। আইন যেমন আছে, তেমন আইনের ফাঁকও আছে।

—এটা দাদা ঠিক উত্তর হলো না। সবাই আইনের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যায়? যে-সব বাঙালির ব্যবসা ফেইল করেছে, তারা সবাই খুব অনেস্ট ছিল? আর একটা কথা, আপনারা মাড়োয়ারি শুনলেই ব্যবসায়ীর জাত মনে করেন কেন? মাড়োয়ারিদের মধ্যে অন্য কিছু নেই? এরা যে অন্যদিকেও অনেক এগিয়েছে, তা খেয়াল করেন না? কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার আছে মাড়োয়ারি। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে এক সময় বাঙালিদের একচেটিয়া অধিকার ছিল শুনেছি, এখন আমারই চেনাশুনা, আমার কমিউনিটির অনেক লোক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির টপ পজিশনে আছে। বড় বড় মাড়োয়ারি স্কলারদের নাম আপনি শুনতে চান? আই এ এস পরীক্ষায় সাকসেসফুলদের তালিকায় এখন আপনি বাঙালিদের নাম প্রায় খুঁজেই পাবেন না, মাড়োয়ারি নাম অনেক পাবেন।

লরার মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়েছে। সে আর মুমু বারবার অন্য কথা বলে থামাবার চেষ্টা করছে আমাদের। ওদের ধারণা আমরা ঝগড়া করছি। শংকর খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, গৌরবর্ণ মুখটি লালচে হয়ে গেছে, বলে যাচ্ছে অনেক কথা। তর্কের খাতিরে আমাকে মাঝে মাঝে দু’-একটা উত্তর দিতেই হচ্ছে। লরা বলল, আর ভালো লাগছে না। আমি এবার উঠব। একটা কথা বলি, নীললোহিতজি। আমার মা ছিলেন বাঙালি বাবা পাঞ্জাবি। আমি কিন্তু বাঙালিও না, পাঞ্জাবিও না। আমি ইণ্ডিয়ান।

আমি বললাম, সে তো খুব চমৎকার ব্যাপার।

যদিও আমি ইণ্ডিয়ানত্ব ব্যাপারটায় ঠিক বিশ্বাস রাখি না। আমার ধারণা ইণ্ডিয়াতে একজনও ইণ্ডিয়ান নেই। বাঙালি, অসমিয়া, ওড়িশী, মারাঠী, তামিল, গুজরাতি ইত্যাদিরা যখন দেশের বাইরে যায় তখনই তারা ভারতীয় হয়। লরা যদিও মোটামুটি বাংলা বলতে পারে, তবু তাকে পাঞ্জাবি মেয়েই মনে হয় সব সময়

আট-দশখানা একশো টাকার নোট দিয়ে বিল মেটাতে মেটাতে শংকর আমাকে বলল, আমার পূর্বপুরুষ খুব সামান্য ভাবে ব্যবসা শুরু করেছিল। শুনেছি, আমার গ্র্যাণ্ড ফাদারের ক্যাপিটাল ছিল আড়াইশো টাকা। তারপর আমাদের ব্যবসা অনেক এক্সপ্যাণ্ড করেছে, ডাইভারসিফাই করেছে, কিন্তু আমরা সব ব্যাপারে স্ট্রেট ফরোয়ার্ড এবং স্ট্রিক্ট টু দা রুল। আমাদের মধ্যে এরকম ফ্যামিলি আরও অনেক আছে আমি জানি। সেইজন্য আমার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই। আমি জানি, আমরা টাকা রোজগার করছি ঠিক মতন মার্কেট স্টাডি আর গুড প্ল্যানিং দিয়ে। আই অ্যাম প্রাউড টু বি আ মাড়োয়ারি।

আমি শংকরের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আপনাকে দেখে আমার অনেক ধারণা বদলে গেছে। আমি ওরকম একটা কথা বলে ফেলার জন্য দুঃখিত। খুবই দুঃখিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *