বাড়ির খবর – ৬

লালুদাকে একটা রিপোর্ট দেওয়া দরকার। যদি সেই সূত্রে আরও কিছু টাকা বাগানো যায়। দেবীগড় বেড়াতে গেলে তো কিছু লাগবেই।

লালুদার বাড়ি আমি চিনি না।

কোন্ কোন্ পরিবারে লালুদা দুপুরবেলা টহল দেয় সে খোঁজ রাখাও সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তবে ছুটির দিন তাকে পাওয়া যায় টালি ক্লাবে। সেখানে একলা গেলে আমাকে ঢুকতেই দেবে না বোধহয়। নীপাবৌদির কাছে রোজ সন্ধেবেলা লালুদা একবার যাবেই, সুতরাং সেখানে ওকে ধরাই সুবিধেজনক।

কিন্তু অন্যদের সামনে তো বলা যাবে না, মুমুর বিষয়ে জানানোর জন্য খানিকটা আড়ালের সুযোগ খুঁজতে হবে।

শুনেছি, কিছু কিছু ডাক্তার, উকিল ইচ্ছে করে এক একটা কেস বেশ কিছুদিন জিইয়ে রাখে। তেমন শাঁসালো মক্কেল হলে যত বেশি টাকা আদায় করা যায়। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কিংবা স্পাইরাও সে-রকম কিছু করে কি না, সে বিষয়ে কিছু শুনিনি বটে, কিন্তু অসম্ভবও কিছু নয় বোধ হয়। আমাকেও সেই টেকনিক নিতে হবে।

প্রথমে মুমু সম্পর্কে একটা ভয়াবহ ছবি আঁকতে হবে লালুদার কাছে উচ্ছন্নের পথে যাচ্ছে মুমু। স্কুল পালিয়ে সিনেমায় নামার চেষ্টা করছে, এটা কেমন? না, ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সিনেমার লাইনের অনেক লোককেই লালুদা চেনে। অন্তত মুখে তো তাই বলে। সৌমিত্র চ্যাটার্জির সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবে আড্ডা হয়, অপর্ণা সেনের সঙ্গে পিকনিকে গেছে, রূপা গাঙ্গুলী লালুদা বলতে অজ্ঞান, এমনকি উত্তমকুমারও নাকি ওর কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতেন।

সিনেমা দরকার নেই। অবৈধ প্রেম! নিষ্পাপ, সরল কিশোরীকে প্রলুব্ধ করছে এক লম্পট প্রৌঢ়। মাকড়সার মতন সে জাল বিস্তার করেছে। তার পরিচয়টা এখনো পুরো জানা যায়নি, কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধ পতঙ্গের মতন মুমু ধরা পড়তে যাচ্ছে সেই জালে। তাকে উদ্ধার করতে হবে।

কিংবা ড্রাগ্‌স। শুনলেই যে-কেউ বিশ্বাস করবে। সর্বনাশা নেশার মোহ ম্যানড্রাক্স, হেরোইন! এক সহপাঠিনীর দাদা সেই দুষ্টচক্রের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে মুমুকে। এখনো সময় আছে তাকে ফেরাবার। কিন্তু তাড়াহুড়ো করাটা ঠিক হবে না। জেদি মেয়ে, তা হলে বেঁকে বসবে। আস্তে আস্তে তাকে নিয়ে যেতে হবে ঠিক পথে।

আসলে কিন্তু মুমুদের ক্লাবটা আমার ভালোই লেগেছে। আপাতত নিৰ্দোষই তো মনে হয়। ধর্মের সঙ্গে কিছুটা প্রেম প্রেম খেলা মিশিয়ে দেওয়া, সেটা এক বয়েসের ছেলেমেয়েদের ভালো লাগতেই পারে।

প্রিসিলা মনে হয় খানিকটা পাগলী আর খানিকটা ম্যাজিক জানে। আধো—অন্ধকার ঘরের সব কটা দেওয়ালে আয়না ফিট করে নানা রকম ভেল্কি দেখায়। সেগুলো মন্দ কী! আমি তো বেশ উপভোগই করছিলাম। মুখোমুখি দু’ দিকের দেওয়ালে আয়না থাকলে একটা দরজাকেই অসংখ্য দরজা বলে মনে হয়, সেটা পরে বুঝেছি। প্রিসিলার কাছে আমার অজ্ঞাত তৃতীয় প্রশ্নটার উত্তর শোনা হলো না। তার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, না অজ্ঞান হয়ে গেলাম? শরবতটাতে কিছু একটা মেশানো ছিল। অন্তত তৃতীয় গেলাসে। যা-ই মেশানো থাক, ক্ষতিকর কিছু নয়।

ঘণ্টা তিনেক আমি ঘুমিয়েছিলাম মাত্র। চোখ মেলে প্রথমটায় বুঝতেই পারিনি, কোথায়, কী অবস্থায় শুয়ে আছি। একটা সুন্দর ঘর, ধপধপে বিছানা। সামনের দেওয়ালেই একটা ঘড়ি, তাতে ন’টা বাজে।

আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই একজন উর্দি পরা বেয়ারা এসে ঢুকল। বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনার কিছু লাগবে স্যার?

ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই সব মনে পড়ল। প্রিসিলা নামে বিলিতি গুরুমা টাইপের এক মহিলা আমার অবচেতন থেকে প্রশ্ন বার করে উত্তর দিচ্ছিল।

ফ্ল্যাটটা একেবারে নিস্তব্ধ।

আমি সেই বেয়ারাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, সব লোকজন গেল কোথায়? সে বলল, কেউ তো নেই স্যার! মেম্বাররা সব চলে গেছে। সাতটার সময় ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়!

এমন ভাবে আমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত হয়নি। সবাই চলে গেছে, আমাকে কেউ এই বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছে। আমার বেশ লজ্জা ও অনুতাপ হলো। প্রিসিলার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, উনি কোথায়? মানে, প্রিসিলা দেবী!

—রানীজী? উনিও তো চলে গেছেন।

—কখন ফিরবেন?

-আজ তো আর ফিরবেন না স্যার। রানীজী এখানে তো থাকেন না।

—উনি এখানে থাকেন না? তা হলে কে থাকে!

—এটা তো ক্লাব, স্যার। এখানে কেউ থাকে না। রাত্তিরে থাকে না।

এই রকম পাড়ায়, এত বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট শুধু ক্লাব! এ রকম অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়াই অন্তত হাজার চারেক টাকা। খুব বড়লোকদের ক্লাব বলতে হবে!

আমি উঠে দাঁড়িয়ে দু’ পা হাঁটলাম। মাথা টলমল করছে না, পা দুর্বল নয়, সবই ঠিক আছে। শরবতটায় মদ কিংবা কোনো ড্রাগ মেশানো ছিল বলে মনে হয় না। হয়তো ছিল হাল্কা ঘুমের ওষুধ। কিংবা ট্র্যাংকুইলাইজার। তাতে ম্যাজিক দেখতে সুবিধে হয়।

ম্যাজিক জিনিসটা বেশ ভালো, আমি বেশ উপভোগ করি। ম্যাজিককে অন্য কিছু না ভেবে ম্যাজিক হিসেবে ধরলেই আর কোনো অসুবিধে নেই।

ক্লাবের সব মেম্বার চলে গেছে, এই বেয়ারাটি আমাকে দেখাশোনার জন্য বসে ছিল। একে কিছু বখশিস দেওয়া উচিত।

এই সব বড়লোকদের জায়গায় কত বখশিস দিতে হয়? দু’টাকা, তিন টাকা কি নেবে? অবজ্ঞায় ঠোঁট ওল্টাবে। পাঁচ টাকা? আজকাল পাঁচ টাকায় এক প্যাকেট মাঝারি সিগারেটও হয় না।

নাঃ, একটা দশ টাকার নোটই বার করলাম পকেট থেকে, যদিও গা’টা খুব কচকচ করছে! আমার পক্ষে দশ টাকা অনেক।

বেয়ারাটি জিভ কেটে বলল, না, না, স্যার, ওসব কিছু লাগবে না!

আমি তাজ্জব! কোনো বেয়ারা দশ টাকা নিতে অস্বীকার করতে পারে, এ আমার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে! আরও বেশি চায় নাকি? না, দশ টাকার বেশি কোনোক্রমেই দেওয়া যেতে পারে না।

আমি বললাম, নাও, নাও না! একটু চা-মিষ্টি খাবে।

বেয়ারাটি এবার বেশ দৃঢ় স্বরে বলল, না, স্যার। কোনো মেম্বারের কাছ থেকে টাকা নেওয়া আমাদের নিষেধ। আমরা কক্ষনো নিই না।

তবু আমি বললাম, নাও, নাও, কিচ্ছু হবে না।

বেয়ারাটি এবারও মাথা ঝাঁকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। এখানে আর কোনো লোক নেই, কেউ দেখবে না, তবু সে দশ টাকা নিতে চাইছে না। এর সততা প্রায় অবিশ্বাস্য পর্যায়ের।

যাক, আমার দশ টাকা বেঁচে গেল। এই টাকায় ট্যাক্সি চাপা যেতে পারে। কিন্তু এর পরেও আর একটি চমক।

বেয়ারাটি বলল, আপনি এখন যাবেন স্যার? আপনার জন্য গাড়ি মজুত আছে। আমি প্রচণ্ড চমকে উঠে বললাম, গাড়ি? কার গাড়ি?

সে বলল, শংকর সাহেব আপনার জন্য গাড়ি রেখে দিয়েছেন। আপনি যখন যাবেন, আপনাকে গাড়ি পৌঁছে দেবে।

—কোথায় পৌঁছে দেবে?

—যেখানে আপনি যাবেন। ড্রাইভার আছে, ওকে বললেই হবে।

—কেন, গাড়ি পাঠিয়েছেন কেন? আমার তো গাড়ির দরকার নেই।

—তা তো জানি না, স্যার। শংকর সাহেব বলে গেছেন, গাড়ি নীচে থাকবে। যত রাত হোক, আপনাকে পৌঁছে দেবে। চলুন, আপনাকে আমি নীচে নিয়ে যাচ্ছি, গাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছি!

তার সঙ্গে আমি এলাম লিফটের দরজার কাছে। এখন লিফ্‌টম্যান আছে। মাঝ পথে থামতে থামতে লিফ্‌ট নেমে এল একতলায়। এ বাড়ির কম্পাউণ্ডের মধ্যেই একটা সাদা রঙের ফিয়াট গাড়ির দরজা খুলে ঘুমোচ্ছে ড্রাইভার। বেয়ারাটি কাছে গিয়ে বলল, ড্রাইভার সাব, উঠিয়ে!

ড্রাইভার তড়াক করে নেমে এসেই আমাকে একটা স্যালুট দিল। তারপর পেছনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল।

গাড়িটা একেবারে ঝকঝকে নতুন। সব জানলার কাচ বন্ধ। স্টার্ট দেবার আগে একটা শোঁ শোঁ শব্দ শুরু হলো। এয়ারকণ্ডিশান্ত!

আমার মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। এসব কী হচ্ছে? আমার মতন একজন এলেবেলে লোকের জন্য এত খাতির?

শংকর জৈন একবার বলেছিল বটে, আমাকে আর মুমুকে সে বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমাকে প্রিসিলা ডাকবার পর মুমু আর অপেক্ষা করেনি। সেটা সে ঠিকই করেছে। তার অনেক দেরি হয়ে যেত।

শংকর আমাকেও পৌঁছে দেবে বলেছিল বলে পরে সে আবার গাড়ি পাঠিয়ে এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে? হতে পারে সে বড়লোক, তার আরও গাড়ি আছে। কিন্তু ক’জন বড়লোক এতটা ভদ্রতা করে?

আমার মানুষ চিনতে সচরাচর ভুল হয় না। এক নজর দেখেই মনে হয়েছিল, ছেলেটি অসাধারণ।

সেদিনের পর মুমুর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মুমুদের বাড়ি যাওয়ার সেটাও আর একটা বড় কারণ।

সুইন হো স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চন্দনদা’রা যোধপুর পার্কে নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। একটা আকাশচুম্বী বাড়ি নয়, পাঁচতলা, সবচেয়ে ওপর তলায় ওদেরটা। এ বাড়িতে এখনো লিফ্ট বসেনি।

যোধপুর পার্কে বাড়ি খুঁজে পেতে আমার প্রত্যেকবার গোলমাল হয়ে যায়। সব রাস্তাই মনে হয় এক রকম। তার ওপর আবার পুরো লোডশেডিং, আকাশে তারার আলোও নেই।

তিন-চারবার ঘুরপাক খাবার পর বুঝতে পারলাম, আমি চন্দনদাদের বাড়ির সামনে দিয়েই ঘুরে গেছি দু’বার। এবার সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় উঠলে বেশ ভালো ব্যায়াম হবে।

লোডশেডিং বলেই সদর দরজাটা বন্ধ।

দারোয়ান-টারোয়ান কারোর পাত্তা নেই। কলিং বেল বাজবে না। উপায়ান্তর না দেখে দরজায় ঠকাঠক শব্দ শুরু করে দিলাম।

সেই শব্দ পাঁচতলা পর্যন্ত পৌঁছোলো না। কিন্তু দোতলা, তিনতলার বারান্দা থেকে দু’জন নারী ও পুরুষ জিজ্ঞেস করল, কে? কে?

আমি কী পরিচয় দেব?

অচেনা লোকদের কাছে আমার নামটার কোনো মূল্যই নেই। যদিও কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কে? আমার একমাত্র উত্তর দিতে ইচ্ছে করে, আমি! আমি! হতাশ পথিক, সে যে আমি, সে-ই আমি!

চেঁচিয়ে বললাম, আমি পাঁচতলায় যাব।

সঙ্গে সঙ্গে দোতলা ও তিনতলার কৌতূহল ও আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেল। পাঁচতলার অতিথির জন্য তারা দরজা খুলতে যাবে কেন? তারা ঢুকে গেল ভেতরে।

এবার উপায়? আরও গলা চড়িয়ে ডাকলাম, চন্দনদা! চন্দনদা!

কেউ সাড়া দিল না। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই নিশ্চয়ই ওরা জানলা বন্ধ করে রেখেছে।

একটু পরে হঠাৎ সদর দরজাটা খুলে গেল। দু’জন লোক বেরিয়ে এল কথা বলতে বলতে। তাদের গলার আওয়াজ আমার অপরিচিত। যাই হোক, সেই সুযোগে আমি ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

সিঁড়িটা কোথায় তা আমার মোটামুটি আন্দাজ আছে, কিন্তু একবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।

পকেটে সিগারেট আছে, দেশলাই নেই। এখন একটা দেশলাই থাকলে কত কাজে লাগত। একটু আগে দেশলাই ফুরিয়ে গিয়েছিল, কিনতে গিয়েও ভাবলাম, চন্দনদা চুরুট খায়, ওর বাড়িতে দেশলাই কিংবা লাইটার পাওয়া যাবে। এই সব ছোটখাটো কৃপণতার জন্য যে সময়ে সময়ে কত অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়, তা বারবার ঠেকেও শেখা হলো না।

পা টিপে টিপে উঠতে লাগলাম। দোতলা, তিনতলা। কোনো কোনো ফ্ল্যাটে বন্ধ দরজার তলা দিয়ে কিছুটা আলো আসছে। ওদের ইনভার্টার আছে। লোডশেডিং-এর জন্যই কেউ দরজা খুলে রাখেনি। না, ভুল হলো, এই সব বাড়িতে কেউ কখনো দরজা হাট করে খুলে রাখে না। এই সব বাড়িতে খালি পায়ে হাঁটে না কেউ।

চারতলা পর্যন্ত উঠতে না উঠতেই একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেল।

প্রথমে মনে হলো, ওপর থেকে ছুটে আসা একটা হাতি কিংবা গণ্ডার আমাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।

পরের মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, একজন মানুষ, একটা সিঁড়ি মিস করে তাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়েছে আমার গায়ে, সেই ধাক্কায় আমার ছিটকে পড়ার কথা ছিল, কিন্ত আমি কোনোক্রমে রেলিং ধরে সামলে নিলাম।

সেই মানুষটা গড়াতে গড়াতে পড়তে লাগল নীচে। সেই অবস্থায় চ্যাঁচাতে লাগল, ওর বাবারে, মরে গেলাম! মরে গেলাম!

আমার সর্বঅঙ্গে শিহরণ হলো। এতো লালুদা! কাকতালীয়। মুমু আমায় অনুরোধ করেছিল লালুদাকে সিঁড়িতে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিতে। আমি কিছুই করিনি। লালুদাই আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, তারপর নিজে গড়াচ্ছে।

পাঁচতলার একটা দরজা খুলে গেল। জ্বলে উঠল একটা টর্চ। নীপা বৌদির গলা শোনা গেল, কী হলো? কেউ পড়ে গেল নাকি? লালুদা! লালুদা!

এর উত্তর শোনা গেল, ওঁ! ওঁ! মরে গেছি! নীপা, মরে গেছি! ততক্ষণে আমি চট করে সরে গেছি চারতলার ল্যাণ্ডিং-এ। অন্য একটা ফ্ল্যাটের পাশের দেয়ালে ছবির মতন সেঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম।

ধরা পড়লেই জানি আমার ওপর সব দোষ পড়বে। যত অহিত, নীললোহিত! লালুদা বলবে, ঐ নীলুই তো আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। মুমু হি হি করে হেসে উঠে যদি হাততালি দেয়, তা হলে তো সোনায় সোহাগা!

নীপা বৌদি কয়েক পা নেমে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, লালুদা? তখন বললাম তোমাকে টর্চটা নিতে, তুমি জেদ করে নিলে না!

লালুদা কাতর গলায় বলল, নীপা! কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার। ডিসলোকেশান! উঠতে পারছি না।

নীপা বৌদি খানিকটা উষ্মার সঙ্গে বলল, তোমাকে বললুম একটু পরে যেতে, কিংবা টর্চটা নিতে। তুমি শুনলে না!

লালুদা বলল, ডাক্তার! শিগগির ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। না হলে বাঁচব না!

এবার পাঁচতলার দরজার কাছে বেরিয়ে এসে মুমু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?

নীপা বৌদি বলল, তোর লালুমামা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। পায়ে খুব লেগেছে। মনে হচ্ছে কোনো ডাক্তারকে একবার দেখাতে হবে। মহা মুশকিল। লালুদা, তুমি গাড়ি চালাতে পারবে?

লালুদা আর্ত গলায় বলল, না, না, না, না, না। পায়ের হাড় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উঠতে পারছি না!

মুমু দুমদাম করে নীচে নেমে এল।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম।

নীপা বৌদি বলল, মুমু, তুই এক কাজ কর। দরজা বন্ধ করে থাক। ভয় করবে না তো? আমি লালুদার গাড়িটা চালিয়ে ডক্টর মল্লিকের কাছে যাচ্ছি তারপর দেখা যাক কী করা যায়। বেশি দেরি হলে তোকে ফোন করব। তুই সাবধানে থাকতে পারবি তো?

মুমু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি চিন্তা করো না।

লালুদা উঃ আঃ মাগো, মরে গেলাম বলতে বলতে নীপা বৌদির কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়াল। মুমু টর্চ জ্বেলে ওদের পৌঁছে দিয়ে এল একতলা পর্যন্ত।

সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দ পেলাম।

মুমু আবার উঠে আসছে। চারতলা পর্যন্ত উঠতেই আমি আমার গুপ্ত স্থান ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়লাম। ওকে খানিকটা চমকে দেবার জন্য হঠাৎ ডাকলাম, এই মুমু!

চমকে উঠল ঠিকই, কিন্তু ভয় পেল না। টর্চের আলো আমার মুখে ফেলে মুমু বলল, ব্লু? তুমি? তুমি এখানে কী করে এলে?

বললাম, আমি তো আগেই এসেছি রে। লালুদার সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগে গেল সিঁড়িতে…

মুমু নাচ শুরু করতে যাচ্ছিল, আমি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললাম, চুপ! কেউ যেন জানতে না পারে!

মুমু তবু ছুটে এসে আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, নীল আংকল, তুমি কী ভালো! তুমি আমার কথা রেখেছ। ও ব্যাটার উচিত শাস্তি হয়েছে, পা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আর কোনোদিন গাড়ি চালাতে পারবে না। ওঃ, তুমি জানো না! হোয়াট আ গ্রেট বোর! রোজ সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িতে এসে বসে থাকে!

মুমুর সঙ্গে ওদের ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, চন্দনদা কোথায়?

মুমু ঠোঁট উল্টে বলল, এখনো ফেরেনি। কোনোদিনই তো দশটার আগে ফেরে না!

এ সংসারের অতি বৃদ্ধা রাঁধুনিও ছুটি নিয়ে দেশে গেছে।

আমার তো আসার কোনো ঠিক ছিল না, মেয়েটাকে একা রেখে নীপা বৌদি চলে গেল। কী-ই বা করবে, লালুদার পা ভেঙে গেলে গাড়িটা পড়ে থাকবে এখানেই। নীপা বৌদি গাড়ি চালাতে জানে। তা ছাড়া, এই সময়ে লালুদাকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া একটা মানবিক কর্তব্য।

কিন্তু দিনের পর দিন নীপা বৌদি লালুদাকে সহ্য করে কী করে?

চন্দনদাই বা কেন রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না? অফিসের কাজ-টাজ বাজে কথা। চন্দনদা তাস খেলা জানে না, বাইরে বিশেষ মদ-টদও খায় না। কানাঘুসো শুনেছি, চন্দনদা সেই রোহিণী নামে পর্বত-আরোহিণী মেয়েটির কাছে প্রায়ই আবার যাওয়া-আসা শুরু করেছে।

রোহিণী নাম্নী মেয়েটিকে আমি খুবই পছন্দ করি, শ্রদ্ধা করি। হয়তো গোপনে ভালোও বাসি। কিন্তু তার কাছে যেতে সাহস পাই না।

সে একটি অসাধারণ মহিলা। তার চোখের দিকে তাকালেই যেন দেখতে পাওয়া যায় পাহাড়ের বিস্তার, অরণ্যের গভীরতা।

পর্বতারোহণের সময়েই একবার তার ডাক্তার স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তা নিয়ে রোহিণী প্রকাশ্যে একবারও হা-হুতাশ করে না, আবার অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে এ পর্যন্ত তাকে ঘনিষ্ঠতাও করতে দেখিনি। বরং একটু আলগা আলগা দূরত্ব রাখে।

আমি রোহিণীর কাছে যাই না। কারণ আমি জানি, আমি একেবারেই তার যোগ্য নই। চন্দনদাই বা তার যোগ্য কোন হিসেবে? চন্দনদা একজন সাধারণ উচ্চপদস্থ চাকুরে ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তবু কেন রোহিণী চন্দনদাকে প্রশ্রয় দেয়?

কিংবা হয়তো প্রশ্রয় দেয় না, নেহাতই ভদ্রতার খাতিরে মেনে নিয়েছে।

মুমুদের ফ্ল্যাটে একটা ইনভার্টার লাগানো হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা আজই বেগড়বাঁই করছে। সেই জিনিসটাকে অবিলম্বে সারাবার জন্য লোক ডেকে আনতে যেতেই লালুদা সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেল। পরোপকারের তাড়াহুড়ো।

দুটো মোমবাতি জ্বলছে। আমি মুমুকে বললাম, তুই তো লেখাপড়া করবি। এখন আমি তা হলে আর বসব না!

মুমু আমার চুল ধরে টেনে বলল, ইস! আমাকে একা ফেলে পালাবে! চুপটি করে বসো এখানে।

অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। প্যাকেটটা বার করে দেশলাই চাইতে যেতেই একটা মোমের দিকে চোখ পড়ল। মোমের আগুন থাকতে দেশলাই কাঠি খরচ করার কোনো মানে হয় না।

মুমু চোখ নাচিয়ে বলল, এই ব্লু, আমাকে একটা সিগারেট দেবে? বাড়িতে তো কেউ নেই।

আমি তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের ক্লাশের অন্য মেয়েরাও সিগারেট খায় বুঝি?

মুমু দু’ দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, কেউ না!

—তবে?

-তবে আবার কি? আমি কি অন্যদের মতন নাকি? আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করব। বেশ করব সিগারেট খাব!

–তোর যা ইচ্ছে করতে পারিস। কিন্তু আমি তাতে সাহায্য করব, তার কি কোনো মানে আছে? আমি সিগারেট দেব না।

—মরালিস্ট! পাজি! ছেলেরা সিগারেট খাবে, মেয়েরা খাবে না কেন?

—ছেলে-মেয়ের প্রশ্ন নয়। রাস্তায় কোনো কমবয়েসী ছেলেকেও সিগারেট খেতে দেখলে আমার বিচ্ছিরি লাগে। সিগারেট ধরার আঙুলের একটা বয়েস আছে। কচি আঙুলে একদম মানায় না। তা ছাড়া আজকাল সিগারেটের বিরুদ্ধে এত সব লেখালিখি হচ্ছে, যাদের সিগারেটের নেশা এখনও ধরেনি,তাদের একদম না খাওয়াই তো ভালো।

আমার মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল মুমু। তারপর ফিক করে হেসে ফেলল।

–এর মধ্যে হাসির কথাটা আবার কী হলো?

—জানো ব্লু, তোমাকে দেখলেই আমার রাগাতে ইচ্ছে করে। বকুনি দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ, আজ এত ভালো লাগছে তোমাকে, তুমি লক্ষ্মী ছেলের মতন আমার কথা শুনেছ। লালুমামা কি বুঝতে পেরেছে? দেখতে পেয়েছে তোমাকে?

যে কাজ আমি করিনি, তার কৃতিত্বও আমার নেওয়া উচিত নয়।

কিন্তু এখন আমি অস্বীকার করলেও মুমু বিশ্বাস করবে না। আমার গায়ে ছোঁয়া লাগার আগেই লালুদা একটা সিঁড়ি হড়কে গেছে। লালুদাই আমার গায়ে ধাক্কা দিয়েছে, গড়িয়ে পড়ে গিয়ে পা-ভাঙার কথা ছিল আমার

আমি বললাম, না, কেউ দেখতে পায়নি। খবর্দার, তুই বলিসনি যেন!—তোমাকে আমি প্রাইজ দেব। তুমি চুরুট খাও? বাবা খুব ভালো চুরুট এনেছে কাল—বিলিতি, তার থেকে তোমাকে দিতে পারি।

–না, দিতে হবে না। আমি চুরুট খেতে পারি না।

–তা হলে, চকোলেট খাবে? এই যা, চকোলেট তো নেই। তোমাকে শরবত বানিয়ে দিতে পারি।

–তোদের ক্লাবের পিংক রঙের শরবতটা কী দারুণ ছিল রে। ওরকম কখনো খাইনি!

—ওটা প্রিসিলার স্পেশাল। ওরকম আর কোথাও পাওয়া যায় না।

—তোদের ক্লাবটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তুই কি প্রত্যেক দিন স্কুলের পর ওখানে যাস?

–না, প্রত্যেক দিন যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে!

–তোদের ক্লাবে আমাকে মেম্বার করবে? কত করে চাঁদা?

—চাঁদা তো লাগে না! চাঁদা দিতে হবে কেন?

—সে কি রে, খরচ চলে কী করে? অমন দুর্দান্ত একটা সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট, তার ভাড়াই তো অনেক।

—ওটা তো শংকরের বাবা দিয়েছে। পয়সা লাগে না। তা ছাড়া প্রিসিলারও অনেক টাকা। মাঝে মাঝে আমাদের সুন্দর সুন্দর জিনিস উপহার দেয়।

—প্রিসিলাই ক্লাবটা চালায়? ওর আর এক নাম রানীজী?

—এটা হচ্ছে কুইন্‌স ক্লাব। প্রিসিলা পার্মানেন্ট কুইন। তা ছাড়া প্রত্যেকদিন লটারিতে একজন করে কুইন হয়। তখন সেই কুইনের কথা সবাইকে শুনতে হবে। এমনকি প্রিসিলাও শুনবে।

—তুই কুইন হয়েছিস?

–কেন হবো না? আমি অবশ্য ক্লাবটায় নতুন যাচ্ছি। এর মধ্যে দু’বার কুই হয়েছি।

—প্রত্যেক কুইনের তো একটা করে নাম থাকে মনে হলো। তুই কোন্ রান হয়েছিলি?

–তোমাকে বলব কেন? আমাদের ক্লাবের কথা বাইরে বলা নিষেধ তোমাকে সেদিন নিয়ে গেছি, তুমি কিন্তু বাইরের কারুক্কে জানাবে না প্রমি করেছ! তুমি মেম্বার হতে পারবে না, এখন আর নতুন মেম্বার নেওয়া হচ্ছে না তুমি আমার গেস্ট হিসেবে মাঝে মাঝে যেতে পার। তুমি সেদিন ঘুমিয়ে পড়ে কেন?

—কী জানি! হঠাৎ চোখ বুজে এল। আচ্ছা, ঐ শরবতটা খেয়ে তোর কখনে ঘুম পায়নি?

—না তো! প্রথম দিনই প্রিসিলা তোমাকে ডাকল, এটা খুব রেয়ার ঘটনা নতুন মেম্বাররা বেশ কয়েকদিন প্রিসিলার সঙ্গে কথা বলার চান্সই পায় না।

—জানিস মুমু, তোদের ঐ যে শংকর, সে আমার জন্য একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল, যাতে বেশি রাত্তির হলেও আমার বাড়ি ফিরতে কোনো অসুবিধে ন হয়। ছেলেটা কী অসাধারণ ভদ্র!

—শংকর সত্যিই অসাধারণ। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট, তা জানো তো’ ইকোনমিকসে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। লণ্ডন থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে এসেছে। এখন আবার কী যেন পড়ছে। ওরা যে অত বড়লোক, তা ওর ব্যবহার দেখলে কোনো দিন বোঝা যাবে না।

—ইস, মুমু, তুই যদি আর একটু বড় হতিস, তা হলে তোর সঙ্গে শংকরের বিয়ে হলে বেশ হতো! শংকর শান্ত-শিষ্ট আর তুই একটা মেয়েডাকাত, তোদের মিল হতো বেশ ভালো।

—ভ্যাট, বাজে কথা বলবে না, আমি কোনোদিনই বিয়ে করব না! শংকরের সঙ্গে তো লরা’র বিয়ে হবে। এই যাঃ, তোমাকে বলে ফেললাম। এটা খুব সিক্রেট লরা শুধু আমাকে বলেছে, কেউ জানতে পারলেই গোলমাল হয়ে যাবে।

-কেন গোলমাল হবে কেন?

—চুপ! ঐ বিষয়ে নট অ্যানাদার ওয়ার্ড। তোমার এত কৌতূহল কেন, ব্লুি—শংকর সম্বন্ধে সত্যিই আমার খুব কৌতূহল হয়েছে। যাক গে যাক, আর শুনতে চাই না। শংকরের সঙ্গে তোর আবার দেখা হলে আমার হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে দিস। আচ্ছা, ঐ লরা মেয়েটা কি বাঙালি?

–লরার মা বাঙালি, বাবা পাঞ্জাবি। ওরা অনেকদিন ইটালিতে, রোমে ছিল

—বাবা পাঞ্জাবি? আমি ভেবেছিলাম, মেয়েটা বুঝি বৌদ্ধ। আমাকে দেখে ‘ওম মণিপদ্মে হুম’ বলেছিল।

—বুটিস্ট কেন হতে যাবে। আমাদের ক্লাবে অনেকেই নানা রকম গ্রীটিংস জানায়। তুমি গুটেন মংগার জানো? খারাসো জানো? বঁ ঝুর জানো?

মুমুর কাছে আমার বিদ্যে ধরা পড়ার আগেই দরজায় খট খট হলো।

মুমু উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কে?

বাইরের থেকে নীপা বৌদির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, মুমু, খুলে দে! দরজা খোলার পর শুধু নীপা বৌদি নয়, সঙ্গে দেখা গেল লালুদা এবং অন্য একজন অচেনা লোককে।

আমি দারুণ চমকে উঠলাম। লালুদা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো ব্যাণ্ডেজ ট্যাণ্ডেজ নেই, মুখে কাঁঠালি কলা-মার্কা হাসি।

মুমু বলল, একী?

লালুদা বলল, কিছু হয়নি, বুঝলে। খুব জোর বেঁচে গেছি। অন্ধকারে সিঁড়িতে কে যেন আমাকে ধাক্কা মারলে, তাকে দেখতে পেলাম না, ঠিক ভূতের মতন, ভূত নিশ্চয়ই নয়, কোনো একটা গাঁইয়া, আমি তো ভেবেছিলাম কম্পাউণ্ড ফ্ল্যাকচার হয়েছে, হাড়-ফাড় সব গুড়িয়ে গেছে, কিন্তু ডাক্তার মল্লিক দেখে বলল, কিছু হয়নি, হাঁটুন তো, হাঁটুন। জোর করে আমাকে হাঁটালো, আমি দেখলাম, ওমা, সব ঠিকঠাকই তো আছে। একটু মচকেছে বোধহয়, একটু একটু ব্যথা আছে।

মুমু আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালো।

নীপা বৌদি বলল, ওমা, নীলু, তুমি কখন এলে?

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এই তো মিনিট পাঁচেক আগে, চন্দনদার সঙ্গে একটা দরকার ছিল, এসে দেখি মুমু একা রয়েছে। তাই বসে গেলাম।

নীপা বৌদি বলল, বেশ করেছ। মুমু এই অন্ধকারের মধ্যে একা ছিল, তাই আমার চিন্তা হচ্ছিল খুব—বসো, বসো নীলু, আমি চা করছি।

লালুদা বলল, আমি মিস্তিরি নিয়েও এসেছি। ইনভারটারটা সারিয়ে ফেলবে। আর কোনো চিন্তা নেই। সবই ঠিকঠাক হয়ে গেল বেশ।

এই সময় আলোও জ্বলে উঠল।

লালুদা আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে একটা ইঙ্গিত করতেই আমিও ভুরু নাচিয়ে উত্তর দিলাম।

চায়ের সঙ্গে পাঁপড় ভাজা খাওয়া হলো। রাত সাড়ে নটার মধ্যেও চন্দনদার পাত্তা নেই। লালুদা আরও কতকক্ষণ এখানে থাকতে চায় কে জানে!

লালুদা রোজ সন্ধেবেলা এখানে এসে বসে থাকে বলেই চন্দনদা ইচ্ছে করে বাড়ি ফেরে না। রোহিণীর কাছে চলে যায়? কিংবা চন্দনদা সন্ধের সময় বাড়িতে থাকে না বলেই নীপা বৌদি লালুদাকে প্রশ্রয় দেয়? একজন কারুকে তো চাই কথা বলার জন্য। এই ধাঁধাটার উত্তর বোধগম্য হলো না আমার।

এবার আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চন্দনদার সঙ্গে দেখা হলো না। আমি চলি।

সঙ্গে সঙ্গে লালুদাও বলল, চলো, আমিও যাব। তোমাকে পৌঁছে দেব খানিকটা।

সিঁড়িতে এখন আলো জ্বলছে। পাশাপাশি নামতে অসুবিধে নেই। ওপরের দরজার কাছে মুমু দাঁড়িয়ে আছে, আমি আর তাকালাম না পেছন দিকে।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার পরই লালুদা বলল, কিছু খবর পেলে? দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। মুমু প্রায়ই ইস্কুল ছুটির অন্তত দু’ ঘণ্টা পরে বাড়িতে ফেরে।

আমি বললাম, হুঁ!

—মুমু আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না।

—হুঁ!

—নীপার সঙ্গেও সব সময় ঝগড়া-ঝগড়ার সুরে কথা বলে! এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। যারা ড্রাগ্‌স খায়, তাদেরই মেজাজ এরকম খিটখিটে হয়।

—হুঁ!

—বারবার হুঁ হুঁ করছ কি? তোমাকে যে কাজে লাগিয়েছি, তার কি রেজাল্ট পেলে বলো!

–কেস খুব সীরিয়াস লালুদা!

—অ্যাঁ? তুমি কী জেনেছ?

—এই শহরে একটা অতি ঘোড়েল লোক আছে। সেই লোকটা অল্পবয়েসী মেয়েদের সিনেমায় নামাবার লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে টানে। সিনেমার সঙ্গে তার কোনো কানেকশান নেই, এমনিই ফল্স হোপ দেয়। তারপর তাদের ড্রাগের নেশা ধরায় আস্তে আস্তে। একবার নেশা ধরাতে পারলে সেই মেয়েদের নিয়ে যা ইচ্ছে করা যায়।

—কী বলছ তুমি, নীলু? এরকম সাঙ্ঘাতিক লোক…মুমু তার পাল্লায় পড়েছে। নীপা জানতে পারলে…ওদের সংসারটা তছনছ হয়ে যাবে। কে, কে, লোকটা কে, আমি তাকে পুলিশে ধরাবো। পুলিশ কমিশনার আমার বিশেষ চেনা। দু’জন মন্ত্রীকে আমি চিনি।

—নামটা এখনো জানতে পারিনি!

–নাম জানো না? তবে এসব কী করে জানলে?

—লোকটা এতই ধুরন্ধর যে নিজের আসল নামটা গোপন রাখে। এক এক জায়গায় এক এক রকম নাম বলে। মুমুর থেকে তিন-চার বছরের বড় একটা মেয়ের কাছ থেকে আমি ঐ লোকটার কীর্তিকলাপ অনেকটা জেনেছি। ভালো ভালো ফ্যামিলির মেয়েরা ওর জালে জড়িয়ে পড়েছে। আমি নিয়মিত মুমুকে ফলো করছি।

—বাড়িটা চিনতে পারবে তো? কোন বাড়িতে মুমু যায়?

—একটা অসুবিধে কী হচ্ছে জানেন, লালুদা? মুমুর ক্লাশের একটা মেয়ের জন্য বাড়ি থেকে গাড়ি আসে, সেই গাড়ি করে ওরা হুস করে চলে যায়। আমি ট্রামে-বাসে গিয়ে ওদের ধরতে পারি না।

—ট্যাক্সি, ট্যাক্সি করে ফলো করতে পারনি?

—সব সময় কাছাকাছি ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। কিংবা পকেটে তত পয়সাও থাকে না।

–আঃ হা, তোমাকে বলেছি না পয়সা-কড়ির দরকার হলে আমাকে বলবে! আগে থেকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে ট্যাক্সি। যে-কোনো উপায়ে মুমুকে ফেরাতেই হবে ওখান থেকে।

–আর সাত দিন। আর ম্যাকসিমাম সাত দিনের মধ্যে আমি সব প্রবলেম সল্ভ করে ফেলব, লালুদা। আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন!

লালুদা পকেট থেকে মোটা ওয়ালেট বার করল। গুনতে লাগল পঞ্চাশ টাকার নোট।…চার-পাঁচ-ছয়, একটু থেমে সাতখানা তুলে বলল, সাত দিন সময় চাইছ তো? পার ডে পঞ্চাশ, এতে হয়ে যাবে না? মুমুকে ফলো করার সময় ট্যাক্সি নেবে, তারপর তুমি যখন নিজে ফিরবে, তখন বাসে চাপবে। ঠিক আছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লালুদা বলল, নীপার মনের শান্তি যাতে কোনোক্রমেই নষ্ট না হয়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। মেয়েটার এমনিতেই কত কষ্ট!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *