বাড়ির খবর – ৩

মুমুদের ইস্কুল ছুটি হবার সময় অন্তত দুশোটা গাড়ি সেখানে জড়ো হয়। সামনেই ট্রাম লাইন। তখন অত গাড়ি ট্রাম, মিনিবাস, রিক্সা সব মিলিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি জটলা। প্যাঁপোঁ করে একসঙ্গে অনেকগুলো হর্ন বাজে। হুড়হুড় করে নীল স্কার্ট পরা মেয়ের দঙ্গল বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে কোনো একজনকে খুঁজে বার করা বেশ শক্ত ব্যাপার।

আমি দারোয়ানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

অন্য দুটি মেয়ের সঙ্গে বেরিয়ে কথা বলতে বলতে মুমু একটা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম, এই মুমু তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। আমাকে হঠাৎ এ জায়গায় দেখে মুমু বেশ ঘাবড়ে গেল। শুকনো মুখে জিতে করল, কী? কী হয়েছে?

আমি বললাম, তোর কাকা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তোকে এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে একবার।

অন্য মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ওকে নিয়ে যাচ্ছি।

একটি মেয়ে বলল, আমরা পৌঁছে দেব? আপনিও গাড়িতে আসুন না! আমি বললাম, তার দরকার নেই। ট্যাক্সি ধরে রেখেছি!

মুমুর হাত ধরে নিয়ে চললাম মোড়ের দিকে

একটু বাদেই মুমু জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, মিথ্যে কথা—তাই না?

—মোটেই না।

–আমার আবার কাকা কে? আমার তো কোনো নিজের কাকা নেই!

—কাকা নেই, তার অসুখও হতে পারে না। সুতরাং এটা মিথ্যে কথা নয়। কাকা থাকলে তার অসুখের কথা বলাটা মিথ্যে হতো। এটা একটা কাল্পনিক ব্যাপার। কল্পনা আর মিথ্যে কি এক?

—কল্পনা মানে ইমাজিনেসন?

—কল্পনা মানে ইমাজিনেশন নয়! কল্পনার ইংরিজি ইমাজিনেশন। যেমন বাবা মানে ফাদার নয়! ইংরিজিতে বাবাকে বলে ফাদার।

—হচ্ছিল কাকার অসুখের কথা। তার মধ্যে আবার বাবা এল কী করে? বাবার কিছু হয়েছে?

—কিচ্ছু না। তোর বাবার সঙ্গে আমার বেশ কিছুদিন দেখাই হয়নি।

—তুমি কেন আমার বন্ধু অদিতিকে বললে, তোমার ট্যাক্সি দাঁড় করানো আছে। কোথায় ট্যাক্সি? এটা মিথ্যে বলোনি?

—এটাকেও ঠিক মিথ্যে বলা যায় না। একটা ট্যাক্সি স্টার্ট বন্ধ না করে ঘ রর ঘ-র-র আওয়াজ করে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, এটা আমি কল্পনা করেছি। এই কল্পনাকে অনায়াসে এক্ষুনি বাস্তব করা যায়।

—বাস্তব মানে?

—হায় রে, খুকি, এখনো বাস্তবের মানে জানিস না। থাক, যতদিন না জেনে থাকা যায় ততই ভালো। আর কয়েক বছর পরে তো ঠেকে শিখতেই হবে। কঠোর বাস্তবের মধ্যে পড়ে যেতে হবে!

—অ্যাই, ব্লু, তুমি আমাকে খুকি বলবে না। তুমি আমাকে ডেকে আনলে কেন, এবার সত্যি করে বলো তো?

—মুমু, তুই তো এখন বাড়ি ফিরছিলি না, বুঝতেই পারছি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাচ্ছিলি। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই বা কী করবি! তোর মা ছ’টার আগে ফিরতে পারে না। বাড়িতে রাঁধুনি বুড়িমা ছাড়া আর কেউ নেই। আজ চল না, আমার সঙ্গে একটু বেড়াবি!

–তোমার সঙ্গে কোথায় বেড়াব?

—আজ বেশ মেঘলা মেঘলা আছে। ময়দানে গিয়ে বসতে পারি, গঙ্গার ধারে গিয়ে নৌকোয় চড়তে পারি।

মুমু হঠাৎ হি হি হি হি করে জোর হেসে উঠল। ওর দু’ চোখে চকচক করছে দুষ্টুমি।

আমি বললাম, কী রে, তুই হাসছিস কেন!

মুমু মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল। তারপর ফিসফিস করে বলল, তুমি যে বলেছিলে, আমার আঠারো বছর বয়স না হলে চুমু খাওয়া চলবে না? আমার গায়ে যেন ইলেকট্রিক শক লাগল। একটি কিশোরী মেয়ের মুখে চুমু শব্দটা সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক শোনায়!

আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, এই মুমু, তোকে পাকা পাকা কথা বলতে বারণ করেছি না?

—বেশ করব বলব। তুমি কি আমার গার্জিয়ান? তুমি আমায় শাসন করবার কে? তোমাকে আমি এমনিই নীলকাকা বলি। তোমাকে আমি নাম ধরেও ডাকতে পারি। সত্যি করে বলো তো, তোমার মতলবটা কী? তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যেতে চাইছ?

—মুমু, আমি বুঝি তোর বন্ধু নই? আমরা একসঙ্গে ছোটপাহাড়ী যাইনি? পুরুলিয়া যাইনি? তুই একদিন বিকেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতে পারিস না?

—তুমি হঠাৎ আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চাইছ কেন, সেটা আগে জানতে চাই! তুমি এত বড় ছেলে, তোমার গার্ল ফ্রেণ্ড নেই?

—ছিল একজন। কিন্তু সে যে কোথায় গেল। আর আসে না। অনেকদিন তাকে দেখতে পাই না!

—আহারে, বেচারা ব্লু, কোনো মেয়ে তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে না তাই তুমি আমার কাছে এসেছ! তাই না? কোনো সুবিধে হবে না। কেটে পড়।

—তুই আমার সঙ্গে যাবি না, মুমু?

—না। আমি অদিতির সঙ্গে এক জায়গায় যাচ্ছিলুম, তুমি একটা বাজে কথা বলে আমাকে টেনে আনলে।

—যাবি না? আমার সঙ্গে যাবি না?

—না, না, না!

—ঠিক আছে। এই শেষ। তোর সঙ্গে আর কখনো আমার দেখা হবে না! মুমু আবার হি হি করে হেসে উঠল। তারপর আমার বুকে একটা আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বলল, খুব রাগ হয়েছে বাবুর। জানতুম। তোমাকে রাগানো খুব সোজা। বেড়াতে নিয়ে যাবে তো, কী খাওয়াবে তা বলছ না কেন? আগে সেটা বলো।

সত্যিই আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিতে একটু সময় লাগল। তারপর বললাম, আইসক্রিম, ফুচকা, চ্যাপটা ছোলা, চিকেন রোল, যা খেতে চাস।

—ট্যাংরার চীনে রেস্তোরাঁয় ফ্রায়েড প্রন খাওয়াতে পারবে?

–না, তা পারব না। কোনো স্কুলের মেয়েকে হোটেল-রেস্তোরায় নিয়ে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। তাও স্কুলের পোশাকটা পাল্টে যদি শাড়ি পরে নিস, তাহলে তোকে অনেকটা বড় দেখাবে।

—আহা-হা, স্কুলের মেয়েকে নিয়ে ময়দানে কিংবা গঙ্গার ধারে ঘোরা যায়, অথচ রেস্তোরাঁয় বসা যাবে না কেন? কী যে তোমাদের ব্যাপার বুঝি না। ঠিক আছে, আমি ময়দানে গিয়ে ফুচকা খাব। যত খুশি খাব, থামতে বলতে পারবে না।

—তাহলে চল, একটু এগিয়ে গিয়ে ট্যাক্সি ধরি।

—তুমি তো চাকরি করো না। ট্যাক্সি চড়ার টাকা কোথায় পেলে?

—তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। মাঝে মাঝে পার্ট টাইম কাজ পেয়ে যাই দু’একটা।

সামনের রাস্তাটায় প্রচুর গাড়ি-লরির স্রোত। খালি ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে না। দেখা গেলেও এই মোড়ের মাথায় থামবে না। এগিয়ে যেতে হবে ফাঁড়ির কাছে। রাস্তায় পা দিতেই মুমু বলল, তুমি আমার হাতটা ধরো। রাস্তাটা পার হতে আমার ভয় করে।

আমি ওর একটা হাত ধরে বললাম, তাহলে তুইও কোনো কিছুতে ভয় পাস।

মুমু বলল, শক্ত করে ধরেছ তো!

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল, জানো, আমি এখন তোমাকে খুব মার খাওয়াতে পারি? যদি চেঁচিয়ে বলি, এই লোকটা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁচান, বাঁচান।

আমি আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি ওর হাত ছেড়ে দিলাম। কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! এমনিতে আমার সঙ্গে অন্য সময় খুব ভাব দেখায়। বই চাইতে আসে। আগে শুধু ইনিড ব্লাইটন আর মিল্স অ্যাণ্ড বুনের বই পড়ত, বাংলা বই কিছু পড়েনি বলে একদিন আমি খুব ঠাট্টা করেছিলাম। তারপর থেকে আমার কাছে বাংলা বই চাইতে আসে। অনেক বই ওকে কিনে দিতেও হয়।

বছর দুয়েকের মধ্যে মুমু অনেকটা বদলে গেছে। বাচ্চা বয়স থেকেই ও খুব জেদি, কিন্তু সারল্যও ছিল খুব। কিন্তু এখন যেন বড়দের জগৎটা বুঝে গেছে অনেকটা। অথচ কতই বা ওর বয়েস, বড় জোর তেরো-চোদ্দ।

আমি বললাম, কেন, আমাকে মার খাওয়াতে চাইবি কেন?

–মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে করে কারুকে মার খাওয়াতে। আমার বাবাকে কেউ মারুক, আমার মাকে মারুক!

–এ কী বলছিস রে, মুমু? নিজের বাবা-মাকে কেউ মার খাওয়াতে চায়?

—ওরা কেন সব সময় ঝগড়া করে?

—এখনো ঝগড়া করে? চন্দনদা আর নীপা বৌদির ঝগড়া তো মিটে গিয়েছিল!

—কিচ্ছু মেটেনি। ঐ লালু রাস্কেলটা আমাদের বাড়িতে রোজ সন্ধেবেলা বসে থাকে। বাবা সেইজন্য বাড়ি ফিরতেই চায় না সন্ধেবেলা। অনেক রাত করে ফেরে। খুব ড্রিংক করে আসে, তারপরই দু’জনে ইংরিজিতে ঝগড়া শুরু করে। হাউ ফানি! আমি যেন ইংরিজি বুঝি না। তখন আমার ইচ্ছে করে, কেউ যদি, ফ্যানটমের মতন যদি কেউ এসে ঠকাস ঠকাস করে ওদের মাথা ঠুকে দিত, তা হলে বেশ হতো!

ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে আমার খানিকটা সময় লাগল। চন্দনদাকে বেশি ড্রিংক করতে তো কখনো দেখিনি। এখন বাড়িয়েছে? বাড়িতে বসে খেলেই তো পারে, নীপা বৌদির তো তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়। চন্দনদার সঙ্গে একদিন দেখা করে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নিতে হবে।

–তোর বাবা-মায়ের ওপর রাগ, তাও না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুই আমাকে মার খাওয়াতে চাস কেন রে?

—তুমি আমার বাবার সাইডে। বাবাকে সব সময় সাপোর্ট করো!

আমি খপ করে মুমুর হাতটা আবার চেপে ধরে বললাম, আমাকে মার খাওয়ানো অত সোজা নাকি? তুই চ্যাঁচালেই আমিও বলব, এ মেয়েটা বাড়ি থেকে পালাচ্ছে! পালিয়ে বোম্বেতে সিনেমায় নামতে চায়।

—বেট?

—লোকদের বলব, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, একে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। কয়েকজন লোককে সত্যি সত্যি তোর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাব।

-কাগজ পড়ো না? ছেলেধরা শুনলেই লোকে মারতে শুরু করে, আর যদি শোন মেয়ে-ধরা—

—তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার কথাই বিশ্বাস করবে।

—তোমার চেহারাটাই তো ছেলেধরাদের মতন। বিশ্বাস করে কিনা, বেট ধরে দেখবে?

আর কথা না বাড়িয়ে আমি মুমুকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম রাস্তার অন্য ধারে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, আমার ওপর সত্যিই যদি রাগ থাকে, তা হলে তুই বাড়ি যা। কিংবা যেখানে ইচ্ছে যা। আমার সঙ্গে যেতে হবে না!

–তুমি যে ফুচকা খাওয়াবে বললে?

–দ্যাখ মুমু, আমি তোকে ভালোবাসি। সেইজন্য মাঝে মাঝে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসি। আমার সঙ্গে যদি তোর মিশতে ইচ্ছে না করে তা হলে আর আমি আসব না।

–ও সব বাজে কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে ফুচকা খাওয়াবার অফার দিয়ে এখন কি ব্যাক-আউট করছ?

—যে আমার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলবে, যে আমাকে মার খাওয়াতে চাইবে, তাকে আমি ফুচকা খাওয়াতে চাইব কোন্ দুঃখে? যা যা, ভাগ্, বাড়ি যা!

–তোমার কী হয়েছে, নীলকাকা? তুমি দিন দিন এত গবেট হয়ে যাচ্ছ কেন? তোমাকে আমি সত্যি সত্যি মার খাওয়াতুম নাকি? ইয়ার্কিও বুঝতে পার না আজকাল?

–তোর বাবা-মা সম্পর্কেও ইয়ার্কি করছিলি?

–তুমি একদিন এসে ওদের দু’জনের মাথাটা খুব জোর ঠুকে দিতে পার না? তুমি আর একটা কাজ যদি করতে পার, তাহলে আজ থেকে তিন বছর সাত মাস বার দিন পরে তোমাকে ঠিক চুমু দেব। একটা না, অনেকগুলো! অ্যাডভান্স হিসেবে তোমার হাতে একটা চুমু খেতে পারি না এখন?

—মুমু, এসব কী পাগলামি হচ্ছে?

—কাজটা কী জানো? তুমি আমাদের বাড়ির সিঁড়ির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকবে। ঐ লালুটা, রোজ আসে তো আমাদের ওখানে, ও যখন ফেরার সময় নামবে, তুমি ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে। খুব জোরে ফেলতে হবে, যাতে ওর একটা পা অন্তত ভেঙে যায়। পা ভাঙলে ও আর গাড়িও চালাতে পারবে না, আমাদের বাড়িতেও আসতে পারবে না।

—লালুদার ওপর সত্যিই তোর খুব রাগ?

—ওর ওপর আমার সবচেয়ে বেশি রাগ। ও-ই তো যত নষ্টের গোড়া।

—আচ্ছা ঠিক আছে, পরে ব্যাপারটা ভেবে দেখা যাবে।

–তোমার ওপর এই কাজটার ভার রইল কিন্তু। মনে রাখবে!

একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল এই সময়। ড্রাইভারটি বাঙালি। মুমুকে নিয়ে ভিকটোরিয়ার সামনে নামবার সময় সে বেশ বক্ৰচোখে তাকাল আমার দিকে। বয়সের তুলনায় মুমুকে বেশ বড়ই দেখায়। আমাদের কেউ ভাই-বোন বলেও ভাববে না। ড্রাইভারটি ভাবছে, আমি একটি কিশোরী মেয়েকে বখাচ্ছি। ঐ মেয়ে যে আমাকে নাকানি-চোবানি খাওয়াতে পারে, তা ও কী বুঝবে?

কলেজে পড়ার সময় আমি ফুচকা খাওয়ার চাম্পিয়ন ছিলাম। একবার কলেজ স্কোয়ারে একজন ফুচকাওয়ালার কাছে একচল্লিশটা ফুচকা খাবার পর সে ভয় পেয়ে বলেছিল, বাবু, আপনাকে আর দেব না। অনেকের ধারণা, ফুচকাওয়ালারা নোংরা, তেঁতুল গোলা জলে ওরা হাত ডোবায়, হাতে কত জার্ম থাকতে পারে, কিন্তু এত ফুচকা খেয়েও তো আমার কক্ষনো অসুখ-বিসুখ হয়নি।

চন্দনদা আর নীপা বৌদি দু’জনেই খাওয়ার ব্যাপারে পিটপিটে

চন্দনদা বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই মেয়ের জন্য কেক, পেস্ট্রি, স্যাণ্ডউইচ, প্যাটিজ নিয়ে যায়। ফুচকা কিংবা আলুকাবলি খেতে দেখলেই শিউরে ওঠে। নিশ্চয়ই মুমুকে কখনো খেতে দেয় না। তাই মুমু আইসক্রিমের বদলে ফুচকা খেতে চেয়েছে।

আমি বললাম, দেখি তুই কটা খেতে পারিস। আমার সঙ্গে পারবি কমপিটিশনে?

মুমু বলল, বেট?

আমি বললাম, অমন কথায় কথায় বাজি ধরতে নেই। দেখাই যাক না। স্টার্ট!

মোটে বারোটা খাবার পর মুমু বলল, আর পারছি না। টিফিনে তিনটে স্যাণ্ডউইচ খেয়েছি, তাই পেট ভর্তি।

আমি, আরও একটা নিয়ে শেষ করলাম। মুমুকে যে হারিয়ে দেওয়া হলো, সেটা আর মুখে বললাম না। জিজ্ঞেস করলাম, এবার আইসক্রিম? কিংবা কোল্ড ড্রিংক?

মুমু দু’দিকে মাথা নাড়ল। তারপর একটু কী যেন চিন্তা করে বলল, এখন কটা বাজে?

-সাড় চারটে

—দুপুরে খুব বৃষ্টি হয়েছে, মাঠ ভিজে। মাঠে তো বসা যাবে না।

—ভেতরে গিয়ে বেঞ্চে বসতে পারি। তোর সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে, মুমু।

—এখানে বসার চেয়ে ..ব্লু, তুমি আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?

—কোথায়?

–তোমাকে আমি নিয়ে যাব। আমাদের একটা ক্লাব আছে। স্কুলের ছুটির পর আমি প্রায়ই সেখানে যাই। তুমি চলো না, তোমার ভালো লাগতে পারে।

—তোমাদের ক্লাব, মানে সেখানে তোদের বয়েসী স্কুলের ছেলেমেয়ে, আমি তার মধ্যে গিয়ে কী করব?

–না, না, কয়েকজন বড়ও আছে। বেশ মজার জায়গা।

—সবাই আমার অচেনা। তারা আমার যাওয়াটা কি পছন্দ করবে?

—কেউ তোমাকে নিয়ে মাথাই ঘামাবে না। ওখানে কেউ কারুর সম্বন্ধে কিছু বলে না। তা ছাড়া সেখানে প্রিসিলা আছে।

—প্রিসিলা কে?

—গেলেই দেখতে পাবে। এখানে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু প্রিসিলা কে, প্রিসিলা কে বলে কী বুঝবে? প্রিসিলা হচ্ছে প্রিসিলা!

আবার ট্যাক্সি।

এবার ফিরে গেলাম মুমুদের স্কুলের কাছেই। গুরুসদয় রোডে। একটা বারোতলা বাড়ির সামনে মুমু ট্যাক্সিটা থামাল।

এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার পাশাপাশি এই কয়েকটা আকাশচুম্বী বাড়ি দেখেছি। কখনো ভেতরে ঢুকিনি। কারা এসব বাড়িতে থাকে তা-ও জানি না।

মুমু যে প্রায়ই আসে তা বেশ বোঝা গেল। গেটের দারোয়ানদের ভূক্ষেপ না করে গট গট করে ঢুকে এল ভেতরে। সোজা গিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়াল। পাশাপাশি দুটো লিফ্ট। পাশের লাল আলো দেখে বোঝা গেল দুটোই ওপরে উঠছে। প্রথমে যেটা নামল, তাতে লিফ্‌টম্যান নেই।

তবু মুমু আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা টেনে দিল। তারপর টিপল এগারো নম্বর বোতাম।

নিঃশব্দে লিফটটা উঠতে লাগল ওপরে। মুমু আমার বুকের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলল, ব্লু, এই জায়গাটার কথা কারুকে বলিনি। সিক্রেট। তোমাকে নিয়ে এলাম কেন বলো তো? বলতে পারবে না। তুমি একটা হাঁদারাম। তুমি কিন্তু আমাদের ক্লাবটার কথা আর কারুকে জানাতে পারবে না!

—প্রতিজ্ঞা করতে হবে?

—মনে মনে করো। মোট কথা কারুক্কে বলবে না। আর তোমাকে যে কাজের ভার দিয়েছি, সেটা মনে থাকবে তো? লালুমামাকে ল্যাঙ মেরে ওর পা-টা ভেঙে দেওয়া চাই। আমাদের বাড়ির সিঁড়িতেই করবে, তা হলে আমরা বেশ দেখব!

অগ্রিম পুরস্কার হিসেবে মুমু আমার ডান হাতটা তুলে ওর ঠোটে ছোঁয়াল।

তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে লালুদা আমাকে কাজ দিয়েছে মুমুর ওপর নজর রাখার। আর মুমু আমার ওপর ভার দিচ্ছে লালুদার পা খোঁড়া করার।

এক ধরনের স্পাইদের বলে ডাবল এজেন্ট, যারা গোপনে দু’পক্ষের হয়েই কাজ করে। আমার অবস্থাটাও এখন সে-রকম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *