বাড়ির খবর – ১০

১০

ঊষাকোটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটা হাইওয়ে গেছে, সেটা আমার মাথায় ছিল। সকলের অলক্ষ্যে বাংলোর সামনের রাস্তাটা ধরে আমি এগিয়ে গেলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এ পৃথিবীর কিছুই আর ভালো লাগছে না।

মিনিট পনেরো পরে পাওয়া গেল বড় রাস্তা। মাঝে মাঝে দুটো একটা ট্রাক ও প্রাইভেট গাড়ি যাচ্ছে। এই রকম রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে লিফ্ট নেবার অভিজ্ঞতা আমার ভালো আছে। ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। অনেকেই থামে না। আমাদের দেশে হিচ হাইকিং চালু নেই। গুণ্ডা-বদমাশরা গাড়ি থামিয়ে লুটপাট করবে, এই ভয় পায় সবাই।

প্রীতম যদি কোনো কারণে খোঁজ করতে আসে, তাই এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়। আমি বড় রাস্তা ধরেও হনহন করে হেঁটে গেলাম অনেকটা। আজ বেশ গরম, হাওয়া বন্ধ, ঘাম ঝরছে দরদর করে।

একটা বেশ ফাঁকামতন জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। গাড়িওয়ালাদের বোঝানো দরকার আমার কোনো দলবল নেই।

আট-দশখানা গাড়ি ও ট্রাক আমাকে পাত্তাই দিল না। আমার হাততোলা মূর্তির দিকে একবার তাকিয়েই ড্রাইভার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এদিকে শিগগিরই ডাকাতি—টাকাতি হয়েছে নাকি?

এবারে দ্বিতীয় টেকনিকটা কাজে লাগাতে হলো। আর প্রাইভেট গাড়ি নয়, ট্রাক দেখলেই রাস্তার ওপর অনেকটা এগিয়ে এসে হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট নিয়ে নাড়তে লাগলাম।

তৃতীয় ট্রাকটা থামল। ড্রাইভার মুখ ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাঁহা?

আমি বললাম, সম্বলপুর।

সে বলল, পাঁচ রুপিয়ায় হবে না। দশ রুপিয়া।

ঠিক আছে, তাই সই। গরমের মধ্যে আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

সম্বলপুর পৌঁছে আবার অন্য ট্রাকে হীরাকুদ। বাঁধ ও হ্রদ দেখব ঠিক করেছিলাম। দেখবই। দাদাকে রিপোর্ট দিতে হবে। দাদা খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করবে!

ফেরার পথে ট্রেনে চেপে আকস্মিকভাবে আর একটা আবিষ্কার করা গেল।

আমার উল্টোদিকের সহযাত্রী একটি ওড়িয়া সংবাদপত্র পাঠ করছেন। পেছনের পাতায় একটা তিন কলম ছবি। কয়েকজন মানুষ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একজন ম-বাবু!

ওড়িয়া অক্ষর আমি মোটামুটি পড়তে পারি। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সহযাত্রী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা। এই ছবির একজন লোক আমার চেনা। ক্যাপশানে কী লেখা আছে একটু বলবেন?

ভদ্রলোক বললেন, সম্বলপুরে একটা স্টেডিয়াম তৈরি হবে। তার ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করতে এসেছিলেন এক মন্ত্রী। আপনি কোন্ লোকটিকে চেনেন? ডান দিক থেকে দ্বিতীয়? এর নাম ত্রিলোচন জৈন। ইনি স্টেডিয়ামটা বানাবার কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন!

ত্রিলোচন জৈন! তপনদার মুখে এঁর নাম শুনেছি। কলকাতার বহু মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এর প্রোমোটার। ওড়িশাতেও এঁর যথেষ্ট আধিপত্য আছে দেখা যাচ্ছে। সেই জন্যই ঊষাকোটি জঙ্গলের ওই প্রহসন!

খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলাম!

ত্রিলোচন জৈনের সঙ্গে ওই শরবতের স্বাদের কি কোনো সম্পর্ক আছে? মুমুদের ক্লাবে প্রিসিলার দেওয়া শরবত আর এখানকারটা যে একই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু একটা ট্রাংকুলাইজার ধরনের জিনিস ওতে মেশানো থাকে, যাতে স্নায়ুর আরাম হয়, যুক্তিবোধ অনেকটা শিথিল হয়ে যায়। আমি নিজেও সেটা অনুভব করেছি।

ত্রিলোচন জৈন কি শংকর জৈনের কেউ হয়? জৈন খুব কমন পদবী, অনেকেরই হতে পারে। তবে, মুমু বলেছিল, ওদের ক্লাবের ওই ফ্ল্যাটটা শংকরের বাবা এমনিই ব্যবহার করতে দিয়েছে।

আমার মনে পড়ল, তাজ বেঙ্গলে শংকরের সঙ্গে সেই তর্কের কথা। শংকরের যুক্তি ছিল অনেক, আমাকে সে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল প্রায়। কিন্তু ত্রিলোচন জৈন শংকরের বাবা-কাকা-জ্যাঠা কেউ একজন হতে বাধ্য। শংকর কি এসব জানে না?

আমার উচিত এই পুরো ব্যাপারটাই মাথা থেকে মুছে ফেলা।

এসব বিশ্রী ব্যাপারের মধ্যে নিজেকে জড়াবার কী দরকার? এরকম তো অনবরতই চলছে। একটা শুধু আমি নিজের চোখে দেখলাম। ত্রিলোচন জৈন যেমন অপরাধী, স্ত্রীর লোভের কাছে পরাজিত ক-বাবুও তার চেয়ে কিছু কম নন। ক—বাবুর পরিচয় জানা এমন কিছু শক্ত হবে না, কিন্তু আমি জানতে চাই না।

কলকাতায় ফিরে দুটো দিন চুপচাপ কাটালাম।

ঊষাকোটি জঙ্গলের বদলে আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল দিকশূন্যপুরে। সেখানে আমাকে মানায়। আমি যোদ্ধা নই। আমি পলাতক। যারা বড় বড় বীর হিসেবে পরিচিত, যারা জননায়ক, তারাই এ ব্যবস্থা পাল্টাতে পারছে না, আমি তো কোন্ ছার।

পরের দিন মনে হলো, তপনদা-শিখা বৌদিরা কি সত্যই চলে গেল নাকি? একবার খোঁজ নেওয়া দরকার।

ও বাড়িতে গিয়ে দেখি, জিনিসপত্র বাঁধা-ছাঁদা হচ্ছে। সেখানে চন্দনদাও উপস্থিত।

আমি বিষণ্নভাবে জিজ্ঞেস করলাম, তপনদা, সত্যি তুমি কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছ?

চন্দনদা বলল, যাবে না কেন? বম্বেতে ও অনেক ভালো অফার পেয়েছে। বাঙালিদের এই এক দোষ, কলকাতা ছেড়ে যেতে চায় না। আরে কলকাতায় কি ভালো চাকরির আর কোনো স্কোপ আছে? সব এখন বম্বে কিংবা দিল্লিতে! আমি বললাম, কেন, কলকাতায় আর বড় চাকরির স্কোপ নেই কেন? কলকাতা কি ছোট জায়গা!

তপনদা হেসে বলল, নীলু একটা মিলিয়ান ডলার প্রশ্ন করেছে। এর উত্তর সহজে দেওয়া যাবে না রে!

চন্দনদা ধমকের সুরে বলল, কলকাতা নষ্ট হয়েছে বাঙালিদের দোষে! বাঙালিরা লেথার্জিক, ঘরকুনো। অন্যের নিন্দে করে, নিজেদের উন্নতির চেষ্টা করে না। তপন, তুই বম্বেতে গিয়ে আস্তে আস্তে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলিস। আমরাও গিয়ে থাকব মাঝে মাঝে!

তপনদা বলল, কলকাতায় পারলুম না। কিনতে হবে বম্বেতে! আমাদের এই বাড়িটা ভেঙে যে মাল্টিস্টোরিড হবে, তার এক একটা টু-বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টের দামই হবে দশ লাখের ওপর। বম্বেতে এর ডাবল ছাড়া কম নয়। আমি একবার গিয়েছিলুম ত্রিলোচন জৈনের অফিসে, ইনস্টলমেন্টে পাওয়া যাবে কিনা খোঁজ নিতে। ওসব হবে না। ক্যাশ ডাউন। কটা বাঙালি দশ লাখ টাকা একসঙ্গে দিতে পারে বল তো? সব অবাঙালিরাই কিনবে!

চন্দনদা বলল, তবু বেশি দাম দিয়েও বম্বেতে কেনা অনেক ভালো। ওখানকার বাড়ি অনেক মজবুত হয়। আমি তো ফ্ল্যাটটা কিনে ঠকেছি। এর মধ্যেই সব কিছু নড়বড় করছে। এখানকার কোন বাড়ি কবে ভেঙে পড়বে তার কি কিছু ঠিক আছে? আরে, কলকাতায় একটা ভালো আর্কিটেকট পর্যন্ত নেই! আজকের কাগজেই একটা খবর দেখেছিস? কাঞ্চন সেনগুপ্তকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। আজকের ইংরিজি কাগজটা বার কর!

এসব বাড়ির আলোচনা আমার ভালো লাগছে না। আমি শিখা বৌদির সঙ্গে গল্প করবার জন্য উঠে পড়তে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কাঞ্চন সেনগুপ্ত নামটা আমার কানে খট করে লাগল। ইনিই কি ক-বাবু?

চন্দনদা কাগজটা টেনে নিয়ে বলল, এই দ্যাখ। টালিগঞ্জে সেই যে একটা বাড়ি মাস দু’-এক আগে ভেঙে পড়েছিল, তার জন্য সে বাড়ির প্রোমোটার আর এক লাখোটিয়াকে পুলিশ ধরেছিল। পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছে অবশ্য। এখন জানা যাচ্ছে, প্রোমোটারদের কোনো দোষই নেই। ওরা করপোরেশানে বাড়ির যে প্ল্যান সাবমিট করে, সেটাতে এই কাঞ্চন সেনগুপ্ত খানিকটা মডিফিকেশন করেছিল। কয়েকটা পিলার বদলেছে, ফ্লোর পেশ বাড়িয়েছে। ওই কারণেই বাড়িটা ভেঙেছে, এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। লোকটা কিস্যু জানে না। অথবা ঘুষ খেয়েছে। প্ল্যানটায় ওর এক বছর আগেকার সই আছে।

তপনদা বলল, ইস্!

চন্দনদা বলল, এর পরেও তুই বাঙালিদের সাপোর্ট করবি?

তপনদা বলল, আমি কাঞ্চন সেনগুপ্তকে একটু একটু চিনি। খুব ভালো ইঞ্জিনিয়ার, আর সোজা ধরনের মানুষ বলেই তো জানতুম।

কাগজের পাঁচের পাতায় ছোট খবর। আগে আমার নজরে পড়েনি। কোনো ছবি নেই। কাঞ্চন সেনগুপ্তই যে ক-বাবু তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আবার তপনদার বর্ণনা শুনে মনে হয় হতেও পারে। কিন্তু এই লাখোটিয়া কে? সেই লাখোটিয়া যদি প্রোমোটার হয়, তা হলে ত্রিলোচন জৈন ক-বাবুকে ঘুষ দিতে যাবে কেন? সব ব্যাপারটাই গুলিয়ে যাচ্ছে।

কিংবা লাখোটিয়া নামে লোকটি ত্রিলোচন জৈনের ডামি? ত্রিলোচন আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ে? সেই জন্যই শংকর জৈন তার বাবা-কাকাদের সব কীর্তি—কাহিনী জানে না?

বিকেলবেলা তপনদাদের হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এলাম।

কলকাতা শহরটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাজারে আর তপনদার সঙ্গে দেখা হবে না। তপনদার সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের মজার কথা আর শুনতে পাব না। ট্রেন ছাড়ার সময় শিখা বৌদির চোখ ছলছল করছিল, তপনদা উদাসীন ভাব এঁকে রেখেছিল মুখে।

একবার কফি হাউসের দিকে ঘুরপাক দিতে গেলাম।

ভেতরে ঢুকেই প্রথম টেবিলটাতে বসে আছে প্রীতম। অন্য দু’জনের সঙ্গে। প্রীতমের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি ঘুরিয়ে নিলাম মুখ। ওর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। বসলাম অন্য একটা টেবিলে। আরও কেউ না কেউ এসে যাবেই। প্রথমেই উঠে এল প্রীতম। সে আগেই অর্ডার দিয়েছে, বেয়ারা নিয়ে এল দু’ প্লেট মাটন ওমলেট।

কথা না-বলাটা ছেলেমানুষের পর্যায়ে চলে যায়। আমি গম্ভীরভাবে বললাম, প্রীতম, এক্ষুনি যদি সরিয়ে না ফেলিস, তা হলে এই খাবারের প্লেটটা আমি ছুঁড়ে ফেলে দেব। তুই যদি টেবিল না ছাড়িস, তা হলে আমি কফি হাউসে আসাই ছেড়ে দেব। উঠে যাব এক্ষুনি।

প্রীতম বলল, তোর এত পরিবর্তন হলো কী করে রে, নীলু? আগে তো রাগ দু’ দিনের বেশি থাকত না। এবার পাঁচ-ছ’ দিন হয়ে গেল।

—এটা রাগের প্রশ্ন নয়। নীতির প্রশ্ন। তোর সার্কেল আর আমার সার্কেল আলাদা হয়ে গেছে।

—আমার কোনো সার্কেল নেই। প্রফেশানাল ফটোগ্রাফার হচ্ছে স্রোতের কচুরিপানা। যখন যেদিকে খুশি যায়। আর খাবারের ওপর কেউ রাগ করে? ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নে।

—আমি খাব না, প্রীতম। আমার ঘেন্না করছে।

—তুই পঞ্চাশ টাকা রেখে এসেছিলি। মনে কর না, এটা তোরই সেই টাকায়। বর্বরস্য ধনক্ষয়ম! না, না, তোর টাকাটা সেই সেন্সে বলছি না, বলছি যে, সম্বলপুরে তুই যা খেয়েছিস, সেটা আমার রোজগার করা টাকায়। আমি তোকে খাওয়াতে পারি না? তুই টাকা ফেরত দিলি কোন্ আক্কেলে? আমি টাকাটা রোজগার করেছি এক বর্বরের কাছ থেকে, সেটা আমার দোষ হতে পারে, কিন্তু খাবারের তো দোষ নেই।

—প্রীতম, তুই এখান থেকে উঠবি কি না!

–উঠতে পারি একটা শর্তে। যদি তুই আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাস আমার মা তোকে ডেকেছে! সামহাউ আমার মা বোধহয় আমার চেয়েও তোকে বেশি পছন্দ করে। আমি ফিরে এসে মাকে বলেছিলাম, নীলুটা একা একা গোঁয়ারের মতন জঙ্গল থেকে চলে গেল। কী ভাবে ফিরল কে জানে! ব্যস, মা অমনি রেগে কাঁই। বলল, আমারই সব দোষ! নীলু অতি ভালো ছেলে, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না! আমার মাকে তুই কী গুণ করেছিস রে, শালা!

—ঠিক আছে, আমি মাসিমার সঙ্গে দেখা করে আসব। তুই যখন বাড়িতে থাকবি না।

—তখন আমার নামে প্রাণ খুলে চুকলি কাটবি তো? লেট আস কমপ্রোমাইজ। তুই কি চাস বল তো? তোর ভালো ভালো কয়েকখানা ছবি তুলে দেব?

আমি কয়েক মুহূর্তে প্রীতমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রীতমটা ছিনে জোঁক, ও আমায় কিছুতেই ছাড়বে না। ওকে মারলেও যাবে না জানি। আমার মাথায় একটা চিন্তা এল!

আমি বললাম, তোকে ক্ষমা করতে পারি। এক নম্বর, তুই ঐ ধরনের নোংরা কাজ আর নিবি না। আর, তুই যে ওখানে ছবি তুলেছিস, তার দু’-একটা কপি আমাকে দিতে পারবি?

প্রীতম বলল, এক নম্বরটা ভেবে দেখব। দু’নম্বরটা পারব না।

–কেন?

—নেগেটিভ সুদ্ধু দিয়ে দিয়েছি। দু’খানা করে প্রিন্ট আর নেগেটিভ। সেই রকম কন্ট্রাক্ট ছিল।

—নিজের কাছে স্পেসিমেন রাখিসনি?

—এসব কেসে রাখতে নেই। কেন? তুই ছবি নিয়ে কী করবি? খবরের কাগজে দেওয়া চলবে না রে, নীলু। কথা দিয়েছি। এটা প্রফেশনাল এথিক্স।

—আমি খবরের কাগজে পাঠাব না। অন্য একটা পার্সোনাল দরকারে।

—তা হলে চেষ্টা করতে পারি। আমার নিজেরই তো ডার্করুম। নিজেই ডেভেলপ প্রিন্ট করি। সবকটা প্রিন্ট ভালো হয় না। সেরকম দু’-একটা থাকতে পারে।

—চল, এক্ষুনি যাব তোর বাড়িতে। দেখব সেগুলো।

প্রীতমের বাড়ি ঘুরে, মাসিমার আদর-যত্ন ভোগ করে বাড়ি ফিরলাম রাত দশটায়। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম।

তিনখানা প্রিন্ট পাওয়া গেছে। মোটামুটি ভালোই। তিনটেই হীরের সেট সমেত ত্রিলোচন জৈন। ক-বাবু ও তাঁর স্ত্রী। স্পষ্ট চেনা যায়।

ছবিগুলো নেবার সময় ভেবেছিলাম, এগুলো পাঠিয়ে দেব শংকর জৈনের কাছে। সেদিন হোটেলে সে আমাকে তর্কে হারিয়ে দিয়েছিল, এই ছবিগুলো হবে তার যথার্থ উত্তর।

আইনসঙ্গত ব্যবসা? বুদ্ধির জোর? আসলে একটা দুষ্ট পাপচক্র!

শংকরের মতন আধুনিক ছেলেরা হয়তো এসব থেকে মুক্ত। তারা লেখাপড়া শিখছে। অনেকে ব্রিলিয়ান্ট, আধুনিক চেতনাসম্পন্ন। তারা হয়তো তাদের বাবা—কাকাদের রীতিনীতিগুলো পাল্টে দেবে। কিন্তু এতদিন ওদের অনেকে কীভাবে চালাচ্ছে, তা জানবে না?

সকালবেলা আমার মত আবার বদলে গেল।

একটা গ্লানিতে ভরে গেল মন। ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলাই ভালো। কোনো সন্তানের কাছে তার বাবার পাপের কথা প্রকাশ করে দেওয়া কি উচিত? ছেলে যদি নিজে জানতে পারে তো আলাদা কথা, কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এই ছবি পাঠানোও কি এক ধরনের নোংরামি নয়?

শংকরের প্রতি কি আমার কোনো ঈর্ষা আছে? সে অত্যন্ত সুদর্শন, সুপুরুষ। সব মেয়েরাই তাকে পছন্দ করে। ইচ্ছেমতন টাকা খরচ করতে পারে সে। আগাগোড়াই সুখী, নিশ্চিন্ত জীবন। সেটাতে একটা আঘাত দিয়ে আমি আনন্দ পেতে চাই?

ভাবতেই নিজের সম্পর্কে আমার একটা ধিক্কার জন্মাল। অন্যদের ছোট করে যারা নিজেদের অক্ষমতার প্রতিশোধ নিতে চায় তারা তো অতি নীচু ধরনের মানুষ।

নাঃ, এসব কিছু আমার দরকার নেই।

ওহে পলাতক নীললোহিত, একবার চলো না দিকশূন্যপুরে। কতদিন যাওনি সেখানে। কত দিন নীলা নাম্নী সেই নারী তোমাকে দেখা দেয়নি। চলো, চলো। আবার বাড়ি থেকে পালাবার একটা সুযোগ খুঁজতে হবে। দু’দিন পরেই সকালে মুমু এসে হাজির। তার গল্পের বই চাই।

মুমু অনেক খবর শোনাল।

এর মধ্যে ওদের ক্লাবটি ভেঙে যাবার উপক্রম। প্রিসিলার ওপর মুমু দারুণ চটে গেছে। প্রিসিলা নাকি এ ক্লাবের দুটি মেয়েকে একদিন একটা হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল।

মুমু আমাকে জিজ্ঞেস করল, সেটা খুব খারাপ নয়? শুধু দুটো মেয়েকে ও হোটেলে নিয়ে যাবে কেন?

আমি বললাম, কী জানি কী ব্যাপার। তোকেও যেতে বলেছিল নাকি?

—ইস, বললেই আমি যেতাম নাকি? আমি আর মিলি ক্লাব ছেড়ে দিচ্ছি। লরাও আর যায় না। জানো, তো, লরা শংকরের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে?

–সে কি রে, কেন?

-লরার বাবাও রাজি নয়। শংকরের বাবাও তো রাজি নয়। দু’জনেই দু’জনের বাবাকে ভয় পায়। অথচ দু’জনেরই ইচ্ছে আছে। সাহস নেই।

—তুই হলে কী করতিস?

—আমি হলে বাবা-মায়ের কথা শুনতাম না। আমি অবশ্য বিয়ে-টিয়ে করবই না। বিয়ে মানেই তো ঝগড়া। দেখছি তো কত!

–তোকে আর পাকামি করতে হবে না। কে বলেছে, বিয়ে মানেই ঝগড়া?

—প্রথম দু’তিন বছর ভাব থাকে। তারপরেই ঝগড়া শুরু হয়। আমার বাবা—মাকেই দ্যাখো না।

—ওসব এমনি এমনি ঝগড়া। আজ আছে, কাল নেই। তুই বিয়ে করবি না, কী করবি তা হলে ভবিষ্যতে?

—বিজনেস করব। মস্ত বড় ফ্যাকট্টি বানাব। বাঙালিরা ব্যবসা করতে পারে না, সবাই বলে। আমি দেখিয়ে দেব! জানো ব্লু, সেদিন শংকরের সঙ্গে তোমার কথা হচ্ছিল আইসক্রিম খাওয়ার সময়। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। বাঙালিদের সব দোষ, আর মাড়োয়ারিদের সব ভালো? মোটেই না। আমাদের স্কুলে রূপা নামে একটা মেয়ে আছে, তার বাবাটা খুব পাজি!

-অনেকে ভালোও আছে।

–থাকতে পারে। কিন্তু সব বাঙালিকে খারাপ বলবে কেন? ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি?

কথা বলতে বলতে মুমু আমার বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ওর জন্য শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রন্থাবলীর পরের পার্ট আনা হয়নি ও তা শুনতে চাইছে না।

হঠাৎ একটা বইয়ের ফাঁকে সেই ছবি তিনটে বেরিয়ে পড়ল।

মুমু বলল, একী, তোমার কাছে শংকরের বাবার ছবি কেন?

ত্রিলোচনই যে শংকরের বাবা তা আমি প্রীতমের কাছে শুনে নিয়েছি। ও ঐ পরিবারের অনেক কিছু জানে। কাঞ্চন সেনগুপ্তও ক-বাবু। উনি ধরা পড়ে যাওয়ায় প্রীতম বেশ ঘাবড়ে গেছে। এতটা হবে সে ভাবেনি। এখন তার মধ্যেও বাঙালি সেন্টিমেন্ট খানিকটা কাজ করছে। কাঞ্চন সেনগুপ্তর মতন একজন মানুষকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অপরাধে যে সে-ও কিছুটা অপরাধী, তা প্রীতম বুঝেছে।

মুমু জিজ্ঞেস করল, এই গয়নার বাক্সটা নিয়ে শংকরের বাবা কী করছে? ঘুষ দিচ্ছে বুঝি?

আজকালকার ছেলেমেয়েদের কিছু বলতে হয় না, ওরা অনেক কিছুই জেনে বসে আছে। আমি পনেরো বছর বয়েসে এরকম একটা ছবি দেখলে কি প্রথমেই এরকম একটা কথা ভাবতাম?

মুমু আবার জিজ্ঞেস করল, শংকরের বাবা অন্য লোকদের গয়না ঘুষ দেয় কেন?

আমি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।

—হ্যাঁ তুমি জানো! বলো, ছবিগুলো তুমি রেখেছ কেন?

-এমনিই। একজন দিয়েছে দেখতে।

—লরার বাবাও লরাকে এই কথা বলেছিল। লরা মানতে চায়নি। এই ছবিগুলো আমি লরাকে দেখাব।

আমি হা-হা করে উঠে বাধা দিতে গেলেও মুমু আমাকে অবকাশ দিল না। ছবি কটা হাতে চেপে বুকে চেপে প্রথমে ঘরের মধ্যে কয়েক পাক ঘুরল। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল।

এর পর সাত দিনের মধ্যে ঘটে গেল বেশ কয়েকটা বড় ঘটনা। খবরের কাগজের হেড লাইন।

হয়তো ঐ ছবি তিনটিই দায়ী নয়। আরও অনেক কিছুর যোগাযোগ হয়েছে এক সঙ্গে। জৈন পরিবারে ভাঙন। বাবার বিরুদ্ধে ছেলের বিদ্রোহ। শংকর জৈন বাবার নামে বিবৃতি দিয়েছে। লাখোটিয়া নামে কেউ নেই, ত্রিলোচনই বেনামে টালিগঞ্জের ভাঙা বাড়ির প্রোমোটার। কাঞ্চন সেনগুপ্তের সই করা যে বাড়ির প্ল্যান পুলিসের হাতে পড়েছে, সেটা ডুপ্লিকেট। এ ছাড়া ত্রিলোচন জৈনের কুকীর্তির আরও বিবরণ।

ত্রিলোচন জৈন বিদেশে পালাতে গিয়েও ধরা পড়েছে এয়ারপোর্টে। তার সঙ্গে ছিল প্রিসিলা। ম্যাজিশিয়ান প্রিসিলা অতগুলো দরজা দেখিয়েছিল আমাকে, আজ সেও পালাতে পারল না কোনো দরজা দিয়ে।

শংকর জৈন নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে লরাকে বিয়ে করেছে। কোনো ধুমধাম হয়নি, সাধারণ রেজিস্ট্রি। শুধু খবরের কাগজের রিপোর্ট নয়, মুমুর কাছে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাও শোনা গেল। যে অল্প কয়েকজন সেই বিয়ের সময় উপস্থিত ছিল, মুমু তাদের মধ্যে একজন।

আমি খালি ভাবছিলাম, এই সব খবর কি তপনদার চোখে পড়ছে না? চিঠি লিখে জানাতে হবে। ত্রিলোচন জৈনের জন্য বহু মধ্যবিত্ত পরিবার তছনছ হয়ে গেছে, তার নিজের পরিবারেও যদি ফাটল ধরে সেটাকে তো নিয়তির সুবিচারই বলা উচিত।

আমাকে কিছু করতে হয়নি বাবা! আমি দূরে দূরে আছি। পাছে কোনো রকম ঝঞ্ঝাটের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়, কোনো সাক্ষী-ফাক্ষি দিতে হয়, তাই কালই আমি দিকশূন্যপুরে চলে যাব।

শংকর জৈন যথার্থ সাহসের পরিচয় দিয়েছে। কলকাতা ছাড়ার আগে তাকে একবার অভিনন্দন জানিয়ে যেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *