বহুরূপী
(রূপিকা)
আধ ভেজান জানালার পাশে রোজই বসি। আর রোজই দেখি নীচের গলি দিয়ে কত লোকজন, কত গাড়ী ঘোড়া অবিরাম যায়। সেখানে বসি কেন ? না ব’সে কোথায় যাব? সেয়ানা মেয়ে, তায় আইবুড় আবার পর্দানশীন; মা আমাকে যে বেরুতে দেন না। তার উপর বাড়ীখানাও ছোট; আবার চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রাণটা যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন জানালার পাশে এসে বসি। কিন্তু জানালাটা যে একেবারে খুলে বসব, সেটী হবার যো নেই; তা হলে বকুনির আর অন্ত থাকবে না।
যখন প্রথম দেশ থেকে বাবা এই শহরের বাসা বাড়ীতে নিয়ে আসেন, তখন কত দিন দানা পানি ছেড়ে কেবলই কেঁদেছি। এখনও সেই পাড়াগাঁয়ের গাছে ঢাকা ঠাণ্ডা বাড়ীখানার কথা আর খোলা প্রাণের কথা মনে হলে অজানায় দীর্ঘশ্বাস পড়ে, চোখে পানি ভরে আসে। হায় খোদা! কবে যে বাড়ী যাব! এখানকার ইট পাথর দেখে দেখে চোখ দুটো যে ঘোলা হবার মত হ’ল ! বদ্ধ বাতাস গিলে গিলে প্রাণটা যে সারা হয়ে গেল।
গলি দিয়ে কত রকম পোশাকের কত লোক যায়। যে যার কাজে যায়। কাজের কি শেষ নেই । কত ভিখারী করুণ সুরে ভিখ, মাঙতে যায়। কত ফেরিওয়ালা কত রকম ডাক ডেকে যায়। কত লোক পায়ে হেঁটে যায়। কত লোক গাড়ী ঘোড় চড়ে যায়। কেউ মাথা হেট করে চলে। কেউ মাথা উঁচু করে চলে। আমি ব’সে ব’সে দেখি।
এই অন্তহীন লোকের স্রোতের মাঝে আমি এক জনকে ধরে ফেলিছি। কখনও সে মহারাজ সাজে, কখনও সে কাঙাল বনে। কখনও সে হাত পেতে ভিখ, মাঙে, কখনও সে দুই হাতে দান করে। কখনও সে বাবু, কখন সে মুটে। কখনও সে জোয়ান, কখনও সে বুড়ো। সে কি বহুরূপী। সে কখনও রাত্রে যায়, কখনও দিনে যায়। তার সময় নেই, অসময় নেই। তাকে কিন্তু আমি ধরে ফেলেছি তার চোখ দেখে। সে সব লুকাতে পারে, পারে না তার ঢলঢলে ছলছলে চোখ দুটিকে লুকাতে।
তখন থেকে আমার নজর সেই বহুরূপীর ওপর। কখন সে যায়, কখন সে আসে—আমি তার আশায় বসে থাকি। আমার লক্ষ্য কেবল সকলের চোখের ওপর। এ ত সে নয়। হাঁ, এই সেই। এমন ক’রে কত দিন যায়।
আমি খুব ডাগর হয়ে উঠেছি। আমার বিয়ের জন্যে মায়ের ঘুম নেই। আচ্ছা, গরীবের মেয়ে এত শীগ্গির বেড়ে ওঠে কেন—তা তোমরা বলতে পার? জানালার ধারে বসা আর বহুরূপীর সন্ধান করা আমার মস্ত বড় একটা বদ অভ্যাস জন্মে গেছে। তা না হলে মার এত গাল মন্দতেও আমি আজ সেই আধ-ভেজান জানালার পাশে বসে আছি!
নিশ্চয় সে আজ সারাদিন এ পথ দিয়ে যায় নি। গেলে নজরে না পড়ে যেত না। এই কথা মনে মনে ভাবছি, এমন সময় কানে আওয়াজ পড়ল এক ফেরিওয়ালার। চেয়ে দেখলুম হাঁ, সেই ঢলঢলে ছলছলে চোখসেই বহুরূপী। দক্ষিণ বাতাসে জানালাটা হঠাৎ খুলে গেল। ছি! কি লজ্জার কথা। আজ চার চোখ এক হ’ল। সে কি ডাকছিল “আমের আচার” না “আমায় চাই” আমি বুঝে উঠতে পারলুম না। ফেরিওয়ালাদের কথার ভঙ্গিই ও রকম। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। তার পর কি হল জানি নে।
এক দিন দেখি আমি রোগ শয্যায়। বাপ মা একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছেন। এক বুড়ো কবিরাজ আমার পাশে বিছানায় বসে আমার নাড়ী দেখছেন। আমার শরীর শিউরে উঠল। আমি আমার ক্ষীণ চোখ দুটি দিয়ে তার মুখের পানে চাইলুম। আঃ! মরি! মরি! এই সে ঢল ঢলে ছলছলে চোখ! এ যে সেই বহুরূপী! আমার মাথা ঘুরতে লাগল। তিনি বললেন “ওষুধটা খেয়ে নাও, আমার লক্ষীটী! সব সেরে যাবে।” আমি ঝোকের মাথায় বলে ফেললুম “না, আমি সারতে চাই নে।” আমার বুকের ভিতর যেন আমার পরাণটী কেঁদে বল্লে, “কেবল তোমাকে আমার পাশে পেতে চাই, হে আমার বৈদ্যরাজ”!
অনেক দিন হয়ে গেছে। পাঠকপাঠিকারা, আমাকে তোমরা বেহায়া ভেব না। তিনিই আমার স্বামী।