অন্ধ ক’নে
(রূপিকা)
(এক)
আজ আমার বিয়ে। মাটি যদি ফেটে যেত, তবে তার ভিতর লুকিয়ে লজ্জার হাত থেকে বেঁচে যেতুম। বিয়েয় আবার লজ্জা! হাঁ, আমার পক্ষে বটে। একে আমি গরীবের মেয়ে, তায় আবার অন্ধ, তার উপর কুৎসিত। শুনেছি যিনি আমার বর, তিনি খুব বুড়ো আর তার নাকি অনেকগুলি পরিবারও আছে। তবে তিনি মস্ত জমিদার। সমস্ত ভবনগরের ষোল আনা মালিক। দয়া করেই নাকি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। বিয়ের আগে আমার মরণ হ’লে ভাল হত। কিন্তু মরণকে যখন সাধা যায়, তখন তাকে পাওয়া যায় না। যখন কেউ তাকে চায় না, তখনই বুঝি সে আসে।
চিরদিনই আমি কিন্তু অন্ধ কুশ্রী ছিলুম না। একদিন ছিল, যখন সকলে রূপসী বলে আমার তারীফ করত। আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি নিজেই নিজের রূপ দেখে আপনহারা হয়ে যেতুম। আমার রূপযৌবনের কথা শুনে চারিদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসত। আমি সব প্রস্তাব দুর্গন্ধ ফুলের মত ছুড়ে ফেলে দিতুম। এমনই ছিল আমার রূপের গর্ব। তারপর আমার উপর মা শীতলার কৃপা হল। রূপ গেল। চোখ গেল। বোধ হয় চোখ দু’টী যাওয়া বিধাতার অনুগ্রহ। তা না হলে হয়ত আমি নিজেই নিজের চেহারা দেখে নিত্য মরমে মরে যেতুম।
শিলে ছেঁড়া পোকায় খাওয়া ফুলের কানের কাছে এসে আর কোনও মৌমাছি তার গুণগুঞ্জন করে না। আমার আর বর জোটে না। সেটা আমার বাপ মার কাছে নেহাত অস্বস্তির বিষয় হলেও আমার কাছে বড় স্বস্তির বিষয় ছিল। সইরা অনেক করে বোঝালে–চিরকাল আইবুড়ো হয়ে থালে কলঙ্ক হবে। মা কেঁদে বললেন—তা হলে জাত যাবে। বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন-একঘরে হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু বর কোথায় ? শেষে নাকি ইনি দয়া করে আমাকে গলায় তুলতে (না, পায়ে রাখতে?) রাজি হয়েছেন। আজ বিয়ের দিনের সকালে সব অতীত কথা মনের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে আসছে। আর তাঁর দয়া আমাকে কৃতজ্ঞ না করে আমার মরমের পরতায় পরতায় যেন বিষ মাখান সূচ ফোটাচ্ছে। আজ যদি চোখ থাকত, একদিকে ছুটে পালাতুম।
বিয়ে বাড়ী। চারিদিকে হৈ চৈ। আমি কিন্তু একেলা। মাঝে মাঝে শানায়ের শাহানা রাগিণী কানে এসে লাগছে। কিন্তু মনের কান্না বাজনার উপর ছাপিয়ে উঠছে।
(দুই)
সইদের ঠেলাঠেলিতে জেগে উঠলুম। তারা কেবল বলছে—ওঠ, ওঠ, ওলো, তোর বর এসেছে। তারাই সাজিয়ে গুজিয়ে দিলে। হিপনোটাইযডের মত বিয়ের সমস্ত আচার শেষ করলুম। শুভ দর্শন হ’ল, কি অশুভ দর্শন হল—তা জানি নে। আমি পলে পলে মরমে ম’রে যেতে লাগলুম।
সইরা একে একে সরে গেছে। বাসর ঘরে এখন আছি শুধু আমি আর তিনি। তার গাল দিয়ে আমার গাল ছুঁয়ে আমার কানে কানে কি মধুর কথাগুলি তিনি বললেন! মরে যাই! এমন মনকাড়া কথা আর কখন ত শুনি নি। কথার সঙ্গে সঙ্গে তার সুগন্ধ মুখের হাওয়া আর নিঃশ্বাস আমাকে যেন মাতাল করে তুলছিল। তার পরশে আনন্দে অবশ হয়ে আমার সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠছিল।—তবে তিনি দয়া করে আমার বিয়ে করতে চান নি। তিনি ছোটো বেলা থেকেই আমাকে ভালবেসে আসছেন। তবে প্রত্যাখ্যানের ভয়ে আমার সুসময়ে বিয়ের প্রস্তাব করেন নি। আমার দুর্দিনে যখন সকলে সরে গেছে, তিনি সাহস করে আমাকে চেয়েছেন। তবে তিনি বুড়োত যাই হক, আমি তার দয়ার পাত্রী নই, আমি যথার্থ ই তার প্রেমের পাত্রী। হায় রে ! আজও আমার প্রেমিক আছে। তামার চোখ দিয়ে দর, দর, ক’রে গরম জল বেরুতে লাগল।
আমার সমস্ত প্রাণ আমার অন্ধ চোখে এনে তার পানে চাইলুম। এ কি? এ যে নবীন যুবক! এ কি ? এ যে পরম সুন্দর! আমার চোখের ছানি কেটে গেছে ? না, আমি স্বপ্ন দেখছি ? আমি বললুম, “প্রিয়তম, তুমি এত নবীন !” তিনি বললেন “তোমার নবীনতা আমাকে নবীন করেছে।” আমি বললুম, “আমার জীবন-সর্বস্ব, তুমি এত রূপবান্” তিনি বললেন, “প্রিয়ে, তোমার রূপ আমাকে রূপবান করেছে।” আমি কেঁদে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লুম ; বললুম, “আমার মাফ করো। আমি অতি কুৎসিত, তোমার চরণের দাসী : হ’বার যোগ্য নই।” তিনি আবেগভরে আমাকে বুকে তুলে নিলেন ; বললেন, “প্রিয়তমে, আজ থেকে তুমি আমার মাথার মণি হ’লে।