বছর কুড়ি আগে

বছর কুড়ি আগে

এই গল্প যারা পড়বে তারা সকলেই হয়তো একবাক্যে বলবে স্রেফ চমক সৃষ্টিকারী মস্তিষ্কপ্রসূত একটা ঘটনা মাত্র। কিন্তু এই গল্প যিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁকে অবিশ্বাস করার মতো মানসিকতা আমার অন্তত নেই। ঘটনাকালও খুব বেশি পুরনো দিনের নয়। মাত্র বছর কুড়ি আগেকার কথা।

মৌলালির কাছে রতিকান্ত পোদ্দার নামে এক ভদ্রলোক থাকতেন। খুবই অভাবী লোক। স্ত্রী এবং দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে দারিদ্র্যের সংসার। ভদ্রলোক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। দুর্ভাগ্যবশত প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় চাকরি খুইয়ে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন ভদ্রলোক। একেই চাকরিহীন হয়ে মনমেজাজের ঠিক ছিল না, তার ওপর স্ত্রীর গঞ্জনা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে রতিকান্তবাবু ঠিক করলেন, আত্মহত্যা করে এই কলহ ও দুর্ভাবনার হাত থেকে রেহাই নেবেন তিনি।

এই ভেবে এক রাতে রতিকান্তবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে কাছাকাছি এক বিখ্যাত কবরখানায় ঢুকে পড়লেন। পকেটে কাগজে মোড়া বিষও ছিল । এটা খেলেই সব জ্বালার অবসান হয়ে যাবে। নিরাপদে দেহরক্ষার জন্য নির্জন কবরখানাই হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। এখানে কেউ চেঁচামেচি করবে না, বাধা দেবে না, অথচ শান্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া যাবে।

তখন গরমের দিন। তায় ফুটফুটে জ্যোৎস্নার রাত। রতিকান্তবাবু কবরখানায় ঢুকে চাঁদের আলোয় আলোকিত জায়গাটার ভেতরের রূপ দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলেন। চিরকাল এর বাইরে দিয়েই যাতায়াত করেছেন তিনি। ভেতরে কখনও ঢোকার প্রয়োজন মনে করেননি। আজ ভেতরে ঢুকে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে উঠল তাঁর মনপ্রাণ। অন্য সময় হলে কবরখানায় ঢোকার কথা সজ্ঞানে চিন্তাই করতে পারতেন না তিনি। কিন্তু মৃত্যুর জন্য যে মানুষ তৈরি, তার আর ভয় কীসের?

কবরখানায় ঢুকে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। কত বিচিত্র রকমের স্মৃতিসৌধ যে আছে তা তাঁর ধারণারও বাইরে ছিল। অবশেষে অনেক ক্লান্ত হয়ে একটি খুব সুন্দর সোপানযুক্ত বড়সড় স্মৃতিসৌধের ওপর বসে পড়লেন। ফুরফুর করে হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় ঘুম নেমে আসছে চোখে। কত মানুষ তো এর ভেতরে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। কাজেই এর ওপর শুয়ে যদি কেউ একটু ঘুমোয় তো কার কী বলার আছে? এই ভেবে তিনি কবরসৌধের মসৃণ পাথরের চাতালে শুয়ে পড়লেন। কেউ কোথাও নেই। নিস্তব্ধ নিঝুম চারদিক। শুধু আগাছায় ভরা। মাঝেমধ্যে দু-একটা কেঁদো কুকুরের ছুটোছুটি ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই। শুয়ে থাকতে-থাকতেই ঘুমে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন খেয়ালও নেই তাঁর। হঠাৎ একজনের ধমকে ঘুম ছুটে গেল।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসেই দেখলেন তাঁর সামনে একজন দীর্ঘ দেহ খাঁটি ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। জ্যোৎস্নার আলোয় সাহেবের গায়ের রঙে যেন বিদ্যুৎ ঠিকরোচ্ছে। আর নীল চোখ দুটো যেন কাচের গুলির মতো চিকচিক করছে।

রতিকান্তবাবুকে উঠে বসতে দেখে কড়া গলায় সাহেব বললেন, “হোয়াট ননসেন্স ইজ দিস! গেট ডাউন।”

রতিকান্তবাবু সাহেবের ধমক খেয়ে কবরের চাতাল থেকে মারলেন এক লাফ। সাহেব ভাঙা ভাঙা বাংলায় গলার স্বর কঠিন করেই বললেন, “কী নাম আছে টোমার?”

“আজ্ঞে, আমার নাম রতিকান্ত পোদ্দার।”

“এটো রাটে টুমি কবরখানার মঢ্যে আসিয়াছো কেন?”

“আমি ভুল করে এসে পড়েছি সাহেব। আর কখনও আসব না।’

“আর কখনও আসিবার সময় টুমি পাইলে টো আসিবে। হামি টো এখুনি টোমাকে গোলি করিয়া মারিয়া ডিবে।”

রতিকান্তবাবু আত্মহত্যা করবেন বলেই এসেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আমাকে এবারের মতন ক্ষমা করুন সাহেব। আমি এর আগে কখনও এখানে আসিনি। মা কালীর দিব্যি, আর কখনও আসবও না। বহু দুঃখে এসেছিলাম।” বলে পকেট থেকে কাগজে মোড়া বিষটা বের করে বললেন, “এই দেখুন, আমি এটা খেয়ে সুইসাইড করব বলে এসেছিলাম।”

“কী ওটা?”

“এটা বিষ।”

“কই ডেখি?”

রতিকান্তবাবু সাহেবের হাতে বিষটা দিতেই সাহেব সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “এটা খাইলে ইঁডুর ছুচা মরিবে। টুমি মরিবে কেন? ডু-একবার বমি করিলেই টো বাঁচিয়া উঠিবে টুমি। একদম ভেজাল চিজ আছে।”

রতিকান্তবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “অ্যাঁ! ভেজাল?”

“টবে না টো কি? টোমরা স্বড়েশিরা আসল মাল খাওয়াইবে লোককে? টা যাক। কিনটু টুমি সুইসাইড করিটে আসিয়াছিলে কেন? হামি মরিয়া যেখানে বাঁচিয়া উঠিতে চাহিটেছি টুমি বাঁচিয়া সেখানে মরিয়া যাইটে চাহিটেছ কী কারণে?”

রতিকান্তবাবু তো লাফিয়ে উঠলেন, “আ-আপনি বাঁচতে চাইছেন? মা-মা-মানে আপনি বেঁচে নেই? তার মানে আপনি মি-মি-মৃত?”

“হ্যাঁ, হামি মূটো। বাঁচিয়া ঠাকিলে আমি এই রাট ডুপুরে টোমার সঙ্গে এইখানে কি নকশা মারিটে আসিটাম? টুমি যে কবরের উপর শুইয়া আছ এইটাই হামার কবর।”

রতিকান্ত বললেন, “অ। বুঝেছি। তা আপনি কতদিন আগে মরেছেন সাহেব?”

“তাহা শুনিয়া টোমার লাভটা কী? টোমরা স্বড়েশিরা একডিন হামাকে গোলি করিয়া মারিয়াছিলে।”

“তা হতে পারে । তবে আমি কিন্তু স্বদেশি ফদেশি নই সাহেব। দেশ এখন স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি আপনাকে মারিনি। মা কালীর দিব্যি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন সাহেব।”

“ড্যাম ফুল ব্লাডি ইডিয়ট। টুমি মরিটে আসিয়াছ যডি টো বাঁচিবার জন্য এমন ছটফট করিটেছ কেন? কান ঢরিয়া ওঠবোস করো।” রতিকান্তবাবু তাই করলেন।

“স্টপ। এইবার হামাকে সোটটো করিয়া বলো টো টুমি এইখানে মরিটে আসিয়াছিলে কেন?”

রতিকান্তবাবু বললেন, “আমার দুঃখের কথা কী আর বলব সাহেব, বড় কষ্টে দিন কাটছে আমার। খুব গরিব লোক আমি। তার ওপর চাকরিটা খোয়ালাম।”

“চাকরি খোয়াইলে? কেন? চুরি করিয়াছিলে না ঘুষ খাইয়াছিলে?”

“ওসব কিছু নয় সাহেব। কোম্পানিটা উঠে গেল।”

“ফের মিঠটা কঠা বলিতেছ? উঠিয়া গেল না উঠাইয়া ডিলে? কোনও কোম্পানি কি শুঢু শুঢু উঠিয়া যায়? যাক, টুমি টা হলে বলিটে চাও চাকরি খোয়াইয়া টুমি অসুবিধায় পড়িয়াছ। পেট ভরিয়া খাইটে পাও না।”

“হ্যাঁ, আমার বউ ছেলে মেয়ে সব আছে। আমি এখন এমনই অভাবে পড়েছি যে নিজেও খেতে পাই না, তাদেরও খেতে দিতে পারি না।”

“অ। এইজন্য টুমি মরিটে আসিয়াছিলে?”

“ঠিক তাই।”

“মরিয়া টুমি ভুট হইটে আর আকাশ হইটে খাবার পাড়িয়া উহাড়ের খাইটে ডিটে, এই টো?”

“হ্যাঁ।”

“ইডিয়ট। টোমার কি ধারণা সব লোক মরিলেই ভুট হয়?”

“জানি না সাহেব।”

“ঠিক আছে। হামি টোমার সব কঠা শুনিলাম। টোমার সুইসাইড করিবার প্রয়োজন নাই। হামি টোমাকে একটা গিনি ডিটেছি। টুমি এইটি লইয়া চলিয়া যাও। এইটি বিক্রয় করিলে অনেক টাকা পাইবে টুমি। ওই টাকায় টোমরা পেট ভরিয়া খাইয়া বাঁচিবে। টাকা ফুরাইলে টুমি আবার আসিবে হামার কাছে। হামি টোমাকে আবার গিনি ডিব। কিনটু এই কঠা টুমি কাউকে বলিবে না। যডি বলো, হামি টোমাকে মারিয়া ফেলিব।”

রতিকান্তবাবু গিনিটা পকেটে পুরেই কবরখানার বাইরে এসে একবার গিনিটা বের করে দেখলেন সত্যিই সেটা পকেটে আছে কি না। কেননা এতক্ষণ যা ঘটে গেল তা তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। হাত দিতেই ধাতব গিনিটা হাতে ঠেকল । এই তো, এই তো রয়েছে। তবে তো মিথ্যে নয়। কেননা তাঁর বারবারই মনে হচ্ছিল এতক্ষণ তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু চকচকে গিনিটা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল এতক্ষণ যা তিনি দেখেছেন তা সত্যিই।

রতিকান্তবাবু গিনিটা পরদিনই একটি জুয়েলারির দোকানে বিক্রি করে অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকগুলি অর্থ লাভ করেন। কারণ গিনিটার ধাতব মূল্যের থেকে এর প্রাচীনত্বের দাম ছিল অনেক।

দোকানদার রতিকান্তবাবুর পূর্ব পরিচিত। গিনি দেখেই বললেন, “কী ব্যাপার রতিকান্তবাবু, এ মাল কোথায় পেলেন?”

“কোথায় আর পাব মশাই? আমারই ছিল। বাবা জাহাজে কাজ করতেন । সাহেবদের নেকনজরে পড়ে গিয়েছিলেন। দু-একদিন ছাড়াই সাহেবরা বাবাকে একটা করে গিনি উপহার দিতেন। তারই কিছু কিছু জমানো ছিল । এতদিন বেচিনি। এখন অভাবের জ্বালায় বেচতে এসেছি।”

“তা বেশ করেছেন। তবে একটা কথা, আপনার যখনই ওগুলো বেচবার দরকার হবে তখন আমার দোকানেই আসবেন, কেমন? কেননা এ জিনিস আমরা দাম দিয়ে কিনলেও এগুলো আমরা নষ্ট করব না। এতদিন আপনার সঞ্চয়ে ছিল, এবার আমার সংগ্রহে থাকবে, এই আর কি।”

রতিকান্তবাবু গিনি বিক্রির টাকা গৃহিণীর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন । গৃহিণী অবাক হয়ে বললেন, “ও বাবা! এত টাকা! কোথায় পেলে তুমি? এই যে শুনলাম তোমার চাকরি নেই।”

“চাকরি সত্যিই নেই। আপাতত ছোটখাটো কাজ একটা জুটিয়ে নিয়েছি। তবে দিনমানে নয়, রাতে।”

“রাতে! কোনও খারাপ কাজ নয় তো?”

“না। আর হলেও তোমার তাতে কী? খারাপ কাজ করলে তার ফল আমিই ভোগ করব। তুমি তো করবে না। আমি টাকা আনব, তুমি সংসার চালাবে। আমি কী করছি না করছি সে ব্যাপারে তুমি একদম মাথা গলিও না।”

গৃহিণী চুপ করে গেলেন।

রতিকান্তবাবু সাহেবের কথামতো গিনি প্রসঙ্গও তুললেন না, সাহেবের কথাও বললেন না। তবে পরদিন থেকে রোজই সন্ধের পর চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা কবরখানায় চলে যেতেন এবং সাহেবের স্মৃতিসৌধ নিজে হাতে পরিষ্কার করে দিতেন। সাহেবও রোজই একবার করে দেখা দিতেন রতিকান্তবাবুকে এবং প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে একটি করে গিনি উপহার দিতেন।

এইভাবেই দিন যায়।

একদিন হঠাৎ গিনি বিক্রি করতে গিয়ে রতিকান্তবাবু হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে। দোকানদারের কারসাজিতেই হোক বা অন্য কোনওভাবেই হোক রতিকান্তবাবু পুলিশের শিকার হলেন।

পুলিশ নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে জানতে চাইল রতিকান্তবাবুর কাছে, এগুলো চোরাই মাল, না সত্যিই তাঁদের পিতৃপুরুষের সঞ্চিত সম্পত্তি। যদি তাই-ই হয় তবে তার পরিমাণ এখন কত?

রতিকান্তবাবু কী আর বলেন? তিনি একই কথা বারবার বলতে লাগলেন, “এসব চোরাই মাল নয়, সবই তাঁর পিতৃদত্ত ধন। এমনকী এও বললেন, আজকের এই গিনিটি ছাড়া তাঁর সঞ্চয়ে আর একটি গিনিও অবশিষ্ট নেই।”

পুলিশ তবুও তাঁর কথা বিশ্বাস করল না । কেননা এই গিনিগুলোর একটির সঙ্গে আর একটির মিল নেই। যথেষ্ট সময়ের ব্যবধানে এগুলি তৈরি হয়েছিল। কাজেই একই লোকের কাছে বিভিন্ন সময়ের এতগুলি গিনি কী করে থাকতে পারে? এটা একটা রীতিমতো সন্দেহের ব্যাপার। তাই পুলিশ রতিকান্তবাবুকে অ্যারেস্ট করে তাঁর বাড়িতে এসে ঘরদোর তছনছ করে চারদিক তন্নতন্ন করে নেড়ে ঘেঁটে কিছুই না পেয়ে ফিরে গেল। ফিরে গিয়েও লকআপে রাখা রতিকান্তবাবুকে ভীতি প্রদর্শন করে কথা আদায়ের চেষ্টা করতে লাগল।

রতিকান্তবাবু অনেক কাঁদাকাটা করলেন। দারোগাবাবুর হাতেপায়ে ধরলেন। কিন্তু কোনও ফল হল না তাতে । রতিকান্তবাবুর গৃহিণী এসেও হাতেপায়ে ধরলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।”

দারোগাবাবু বললেন, “যতক্ষণ না সত্যি কথা বলবেন উনি, ততক্ষণ ওঁকে ছাড়া হবে না।”

রতিকান্তবাবুর গৃহিণী স্বামীর কাছে গিয়ে কেঁদে বললেন, “আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, নিশ্চয়ই তুমি কোনও খারাপ কাজ করছ। কেন ও কাজ করতে গেলে তুমি? রোজ সন্ধেবেলা তুমি চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে বেরোতে আর ফিরতে রাত বারোটার পর। এখন আমি কী করি?”

রতিকান্তবাবু তখন সাহেবের নিষেধ সত্ত্বেও সব কথা খুলে বললেন গৃহিণীকে। এবং বললেন, যেভাবেই হোক সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে এই বিপদের কথাটা জানিয়ে আসতে।

গৃহিণী তো ভয়েই সারা। শোনামাত্রই আঁতকে উঠে বললেন, “ওরে বাবা! কবরখানায় ঢুকে সাহেব ভূতের সঙ্গে আমি কী করে কথা বলব গো! একেই আমার ভূতের ভয়।”

রতিকান্তবাবু বললেন, “তা অবশ্য ঠিক। তবু তুমি এক কাজ করো, আমি বরং একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, তুমি সেটা সাহেবের কবরের ওপর পাথর চাপা দিয়ে রেখে এসো। তবে খুব সাবধান। ভুলেও যেন কারও কাছে বোলো না এ-কথা।”

“না, না, তা বলব না। কিন্তু আমি সাহেবের কবর চিনব কী করে?”

“সেসব বলে দিচ্ছি আমি। বলেই রতিকান্তবাবু একটা সাদা কাগজে দু-এক ছত্রে নিজের বিপদের কথা জানিয়ে লিখে দিলেন, “প্লিজ হেল্প মি”, তারপর গৃহিণীকে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কোনখানে যেতে হবে। এবং এও বলে দিলেন, ওই কবরখানার সবচেয়ে বড় স্মৃতিসৌধটাই সাহেবের।

রতিকান্তবাবুর গৃহিণী দিনের আলো থাকতে-থাকতেই রক্ষীদের নজর এড়িয়ে ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে কবরখানায় ঢুকে পড়লেন। তারপর রতিকান্তবাবু যেভাবে যেমন করে যেতে বলে দিয়েছিলেন ঠিক সেইভাবেই গিয়ে এখানকার সবচেয়ে বড় স্মৃতিসৌধটির কাছে পৌঁছলেন। তারপর বিশেষ চিহ্ন আঁকা দীর্ঘ এপিটাফের নীচে একটি পাথর চাপা দিয়ে চিঠিটা রেখে চলে এলেন।

রাত তখন একটা।

থানার লকআপের ভেতরে দারোগাবাবু রতিকান্তবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছেন। আর রতিকান্তবাবুও সেই একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন, “বিশ্বাস করুন আপনারা, আমি চুরি করিনি। এ সবই আমার পিতৃদত্ত ধন। যা ছিল সবই বেচে দিয়েছি। তা ছাড়া আপনারা তো আমার বাড়ি তল্লাশ করে দেখেই এসেছেন, তবুও কেন অবিশ্বাস করছেন আমাকে?”

“অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই করছি। এইসব দুষ্প্রাপ্য গিনিগুলি আপনার পিতৃদত্ত ধন হলে আপনার এইরকম দশা হত? আপনি তা হলে ভাড়াবাড়িতে টিনের ঘরে থাকতেন? চালাকির জায়গা পাননি?”

রতিকান্তবাবু নীরব। সত্যিই তো! কী উত্তর দেবেন তিনি? এমন সময় হঠাৎ এক কাণ্ড।

রুদ্রমূর্তিতে ঝড়ের বেগে যিনি এসে সেখানে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে দেখেই চমকে উঠলেন সকলেই। দরোয়ান থেকে ও. সি. পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে স্যালুট করলেন তাঁকে। সেই অতি ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন সবাই। কে ইনি? পুলিশ কমিশনার? না। তিনি তো বাঙালি। তবে কি সেন্ট্রাল থেকে এসেছেন কোনও ব্রিগেডিয়ার? তাই বা কী করে হবে? ইউনিফর্ম তো পরে আছেন উচ্চপদস্থ সার্জেন্টের। তা হলে? কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব! কী ভয়ানক তাঁর নীল চোখের চাহনি! কী হিংস্র তাঁর লাল টকটকে মুখ! খাঁটি ইংরেজ সাহেব। কে পাঠাল এঁকে? কোথা থেকে এলেন?

সাহেব এসেই গটগট করে ও. সি.-র ঘরে ঢুকলেন। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ক্রুদ্ধ চোখে ঘরের চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। টেবিলের কাগজপত্তরগুলো একটু নাড়াচাড়া করলেন। চেয়ারটা টেনে নিয়ে একবার বসতে গিয়েও বসলেন না। জুতোসুদ্ধু একটা পা চেয়ারের ওপর রাখলেন। তারপর টেবিলে রাখা ময়লা ছোপধরা কাচের গেলাসটা ঘরের কোণে আছাড় মেরে বোমার মতো ফেটে পড়লেন, “আমার ঘরের এই রকম অবোশটা কে করিয়াছে?” তারপর ও.সি.-র দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “হু আর য়্যু?”

ও. সি. সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, “স্যার, আমি বর্তমানে এই থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার।”

“ইউ ব্লাডি ফুল। টেল মিস্টার টেগার্ট। ইউ আর রিয়ালি আনফিট ফর দিস পোস্ট।”

তারপর গোটা থানার চারদিক ব্যাঘ্রবিক্রমে ঘুরেফিরে দেখে লকআপের কাছে এসে রতিকান্তবাবুর দিকে তাকিয়ে ও.সি.-কে বললেন, “এই লোকটাকে টোমরা ঢরিয়া রাখিয়াছ কেন?”

“একে আমরা স্মাগলার সন্দেহ করে ধরে রেখেছি স্যার।”

“ব্লাডি ফুল। হি ইজ এ ভেরি গুড ম্যান। আই নো হিম। যডি ভাল চাও টো টোমরা ইহাকে এখুনি ছাড়িয়া ডাও।”

বলার সঙ্গে-সঙ্গেই ছেড়ে দেওয়া হল রতিকান্তবাবুকে।

লকআপ থেকে বেরিয়ে রতিকান্তবাবু দেঁতো হেসে সাহেবকে একটা স্যালুট দিলেন। সাহেব রতিকান্তবাবুকে ধমকালেন, “গেট আউট অফ হিয়ার।”

রতিকান্তবাবু সাহেবের এরকম মূর্তি কখনও দেখেননি। এমন ইউনিফর্ম পরা বদমেজাজি পুলিশি চেহারা কখনও না। তাই ধমক খেয়ে কোনওরকমে কোঁচা গুটোতে গুটোতে দৌড়ে পালালেন।

রতিকান্তবাবু চলে যাওয়ার পর সাহেবও চলে গেলেন ঝড়ের বেগে।

আর থানাসুদ্ধু লোক ভয়ে বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

সাহেব যাওয়ার আগে পুলিশের খাতায় খসখস করে কী যেন সব লিখে গেছেন।

বিস্ময়ের ঘোর কাটলে সবাই একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে খাতার পাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখলেন সাহেব যা লিখে গেছেন: ‘দি ম্যান ইজ নোন টু মি অ্যান্ড অ্যাজ সাচ আই অ্যাম রিলিজিং হিম।’ লেখার শেষে নিজের নামও সই করে গেছেন সাহেব।

ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে এমনই সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে, সবাই যেন কী রকম হয়ে গিয়েছিলেন। সাহেবকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মনোবলও ছিল না কারও। যাই হোক, সে রাতের সেই অবাস্তব অভিজ্ঞতার সত্যাসত্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেল টেগার্ট যখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন তখন এই নামাঙ্কিত ব্যক্তি ওই থানারই একজন ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। পুরনো নথিপত্রের সইয়ের সঙ্গে সে রাতের সেই রহস্যময় মানুষটির সইয়ের হুবহু মিল পাওয়া গেল। শুধু তারিখেরই যা হেরফের হল। এবং অনুসন্ধানে এও জানা গেল, এই সাহেবটি তৎকালীন সময়ে স্বদেশিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *