কী ভয়ঙ্কর রাত

কী ভয়ঙ্কর রাত

১৯৫০ সালের কথা। আমরা তিন বন্ধুতে জুনপুট বেড়াতে গেছি। তখন এখনকার মতো এমন যাতায়াতের সুবিধা ছিল না। কাঁথি থেকে গোরুর গাড়িতে অথবা পায়ে হেঁটে জুনপুট যেতে হত। আমরা তিনজনে খুব ভোর ভোর রওনা হলাম কাঁথি থেকে। ইচ্ছেটা জুনপুটের নির্জন সমুদ্রতীরে ঝাউবনের শোভা দেখব। জেলেদের মাছধরা দেখব। আর দু’দিনের ছুটি উপভোগ করে ফিরে আসব কলকাতায়।

জুনপুট এখনও ভাল করে গড়ে ওঠেনি। তখনকার অবস্থা তা হলে বোঝ। না ছিল হোটেল, না ছিল থাকার ব্যবস্থা, না কোনও কিছু। জঙ্গলময় একটি গ্রাম ছিল জুনপুট। গ্রাম থেকে সমুদ্রতীরের দূরত্বও ছিল প্রায় এক মাইল। আমরা কাঁথি থেকে মাইল পাঁচেক পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর জুনপুটের সমুদ্রতীরে পৌঁছলাম।

আমাদের তিনজনেরই ছিল সেই প্রথম সমুদ্রদর্শন। সমুদ্রের বিশাল আকার দেখে আমাদের সে কী আনন্দ! তখন গ্রীষ্মকাল। এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ের সে কী নাচুনি! তাই দেখে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। সমুদ্রতীরের চনচনে রোদের উত্তাপ এড়াতে আমরা তটসংলগ্ন ঝাউবনে বসে নানারকম আলোচনা করতে লাগলাম।

আমাদের সমস্যা হল থাকার ব্যাপার নিয়ে। একটা রাত্রি অন্তত এখানে না থাকলে ঠিক মন ভরবে না। কিন্তু থাকব কোথায়? কাছেপিঠে থাকার মতো কোনও আশ্রয়স্থানই দেখতে পেলাম না। কয়েকজন মাঝিমাল্লা সেখানে ঘোরাফেরা করছিল। তাদের জিজ্ঞেস করতে কেউ কথার উত্তরই দিল না আমাদের। একজন শুধু বলল, “এখানে কেউ থাকে না বাবু। এখানে থাকার সেরকম ব্যবস্থা নেই। আপনারা কাঁথিতেই ফিরে যান।”

আমার সঙ্গে যে দু’জন বন্ধু ছিল তাদের একজনের নাম বিমান, অপরজনের নাম প্রশান্ত। বিমান বলল, “দেখুন আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি সমুদ্র দেখব বলে। তা আপনাদের নৌকোতেই আমাদের একটা রাত থাকার ব্যবস্থা করে দিন না!”

মাঝি বলল, “আমরা সন্ধের আগেই এখান থেকে চলে যাব। তা ছাড়া বিশ্বাস করুন, এ জায়গা ভাল নয়।”

“কেন, চুরি ডাকাতি হয়?”

“না না। কার কী আছে যে, চুরি ডাকাতি হবে? অন্য উপদ্রব হয় এখানে, আপনারা থাকতে পারবেন না। কেউ থাকে না এখানে।”

বিমান বলল, “অন্য উপদ্রব মানে ভূতের উপদ্রব তো? তা হলে শুনুন, ভূতে আমরা বিশ্বাস করি না। আর ভূত বলে যদি কিছু থাকেও, তা হলে আমাদের উপদ্রবে তারাই পালাবে এখানে থেকে।”

মাঝিটা এবার গম্ভীর মুখে তাকাল আমাদের দিকে। তারপর খুব রাগত স্বরে বলল, “বাবু, আমার মাথার চুল পেকে গেছে। আপনারা এখনও ছেলেমানুষ। অনেক আচ্ছা আচ্ছা লোককে দেখলুম আমি। ওনাদের সম্বন্ধে একটু ভেবেচিন্তে মন্তব্য করবেন। বুঝতে পারছি আপনাদের নিয়তিই আপনাদের মুখ দিয়ে এইসব বলাচ্ছে। তবু বলছি শহর বাজারে যা করেন এখানে কোনওরকম গোঁয়ার্তুমি করবার চেষ্টা করবেন না। এ বড় খারাপ জায়গা।”

বিমান বলল, “বেশ তো, পরীক্ষা হোক। আপনাদের কুসংস্কার বড়, না আমাদের সাহস।”

“যা ইচ্ছে করুন। আমি এখানকার ব্যাপার জানি বলেই সাবধান করে দিলুম আপনাদের। আর একটু পরেই পাড়ি দেব আমরা সাগর দ্বীপে। কেউ থাকব না এখানে, তখন মরবেন।” প্রশান্ত বলল, “সাগর দ্বীপ এখান থেকে কতদূর?”

“তা দূর আছে বইকী! বরং চলুন আপনারা আমাদের গ্রামে।”

“তাই কি পারি? এই ঝাউবনে আজ রাত্রে ভূতের সঙ্গে ডান্স না করে কী করে যাই বলুন?”

মাঝি আর আমাদের সঙ্গে কোনও কথা না বলে পাশের একটি নৌকোর পাটাতনে উঠে ভাত খেতে বসে গেল।

আমরা তখন নিজেদের মনে সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে দিঘামুখী হয়ে এগিয়ে চললাম। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর ঘন ঝাউবনের ভেতর হঠাৎ একটি দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়িটা হাল আমলের নয়। বহু পুরনো। দেখে কোনও রাজবাড়ি বলে মনে হল।

আমি বিমানকে বললাম, “ওই দেখ বিমান।”

বিমান বলল, “তাই তো রে! বাড়ি এখানে কোত্থেকে এল?”

প্রশান্ত বলল, “এগিয়ে চল তো দেখি। যদি এখানে কোথাও একটু থাকবার ব্যবস্থা ম্যানেজ করতে পারি।”

এমন সময় আমাদের পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “ওটা ভূতের বাড়ি।” আমরা পিছু ফিরে দেখলাম বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

কুচকুচে কালো গায়ের রং। পরনে হাফপ্যান্ট। সাদা সাদা দাঁত বের করে হাসছে। বিমান বলল, “তুমি কে বাবা, ঝাউবনের কেলেমানিক? তুমি নিজেই একটা ভূত নও তো?”

ছেলেটি বলল, “আমার নাম কেলেমানিক নাকি? আমার নাম তো বিশু।” “তা বিশুই হও আর শিশুই হও, ওই বাড়িটা কাদের?”

“রাজাদের। ও বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। ওটাকে সবাই ভূতের বাড়ি বলে। রাত্রে ওখানে কুকুর ডাকে। বন্দুকের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। নাচগান হয়।”

“বলিস কী রে! এত কিছু হয় এখানে?”

“হ্যাঁ গো। মিথ্যে কথা বলছি না।”

প্রশান্ত বলল, “আমরা ওই বাড়িতে এক রাত্রি থাকতে চাই।”

বিশু বলল, “কেউ পারে না তো তোমরা। শখ মন্দ নয়! ওঃ! কী বলে? আমার বাবা ওই বাড়ির বাগানের মালী ছিল, বাবাই থাকতে পারে না।”

“তুই কখনও থেকেছিস ওই বাড়িতে?”

“আগে বাবার সঙ্গে থেকেছি।”

আমি বললাম, “আমরা যদি এক রাত ওই বাড়িতে থাকি, তোর বাবাকে বলে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি আমাদের?”

“পারব। তবে এখানে কেউ থাকে না। যারা থাকে ভূতে তাদের গলা টিপে মেরে ফেলে।”

বিমান বলল, “গুল মারবার জায়গা পাসনি ব্যাটা? কেউ যদি থাকেই না তো ভূতে গলাটা টেপে কার? তোর?”

বিশু এ-কথার উত্তর দিতে পারল না।

প্রশান্ত বলল, “এই বাড়িতে থেকে তুই কাউকে মরতে দেখেছিস?”

“না।”

“তবে চল। তোর বাবার কাছে নিয়ে চল আমাদের। তোর বাবা ব্যবস্থা করে দিলে এই বাড়িতেই আমরা রাত্রিবাস করব আজ।”

বিশু আমাদের ওর পিছু পিছু আসতে বলে ঝাউবনের বাইরে এল। তারপর ডানদিকের পথ ধরে কিছুটা এগোতেই দেখা গেল একজন বুড়ো মতো লোক জঙ্গল থেকে ঘাস কেটে

থলির বস্তায় পুরছে। বিশু বুড়োর কাছে গিয়ে কানে কানে কী যেন বলল।

বুড়ো তাড়াতাড়ি বস্তা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি ওই রাজবাড়ির বাগানের মালী ছিলেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আমরা জুনপুট বেড়াতে এসেছি। কিন্তু এখানে কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। আপনি কি পারেন ওই বাড়িটাতে আমাদের এক রাত্রি থাকার ব্যবস্থা করে দিতে?”

“কেন পারব না? বাড়ির চাবি তো আমার কাছে। তবে কি জানেন, ও বাড়িতে থাকা

উচিত নয়। ওটা ভূতের বাড়ি। ও বাড়িতে এক রাত কেউ থাকলে সে পাগল হয়ে যায়।”

“ওই বাড়িতে থেকে পাগল হয়ে গেছে এমন কাউকে আপনি দেখাতে পারবেন?” “না।”

“তবে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”

বুড়ো বলল, “তা আমি বলি কি বাবু, আপনারা কাঁথিতেই ফিরে যান। এখানে রাত্রিবাস করবেন না।”

প্রশান্ত বলল, “কেন, ওখানে কোনও দলের গোপন আড্ডা হয় বোধ হয়?”

“না বাবু। গভীর রাতে ও বাড়িতে আলো জ্বলে। নাচগান হয়। বন্দুকের শব্দ শোনা যায়।”

আমি বললাম, “গুষ্টির মাথা হয়।”

প্রশান্ত বলল, “তবে হ্যাঁ, তুমি চাবি দিলে আজ রাত্রে ও বাড়িতে সত্যিই আলো জ্বলবে। নাচগান হবে। বন্দুকের আওয়াজ অবশ্য শোনাতে পারব না। আর এও দেখে রেখো, এই শেষ রাত। আমরা তিনজনে আজ সারারাত ধরে এমন ভূতের নাচ নাচব যে আর কখনও ওই বাড়িতে ভূতের উপদ্রবই হবে না।”

বুড়ো বলল, “এক মিনিট দাঁড়ান আপনারা।” বলে, হনহন করে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এল একটা চাবির গোছা নিয়ে। বলল, “নিন চাবি। কাল কখন ফিরবেন আপনারা?”

“তা ধরুন ভোরবেলা।”

“ঠিক আছে। আমি এখানেই থাকব। না থাকি বিশু থাকবে। চাবিগুলো ফেরত দিয়ে যাবেন। আর একটা কথা, ঘরের জিনিসপত্তরে দয়া করে হাত দেবেন না, বাগানের ফুল ছিঁড়বেন না।”

আমি বললাম, “না না, ওসব কিছু করব না আমরা।” তারপর বললাম, “আচ্ছা এখন তো বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। এখানে খাওয়াদাওয়ার কী ব্যবস্থা করা যায়?”

আপনারা। কোনও বাড়িতে টাকাপয়সা দিয়ে দেবেন, ওরাই রেঁধে দেবে। ফেরার সময় কারও কাছ থেকে একটা হারিকেন চেয়ে আনবেন।”

“যান না, গ্রামে যান।”

“আমাদের কাছে মোমবাতি আছে।”

“তা হলে তো খুব ভাল।”

আমরা চাবির গোছাটা সঙ্গে নিয়ে প্রথমেই চলে গেলাম জুনপুট গ্রামে আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে। এবং রাতের আহার সংগ্রহ করতে। যাওয়ার সময় দেখলাম সেই মাঝিরা তখন নোঙর খুলে সাগর দ্বীপে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমরা তাদের যাত্রাপথের দিকে চেয়ে থাকলেও তারা কিন্তু ফিরেও তাকাল না আমাদের দিকে।

গ্রামে গিয়ে আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে রাতের জন্য কিছু মুড়ি আর রসগোল্লা নিয়ে আবার সমুদ্র সৈকতে ফিরে এলাম। সমুদ্র এখন আরও অশান্ত। আরও উত্তাল। যত জোরে হাওয়া বইছে সমুদ্র ততই ফুলছে। আমরা বালুচরের গা ঘেঁষে ঝাউবনে ঢুকলাম।

বিশু আমাদের দেখেই ছুটে এল। তারপর আমাদের আগে আগে চলতে লাগল সে। আমি বললাম, “কী রে ব্যাটা, বেশ তো মনের আনন্দে নাচতে নাচতে যাচ্ছিস। ভয় করছে না?”

বিশু বলল, “ভয় করবে কেন? আপনারা তো আছেন। তা ছাড়া দিনের বেলা ওখানে কিছু হয় না, ভূত আসে রাত্রিবেলা।”

“তোরা দিনের বেলা ঢুকিস ওখানে?”

“আমরা কোনও সময়ই ঢুকি না।”

যাই হোক, আমরা সেই পুরনো রাজবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বড় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মস্ত দোতলা বাড়ি। গেটের তালাটার অবস্থা দেখে মনে হল বেশ কয়েক বছর খোলা হয়নি এর দরজা। আমরা বহু কষ্টে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘন ঘাস ও আগাছায় ভরে আছে চারদিক। আর চাঁপা, গন্ধরাজ ও ম্যাগনোলিয়ার গন্ধে ম ম করছে। আমরা ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। বাড়িটা বাইরে যেমন পোড়ো বলে মনে হয়, ভেতরে কিন্তু তা নয়। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মনে হল দিনকতক আগে বুঝি কেউ এসে এখানে থেকে গেছে।

আমরা নীচের তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম। নীচে-ওপর মিলে মোট দশখানা ঘর রয়েছে এ বাড়িতে। বড় বড় ঘর। মাঝখানে একটি হলঘর। বিশু বলল, “এটা রাজাবাবুদের জলসাঘর।”

আমি বললাম, “এই ঘর থেকেই তা হলে গানবাজনার আওয়াজ শোনা যায়?”

“হ্যাঁ।”

এই ঘরটি ছাড়া প্রায় সব ঘরই খাট আলমারি এবং নানারকমের দামি জিনিস দিয়ে সাজানো। খাটের ওপর পুরু গদি। দুধসাধা বেডশিট দিয়ে ঢাকা। যেন এইমাত্র পেতে রেখেছে কেউ। কোথাও এতটুকু ধুলোর আস্তরণ নেই।

বিমান বলল, “রহস্যটা বুঝতে পারছিস? আসলে ভূতটূত কিছু নয়। এই বাড়ি রীতিমতো গোপনে ব্যবহার করা হয়। আর গ্রামের লোকেরা মনে করে ভূতের উপদ্রব হচ্ছে।” বিশু বলল, “আপনারা বিশ্বাস করছ না তো? থাকো না রাত্রিবেলা, তারপর বুঝবে।”

প্রশান্ত বলল, “ভূত যদি থাকে তা হলে আমাদের সঙ্গে দেখা হবেই। আমরা আজ সারা রাত ধরে ভূতেদের সঙ্গে এই জলসাঘরে নাচগান করব। তারপর কাল সকাল হলেই ভূতগুলোকে ধরে সোজা নিয়ে যাব তোদের গ্রামে।”

আমি বললুম, “তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি বিশু? তা হলে দেখবি ভূতগুলোকে কী রকম জব্দ করব আজ।”

বিশু বলল, “না বাবা। দরকার নেই।”

বিমান বলল, “তুই থাকলে হত কি, তোকে দেখেই ভূত পালাত। যা কালো তুই ! ভূতেরা বোধ হয় তোর চেয়ে ফরসা। ভূত এলেই আমরা তোকে দেখিয়ে বলতাম, এই দেখ তোদের বাচ্চাকে আমরা ধরে রেখেছি।”

বিশু বলল, “না, এ বাড়িতে কিছুতেই থাকব না।”

আমরা খাবারগুলো ঘরের ভেতর রেখে ওয়াটার বটলটা দেওয়ালের হুকে ঝুলিয়ে আবার চললাম সমুদ্রতীরে। কেননা সন্ধে হতে এখনও অনেক দেরি। কী করব অতক্ষণ ওই বাড়িতে চুপচাপ বসে থেকে? বিশেষ করে সারাটা রাত যখন ওই বাড়িতে থাকতেই হবে আমাদের। তার চেয়ে সি-বিচে গিয়ে একটু ঘুরে বেড়ালে সমুদ্রের অনেক নতুন নতুন রূপ দেখতে পাব। ঝাউবনে ঝাউয়ের হাহাকার শুনতে পাব। আসলে সমুদ্রদর্শনের জন্যই তো আমাদের এখানে আসা।

সমুদ্রে এখন ভাটার টান। জল যত সরে যাচ্ছে ততই বিভিন্ন রকমের ঝিনুকের খোলার বহর দেখা যাচ্ছে। আমরা কাড়াকাড়ি করে সেইসব ঝিনুক কুড়োতে লাগলাম। এমন সময় দেখি আমাদের অদূরেই সেই নির্জন বালুচরে এক সুন্দরী মহিলা নিজের মনেই ঝিনুক কুড়িয়ে চলেছেন। দেখে বেশ বড় ঘরের বউ বলেই মনে হল। এ মহিলা এখানে এলেন কোত্থেকে?

হঠাৎ ঝাউবনের ভেতর থেকে এক স্মার্ট যুবককে বেরিয়ে আসতে দেখলাম! তিনি আমাদের দেখে দূর থেকে বললেন, “এই যে ভায়ারা, শুনছেন?”

যাক, মহিলা তা হলে একা নন। আমরা তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম।

যুবক আমাদের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললেন, “আপনারা কি তারাই নাকি মশাই?”

“কারা?”

“মানে যারা নাকি ওই ভূতের বাড়িতে রাত কাটাতে চান?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আপনারা কি সত্যিই ও বাড়িতে থাকবেন?”

“তা ছাড়া উপায় কী বলুন? এখানে সমুদ্রের ধারে ওই বাড়িটা ছাড়া আর তো রাত্রিবাসের উপযোগী কিছুই দেখছি না। এখন গ্রীষ্মকাল। ইচ্ছে করলে আমরা এই ঝাউবনে বা বালির চড়াতে রাত কাটাতে পারতাম। তবে ভয়টা তো ভূতের নয়। ধরুন যদি সাপে কামড়ায়। সাপকে ভয় করি। তাই সাহসে ভর করে ওই বাড়িতেই রাত কাটাব আমরা। তা ছাড়া এও একটা অ্যাডভেঞ্চার। ভূতের গল্প অনেক শুনেছি। কিন্তু ভূতকে চাক্ষুষ কখনও দেখিনি। তাই জেদের বশে থাকছি ওই বাড়িতে। ভূত যদি থাকেও, এই সুযোগে তাঁর দেখাটা পেয়ে যাব।”

যুবক উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তা হলে ভাই একটা কথা বলব?” “বলুন।”

“আজ রাত্রে ওই বাড়িতে আমাদেরকেও আপনাদের সঙ্গী করে নেবেন?”

“সে কী! ভয় করবে না আপনাদের?”

“আমরা দু’জনে হলে ভয় করত! কিন্তু আপনারা যখন আছেন তখন ভয় কী?” আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, “দেখুন যতই সাহসে ভর করে থাকি না কেন, তবু আমরা তিনজন। আপনাদের পেয়ে আমাদেরও বুকে বল এল। আর কিছু না হোক, সারারাত গল্প করেও তো কাটাতে পারব।”

যুবক অদূরে ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত থাকা মহিলাকে ডাকলেন, “স্বাতী, একবার শুনে যাও।”

মহিলা এক কোঁচড় ঝিনুক নিয়ে এগিয়ে এলেন।

“এঁরাই সেই তিনজন। যাঁরা ওই বাড়িতে রাত্রিবাস করতে যাচ্ছেন। আমি এঁদের রাজি করিয়েছি আমাদের সঙ্গে নিতে।”

মহিলা খুব খুশি হয়ে বললেন, “অজস্র ধন্যবাদ।”

আমি বললাম, “আপনার ভয় করবে না?”

“না ভাই। অত আমার ভূতের ভয় নেই। বিশেষ করে আপনাদের মতো ভাইদের সঙ্গে পেলে আমি এক রাত কেন দশ রাত ও বাড়িতে কাটাতে পারি।”

আমি বললাম, “খুব ভাল হল। আমরা অবশ্য কাল সকালেই কাঁথি চলে যাব। কিন্তু আমরা যে ওই বাড়িতে রাত্রিবাস করতে যাচ্ছি এ-কথা কে বলল আপনাদের?” “সবাই বলছে। সবাই জেনে গেছে আপনারা আজ ওই বাড়ির অতিথি।”

এমন সময় বিশু এল ছুটতে ছুটতে, “আমি বলেছি গো।”

অদূরে মালীবুড়োকেও দেখা গেল। মালীবুড়ো ঘাসের বোঝা মাথায় নিয়ে কাছে এসে বলল, “এই তো, এনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে দেখছি। তা ভালই হয়েছে। দল বেঁধে থাকুন। তবে আমি এখনও বলছি, যা করছেন ঠিক করছেন না।” সূর্য তখন অস্ত গেল।

মালীবুড়ো বলল, “যান। একান্তই যাবেন যখন তখন এইবেলা চলে যান। আর দেরি করবেন না।”

বিশু হঠাৎ বলল, “বাবা আমি যাব ওদের সঙ্গে?”

মালীবুড়ো লাফিয়ে উঠল, “খবরদার! ওই বাড়িতে কেউ যায়? তুই যদি যাস তো আমার যেতে আপত্তি কী?”

বিমান হঠাৎ ধরে বসল, “আচ্ছা, কেন আপনারা অহেতুক ভয় পেয়ে এত ভীত হচ্ছেন! কবে কী হয়েছে তা কে জানে? আমরা এতজন যখন আছি তখন ভয় কী? আমাদের সঙ্গে একজন মহিলা রয়েছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন না, আর আপনি ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন? আপনি নিজে এক রাত থেকেই দেখুন না! তা হলেই প্রমাণ হয়ে যাবে, ভূত আছে কি নেই!”

“কিন্তু বাবু, ওই বাড়ির ভেতর থেকে গানবাজনার আওয়াজ আমি নিজের কানে শুনেছি। একটা কুকুর কী সাংঘাতিক রকমের চিৎকার করে ডেকে ওঠে। রাতের অন্ধকারে ওই বাড়ির ভেতর আলো জ্বলে।”

“সেইজন্যই তো বলছি, আজ রাত্তিরে আমাদের সঙ্গে থেকে আপনি নিজের চোখেই দেখে আসবেন ওখানে কী হয় না হয়।”

মালীবুড়ো একটু ভেবে বলল, “আবার ওই বাড়িতে আপনারা আমাদের ঢোকাবেন? ঠিক আছে, আপনারা যান। আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে রাত্রে শোওয়ার সময় যাব।”

“যাক, পথে এসেছেন দেখছি, ভূত থাকলেও ভূত আপনার কী করবেটা শুনি? গলা টিপে মেরে ফেলবে এই তো? যদি মেরেই ফেলে, তাতেই বা হয়েছেটা কী? বলি, বয়স তো যথেষ্ট হয়েছে। আর কতদিন বাঁচবেন?”

মালীবুড়ো বলল, “যান। তাড়াতাড়ি যান। ফটকটা খোলা রাখবেন। আমরা সময়মতো যাব।”

মালীবুড়োকে বিদায় দিয়ে আমরা পাঁচজনে ঝাউবনের ভেতরে সেই পোড়ো বাড়িতে এসে ঢুকলাম। সঙ্গে টর্চ ছিল। টর্চের আলোয় পথ দেখে দোতলায় উঠে পাশাপাশি দুটো ঘর নিয়ে নিলাম আমরা। বাতি জ্বাললাম।

মহিলা তো ঘর দেখে দারুণ খুশি, “অ্যাঁ! এমন চমৎকার ঘর। খাট বিছানা। রাজবাড়ি একটা। এরা বলে কিনা ভূতের বাড়ি! আমার তো মনে হচ্ছে সারাজীবন এইখানেই থেকে যাই।”

আমি বললাম, “সত্যি! কী সংস্কার বলুন তো মানুষের?”

এর পর আমরা গোটা বাড়িটাতে দাপিয়ে বেড়ালাম প্রায়। তারপর সিঁড়ির দরজা খুলে সবাই মিলে ছাদে উঠলাম। আঃ, কী শান্তি! মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত কালো আকাশ। আমি রাতের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললাম, “ভূত বাবাজি, আমরা আজ রাত্রে আপনাদের অতিথি। আপনারা কোথায়?”

মহিলা খিলখিল করে হেসে জোরে উত্তর দিলেন, “সাড়া দেব না।”

আমি হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে বললাম, “তা বললে কী হয়? বলুন না কোথায়?” মহিলা হেসে লুটোপুটি খেতে-খেতেই উত্তর দিলেন “আমি এইখানে। আপনাদের সামনে।”

“আপনার নামটা জানাবেন দয়া করে।”

“হ্যাঁ। আমার নাম স্বাতী।”

যুবকও অমনই হাসতে হাসতে বললেন, “আমার নামটাও জেনে নিন। আমার নাম অরুণকুমার।”

এবার আমরা সকলেই হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লাম। আমি বললাম, “যাক, আজ রাত্রে আমরাই তা হলে ভূতের ভূমিকায় অভিনয় করব।”

যুবক অর্থাৎ অরুণকুমার বললেন, “সত্যি, আপনাদের পেয়ে যে কী ভাল লাগছে আমাদের! না হলে আমরা দু’জনে তো হাঁফিয়ে উঠছিলাম।”

স্বাতীদি বললেন, “চলুন। বেশি রাত করে লাভ নেই। খাওয়াদাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। আমাদের টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি লুচি আর মাংস আছে।” “আমরাও মুড়ি মিষ্টি নিয়ে এসেছি।”

স্বাতীদি ঠোঁট উলটে বললেন, “এ রাম! মুড়ি কে খাবে? মুড়ি আমি খেতে পারি না। তার চেয়ে মিষ্টিগুলো বরং কাজে লাগান। আপনারা বসুন। আমি টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে আসছি।”

আমি বললাম, “না না, স্বাতীদি। একলা যাবেন না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান। প্রশান্ত তুই বরং যা।”

“কোনও দরকার নেই। এত ভূতের ভয় করি না আমি। তা বলছিলাম কি, আপনাদের সঙ্গে খাবার জল আছে তো?”

“আছে। আমাদের ঘরে দেওয়ালের হুকে ওয়াটার বটলটা ঝুলিয়ে রেখে এসেছি।” স্বাতীদি সিঁড়ির দরজার কাছে যেতেই আমি আবার বাধা দিলাম, “শুনুন, একলা যাবেন না কিন্তু।”

স্বাতীদি হেসে বললেন, “আমি একলাই যাব।”

আমি অরুণবাবুকে বললাম, “দাদা ওঁর কথা শুনবেন না। আপনিই বরং ওঁর সঙ্গে যান। বলা যায় না তো, যদি কিছু দেখে ভয়টয় পান।”

অরুণবাবু বললেন, “ঠিক।” বলে স্বাতীদির সঙ্গে গেলেন।

একটু পরেই সবকিছু নিয়ে ওপরে উঠে এলেন ওঁরা। তারপর ছাদে বসে বেশ জুত করে লুচি, মাংস আর রসগোল্লা খেলাম। খেয়ে জলটল খেয়ে ঘড়ি দেখলাম, রাত বারোটা। স্বাতীদি বললেন, “আর ছাদে নয়। এবার নীচে চলুন। ওঃ, কী আনন্দের দিন আজ।

আমার চোখে তো একটুও ঘুম আসছে না। চলুন, এবার আমরাই সারারাত ধরে গান গেয়ে, চেঁচিয়ে, হল্লা করে ভূতের উপদ্রব করি। এমন উপদ্রব করব যে, ভূত বলে যদি কিছু থাকেও, তারাও ভয়ে পালাবে।”

বিমান বলল, “ঠিক কথা।”

আমরা যেই উঠতে যাব অমনই কোথা থেকে একটা কেঁদো কুকুর এসে হাজির হল সেখানে।

স্বাতীদি লাফিয়ে উঠলেন, “ও মা! এ কী! এ কী! এখানে কুকুর এল কোথা থেকে?” কুকুরটা তখন স্বাতীদির পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খেতে লাগল।

প্রশান্ত বলল, “এই হচ্ছে তা হলে পোড়ো বাড়ির ভূত। রাত্রিবেলা চেঁচাবে আর লোকে ভাববে ভূতে ডাকছে।”

কুকুরটা এবার স্বাতীদিকে ছেড়ে আমাদের এঁটো পাতাগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর কড়মড় করে মাংসের হাড়গুলো খেতে লাগল চিবিয়ে। আমরা কুকুরটাকে ছাদে রেখেই সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে নেমে এলাম।

নেমে এসেই দেখি আমাদের ঘরের পাশে মালীবুড়ো আর বিশু চুপচাপ বসে আছে। স্বাতীদি বললেন, “এই তোমরা এখানে কেন? যাও, নীচের ঘরে যাও। এখানে আমরা শোবো, হল্লা করব। সারারাত ঘুমোতে পারবে না তোমরা।’ “”

আমি মালীবুড়োকে বললাম, “হ্যাঁ, স্বাতীদি ঠিকই বলেছেন। তোমরা নীচের ঘরেই যাও। নইলে আমাদের দাপাদাপিতে তোমরা অস্থির হয়ে উঠবে।” তারপর বিশুকে বললাম, “কী রে ব্যাটা, কেমন বুঝছিস?”

বিশু হেসে বলল, “আপনারা শহরের লোক। সাহস আছে আপনাদের।” “যা, এবার নীচের ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমোগে যা। ভয় পেলে ডাকিস।’ মালীবুড়ো হঠাৎ বলল, “জলসাঘরের দরজা খুলল কে?” ”

“আমরা খুলেছি।”

“ওটা এখুনি বন্ধ করে দিন।”

স্বাতীদি বললেন, “থাক না খোলা। আজ রাত্রে আমরাই যদি এখানে গানবাজনা করি?” মালীবুড়ো স্বাতীদির কথার উত্তর না নিয়ে বলল, “এই ঘর অভিশপ্ত। এ ঘরের দরজা খুলবেন না। কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে চলে যান এখান থেকে।”

আমি বললাম, “না। আজ আর কোনও ঘরই বন্ধ নয়। সব ঘরের দরজাই খুলে দেব আমরা। এই বাড়ির অভিশাপ আজ আমরা কাটাবই।”

“আপনাদের এখানে থাকতে দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছিল। ঠিক আছে, যা ভাল বোঝেন করুন।” বলে মালীবুড়ো বিশুকে নিয়ে চলে গেল।

ওরা চলে গেলে আমরা কেউ আর শোওয়ার ঘরে না ঢুকে জলসাঘরে ঢুকলাম। বিমান রসিকতা করে বলল, “এই তা হলে জলসাঘর! এই ঘরেই একসময় নাচগানের ফোয়ারা ছুটত? তা যারা সেসব করত তারা কোথায় লুকোলে বাবারা? শোনাও না একটু তোমাদের গানবাজনা?”

স্বাতীদি বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক কথা। এই পোড়ো বাড়িতে, আমরা যাদের অতিথি হয়ে এসেছি তারা কেন আমাদের সঙ্গে এইরকম করছে? যা হোক শোনানো উচিত।”

প্রশান্ত বলল, “যদি অশরীরী কেউ থাকো এই বাড়িতে, তা হলে আমি এক-দুই-তিন বলছি। তিন বলার সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দেবে। নইলে জানব এখানে কেউ নেই। সব ভাঁওতা।” বলেই প্রশান্ত হাঁক দিল, “এক-দুই-তিন।”

কিন্তু না। কোনও সাড়াশব্দই কোথাও থেকে এল না।

প্রশান্ত বলল, “তা হলে আমরাই শুরু করি। আজ রাতে জলসাঘর আবার ভরে উঠুক গানে গানে।”

একটা বাংলা সিনেমার গান দিয়ে শুরু হল। প্রথম লাইনটা প্রশান্ত ধরতেই সুরে সুর মিলিয়ে আমি কণ্ঠ দিলাম। তারপর বিমান। বিমানের দেখাদেখি স্বাতীদিও সুরেলা গলায় গান ধরল। অরুণবাবুও চুপ করে রইলেন না। সবক’টা কণ্ঠ একত্রিত হয়ে জলসাঘর ভরিয়ে তুলল একেবারে।

গান শেষ হলে আমরা হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লাম।

রাত তখন একটা।

প্রশান্ত বলল, “আর কি! এবার শুয়ে পড়া যাক।”

স্বাতীদি অবাক হয়ে বললেন, “ওমা, শোবে কী! শোওয়ার পরে যদি চুপি চুপি ভূতেরা আসে? আজ কোনও শোওয়া-টোয়া নয়। আজ শুধু রাত জেগে ভূতের জন্য অপেক্ষা করা।”

বিমান বলল, “ঠিক। শুলেই গোলমাল। তার চেয়ে আমি বলি কি, স্বাতীদি, আপনি একটা গান ধরুন। খুব ভাল গলা আপনার।”

স্বাতীদি বললেন, “একা একা শুধু গলায় কি গান হয়? বেশ হত যদি একটা হারমোনিয়াম থাকত।”

অরুণবাবু বললেন, “এই তো, ঘরের কোণে একটা হারমোনিয়াম রয়েছে দেখছি।”

স্বাতীদি বললেন, “করেকার পুরনো। ওতে আওয়াজ বেরোবে?” বলে হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে রিডগুলো টিপে দেখতেই সুরে সুরে ঘর ভরে গেল। হঠাৎ বিছে কামড়ালে যেমন হয় ঠিক সেইভাবে লাফিয়ে উঠলেন স্বাতীদি, “এ কী এ কী! আমার সারা গা জ্বলে যাচ্ছে কেন? আমার যেন কীরকম হচ্ছে। বড় কষ্ট হচ্ছে আমার।”

অরুণবাবু উঠে গিয়ে স্বাতীদিকে ধরলেন, “না না ও কিছু নয়। কী কষ্ট হচ্ছে? আসলে সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছ। রাত জেগে হইহল্লা করছ। একটু শুয়ে থাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিন্তু বললেই কি হয়? স্বাতীদির গলা থেকে একটা চাপা আর্তস্বর বেরিয়ে এল, “আ-আ-আঃ।”

সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভে গেল। গোটা ঘর ভরে গেল অন্ধকারে। বাইরে চাঁপাগাছের ডালে একটা নিশাচর পাখি ডাকল। হঠাৎ ফুলের গন্ধে ভরা একঝলক মিষ্টি বাতাস বয়ে গেল আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে।

পরক্ষণেই আলোয় ভরে উঠল গোটা ঘর।

কিন্তু এ কী! এ কী দেখছি আমরা!

দেখলাম জলসাঘরের মাঝখানে শলমা চুমকির পোশাক পরে রাজনর্তকীর সাজে সজ্জিতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বাতীদি। আমাদের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসছেন। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠনের আলোর বন্যা বইছে। একপাশে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে রাজপোশাক পরে সুরাপাত্র হাতে অরুণকুমার। যেন রুপোলি পর্দার কোনও ছায়াছবির দৃশ্য দেখছি আমরা। স্বাতীদি আমাদের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়েই পায়ের ঘুঙুর বাজিয়ে হাতে তাল দিলেন— তা থেই তা তা থেই। অমনই নেপথ্যে এক সুরেলা হারমোনিয়াম দ্রুত লয়ে বেজে উঠল। সেই সুরে সুর মিলিয়ে ওস্তাদি গানের সঙ্গে জলদে উঠল তবলার লহরা। তারপর ত্রিতাল ঠেকার তালে তালে শুরু হল নাচের ঘূর্ণি।

আমরা বিস্মিত, বিমূঢ়, স্তব্ধ।

হঠাৎ সেই নাচগানের মাঝখানে চেঁচিয়ে উঠলেন অরুণকুমার, “এ কী! তুমি! তোমাকে কে এখানে আসতে বলেছে? বন্ধ করো এই গান। নাচ থামাও। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তুমি ঘরের বউ হয়ে…।”

স্বাতীদি বললেন, “না। শুনতেই হবে তোমাকে। আজ আমি সারারাত ধরে নাচব গাইব। আমাকে নাচতে দাও! আমাকে গাইতে দাও।”

“খবরদার বলছি। আমার কথা অমান্য করার পরিণাম কি তা জানো?”

“জানি। তুমি আমাকে গুলি করে মারবে, এই তো? মারো—মারো আমাকে। দেখব তোমার বন্দুকে কত গুলি আছে! এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল।”

বলার সঙ্গে-সঙ্গেই অরুণকুমার উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দেওয়ালে আটকানো বন্দুকটা নিয়ে এসেই উঁচিয়ে ধরলেন স্বাতীদির দিকে।

আমরা চিৎকার করে উঠলাম, “আরে আরে! এ কী করছেন? আপনি কি সত্যি সত্যি গুলি করে মারবেন নাকি? অরুণবাবু!”

“সরে যাও। সরে যাও তোমরা। ওকে আমি শেষ করে দেব।”

ততক্ষণে বন্দুকের গুলি ছুটে গেছে।

স্বাতীদির বুক রক্তে ভেসে গেল। স্বাতীদি—আ-আ-আঃ করে ঘরের মেঝেয় লুটিয়ে পড়লেন।

বন্দুকের শব্দ শোনামাত্র ছাদের ওপর একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল হঠাৎ দেখা গেল কুকুরটা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাতীদির ওপর। এ কী করে সম্ভব! এ তো সেই কুকুরটা। যেটাকে আমরা ছাদে রেখে সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে নেমে এসেছি।

আবার গর্জে উঠল বন্দুক।

কুকুরটা আঁ-আঁ-আঁউ করে যন্ত্রণায় ককিয়ে স্থির হয়ে গেল।

অরুণকুমার হঠাৎ স্বাতীদির দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “এ কী! এ কী করলাম আমি। আমি কি সত্যি মেরে ফেললাম তোমাকে? স্বাতী, তুমি কথা বলছ না কেন?” এইসব চেঁচামেচি আর বন্দুকের শব্দ শুনে মালীবুড়ো ও বিশু ছুটে এসেছে ওপরে। ভয়ে বিবর্ণ মুখে দরজার একপাশে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মেঝেয় পড়ে থাকা রক্তাক্ত স্বাতীদির দিকে চেয়ে চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে যেন।

অরুণকুমার চোখ লাল করে বললেন, “তোরা এখানে কেন। কী চাই তোদের? মজা দেখতে এসেছিস?”

আতঙ্কে থমথম করছে ওদের মুখ। মালীবুড়ো কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “এ কী করলেন দাদাবাবু! আপনি সত্যি সত্যি মেরে ফেললেন বউদিমণিকে?”

“স্টপ ইয়োর ওয়ার্ড। ন্যুইসেন্স। তোদেরকেও আমি গুলি করে মারব! এই বাড়ির একটি প্রাণীকেও জীবিত রাখব না আমি। যেমন করে স্বাতীকে মেরেছি, ঠিক সেইভাবেই তোদেরকেও মারব।”

মালীবুড়ো আর বিশু তখন চোখের পলকে ছুটে পালাল সেখান থেকে।

অরুণকুমার বন্দুক উঁচিয়ে তাড়া করলেন ওদের, “কোথায় পালাবি বাছাধন?” (

আমরা বিস্মিত, বিমূঢ়। কী যে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না তার।

তবুও আমরা ছুটলাম ওদের পিছু পিছু। যে করেই হোক এই হত্যালীলা বন্ধ করতেই হবে। বিমল বলল, “কী হচ্ছে অরুণবাবু? আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আপনি কি জানেন খেয়ালের বশে কী কাণ্ড করেছেন আপনি? আমরা সবাই যে একধার থেকে অ্যারেস্ট হয়ে যাব।”

অরুণকুমার তখন বারান্দার কাছে ছুটে গেছেন।

বিশু এক লাফে গেট পার হয়ে গেল। কিন্তু মালীবুড়ো পারল না। যেই না গেটের কাছে আসা অমনই ওপর থেকে শব্দ হল ‘গুডুম’। মালীবুড়োর দেহটা ছিটকে পড়ল একটা ম্যাগনোলিয়া গাছের কাছে। কে জানে হয়তো এই গাছটা মালীবুড়োই একদিন যত্ন করে বসিয়েছিল নিজের হাতে।

অরুণকুমার এবার তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। আমরাও নামলাম ওঁর পিছু পিছু।

অরুণকুমার গেট পেরিয়ে ছুটে চললেন ঝাউবনের দিকে।

আমরাও ছুটছি।

ওই তো বিশু, সেও ছুটছে প্রাণের দায়ে।

ওকে বাঁচাতেই হবে।

অরুণকুমারের বন্দুক আবার গর্জে উঠল।

অসহায় বিশুর কাতর আর্তনাদ শোনা গেল

—আ-আ-আ।

অরুণবাবু ছুটে বিশুর কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে একবার দেখলেন ওকে। তারপর ওর বুকে একটা পা রেখে অল্প একটু চাপ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “শেষ হয়ে গেছে। আর একটিই মাত্র গুলি অবশিষ্ট আছে। সেটা আমি নিজের জন্য রাখলাম।

আপনারা ছেলেমানুষ। তার ওপর আমাদের অতিথি। সেইজন্যই কিছু বললাম না। তবে ভবিষ্যতে এই বাড়িতে আর কখনও রাত্রিবাস করবার চেষ্টা করবেন না। যান চলে যান।”

আমরা অতিকষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। ভোরবেলা গ্রামে পৌঁছে শুনলাম গতকাল আমরা বিশু, মালীবুড়ো, স্বাতীলেখা ও অরুণকুমার নামে যাদের দেখেছি তারা কেউ জীবিত নয়। ১৯৩০ সালের এক ভয়ঙ্কর রাতে কী এক অজ্ঞাত কারণে ওরা নাকি ওইভাবেই মারা গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *