কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট

কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট

হাওড়ার বিখ্যাত কালো সেনের নাম কে না শুনেছে? অতবড় একজন যাত্রাদলের ক্ল্যারিওনেট বাদক তখনকার দিনে আর কেউ ছিল না। কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট ছাড়া জমতই না কোনও যাত্রার আসর। তা সেই কালো সেন একবার ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন। কীরকম? শোন তা হলে গল্পটা! আমি শুনেছিলাম আমার মামা, যাত্রা জগতের এক দিকপাল অভিনেতা, চণ্ডী ব্যানার্জির কাছ থেকে।

সেবার মছলন্দপুরের কাছে কোনও এক গ্রাম থেকে যাত্রার বায়না এসেছিল আমাদের। কোনও এক গ্রাম বলছি এই কারণে যে, গ্রামের নামটা আমার ঠিক মনে নেই। তখন বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাস।

প্রচণ্ড গরমের দিন। সেই গ্রামে চব্বিশ প্রহরার হরিসভা উপলক্ষে যাত্রা। আমরা সবাই শিয়ালদা থেকে ট্রেনে রওনা হলাম মছলন্দপুরের দিকে। কয়লার ইঞ্জিনের গাড়ি। ঝিকি ঝিকি ঝিকি ঝিকি করে ছুটে চলল গাড়িটা। আমাদের দলের সমস্ত অভিনেতা এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা আছেন। নেই শুধু কালোদা। কালোদা আমাদের অনেক আগে সকালের গাড়িতে চলে গেছেন। তার কারণ এই লাইনেই কোথায় যেন তাঁর মেয়ের বাড়ি। তার সঙ্গে একটু দেখা করে মছলন্দপুর স্টেশনে হাজির হবেন এইরকমই কথা ছিল। তা ট্রেনে যেতে যেতে আমরা দেখতে পেলাম ঘন কালো একটা মেঘ ধীরে ধীরে আকাশটা ছেয়ে ফেলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে তখন। কিন্তু সেই বিকেলেও যেন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এল। তবে যে প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছিলাম আমরা, তার থেকে কিন্তু অব্যাহতি পেলাম। খানিক বাদেই ঝড় উঠল। কালবৈশাখীর ঝড়। ঝড়ের গোঁ গোঁ শব্দে মনে হল, ট্রেনটাকেও উড়িয়ে নেবে বুঝি! আমরা ধুলোর হাত থেকে বাঁচবার জন্য ট্রেনের জানলার কাচ উঠিয়ে দিলাম। একটু পরেই শুরু হল বৃষ্টি। সেইসঙ্গে ন্যাপথলিনের মতো শিল। যতদূর চোখ যায় শুধু বরফের আস্তরণ। তবু তারই মধ্যে আমরা সন্ধের মুখে মছলন্দপুরে ট্রেন থেকে নামলাম।

অত জল ঝড়েও দুটি গোরুর গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা স্টেশনের ওয়েটিংরুমে গিয়ে বসতেই যাত্রার আহ্বায়করা এসে দেখা করলেন আমাদের সঙ্গে।

বৃষ্টি তখনও পড়ছিল এবং বেশ ঝমঝমিয়ে। কাজেই সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরনোর কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবুও ওদের আহ্বায়ক দয়ালবাবু বললেন, “মহাশয়গণ ! আপনারা যে সেই কলকাতা থেকে এতদূরে গাওনা গাইতে এসেছেন এতে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবে দোহাই আপনাদের, এই দুর্যোগ দেখে ফিরে যাবেন না যেন। আজ রাতে না হয় কাল রাতেও গাওনা আমাদের হবেই। দুর্যোগের ব্যাপারে আমাদের তো কোনও হাত নেই। এসব হচ্ছে গিয়ে বিধির বিধান। তাই—”

আমরা বললাম, “না না। ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের কালোদাকে নিয়ে। কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট ছাড়া আমাদের যাত্রা তো জমবে না। তা সেই কালোদাই যে নেই।” “আসেন নাই তিনি!”

“না। এইখানেই কোথায় যেন তাঁর মেয়ের বাড়ি। উনি সকালের গাড়িতে মেয়ের বাড়িতে “

এসেছেন। কথা ছিল এই গাড়িতেই উনি আমাদের সঙ্গে এসে একসঙ্গে যাবেন। “তা। তার জন্য অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। যা দুর্যোগ গেল তাতে মনে হয় উনি ঠিক সময়ে এসে ট্রেন ধরতে পারেননি।”

“পরের গাড়ি কখন?”

“সে তো রাত বারোটায়।”

“সর্বনাশ! এখন তা হলে কী করা যাবে?”

“চিন্তার কিছু নাই আপনাদের, বৃষ্টি থামলে আপনারা এগিয়ে চলুন। তারপর যদি উনি রাত বারোটার গাড়িতে আসেন তা হলে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করে রাখব।” আমরা বললাম, “তা না হয় হল। কিন্তু যদি তিনি বারোটার গাড়িতেও না আসেন তা হলে? তা হলে কী হবে?”

“কী আর হবে বাবু? মানুষের সুখ অসুখ তো আছেই। একান্ত উনি আসতে না পারেন ক্ল্যারিওনেট বাজাবার লোক আমরা আশপাশের গ্রাম থেকেই ধরে আনব। মনের মতো হয়তো হবে না আপনাদের, তবু কাজটা তো চালিয়ে দেবে।”

আমরা এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। কেননা কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট ছাড়া আমাদের যাত্রার দলকে কেউ যে মেনে নেবে তা কিন্তু ভাবতেই পারিনি।

বেশ একটু রাত করেই বৃষ্টি থামল। বৃষ্টি থামলে আমাদেরও যাওয়ার পালা।

তা আমরা যখন যাওয়ার তোড়জোড় করছি তখন আমাদের অধিকারী মশাই বললেন, “দেখুন মশাইরা, রাত যখন হয়েই গেল, আর আজ রাতে যাত্রা হওয়ার যখন কোনও সম্ভাবনাই নেই, তখন আর একটু অপেক্ষা করে কালোদার জন্য বারোটার গাড়িটা দেখেই যদি রওনা দিই তো ক্ষতিটা কী? আমার মনে হয় সেটা করাই ভাল ! তাতে কালোদার কাছে আমাদের আন্তরিকতাটা বেশ ভালভাবেই প্রকাশ পাবে।”

অধিকারীর কথায় আমরা সবাই একমত। কেননা হাজার হলেও এটা একটা মানসিকতার ব্যাপার। এই দূর দেশে ভিন গাঁয়ে দুর্যোগের রাতে একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা না করে তাকে একা রেখে স্বার্থপরের মতো চলে যাওয়াতে কারও সায় ছিল না ! তাই বারোটার গাড়ি পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম।

কিন্তু না। অপেক্ষা করাটাই সার হল আমাদের। বারোটার গাড়িতেও কালোদা এলেন না। এটা কিন্তু একটা অঘটন। কেননা কালোদার অনুপস্থিতি এবং মধ্যরাতে সূর্যোদয় দুটোই অসম্ভব ব্যাপার। তবে কি কালোদার কিছু হল? শরীর খারাপ করল না তো? হাই প্রেসারের রোগী। বলা তো যায় না!

এমন সময় হঠাৎই এক চমকপ্রদ সংবাদ। এই ট্রেন থেকে এমন এক যাত্রী স্টেশনে নামলেন যিনি আমার পূর্বপরিচিত। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, “আরে চণ্ডীদা! এত রাতে চললে কোথায়?”

বললাম, “দেখতেই তো পাচ্ছ ভাই, যাত্রা গাইতে যাচ্ছি। তা জল ঝড়ের জন্য আটকে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”

“কী আশ্চর্য! ঝড় জল তো অনেকক্ষণ থেমে গেছে।”

“তা গেছে। তবে এর আগের গাড়িতে আমাদের সঙ্গে কালোদার আসার কথা ছিল। তিনি আসেননি। তাই লাস্ট ট্রেনের অপেক্ষায় কালোদার জন্য বসে ছিলাম আমরা।” “হায় কপাল! কালোদা আর আমি তো একসঙ্গেই এলাম। একই বগিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একটুর জন্য আগের গাড়িটা ধরতে পারেননি উনি। তাই দারুণ আফসোস করছিলেন। এমন সময় সানকিভাঙার মাঠে গাড়িটা সিগন্যাল না পেয়ে থেমে গেলে একজন সহযাত্রীর কথা শুনে নেমে পড়লেন উনি। তোমরা যে গ্রামে যাচ্ছ সেই গ্রাম নাকি ওখান থেকে মাত্র মাইল দুই দূরে।”

আমরা হায় হায় করতে লাগলাম।

কর্মকর্তারা বললেন, “সর্বনাশ হয়ে গেছে মশাই।”

অধিকারী বললেন, “কেন? কেন?”

সানকিভাঙার দু’মাইল দূরে আমাদের গ্রাম ঠিকই, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যতসব ঠ্যাঙাড়ে আর ডাকাতের ঘাঁটি ওইদিকে। ও-পথে গেলে ওদের নজর এড়ানো অসম্ভব। ভদ্রলোক তো দেখছি বেঘোরে মরবেন।”

আমি এবার ট্রেনের ভদ্রলোককে বললাম, “আপনি তো মশাই স্থানীয় লোক। কালোদা যখন পরের কথা শুনে নামলেন ওখানে, তখন আপনি কেন বাধা দিলেন না তাঁকে?”

“অনেক বারণ করেছিলাম চণ্ডীদা। কিন্তু উনি শুনলেন না। কী বললেন জানো? বললেন, আজই হবে আমার শিল্পীজীবনের পরীক্ষা। মৃত্যুর দূত যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আর আমার এই ক্ল্যারিওনেটের জাদুতে যদি তাকে মোহিত করতে না পারি, তা হলে বৃথাই আমার সাধনা। আমি এইখানেই নামব।”

কর্মকর্তারা বললেন, “বলেন কী মশাই! উনি তো দেখছি মহানুভব লোক। নিজের শিল্প সত্তার প্রতি এত বিশ্বাস? একটু ভয়ডর নেই?”

অধিকারী বললেন, “জাত শিল্পী কি ওসব ভয়ে ভীত হয় মশাই? আসলে এটা একটা গপাওয়ার।”

কর্মকর্তারা বললেন, “তবে আমাদের মনে হয় যে লোকটি ওঁকে সানকিভাঙায় নামিয়েছে সে নিশ্চয়ই ডাকাতের লোক। ডাকাত না হলে এত রাতে কেউ ওখানে নামবে না, বা কাউকে নামতেও বলবে না। আর এই ডাকাতদের জন্যই রোজ রাতের গাড়িগুলো ওখানে থামে। না থামানো ছাড়া উপায়ও নেই। ওদের কথা না শুনলে রেল কর্মচারীগুলোই আচমকা যখন-তখন মারধোর খেয়ে মরবে।”

যাক, কালোদার কপালে কী আছে তা ভগবানই জানেন, এখন আমরা ভালয় ভালয় গ্রামে গিয়ে পৌঁছতে পারলে বাঁচি! আমরা সবাই গোরুর গাড়িতে চাপলাম। এবং কাদামাটির পথ পার হয়ে অতিকষ্টে গ্রামেও পৌঁছলাম। চাঁদ ও তারায় আকাশ তখন ঝলমল করছে। দুর্যোগের চিহ্নমাত্র আর নেই। তবে এও সত্যি, কালোদা গিয়ে পৌঁছতে পারেননি।

আমাদের সকলেরই মনে একটা আতঙ্ক জেগে উঠল । কালোদা কি তা হলে সত্যিই ডাকাতের হাতে পড়লেন? তা যদি না পড়েন তা হলে এতক্ষণ কী করছেন কালোদা? যে পথে উনি এসেছেন সেই পথে আমরা পৌঁছবার অন্তত ঘণ্টা দুই আগে ওঁর পৌঁছে যাওয়ার কথা!

যাই হোক, সে রাত দেখতে দেখতে কেটে গেল।

পরদিন সকালে কালোদার খোঁজে লোক গেল সানকিভাঙার দিকে। কিন্তু না। কেউ কোনও খবরই দিতে পারল না কালোদার।

আমরা দুঃখভরা মনে সে রাতে যাত্রার আসরে নেমে পড়লাম। অদ্ভুত ব্যাপার! কনসার্ট বেজে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই শোনা গেল কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট। কী আশ্চর্য! কালো সেন নেই কিন্তু তার ক্ল্যারিওনেট বাজে কোত্থেকে? ক্ল্যারিওনেট অবশ্যই বাজছে! বাজাচ্ছে এক গ্রাম্য লোক। সে বলল, “মশাই বেসুরো বাজনদার বলে নেহাত নিরুপায় না হলে আমায় কেউ ডাকে না। কিন্তু এই আসরে বসে ক্ল্যারিওনেটে মুখ দেওয়ামাত্রই সুর যে কীভাবে বেজে উঠছে তা আমি বুঝতে পারছি না। আসলে এটা শুধু আমি আমার ঠোঁটেই ছুঁইয়ে রেখেছি কিন্তু আমি বাজাবার আগে আপন মনেই বেজে চলেছে ও।”

আমরা সত্যিই অবাক হলাম।

শুরু হল যাত্রা।

বাজতে লাগল ক্ল্যারিওনেট। সে কী অনবদ্য সুর! যেন মধু ঝরছে সুরে সুরে।

ভোরবেলা যাত্রা শেষ হল।

আমরা সে দিনটাও সেই গ্রামে বিশ্রাম নিলাম। তাই যাত্রা শেষ হওয়ার পর আমরা দু-তিনজন বন্ধু মিলে নিজেরাই একবার কালোদার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। সেই সানকিভাঙার মাঠের দিকে। এটা আমাদের কর্তব্য। আমরা তাঁর খোঁজখবর না নিয়ে ফিরে যাই কী করে?

সানকিভাঙার আশপাশের গ্রামের লোকেরা বলল, “বাবু! আমরা কুখ্যাত লোক। চুরি ডাকাতি আমরা করি বটে, তবে একজন শিল্পী লোককে আমরা শুধু শুধু মেরে ফেলব কেন? সে রাতে আমরা সবাই যাত্রার আসরেই ছিলাম। তারপর ঝড় জলে যে যেদিকে পেরেছি পালিয়েছি। আমাদের মনে হয় তিনি নিশ্চয়ই পথ ভুল করে অন্য কোথাও চলে গেছেন। কেননা সে রাতে ওঁকে পথ বলে দেওয়ার মতো লোকও তো কেউ এ গ্রামে ছিল না।”

কথাটা অবিশ্বাস্যও নয়। কিন্তু পথ ভুল করে কোথায়ই বা যেতে পারেন কালোদা? তবে কি কালোদা মারা গেছেন। তাঁর প্রেতাত্মাটা ট্রেনের ওই ভদ্রলোককে দেখা দিয়ে অন্যের কথা শুনে সানকিভাঙায় নেমে যান। এবং কালোদার প্রেতাত্মাই ওই আনাড়ি গ্রাম্য ক্ল্যারিওনেট বাদকের বংশীতে ভর করেন।

হঠাৎ এইরকম ভেবেচিন্তে ফিরে আসছি। হঠাৎই কানে এল সেই সুর। বেশ ভাল করে কান পেতে শুনলাম দূরাগত সেই বংশীধ্বনি।

আমার সঙ্গীদের বললাম, “শুনছিস?”

“শুনছি। কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট।”

ডাকাত গ্রামের লোকেরা বলল, “বাবু, এই বাঁশিটা কিন্তু পরশু ঝড়জলের রাত থেকেই একভাবে বেজে চলেছে। আমরা ভাবছি আপনাদের যাত্রাদলেই কেউ বোধ হয় বাজাচ্ছে। “কিন্তু শব্দটা আসছে কোনদিক থেকে?”

অনেক চেষ্টার পর সেই অস্পষ্ট সুরের উৎসের যখন দিকনির্ণয় করলাম তখন ওরা বলল, “বাবু ওদিকে তো ডহর। গভীর বন। ওদিকে যাবেন কী করে? ও বড় বিপজ্জনক জায়গা। সাপকাটি হয়ে মরবেন যে!”

আমরা বললাম, “তবু যাব।”

“তা হলে চলুন, শ্মশানের পাশ দিয়ে ঘুরে যাই।’

তা ভাগ্য ভালই বলতে হবে। হোগলার বন পার হয়ে সাপের কামড় এড়িয়ে শ্মশানের দিকে বাঁক নিতেই ক্ল্যারিওনেটের সুর প্রকট হল। আর শ্মশানের কাছাকাছি যেই না গেছি অমনই আনন্দে উল্লসিত হলাম আমরা।

সে কী অপূর্ব সুর !

কালো সেনের ক্ল্যারিওনেটের জাদুতে সেই বনাঞ্চলে নিভৃত শ্মশানে যেন মরা গাছে ফুল ফুটেছে।

আহা-হা। এই না হলে কালোদা!

আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি এক অদ্ভুত কাণ্ড! শ্মশানের পরিত্যক্ত একটি মাটির ঘরে দামি কার্পেটের আসনে রাজার পোশাক পরে বসে আছেন কালোদা। মাথায় উষ্ণীষ। কপালে চন্দন টিপ। গলায় গন্ধরাজের মালা! কালোদা মুদিত নয়নে এক মনে তাঁর ক্ল্যারিওনেট বাজিয়েই চলেছেন।

আমরা বিস্ময়ে হতবাক!

সবাই একজোটে ডাকলাম, “কালোদা?”

কালোদা শুনতেই পেলেন না আমাদের কথা।

আমরা আবার ডাকলাম, “কালোদা, আপনি এখানে বসে কী করছেন? আমরা যে চারদিকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা! কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট আরও মধুর সুরে বাজতে থাকে।

অবশেষে আমিই এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিলাম। আদর করে ডাকলাম, “কালোদা!” এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেলেন কালোদা।

আর কী আশ্চর্য ! আমি স্পর্শ করামাত্র সেই উষ্ণীষ, রাজপোশাক, দামি কার্পেটের আসন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। রইল শুধু গলায় গন্ধরাজের মালাটা।

কালোদা হতভম্ব হয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ কী! তোমরা! তোমরা এখানে কেন?”

“আপনি এখানে কেন?”

“আমি কোথায়?”

“আপনি শ্মশানে।”

“শ্মশানে! আমি মরে গেছি নাকি?”

“না। এখনও মরেননি। তবে আমরা না এলে মরে যেতেন।”

কালোদাকে আমরা ধরাধরি করে তুলে দাঁড় করালাম।

কালোদা বললেন, “কী ব্যাপার বলো তো? কী থেকে কীসব হয়ে গেল যেন! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আর বুঝে কাজ নেই। আপনাকে যে আমরা ফিরে পেয়েছি এই আমাদের বাপের ভাগ্যি! এখন চলুন আমাদের সঙ্গে। একটু চান খাওয়া করে সুস্থ হবেন।” কালোদা বললেন, “খাওয়া আমার যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু…!”

“পরে সব শুনব। এখন চলুন তো।”

আমরা কালোদাকে নিয়ে গ্রামে ফিরলাম। কালোদাকে ফিরে পেয়ে আমরা যত না খুশি তার চেয়ে বেশি খুশি যেন গ্রামবাসীরা। কেননা তারা সবাই একটা মস্তবড় বদনামের হাত থেকে বাঁচল।

কালোদাকে ফিরে পেয়ে ওঁর একটু সেবা-শুশ্রূষা করে জিজ্ঞেস করলাম, “একটু মনে করে দেখুন তো কালোদা, কী থেকে কী হল! মানে, আপনি কীভাবে ওই ভাঙা চালাঘরে গিয়ে ঢুকলেন?”

কালোদা বললেন, “হ্যাঁ! সব মনে পড়ছে আমার।” বলে তিনি যা বললেন তা হল এই:

সেদিন আমি যখন মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছি তখন পথে হঠাৎ ঝড় জলে আটকে গেলাম। সে কী দারুণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে যখন আমি স্টেশনে পৌঁছলাম তখন সবে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

কী আর করি? পরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পরের গাড়ি তিন ঘণ্টা পর। তবু বসেই রইলাম। তা গাড়ি এল। চাপলাম। সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ হতে তাঁরা বললেন, “আপনি বৃথাই চিন্তা করছেন। আজ রাতে এই পরিস্থিতিতে যাত্রা অসম্ভব! আপনি ধীরেসুস্থে নিশ্চিন্তে যান।”

আমি তাই চললাম।

হঠাৎ এক জায়গায় ট্রেনটা সিগন্যাল না পেয়ে থেমে গেল।

একজন সহযাত্রী বললেন, “এখান থেকে মাত্র দু’ মাইল হেঁটে গেলেই আপনার গন্তব্যস্থল। তবে কিনা জায়গাটা ভাল নয়। ডাকাতের আড্ডা এখানে। রাতে এ পথে যাওয়া অসম্ভব।”

আমি বললাম, “তা হলে আমি এইখানেই নামব।”

আমাকে অনেকেই ওখানে বারণ করলেন। কিন্তু আমি কারও কথাই শুনলাম না। আমি সেই অন্ধকারেই মাঠের মাঝখানে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম।

সবে দু-এক পা এসেছি এমন সময় দেখি মাঠের ওপর দিয়ে মশাল জ্বেলে একটা পালকি বেহারা সমেত এসে হাজির হল আমার সামনে। তারা বলল, “এত রাতে আপনি কোথায় যাবেন?”

আমি আমার পরিচয় দিতেই আনন্দে লাফাতে লাগল তারা। বলল, “আরে! আমরা তো আপনাকে নিতেই এসেছি।”

আমি বললাম, “কিন্তু আমি যে এখানে নামব তা আপনারা জানলেন কী করে?” “জানতাম। কেননা ট্রেন তো এখানে থামে। তাই ভাবলাম যদি আপনি বুদ্ধি করে নেমে

পড়েন তা হলে খুব ভাল হয়। আসুন, বসুন।”

আমি নির্ভয়ে চেপে বসলাম তাতেই!

এর পর ওরা আমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর কত কী যে খেতে দিল তার ঠিক নেই। খাওয়াদাওয়া হলে ওরা বলল, “আপনি অত্যন্ত গুণী লোক। আমাদের খুব ইচ্ছে যে প্রাণভরে আপনার একটু বাঁশি শুনি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনারা কারা?”

“আমরা যেই হই না কেন, আপনার কোনও ভয় নেই। আমরা কেউ কোনও ক্ষতি করব না আপনার। আপনি বাজান।”

আমি ক্ল্যারিওনেটে ফুঁ দিলাম।

আর সঙ্গে সঙ্গে দেখি কী এক অদ্ভুত কাণ্ড! শ্মশানের শ’ থেকে, গাছের ডাল থেকে, অন্ধকারের ভেতর থেকে দলে দলে সব ছায়ামূর্তিরা বেরিয়ে এসে নাচ শুরু করল। আমার পোশাক-পরিচ্ছদ সব পালটে গেল আর আমিও যেন কেমন হয়ে গেলাম। সারারাত ওরা নেচে নেচে ভোরবেলা মিলিয়ে গেল। এর পর দিনের আলোতেও আমি না পারলাম চোখ মেলতে, না পারলাম বাঁশি থামাতে। শুধু মাঝে মাঝেই শুনতে পেলাম, ‘বাজিয়ে যাও কালো সেন, বাজিয়ে যাও। এমন আমরা কখনও শুনিনি।’ এর পর দিন-শেষে সন্ধে হতেই আবার ওরা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে নাচ শুরু করল। আমি ক্ষুধা তৃষ্ণা সবকিছু ভুলে গেছি ভাই। তা এভাবে ক’দিন কেটেছে বলো তো?

আমরা সব বললাম। তারপর বললাম, “যে ক’দিনই কাটুক, ভগবানের দয়ায় আপনাকে যে ফিরে পেয়েছি এই ঢের! এখন ভালয় ভালয় পালাই তো চলুন।”

গ্রামবাসীদের সহায়তায় আমরা সেদিনই বিকেলের গাড়িতে কলকাতায় ফিরে এলাম, তবে এর পর থেকে কালোদা দল ছেড়ে একা একা কোথাও বাজাতে যাননি।
 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *