ফুলমণি-উপাখ্যান – ৭

প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে এলেন লেডি রাণু মুখার্জি।

এতদিন তাঁকে শুধু ছবিতেই দেখেছি। অসাধারণ রূপসী ছিলেন, এখন প্রচুর বয়েস হয়ে গেলেও সেই রূপের আভা যায়নি। একা একা আর চলাফেরা করতে পারেন না, সব সময় তাঁর সঙ্গে একজন সেবিকা থাকে, তবু নাকি তিনি আজও প্রত্যেকটি ছবির প্রদর্শনীতে আসেন। শিল্পের প্রতি এই ভালোবাসা তাঁর বর্ণময় জীবনকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

শিল্পী জগতের এই প্রবাদ-প্রতিমাকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলুম দূর থেকে।

সিরাজুল সাহেব এই প্রদর্শনীর শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন।

অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের তিনখানা ঘর জুড়ে চলছে এই প্ৰদৰ্শনী। মোট সতেরোজন শিল্পী, সকলেই যে বয়েসে নবীন তা নয়। কেউ কেউ এসেছে বারাসত, বনগাঁ, ঝাড়গ্রাম, দুর্গাপুর থেকে। তবে কলকাতার ছেলেমেয়েদের সংখ্যাই খুব বেশি। সতেরোজনের মধ্যে একজন শুধু অসুস্থ বলে আসতে পারে নি।

অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো ফুলমণিকে। আজও পায়ে সেই রবারের চটি, নীল পাড় সাদা শাড়ি, বিশেষত্বের এই যে আজ তার মাথার চুল ভালো ভাবে আঁচড়ানো, তাতে একগুচ্ছ সাদা ফুল গোঁজা।

ছোটপাহাড়ী থেকে এনে ফুলমণিকে আর কোথায় তুলব, চন্দনদার কথা মতন নিয়ে গিয়েছিলুম নীপা বউদির কাছে। নীপা বউদি বেশ আগ্রহ করেই ফুলমণিকে স্থান দিয়েছে। আজকাল সব মহিলাদের মধ্যেই একটু একটু উইমেন্‌ লিব-এর ছোঁয়া আছে, তাই একজন নারী হয়ে অন্য একটি নারীকে সাহায্য করতে নীপা বউদির কোনো কার্পণ্য নেই।

মুশকিল হয়েছিল লালুদাকে নিয়ে। এই সর্বঘটে কাঁঠালি কলাটি যথারীতি সে বাড়িতে উপস্থিত। ফুলমণি সম্পর্কে নীপা বউদির উৎসাহ দেখে লালুদা উৎসাহ চতুর্গুণ বেড়ে গেল। ফুলমণি দু’খানা মাত্র নীল-পাড় শাড়ি ছাড়া আর কিছুই আনেনি শুনে লালুদা লাফিয়ে উঠে বলল, সে কি, অত বড় আ একজিবিশানে যাবে, রেডি রাণু আসবেন, সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠানো দরকার তাহলে ওর তো জন্য একজোড়া বেনারসী কিনে আনি?

নীপা বউদি বললে, বেনারসী? কেন, ও কি বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি?

লালুদা বলল, তা হলে সিল্ক টাঙ্গাইল!

নীপা বউদি বলল, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি! ও অন্ত সেজেগুজে যাবে কেন? ওর যা স্বাভাবিক পোশাক, তা পরেই যাবে। তাতে ওর আত্মসম্মান বাড়বে।

–তা হলে এক সেট রুপোর গয়না কিনে আনা যাক। ওরা রুপোর গয়ন খুব পরে আমি দেখেছি!

—কোনো দরকার নেই। বেশি সাজগোজ করে ও যাবে কেন?

—আহা, বুঝছ না নীপা। লোকের চোখে পড়া দরকার, বুঝলে না, আজকাল পাবলিসিটির যুগ।

—ছবি ভালো লাগলেই লোকে ওকে চিনবে।

–তা হলে অন্তত কয়েকটা ভালো সাবান।

নীপা বউদির ধমক খেয়ে লালুদা শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হলো বটে, কিন্তু কোনে অছিলাতেই টাকা খরচ করার সুযোগ না পেয়ে মর্মাহত হলো খুব

নীপা বউদি যে ফুলমণির পোশাক নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেনি, তাতে আমিও খুশি হয়েছি। এক সাঁওতাল গ্রামের মেয়ে কেন কলকাতার মেয়েদের মত সাজতে যাবে। ওর নিজের পোশাকই তো ওর অহংকার। ও যেমন, ঠিক তেমনই ওকে মানবে।

এখন যে ফুলমণি অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ওকে একটুও বেমানান লাগছে না। পোশাক নয়, আসল তো মুখ। নিরক্ষর, গ্রাম্য মেয়ে হলেও ফুলমণি বোকা নয়। শিল্পীসুলভ একটা প্রত্যয়ের ছাপ আছে ওর মুখে। এখানকার অন্য ছবিগুলো দেখে ও নিশ্চয়ই বুঝেছে যে ও নিজেও অন্যদের চেয়ে কম কিছু নয়।

সতেরো জনের মধ্যে ফুলমণি ছাড়াও আরও পাঁচটি মেয়ে আছে, তারাও কেউ উগ্র সাজগোজ করেনি। সহজ-অনাড়ম্বর পোশাক। ফ্যাশানেবল মহিলার সচরাচর ভালো শিল্পী হয় না।

সিরাজুল তারিক অন্য শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে ফুলমণির কাছে এসে বললেন, এই মেয়েটি, জানেন, কোথাও শেখেনি, একট রিমোট গ্রামে থাকে, কিন্তু অসাধারণ ছবি এঁকেছে।

লেডি রাণু বললেন, তাই নাকি? তাহলে তো ওর ছবিই আগে দেখতে হয়।

প্রত্যেকেরই চারখানা করে ছবি টাঙানো হয়েছে। ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে লেডি রাণু বলতে লাগলেন, বাঃ বেশ তো। সত্যি ভালো।

তারপর ফুলমণিকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক রকম লাইন দেখছি, তুমি কতগুলো তুলি ব্যবহার করো?

সিরাজুল সাহেব বললেন, ও তো তুলি দিয়ে আঁকে না।

ফুলমণি তার একটা হাত তুলে পাঞ্জাটা মেলে ধরল।

সিরাজুল সাহেব বললেন, ও শুধু আঙুলের ডগা আর নখ দিয়ে আঁকে। আমি নিজে দেখেছি আঁকতে। ফ্যানটাস্টিক!

লেডি রাণু খুবই অবাক হলেন। আরও অনেক প্রশংসা করে চলে গেলেন অন্য ছবির দিকে।

লোক কম হয়নি। প্রেস, চিত্র সমালোচক, ফটোগ্রাফার, শিল্পীদের আত্মীয়—স্বজন এবং কিছু দর্শক। নীপা বউদিরা আজ আসতে পারেনি, কাল আসবে, বলেছে।

ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে কিছু দর্শক দেখলেই আমি তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই, তাদের মন্তব্য শোনার চেষ্টা করি। সবাই যে একবাক্যে প্রশংসা করছে তা নয়। কেউ কেউ শুধু চোখ বুলিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ খুঁটিয়ে দেখছে। কেউ বলছে, বাঃ, মন্দ নয়।

দু’জন নামকরা সমালোচক সিরাজুল সাহেবের কাছে যেচে প্রশংসা করে গেলেন। আলাপ করলেন ফুলমণির সঙ্গে। ফুলমণি একটা-দুটো প্রশ্নের উত্তরও দিল। ওঁদের মধ্যে একজন শুধু প্রশংসাই করে গেলেন, আর একজন রঙের ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি পরামর্শ দিলেন ফুলমণিকে। দু’জনের ব্যবহারই বেশ আন্তরিক। চন্দনদা সমালোচকদের সম্পর্কে বড় কঠিন মন্তব্য করেছিলেন। এই তো এঁরা নিজে থেকেই এসেছেন। এখানে মদের ফোয়ারা নেই, খাওয়া-দাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা নেই, শুধু চা আর দুটো করে সিঙ্গাড়া।

কিছু কিছু খ্যাতিমান শিল্পীরাও আসছেন, কয়েকজনকে চেনা যায়। এঁরা তরুণদের কাজ সম্পর্কে কৌতূহলী, এক একজনকে ঘিরে ছোটখাটো দল হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সদলবলে চলাই রীতি। আমি লক্ষ করলুম, এরা প্রায় সকলেই ছবিগুলোর দিকে ওপর ওপর চোখ বুলোলেন শুধু, তারপর ভক্তদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। এঁদের পাকা চোখ, এক ঝলক দেখেই বুঝে নেন। কোনো কোনো তরুণ শিল্পী তার গুরুস্থানীয়কে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ছবিগুলোর কাছে। এক একজন শিল্পী এতই ভদ্র এবং উদার যে সবাইকে বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রশংসা।

সিরাজুল তারিক সাহেব চলে গেলেন একটু আগে।

.

আমার ওপর নির্দেশ দিয়ে গেছেন, ফুলমণিকে নিয়ে শেষপর্যন্ত থেকে যেতে। আটটার সময় বন্ধ হবে। থাকতে আমার খারাপ লাগবে না। এতগুলি শিল্পীর এত রকমের ছবি, এতদিনের নিষ্ঠা, ভাবনা, রঙের পরীক্ষা, সব মিলিয়ে পরিবেশটা একেবারে অন্য রকম। যেন একটা চমৎকার উদ্যান।

কোনো বিখ্যাত শিল্পীকে ফুলমণি তার নিজের ছবির কাছে নিয়ে যাবে, সে প্রশ্নই ওঠে না। সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। আমিও কারুকে অনুরোধ করতে পারছি না, কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আপনার এত উৎসাহ কেন, মশাই? ঐ মেয়েটা আপনার কে হয়?

আমি দূর থেকে অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখছি। কেউ ফুলমণির ছবির সামনে থামছে, কেউ থামছে না। তবে একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত একজনও কেউ বলেনি যে এ আদিবাসী মেয়েটির আঁকা ছবি নিম্নমানের, এই প্রদর্শনীর উপযুক্ত নয়! ফুলমণির ছবি দয়া করে রাখা হয়নি, কিংবা চন্দনদা -সিরাজুল সাহেবের হুজুগে পক্ষপাতিত্ব নয়। অন্য শিল্পীদের সমান যোগ্যতা তার আছে।

আমাদের দেশে প্রদর্শনীর মাঝখানে ছবি কেউ কিনতে চাইলে ‘সোলড’ লিখে দেওয়া হয় না, শুধু একটা লাল টিপ দেওয়া হয়। ফুলমণির ছবি কেউ কেনে কিনা সে সম্পর্কে আমার দারুণ কৌতূহল। সিরাজুল সাহেব অবশ্য বলেছিলেন; আমাদের দেশে সাধারণ বাঙালি দর্শকরা তো ছবি কেনে না, তাদের পয়সা নেই। ছবি কেনে গোয়েঙ্কা, ডালমিয়া, বিড়লা, রুশি মোদিরা। তারা নতুনদের প্রদর্শনীতে চট করে আসে না, তাদের প্রতিনিধিদের ধরে আনতে হবে।

তবে এরই মধ্যে একটি মাত্র ছবিতে লাল টিপ পড়েছে। কৌশিক শূর নামে একজনের আধা বিমূর্ত ছবি। কৌশিক শূরের বয়েস বড় জোর সাতাশ, মুখ ভর্তি দাড়ি, চোখ দুটি স্বপ্নময়।

সাড়ে সাতটার সময় এলেন বিশ্বদেব রায়চৌধুরী, এঁর খ্যাতি ভারত জোড়া। দীর্ঘকায়, সুপুরুষ, সদা হাস্যময় মুখ। তাঁর কোনো এক ভাবশিষ্যের ছবি আছে এখানে, খুব সম্ভবত সেইজন্যই তিনি এসেছেন।

ঘুরতে ঘুরতে তিনি ফুলমণির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন।

অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে মাথায় ফুল গোঁজা একটি সাঁওতাল মেয়েকে তো আর প্রতিদিন দেখা যায় না। কোনো চাষী, জেলে, মজুর, তাঁতি কোনোদিন এখানে আসে না। এসব ছবি তাদের জন্য নয়। শিল্প-সাহিত্য গোটা ব্যাপারটা থেকেই আমাদের দেশের শতকরা আশিজন বাদ।

বিশ্বদেব রায়চৌধুরীর বিস্ময় স্বাভাবিক।

কয়েকজন তরুণ শিল্পী ফুলমণিকে ওঁর কাছে নিয়ে গেল। আমি দূর থেকে দেখলাম, উনি ফুলমণির সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে দুচারটে কথা বললেন, ফুলমণির ছবিও দেখলেন!

তারপর তিনি অন্যদিকে মন দিতে আমি ফুলমণিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলুম।

জিজ্ঞেস করলুম, ওঁকে চিনতে পেরেছ? শিল্পী! উনি কী বললেন তোমাকে?

ফুলমণি সরু করে হেসে, দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, উনার ভালো লাগে নাই।

কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না। বিশ্বদেব রায়চৌধুরী যে-ধরনের মানুষ, খারাপ লাগলেও তো সে কথা মুখে বলবেন না। তিনি এখন এত উঁচুতে উঠে গেছেন যে কারুকেই আর ছোট করার দরকার হয় না ওঁর।

পাশ থেকে আর একটি মেয়ে বলল, না, না, উনি ছবিগুলোকে খারাপ বলেন নি। প্রশংসাই করেছেন। শুধু বললেন, যে-কাগজে আঁকা হয়েছে, তাতে রং বেশিদিন থাকবে না। ভালো কাগজে কিংবা ক্যানভাস ব্যবহার করা উচিত।

আমি ভাবলুম, ভালো কাগজ কিংবা ক্যানভাস কেনার পয়সা ও পাবে কোথায়? সিরাজুল সাহেব ঝোঁকের মাথায় বলেছিলেন, ফুলমণির ছবির প্রত্যেকটির দাম পাঁচ হাজার টাকা। এখানে ছবির মেটেরিয়াল অনুযায়ী দাম ধরা হয়েছে। ফুলমণির একটা ছবির দাম সাত শো, অন্যগুলো এক হাজার, দেড় হাজার, দু’হাজার। বিক্রি হয় কি না সেইটাই পরীক্ষা। ধরা যাক সব কটাই বিক্রি হয়ে গেল। তারপর ফুলমণি কী করবে? ঐ কটা টাকায় ওর কত দিন চলবে? ওর শ্বশুর বেশ কিছুটা নিয়ে নেবে, পাড়া প্রতিবেশীরাও ভাগ বসাবে। বড় ভোজ হবে। ফুলমণি কি আবার ইট বওয়ার কাজে ফিরে যাবে?

অন্য আর পাঁচজন শিল্পীর মতন ফুলমণি শুধু ছবি আঁকার সাধনা করে যাবে, এর কি কোনো উপায় নেই?

চন্দনদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।

সিগারেট টানার জন্য বাইরে এলুম, ফুলমণিও এল আমার সঙ্গে। অ্যাকাডেমির সামনের প্রাঙ্গণে সবসময়েই ভিড় থাকে, এখন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। বিদ্যুতের চমক বৃষ্টির খবর দিল। অনেকগুলো ফুলের গন্ধ আসছে এক সঙ্গে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি, কেমন লাগছে এখানে?

ফুলমণি হাসল।

কথা তো বলেই না প্রায়, ঐ হাসিটুকুও যথেষ্ট।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলুম, যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়, তুমি কলকাতায় থেকে যেতে পারবে? এখানে ইচ্ছে মতন ছবি আঁকবে।

আমার চোখের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে ফুলমণি বলল, কী জানি!

আর কিছু বলার আগেই ভেতরে একটা গোলমাল শুনতে পেলুম। কে যেন রেগেমেগে চিৎকার করছে।

আর্ট এক্‌জিবিশানে সবাই মৃদু স্বরে কথা বলে। এখানে চীৎকার অস্বাভাবিক। ছুটে গেলুম হলের মধ্যে।

এখন দর্শক আর নেই বলতে গেলে। সবাই প্রায় শিল্পী বা তাদের বন্ধুবান্ধব বিশ্বদেব রায়চৌধুরী দূরের এক কোণে ছবি দেখছেন, আর ফুলমণির ছবির সামনে একজন মজবুত, দীর্ঘকায়, ঈগল-নাশা পুরুষ, অনিন্দ্য দাস! হাতে বেতের ছড়ি।

ছড়িটা তুলে বললেন, কোথায় চন্দন ঘোষাল কোথায়? ডাক সেই শালাকে। আদিবাসী মেয়ের আঁকা ছবি? কোন কালচার? এথনিক? আমার সঙ্গে ফেরোজি! চন্দন ঘোষালকে চিনি না? আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ছবি আঁকার খুব শখ ছিল। ছবির হ্রস্বি-দীর্ঘি জ্ঞান নেই, তবু আঁকবে। এই সব এঁকেছে, নিজের নামে ছবি ঝোলাবার মুরোদ নেই, এখন সাঁওতাল মেয়ের নামে চালাচ্ছে।

আমাকে দেখতে পেয়ে গলা চড়িয়ে অনিন্দ্য দাস জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাই যে, এই ছেলে—ইদিকে আয়। চন্দন কোথায়?

আমি বললুম, তিনি আসেননি।

—পালিয়ে থাকছে! সাহস নেই! ওর কি এত পয়সার খাঁকতি হয়েছে যে ছবির বাজারে ঢুকতে চায়? আদিবাসী আর্ট, শালা! মধুবনী পেইন্টিং এখন বালিগঞ্জে তৈরি হয়, আমি জানি না? কালিঘাটের পটের ভ্যাজাল, আর্ট কলেজের ছাত্ররা এঁকে সাপ্লাই দিচ্ছে! চন্দন আসেনি কেন? তোরা যে বলছিলি…কোথায় সেই মাগিটা কোথায়? মাগিটাকে শো কর, দেখি সে কেমন আঁকে।

আমার মাথায় রাগ চড়ে গেল।

অনিন্দ্য দাস যত বড় শিল্পীই হোক না কেন, আমি তার ধমক খেতে যাব কোন্ দুঃখে?

আমি বললুম, আপনাকে আমি প্রমাণ দিতে যাব কেন? আপনার ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস করবেন না! হাতের ছড়িটা আমার কাঁধে ঠেকিয়ে অনিন্দ্য দাস বললেন, আলবাৎ প্রমাণ দিতে হবে! আর্টের বাজারে জোচ্চুরি আমরা সহ্য করব না। ফল্স নামে ছবি বেচা, আমাদের সকলের বদনাম হবে!

বিশ্বদেব রায়চৌধুরী কাছে এগিয়ে এসে সস্নেহ ভর্ৎসনার সঙ্গে বললেন, কী হলো অনিন্দ্য, এত রাগারাগি করছ কেন?

অনিন্দ্য দাস বললেন, আপনি চুপ করুন তো। আপনি কিছু জানেন না, কী সব নখরাবাজি চলছে চারদিকে। আমি মাগিটাকে দেখতে চাই, সে কেমন ছবি আঁকে। এটা কিছু অন্যায় বলিনি!

কথা বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস একটুখানি দুলে যেতেই বোঝা গেল, তিনি বেশ খানিকটা মদ্য পান করে এসেছেন। তাঁর মাথায় কোনো যুক্তিবোধ কাজ করছে না।

বিশ্বদেব রায়চৌধুরী বুঝলেন, এখানে আর কথা বলতে গেলে তার মান থাকবে না। তিনি আস্তে আস্তে সরে পড়লেন।

অন্য একজন কেউ বলল, মেয়েটি তো এখানেই ছিল। বোধহয় বাইরে গেছে।

কোথায়, কোথায়, বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস দরজার দিকে এগোলেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে হলো।

ফুলমণি জলের ফোয়ারাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে দু’এক ফোঁটা।

ফুলমণিকে দেখে হা হা শব্দ অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন অনিন্দ্য দাস।

তারপর বললেন, এই মেয়ে! একে তো রেল লাইনের ধার থেকে ধরে এনেছে! একটা সাঁওতাল মেয়েকে এনে দাঁড় করালেই হলো! ও ওর বাপের জন্মে তুলি ধরতে শিখেছে? আমি বাজি ফেলতে পারি!

ফুলমণির কাছে গিয়ে তিনি আবার বললেন, এই মেয়ে, তুই ছবি আঁকতে পারিস? সত্যি করে বল্!

ফুলমণি কোনো উত্তর দিল না, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ফস করে পকেট থেকে একটা তুলি বার করে অনিন্দ্য দাস বললেন, এটা ধর তো! ছবি এঁকে দেখাতে হবে না, শুধু তুলিটা কেমন ভাবে ধরিস, সেটা দেখব!

আমি বললাম, ও তুলি দিয়ে আঁকে না।

—তবে কি ইয়ের ইয়ে দিয়ে আঁকে!

–ও শুধু আঙুল দিয়ে আঁকে।

আবার একখানা জোর হাসি দিলেন অনিন্দ্য দাস। আমাকে একটা খোঁচা মেরে বললেন, আঙুলে দিয়ে…একি বাবা কপালে ফোঁটা কাটা? তোর কপালে মেয়েটা ফোঁটা দিয়েছে নাকি রে?

ফুলমণির একটা হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, দেখি দেখি, আঙুলগুলো দেখি! এ যে সব চ্যাড়োশ!

ফুলমণি জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল।

অনিন্দ্য দাস বললেন, ইঃ, তেজ আছে! ক’ পয়সা পেয়েছিস?

ফুলমণির গালে এক আঙুলের ঠোনা মেরে বললেন, মুখটা ফেরা তো। হুঁ, প্রোফাইলটা ইন্টারেস্টিং।

হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি একটা সাঁওতাল ছেলে। ঝাড়খণ্ডের সমর্থক। আমার গ্রামের একটি মেয়েকে অপমান করছে কলকাতার এক বাবু। আমার রক্ত গরম হয়ে গেল।

আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিন্দ্য দাসের কলার চেপে ধরে বললুম, ছেড়ে দিন ওকে। অসভ্য কোথাকার।

অনিন্দ্য দাস আমাকে মারার জন্য ছড়ি তুললেন।

আর কয়েকজন মাঝখানে এসে পড়ে ঠেলে সরিয়ে দিল দু’জনকে

কেউ একজন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ভেতরে। জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। রাগে তখনও আমি হাঁপাচ্ছি। অনিন্দ্য দাসের কয়েকটা দাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।

যে ছেলেটি আমাকে টেনে এনেছে, সে বলল, চুপ করে একটু বসুন। অনিন্দ্য দাস লোক খারাপ নন। যখন তখন মাথা গরম করেন। কিন্তু গ্রেট সোল। আপনার সঙ্গে যদি ভাব হয় একবার, দেখবেন আপনার জন্য সর্বস্ব দিয়ে দেবেন।

আমি বললুম, আমার দরকার নেই ভাব করার। যে ওরকম মুখ খারাপ করে…।

–ওনার মুখটাই ওরকম, মনটা পরিষ্কার!

—ফুলমণিকে ও যদি আবার কিছু বলে?

—না, ফুলমণি বাথরুমে গেছে।

পাশ থেকে আর একজন বলল, অনিন্দ্যদা চলে গেলেন। কী বলতে বলতে গেলেন জানো, এখানকার সব কটা ছবি বোগাস! সব ফল্স।

ঐ দু’জন খুব হাসতে লাগল।

একজন বলল, কাল দেখবি অনিন্দ্যদা এসে খুব প্রশংসা করবে। আজ পেটে একটু বেশি পড়েছে।

কর্তৃপক্ষস্থানীয় একজন ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বললেন, আপনারা এখানে মারামারি শুরু করেছিলেন? ছি ছি ছি। এখানে কোনোদিন ওসব হয় না। আমি আহতভাবে বললুম, আপনি শুধু আমাকে বলছেন? আমি কি শুরু করেছি। অনিন্দ্যবাবু যা-তা বলতে শুরু করলেন।

-অনিন্দ্যবাবু একজন নামকরা আর্টিস্ট। তার মুখে মুখে আপনি কথা বলতে গেলেন কেন? আপনি কে?

—আমি ছবি আঁকতে পারি না বটে, কিন্তু আমি একজন ভদ্রলোক।

—সিরাজুল সাহেবকে বলব।

—যা খুশি বলবেন। আমি চলে যাচ্ছি, আর আসব না।

আটটা বেজে গেছে। বন্ধ করার সময়ও হয়ে গেছে। চলে এলুম বাইরে। ফুলমণি এখনো বাথরুম থেকে ফেরেনি।

এতক্ষণ পর্যন্ত এই পরিবেশটা সম্পর্কে যে ভালো লাগা ছিল, একজন লোক এসে তা নষ্ট করে দিল। এখানে চন্দনদার উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। অন্তত প্ৰথম দিনটা। কিন্তু চন্দনদা নিজে সব ব্যবস্থা করে দিলেও সামনে আসতে চাইছে না। নীপা বউদিকে বোঝাতে চায় যে ফুলমণি সম্পর্কে যাবতীয় উৎসাহ শুধু আমার

একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি এতক্ষণ কী করছে বাথরুমে? সেদিকে খানিকটা এগিয়ে গেলুম, কিন্তু মেয়েদের বাথরুমের মধ্যে ঢুকে তো দেখা যায় না।

বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে গজরাচ্ছে আকাশ।

আসল বৃষ্টি শুরু হয়নি, ঝোড়ো বাতসের সঙ্গে বড় ফোঁটা এসে গায়ে লাগছে। এই রকম সময়ে বেড়াতে মজা লাগে। ফুলমণি যদি চায়, এক্ষুনি বাড়ি না ফিরে ময়দানে খানিকক্ষণ ঘোরা যেতে পারে। কলকাতার ময়দানের একটা দারুণ রূপ আছে, সেটা দেখলে ওর ভালো লাগবে আশা করি। চৌরঙ্গির একদিকে আলোকোজ্জ্বল বড় বড় বাড়ি, আর একদিকে অন্ধকার।

আরও একটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল, ফুলমণি তবু আসছে না কেন? এবারে বোধহয় গেট ফেট বন্ধ করে দেবে! না, পেছন দিকের হলের নাটক এখনো ভাঙেনি।

বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ফুলমণি অসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি?

একটি যুবতী খটখটে জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে আসছে বাথরুম থেকে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কিছু মনে করবেন না। বাথরুমে কি আর কেউ আছে? আমার একজন আত্মীয় ঢুকেছিলেন—

মেয়েটি সপ্রতিভ ভাবে বলল, না, আর কাউকে দেখলুম না তো!

তারপর সে নিজেই আর একবার উঁকি দিয়ে এসে বলল, না, কেউ নেই।

আমি বললুম, কেউ নেই? তা হলে…তাহলে আমি একবার নিজে দেখে আসতে পারি?

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, যান না। আমি দাঁড়াচ্ছি।

কপালে আমার এও ছিল, মেয়েদের বাথরুম পরিদর্শন করতে হবে। তাও কি না ফাঁকা। মেয়েদের বাথরুমের দেয়ালে কিছু লেখা থাকে কি না সে বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল যথেষ্ট, কিন্তু এখন সেসব দেখার সময় নয়।

নিঃসন্দেহ বলা যায় ভেতরে কেউ নেই।

যুবতীটি অপেক্ষা করছে, বলল, পেলেন না?

আমি দু’দিকে মাথা নাড়লুম।

-কী রকম দেখতে বলুন তো?

—নীল-পাড় সাদা শাড়ি পরা, মাথায় ফুল গোঁজা, রোগা, আপনারই বয়েসী হবে বোধহয়।

—না, সে-রকম কারুকে দেখিনি। দেখুন বোধহয় বাইরে অপেক্ষা করছেন।

যুবতীটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে চলে এলুম গেটের বাইরে। সেখানে কেউ নেই। রাস্তার ওপারে নিশ্চয়ই যাবে না।

ফিরে এসে অ্যাকাডেমির ঘরগুলো খুঁজলুম তন্নতন্ন করে।

যদি ভুল করে থিয়েটার হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাই অপেক্ষা করলুম নাটক শেষ হওয়া পর্যন্ত। পৌনে ন’টায় হুড়হুড় করে বেরিয়ে এল বহু নারী পুরুষ, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি পরীক্ষা করলুম প্রত্যেকটা মুখ। সবাই বেরিয়ে গেলে মঞ্চ এবং গ্রীনরুম দেখতেও বাকি রাখলুম না।

ফুলমণি কোথাও নেই।

আমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এ কী হলো? আমাকে কিছু না বলে কোথায় যাবে ফুলমণি? অনিন্দ্য দাসের বিশ্রী ব্যবহারে রাগ করে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তা হলেই তো সর্বনাশ। ফুলমণি কলকাতার কিছুই চেনে না। এত গাড়ি—ঘোড়ার রাস্তা কী করে পার হতে হয় জানে না।

সামনের রাস্তার এদিক থেকে ওদিক, ময়দানের খানিকটা অংশে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো লাভ হলো না।

তা হলে কি নীপা বউদির বাড়িতে ফিরে গেছে? ঠিকানাও তো জানে না। আসবার সময় ট্যাক্সিতে এসেছি, সেই সব রাস্তা মনে রেখেছে? গ্রামের লোক শহরে এলে দিশেহারা হয়ে যায়, সমস্ত রাস্তাই তাদের এক রকম মনে হয়। তবে যদি ফুলমণির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ হয়, বলা তো যায় না!

এ ছাড়া আর তো কিছু করবারও নেই। একটা ট্যাক্সি পেয়েই বললুম, খুব জলদি, সুইন হো স্ট্রিট—

ঠিক তখনই আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি নামল। চড়চড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ চিরে গেল কলকাতার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।

নীপা বউদি আর লালুদা টিভিতে সিনেমা দেখছে।

বুকের ধড়ফড়ানি অতি কষ্টে সামলে আমি জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি কী করছে? কখন ফিরল? নীপা বউদি বলল, ফুলমণি! সে একা ফিরবে কী করে? তোমার সঙ্গে আসেনি?

আমি ধপাস করে বসে পড়লুম সোফায়! হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পায়ে জোর নেই!

সব শুনে লালুদা চক্ষু গোল গোল করে বলল, কেস সিরিয়াস! মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি হারিয়ে যায়, আদিবাসী মেয়ে, আমাদের নামে অ্যাবডাকশান চার্জ আনতে পারে। ওহে নিলাম্বুজ, এটা কী করলে?

আমি কী করব বলুন! ও বাথরুমে গেল, তখনও কি আমি ওর পেছন পেছন যাব?

—তাও যাওয়া উচিত ছিল—

নীপা বউদি বলল, তুমি হুট করে চলে এলে? ওখানেই আছে নিশ্চয়ই যাবে কোথায়!

—আমি সব জায়গায় দেখেছি। কেউ নেই। এখন আর লোকজনই নেই বলতে গেলে!

–হয়তো কোনো গাছ-টাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে!

মুমু পাশের ঘরে পড়তে বসেছিল। উঠে এসে সব শুনছে। সেও বলল, নীলকাকা, তুমি ওকে হারিয়ে ফেললে? এখন কী হবে?

সবাই আমার নামে দোষ দিচ্ছে! আমি যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছি।

লালুদা বলল, এক্ষুনি তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়। চলো বেরোই। থানায় একটা ডায়েরি করতে হবে। নীলমণিকে যদি অ্যারেস্ট করে, তার জন্য জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে।

নীপা বউদি চমকে উঠে বলল, কেন, নীলুকে অ্যারেস্ট করবে কেন?

মুমু একগাল হেসে বলল, বেশ হবে! নীলকাকাকে জেলে ভরে রাখলে খুব মজা হবে! আমরা দেখতে যাব!

রাত হয়ে গেছে, তাই মুমুর বায়না সত্ত্বেও তাকে সঙ্গে নেওয়া হলো না, কাল তার ইস্কুল আছে। লালুদার সঙ্গে নীপা বউদি আর আমি বেরিয়ে পড়লুম। বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেছে।

একটা গাড়ি থাকলে কত সুবিধে। নীপা বউদির কথায় থানায় না গিয়ে আমরা আগে গেলুম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের কাছে।

সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, রেড রোড়, রেস কোর্স এই সব চক্কর দিয়ে প্রায় পুরো ময়দানটাই ঘুরে দেখা হলো। ফুচকা, আলুকাবলির দোকানগুলোও উঠে গেছে, দু’একটা থেমে থাকা গাড়িতে রয়েছে কয়েক জোড়া দুঃসাহসী প্রেমিক-প্রেমিকা, কিছু গোপন মদ্যপায়ী ও কিছু পুলিশ ছাড়া আর কেউ নেই।

লালুদা বলল, মেট্রো রেলের কাজের জন্য অনেক আদিবাসী ওয়ার্কার আনিয়েছে। তারা ময়দানের মধ্যে এক জায়গায় ঝুপড়ি বেঁধে আছে। আমার মনে হয় মেয়েটা সেখানে চলে গেছে। হয়তো কোনো দেশোয়ালির সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।

নীপা বউদি বলল, সেখানে আমরা যাব কী করে?

লালুদা বলল, দ্যাখোই না!

সত্যি লালুদা অসাধ্যসাধন করতে পারে।

টাটা সেন্টারের কাছাকাছি উল্টো দিকে গাড়িটা থামাল লালুদা। এখানে মেট্রো রেলের অনেকগুলো গুদাম ঘর, শেড আছে। মাঝখান দিয়ে একটা সরু পথ, অন্ধকার। লালুদার গাড়িতে টর্চও থাকে, লোডশেডিংয়ের সময়ের জন্য। নীপা বউদিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে লালুদা শুধু আমাকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাইল, নীপা বউদি রাজি হলো না। এত রাতে নীপা বউদির পক্ষে একা গাড়িতে বসে থাকা বিপজ্জনক।

ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, এক জায়গায় রয়েছে অনেকগুলো ঝুপড়ি। কলকাতার একেবারে বুকের ওপর একটা আদিবাসী গ্রাম। একজন গার্ড প্রথমে আমাদের বাধা দিয়েছিল, লালুদা তার হাতে একটি কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিতে সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাদের।

কিছু লোক এক জায়গায় গোল হয়ে বসে আছে, মাঝখানে জ্বলছে একটা হ্যাজাক। সেখানে হাত ধরাধরি করে নাচছে দুটি মেয়ে। অন্যরা হাততালি দিচ্ছে। তাদের পাশে পাশে দিশি মদের বোতল।

প্রথমে আমার বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। যে দু’জন নাচছে, তাদের মধ্যে একজন ফুলমণি নয়? সেই রকম নীলপাড় শাড়ি, মাথায় ফুল গোঁজা।

ফুলমণি যদি আমাকে কিছু না বলে চলে এসে এখানে এসে নাচত, তা হলে আমি একে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতুম না। না, এ দুটি মেয়ের একজনও ফুলমণি নয়।

আমাদের দেখে নাচ থেকে গেল। ওরা মনে করল, আমরা পুলিশ। ওরা যদিও বে-আইনি কিছু করছে না, মদটা ওদের খাদ্যের মধ্যে পড়ে, আর নিজেরাই নাচ গানে মেতে আছে—তবু বিনা কারণেও পুলিশের ঝামেলা করতে তো বাধা নেই! ওদের সব বুঝিয়ে বলা হলো। ছোটপাহাড়ী থেকে কেউ এসেছে? ফুলমণি নামে কোনো মেয়েকে চেনে?

এরা এসেছে বীরভূম থেকে। ছোটপাহাড়ী কোথায় তা এরা জানে না।

এখানে ফুলমণি নামে কেউ নেই।

লালুদা অদম্য। গাড়িতে ফিরে এসে বলল, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে! কী বলো তো?

লালুদার মাথার আইডিয়া আন্দাজ করার মতো প্রতিভা আমার নেই।

লালুদা বলল, কলকাতায় অনেক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। রাইট? সেখানে অনেক মিস্ত্রি-মজুর কাজ করে, রাইট? মেয়েরা মাথায় করে ইট বয়ে নিয়ে যায়? সে-রকম কোনো বাড়িতে মজুরনীদের কাজ করতে দেখে ফুলমণির দেশের কথা মনে পড়ে গেছে। ফুলমণি ওমনি তাদের কাছে ছুটে গেছে। কী—যেতে পারে না? তুমি কী বলো, নীলধ্বজ?

নীলধ্বজ নামে কোনো ব্যক্তি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে কিছু মতামত দিতে পারত, কিন্তু আমার মাথাটা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছি না।

লালুদা বলল, লেটস গো!

চৌরঙ্গির ওপরেই তৈরি হচ্ছে একটা এগারোতলা বাড়ি। গাড়ি চলে এল সেখানে। চারজন গার্ড মালপত্র পাহারা দিচ্ছে, কোনো মিস্তিরিমজুর রাত্তিরে সেখানে থাকে না।

এরপর থিয়েটার রোড।

এখানে যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে তার কন্ট্রাক্টর লালুদার চেনা।

দারোয়ানরা বসে বসে রুটি পাকাচ্ছে, লালুদা তাদের ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল, সুখেন্দুবাবু হ্যায়?

পাগল না হলে সুখেন্দুবাবু নামে কন্ট্রাক্টরের এত রাতে এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু ও নামটা বলে দারোয়ানদের কাছে নিজের দর বাড়িয়ে নিল লালুদা। তারপর আসল কথাটা পাড়ল।

দারোয়ানদের মধ্যে একজন বেশ রসিক। সে জানালো যে ফুলমণি নামে কেউ নেই। আজ নতুন কোনো মেয়ে আসেনি। মুসলমান কামিন এখানে থাকে, তাদের কারুকে লাগবে?

নীপা বউদি বিরক্ত হয়ে বলল, দুর, এ ভাবে খোঁজা যায় নাকি? এটা পাগলামি হচ্ছে।

লালুদা বলল, তবে তো থানায় যেতেই হয়, হাসপাতালগুলোতেও খোঁজ নিতে হবে।

যাওয়া হলো ওয়াটগঞ্জ থানায়। ময়দান অঞ্চল ওই থানার এক্তিয়ারে।

এখানে নীপা বউদি গাড়িতেই বসে রইল। লালুদা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলল, কথাবার্তা যা বলার আমিই বলল, বুঝলে নীলরতন। তুমি চুপ করে থাকবে। নইলে তোমাকে যদি ফস করে অ্যারেস্ট করে ফেলে! অবশ্য অ্যারেস্ট করলেও তোমাকে ছাড়াবার ক্ষমতা আমার আছে।

দারোগাবাবু পাতলা কাগজে তামাক ভরে সিগারেট বানাচ্ছেন।

লালুদা দরজার কাছ থেকেই সাড়ম্বরে বলল, নমস্কার। কী খবর, ভালো? দারোগা প্রতি-নমস্কার না দিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? টেবিলের ওপর হাত দিয়ে ঝুঁকে লালুদা বলল, একটি আদিবাসী মেয়ে, বুঝলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়েস হবে, সন্ধে থেকে হারিয়ে গেছে।

দারোগা ভুরু নাচিয়ে বলল, হারিয়ে গেছে, না পালিয়ে গেছে? কোথায় মাইফেল বসেছিল?

—মাইফেল মানে? ও, না, না, সেসব কিছু না। ফুলমণিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

—ফুলমণি নামে আদিবাসী মেয়ে? কোনো আদিবাসী মেয়ে কক্ষনো হারায় না। সেরকম কোনো রেকর্ড নেই আজ অবধি।

—হ্যাঁ, হারিয়েছে। ফ্যাক্ট। ডায়েরি লিখুন।

—মার্ডার-ফার্ডার করে আসেননি তো? রাত সাড়ে এগারোটায় হঠাৎ একটা আদিবাসী মেয়ে সম্পর্কে এত দরদ?

—না, না, সে ছবি আঁকে।

—ছবি আঁকে! ও-ও-ও। ছবি আঁকলে আর মার্ডার করা যায় না?

—আপনি আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না।

—আপনার কথা কিছু বুঝতেই পারছি না মশাই!

—জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার আমার বন্ধু! আমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড!

–সে কথা আগে বলেননি কেন? জয়েন্ট সি পি কিংবা সি পি কিংবা কোনে আই জি যদি আপনার বন্ধু হয় তা হলে আপনি মার্ডার-ফার্ডার যা খুশি করতে পারেন সেসব বুঝবে লালবাজার। এখানে কেন?

—আই ইনসিস্ট!

—আপনি সরুন না মশাই। ওই ছেলেটিকে বসতে দিন!

দারোগা আমার দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বলল, কী হয়েছে বলো তো ভাই ঠিক দু’ লাইনে বলবে, বেশি সময় নষ্ট করবে না।

আমি মুখস্থ কবিতার ভঙ্গিতে বললুম, ছোটপাহাড়ী থেকে একটি সাঁওতা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে ভালো ছবি আঁকে। আজ তার ছবির প্রদর্শ ছিল অ্যাকাডেমিতে। সন্ধের পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তা পরনে…

—ব্যস, ব্যস, দু’ লাইন হয়ে গেছে। মেয়েটার ছবি কোথায়?

—ওর ছবি তো অ্যাকাডেমিতে টাঙানো হয়েছে।

—ওই ছবির কথা বলছি না। ফটোগ্রাফ। মেয়েটির ফটোগ্রাফ।

—তা তো তোলা হয়নি।

—কেন হয়নি?

লালুদা বাধা দিয়ে বলল, সে কি আমাদের আত্মীয় যে তার ছবি তুলে রাখব?

দারোগা লালুদাকে ধমক দিয়ে বলল, আত্মীয় যদি না হয় তা হলে সে হারিয়ে গেছে বলে আপনার এত মাথাব্যথা কেন?

তারপর দারোগা আমাকে বলল, চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি যান। সে নিশ্চয় নিজের দেশে ফিরে গেছে। কলকাতা শহরের মতন একটা জঘন্য জায়গা তা ভালো লাগবে কেন? আমারই ভালো লাগে না। চান তো ডায়েরি লিখে নিচ্ছি কোনো দরকার নেই যদিও!

থানা থেকে বেরিয়ে এসে লালুদা বলল, ও ব্যাটারা খুঁজবে না। পলিটিক্যা লিডার ছাড়া আর কারুর কথা শোনেই না। লালবাজারে গিয়ে প্রেশার দিতে হবে

বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশ এখনো থমথমে, চমক দিচ্ছে বিদ্যুৎ। সিনেমা নাইট শো ভেঙেছে, তাই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেল হঠাৎ। দোতলা বা ভর্তি মানুষ! সন্ধে থেকে কিছু খাইনি। খিদের কথা এতক্ষণ মনেও পড়েনি। এখ গোরুর গাড়ির চাকার মতন ঘর্ঘর শব্দে জেগে উঠল খিদে।

লালুদা বলল, কলকাতা শহরে এত গাড়ি-ঘোড়া, ট্রাম-বাস, তার মধ্যে গ্রামে একটা অবলা মেয়ে…একটা বনের হরিণীকে এনে যদি কলকাতার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে কী অবস্থা হবে বলো তো!

আমি থ। এত রাত্রে আচমকা কবিত্ব শক্তি জেগে উঠল লালুদার। ফুলমণি…বনের হরিণী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *