ফুলমণি-উপাখ্যান – ৫

নীপা বউদি বলল, এই সব ছবি, সত্যি একটা কামিন এঁকেছে?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ। নীলু ওর বাড়ি দেখে এসেছে। ওর শ্বশুরও ছবি আঁকে, সেগুলোও তো দেখলে।

নীপা বউদি বলল, এত ভালো যে আঁকতে পারে, তাকে দিয়ে তোমরা জনমজুরি করাচ্ছো? যার মাথায় রয়েছে এমন সব দারুণ ছবির আইডিয়া, তার মাথায় ইট বওয়াচ্ছ? চীনের কালচারাল রেভোলিউশানের পরেও তোমাদের শিক্ষা হলো না?

চন্দনদা ছাত্রজীবনে নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গে একটা খোঁচা দেওয়া হলো!

চন্দনদা তর্কের মধ্যে না গিয়ে বলল, আমি কী করব বলো! এ ধরনের শিল্পীদের সাহায্য করা সরকারের কাজ। জীবিকার জন্য বেচারা ইঁট বওয়া ছাড়া আর কী করবে?

নীপা বউদি বলল, কেন, তোমাদের কোম্পানিও তো অনেক কিছু করে। পাহাড়ে চড়ার জন্য টাকা দেয়। আর একজন শিল্পীকে দিতে পারে না?

মেয়েদের একটা পর্বত অভিযানের টিমকে স্পনসর করেছিল চন্দনদার কোম্পানি। সেই দলের লিডার ছিল রোহিণী। সেই সময় ঐ পর্বত অভিযান ও রোহিণীর সঙ্গে চন্দনদা একটু বেশি বেশি জড়িয়ে পড়েছিল। সেই ব্যাপারে আর একটি খোঁচা।

চন্দনদা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল, যার মানে হলো, ফুলমণিকে এনে একবার তোর বউদির সামনে হাজির করাতে হবে। যাতে নীপা বোঝে যে ফুলমণির সঙ্গে প্রেম করা সম্ভব নয়!

নীপা বউদি বৃষ্টি ভেজা মেয়েটার ছবিটা তুলে বলল, এই ছবিটা আমার এত ভালো লাগছে, রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। এটা যদি আমি কিনে নিই?

লালুদা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, যদিও চুপ করে থাকা তার স্বভাব নয়। এবারে ছবি বিষয়ে নীপা বউদির মতামত সবটা শুনে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেনো না, কেনো! কত দাম? সত্যিই অসাধারণ ছবি। একসেলেন্ট। মাস্টার পিস। কত দাম দিতে হবে, বলো না, নীলমাধব! দুটোও তো কেনা যেতে পারে। এইটা আর ওইটা।

লালুদা অন্য হাতে হনুমানের সমুদ্র পার হবার ছবিটা তুলে ধরল।

নীপা বউদি বলল, ধ্যাৎ। ওটা তো ওর শ্বশুরের আঁকা, একেবারে বাজে। দুটো ছবির তফাত বোঝেন না?

লালুদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অফকোর্স তফাত আছে! খুবই তফাত। কোনো তুলনাই চলে না। বাচ্চা মেয়েটার ছবি, অপূর্ব, অপূর্ব! এটা কিনে ফেলা যাক। নীলাচল, কত দাম দিতে হবে? বেশি করে বলো, যাতে মেয়েটির সাহায্য হয়।

নীপা বউদি বলল, দাঁড়ান, একবার মেয়েটিকে কিছু টাকা দিলে এমন কি সাহায্য হবে? ওর আত্মীয়স্বজনরা সেই টাকা খেয়ে ফেলবে। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আজেবাজে কাজ ছেড়ে ও শুধু ছবি আঁকতে পারে। গভর্নমেন্টের কোনো স্কলারশিপ-টলারশিপ জোগাড় করা যায় না?

চন্দনদা বলল, এমনি এমনি কি হয়? একটা একজিবিশন করা দরকার, ক্রিটিকদের মতামত দরকার। সেসব এখানে বসে কে করবে? কে ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাবে?

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় চন্দনদা থেমে গেল। একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে হেসে নিয়ে বলল, একটা কাজ করা যেতে পারে। শিগগিরই আমি কলকাতায় যাব। শুক্‌কুরবার মহরমের ছুটি, শনিবারটা ম্যানেজ করলে পরপর তিন দিন, নীলু, তুইও আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারিস। ছবিগুলো নিয়ে চল। আমি তো সময় পাব না, তুই কয়েকজনকে দেখিয়ে আন!

সেই রকমই ব্যবস্থা হলো। লালুদার ছোট গাড়িতে জায়গা হবে না। তাই একসঙ্গেই বেরিয়ে চন্দনদা আর আমি এলুম ট্রেনে, অন্যরা গেল গাড়িতে।

কলকাতায় কোনো বড় আর্টিস্ট কিংবা ক্রিটিককে আমি চিনি না। মানে, আমি অনেককে চিনি, কিন্তু তাঁরা আমায় চেনেন না। এ পর্যন্ত কখনো কোনো শিল্পীর বাড়িতে যাইনি।

শিল্পী শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে আমি হতাশ!

গল্ফ গ্রীনের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি, চন্দনদাই নিয়ে গেল সেখানে। চন্দনদার সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সারা ভারতেই তাঁর খ্যাতি, খুব ব্যস্ত মানুষ, তাই টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল।

শিল্পীদের চেহারা ও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মনের মধ্যে একটা ছবি তৈরি হয়ে আছে। গল্প-উপন্যাসে, সিনেমার আসরে সেই রকম শিল্পীদেরই দেখি, তাঁরা বোহেমিয়ান, মাথায় বাবরি চুল, মুখে দাড়ির জঙ্গল, মদের নেশায় সব সময় চোখ লাল, পোশাক উদ্ভট, তাঁদের স্টুডিয়োতে সব কিছু এলোমেলো ভাবে ছড়ানো, মেয়েদের নিয়ে তাঁরা ছিনিমিনি খেলেন।

কোথায় কী! শান্তনু চৌধুরীর ফ্ল্যাটটা নিখুঁত ভাবে সাজানো, মাথায় অল্প টাক, দাড়ি কামানো, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, ফর্সা, গোলগাল চেহারায় তাঁকে মনে হয় এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক। বসবার ঘরটির দেয়ালে একটি মাত্র ছবি, দেলাক্রোয়া’র একটি ছবির বড় প্রিন্ট। এখনো যে দেলাক্রোয়া’র এ রকম কোনো ভক্ত আছে, তা আমার জানা ছিল না।

বসবার ঘরে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর শিল্পী নিজেই এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্টুডিওতে। উত্তর আর পূর্ব ধার খোলা একটা বড় ঘর, দেয়ালের গায়ে ঠেসান দেওয়া বেশ কয়েকটি ক্যানভাস, ইজেলে একটি অসামাপ্ত ছবি। আগেই শুনেছি, শান্তুনু চৌধুরী প্রতিদিন নিয়ম করে আঁকেন, মাসে অন্তত দুটি অয়েলের ছবি শেষ করেন। তাঁর এক-একটি ছবির দাম অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা।

চন্দনদার সঙ্গে কথায় কথায় তিনি জানালেন যে, তার এই স্টুডিওতে আর কুলোচ্ছে না, এই গল্ফ গ্রীনেই তাঁর নিজস্ব একটা বাড়ি হচ্ছে, সম্পূর্ণ তিনতলা জুড়ে হবে স্টুডিও। চন্দনদাকে বাড়ির প্ল্যান দেখিয়ে অভিমত নিলেন, সিমেন্ট ও ইঁটের দাম কত যাচ্ছে তার খোঁজ-খবর জানালেন। তারপর আমরা তাঁর ছবিগুলো দেখলাম। ছবি তিনি খুবই ভালো আঁকেন, রঙের ব্যবহার অসামান্য, শিগগিরই তাঁর এই সব ছবির একটা বড় প্রদর্শনী হবে দিল্লিতে।

ইতিমধ্যে চা এসে গেছে।

চন্দনদা আমায় বললেন, নীলু, এবার বার কর।

শান্তনু চৌধুরী ঈষৎ চঞ্চল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ছবি আঁকো নাকি?

চন্দনদা বললেন, না, না, ও আঁকে না, ছোটপাহাড়ীতে একটি আদিবাসী মেয়ে…

ফুলমণির কাহিনীটা বলতে লাগলেন চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরী অন্যমনস্কভাবে শুনতে শুনতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই নাকি? বাঃ ইন্টারেস্টিং—দেখি, দেখি, ছবিগুলো দেখি

আমি ছবিগুলো মেলে ধরলুম।

শান্তনু চৌধুরী ছবিগুলোর দিকে দ্রুত চোখ বোলালেন, তাঁর মুখের কোনো ভাবান্তর হলো না।

তিনি বললেন, বাঃ, বেশ ভালো, বেশ ভালো!

বৃষ্টি ভেজা মেয়েটির ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, এটা কী রকম লাগছে।

শান্তনু চৌধুরী একই সুরে বললেন, বেশ ভালো, বেশ ভালো।

চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, ছবিগুলোর বিশেষ কোনো গুণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

শান্তনু চৌধুরী বললেন, বললাম তো, ভালোই এঁকেছে। একজন আদিবাসী মেয়ের পক্ষে, ভালোই বলতে হবে।

তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, আপনাদের কোম্পানি এবার কার ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করছে?

চন্দনদা বলল, খুব সম্ভবত হেমেন মজুমদারের। ওঁর ফ্যামিলির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। এসব তো আমি একা ঠিক করি না। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টার…।

শান্তনু চৌধুরী খুব চাপা বিদ্রূপের সুরে বললেন, ওঃ, হেমেন মজুমদার? আচ্ছা! বেশ বেশ।

এরপর তিনি আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেটা স্পষ্ট উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত।

বোঝাই গেল, ফুলমণির ছবিগুলোকে উনি কোনো গুরুত্বই দেননি। যেটুকু প্রশংসা করেছে, তা নিছক ভদ্রতার। তবে কি ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করছি? আমাদের উচ্ছ্বাস সবটাই ভুল!

দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনেক ইয়াং ছেলেমেয়ে আমাকে ছবি দেখাতে চায়, আমি সময় পাই না, সকলের জন্য সময় দিতে গেলে আমার নিজের কাজ…তবে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করি সাহায্য করার।

আমাদের মুখে আর কথা নেই। ফুলমণি সামান্য মনোযোগেরও অযোগ্য!

বাইরে বেরিয়ে আমি খানিকটা রাগের সুরে বললুম, চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরীর এত নাম, কিন্তু দেখলে শিল্পী বলে মনেই হয় না। মনে হয়, কোনো বড় অফিসার!

চন্দনদা বলল, তুই বুঝি ভেবেছিলি, সকালবেলাতেই মাতাল হয়ে একটা মেয়ের গলা জড়িয়ে বসে থাকবে। ওসব নাইনটিনথ সেঞ্চুরির ধারণা! তখন একটা বোহেমিয়ানিজম আর খ্যাপামির যুগ ছিল। এখন শিল্পীরাও সামাজিক মানুষ। মাতলামি আর বেলেল্লাপনা করলে সীরিয়াস কাজ করা যায় না এ যুগে। কী দারুণ কমপিটিশন! ছবি আঁকাও অন্য আর পাঁচটা কাজের মতন একটা কাজ!

এ কথাটা আমার পছন্দ হলো না। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা এসব কিছুতেই অন্য কাজের মতন নয়। তা হলে চেষ্টা করলেও সবাই পারে না কেন? যারা পড়াশুনোয় ফার্স্ট হয়, তারা কি এগুলো পারে? চন্দনদাই আগে উল্টোকথা বলেছে।

আমরা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এই সময় একজন কেউ বলল, এই চন্দন, এখানে কোথায় এসেছিলি?

একজন প্রায় ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে ভদ্রলোক, ব্রোঞ্জের মতন গায়ের রং, তীক্ষ্ণ নাক, কৌতূহলী চোখ, দাড়ি কামানো, কিন্তু মাথার চুল বড় বড়, প্যান্টের ওপর ফতুয়া জাতীয় একটা জামা পরা, হাতে একটা ছড়ি, তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।

ভদ্রলোকের বয়েস চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ঋজু শরীর, হাতে ছড়ি নেবার কথা নয়, ওটা বোধ হয় স্টাইল করার জন্য।

তিনি আবার বললেন, শান্তনুর কাছ থেকে ছবি কিনতে এসেছিলি বুঝি? কত টাকা খসল?

চন্দনদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, নীলু, এ হচ্ছে অনিন্দ্য দাস। আমরা ইস্কুলে একসঙ্গে পড়েছি।

নাম শুনেই চিনতে পারলুম। ইনিও খুবই বিখ্যাত শিল্পী। কয়েক বছর আগে একটা ফরাসি কাগজে এঁর সম্পর্কে একটা বড় আর্টিকেল বেরিয়েছিল ছবি-টবি দিয়ে, তার অনুবাদ আবার ছাপা হয় বাংলা কাগজে। ফরাসি দেশের সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেই এঁকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় কলকাতায়।

চন্দনদা বলল, না রে, ছবি কিনতে আসিনি। শান্তনু চৌধুরীকে কয়েকটা ছবি দেখাতে এসেছিলুম।

—তুই আবার ছবি আঁকছিস বুঝি? আবার ইচ্ছেটা চাগিয়েছে? টাকা তো কম রোজগার করিস না।

—ধ্যাৎ, আমি কি আঁকব! এগুলো একটা আদিবাসী মেয়ের। আমাদের ভালো লেগেছিল, তাই শান্তনু চৌধুরীকে দেখিয়ে মতামত জানতে এসেছিলুম।

—শালা, তুই আমাকে আগে দেখাসনি কেন? তুই কাকে বেশিদিন চিনিস, আমাকে, না শান্তনুকে? শান্তনু বড় আর্টিস্ট?

–তোর কথাটা মনে পড়েনি, মানে, তুই তো মেইনলি স্কালপ্টর, তুই মূর্তি গড়িস…

—স্কলাপচার করি বলে ছবি বুঝি না? স্কালপ্টররা ছবি আঁকে না? তোদের রদ্যাঁ ছবি আঁকেনি? দেবীপ্রসাদ, রামকিঙ্কর ছবি আঁকেনি?

আমার দিকে ছড়িটা তুলে অনিন্দ্য দাস বললেন, এই ছেলে, হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কি, বার করো ছবিগুলো।

শান্তনু চৌধুরীর তুলনায় অনিন্দ্য দাসকে প্রায় প্রথম নজরেই আমার ভালো লেগে গেল। প্রাণবন্ত মানুষ, মিষ্টি মিষ্টি ভদ্রতার ধার ধারেন না।

দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে কী করে ছবি দেখাব! চন্দনদার গাড়ির বনেটের ওপর মেলে ধরলুম।

অনিন্দ্য দাস বেশ খুঁটিয়ে খুঁচিয়েই পাঁচটা ছবি দেখলেন। তারপর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে এঁকেছে?

চন্দনদা ফুলমণির বৃত্তান্ত সবিস্তার বলতে যেতেই অনিন্দ্য দাস তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়?

-সে তো ছোটপাহাড়ীতে থাকে।

—তাকে নিয়ে আয়।

—সেটা খুব মুশকিলের ব্যাপার। আচ্ছা অনিন্দ্য, বল তো, এই ছবিগুলো ঠিক কেমন? মেয়েটার সত্যিই কোনো ট্যালেন্ট আছে?

—ধুস! বোগাস! এ রকম ছবি যে-কেউ আঁকতে পারে। আর্টিস্টকে না দেখলে, তার সঙ্গে কথা না বললে কি ছবি বোঝা যায়? তার কতটা ভিশান আছে, তার ডেপ্থ কতটা, তার স্টাগ্ল করার ক্ষমতা, এ সব না বুঝলে শুধু কটা ছবি দেখে কী হবে?

—আঁকার ক্ষমতা, নতুনত্ব আছে কি না, সেটুকু তো অন্তত—

—আবার বাজে কথা বলছিস, চন্দন! একি ইম্প্রেশানিস্টদের ছবি, যে প্রত্যেকটা ছবিরই আলাদা একটা প্রাণ আছে, আলাদা একটা সত্তা আছে, কে এঁকেছে তা বলে দেবার দরকার হয় না, প্রত্যেকটা ছবিই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আমি বললুম, সব ভালো ছবিই তো এ রকম হয়। ছবি দেখে যা মনে হয়। অনিন্দ্য দাস এক ধমক দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে তর্ক করো না ছোকরা, তর্ক করো না। যা বলছি শুনে যাও।

আমি তবু প্রতিবাদ করে বললুম, আর্টিস্টদের দেখে, কথা বললেও তো মনে হয় না।

অনিন্দ দাস ঠিক আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরে এবার হে-হে করে হেসে ফেললেন। শান্তনু চৌধুরীর বাড়ির দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বললেন, ছবি আঁকলেই কি শিল্পী হওয়া যায়? শান্তনু খুব নাম করেছে, ভালোই আঁকে, নিশ্চয়ই ভালো আঁকে কিন্তু সবই রঙের পোঁচ, বুঝলে, রঙের পোঁচ! ওর মধ্যে যে ফাঁকিবাজি আছে, তা আমরা বুঝি, তোমরা বুঝবে না। স্কালপচার করতে গেলে কব্জির জোর লাগে, আর লাগে এই দুটো এক সঙ্গে।

অনিন্দ্য দাস নিজের মাথায় আর বুকে দুটো টোকা দিলে।

তারপর চন্দনদাকে বললেন, তুই বুঝি শান্তনুর ছবি দিয়ে তোদের কোম্পানির ক্যালেন্ডার করবি ভাবছিস? দে, যত ইচ্ছে তেল দে! কেন, স্কালপচার দিয়ে বুঝি ক্যালেন্ডার করা যায় না? শালা বাঙালিরা ভাস্কর্যের কিছুই বোঝে না। কেষ্টনগরের পুতুল দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। কলকাতা শহরে যে মূর্তিগুলো বসিয়েছে, ইচ্ছে করে লাথি মেরে সেগুলো সব ভেঙে দিই!

অনিন্দ্য দাস শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতেই যাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, উনি শান্তনু চৌধুরীকে একটুও পছন্দ করেন না। তবু দু’জনে নিশ্চয়ই এখন হেসে হেসে গল্প করবেন।

গাড়িতে উঠে চন্দনদা বিমর্ষ ভাবে বলল, কী হলো রে, নীলু। দু-দুজন বিখ্যাত আর্টিস্ট এ ছবিগুলোকে তো পাত্তাই দিল না। আমরা তা হলে বোকার মতন নাচানাচি করেছি?

—কোনো নিরপেক্ষ আর্ট ক্রিটিককে একবার দেখালে হয় না?

–তুই যে অদ্ভুত কথা বললি রে, নীলু! নিরপেক্ষ ক্রিটিক বলে পৃথিবীতে কোনো বস্তু আছে নাকি? সব ক্রিটিকই কোনো না কোনো দিকে হেলে থাকে।

—খবরের কাগজে যাঁরা সমালোচনা লেখেন।

—তুই দেখবি, একই শিল্পীর ছবি, স্টেটসম্যান যাচ্ছেতাই বলে উড়িয়ে দিচ্ছে আর আনন্দবাজার তাকেই মাথায় তুলে নাচছে। আবার এর উল্টোটাও হয়। ছবির জগতে যে-রকম গ্রুপইজম আছে, তা তোর-আমার বোঝার সাধ্য নেই।

–তবু তো কিছু কিছু শিল্পীর নাম সারা দেশেই নাম ছড়িয়ে যায়। তাঁদের ছবির কদর হয়।

—সে হচ্ছে জনসাধারণের বিচার। জনসাধারণই তো আলটিমেট ক্রিটিক। কিন্তু ফুলমণির ছবি জনসাধারণের কাছে পৌঁছোবার কোনো উপায় নেই। কষ্টে—সৃষ্টে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেও কেউ আসবে না, ক্রিটিকরা পাত্তা দেবে না। আজকাল গণ্ডায় গণ্ডায় প্রদর্শনী হয় প্রতি সপ্তাহে। বিরাট করে পাবলিসিটি দিতে হবে, উদ্বোধনের দিন মস্ত পার্টি দিয়ে মদের ফোয়ারা বইয়ে দিতে হবে, তবে তো গণ্যমান্যরা আসবে!

—তা হলে আর কিছু করা যাবে না?

—নাঃ।

একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, তোর মন খারাপ লাগছে না, নীলু?

—হুঁ।

-কেন মন খারাপ লাগছে জানিস? আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে স্বার্থপর। ফুলমণির ছবির কিছু হলো না, সেজন্য আমরা যতটা না দুঃখিত, তার চেয়ে বেশি দুঃখিত এই জন্য যে আমরা ওর উপকার করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলুম, সেটা ব্যর্থ হলো! আমরা হেরে গেলুম। তাই না!

–তাও বলা যেতে পারে।

—মন খারাপ হলে আমার কাবাব আর পরোটা খেতে ইচ্ছে করে। খাবি?

—কাবাব আর পরোটা খুব আনন্দের সময়েও খেতে আমার কোনো আপত্তি থাকে না!

—তা হলে চল পার্ক সার্কাসের দিকে। ওখানে একটা ভালো রেস্তারাঁয়….

হঠাৎ থেমে গিয়ে চন্দনদা গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, এই, এই, গাড়ি ঘোরা, চলো তো একবার আলিপুরের দিকে।

আমার বিস্ময় দেখে বলল, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল রে। সিরাজুল তারিক-এর বাড়ি গিয়ে একবার কাবাব খেয়েছিলুম, কী অপূর্ব তার স্বাদ, এখনো জিভে লেগে আছে।

—এখন হঠাৎ তাঁর বাড়িতে গেলেও কি তিনি কাবাব খাওয়াবেন নাকি?

—তুই কি ইডিয়েট রে! নাম শুনে চিনতে পারলি না? সিরাজুল তারিক!

-মানে, যিনি আর্টিস্ট?

—তাছাড়া সিরাজুল তারিক আবার ক’জন আছে? আমার সঙ্গে একদিন আলাপ হয়েছিল। বারবার তিনবার। ওঁর মতামতটাও নেওয়া যাক। উনিও যদি উড়িয়ে দেন, তা হলে ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা আর মাথাই ঘামাব না।—কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে গেলে কি উনি সময় দেবেন?

—একটা জিনিস লক্ষ করলি তো। বড় কোম্পানির ক্যালেন্ডারে ছবি দেবার জন্য আর্টিস্টরা বেশ ব্যস্ত। অন্তত লাখখানেক টাকা তো পাওয়াই যায়। সিরাজুল সাহেবকে প্রথমে সেই টোপটা দেব। তা হলে ঠিকই সময় পাবেন কথা বলার!

ঠিক আলিপুর নয়, খিদিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি সিরাজুল তারিকের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। ইনি বাংলার প্রবীণ বিখ্যাত শিল্পীদের অন্যতম। মতামতের দিক থেকে খানিকটা ট্র্যাডিশনাল। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে ওঁর একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলুম। উনি অল্প বয়েসে অয়েলের কাজ কিছু করেছেন, এখন আর অয়েল ছোঁন না। ওয়াটার কলার আর ওয়াশ-এর কাজই বেশি করেন। আজকালকার অনেক শিল্পীর মতন উনি অ্যাক্রিলিকের চকচকে রং একেবারে পছন্দ করেন না। অয়েল সম্পর্কে উনি একটা গল্পও বলেছেন। আমাদের দেশে তো আগে অয়েলের কাজ হতো না। জাহাঙ্গির বাদশার দরবারে ইংরেজদের দূত হিসেবে গিয়েছিলেন স্যার টমাস রো। অনেক রকম উপহার-উপঢৌকন নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জিনিসগুলো খুলে খুলে দেখাচ্ছেন। তার মধ্যে একটা অয়েল পেইন্টিং ছিল। সেটা দেখে জাহাঙ্গির বাদশা মুখ কুঁচকে বলেছিলেন, ওটা সরিয়ে নাও, বড্ড’ চকচক করছে।

ওয়াশ-এর ছবির মতনই সিরাজুল তারিক মানুষটি শান্ত, স্নিগ্ধ। চোখ দুটি আশ্চর্য মায়াময়।

নিজেই তিনি দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে বসালেন। সরু পাজামা ও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা, মুখে ধপধপে সাদা দাড়ি, মাথার চুলও সাদা, তবে বেশ পাতলা হয়ে গেছে। গলায় ঝুলছে কালো সুতোয় বাঁধা চশমা। কথা বললেন খুব নরম গলায়। তাঁকে দেখলে ঋষি দরবেশদের কথা মনে পড়ে।

সিরাজুল তারিক সঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী এম এফ হুসেনের চেহারার খানিকটা মিল আছে। কিন্তু হুসেন ফাইভ স্টার হোটেলে উঠলেও রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন, খবরের কাগজের হেডলাইন দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি এঁকে ফেলেন, এই সব গিমিক সিরাজুল সাহেবের চরিত্রে একেবারেই নেই। তাঁর ছবির বাজার দর বেশ ভালো। তবু তিনি আগেকার চালচলন পাল্টাননি, পুরনো বাড়িটা ছাড়েননি। নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করেন।

চন্দনদার ক্যালেন্ডারের প্রস্তাবটাকে উনি আমলই দিলেন না। হেসে বললেন, না, না। আমি ছবি দেব কী করে? আমি বছরে পাঁচ-সাতখানার বেশি ছবি আঁকি না। কেউ অর্ডার দিলে তাড়াতাড়ি এঁকে দিতেও পারি না। ছবি আঁকব কি, ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতে থাকতেই দিন কেটে যায়। কত ছবি চোখে ভাসে। সেগুলো এঁকে ফেলার চেয়ে সেগুলো নিয়ে কল্পনায় খেলা করতেই বেশি ভালোবাসি। আমার যে-ক’খানা ছবি বিক্রি হয় আপনাদের দয়ায়, তাতেই বেশ চলে যায়।

চন্দনদা তখন বললেন, আমি একটি মেয়ের আঁকা কয়েকটি ছবি এনেছি। অনুগ্রহ করে একটু দেখবেন?

সিরাজুল সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই। নিজের ছবি আঁকার চেয়েও ছবি দেখতেই আমি বেশি পছন্দ করি।

প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে তিনি ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। একটাও কথা বললেন না। আকাশে মেঘ জমেছে, তিনি আলো জ্বেলে দিলেন ঘরের। ছবিগুলো নিয়ে একবার জানলার কাছে গেলেন, একবার আলোর নীচে ধরলেন, নিজের ইজেলে চাপিয়ে দেখলেন।

তারপর বিহ্বল চোখে চন্দনদার দিকে চেয়ে বললেন, এ আমাকে কী দেখালেন, ঘোষালবাবু? এ ছবি কে এঁকেছেন?

চন্দনদা নার্ভাস গলায় বললেন, এ ছবিগুলো কী ভালো? এর কোনো মূল্য আছে?

সিরাজুল সাহেব বললেন, ভালো মানে কি! আমার আজকের সকালটা ধন্য হয়ে গেল! অসাধারণ! তুলনা নেই। আর মূল্যের কথা বলছেন? এই প্রত্যেকটা ছবির জন্য আমি পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে রাজি আছি। দেবেন আমাকে?

2 Comments
Collapse Comments

NIL Lohit er sathe Fulmoni ar Choto pahari o hariye geche ajker duniay te

Endless Ending !

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *