ফুলমণি-উপাখ্যান – ৬

এত দ্রুত যে ব্যাপারগুলো ঘটবে তা আমি ধারণাও করতে পারিনি।

সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ হলো আকস্মিক ভাবে। খুব ছোটখাটো ঘটনা থেকে কোনো মানুষের নিয়তিটাই বদলে যেতে পারে। চন্দনদার যদি হঠাৎ কাবাব-পরোটা খাবার কথা মনে না পড়ত, তা হলে সিরাজুল সাহেবের কাছে আসাই হতো না। কিংবা, ফুলমণি যদি ছোটপাহাড়ীর বদলে জামসেদপুরে ইট বওয়ার কাজ করতে যেত, তা হলে সে চন্দনদার নজরে পড়ত না, তার ছবি আঁকা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

সিরাজুল সাহেব আমাদের ছাড়লেন না, দুপুরে তাঁর বাড়িতেই খেতে হলো। কাবাব-পরোটা নয় অবশ্য, ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ ও ডিমভরা কই মাছের ঝোল। খুব সম্প্রতি তিনি সব রকম মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

ছবিগুলো সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত!

আমাদের তিনি বোঝালেন ছবিগুলোর বিশেষত্ব কোথায়। যে-কোনো শিল্পীই তার কাছাকাছি পরিবেশ, মানুষজন ও প্রকৃতির যে-বাস্তবতা, তা ফুটিয়ে তুলতে বাধ্য। সমসাময়িক বাস্তবতা সব শিল্পের ভিত্তি। তবে নিছক বাস্তবতা নয় এবং নিছক সমসাময়িকতাও নয়। তার মধ্যে একটা বিশ্বজনীনতা ও চিরকালীনতার ছোঁয়া লাগলেই তা সার্থক শিল্প হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, যেমন ধরুন, হ্যামলেট। ওর কাহিনীটা আসলে কী? ডেনমার্কের একটা ছোট্ট রাজ্যের রাজপরিবারের ঘরোয়া কোন্দল। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ ওর রস · অনুভব করতে পারে। কিংবা ধরুন মোনালিসার মুখখানা। লিওনার্দো তো একজন ইতালিয়ান মহিলার মুখ এঁকেছে, তাঁর চোখের সামনে ছিল সমসাময়িক বাস্তবতা, তবু ঐ মহিলার মুখের হাসি চিরকালীন হয়ে গেল।

আমি বললুম, সিরাজ সাহেব, এক আদিবাসী মহিলার ছবি প্রসঙ্গে হ্যামলেট আর মোনালিসার প্রসঙ্গ টানা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না।

সিরাজ সাহেব প্রশংসার ব্যাপারে কার্পণ্যে বিশ্বাস করেন না। তিনি বললেন, কেন তুলনা করা যাবে না? আমরা সবাই তো আদিবাসী তাই না? এখানে দেখুন, এই মহিলাটিকে কাছাকাছি যে-সব মানুষজন দেখেছে, গাছপালা, গোরু-মোষ, এই সবই এঁকেছে। ফোক ট্র্যাডিশনও আছে তার রেখার মধ্যে। যামিনী রায়ের মতন মোটা মোটা দাগ। ড্রয়িং-এ হাত পাকা, কিন্তু নিখুঁত ড্রয়িং করেনি, স্টাইলাইজড। এই যে তিনটে মোষ, এই মোষগুলো ছোটপাহাড়ী নয়, সারা পৃথিবীর। এ মেয়েটির অন্তর্দৃষ্টি আছে। এ বড় দুর্লভ, বুঝলেন, খুবই দুর্লভ।

আমি এবার ফস করে জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা, আপনি তো এত প্ৰশংসা করছেন, কিন্তু শান্তনু চৌধুরী আর অনিন্দ্য দাস একেবারে পাত্তাই দিলেন না কেন? তাঁরাও তো বড় শিল্পী, তাঁরা এ ছবিগুলোর মধ্যে কোনো গুণই দেখতে পেলেন না!

সিরাজ সাহেব চুপ করে গেলেন।

তিনি এতই ভদ্র যে সমসাময়িক কোনো শিল্পী সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে চান না।

চন্দনদা বললেন, ওঁদের অ্যাটিচুড়টা আমি বুঝতে পেরেছি। ওঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না, নীলু। কোনো কোনো শিল্পী হয় খুব সেল্ফ সেনটারড! নিজের ছবি ছাড়া আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না। নিজের সৃষ্টি নিয়েই মগ্ন থাকে। আবার কেউ কেউ গোটা শিল্প জগতটাকে ভালোবাসে, নিজেকে শিল্পী সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে, শিল্প জগতে নতুন কিছু ঘটলেই তারা খুশি হয়ে ওঠে…আমি ঠিক বলছি না সিরাজসাহেব?

সিরাজ সাহেব আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।

এরপর তিনি আর একটি চমকপ্রদ কথা বললেন।

চন্দনদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোটপাহাড়ীতে কী করে যেতে হয়? আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আজই যাওয়া যায় না?

চন্দনদা বলল, আপনি যাবেন সেখানে?

—হ্যাঁ। শুধু এই পাঁচখানা ছবি দেখলেই তো চলবে না। ও আরও কী কী ছবি এঁকেছে দেখতে হবে। ওর আঁকার পদ্ধতিটাও জানা দরকার। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই!

—ঠিক আছে, আপনি চলে যান মা নীলুর সঙ্গে, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার অফিসের দু-একটা কাজ, আমায় থাকতে হবে কলকাতায়। নীলু তো আজই ফিরছে।

–আমি যেতে চাই, তার আরও একটা বিশেষ কারণ আছে, ঘোষালবাবু। সামনের সপ্তাহে অ্যাকডেমিতে সারা বাংলা তরুণ শিল্পীদের একটা বড় প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে। ছবি বাছাইয়ের ভার দেওয়া হয়েছে আমার ওপর। আমি এই মেয়েটিকে সুযোগ দিতে চাই। ওর একটা এক্সপোজার হবে। অন্য সব শিল্পীদের ছবির পাশে ওর ছবিও থাকবে, লোকে দেখবে। লোকেরাই ওর বিচার করুক।

—এ তো অতি চমৎকার ব্যাপার। এমন সুযোগ তো আশাই করা যায় না! আমাদের আর কিছু বলতে হবে না। শিল্প-রসিকরাই ওর বিচার করবে!

মেয়েটিকে কলকাতায় আনা যাবে না? প্রদর্শনীতে অন্য শিল্পীরা সবাই থাকবে!

–কেন আনা যাবে না? ওর ভাড়ার টাকা আমি দিয়ে দেব। থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে!

এবার আমি বাধা দিয়ে বললুম, চন্দনদা, ফুলমণি কি আসতে চাইবে? এত লাজুক, কথাই বলতে চায় না, কোনোদিন নিজের জায়গা ছেড়ে বাইরে যায়নি!

সিরাজুল সাহেব বললেন, আমি বুঝিয়ে বলব। আমি তো যাচ্ছি।

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, তাকে আসতেই হবে, যদি সে সত্যিই শিল্পী হতে চায়। শুধু ঘরে বসে ছবি আঁকলেই তো চলে না। শিল্পীকে ছবির ফ্রেমিং পর্যন্ত শিখতে হয়। অন্য কে কী রকম আঁকছে তা জানতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতার জগতটাকে বাড়াতে হয়। এই সবই পার্ট অফ দা গেইম। ফুলমণি যদি আসতে না চায়, ছবিগুলো তাকে ফেরত দিয়ে আসবি। বাকি জীবন তা হলে সে ইঁট বওয়া কুলি হয়েই কাটাক। সিরাজুল তারিকের মতন এত বড় একজন শিল্পী নিজে তার কাছে যেতে চাইছেন—

সিরাজুল সাহেব বললেন, আচ্ছা, আগে গিয়েই দেখা যাক না।

চন্দনদা রয়ে গেল কলকাতায়। সিরাজুল সাহবকে নিয়ে আমি ছোটপাহাড়ী পৌঁছোলুম পরের দিন দুপুরবেলা। গেস্ট হাউজে একটা ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি বললুম, আপনি খেয়ে-দেয়ে এখন বিশ্রাম নিন। কাল সকালবেলা যাওয়া যাবে ফুলমণির গ্রামে।

কিন্তু বৃদ্ধের কি অদম্য উৎসাহ!

তিনি বললেন, ট্রেনে বসে বসে এসেছি, পরিশ্রম তো কিছু হয়নি। বিশ্রামের কী দরকার! চলুন, বিকেলেই দেখা করি আমাদের শিল্পীর সঙ্গে।

আজ ছুটির দিন নয়, ফুলমণি কাজে এসে থাকতে পারে। তার গ্রামে যাবার বদলে আগে একবার কনস্ট্রাকশন সাইটটা দেখা দরকার। অনেকটা হেঁটে যেতে হবে।

সিরাজুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনাকে আমার সাইকেলে যদি ক্যারি করি, আপত্তি আছে?

উনি হেসে বললেন, আপত্তি কিসের। গেলেই তো হলো।

এত বড় একজন শিল্পীকে আমি আমার সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এটা যেন ভাবাই যায় না। শিল্পীরাও কত সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে পারেন!

সিরাজুল সাহবের এক-একখানা ছবির দাম পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা। ঘরে বসে নিজের ছবি আঁকার বদলে ইনি এতদূর ছুটে এসেছেন এক অজ্ঞাত কুলশীল শিল্পীকে প্রমোট করার জন্য। একেই বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো!

আমাদের লেবরেটরি বাড়িটার গেটের সামনে নামলুম সাইকেল থেকে। পড়ন্ত বিকেলের আলো হলুদ হয়ে এসেছে। দূরের পাহড়ের চূড়ার কাছে মুকুট হয়ে আছে সূর্য। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে সেদিকে।

বাড়িটার বাইরের দেয়ালে বাঁশের ভারা বাঁধা। সেই ভারা বেয়ে মাথায় ইঁটের বোঝা নিয়ে উঠছে এক রোগা নারী। রোদ ঝলসাচ্ছে তার পিঠে।

সেই দিকে আঙুল তুলে বললম, ঐ দেখুন আমাদের শিল্পী। সিরাজুল সাহেব অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কবে আমরা আমাদের দেশের মা-বোনদের এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারব? মেয়েদের কি আমরা অন্য কাজ দিতে পারি না?

আমি বললুম, সিরাজুল সাহেব, মফস্বল শহরে মেথরানী মেয়েরা মাথায় করে গুয়ের পাত্র বয়ে নিয়ে যায়, দেখেননি? এর চেয়ে হীন কাজ কি আর কিছু আছে? কে জানে, সেই মেথরানীদের কেউ ছবি আঁকতে পারে কি না। কিংবা হয়তো আশা ভোঁসলের মতন গানের গলা আছে।

সিরাজুল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

তারপর বললেন, আমার মেয়ে, আমিনা, তার কথা আপনি শুনেছেন নীলুবাবু?

আমি বললুম, না।

দূরের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, সে ছিল আমার চোখের মণি, সে একদিন…যাক, আর একদিন বলব…

সিরাজুল সাহেব হঠাৎ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ভেতরে এনে আমার ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে তাঁকে বসালুম।

হেড মিস্তিরি ইরফান আলি এসে আমাকে বলল, সাহেব, আমাদের পেমেন্ট এনেছেন, না মহিমবাবু দেবেন?

এখানকার প্রত্যেক মজুরদের আলাদা ভাবে প্রতিদিন টাকা না দিয়ে এক সঙ্গে থোক টাকা দেওয়া হয় ইরফান আলিকে। সে অন্যদের কাজ অনুযায়ী মজুরি দেয়। এ রকমই প্রথা। আমার ছুটি, মহিমবাবুই টাকা আনবেন।

সে কথা বলতে ইরফান আলি খানিকটা অপ্রসন্নভাবে ঘড়ি দেখে বলল, উনি কখন আসবেন, ছুটির সময় হয়ে এল।

আমি বললুম, আপনি সাইকেল নিয়ে মহিমবাবুর কাছে চলে যান না।

এরপর আমি ফুলমণিকে ডাকিয়ে আনলুম এ ঘরে।

একটা মলিন ছাপা শাড়ি পরে আছে ফুলমণি। সেটা অটুটও নয়। লাল ধুলো

লেগে আছে এখানে ওখানে। মুখখানা ঘামে মাখা।

আমি বললুম, ফুলমণি, ইনি হচ্ছেন সিরাজুল তারিক সাহেব। খুব বড় শিল্পী। এঁর আঁকা ছবি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় দেখানো হয়। তোমার ছবিগুলো এঁর ভালো লেগেছে। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

অন্যদিন ফুলমণি যাকে বলে সাত চড়ে রা কাড়ে না, আজ একজন শিল্পীর কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া হলো।

সে মাটিতে বসে পড়ে সিরাজুল সাহেবের দু’টি পায়ের পাতা স্পর্শ করল।

সিরাজুল সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে, না, না, ওঠো মা। ওঠো।

হাত ধরে তিনি ফুলমণিকে তুলতে তুলতে বললে, ইস, এত রোগা কেন? গায়ের জোর না থাকলে ছবি আঁকবে কী করে? মাথায় অতগুলো ইঁট নিয়ে ওঠো, যদি পা পিছলে পড়ে যাও? ভাবলেই ভয় করে।

আমার মনে হলো, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেল এখানেই। ফুলমণিকে আমি সঁপে দিলাম সিরাজুল সাহেবের হাতে। এবার থেকে উনিই যা কিছু করার করবেন।

পরদিন ভোরে অবশ্য সিরাজুল সাহেবকে ফুলমণিদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে হলো আমাকেই। আমি মহিমবাবুকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু সিরাজুল সাহেব হেঁটেই যেতে চান। পায়ে হেঁটে নদী পেরুলেন।

এর মধ্যে ফুলমণি সম্পর্কে খানিকটা খোঁজ-খবর পাওয়া গেছে।

ফুলমণির স্বামী মারা গেছে দু’বছর আগে। এর মধ্যে ওর আবার বিয়ে হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, ওদের সমাজে এরকমই হয়। কিন্তু ফুলমণি বিয়ে না করে রয়ে গেছে শ্বশুরের কাছে। ওর শ্বশুর বৃদ্ধ ও পঙ্গু, তাকে দেখবার আর কেউ নেই। একটা চোদ্দ বছরের ভাতুয়া ছেলেকে ওরা বাড়িতে রেখেছে, ফুলমণি যখন কাজে যায়, তখন সেই ছেলেটি ওর শ্বশুরের দেখাশুনো করে। এই শ্বশুর ফুলমণির ছবি আঁকার গুরুও বটে।

প্রথম দেখে বৃদ্ধকে আমার স্বার্থপর ধরনের মনে হয়ছিল। অবশ্য অসহায় বটে। অসহায় ও দুর্বলেরা বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠে।

এবার আমরা যাবার পর গ্রামের অনেক লোক ভিড় করে দেখতে এল। ফুলমণি সম্পর্কে বাবুশ্রেণীর লোকেরা এত আগ্রহ দেখানোতে ফুলমণি এখানে বেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফুলমণি ছবি আঁকে তা এরা জানে, কিন্তু সেই ছবি নিয়ে বাবুদের এত মাথাব্যথা কেন তা তারা বুঝতে পারে না। অনেকেই বাড়ির দেয়ালের গায়ে ছবি আঁকে, বৃষ্টির জলে তা এক সময় ধুয়ে যায়। ছবির আবার এর চেয়ে বেশি মূল্য আছে নাকি?

আমি এলেবেলে হলেও সিরাজুল সাহেবের চেহারা দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। তিনি একটা ছেঁড়া জামা পরে থাকলেও বোঝা যাবে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তা ছাড়া, আমি ছোটপাহাড়ীতে চাকরি করি, আমার পক্ষে এ গ্রামে আসাটা খুব একটা আশ্চর্যের কিছু না, কিন্তু সিরাজুল সাহেবের মতন এক সম্ভ্রান্ত মানুষ কলকাতা থেকে এসেছেন ফুলমণির সঙ্গে দেখা করতে, এর মর্ম এখানকার মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকগুলো কৌতূহলী, উৎসুক মুখ ঘিরে রইল আমাদের।

সিরাজুল খুব সহজেই ফুলমণির জড়তা কাটিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফুলমণির অন্য ছবি দেখতে দেখতে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। ফুলমণি কী ভাবে ছবি আঁকে, তাও সে ঘরের বারান্দায় বসে তখনই এঁকে দেখাল।

বৃদ্ধটি এত সব ব্যাপারে তেমন খুশি নয়। সে চায় তার ছবি সম্পর্কে কথা বলতে। তাকে বাদ দিয়ে তার পুত্রবধূর অসমাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে এত মাতামাতি করা হচ্ছে কেন?

আমাকে একটা কায়দা করতে হলো।

চন্দনদা আমাকে আলাদা ভাবে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিল, ফুলমণি যদি কলকাতায় আসতে রাজি হয়, তা হলে ওর শ্বশুরকে এই টাকাটা দিয়ে আসি কয়েকদিনের সংসার খরচের জন্য!

আমি বৃদ্ধকে বললুম, আপনার ছবিগুলো কলকাতায় অনেকের খুব ভালে লেগেছে। সবাই জিজ্ঞেস করছিল আপনার কথা।

বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, ভালো লেগেছে? ভালো লেগেছে?

আমি বললুম, হ্যাঁ। আপনার সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। চারশো টাকায় এই নিন সেই টাকা। একশো টাকা আমি সরিয়ে রাখলুম, ওটা ফুলমণিকে হা খরচ হিসেবে দিতে হবে। ফুলমণি যদি দিন সাতেকও বাইরে থাকে, তার মধে এই বৃদ্ধের জন্য চারশো টাকাই যথেষ্ট!

বৃদ্ধ শিশুর মতন খুশি হয়ে বার বার বলতে লাগলেন, আমার ছবি…শহরে মানুষ দাম দিয়ে কিনেছে? আমি আরও ছবি আঁকব!

কিন্তু ফুলমণিকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব শুনে বৃদ্ধের সেই খুশি অন্তর্হিত হয়ে গেল একটুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকার পর বললেন, না, না, না, ও ব করে একা একা কলকাতায় যাবে? আমার তবিয়ৎ ঠিক থাকলে আমি যেতাম ও যাবে না!

পেছনের দর্শকদের মধ্যে থেকে এক ছোকরা বলল, ফুলমণি কি গান গাইতে না নাচবে? ছবি দেখাবার জন্য ওকে যেতে হবে কেন? শুধু ছবিগুলো নিে গেলেই হয়!

আরও কয়েকজন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ফুলমণি গান গাইবে না, নাচবে?

মুখচোরা, হার জিরজিরে ফুলমণির গান গাওয়া কিংবা মঞ্চের ওপর নাচে দৃশ্যটা এমনই অবিশ্বাস্য যে অনেকেরই হাসি পায়।

ফুলমণির শ্বশুর জনসমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বললেন, ও চলে গেে আমাকে দেখবে কে? আমি একা এই খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে মরব?

বাসন্তী এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। ফুলমণির প্রতি তার সহানুভূতি হয়েে সম্প্রতি। সম্ভবত ছবি এঁকে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা তাকে আকৃষ্ট করেছে।

বাসন্তী বলল, যাক না, ফুলমণি। আবার তো ঘুরে আসবে। এই কদিন আমি তোমাকে দেখব।

এরপর ফুলমণির যাওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে নানারকম কথা শুরু হয়ে গেল আমি বসে রইলুম চুপ করে।

খানিকবাদে ফুলমণির শ্বশুর সিরাজুল তারিককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলুন না, আপনি বুঝদার মানুষ, ফুলমণির কলকাতায় যাওয়ার কি প্রয়োজন আছে

সিরাজুল সাহেব শান্ত ভাবে বললেন, আছে। গেলে ভালো হয়। ছবির প্রদর্শ হলে অনেকে শিল্পীকে দেখতে চায়। ফুলমণিরও উপকার হবে, জানাশুনা হে অনেক লোকের সঙ্গেই, ও আরও অনেক ছবি দেখবে, শিখতে পারবে।

বৃদ্ধ বললেন, কলকাত্তা বড় খিটকেল জায়গা। আমি তো জানি!

সিরাজুল সাহেব বললেন, ফুলমণিকেই জিজ্ঞেস করা যাক না, ও যেতে চায় কি না। না চাইলে জোর করে তো কেউ নেবে না।

উঠোনে ফুলমণির শ্বশুরের খাটিয়া ঘিরে কথা হচ্ছে আমাদের। ফুলমণি বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। সে ছবিগুলো সব গুছিয়ে রাখছে।

সবাই এবার সেদিক তাকাল।

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তুই যাবি?

ফুলমণি মাথা তুলল, নীচু গলায়, কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, যাব!

শুনেই মনে হলো সে অনেকক্ষণ আগেই মন ঠিক করে রেখেছে। অন্যদের মতামতের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। ঐ একটা শব্দ শুনেই ফুলমণির ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। মেয়েটা যতই লাজুক হোক, এই ছোট গণ্ডির বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার আকর্ষণ আছে, ছবির প্রদর্শনীতে সে উপস্থিত থাকতে চায়, তার মানে প্রকৃত শিল্পী হবার বীজ রয়েছে ওর মধ্যে।

বৃদ্ধ এবার আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, আপনারা তো ওকে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ও ফিরবে কী করে? কোনোদিন একলা কোথাও যায়নি, লোকের সঙ্গে কথা বলতে জানে না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমার সঙ্গে ফিরবে। আমি তো কলকাতায় থাকি না, এখানে চাকরি করি, দু’চার দিনের মধ্যেই আমাকে ফিরতে হবে?

এরপর আর আপত্তির কারণ রইল না।

কিন্তু বাধা এল অন্য দিক থেকে।

সন্ধেবেলা গেস্ট হাউসে এসে উপস্থিত হলেন মহিম সরকার। চোখ সরু করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ নীললোহিত, আপনি নাকি একটা কামিনকে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন?

আমি বললুম, হ্যাঁ। কামিন মানে ঐ ফুলমণি, যে খুব ভালো ছবি আঁকে।

 মহিমবাবু বললেন, ছবি-ফবি আমি বুঝি না। আমি বুঝি কোম্পানির কাজ। এখানকার একটা ওয়ার্কার মেয়েকে আপনারা কাজ নষ্ট করে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য ওয়ার্কাররা কী ভাববে?

—তারা কী ভাববে আমি কি করে জানব বলুন তো?

—তারা চটে যাবে না? একজনকে, একটা মেয়েকে বেশি বেশি খাতির করা হচ্ছে, এটা তারা সহ্য করবে কেন! আপনি এ কাজটা ভালো করছেন না।

—আমি তো নিজের দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি না, মহিমবাবু। আমাকে চন্দনদা, আই মিন, মিঃ চন্দন ঘোষাল বলেছেন, এটা তাঁরই নির্দেশ।

—মিঃ ঘোষালের পার্সোনাল ব্যাপার হলে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু কোম্পানির কাজ হ্যামপার হলে—

—এটাও কোম্পানির কাজের মধ্যে পড়ে। কোম্পানি ঠিক করেছে, এখানে শুধু বাড়ি আর কারখানা বানালেই চলবে না। স্থানীয় লোকদের উন্নতির দিকটাও দেখতে হবে। অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দুটো দিকই।

—সেই ছুতোয় একটা ইয়াং মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া

—দেখুন মহিমবাবু, ফুলমণি ইয়াং ঠিকই এবং মেয়েও বটে। কিন্তু আপনি যে সেন্‌সে বলছেন, সেটা এখানে খাটে না। ছবি আঁকতে পারাটাই ওর একমাত্র যোগ্যতা। এখানকার একটি মেয়ে যদি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলে এই জায়গাটারও তো সুনাম হবে।

—আপনি ওকে নিয়ে যাচ্ছেন, আপনি সদ্য কাজে যোগ দিয়েছেন, এর মধ্যেই ছুটি নিয়েছেন দু’দিন, আবার কলকাতায় চলে যাচ্ছেন—

—আবার ছুটি নেব। চাকরিতে ক্যাজুয়াল লীভ, আর্নড লীভ এসব পাওয়া যায় না?

—আপনি কি পার্মানেন্ট স্টাফ যে ছুটি পাবেন? আপনার চাকরির মোট তিন সপ্তাহও হয়নি, হে হে হে, এর মধ্যে ছুটি!

—দেখুন, আমাকে চাকরিটা দিয়েছেন মিঃ চন্দন ঘোষাল। তিনিই আমার বস, তাই না? তিনি যে কাজ দেবেন, আমাকে সেই কাজই করতে হবে।

—সে আপনি যাই-ই বলুন মশাই, ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। ঝাড়খণ্ডী আন্দোলন চলছে, এখানকার কোনো মেয়েকে বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া এর মোটেই ভালো চোখে দেখবে না, এই আমি বলে যাচ্ছি!

মহিম সরকার আমাকে মোটামুটি শাসানি দিয়েই চলে গেলেন।

চন্দনদা এসে পৌঁছলো রাত্তিরের দিকে। মহিম সরকারের আপত্তির কথাট জানাতে চন্দনদা পাত্তাই দিল না। বাঁ হাতে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলল, দুর দুর, ও লোকটা একটা মাথা-মোটা! একটা সাঁওতাল মেয়ের আঁকা ছবি অন্য সব শিল্পীদের সঙ্গে সমান মর্যাদায় একটা বড় প্রদর্শনীতে স্থান পাচ্ছে, এরকম আগে কখনো ঘটেছে? বিরাট ব্যাপার। একজন গুণীর মর্যাদা দেওয়াটা কখনো অপরাধ হতে পারে? ঝাড়খণ্ডী নেতারা এটা ঠিক বুঝবে। ওদের সঙ্গে আমার ভাব আছে

পরদিন সকালেই রওনা হলুম আমরা। বাসে যেতে হবে না, চন্দনদার জি আমাদের রেল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। ফুলমণির ছবিগুলো ভালোভাবে প্যাক করে নিয়েছেন সিরাজুল সাহেব। একটা পুঁটুলিতে ভরে নিয়ে এসেছে ফুলমণি তার অন্য জিনিসপত্র। পায়ে রবারের চটি, পরনে একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি

গেস্ট হাউসের সামনে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে কয়েকজন। বাসন্ত আর ওদের গ্রামের কয়েকটি ছেলে। এবং মহিম সরকার। তিনি এখন দিব্যি হেসে হেসে গল্প করছেন চন্দনদার সঙ্গে। হঠাৎ এক সময় কাছে এসে ফুলমণির দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে তিনি বললেন, ফুলমণি, তোর কিন্তু ফার্স্ট হওয় চাই। তুই প্রাইজ নিয়ে ফিরে এলে আমি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব।

জিপে ওঠার আগে ফুলমণি একবার দূরের মাঠের দিকে ঘুরে তাকালো। আজকে আকাশ সজল মেঘে ঢাকা। পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে না। ডান পাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটা মোষকে তাড়িয়ে নিয়ে এল একটা বাচ্চা রাখাল। একটা কুকুর অকারণে সেখানে চ্যাচাচ্ছে, উড়ে গেল এক ঝাঁক কোচ বক।

ফুলমণি যেন তার ছবির পটভূমিকাগুলি একবার দেখে নিল চোখ ভরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *