ফুলমণি-উপাখ্যান – ১

দুপুরবেলার কাঁচা ভাত-ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল চন্দনদা।

দিনটা চমৎকার। সকাল থেকেই রিমঝিম ঘন ঘন রে।

বাজারে ইলিশ মাছ সস্তা। এমন দিনে মাকে বলা যায়। বলা যায় খিচুড়ি, খিচুড়ি! পৃথিবীতে আর কোনো খাবার নেই, যার স্বাদ বৃষ্টির দিনে বেশি ভালো হয়ে যায়, খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার মতন। খাওয়ার পর বাথরুমে না গিয়ে আমি আঁচালাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলে। সারা গায়ে বৃষ্টির গন্ধ হয়ে গেল।

এরপর একখানা বই বুকে নিয়ে ঘুম না দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যত আকর্ষণীয় প্রেমের গল্প বা গোয়েন্দা গল্পই হোক, বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর দু’-চার পাতার বেশি পড়া যায় না, চোখ জুড়িয়ে আসে। খিচুড়ির ঘুমের চরিত্রই আলাদা। এই ঘুম আসে খুব মৃদুভাবে। প্রথমে একটা নাচের ছন্দ শোনা যায়। মনে হয় যেন সুরলোকের চান-গানের আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে অবচেতনে। তারপর কোথা থেকে একটা নরম মখমলের চাদর উড়ে এসে ঢেকে দেয় শরীর। কেউ যেন কোমল আঙুল বুলিয়ে দেয় দু’চোখের পাতায়। ছোট ছোট স্বপ্ন ঝিলিক দেয়। তারপর বিছানা, খাট-ফাট সুদ্ধু সব কিছুই ভাসতে থাকে শূন্যে।

আহা, এই রকম দিনেও এত লোককে অফিসে, স্কুলে-কলেজে যেতে হয়। তারা কি দুঃখী! রাস্তায় গোড়ালি-ডোবা জলে, ছপছপিয়ে যাও, তারপর বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকো। এরই মধ্যে কোনো গাড়ি বা ট্যাক্সি তোমার গায়ে কাদা ছিটিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ মনে হবে, কোনো কাক এসে বুঝি মাথায় একটা ঠোক্কর মারল, আসলে সেটা পাশের মানুষের ছাতার শিকের খোঁচা। বাইরে ফিনফিনে হাওয়া অথচ বাসের মধ্যে গরম আর ঘাম। অধিকাংশ অফিসেই জানলা দেখা যায় না, জানলা থাকলেও আকাশ দেখা যায় না, দিনের বেলাতেও আলো জ্বলে। বেচারা চাকুরিজীবীরা কি হতভাগ্য!

আমি বাল্যকালে কোনো পাপ করিনি। ইস্কুলে পড়ার সময় খামোকা ক্লাসের অন্য বন্ধুদের বঞ্চিত করে ফার্স্ট-সেকেন্ড হবার চেষ্টা করিনি কক্ষনো। কলেজে লেকচারাররা যখন শেলি-কীটসের কবিতা কাটা-ছেঁড়া করতেন, তখন দিব্যি আড্ডা মারতাম কফি হাউজে, অর্থনীতির কূটকচালি নিয়ে মাথা ঘামাইনি কোনো দিন, ইতিহাসের বই সামনে খুলে হাত মকসো করতাম প্রেমপত্র লেখায়। এই সব সুকৃতির ফলে চাকরির বাজারে আমার দাম কানাকড়ি, স্বেচ্ছায় দাসত্ব খোঁজার জন্য হন্যে হতে হয়নি আমাকে। আমি বেঁচে গেছি। শহরের রাস্তায় যখন মাইনে বাড়াবার মিছিল দেখি, আমার মজা লাগে। আমাকে ওই গড্ডলিকা প্রবাহে কোনোদিনও যোগ দিতে হবে না। আমার কিছু না কিছু খুচরো পয়সা রোজ জুটে যায়, তাই-ই যথেষ্ট।

এমন চমৎকার, মোহময় একটা দিনে যারা চাকরি করছে করুক, আমি খিচুড়ি-ইলিশ মাছ দিয়ে আত্মাকে পরম সন্তুষ্ট করে, বিছানায় শুয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে গিয়েছিলাম ঘুমের দেশে।

আধ ঘণ্টাও ঘুমোইনি, এর মধ্যে মূর্তিমান উপদ্রবের মতন চন্দনদার আবির্ভাব। হাঁটু দিয়ে আমার পিঠে একটা গোঁত্তা মেরে জলদ-গম্ভীর স্বরে ধমক দিয়ে বলল, এই নীলু, ওঠ! ওঠ!

আমি চোখ মেলে প্রথমে চন্দনদাকে চিনতেই পারলাম না। এমনিতেই তার বেশ বড়সড় চেহারা, তার ওপরে আবার একটা খয়েরি রেইন কোট পরে আছে, মনে হয় যেন একটা দৈত্য।

আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে? কে?

চন্দনদা বলল, দুপুবেলা ষাঁড়ের মতন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিস, তোর লজ্জা করে না? পুরুষমানুষ কখনো দুপুরে ঘুমোয়?

দিবানিদ্রার ব্যাপারে নারী জাতিরই কেন একচেটিয়া অধিকার থাকবে, তা আমার বোধগম্য হলো না। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথায় অনেক কিছু ঢোকেও না। চন্দনদার গলার আওয়াজ ও ভাষা চিনতে পেরে আমি বললাম, খিচুড়ি খাবে? এখনো আছে অনেকটা।

চন্দনদা একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, কী আবোল তাবোল বকছিস! আমি হঠাৎ এই অসময়ে খিচুড়ি খেতে যাব কেন?

দু’ হাতে চোখ কচলে বাস্তব জগতে ফিরে এলাম।

চন্দনদাকে বেশ কয়েক মাস বাদে দেখলাম, ওঁদের বাড়িতেও আমি যাইনি অনেকদিন। এর আগে দু’-একটা ঘটনার জন্য চন্দনদা আমার ওপর খানিকটা বিরূপ হয়েছিল। একবার মারবেও বলেছিল। কিন্তু সেসব তো চুকেবকে গেছে। এর মধ্যে আমি তো আর কোনো গণ্ডগোল করিনি, ওদের পারিবারিক ব্যাপারেও নাক গলাইনি, তা হলে হঠাৎ এই বৃষ্টির দিনের প্রাক-বিকেলে চন্দনদা আমাকে হাঁটুর গোঁত্তা লাগাতে এল কেন? অজান্তে কিছু দোষ করে ফেলেছি নাকি?

চন্দনদা গাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, ছি ছি ছি, কোনো কম্ম নেই, দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস। যুবশক্তির কি অপচয়! এই জন্যই তো দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে। আর কিছু কাজ না থাকে তো রাস্তার গাছগুলোতে জল দিলেও তো পারি তাতে শরহটা সবুজ হবে!

এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার গাছে পাগল ছাড়া কেউ জল দিতে যায়? গাছের বা কি ভাববে। চন্দনদাকে এ কথা বলে লাভ নেই, যা মেজাজ দেখছি, আব বকুনি খেতে হবে।

ভেতরের পকেট থেকে চন্দনদা একটা চুরুট বার করে ঠোটে গুঁজল, তারপ তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমি বললাম, দেশলাই দেব?

চোখ কটমট করে চন্দনদা বলল, আমার দেশলাই লাগে? উজবুক! জানি না?

হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর ধরে চন্দনদা ধূমপান ত্যাগ কর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সিগারেট বর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু মুখে একটা চুরুট : রাখলে চলে না। সন্ধের সময় সেটা ধরায়। প্রতিদিন একটা চুরুট খাওয়া চাই

এবার রেইন কোটের পকেট থেকে বার করল একটা চৌকো প্যাকেট। দেে মনে হয় মিষ্টির বাক্স। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নে, ছোট পাহা থেকে তোদের জন্য সন্দেশ এনেছি।

এ আবার কী ব্যাপার! প্রথমে হাঁটুর গুঁতো, তারপর সন্দেশ? একেই বে হট অ্যাণ্ড কোল্ড ট্রিটমেন্ট। চন্দনদার সব কিছুই অদ্ভুত।

প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিলাম, চন্দনদা বলল, খুলে দেখা না? খা একটা! এরকম সন্দেশ কলকাতায় পাবি না!

—পরে খাব, চন্দনদা।

–না, এখনই খা। এত দূর থেকে আনলাম!

মুখে যার টাটকা ইলিশ মাছ ভাজার স্বাদ লেগে আছে, তাকে মিষ্টি খেে বলা অত্যাচারের মতন নয়?

প্যাকেটের বাঁধন খুলে দেখা গেল তার মধ্যে চকোলেট রঙের দশ-বারোাঁ ছোট ছোট সন্দেশ রয়েছে। একটা তুলে মুখে দিতেই হলো। পোড়া পোড়া ক্ষিরে স্বাদ। মন্দ না। আমি সন্দেশ-রসিক নই, তবু মনে হলো, এটা অন্য ধরনের

বললাম, চমৎকার! ছোটপাহাড়ীতে এত ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়।

—তোর জন্য দু’রকম সন্দেশ এনেছি, নীলু!

—রক্ষে করো, চন্দনদা, আমি আর খেতে পারব না। একটাই যথেষ্ট।

—তোকে দুটো সন্দেশ খেতে বলিনি, ইডিয়েট। বললাম না, দু’রকম। এক হচ্ছে এই সন্দেশ মানে মিষ্টি। আর একটা সন্দেশ হচ্ছে খবর। খুবই সুখবর তুই একটা চাকরি পেয়েছিস।

—অ্যাঁ?

—কথাটা কানে গেল না তোর? তুই একটা চাকরি পেয়েছিস! চাকরি, চাকরি!

—চাকরি?

অমন ভেটকি মাছের মতন তাকিয়ে রইলি কেন? অন্য যে-কোনো ছেলে এই খবর শুনে লাফিয়ে উঠত!

—আমার এমন ক্ষতি করতে কে বলল তোমাকে, চন্দনদা?

—ক্ষতি? প্রিপস্টারাস! এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি! দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার, কেউ কোনো চান্স পায় না, আর তোকে একটা প্লেটে করে সাজিয়ে…

—আমি তো বেকার নই। আমি কি অ্যাপ্লিকেশন করেছি কোথাও? যে চাকরি চায় অথচ পায় না, সে তো বেকার। আর যে চাকরি খোঁজেই না, চাকরির যার দরকার নেই, তাকে কি বেকার বলা যায়?

—তুই বেকার নোস?

—ডিক্‌শিনারি দ্যাখো।

—আমার সঙ্গে চ্যাংড়ামি হচ্ছে, নীলু! ওঠ, জামা পর!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যারা ভালো ভালো চাকরি করে, কিংবা ব্যবসায়ে সার্থক, যারা কর্মবীর, তাদের কিছুতেই বোঝানো যায় না আমার যুক্তিটা। সবাইকেই কি চাকরি করতে হবে, কোনো না কোনো কাজের জোয়াল ঘাড়ে নিতে হবে? তা হলে কদমতলায় বসে বাঁশি বাজাবে কে? কে ছবি আঁকবে? যাত্রাদলে নতুন ছেলে আসবে কী করে? এসবও যারা পারে না, স্রেফ বাউণ্ডুলেপনা করার জন্যও তো কিছু মানুষ দরকার। যে-জাতের মধ্যে বাউণ্ডুলে কিংবা ভবঘুরে নেই, সে জাতের কখনো উন্নতি হতে পারে?

আমি হাত জোড় করে বললাম, আমায় ছেড়ে দাও, চন্দনদা। আমার এমন সর্বনাশ করো না।

চন্দনদা চোখ কপালে তুলে বলল, সর্বনাশ? দু’ হাজার সাতশো টাকা মাইনে পাবি।

—চুপ, চুপ, আস্তে। অত টাকার কথা মা শুনতে পেলে কান্নাকাটি করবে।

—মাসিমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। দাদার ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস। তোর লজ্জা করে না? সবাই বলে, চেনাশুনো সকলেরই মোটামুটি হিল্লে হয়ে গেল, শুধু নীলুটাই গাছ—দামড়া হয়ে রইল। লাফাংগার মতন ঘুরে বেড়ায়, হ্যাংলার মতন লোকের বাড়িতে ঠিক খাওয়ার সময় গিয়ে হাজির হয়—

—বাজে কথা। নেমন্তন্ন না করলে আমি কারুর বাড়িতে যাই না। এমনকি নেমন্তন্ন করলেও সব বাড়িতে যাই না।

—তুই একদিন ভরপেট খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও লালুদার সঙ্গে টলি ক্লাবে গিয়ে গোগ্রাসে গিলিসনি?

—সেটা অন্য কথা। লালুদা আমাকে জোর করে খাইয়েছে। লালুদা আমাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে চাইছিল।

—লালুদাই বলেছে, দরকার হলে তোকে ঘাড় ধরে চাকরির জায়গায় নিতে হবে।

—আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে না?

—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি এবার মুচকি হাসলুম। চন্দনদা গোঁয়ার লোক, কাকুতি মিনতি করে ছাড়া পাওয়া যাবে না। ইন্টারভিউতে ফেল করা অতি সহজ। এমনি যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাই…এর আগেও কেউ কেউ আমাকে দু’-এক জায়গায় জোর করে কাজে ঢুকিয়েছে, সিঙ্গাপুর থেকে আমার এক মামা এসে তো উঠে পড়ে লেগেছিল…সব কটা চাকরি থেকেই আমি অবিলম্বে সগৌরবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। চাকরির মালিকদের আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, আমিই একমাত্র, যে বরখাস্ত হলেও আন্দোলন করে না। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসে।

না-ধরানো চুরুটটা দু’বার টেনে চন্দনদা গলা নরম করে বলল, আচ্ছা নীলু, তুই কেন কাজ করতে চাস না বল্ তো? তোর ইচ্ছে করে না, নিজে রোজগার করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি, লোকজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকবি।

-মাথা উঁচু করেই তো আছি। তুমিই বলো, কার মাথা বেশি উঁচু, যে দান করে, না যে দান প্রত্যাখ্যান করে? এ দেশে কত ভালো ভালো ছেলেমেয়ে রয়েছে, পড়াশুনা শেষ করেও কোনো সুযোগ পায় না, তোমাদের মতন লোকেরা ভাবো, আহা বেচারারা… যুবশক্তির অপচয়…তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে ডেকে, তোমরা ছিটে ফোঁটা দায় বিলোও! যে-কোনো একটা চাকরি দিয়েই ভাবো তাদের ধন্য করে দিলে! আমি সেই সব ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে এক জ্বলন্ত প্ৰতিবাদ। আমি দয়া চাই না! আমি দয়া চাই না। সারা জীবন আমি এই ধ্বজা উড়িয়ে যাব!

—তোমাকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না, শয়তান। শুধু বাজে কথার ফুলঝুরি। আমরা সবাই খেটে খেটে মরব, আর তুই শুধু মজা করবি—ইয়ার্কি! কালকেই তোকে ছোটপাহড়ীতে যেতে হবে!

—ছোটপাহাড়ীতে কেন?

–সেখানেই তো তোর কাজের ব্যবস্থা হয়েছে!

সঙ্গে-সঙ্গে সব কিছু বদলে গেল। অন্ধকার বাড়িতে পটাপট আলো জ্বলে ওঠার মতন খুশির ধাক্কা লাগল আমার সব কটা ইন্দ্রিয়তে। ছোটপাহাড়ী! সে যে অপূর্ব সুন্দর এক স্থান। সব দিকে গোল হয়ে ঘিরে আছে সবুজ মখমলে ঢাকা পাহাড়। মাঝখানটাতেও এত গাছপালা যে তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাড়ি—ঘর থাকলেও চোখে পড়ে না। মনে হয় এক সবুজের রাজ্য। দিনে দু’বার বাস যায়, তা ছাড়া তেল-কালি-ধোঁয়ার কোনো উপদ্রব নেই। ছোটপাহাড়ীতে একটা সরু পায়ে-চলা রাস্তার ধারে আমি যত বনতুলসীর ঝাড় দেখেছি, সে রকম বুঝি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিনা যত্নে, বিনা প্রয়োজনে এত অসংখ্য ফুল ফুটে আছে, এক একটা ছোট ছোট ফুলের কতরকম রং! সেই সব ফুলের একটা স্নিগ্ধ টান আছে। ওই বনতুলসীর ঝাড়ের কাছে আবার যাবার জন্য আমি যে কোনো মূল্য দিতে রাজি আছি।

—ছোটপাহাড়ীতে কী কাজ, চন্দনদা?

–সেসব পরে বুঝিয়ে দেব। মোট কথা, তোকে যেতেই হবে।

—যেতেই হবে, কী বলছ? ছোটপাহাড়ীতে নিয়ে গিয়ে যদি তুমি আমাকে তোমার কোয়ার্টার ঝাঁট দিতে বলো, তোমার জন্য রান্না করে দিতে বলো, তোমার জুতো পালিশ করে দিতে বলো, সব রাজি আছি।

চন্দনদা এবার হকচকিয়ে গেল, আমার আকস্মিক মতি-পরিবর্তনের কারণটা ধরতে পারল না। বুঝবে কী করে, চন্দনদা সেই বনতুলসীর জঙ্গলের দিকে বোধহয় কোনোদিন চেয়েও দেখেনি।

আমি তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে বললাম, তুমি চা খাবে? এক্ষুনি চা আনছি। আর কী খাবে বলো, গরম গরম কচুরি? ডাল ডিমের ওমলেট?

চন্দনদা বলল, এখন কিছু খাব না। বৃষ্টি অনেকটা কমেছে, চল তোকে বেরোতে হবে।

তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি চাপিয়ে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার সঞ্চয় সাত টাকা আশি পয়সা পকেটে নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। চন্দনদা কোম্পানির গাড়িতে এসেছে। চন্দনদাদের হেড অফিস কলকাতায়, মাঝে মাঝে চন্দনদাকে ছোটপাহাড়ীতে গিয়েও থাকতে হয়।

খাকি পোশাক ও মাথায় টুপি পরা ড্রাইভার তাড়াতাড়ি চন্দনদাকে দেখে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি যখন চাকরি করব, তখন কি আমাকেও…। দু’ হাজার সাতশো টাকা মাইনেতে কি গাড়ি দেয়?

চন্দনদার বাড়ির সামনে একটা লাল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ লালুদা এসেছে, নীপা বউদির বয় ফ্রেন্ড। আজকাল চন্দনদাও লালুদাকে সহ্য করে নিয়েছে। লালুদার অবাধ যাওয়া-আসা আটকাবার কোনো উপায় নেই!

লালুদা ছাড়াও রয়েছে তপনদা। তপনদা কলকাতার বাড়িওয়ালাদের ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে পাকাপাকি বম্বে চলে গিয়েছিল, কোনো কাজে আবার এসেছে বোধহয়। তিনজনে ভি সি আর-এ একটা ছবি দেখছিল নিবিষ্টভাবে, চন্দনদা ঘরে ঢুকেই বলল, এখন ওসব বন্ধ করো।

লালুদা বলল, আর একটু দেখে নি, মেয়েটার ডেড বডি খুঁজে পাওয়া গেল কি না—

চন্দনদা বলল, এই জন্যই আমি বসবার ঘরে টি ভি রাখা পছন্দ করি না। ইচ্ছে মতন কথা বলার উপায় নেই।

নীপা বউদি ভি সি আর অফ করে দিয়ে হাসিমুখে বলল, তুমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসো না বলে কি আর কেউ দেখতে পারবে না?

চন্দনদা বলল, রান্নাঘরে টি ভি লাগাও, ভি সি আর লাগাও, যত ইচ্ছে দেখো! দেয়ালে গোপাল ঘোষের আঁকা একটা প্রকৃতি-দৃশ্যের ছবি। চন্দনদা ছবি ভালোবাসে, প্রায়ই এ বাড়ির দেয়ালের ছবি বদলে যায়। ছবিটার কাছে গিয়ে চন্দনদা বলল, এঃ, ছবিটা বেঁকে রয়েছে। সেটুকুও তোমরা লক্ষ করো না?

নীপা বউদি বলল, জানলার পাশে কেউ ছবি রাখে? এ দিকের দেয়ালটা আবার তোমার পছন্দ নয়।

নীপা বউদি আর চন্দনদার ঝগড়া বিখ্যাত। যে-কোনো ছুতোয় একবার শুরু হলে কখন যে থামবে তার ঠিক নেই। ওরা অবশ্য বলে, এটা ঝগড়া নয়, মতভেদ, তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সেই তর্ক-বিতর্কে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

তপনদা আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে বলল, কী রে নীলু, ধরা পড়ে গেলি শেষ পর্যন্ত?

এ বাড়িতে মুমু আমার একমাত্র বন্ধু। তার সাড়া-শব্দ নেই। আমি নীপা বউদিকে জিজ্ঞেস করলুম, মুমু কোথায়?

নীপা বউদি বলল, সাঁতারের ক্লাসে গেছে। আজকাল খুব সাঁতারের ঝোঁক হয়েছে।

আমি চমৎকৃত হলুম। গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস এসব শুনেছি। সাঁতারেরও ক্লাস? তাও এরকম বৃষ্টির দিনে। কোনো ঘরের মধ্যে হয় বোধহয়। লালুদা আমার দিকে তাকিয়ে কান-এঁটো-করা হাসি দিয়ে বলল, আমরা সবাই তোমার জন্য খুব চিন্তিত ছিলাম, নীলাদ্রি। আমাদের চেনাশুনো সকলেই কোনো না কোনো কাজ করে, তুমিই বেকার বসেছিলে। চন্দন তোমার জন্য একটা কাজ জোগাড় করে এনেছে, এটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু—

লালুদা একটু থামতেই চন্দনদা ধমক দিয়ে বলল, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী আছে?

লালুদা আমার দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল, নীলকান্তর এত বড় বড় চুল মাথায়, এইভাবে কি চাকরিতে জয়েন করা চলে?

নীপা বউদি বলল, সত্যি, তুমি ক’মাস চুল কাটোনি!

লালুদা বলল, আহা বেকার ছেলে, পয়সা পাবে কোথায়? সেলুনে নিয়ে গিয়ে ওর চুল কাটিয়ে আনছি!

চন্দনদা বলল, কোনো দরকার নেই। বড় চুল আছে তো কি হয়েছে। লালুদা বলল, বড় চুল থাকলে ক্ষতি নেই বলছ? থাক তবে। কিন্তু–

—আবার কিন্তু?

—আমি যতদিন দেখছি, নীলমণি শুধু পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে থাকে। ওর কি প্যান্ট-শার্ট আছে?

তপনদা মুচকি হেসে বলল, ভারতীয় সংবিধানে কোথাও লেখা আছে কি যে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চাকরি করা যাবে না?

লালুদা বলল, সব কিছুর একটা ডেকোরাম আছে তো! বাড়িতে পাজামা পরা যায়, বেকার অবস্থায় বাইরে ঘোরাঘুরিও করলে ক্ষতি নেই, রাস্তায় ঘাটে পাঞ্জাবি পাজামা পরা ছেলে-ছোকরা দেখলেই বুঝতে পারি বেকার। কিন্তু চাকরির জায়গায় ফিটফাট হয়ে না গেলে লোকে মানবে কেন?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ, প্যান্ট-শার্ট হলে ভালো হয়। কী রে, তোর প্যান্ট শার্ট নেই? লালুদা তাড়াতাড়ি বলল, আমি কিনে দেব। এক জোড়া করে প্যান্ট-শার্ট, শু-মোজা-টাই…এখনো নিউ মার্কেট খোলা আছে, চলো, নীলরতন।

আমাকে নিয়ে একটা গিনিপিগের মতন যেন কাটাছেঁড়া চলছে। এবার মুখ খুলতেই হলো। ভুরু তুলে বললুম, টাই-ও পরতে হবে? দু’ হাজার সাত শো টাকা মাইনে তো আজকাল ব্যাঙ্কের বেয়ারা-দারোয়ানরাও পায়। তাই না নীপা বউদি? তারা কি টাই পরে?

চন্দনদা বলল, ওরে বাবা! এই যে সবাই বলে নীলু নাকি চাকরি করাটাই পছন্দ করে না। এখন দেখছি মাইনে নিয়ে দরাদরি শুরু করেছে!

আমি বললুম, দরাদরি না। ওই যে লালুদা বলল, ডেকোরামের কথা! সব অফিসেই দেখেছি বড়-সাহেব, মেজো-সাহেবরা টাই পরে। যদি খুদে কেরানি আর বেয়ারারাও টাই পরতে শুরু করে, তা হলে ওই সব সাহেবরা চটে যাবে না?

চন্দনদা বলল, টাই দরকার নেই। প্যান্ট-শার্ট হলেই চলবে!

লালুদা বলল, তা হলে চলো, নীলকণ্ঠ, ওগুলো কিনে ফেলা যাক। আমি বললুম, প্যান্ট-শার্ট আমার আছে।

—জুতো-মোজা?

—চটি আছে।

–না, না, ট্রাউজার্সের সঙ্গে চটি একেবারেই চলবে না। শু, ভালো শু।

-সমস্ত পৃথিবীটা আপনার টলি ক্লাব নয় লালুদা, যে প্যান্টের সঙ্গে শু পরতেই হবে। তা ছাড়া, আপনি আমার নামটাই মনে রাখতে পারেন না, আপনি আমার জামা-কাপড় কিনে দেবেন কোন্ অধিকারে?

–তোমার নাম মনে রাখতে পারি না? তোমার নাম ওই যে কী বলে, কী বলে, নীলধ্বজ নয়।

নীপাবউদি বলল, ওর নাম নীললোহিত। শুধু নীলু বলেই তো ডাকতে পারেন।

লালুদা বলল, বড্ডো খটোমটো নাম! নীললোহিত! এ নামের মানে কী। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, লালু মানে কী?

এই সময় দরজা ঠেলে একটা ঝড়ের মতন ঢুকল মুমু। এক হাতে দোলাচ্ছে একটা এয়ার লাইনসের ব্যাগ, অন্য হাতে আইসক্রিমের কোন্। মাত্র কয়েকমাস দেখিনি, তার মধ্যেও যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে মুমু। ওর যে মাত্র তেরো বছর বয়েস, তা মনেই হয় না। একটা আগুন রঙের ফ্রক পরা, মাথার চুল ভিজে হিলবিলে হয়ে আছে।

অন্য কারুর দিকে নজর না দিয়ে সোজা চলে এল আমার কাছে। চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, অ্যাতোদিন আসোনি কেন? কোথায় ডুব মেরেছিলে?

আমি বললুম, জনতার মধ্যে নির্বাসনে!

মুমু বলল, তার মানে?

আমি বললুম, ইস্কুলে বাংলার মিসকে জিজ্ঞেস করে মানেটা জেনে নিও!

মুমু খপ করে আমার কান ধরে মুলে দিয়ে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে! পাজি। আনরিলায়েল লায়ার!

নীপা বউদি হা-হা করে বলে উঠল, ও কি হচ্ছে মুমু! নীলু তোর চেয়ে কত বড়, তোর কাকা হয়, আর কান ধরছিস্ যে।

মুমু বলল, তুমি জানো না মা, আমাকে ও লিটল প্রিন্স-এর গল্পটা আর্ধেক বলে তারপর বলল, তোকে বইটা দিয়ে যাব, নিজে পড়িস, কালকেই দিয়ে যাব। তারপর থেকে হাওয়া! আর এদিকে আসার নাম নেই। মিথ্যুক একটা!

লালুদা বলল, আহা, বেকার ছেলে, বই কেনার পয়সা কোথায় পাবে! কী বই; নামটা লিখে দিস, আমি এনে দেব।

চন্দনদা মুমুকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, জানিস মুমু, তোর নীলুকাকা এবার খুব জব্দ হবে। ওকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। প্রথম চাকরি পাওয়ার কথাটা শুনে এমন ভাব করল, যেন ওকে হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও।

আমি মুমুর দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বললু, মুমু, আমি ছোটাপাহাড়ী যাচ্ছি। সেই ছোটপাহাড়ী, তোর মনে আছে?

মুমু খিলখিল করে হেসে উঠল।

আজ তপনদা বিশেষ কোনো কথা বলেনি। মুড নেই। অন্য সময় তপনদা কথা শুরু করলে অন্য কেউ পাত্তা পায় না। আজ মৃদু মৃদু হেসে সব শুনে যাচ্ছে।

এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় দুটো চাঁটি মেরে গেয়ে উঠল, জয় যাত্ৰায় যাও গো…এক মাসের বেশি টিকে থেকো গো…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *