প্রকৃত মুসলমান

প্রকৃত মুসলমান

অনেক দিন আগের কথা। তখন বাদশাহী আমল। এক গ্রামে আতহার নামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক ছিল। সে ছিল খুব সৎ, ধার্মিক ও মিতব্যায়ী। তার স্ত্রী মায়মুনা ধনী কৃষকের মেয়ে। তাই মধ্যবিত্ত বাড়ির বৌ হয়ে এসে সুখী হতে পারল না। কারণ স্বামীর কাছে কোনো সখ সাধের জিনিস চাইলে পেত না। তবে একটা দিক দিয়ে সে খুব সুখী। বাপ- চাচাদের মা-চাচিদেরকে বকাবকি করতে দেখছে। এমনকি মারধরও করতে দেখেছে। কিন্তু তার স্বামী কোনো দিন তাকে বকাবকি বা মারধর করে নি। শুধু নরম মেজাজে উপদেশ দিয়েছে। তাদের সংসার স্বচ্ছল নয়। যতদিন কোনো ছেলে-মেয়ে হয় নি, ততদিন সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকলেও অভাব ছিল না। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে হওয়ার পর সংসারের খরচ বেড়ে যেতে আতহার আরো হিসাব করে সংসার চালায়। বিয়ের কিছু দিন পর মায়মুনা স্বামীর কাছে যখন কিছু জিনিস আবদার করত তখন আতহার বলত, এখন আমাদের সখ-সাধের জন্য অযথা টাকা পয়সা খরচ করা উচিত নয়। যতটা সম্ভব কম খরচ করে ভবিষ্যতের জন্য জমান উচিত। যখন হেলেমেয় হবে তখন তাদেরকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে হবে।

অনেক সময় যখন মায়মুনা রেগে গিয়ে বলত, যে লোক বৌ-এর সখ-সাধ না মিটিয়ে টাকা জমায়, সে কৃপন। তুমিও একজন কৃপন। তাই টাকা খরচ না করে জমাও। তখন আতহার কিছু বলত না, শুধু মিটি মিটি হাসত। তাই দেখে মায়মুনা আরো রেগে গিয়ে বলত, তোমার কি পিত্তি বলতে কিছু নেই? তুমি একজন নিমু। রোদে মানুষ। একথা বলার পরও স্বামীকে একই ভাবে হাসতে দেখে রাগে গর গর করতে করতে তার কাছ থেকে চলে যেত। অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যে স্বামীর বদান্যতা ও ভালবাসার কাছে মায়মুনাকে নতি স্বীকার করতে হয়। এখন সে স্বামীকে পীরের থেকে বেশি সম্মান করে, ভালবাসে।

ঐ গ্রামে আরিফ নামে আর একজন সৎ ও ধার্মিক কৃষক ছিল। সে কোনো বিশেষ কারণে দশ কাঠা জমি বিক্রি করবে। জমিটা ছিল আতহারের জমির পাশে। তাই একদিন আরিফ জমি বিক্রির কথা আতহারকে জানাল।

আতহার বলল, তুমি জমি বিক্রি করো না। আমার কাছে কিছু টাকা আছে, সেই টাকা তোমাকে কর্জে হাসানা দেব।

আরিফ বলল, আমার অনেক টাকার দরকার। আমি তোমার অবস্থার কথা জানি। তাই টাকা কর্জে হাসানা নেব না। তা ছাড়া জমি বিক্রি করার আমি নিয়ত করেছি।

আতহার বলল, ঠিক আছে। সেটা তোমার ইচ্ছা। মুসলমান ভাই হিসাবে যা করা উচিত তাই করতে চেয়েছিলাম। এখন তুমি যদি জমি বেঁচার নিয়ত করে থাক, তা হলে ইনশাআল্লাহ নেয়ার চেষ্টা করব।

আরিফ বলল, জমিটা তোমার জমির পাশে বলে তোমার হক বেশি। তাই তোমার কাছে প্রথম এলাম।

তারপর একদিন দরদাম ঠিক করে আতহার আরিফের জমিটা কিনে নিল। যে দিন জমি রেজিস্ট্রি হল, সেদিন ঘরে এসে আতহার স্ত্রীকে কথাটা জানিয়ে বলল, আমি খুব হিসাব করে সংসার চালাই বলে আগে তুমি আমাকে কৃপন ভাবতে; কিন্তু আজ আল্লাহ আমাকে জমি কেনার তওফিক দিলেন। যদি হিসাব করে সংসার না চালাতাম, তা হলে কি জমি কেনা সম্ভব হত?

মায়মুনা লজ্জিত কণ্ঠে বলল, তখন জ্ঞান না হওয়ার কারণে তোমাকে কৃপন বলতাম। জ্ঞান হওয়ার পর আর বলতে শুনেছ? আর সে জন্য তোমার কাছে মাফও চেয়ে নিয়েছি।

কয়েক দিন পর আতহার কেনা জমিতে চাষ করার জন্য মাটি কোপাচ্ছিল। হঠাৎ কোদালে শক্ত কিছু লাগতে চারপাশের মাটি সরিয়ে একটা পিতলের কলস দেখতে পেল। তারপর সেটা তোলার সময় খুব ভারী লাগল। উপরে এনে কলসের মুখের মাটি সরিয়ে আলগা ঢাকনাটা খুলতে চকচকে সোনার মহর দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল, এটা নিয়ে এখন কি করবে? তখন শয়তান তার মনে ওয়াসওয়াসা দিল, এটা তোর ভাগ্যে ছিল, তাই আরিফ এতদিন জমির মালিক থাকলেও সে পায় নি। এখন এটা নিয়ে ঘরে যা। তুই খুব ধনী হয়ে যাবি।

কথাটা মনে হতে আতহার আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি ঢাকনা চাপা দিয়ে কলসটাকে গামছায় জড়িয়ে আরিফের ঘরে গেল।

আরিফ ঘরের কাছের একটা জমিতে কামলাদের নিয়ে কাজ করছিল। তাকে মাথায় করে গামছা জড়ান কিছু নিয়ে আসতে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, কি ব্যাপার আতহার? মাথায় ওটা কি?

আহতার বলল, এখানে বলা যাবে না, বৈঠকখানায় চল। বৈঠকখানায় এসে আতহার মাথা থেকে কলসটা নামিয়ে গামছা খুলে নিয়ে বলল, তোমার যে জমিটা কিনেছি, সেখানে মাটি কোপাবার সময় এটা পেয়ে ভাবলাম, তুমি বা তোমার পূর্ব পুরুষরা কেউ এটা ওখানে পুঁতে রেখেছিল। তাই দিতে এলাম।

আরিফ বলল, তাই বলে গামছায় জড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে এলে কেন? তারপর জিজ্ঞেস করল, এতে কি আছে দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি। কলস ভর্তি সোনার মহর বলে আতহার ঢাকনাটা খুলে ফেলল।

আরিফ সোনার মহর দেখে অবাক হয়ে আতহারের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিন্তা করতে লাগল, যে লোক এক কলস সোনার মহরের লোভ সামলাতে পারে, সে নিশ্চয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা।

তাকে ঐভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আতহার বলল, কি ভাবছ? অন্য কেউ দেখে ফেলার আগেই ঘরে রেখে এস।

আরিফও আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাই বলল, আমি এটা জমিতে পুঁতে রাখি নি। আর আমার পূর্ব পুরুষদের কেউ রেখেছিল কিনা তাও জানি না। তা ছাড়া আল্লাহ যদি আমার ভাগ্যে এটা রাখত, তা হলে এত বছর জমি চাষ করার সময় পেতাম। পাইনি যখন এটা আমার নয়, তোমার।

আতহার বলল, এটা আমার হবে কি করে? আমি তোমার জমি কিনেছি, এই কলসটাতো কিনি নি। তুমি এটা পুঁতে না রাখলেও তোমার পূর্ব পুরুষদের কেউ হয়তো পুঁতে রেখেছিল। তাই এটা তোমারই প্ৰাপ্য।

আরিফ বলল, জমি যখন বেঁচেছি তখন ঐ জমির উপরে ও নিচে যাই থাকুক না কেন সব তোমার। আর আমার পূর্ব পুরুষরা যদি না রেখে অন্য কেউ রেখে থাকে, তা হলে তা আমার জন্য হালাল হবে না।

তারপরও স্বর্ণমুদ্রা কলসের মালিকানা নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হল। শেষে তারা কলসটা নিয়ে কাজীর কাছে গিয়ে সব কিছু জানিয়ে কে এটার প্রকৃত মালিক ফায়সালা করে দিতে বলল।

কাজী সাহেবও ছিলেন খুব আল্লাহ ভীরু। তিনি ঘটনাটা শুনে ভাবলেন, এরা দু’জনেই তার থেকে বেশি আল্লাহ ভীরু। তারপর চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে এটার ফায়সালা করবেন। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে বললেন, এখনই এটার কোনো ফায়সালা করা যাচ্ছে না। তোমরা কাল সকালে এস। আমি রাতে চিন্তা করে দেখব, এটার প্রকৃত মালিক কে হতে পারে?

পরের দিন সকালে আতহার ও আরিফ গিয়ে হাজির হল কাজীর বাড়িতে।

সালাম বিনি য়র পর কাজী সাহেব বললেন, তোমাদের কার কি ছেলেমেয়ে আছে বল।

প্রথমে আতহার বলল, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটা বড়।

কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ে কি বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে? আতহার বলল, জি, হয়েছে। তার বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজছি। এবার কাজী সাহেব আরিফকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ক’ছেলে ক’মেয়ে?

আরিফ বলল, আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেটা বড়।

কাজী সাহেব তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে কি বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে?

আরিফ বলল, জি, হয়েছে। আমিও তার বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্রী খুঁজছি।

কাজী সাহেব মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তোমরা একে অপরের ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিয়ে দাও, আর এই কলসের স্বর্ণমুদ্রাগুলো দু’জনেই ছেলেমেয়ের বিয়েতে খরচ কর।

কাজীর ফায়সালা শুনে আতহার ও আরিফ দু’জনেই খুশি হল। আতহার বলল, আপনি খুব খাঁটি ফায়সালা করেছেন। আমি এতে রাজি।

তার কথা শেষ হতে আরিফও ঐ একই কথা বলে বলল, আমিও এ বিয়েতে রাজি।

তারপর তারা ঘরে ফিরে খুব ধুমধামের সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিল আর সেই এক কলস স্বর্ণমুদ্রা দু’জনেই ঐ বিয়েতে খরচ করল।

ইচ্ছা করলে, আতহার অথবা আরিফ প্রত্যেকেই কলস ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা নিজেই ভোগ করতে পারত। আর কাজী সাহেবও সরকারী তহবীলে জমা দেয়ার কথা বলে, নিজেই ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহকে ভয় করত। তাই তা করেনি। তাই যারা আল্লাহকে ভয় করে সৎভাবে জীবন যাপন করে, তারাই প্রকৃত মুসলমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *